প্রণয়ের বাঁধন পর্ব-৪১ এবং শেষ পর্ব

0
396

#প্রণয়ের_বাঁধন |অন্তিম পর্বের প্রথম অংশ|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

শরৎ এর স্নিগ্ধ সকাল। আকাশ একদম নীল, মাঝে মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা তুলোর মতো মেঘের দল। বাতাসে হালকা শীতল ছোঁয়া, তবে রোদটা উজ্জ্বল, কোমল আর আরামদায়ক। আমগাছের পাতার ফাঁক গলে এসে পড়ছে রোদ। সামনের আঙিনায় শিউলি ছড়িয়ে আছে। শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধে ভরে উঠেছে সকালের বাতাস। এদিকে বাড়ির ভেতর একদম ভিন্ন চিত্র। রান্নাঘর থেকে আসছে চামুচ বাটির টুং টাং শব্দ। টেবিলে রাখা কফির মগ থেকে ধোঁয়া উঠছে ধীরে ধীরে, জানালার কাঁচে সেই ধোঁয়ার ছোঁয়া পড়ে হালকা আবছা ভাব তৈরি করছে। ব্রেড আর টোস্ট বিস্কুট টেবিলের উপর গুছিয়ে রেখে তনুজা পিছন ঘুরতেই ইভানের দিকে চোখ পড়ল। ইভান মাত্রই ঘুম থেকে জেগে রুম থেকে বেরিয়ে এদিকেই আসছিল। তনুজা আলতো হেসে বলল,

-” শুভ সকাল।”

ইভান দু’হাত উপরে তুলে ঘুমের রেশ কাটানোর আয়েশিভঙ্গি করে, পরপর বলে,

-” শুভ সকাল, ম্যাডাম।”

এতটুকু বলতেই হঠাৎ ঘাড়টা টনটন করে উঠল ব্যথায়। মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো,

-” আহ্!”

ব্যথায় কপাল কুঁচকে নেয় ইভান। মুহূর্তেই তনুজার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল,

-” কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?”

সোফায় শোয়ার কারণে ঘাড় ব্যথা হয়েছে, ইভান তা বুঝতে পারল। কিন্তু তনুজাকে আশ্বস্ত করতে ব্যথাকে হেসে উড়িয়ে দিতে চাইল। গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলল,

-” তেমন কিছু নয়। হয়তো শোয়াটা ঠিকঠাক হয়নি, তাই..”

কথাটা বলতে বলতে ইভান একপাশে মাথা কাত করে গলা ঘোরানোর চেষ্টা করল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আবার মুখ কুঁচকে গেল। এই দেখে তনুজার চোখে উদ্বেগের ছাপ গাঢ় হয়। ব্যস্ত কণ্ঠে ফের শুধালো,

-” তেমন কিছু নয় মানে? ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেলছেন। দেখি..দেখি কী হয়েছে?”

তনুজা দু’কদম এগোয়। ইভানের ঘাড়ে হাত রাখে। উষ্ণ হাতের স্পর্শে ইভান একটু চমকে উঠল, তবে বিরোধিতা করল না। তনুজা চিন্তিত বদনে বলল,

-” ব্যথা বেশি লাগছে?”

ইভান মুচকি হেসে বলল,

-” উম! এতক্ষণ ছিলো, তবে এখন নেই। তুমি হাত রাখার পর সব ব্যথা ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে। তোমার হাতে ম্যাজিক আছে নাকি?”

নিম্নাষ্ঠে দাঁত চেপে ভ্রু নাচিয়ে শেষোক্ত প্রশ্ন করে ইভান।
তনুজা হাতটা সরিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

-” ধ্যাত।”

তনুজার কপালে দুই আঙুল রেখে মৃদু টোকা দিয়ে ইভান বলল,

-” আমি ঠিক আছি, ম্যাডাম। চিন্তার কিছু নেই। সোফায় শোয়ার জন্য হয়তো একটু এমন হয়েছে। তবে ব্যাপার না, এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।”

তনুজা বোকা বোকা চোখে চেয়ে প্রশ্ন করে উঠল,

-” সোফায়? বেড ছেড়ে সোফায়! কিন্তু কেনো? বুঝলাম না তো!”

-” সেটা বুঝলে কী আর আগ বাড়িয়ে আমাকে আলাদা রাখার ফন্দি আঁটতে।”

ইভান মনেমনে বলে মুচকি হাসল। তাড়া দিয়ে মুখে বলল,

-” সেটা তোমাকে বুঝতে হবে না, মাই মিসেস। নাউ, কুইক্লি গিভ মি দা স্টিমিং কফি ইন ইয়োর হ্যান্ড। ফর মাই রিফ্রেশমেন্ট।”

ইভান সোফায় বসে কফির মগে চুমুক দিচ্ছিল; তন্মধ্যে গম্ভীর কিন্তু মিষ্টি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,

-” গুড মর্নিং, পাপা।”

ইভান মুখ তুলে তাকাল। ছেলেকে দেখে ঠোঁটের কোণ প্রশস্ত হয়। মুচকি হেসে বলল,

-” গুড মর্নিং, ইয়ান। ঘুম কেমন হলো?”

ইয়ান হালকা মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়,

-” ভালো।”

এমন সময় ইয়ানের পেছন থেকে ছোট্ট একটা ঝড়ের মতো দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল সোফায়। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

-” মনিন বয়ো পাপাআআ!”

গোলাপি রাতের পোশাকে জড়ানো চঞ্চল নাতাশা সোজা ইভানের কোলের উপর পড়ে। ইভান ত্রস্ত একহাতে সামলে নেয় বাচ্চা মেয়েটাকে। নাতাশা আবদার করে বসল,

-” আমি..আমি কাবো।”

কফির মগ দেখিয়ে নাতাশা বলে। ইভান হেসে বলল,

-” ছোটদের জন্য কফি নয়, ছোট্ট পাখি।”

নাতাশা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

-” তাহলে তকোলেট?”

-” চকলেট পাবে, তবে পরে। আগে নাস্তা করবে তারপর।”

ঠোঁট উল্টে বুঝদারের মতন ঘাড় কাত করল নাতাশা।
.
.
কিছুক্ষণ পর,
নিতি আর তনুজা কিচেনে ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছে। নিতি প্যানে ভাজি নাড়তে ব্যস্ত। পরপর ভাজি বোলে তুলে ডায়নিংয়ে রাখে। দীর্ঘক্ষণ আগুনের আঁচে থাকার দরুন খুব গরম লাগছিল। তাই সোফায় বসে একটু জিরানোর জন্য। ইয়ান চুপচাপ সোফায় একপাশে খেলনা গাড়িটা হাতে নিয়ে নাড়ছে। ওদিকে নাতাশা পুরো বাড়ি মাতিয়ে রেখেছে। ঘরময় দৌড়ঝাঁপ পারছে, থেকে থেকে চিল্লাচিল্লি তো আছেই। পাশে বসা ইয়ানের চুলে হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় নিতি বলল,

-” তা বাবাই বলো তো এখানে এসে কেমন লাগছে?”

