প্রণয়ের বাঁধন পর্ব-৩৯

0
120

#প্রণয়ের_বাঁধন |৩৯|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

সময় গড়িয়ে গেছে, বদলেছে অনেক কিছু। পাঁচটি বছর কেটে গেছে যেন এক পলকে। মির্জা বাড়িতে এসেছে নতুন প্রাণের উচ্ছ্বাস। বাড়ির বড় ছেলে ইভানের একমাত্র পুত্র ‘তাফসির ইয়ান’ ক’দিন পরেই পাঁচ বছরে পা দিবে। তার গাম্ভীর্য আর ছোট ছোট কৌতুহলে ভরে থাকে বাড়ির আঙিনা। মির্জা বাড়ির রাগি দিব্য মির্জা সেও বাবা হয়েছে। বছর দুই আগে তার ঘর আলো করে এসেছে ফুটফুটে কন্যা ‘নুজহাত নাতাশা দ্যুতি’ সকলের নয়নের মণি। মিষ্টি হাসি আর দুষ্টুমিতে মন কেড়ে নেওয়া এক ছোট্ট পরী।

তনুজা তিন বছর আগেই গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে। সংসার, স্বামী আর বাচ্চাদের আগলে রাখাই যেন ওর একমাত্র দায়িত্ব। মেয়েটা এক আদর্শ গৃহিণী, ওর ভালোবাসা আর যত্নে মির্জা পরিবার পরিপূর্ণ। অন্যদিকে আফরিন নিতির শখ ছিলো জব করার। সেই শখ পূরণ করতেই বিসিএস দিয়ে কলেজের বাংলা বিভাগের লেকচারার। দিব্য নিজেদের অফিসেই বাবা-ভাইয়ের সাথে ব্যবসায় জয়েন করেছে।

সাঁঝ পেরিয়ে অনেকক্ষণ আগেই নেমেছে রাতের আঁধার। নিতি ত্রস্ত হাতে আলমারির তাকের কাপড় গুছিয়ে রাখছিল। হঠাৎ করেই সবুজ-সাদার মিশেলে কাগজের একটা প্যাকেট নিচে পড়ল। উবু হয়ে হাতে তুলে দেখতেই, ভেতর থেকে একটা ছবি বেরিয়ে আসে; পাঁচ বছর আগের সেই বসন্ত সন্ধ্যায় স্মৃতি ধরে রাখা ফ্রেম। ছবিটিতে দিব্যর হাত নিতির কোমর পেঁচিয়ে আছে। নিতির চোখেমুখে লজ্জার মিষ্টি ছোঁয়া। সময় যেন থমকে দাঁড়ায় মূহুর্তের জন্য। পুরোনো স্মৃতির সুরভি ছড়ায় নীরব রুমজুড়ে। নিতি নিষ্পলক চাউনিতে চেয়েছিলো ছবিটির দিকে। তন্মধ্যে ওড়নার আস্তিনে টান পড়তেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে; বরফখন্ডের মতো শুভ্ররঙা মুখ, তুলোর মতো তুলতুলে গাল, টানাটানা বড়বড় চোখ। ছোট্ট নাক আর লাল টুকটুকে ঠোঁট। কালো সিল্কি ঘনচুল ঘাড় ছুঁয়ে নিচে আছে। বলার অপেক্ষা রাখে না দেখতে খুবই সুন্দরী আর মিষ্টি। দিব্য-নিতির মেয়ে নাতাশা। নিতি মেয়ের চোখের দিকে চায়। নাতাশার মৃগ আঁখিজোড়ায় চকচক করছে কৌতুহল। কণ্ঠে সেই কৌতুহল রিনিঝিনি সুর তুলল,

-” মাম্মা… মাম্মা ওতা কী?”

নিতি স্মিত হেসে মেয়ের দিকে ঝুঁকে হাতের ছবিটা দেখিয়ে বলল,

-” এটা ছবি দ্যুতি সোনামণি। মাম্মা আর পাপার ছবি।”

নাতাশা দুইহাতে খাবলে ধরে ছবিটা। চোখের কালো মণি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। হঠাৎ আধো আধো বুলিতে প্রশ্ন করে উঠল,

-” আমি তই?”