ইয়ান ঘাড় কাত করে ছোট করে বলে,

-” ভালো।”

তন্মধ্যে নৃত্যকে এদিকে আসতে দেখে নিতি হাঁক ছেড়ে ডাকল,

-” নৃত্য?”

-” হুঁ।”

-” নাতাশা আর ইয়ানের ব্রাশে টুথপেস্ট লাগিয়ে দে। একটু ফ্রেশ করিয়ে দে না।”

নৃত্য ওদের দু’টোকে ডেকে বেসিনের সামনে দাঁড় করায়। পরপর দু’জনের ব্রাশে টুথপেস্ট লাগিয়ে দেয়। এদিকে নাতাশা ছোট হওয়ায় বেসিনের আয়নায় নিজের মুখ দেখতে পাচ্ছে না, তাই হইহই শুরু করে দিলো। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

-” আমি..আমি দেকতে..”

নৃত্য একহাত কোমড়ে রেখে বলল,

-” দাও, তোমার ব্রাশ আমার কাছে দাও। আমি সুন্দর করে করিয়ে দিচ্ছি।”

হাতটা তড়িৎ পিছুনে লুকিয়ে ফেলে নাতাশা। রাগি দৃষ্টিতে চেয়ে কণ্ঠে ভর দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,

-” না..আআআআ। আমি এতাই।”

নৃত্য ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ভেতর যায় টুল আনতে। ইয়ান ব্রাশ করতে করতে দেখে নাতাশা জিহ্ব দিয়ে ব্রাশের সাথে থাকা টুথপেস্ট চেটে চেটে খাচ্ছে। নাতাশা একটু চুপিচুপি পেস্ট খেতে থাকে। ইয়ান ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর মুখে বলল,

-” টুথপেস্ট খেতে হয় না। মাম্মা বলে ওটা খেলে অসুখ করে।”

নাতাশার কথাটা ভালো লাগল না। ও ভ্রু-ট্রু কুঁচকে চোখ পাকিয়ে চাইল। এরমধ্যে নৃত্য টুল এনে নাতাশাকে দাঁড় করিয়ে দেয়। নাতাশা গোলগোল চোখ করে ডান হাতটা নৃত্যের সামনে ধরে, ব্রাশটা দেখিয়ে বলে,

-” আয়ো।”

নৃত্যের কপাল কুঁচকে যায়। চেঁচিয়ে উঠল,

-” হায় আল্লাহ! টুথপেস্ট গেলো কই?”

নাতাশা উত্তর দেয় না। ইয়ান বলল,

-” ফুপ্পি ও টুথপেস্ট লুকিয়ে লুকিয়ে খাচ্ছিল।”

নৃত্যের একহাত কপালে চলে যায়। ইয়ানের দিকে গম্ভীর মুখে তাকায় নাতাশা। নৃত্য কিছু বলবে তার আগেই নাতাশা জিদ ধরে বলল,

-” আয়ো…আয়ো।”

নৃত্যের মুখ বিরক্তিতে ঠাসা। রাগে গজগজ করতে করতে ফের টুথপেস্ট লাগিয়ে দেয়। আর এবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে দেয়, আর যেন না খায়। নাতাশা টুলের উপর দাঁড়িয়ে দুলতে দুলতে ব্রাশ করতে থাকে। আয়নার সামনে দাঁত বের করে দেখে আর কোমড় দুলায়। ইয়ান মুখ ধুতে যাবে, তখন নাতাশা চেঁচিয়ে উঠল,

-” আমি..আমি।”

অর্থাৎ, আগে ও করবে। নৃত্য বলল,

-” আচ্ছা ইয়ান বাবা একটু ওয়েট করো। আর এইযে আহ্লাদি ননি, আসুন আমি মুখ ধুইয়ে দিচ্ছি।”

কিন্তু নাতাশা নাছোড়বান্দা! সে একাই মুখ ধুবে। একা একাই দুইহাতের মাঝে পানি নিয়ে খপখপ মুখে ছিটাতে থাকে। মুখে কম পানি যাচ্ছে, বেশি পানি বুকের উপর দিয়ে ভেসে পড়ছে। শেষে ফাজলামি করে হাতে পানি নিয়ে ইয়ানের দিকে ছিটিয়ে দেয়। আর একা একাই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। নৃত্য দুইহাত দিয়ে নাতাশাকে ধরে ঝট করে নামিয়ে দেয়। বিরক্ত হয়ে বলে,

-” দুষ্টুর মহারানী একটা!”

নাতাশা মুখ বাঁকিয়ে নিতির কাছে এগোয়। নৃত্য ট্যাপ ছেড়ে আদুরে গলায় বলে,

-” ইয়ান সোনা, আমি হেল্প করব?”

ইয়ান ঘাড় নাড়িয়ে জবাবে সম্মতি দেয়। সোফায় বসে ফোনটা হাতে নিতেই মেসেজ নোটিফিকেশন দেখে চেক করছিল নিতি। তন্মধ্যে সামনে দাঁড়িয়ে ছোট্ট ছোট্ট সফেদ দন্তপাটি বের করে দেখাতে থাকে নাতাশা। আবার একহাত মুখের সামনে ধরে ফুঁ দিতে থাকে। যেন ক্লোজ-আপ এর অ্যাড দিচ্ছে। নিতির ওড়নার কোণা ধরে আহ্লাদী স্বরে বলে,

-” মাম্মা পয়িসকার।”

নিতি মেয়ের দিকে তাকায়। দুইহাতে মেয়ের গাল চেপে টুপ করে চুমু খেয়ে বলে,

-” হ্যা হ্যা, খুব পরিষ্কার হয়েছে।”

হঠাৎ নাতাশার জামার দিকে নজর পড়তেই নিতি আঁতকে উঠল,

-” ইয়া আল্লাহ! জামা তো একদম ভিজে চুপচুপ করছে। ভেজা জামা গায়ে থাকলে, ঠান্ডা বসে যাবে তো।”

নিতি মাথা তুলে নৃত্যের দিকে চেয়ে বলল,

-” নৃত্য বোন, নাতাশার ড্রেসটা চেঞ্জ করে দে তো। রুমে ব্যাগের ভেতর দ্যাখ জামা আছে। একটা তাড়াতাড়ি পড়িয়ে দে।”

নৃত্য বিরক্তিতে মুখ শুকিয়ে ফেলে। মনেমনে বলে,

-” এই তো আরেকজন! সক্কাল সক্কাল একের পর এক শুরু হয়ে গেল! এর তো মেয়ে জন্ম দিয়েই কাজ শেষ। সবকিছুতেই এর শুধু হুকুম জারি। আর মেয়েটা? সে তো একেবারেই উল্টো! ওর কোনকিছু করতে গেলেই যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধে। ডানে যেতে বললে যায় বামে। উফ! আল্লাহ! পৃথিবীর সব অবিবাহিত খালাদের হয়েছে এক জ্বা’লা! বোনের বাচ্চা-কাচ্চাদের ফাই-ফরমায়েশ খাটতে খাটতে জীবন শ্যাষ।”