নিতির কপালে ভাঁজ পড়ল। নির্বোধের মতোন ফ্যালফ্যাল করে তাকায় মেয়ের মুখপানে। নাতাশা কপালে দৃঢ় ভাঁজ ফেলে, ছোট্ট নাকটা কিঞ্চিৎ ফুলে উঠল। একটা আঙুল ছবির উপর রেখে বলল,

-” এতানে আমি তই?”

তড়িৎ একটা হাত নিতির কপালে চলে যায়। মেয়ের এহেন প্রশ্নে কী জবাব দেবে ভেবে পাচ্ছে না নিতি। দিব্য
সোফায় বসে ল্যাপটপ কোলের উপর তুলে অফিশিয়াল কাজ করছিলো। নিতি সেদিকে তাকিয়ে মেয়েকে বলল,

-” তুমি কই? এটা আমাকে জিজ্ঞেস না করে তোমার পাপাকে জিজ্ঞেস করো।”

নাতাশা একবার মায়ের দিকে তো আবার খানিকটা দূরত্বে থাকা বাবার দিকে তাকায়। নিতির কথার উত্তরে হালকা ঘাড় কাত করে সম্মতি জানায়। তারপর ছবিটা হাতে নিয়ে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিতি দুইহাত বুকে গুঁজে মিটমিট করে হেসে চেয়ে চেয়ে দেখে। দিব্যর আঙুল ল্যাপটপের কিবোর্ডে ব্যস্ত, দৃষ্টিজোড়া স্থির স্ক্রিনে। এমন সময় আদুরে কণ্ঠে ডাক আসে,

-” পাপা।”

ডাকটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই দিব্য মাথা তুলে সামনে তাকায়। মেয়েকে দেখেই ঠোঁটের কোণ চওড়া হয়। স্মিত হেসে বলল,

-” হ্যা প্রিন্সেস।”

নাতাশা এগিয়ে আসতেই দিব্য ল্যাপটপের শাটার নামিয়ে পাশে রেখে দেয়। তারপর ঝট করে মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। নাতাশা দিব্যর কোলে বসে ঘাড় তুলে তাকায়। ছবিটা সামনে মেলে ধরে প্রশ্ন করল,

-” পাপা…পাপা, এটা আমি তই?”

দিব্য ছবিটার দিকে একবার তাকায়, আবার মেয়ের দিকে। ছবিটা তো পাঁচ বছর আগের, আর নাতাশার বয়স মাত্র দুই। দিব্য একহাতে আলতো করে মেয়ের কপালের উপর ছড়িয়ে থাকা চুল সরিয়ে দিয়ে নরম স্বরে বলল,

-” নাতাশা সোনামণি, এটা অনেক পুরোনো ছবি।”

কথা শেষ হতে না হতেই নাতাশা মুখে অভিমান নিয়ে জেদি গলায় বলে ওঠে,

-” টুমি আর মাম্মা, আমি তই?”

দিব‌্যর কপাল কুঁচকে যায়। ওদিকে নিতি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ মজা পাচ্ছে। মেয়ে পুরাই বাবার কার্বন কপি। বাবার মতো রাগি আর জেদি। নিতি ঢের অনুমান করে নাতাশা এখন জিদ করে দিব্যকে জ্বা’লা’তন করবে। নিতি মনে মনে পৈ”শা”চিক আনন্দ অনুভব করতে থাকে। নাতাশা উত্তর না পেয়ে কণ্ঠে ভর দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,

-” আমি ত..ই?”

দিব্য বেকায়দায় পরে। মেয়ে যেমন রাগি, জেদি ঠিক তেমনি উদ্ভট কথাবার্তা বলে। দিব্যর কাছে মনেহয় এই বিষয়টা নিতির থেকে মেয়ে পেয়েছে। দিব্য নিঃশ্বাস ফেলে আদুরে গলায় বলল,

-” আম্মু আমার, তখন তুমি আমাদের কাছে ছিলে না। উমম! তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে।”

নাতাশার মুখ ফুলে ওঠে। ঠোঁট উল্টে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কান্না জুড়ে দেয়। ছোট ছোট দুই হাত দিয়ে চোখ ডলে ফুঁপিয়ে ওঠে,

-” টোমরা ইকা ইকা তবি টুললে ক্যানো? আমি নেই!”