নৃত্য খানিক পরের দৃশ্য ঢের অনুমান করে নেয়। জামা পড়াতে গেলে, এটা নয় ওটা, ওটা নয় এটা। এই করে একগাদা জামা এলোমেলো করবে। অবশেষে নৃত্যকে সময় নিয়ে সেগুলো গুছিয়ে রাখতে হবে। চোখের সামনে খানিক পরের দৃশ্য জ্বলজ্বল করে উঠতেই, নৃত্যর কেমন কান্না পায়।

__________

সময়টা বেলা এগারোটা নাগাদ। পুকুরপাড়ে ইভান, নৃত্য আর ইয়ান,নাতাশা। ওরা উৎসুক হয়ে মাছ ধরা দেখছে। কেয়ারটেকার হাফিজের হাতে জাল। ধীরে ধীরে জালটা পুকুরের পানিতে ছড়িয়ে দেয়। ভদ্রলোকের চোখে তীব্র মনোযোগ, যেন মাছের অবস্থান ভালো করে বুঝতে চাচ্ছেন। জালটি পুকুরের শান্ত পানির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মাছেরা আটকা পরে। জাল টেনে তুলতেই কাজের মেয়েটা ত্রস্ত হাতে মাছ বাঁশের তৈরি ঝুঁড়িতে তুলতে থাকে। ছোট ঝুড়ি ভরে উঠছে, রঙিন ও তাজা মাছে। মাছগুলোর দেহে সূর্যের আলো পড়লে চকচকে হয়ে উঠছে। ইয়ান চুপচাপ শান্ত দৃষ্টিতে দেখছে। কিন্তু নাতাশা মাছ দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উচ্ছ্বাস করছে। ঝুড়ির উপর ঝুঁকে আঙুল দিয়ে ছুঁবে এমন ভাবসাব করছে। আবার পুকুরের পানি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলছে,

-” কটটো পাই..ইয়ু কটো পাই।”

ইয়ান শুধরে দিতে বলল,

-” পানি।”
.
.
নিতি মাছ ধরা দেখবে বলে পুকুরপাড়ে আসছিলো। এমন সময় পেয়ারা গাছের দিকে নজর পড়তেই থেমে যায়। একটা ডাল বাঁকিয়ে পেয়ারা ছিঁড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু অল্পের জন্য নাগাল পাচ্ছিল না। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে সর্বোচ্চ উঁচু হওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছিল নিতি। এমন সময় মাথার উপর দিয়ে একটা পুরুষালি হাত উঁচুতে ওঠে পরপর ঝট করে পেয়ারাটা ছিঁড়ে নেয়। নিতি ঘাড় ঘুরিয়ে দিব্যকে দেখতে পায়। দিব্য ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,

-” পেয়ারা পাড়ার জন্য হলেও তোর আরেকটু লম্বা হওয়া প্রয়োজন ছিলো।”

নিতি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

-” আমার হাইট স্বাভাবিকই আছে, হু। আমি মোটেই শর্ট নই।”

নিতির একহাত ধরে অন্যহাতে থাকা পেয়ারাটা ধরিয়ে দেয় দিব্য। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিতির মাথার উপর বরাবর নিজের দিকে একহাত টেনে দেখিয়ে ঠান্ডা স্বরে বলে,

-” আমার কাঁধ সমান। উম! তা অবশ্য ঠিকই বলেছিস। আমার বউ হিসেবে তোর হাইট পার্ফেক্টই আছে।”

এই বলে বাম চোখটা টিপে শিষ বাজিয়ে গটগট পা ফেলে দিব্য এগিয়ে যেতে থাকে। নিতি ঠোঁট বাঁকিয়ে পেয়ারায় বাইট দেয়।
.
.
নাতাশা ঝুড়ি থেকে একটা পুঁটি মাছ হাতে তোলে। ফর্সা ছোট্ট কোমল দুই আঙুল দিয়ে মাছটার লেজ চেপে উল্টো দিক করে ঝুলাতে থাকে। তারপর ইয়ানের সামনে ধরে দোলাতে দোলাতে ঠোঁট গোল করে বলে,

-” ইয়ু…ইয়ু!”

নাতাশার চোখেমুখে কপট ভয়ের ছাপ। মুখাবয়ব এমন করছে যেন মাছটা দেখে ও নিজেও খুব ভ’য় পাচ্ছে। সাথে ইয়ানকে তার সঙ্গী বানানো। ইয়ান বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নেয়। ইয়ানের গা বরাবর ছুঁইছুঁই করে খিলখিলিয়ে হেসে হাত নাড়িয়ে বলতেই থাকে,

-” ইয়ু….ইয়ু।”

এমন এটিটিউড করছে মনে হচ্ছে এই বুঝি ইয়ানের গায়ের উপর ফেলবে..ফেলবে। এই দেখে তৎক্ষণাৎ নৃত্য হইহই করে উঠল। ধ’ম’কের সুরে বলল,

-” নাতাশা? হাত থেকে নামাও ওটা! উফফ, আঁশটে ছুঁয়েছো! ইয়াক!”

নৃত্য নাকমুখ সিঁটকাতে থাকে। কিন্তু নাতাশা কি আর কথা শোনে? নাতাশা গোলগোল চোখ করে রাগি মুখবিবরে নৃত্যর দিকে চাইল। নৃত্য অতিষ্ঠ হয়ে নিতিকে ডাকল,

-” অ্যাই আপু! দ্যাখো তো তোমার মেয়ে কী করছে? ইশশ! কী ঘিনঘিনে! মাছ নাড়ছে।”

নিতি চমকে উঠল,

-” ইয়া আল্লাহ! দ্যুতি মামণি, মাছ ধরছো? হাত গন্ধ হয়ে যাবে তো। তাড়াতাড়ি নামাও। নামাও বলছি।”

মায়ের কাছে নালিশ দেওয়ায় নাতাশা নৃত্যর উপর বেজায় চটে। নাক ফুলিয়ে, চোখ মোটা করে ঠোঁট চেপে চেয়ে রয়। এদিকে পেয়ারা চিবুতে চিবুতে নৃত্যের দিকে তাকিয়ে নিতি বলল,

-” নৃত্য, বোন আমার। নাতাশার হাতটা ভালো করে ধুয়ে দে তো। আঁশটে ছুঁয়েছে, এই হাতই আবার মুখে দিয়ে বসবে।”

নৃত্যর শুভ্র বদনখানি ঝটিকায় ফ্যাকাশে হয়ে যায়। বিরক্তিতে মনেমনে আওড়ায়,

-” ওহ্ গড! যেমন মেয়ে, তেমন মা। মেয়ের শুধু আকাম, আর মায়ের শুধু অর্ডার। এই মা-মেয়ের চক্করে আমার জীবন দিনদিন হচ্ছে তেজপাতা।”

_________

পুকুরের টলটলে জলে দুপুরের টাটকা ঝলমলে রোদ খেলা করছে। হালকা বাতাস বইছে, পানির ওপর ঢেউ তুলে দিচ্ছে নরম করে। পুকুরের শান বাঁধানো সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে দিব্য। পানির ছোঁয়া ঠিক পায়ের কাছেই, কাচের মতো স্বচ্ছ পানি হালকা ঢেউ খেলছে। দিব্য উবু হয়ে এক হাতে পায়ের কাছের জিন্স ফোল্ড করছিল। এমন সময় মেয়েলি কণ্ঠস্বর রিনিঝিনি ঝংকার তুলল। পাড়ে দাঁড়িয়ে নিতি বলল,