দিব্য মেয়েকে থামানোর চেষ্টা করে। রাগের খনি মানুষটা এই ছোট্ট মেয়ের কাছে এক বিন্দুও রাগতে পারে না। মেয়ের কাছে কখনো বিরক্তিও প্রকাশ করে না। মেয়ের সব আহ্লাদ, আবদার নিমিষেই পূরণ করে দেয়। দিব্য আলতো হাতে নাতাশার চোখের পানি মুছে দেয়। একদম মোলায়েম স্বরে বলল,

-” প্রিন্সেস, একদম কান্না করবে না।”

কিন্তু মেয়ের অভিমান রাগ এত সহজে ভাঙে না। পেয়েছে বাবার স্বভাব, রাগ হলেই ভাঙচুর করা। নাতাশা অকস্মাৎ হাত বাড়িয়ে পাশে থাকা ল্যাপটপ ফ্লোরে ফেলে দেয়। শব্দ শুনে নিতি চমকে ওঠে, দ্রুত কয়েক কদম এগিয়ে আসে। দিব্য একটুও বিরক্তি প্রকাশ করে না, রাগেও না। মেয়ের মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে। চুলে হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বলল,

-” প্রিন্সেস! আমি কালকেই এই ছবিটাতে তোমাকে এনে দিবো। ঠিক আছে?”

নাতাশা তড়িৎ মাথা তুলে দিব্যর দিকে তাকায়। বড়বড় চোখে প্রশ্ন ঝুলিয়ে বলে,

-” তত্যি?”

দিব্য মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে মৃদু হেসে বলে,

-” সত্যি.. সত্যি সত্যি। নাও প্রমিজ করছি।”

খুশিতে নাতাশার চোখ চকচক করে ওঠে। এক লাফে নিচে নেমে উচ্ছ্বাসে নাচতে থাকে। নিতি ফ্লোর থেকে ল্যাপটপ তুলতে গিয়ে দিব্যর কথা শুনে হাত দু’টো থেমে যায়। নিতির দিকে তাকিয়ে দিব্য বলে,

-” নাতাশার এই উদ্ভট কথাবার্তার জ্বীন তোর থেকে পেয়েছে।”

নিতি ল্যাপটপ তুলে তড়াক সোজা হয়ে দাঁড়ায়। চোয়াল শক্ত করে বলল,

-” আর ওর অতিরিক্ত রাগ? জিদ? রেগে গেলে সবকিছু ভাঙচুর করার স্বভাবটা কার থেকে পেয়েছে?”

দিব্য নির্লিপ্তভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,

-” অদ্ভুত প্রশ্ন আর কথাবার্তার থেকে রাগ-জিদ বরং বেটার।”

নিতির হঠাৎ তীব্র অভিমান জমলো। অভিমানী কিশোরীর মতো হয়ে কণ্ঠে রিনিঝিনি সুর তুলে বলল,

-” আমাকে তো আর ভালো-টালো বাসো না। তাই তো আমার কিছুই তোমার পছন্দ নয়। এইযে আমার কোনো একটা গুণ মেয়েটা পেয়েছে সেটাও তোমার সহ্য হয় না। আফসোস খুব বেশিই আফসোস হয়। পাঁচ পাঁচটা বছর পার হয়ে গেলো। তবুও একটুও ভালোবাসা জন্মালো না তোমার মনে! সেই আগের মতোই কিছু বললেই অজগরের মতো ফোঁসফোঁস করো। কোনোদিন একবারও ভালোবাসো প্রকাশ অবধি করোনি।”

দিব্য ডান ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়। নির্লিপ্ত কণ্ঠে শুধোয়,

-” ভালোবাসা প্রকাশ না করলে বাচ্চা এলো কোত্থেকে? আমার মেয়ের মাম্মা হলি কীভাবে?”

নিতির চোখমুখ লজ্জা আর অস্বস্তিতে ছাপিয়ে যায়। তন্মধ্যে নাতাশা ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে নেলপলিশ এর কৌটা এনে দিব্যর সামনে ধরে বলল,

-” পাপা নাগিয়ে দাও।”

দিব্য বলল,

-” আমি?”