-” আমার শাওয়ার নেওয়া শেষ। এখন ওয়াশরুম ফাঁকা আছে। জলদি শাওয়ার নিয়ে নাও।”

দিব্য সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিতির দিকে না তাকিয়ে হাতঘড়ি খুলতে থাকে, তারপর পকেট থেকে ফোন বের করে দুধাপ উপরের সিঁড়িতে রাখতে রাখতে বলল,

-” আজ পুকুরে গোসল করব। মোবাইল আর ঘড়িটা নিয়ে যা।”

নিতি শাড়ির কুঁচি একহাতে আগলে সন্তর্পণে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। দিব্যর থেকে একধাপ উপরের সিঁড়িতে পা জোড়া থামে ওর। দিব্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দৃষ্টিজোড়া থমকায়। নিতির পরনে নীল রঙের শাড়ি। নীল শাড়িতে যেন এক অপার্থিব আলো ছড়িয়ে পড়ছে ফর্সা গা থেকে। ভেজা চুলগুলো পিঠজুড় সুবিন্যস্ত ছড়িয়ে আছে, মাত্র গোসল করে এসেছে, শ্যাম্পুর গন্ধে বাতাসও মিষ্টি হয়ে উঠেছে। দিব্যর চোখ আটকে যায়, যেন এই মুহূর্তে বাইরে কিছুই আর দেখতে পাচ্ছে না। নিতি খানিকটা দুষ্টুমি মিশিয়ে একহাতে কানের ঝুমকাটা ছুঁয়ে নেড়ে দেয়, ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি। গলা খাঁকারি দিয়ে ,

-” এহেম! এহেম!”

শব্দ করে নিতি। নিতির কাজলটানা চোখে তাকাতেই দিব্যর হৃদস্পন্দন লাগামহীন ঘোড়ার গতিতে ছুটে। নিতির কাজলকালো চোখে এক অদ্ভুত মায়াবী দৃষ্টি, যা দিব্যকে স্থির করে ফেলে। বাতাস একটু জোরে বয়ে যায়, নিতির চুল উড়তে থাকে। দিব্যর বুকের ভেতর কেমন একটা শিহরণ খেলে যায়। পরপর শুকনো ঢোক গিলতে থাকে। নিতি কানের ঝুমকা নেড়ে আড়চোখে চেয়ে দেখে দিব্যর মুখের এক্সপ্রেশন। নিত ধীরে ধীরে দিব্যর দিকে খানিকটা ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলে,

-” এভাবে কী দেখছো?”

দিব্য নিজেকে তটস্থ করে ঘনঘন দু’বার পলক ফেলে। অতঃপর ফাঁকা ঢোক গিলে মুচকি হেসে ফেলল। কিন্তু চোখের গভীরে আটকে থাকা অনুভূতিগুলো তখনও নিতির দিকে ছুটে চলেছে নিঃশব্দে, নিরবধি। দিব্য জিন্সের পকেটে দুইহাত গুঁজে সটান দাড়িয়ে মুখে বাঁকা হাসি টেনে বলল,

-” শাড়িতে তোকে একটু বেশিই..”

আলোর গতিতে নিতির মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়। নিতি মনেমনে ভেবে নেয়; দিব্য নিশ্চিত রোমান্টিক মুডে চলে গিয়েছে। এমন বলবে,

-” শাড়িতে তোকে একটু বেশিই হট লাগছে! বা একটু বেশিই সুন্দরী লাগছে!”

নিতির এমন ভাবনায় এক বালতি ময়লা পানি ঢেলে দেয় দিব্য নিমিষেই‌। দিব্য বলল,

-” শাড়িতে তোকে একটু বেশিই মোটা লাগছে।”

কথাটা শ্রবণ হতেই তৎক্ষণাৎ নিতির মুখটা রাগে লাল হয়ে উঠল। কোথায় রোমান্টিক কথা আশা করেছিলো। সেখানে কীনা মোটা বলল। প্রায় মেয়েদের একটা স্বভাবজাত আছে, মোটা শব্দটা ঠিকভাবে হজম করতে পারে না। নিতির মুখ রাগে লাল হয়ে ধোঁয়া উঠার জোগাড়। নিতি রাগে গজগজ করতে করতে বলল,

-” তুমি একটা আস্ত অ’স’ভ্য! আমাকে মোটা লাগছে, হ্যা? আমি যথেষ্ট স্লিম, হু।”

নিতির রাগে দিব্য মজা পায়। গা দুলিয়ে হেসে ওঠে। ওদিকে দিব্যর হাসিতে নিতির রাগ সপ্তম আকাশ ছুঁলো। দিব্যর বুকের উপর দুইহাত রেখে বাঁকা হেঁসে বলল,

-” আমাকে মোটা বলার শাস্তি স্বরুপ, তোমাকে তো পানিতে চুবানো উচিত। সেটা তো আর পারব না। তাই এ…টা।”

বলেই নিতি অকস্মাৎ এক কান্ড ঘটিয়ে ফেলল, দিব্যর বুকে ধাক্কা দেয়। দিব্যর চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়। নিতির এমন সাহসের বহিঃপ্রকাশে ও হতবাক! কিন্তু দিব্যও কম যায় না। ধাক্কার চাপে টাল সামলাতে না পেরে পিছন দিকে হেলে পড়তে থাকে, ঠিক তখনই নিতির কব্জি চেপে ধরে টান মা’রে।

-” ঝপাৎ!”

শব্দ হয়। দু’জনেই জলের গভীরে তলিয়ে যায়। নিতি চট করে দিব্যর টিশার্ট আঁকড়ে ধরে। কয়েক সেকেন্ড ডুবে থাকার পর দু’জনে একসঙ্গে ভেসে ওঠে। দিব্য কপালের উপর থেকে চুল সরিয়ে পিছনে দিতে দিতে চোখ পাকিয়ে চায়। মাত্র গোসল করে শাড়ি-টাড়ি পরে একটু সাজগোজ করেছিল নিতি। এখনই সব ন’ষ্ট হওয়ার দরুণ নিতির সমস্ত রাগ-ক্ষোভ গিয়ে দিব‌্যর উপর বর্তায়। নিতি ঝট করে দিব্যর টিশার্টের কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-” মাত্র আমি শাওয়ার নিয়েছি। কত সময় নিয়ে শাড়িটা পড়েছিলাম। জানো তুমি? দিলে তো সব ন’ষ্ট করে। তুমি তো এমনিতেই শাওয়ার নিতে। সেখানে আমাকে টানার কী দরকার ছিলো?”

নিতির রাগটাতে দিব্য মজা পেল। গা ছাড়া ভাবে বলল,

-” আরে, আরেকবার গোসল করে নিলি, ক্ষতি কী?”

কথাটা বলে চোখ টিপল দিব্য। দিব্যর কলার ধরে নিজের দিকে আরেকটু নুইয়ে নিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে নিতি বলল,

-” ইচ্ছে তো করছে তোমাকে?”

নিতির কথাই নিতিকে ফিরিয়ে দিতে দিব‌্যর ইচ্ছে করছিলো। নিতি আগে যেমন বলতো, -‘ কী চুমু-টুমু খেতে।’ তবে দিব্যর কণ্ঠনালী দিয়ে বেরুল না। দিব্য ডান ভ্রুটা নাচিয়ে ইশারায় শুধায়,

-” কী?”

নিতি কলার থেকে দুই হাত সরিয়ে নেয়। রাগে হিসহিসিয়ে বলে,

-” উফ্! তুমি আসলেই অসহ্য! কোনোদিন তোমার দ্বারা ভালো কিছু হলো না। ইদানিং তোমার ইনটেনশনই কেমন যেনো আমাকে জ্বা’লা’নো।”

এই বলে নিতি ভেজা শাড়ির আঁচলটা টেনে ঠিক করতে থাকে। দিব্য কপাল কুঁচকে বলল,

-” কখনো আমার না থাকার মূহুর্তে; আমার এই ছোট্ট ছোট্ট জ্বালানো গুলোই তোর বেশি স্মরণ হবে। দেখে নিস।”

নিতি মুখ ভাঙায়। মজার ছলে বলল,

-” কখনোই না। আমি আরো চিল করবো, হু।”

-” আলবাত মনে পড়বে। চোখের জল নাকের জল এক করে এভাবে বলবি..”

এতটুকু বলে দিব্য পানিতে সাঁতার দিতে দিতে সুর তুলল,

-” যে কটা দিন তুমি ছিলে পাশে কেটেছিল নৌকার পানে চোখ রেখে, আমার চোখে ঠোঁটে গালে তুমি লেগে আছো।”

নিতি সিঁড়ির কয়েক ধাপ উপরে উঠে পিছুন ফিরে চায়। রিনিঝিনি সুরে চেঁচিয়ে বলল,

-” তোমাকে মনে পড়ার প্রশ্নই আসে না। কজ তুমি তো কখনো আমাকে ভালোবাসিই বলোনি। আর যে নিতিকে ভালোবাসে না, তার কথা নিতির মনে পড়বে না, হুঁ।”

দিব্য সাঁতরে মাঝ পুকুর অবধি চলে যায়। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে ডাকল,

-” নিতি।”

নিতি পাড়ে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল চিপছিলো। টপটপ করে জলের কণা ঝরছিল আঁচল থেকে। দিব্যর ডাকে মাথা তুলে চাইল। দিব্য খোলা প্রান্তরে গলার স্বর চড়িয়ে বলল,

-” আমার উপর তোর খুব অভিযোগ, তাই না? প্রমিজ করছি, আজকের পর থেকে তোর কোনো অভিযোগ থাকবে না। তোর সব অভিমান হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে… দেখে নিস!”

__________

রোদ ঝলমলে বিকেল। ওরা সবাই মিলে প্ল্যান করেছে বিকেলটা ঘুরাঘুরি করে কাটাবে। গাড়ির দরজার উপর একহাত রেখে অন্যহাতটা জিন্সের পকেটে গুঁজে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দিব্য। ইভান এগিয়ে আসতেই দিব্য বলল,

-” ব্রো, আজ আমি ড্রাইভ করি?”

ইভান প্রথমে একটু অবাক হলো। পরপর বলল,

-” শিওর! তোর ড্রাইভিং স্কিল তো আমার জানা। তবে স্পিড টা একটু কম রাখিস।”

দিব্য মাথা নেড়ে বলল,

-” আরে ধূর! সমস্যা নেই। আজ একদম স্মুথলি ড্রাইভ করবো। দেখে নিস।”

-” ইটস্ ওকে ছোটে। তবে বাচ্চারা আছে, খেয়াল রাখিস।”

এরমধ্যে নিতি মেয়ের হাত ধরে এগিয়ে আসে। নাতাশার হাতে তুলতুলে সাদা রঙের ছোট্ট একটা পুতুল। দেখতে ঠিক যেন মিস্টার বিনের পুতুলটার ন্যায়। নাতাশা আদর করে টুটু বলে ডাকে। সবসময় পুতুলটা কাছে কাছে রাখে। এরমধ্যে তনুজা, ইয়ান আর নৃত্য আসে। দিব্য ইশারা করে নিতিকে ফ্রন্ট সিটে বসতে বলে। নিতি ভেংচি কেটে সামনে বসল।
.
.
অল্প স্বল্প ঘুরাঘুরি শেষে ওরা হাইওয়ের পাশে থাকা একটা রেস্টুরেন্টে ঢোকে। কিন্তু দিব্য গাড়িতেই থাকে। গাড়িতে বসে দিব্যর একহাতে কোকাকোলার ক্যান অন্যহাতে ফোন। এভাবে সময় কাটাতে থাকে।

ওদিকে ওরা হালকা নাস্তা পর্ব শেষে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোয়। রেস্টুরেন্টের দরজা পেরিয়ে বাইরে কয়েক পা আসতেই নাতাশা হঠাৎ বলে উঠল,

-” মাম্মা! মাম্মা আমাল টুটু!”

নিতির কোলে ছিলো নাতাশা। নিতি মেয়ের হাতে পুতুল খোঁজে। কিন্তু মেয়ের হাত দু’টো ফাঁকা। অনেকক্ষণ লক্ষ্য করাও হয়নি। নিতি মেয়েকে পাল্টা প্রশ্ন করল,

-” কোথায় রেখেছো পুতুল? বলো?”

নাতাশা মনে করতে পারে না। অথচ কান্না জুড়ে দিলো,

-” আমাল টুটু তই?…তই?”

বলে বলে। নিতি বিরক্ত হয়ে কষিয়ে ধ’ম’ক দেয়। তনুজা বলল,

-” আহ্, নিতি। শুধু শুধু ওকে বকছো কেনো! বুঝিয়ে বলো। একটু খুঁজলে পাওয়া যাবে।”

নৃত্য কপাল কুঁচকে কিছু মনে করার ভঙিতে বলল,

-” গাড়িটা ওখানে পার্ক করার সময়ও আমি স্পষ্ট নাতাশার হাতে পুতুল দেখেছি। তারমানে এই জায়গায়তেই কোথাও আছে। অন্য কোথাও নয়।”

নাতাশা শব্দ করে কাঁদছে। তনুজা ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” ভেতরে রেখে আসেনি তো। হয়তো হাত থেকে নামিয়েছিলো, পরে আসার সময় মনে নেই।”

নাতাশার কান্না থামাতে ইভান কোলে নিল। বলল,

-” কাঁদে না ছোট্ট পরী। চলো ভেতরে গিয়ে খুঁজে দেখি।”

ওদেরকে দাঁড়াতে বলে ইভান ভেতরে যায় খুঁজতে। ইয়ান টিশার্টের কলার ধরে ফাঁকা করতে থাকে। পরপর তনুজার আঙুল ধরে বলল,

-” মাম্মা গরম লাগছে।”

-” ওয়েট বাবা। এইতো এক্ষুনি বাসায় যাব।”

তনুজা নিতিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-” নিতি, ইয়ানের গরম লাগছে। আমরা বরং গাড়িতে গেলাম। আর গিয়ে দেখি পুতুলটা গাড়িতে আছে কীনা!”