-” হ্যা টুমি।”

মেয়ে যখন একবার বলেছে তুমি, তারমানে তুমিই। জাপানের সুনামি বয়ে গেলেও এই তুমি থেকে অন্যকেউতে হবে না রাজি। দিব্য শেষমেষ মেয়ের নখে নেইলপলিশ দিতে থাকে। নেলপলিশ নেওয়া শেষে নাতাশা দিব্যর গালে টুপ করে চুমু খেয়ে বলে,

-” ত্যাংকিউ পাপা।”

দিব্য মেয়ের মুখে ছোট ছোট চুমুয় ভরিয়ে দিয়ে বলে,

-” ওয়েলকাম প্রিন্সেস।”

নাতাশা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে থাকে। দুই হাত সামনে ধরে নখগুলো দেখে নেয়। তারপর একাই ঠোঁটে লাল লিপস্টিক ঘষে নেয়। ঠোঁট ছাড়িয়ে উপরে নিচে লেগে যায়। তবুও এটাই বাচ্চা মেয়েটার কাছে খুব সুন্দর লাগছে। ফ্রকের দুইকোণা ধরে ঘুরে বলল,

-” পাপা, মাম্মা থুন্দর নাগছে?”

দিব্য থ্যাম্বলস অ্যাপ করে দেখায়। মুখে বলে,

-” প্রিটি লাগছে আমার মাম্মামকে।”

নাতাশা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠল। নিতি মেয়ের ঢং দেখে কপাল কুঁচকে নেয়। মেয়েটা খুব বেশিই আহ্লাদী আর ঢঙি হয়েছে। হঠাৎ নাতাশা বলল,

-” যাইই বয়ো মাম্মাকে দেকিয়ে আতি।”

নিতি বারণ করল ইয়ানকে পড়াচ্ছে হয়তো এখন। গিয়ে ডিস্টার্ব করবে। পেন্সিল, খাতা নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করবে। কিন্তু মেয়ে বারণ শুনলে তো? দিব্য নিতিকে বাধা দেয়। মেয়ে লাফাতে লাফাতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। নিতি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বিছানার উপর থাকা শাড়িটা আলমারিতে রাখতে রাখতে বলল,

-” বাড়ির সবাই তো আছেই, তারপর তোমার অতিরিক্ত আহ্লাদে, প্রশ্রয়ে মেয়েটা দিনদিন খুব বেশিই জেদি হচ্ছে। যা ভবিষ্যতে খুব খা’রা’প হবে।”

এমন সময় কোমরে শক্ত হাতের বাঁধন। ঘাড়ে উষ্ণ নিঃশ্বাস। দিব্য পিছন থেকে নিতিকে জড়িয়ে ঘাড়ে মুখ গুজে বলল,

-” আমার মেয়ে আমার মতো হয়েছে। ভবিষ্যতে রাগে-জিদে আমাকেও ছাপিয়ে যাবে। এতে তোর প্রবলেম কোথায়?”

নিতির চোখেমুখে বিরক্তির ছাঁট পড়ল। ত্যাড়া করে বলল,

-” আমার আবার কীসের প্রবলেম! মেয়ে তো শুধু তোমার একার! আমি তো মেয়ের মা নই যে আমার অসুবিধে হবে। আমি হলাম মেয়ের মাসি। তাই না?”

নিতির বিরক্তি‌ সাথে অল্প স্বল্প অভিমানি রাগটাতে দিব্য যেন বেশ মজা পেল। নিতির রাগটাকে মিষ্টি করতে আলতোকরে ঘাড়ে ঠোঁট ছোঁয়ায় দিব্য। শক্ত করে কোমর পেঁচিয়ে ধরে। ঠান্ডা স্বরে বলে,

– ” মেয়েটা তো আমাদেরই! একটু-আধটু আদর না পেলে কি চলে? ছোট থেকেই কড়া শাসনের মধ্যে রাখলে ওর স্বভাবটাই শুকিয়ে যাবে। তাই এখনই কোনো শাসন-বারণ নয়। ক্লিয়ার?”

দিব্যর নিঃশ্বাস ঘাড়ে-গলায় আঁছড়ে পড়ছে। দিব্যর স্পর্শে নিতির চোখের পল্লব কাঁপতে থাকে। শরীরে শিহরণের আলোড়ন সৃষ্টি হয়। নিজেকে সামলে কপট রাগ ক্ষোভ কণ্ঠে ঢেলে বলল,

-” ছাড়ো! ছাড়ো তো। এখন আদিখ্যেতা করতে হবে না।”

-” কিছু বললেই বলিস, শুধু তোর সাথে ফোঁসফোঁস করি, আবার কাছে আসলেও বলিস আদিখ্যেতা দেখাই। এই দুইয়ের মাঝে আমি পড়েছি বেকায়দায়।”

হতাশার সুরে শেষোক্ত কথা বলে দিব্য। নিতি মুখ খুলবে এমন সময় নৃত্যের গগনবিদারী চেঁচানোর সুর আসলো,

-” আপু…?”

নিতি বি’র’ক্ত মুখে বলল,

-” দেখি ছাড়ো। ওদিকে আবার কী হলো? এত হৈচৈ কীসের!”

__________

নৃত্যের হাতের স্টেথোস্কোপটার বেহাল দশা। নলটা এক পাশে কুঁকড়ে গেছে, ডায়াফ্রামটা যেন একটু বেঁকে বসে আছে, আর রাবারের টিউবটা কোথাও যেন হালকা ছিঁড়ে গিয়েছে। পড়ার টেবিলের সামনে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে, ঠোঁটদুটো শক্ত করে চেপে রেখেছে।

রুমে ঢুকতে ঢুকতে নিতি বি’র’ক্ত স্বরে বলল,

-” কী হয়েছে? এত চেঁচাচ্ছিস কেন?”

নৃত্য ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে হাতটা সামনে ধরে বলল,

-” এটা দেখ!”

নিতি কপাল কুঁচকে তাকায়। নৃত্য গর্জে ওঠে,

-” দ্যাখ তোমার মেয়ে কী করেছে! শুধু এটুকুই নয়, কখন যে রুমে এসে আমার বইয়ে আঁকিবুঁকি করে রেখে গেছে, আল্লাহ মালুম!”

নিতি বি’র’ক্ত হয়ে বলল,

-” স্টেথোস্কোপ এমনভাবে দেখাচ্ছিস, যেন নামকরা ডাক্তার-ফাক্তার হয়ে গেছিস! সবে তো থার্ড ইয়ারে উঠবি। বাচ্চা মেয়ে একটু না হয় ভেঙেছে, তাতে এই নিয়ে ডেকে দেখানোর কী আছে শুনি!”

নিতির কথা শুনে তাজ্জব বনে যায় নৃত্য। পড়ালেখার কোনো জিনিস ন’ষ্ট হলে নৃত্যর খুব রাগ হয়। এইযে বইয়ের পাতায় কালার পেন্সিল দিয়ে আঁকিবুঁকি করে রেখেছে এটা দেখে নৃত্যর কী যে রাগ হচ্ছে। বাচ্চা মেয়েকে তো আর কিছু বলা যাবে না, তাই নিতিকে ডেকে দু’টো কথা বলে মনের রাগটা মেটাতে চাইছিল নৃত্য। কিন্তু নিতির এহেন কথায় সমস্ত রাগ-ক্ষোভ গিয়ে নিতির উপর বর্তায়। নৃত্য চোয়াল শক্ত করে বলল,

-” কোথায় মেয়েকে গিয়ে আদর করে একটু বুঝিয়ে বলবে। নেক্সট যেনো, বইয়ে হাত না দেয়। তা না উল্টো আমাকেই দোষারোপ করছো। মনে হচ্ছে তোমাকে ডেকে আমিই বড্ড পা’প অন্যায় করে ফেলেছি। আমার বইগুলোর দেখ কী হালটাই না করেছে। বই এ চোখ গেলেই আমার কান্না পাচ্ছে।”