নিতি মাথা কাত করে সায় জানায়। তনুজা ছেলের হাত ধরে আসতে থাকে। হঠাৎ একপাশে থাকা রঙিন বেলুনের দিকে নজর পড়ে তনুজার। এগিয়ে গিয়ে বেলুন কিনে ইয়ানের হাতে দিয়ে বলে,

-” এগুলো থেকে নাতাশা যেটা যেটা চাইবে, সেটাই কিন্তু দিবে। নাতাশা এমনিতেই কান্না করছে, এটা পেলে যদি কান্না থামে।”

ইয়ান মাথা নাড়ায়। তনুজা পার্স খুলে টাকা দেয়। এরমধ্যে ইয়ানের হাত থেকে একটা বেলুন উড়ে যায়। ইয়ান সেটা ধরতে পিছু যায়। তনুজা পাশ ঘুরতে নিবে, তন্মধ্যে একটা অসহায় বৃদ্ধা মহিলা সাহায্য চাইতে আসে। তনুজা পার্স খুলে টাকা বের করতে থাকে। ইয়ান বেলুন ধরতে মাঝ রাস্তায় চলে এসেছে। মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ ইয়ানের চোখ যায় একপাশে পড়ে থাকা নাতাশার পুতুলটার দিকে। ইয়ান আশেপাশে না তাকিয়ে পুতুলটা নেওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।

ওদিকে নাতাশাকে কোলে নিয়ে ইভান বেরোয়। ভেতরে পাওয়া যায়নি পুতুল। ওরা আসতে থাকে। এদিকে তনুজা বৃদ্ধার দিকে টাকা বাড়িয়ে দেয়। বৃদ্ধা নীরব স্বরে দোয়া করে চলে যেতেই তনুজা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে; ইয়ান পাশে নেই! হৃদস্পন্দন মুহূর্তেই দ্বিগুণ হয়ে যায় তনুজার। তড়িঘড়ি উল্টোদিকে তাকাতেই দৃষ্টি জমে যায়। সেখানে যা দেখল, তাতে ওর শরীর হিম হয়ে আসে। একদিক দিয়ে বিরাট বাস গর্জন করতে করতে এগিয়ে আসছে, আর অন্যদিক দিয়ে অশ্বারোহী শ’য়’তানের মতো তেড়ে আসছে এক প্রকাণ্ড ট্রাক। চারপাশের শব্দ যেন এক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায়। তনুজার পায়ের নিচের জমিন সরে যেতে থাকে, দৃষ্টির কোণ ঘোলা হয়ে আসে, সমগ্র পৃথিবী যেন দুলে উঠছে। তনুজার কণ্ঠ ফেটে বেরিয়ে আসে এক করুণ আর্তনাদ,

-” ইয়া…ন!”

তৎক্ষণাৎ তনুজা ছুটতে থাকে। গাড়ির বনেটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে দিব্য ফোন স্ক্রল করছিল। হঠাৎ তনুজার আতঙ্কিত চিৎকার কানে আসতেই চমকে উঠে সামনে তাকায়। মাঝ রাস্তায় ইয়ানকে দেখে মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে আসে। মুহূর্তেই একলাফে নেমে দাঁড়ায় দিব্য। এক সেকেন্ড বিলম্ব না করে সর্বোচ্চ বেগে দৌড়ায়।

তনুজার চিৎকার শুনে ইয়ান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। সামনে-পিছনে গাড়ি। এই দেখে ছোট্ট শরীরটা থরথর করে কাঁপছে, চোখে অসহায় দিশেহারা ভ’য়। বুঝতে পারছে না কী করবে! তখন অতকিছু না খেয়াল করেই চলে আসছিল মাঝ রাস্তায়।

ইভানের দৃষ্টি আটকে যায় সেই এক দৃশ্যে; অতীতের কষ্টের স্মৃতিটা যেন ফের সামনে ফিরে এসেছে! প্রতিফলিত হতে চলেছে। লহমায় শরীর জমে যায়, একচুল নড়তেও পারছে না। চোখ বিস্ফারিত, নিঃশ্বাস ভারী। সুঠাম দেহটা কাঁপতে থাকে। ঠোঁট কেঁপে কেঁপে বেরিয়ে আসে,

-” ইয়ান…তনুজাআআআ..”

কয়েক সেকেন্ড পরপরই নিতি দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে। ভেতরে জমে থাকা আ’তঙ্ক অবশেষে ফেটে পড়ে কণ্ঠে,

-” দিব্য…”

#চলবে

#প্রণয়ের_বাঁধন [ অন্তিম পর্ব শেষাংশ]
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এক অনিশ্চয়তার কাহিনি। যেখানে এক সেকেন্ডে সব কিছু বদলে যেতে পারে। মানুষের জীবনে যে নিরাপত্তার অনুভূতি থাকে, তা কেবল একটি অদৃশ্য স্বপ্ন, কারণ সেকেন্ডেই সব কিছু এলোমেলো হতে পারে। এক সেকেন্ড পর কি ঘটবে? তা থাকে অজানা। আশেপাশে না তাকিয়ে তনুজা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে চলে। হঠাৎ শাড়ির কুচির সাথে পা আঁটকে পিচের রাস্তার সাইড বরাবর জমিনে পরে। নরম হাত দুটি পিচের ছোটছোট ইট-পাথরের উপর পড়ে রক্তাক্ত হয় মূহুর্তেই। ইয়ান মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে, দিশেহারা চোখে চারপাশ দেখছে। দু’দিক থেকে ধাবমান গাড়িগুলো অসুরের মতো ধেয়ে আসছে। ইয়ান নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে, এক বোবা আ’ত’ঙ্ক বাচ্চাটাকে গ্রাস করে ফেলেছে।

তনুজার বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে যাচ্ছে ভ’য়ে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে, নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠছে। চোখ দুটো জলে ভরে উঠে সেকেন্ডেই। কন্ঠনালি রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। বুক ফাটলেও চিৎকার করতে পারছে না। কণ্ঠও যেন আটকে গেছে অসহায় আ’ত’ঙ্কে। চিৎকার করে ডাকতে চায়,

-” ইয়ান, এখানে আসো! এক দৌড়ে মায়ের কোলে এসো!”

কিন্তু ওর গলা চেপে ধরে রেখেছে যেন অদৃশ্য শিকল। দুই হাতের তালু পিচের উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে তনুজা। কিন্তু শরীরে যেন এক ফোঁটা বল নেই। নেতিয়ে পড়ছে পুরো শরীর।

ওদিকে অনুভূতির নার্ভ যেন ভোঁতা হয়ে গিয়েছে ইভানের। ইভান ছেলে আর বউয়ের এহেন দৃশ্য দেখে বাকশুণ্য! সুঠাম দেহটা কাঁপতে থাকে। ঠোঁট কেঁপে কেঁপে বেরিয়ে আসে,

-” ই..য়া..ন…তনুজা..আ.আ.আ..”