নিতি গা ছাড়া ভাবে বলল,

-” ডাবল সম্পর্কের জন্য, এরকম একটু-আকটু ডাবল জ্বা’লা’তন সহ্য করতেই হয়।”

নৃত্য দুইহাত এক করে বলল,

-” আপু তুমি এখন যাও তো, তোমার এই অদ্ভুত কথাবার্তায় আমার মেজাজের পারদ বাড়বে বৈ কমবে না। ডাবল সম্পর্কের জন্য ডাবল আদর দিতে হবে, আবার ডাবল জ্বালাতন সহ্য করার ক্ষমতা, ধৈর্য্য রাখতে হবে। ওহ্ গড। একবার ভাবতে হবে, একমাত্র বোনের মেয়ে একটু আকাম নাই করে। আবার, মামাতো ভাইয়ের মেয়ে একটু আকাম নাই করে। ওহ্ শিট! শিট! শিট! তোমাকে ডাকাই আমার ভুল।”

_________

সন্ধ্যার নরম আলোয় সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে ইয়ান। চোখ মোবাইলের স্ক্রিনে নিবিষ্ট। পরনে সাদা টিশার্ট আর ছাই রঙা থ্রি-কোয়ার্টার। যা ওর স্বভাবের শান্ত, স্থিরতাই ফুটে উঠেছে। শ্যামলা রঙের উজ্জ্বল মুখ। উজ্জ্বল মুখে স্পষ্ট শার্প ফিচার, টানাটানা গভীর দুটো চোখ। গভীর দৃষ্টি—যেন চারপাশের সবকিছু খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। বয়সের তুলনায় সংযত, স্বল্পভাষী‌। চোখে-মুখে বুদ্ধির ছটা স্পষ্ট। এইযে মুখে এক ধরনের স্থিরতা, চোখে গভীর মনোযোগ নিয়ে গেইমের জগতে হারিয়ে গিয়েছে; মনে হচ্ছে গেমের জগতে ডুবে থাকা ছোট্ট দার্শনিক যেন।

অন্যদিকে, নাতাশা ঠিক তার উল্টো। ছটফটে, চঞ্চল, এক মুহূর্ত স্থির থাকতে পারে না। এইযে এসেই লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। ইয়ান কপাল কুঁচকে একপলক দেখেই দৃষ্টি ফের মোবাইলে নিবন্ধ করেছে। ঝাল লাগলে যেমন শোশায় অমনি দুই ঠোঁট টান করে, ইঁদুরের মতো ছোট্ট ছোট্ট কিটকিটে সফেদ দন্তপাটি এক করে মাঝে মাঝে শোশাতে থাকে নাতাশা। আর লিপিস্টিক যেন ন’ষ্ট না হয় সেইজন্য খুব সতর্ক আছে। কিছুপল পর..ইয়ানের খেলনা গাড়িটা নিয়ে একবার ফ্লোরে বুম-বুম শব্দ করে ঘুরাতে থাকে; তো আবার ইয়ানের গা ঘেঁষে সোফায়। এরুপ শব্দে আর ঘা ঘেঁষে নাতাশার খেলায় ইয়ানের কপালে বিরক্তির ছাঁট পরে। তবে মুখে কিছুই না বলে নিজেকেই ইয়ান গুটিয়ে নিয়ে একদম চেপে বসল। তন্মধ্যে তনুজা রুমে ঢোকে, হাতে গাজরের হালুয়ার ছোট্ট বাটি। হাসিমুখে সস্নেহে জিজ্ঞেস করে,

-” নাতাশা, সোনা কী করছো?”

তনুজাকে দেখেই নাতাশা একগাল হাসে, বলে,

-” কীলা কুরছি!”

তনুজা হালকা হেসে টেবিলে হাতের বাটি নামায়। নাতাশা চটপট সোফা থেকে নেমে এসে প্রথমে ঠোঁটে আঙুল রাখে, তারপর দুই হাত মেলে ধরে বলে,

—”বয়ো মাম্মা, থুন্দর নাগছে?”

তনুজা নাতাশার নরম গালে চুমু খেয়ে মিষ্টি স্বরে বলে,

-” হ্যাঁ সোনা থুন্দর নাগছে! খুব খুব সুন্দর লাগছে!”

নাতাশা খুশি হয়ে হাতের আঙুলগুলো দেখিয়ে বলে,

-” পাপা দিয়িছে!”

তনুজা অবাক হওয়ার ভান করে বলে,

-“ওমা তাই! তোমার পাপা সাজিয়ে দিয়েছে? খুব সুন্দর হয়েছে, সোনা!”

-” ত্যাংকিউ!”

ইয়ানের হাতে ছিল তনুজার ফোন। হঠাৎ কল আসতেই ও বলে,

-” মাম্মা?”

তনুজা তাকায়,

-” হু?”

ইয়ান ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

-” ফোন… পাপা।”

নরমালি ইভানই এইসময়ে ফোন করে থাকে। তাই ইয়ানের বুঝতে সময় লাগে না এটা বাবাই। তাই তো ঝটপট বাবার কথাই বলে ফেলল। তনুজা ফোন হাতে নিয়ে দেখে। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” পাপা ফোন করেছে। তুমি কথা বলবে?”

ইয়ান মাথা নাড়ায়। তনুজা স্মিত হেসে বলল,

-” রিসিভ করো।”

ইয়ান ফোন রিসিভ করেই আদুরে গলায় ডাকে,

-” পাপা?”

ওপাশ থেকে ছেলের কণ্ঠ শুনে প্রাণ জুড়িয়ে যায় ইভানের। আদুরে স্বরে জবাব দেয়,

-” হ্যাঁ, পাপা। কী করছো?”

-” গেম খেলছিলাম। তুমি কখন আসবে?”

হাতঘড়ি দেখে ইভান বলে,

-” তাড়াতাড়িই চলে আসবো। উমম! নয়টার মধ্যেই। তোমার জন্য কী আনবো? চকলেট?”

ইয়ান তৎক্ষণাৎ বলে,

-” নাহ!”

-” তাহলে কী?”

-” তুমি এসো।”

ছেলে কিছুই চায়না এইজন্য ইভানের হাসি পেল। একহাতে কপাল চুলকে বলল,

-” চকলেটও না, অন্য কিছুও নয়। আমার প্রিন্স শুধু তার বাবাকে চায়।”

ইয়ানের শান্ত উত্তর,

-” হ্যাঁ।”

-” ঠিক আছে বাবা। আমি তাড়াতাড়িই আসছি। ততক্ষণ পড়ালেখা করে নাও। আর হ্যা মায়ের কথা শুনবে। একদম গুড বয় হয়ে থেকো, কেমন?”

-” আচ্ছা।”

এমন সময় অকস্মাৎ নাতাশা ফোন কেড়ে নিতে হাত বাড়ায়। জিদি স্বরে বলল,

-” আমি আমি.. বয়ো পাপা কথা বুলবো!”

ইয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকায়, বিরক্তি স্পষ্ট। তনুজা বলে,

-” ইয়ান, নাতাশাকে ফোন দাও।”

মায়ের মতো শান্ত আর অতি ভদ্র গুণটাও পেয়েছে ইয়ান। তাই তো মায়ের বলার সাথে সাথেই একটুও দ্বিধা না করে ফোন বাড়িয়ে দেয়। নাতাশা ঘাড় কাত করে ফোন চেপে ধরে বলল,

-” অ্যালো! অ্যালো! বয়ো, পাপা!”

ইভান হেসে বলল,

-” ওহহো, আমার ছোট্ট রাজকুমারী! কেমন আছে আমার নাতাশা সোনামণি?”

-” বায়ো!” বলেই কালবিলম্ব না করে আবার বলে,

-” তকলেট..তকলেট..আনবে?”

-” নিশ্চয়, নিশ্চয় আনবো।”

-” আততা!”

ইভান মজা করে জিজ্ঞেস করে,

-” কতগুলো চকলেট আনবো?”

নাতাশা ফোন নামিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে বলে,

-” ইত্ত ইত্ত অনে…ক!”

নাতাশার বলার ধরণ দেখে তনুজা হাসে। বলল,

-” ফোন ধরে বলো, নাহলে বড়ো পাপা শুনবে কী করে!”