গোধূলির নরম আলো পড়ছে তনুজার ক্লান্ত আতংকিত মুখবিবরে। ওর দুচোখের গভীরে এক অনির্বচনীয় আ’ত’ঙ্ক। নিজের দিকে না তাকিয়ে, তাকিয়ে থাকে ছেলের দিকে। ভাঙা কণ্ঠে অস্ফুট স্বরে ফিসফিসিয়ে ওঠে,

-” ই…য়া..ন বা..বা…”

সময় যেন থমকে যায়। অসহায়ের থেকেও অসহায় ঠেকছে সবার। এক নিঃশ্বাসে ছুটছিল দিব্য। ওর চোখ নিবদ্ধ মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ইয়ানের দিকে। পিছন থেকে ধেয়ে আসা ট্রাক যেন এক বিশাল অজগরের মতো গ্রাস করতে আসছে মুহূর্তের ব্যবধানে। ঠিক তখনই এক অটোবাইক পাশ কাটানোর সময় ব্রেক করতে করতে ধাক্কা লাগে দিব্যর গায়ে। বিকট শব্দ ছিঁড়ে ফেলে মুহূর্তের নীরবতা। দিব্য ছিটকে পড়ে সামনে, কপাল ফে’টে যায়। লাল র’ক্তে’র ধারা বয়ে নামে সড়কের রুক্ষ পিচের উপর। কিন্তু ব্যথা অনুভবের সময় কোথায়? দিব্য দিগুন শক্তি নিয়ে ওঠে দাঁড়ায়।ইয়ানের ভীত দৃষ্টির সামনে দিয়েই ছুটে যায়। র’ক্তা’ক্ত কপাল, ধুলো মাখা শরীর নিয়ে তবুও থামেনি দিব্যর পা। ট্রাকের গর্জন ক্রমেই নিকটতর। সময়ের সুতোর শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে দিব্য বড় করে নিঃশ্বাস নেয়। গভীর বিশ্বাসে চোখ বন্ধ করে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইয়ানের দিকে, বাড়িয়ে দেয় বলিষ্ঠ হাত, আঁকড়ে ধরে ছোট্ট বাহুটি। তারপর…তারপর….সব কিছু যেন এক নিমেষে স্তব্ধ হয়ে যায়। নিতি দু’হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে। গলার অন্তঃস্থল থেকে বেরিয়ে আসে এক আকুল আর্তনাদ,

-” দি..ব্য..ও..ও..ও…”

ইভান চোখ বন্ধ করে ফেলে, যেন কিছুই দেখতে চায় না। সময়ের সীমানা ভেদ করে এক তীব্র হাহাকার ছুটে আসে বাতাসে। চারপাশ স্তব্ধ করে দিয়ে বেজে ওঠে হৃদয়ের আর্তনাদ। নিতির চিৎকার যেন ওদের সবার হৃদয়ের গভীরতম শূন্যতাকে স্পর্শ করে। আশেপাশের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে বেদনার আবেশে। তনুজার পক্ষে এত কাছ থেকে সবটা দেখা সম্ভব হয় না, বুকের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে তখনই চোখ শক্ত করে বন্ধ করে ফেলেছিল। এক দম বন্ধ করা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে ঠোঁটের ফাঁক থেকে,

-” ইয়া আল্লাহ! কেনো বারবার আমার সাথেই এমন হয়!”

নিতি দু’হাতে মুখ ঢেকে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। হাঁটুদ্বয় জমিনে গিয়ে ঠেকে। চোখের বাঁধ ভেঙে এলোমেলো কান্না উপচে পড়ছে। কিন্তু গলা দিয়ে একটিও শব্দ বেরোচ্ছে না। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, শোক মেয়েটাকে নিঃশেষ করে ফেলছে। বারবার দুপুরে দিব্যর বলা কথাগুলো কানে বাজছে।

-” আমার উপর তোর খুব অভিযোগ, তাই না? প্রমিজ করছি, আজকের পর থেকে……তোর সব অভিমান হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে… দেখে নিস!”

নিতির ভেতরটা ডুকরে ওঠে। চিৎকার করে বলতে চায়,

-” আমি তো মজার ছলে বলেছিলাম। তুমি কেনো তোমার কথাগুলো সত্যি করতে উঠেপড়ে লাগলে! কেনো? কেনো?”

দিব্যর রাগি মুখ, দিব্যর কখনো অল্প স্বল্প হাস্যোজ্জ্বল মুখ সব যেন একসাথে নিতির চোখে ভাসছে। নিতি ফুঁপিয়ে ওঠে; ঠিক তক্ষুনি কাঁধে উষ্ণ হাতের স্পর্শ অনুভূত হয়। নৃত্য পাশে বসে চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে দৃঢ়ভাবে কাঁধে হাত রাখে। ভেজা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে,

-” আপু, অ্যাই আপু?”

নিতির ফুঁপিয়ে ওঠা বাঁধনহারা হয়। নৃত্য ফের বলল,

-” আপু দ্যাখো..দ্যাখো একবার…”

নিতির বুকের গভীরে সাহসের খোঁজ পাওয়া দুষ্কর। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে, তবু নৃত্যের দৃঢ় আহ্বানে ধীরে ধীরে মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেয়। অস্পষ্ট দৃষ্টিতে সামনের দৃশ্য ধরা পড়ে। সড়কের ধুলো বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। সময়ের প্রবাহে সবকিছুই যেন আবছা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ধূলোর ওপারেই দেখা যায়….দিব্য ইয়ানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে।

নিতির কাছে সবটা যেন স্বপ্নের মতো ঠেকে। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকে ওর হৃদয়। অপরদিকে, তনুজার চোখ দুটো বিস্ময় আর বেদনার এক অপূর্ব মিশ্রণে চকচক করছে, সেখানে জমাট বাঁধা এক গল্প আছে; ভাঙার, গড়ার, আবার নতুন করে জোড়া লাগার।

অপর দিক থেকে আসা বাস ঠিক সময়মতো ব্রেক কষে। কিন্তু বেপরোয়া গতিতে ছুটে আসা ট্রাক থামে না। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার বড় অংশের জন্য দায়ী থাকে ট্রাক। পত্রিকার পাতায় মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে, নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাক রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে উঠে গিয়ে কেড়ে নিয়েছে নিরীহ মানুষসহ পথচারীর প্রাণ। এই তো কিছুদিন আগে রাস্তার পাশের হোটেলে ঢুকে পরে ট্রাক। ঘটনাস্থলেই নি’হ:ত হয় বেশ কয়েকজন।‌ উফ্! আর এটা তো ছিল হাইওয়ে।‌ কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায় ঘটল এক অলৌকিক মুহূর্ত। শেষ মুহূর্তে ইয়ানের বাহু ধরে এক ঝটকায় সরিয়ে নিল দিব্য। সামান্য এদিক-ওদিক হলেই, হয়তো দু’জনেই পিষ্ট হয়ে যেত ট্রাকের নীচে…