তবে জোরে বলায় ইভান শুনতে পায়। নাতাশার দেখানোর ভঙি চোখে না দেখলেও ইভান বুঝে নেয়। ছেলে-মেয়েদের কথা শেষ হলে ফোন তনুজা হাতে নেয়। ব্যালকনির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

-” হ্যালো।”

ওপাশ থেকে ঠান্ডা স্বর আসলো,

-” শুভ সন্ধ্যা ম্যাডাম।”

তনুজা মৃদু হেসে বলল,

-” শুভ সন্ধ্যা।”

প্রয়োজনীয় কথাবার্তা শেষে কল কে’টে তনুজা ইয়ানকে নাস্তা করাতে বসে। সোফায় একপাশে ইয়ান অপরপাশে নাতাশা মাঝে তনুজা। প্রথমে খাবার চামুচে তুলে নাতাশার দিকে বাড়ায় তনুজা। আদুরে গলায় বলল,

-” নাতাশা হা করো।”

নাতাশা আঙুল ঠোঁটের দিকে তাক করে মাথা ঘুরিয়ে না বোঝায়। তনুজা সেকেন্ডেই বুঝে নেয়। লিপিস্টিক ন’ষ্ট হয়ে যাবে তাই নাতাশা রাজি হচ্ছে না। এমনি সময় নাতাশা তনুজার কাছেই বেশি খায়। নিতি কলেজে থাকে তনুজাই বেশি আগলে রাখে। যদিও বাড়ির সবারই নয়নের মণি বাচ্চা দু’টো। তনুজা ফের বলল,

-” বড় করে হা করো। লিপিস্টিক ন’ষ্ট হবে না। আমি বলছি কিচ্ছু হবে না।”

তনুজার কথা একটু হলেও শোনে নাতাশা। বিজ্ঞের মতোন গোল্লাগোল্লা চোখে চেয়ে প্রশ্ন করল,

-” তত্যি।”

তনুজা বলল,

-” হুম। সত্যি বলছি।”

বড় করে হা করে নাতাশা তনুজা অল্প করে চামুচে তুলে সাধধানে মুখে দেয়। আরেকবার ইয়ানকে দেয়। ইয়ান পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে খেতে যাবে, তখন নাতাশা বলে উঠল,

-” পাই পাই।”

ইয়ান কপাল কুঁচকে গম্ভীর মুখে বলল,

-” পাই না, পানি।”

নাতাশা নাক ফুলাল। তনুজা গ্লাসটা ধরে খাওয়িয়ে দেয়।
.
.

কিছুক্ষণ পর…
ইয়ান ড্রয়িং করছিল। পাশে বসা নাতাশা ছটফট করতে করতে বলল,

-” বয়ো মাম্মা, আমি… আমি আঁকব!”

তনুজা মৃদু হেসে বলল,

-” আচ্ছা সোনা, দাঁড়াও। তোমাকে পেন্সিল আর খাতা দিচ্ছি।”

কিন্তু নাতাশা নড়ে চড়ে উঠে জেদ ধরে বসল। অন্য খাতা সে নেবে না। ওর ইয়ানের টাই চাই। চাই মানে চাইই। তনুজা ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করে, খাতাটা কিছুক্ষণ নাতাশাকে দিতে। ইয়ান নাতাশাকে একঝলক দেখে আবার মায়ের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

-” মাম্মা, ও খাতার এদিক–সেদিক আঁকাআঁকি করবে। রঙ ছড়িয়ে পুরোটা ন’ষ্ট করে ফেলবে। এটা আমার স্কুলের খাতা। ওকে অন্যটা দাও।”

ইয়ান দিতে নারাজ, সেটা বুঝতে পেরে নাতাশার রাগ এক লাফে আকাশ ছুঁলো। নাতাশা হঠাৎই তীব্র এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল! ঝটিতি ইয়ানের দিকে ঝুঁকে পড়ে সাদা টিশার্টের বুকে মুখ গুঁজে দিল। এক হাতে শক্ত করে টিশার্ট টেনে ধরে নিজের ঠোঁটের লালচে লিপস্টিক মুছতে লাগল। উদ্দেশ্য—একটাই! ইয়ানের টিশার্ট ন’ষ্ট করা!

#চলবে