ইয়ান থরথরিয়ে কাঁপছে। দিব্যর কপাল বেয়ে র/ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। চারপাশে লোকজন জড়ো হয়েছে। তনুজা আকাশের দিকে তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। দিব্য ততক্ষণে ইয়ানের ছোট্ট মুখটা নিজের হাতের তালুর মাঝে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

-” ভ’য় নেই বাবা। মাম্মার কাছে যাও।”

তনুজা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে দিব্যর দিকে তাকায়। মুখে কিছু বলা হয়ে ওঠে না, কিন্তু চোখে ছিল এক সমুদ্দুর গভীর কৃতজ্ঞতা। দু’জনের মধ্যে আগের সেই জড়তা না থাকলেও কথাবার্তা খুব বেশি হয় না। ইয়ান মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তনুজা ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ওর চোখ বেয়ে নীরবে ঝরতে থাকে অশ্রুধারা।

কখনো প্রকৃতি নির্মমভাবে রিভেঞ্জ নেয়, আবার কখনো সে-ই দিয়ে যায় অপার ভালোবাসা আর প্রতিদান। দিব্যকে বাঁচাতে গিয়ে ইভানের মা প্রাণ হারিয়েছিলেন। আর আজ সেই দিব্য নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে ইভানের ছেলেকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। যদিও জীবন-মৃ’ত্যু সৃষ্টিকর্তার হাতে, তবু এই ঋণ শোধ হওয়ার নয়। ইভান ছুটে এসে দিব্যকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। চোখে অশ্রু, গলায় অস্ফুট ধ্বনি,

-” দিব্য, দিব্য..তুই ঠিক আছিস তো?”

দিব্য র’ক্তা’ক্ত কপালে মৃদু হাসির ছোঁয়া এনে বলে,

-” আ’ম ওকে।”

ইভান পকেট থেকে রুমাল বের করে দিব্যর কপালে চেপে ধরে, কণ্ঠ ভারি হয়ে আসে,

-” ব্লিডিং হচ্ছে, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চল। ব্যান্ডেজ করাতে হবে।”

দিব্য মাথা নেড়ে বলে,

-” এতটুকু কিছু না। বরং বাসায় চল, ইয়ান খুব ভ’য় পেয়েছে।”

কিছু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল নিতি। বুকের ভেতর তোলপাড় চলছে। অভিমানের ভারে পা এগোতে পারছে না। ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে গিয়ে দিব্যর বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলতে। কিন্তু আজ আর নিজের আবেগকে প্রশ্রয় দেয় না নিতি।

নৃত্যর কোলে নাতাশা, ছোট্ট মেয়েটি দিব্যর দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,

-” পাপা! পাপা, তুমি লক্ত! ইশশ…ব্যথা?”

দিব্য এক ঝলক আড়চোখে অভিমানী নিতির দিকে তাকায়। তারপর দৃষ্টি সরিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে গালে চুমু খায়। সস্নেহে ফিসফিসিয়ে বলে,

-” ব্যথা নেই, আমার রাজকন্যা। আমি একদম ঠিক আছি।”

সবার আগে কাছের এক ক্লিনিকে নিয়ে দিব্যর কপালে ব্যান্ডেজ করানো হয়। ডাক্তার প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন। অতঃপর সবাই ফিরছিল বাসায়। গাড়ির ভেতর কেউ কেউ তখনও সেই ভয়াবহ মুহূর্ত নিয়ে কথা বলছিল। এমন সময় দিব্যর কোলের উপর চুপচাপ বসে থাকা নাতাশা ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী গলায় বলে উঠল,

-” আমাল পাপা থুপার হিয়ো!”

এক মুহূর্তের জন্য গাড়ির ভেতর ছড়িয়ে পড়ল আনন্দের উষ্ণতা। নাতাশার মিষ্টি আধো বুলিতে সবাই হেসে উঠল। দিব্য স্মিত হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে থাকে।

___________

সন্ধ্যা পেরিয়ে বাড়ছে রাত। তবু সবার মনে এখনো সেই ভ’য়া’বহ মুহূর্তের ছায়া। একসঙ্গে বসে কথাবার্তা বলার মাঝেও চোখের সামনে ভেসে উঠছে বিকেলের ভয়াবহ দৃশ্য! ফিরেই ইভান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে; সকাল হতেই ফিরে যাবে। এখানে আর এক মুহূর্তও থাকা সম্ভব নয়। ঘুরতে এসে কী যে হতে যাচ্ছিল! দিব্য অনেক বুঝিয়েছে, কিন্তু ইভান অনড়। চোখের সামনে এখনো স্পষ্ট ভেসে উঠছে সেই ঘটনাগুলো, ভাবলেই শরীর শিউরে উঠছে।

ঘড়ির কাঁ’টা রাত এগারোটা ছুঁয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই রাতের খাবার শেষ হয়েছে। নিতি সবার সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে, কথোপকথনে অংশও নিচ্ছে‌। কিন্তু দিব্যর দিকে তাকাচ্ছে না। একটিও শব্দ বলেনি। দিব্য ব্যালকনি থেকে রুমে ঢুকতেই দৃষ্টি চলে যায় বিছানার দিকে। নিতি হাতের উপর থেকে নাতাশার মাথাটা আলতো করে বালিশে শুইয়ে দিচ্ছে। দিব্য কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। নিতি ধীরেসুস্থে উঠে, দিব্যর দিকে না তাকিয়ে ব্যালকনির দিকে পা বাড়ায়। দিব্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে নিতির দিকে। অভিমানী নিতিকে দেখে কিছুটা বিরক্তিও লাগে। নিতি ঠিক দিব্যর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে নেয়, কিন্তু দিব্য হঠাৎই নিতির হাত চেপে ধরে।

নিতি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। দিব্যও ওর দিকে মুখ ফেরায়। চোখে একরাশ প্রশ্ন নিয়ে একপলক দেখেই জিজ্ঞাসা করে,

-” কথা বলছিস না কেন?”

নিতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,

-” আমার কথা বলা বা না বলায় তোমার কিছু আসে-যায়?”

দিব্যর ঠোঁটে ব্যঙ্গের হাসি খেলল। পাল্টা প্রশ্ন ছুঁ’ড়’ল,

-” তোর কী মনে হয়?”

নিতি একদম নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,

-” আমি তোমার কেউ নই। তাই তোমার কিছুই যায় আসে না।”

দিব্যর চোখে এক মুহূর্তের জন্য যেন ব্যথা ঝলকে উঠল। তারপর গা ঝাড়া দিয়ে সেই অনুভূতিটা সরিয়ে দিল। নিতির হাতটা ধীরে ধীরে ছেড়ে দিয়ে এক আঙুল নাকের ডগায় ঘষল। বলল,

-” তুই আমার কেউ নস? তাহলে আমার মেয়ের মা কে? আই মিন, আমার বউ ক_”

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই নিতি তীব্র গলায় বলে উঠল,

-” মেয়ের মা তো তোমার চাহিদা থেকে হয়েছি। নট তোমার ভালোবেসে কাছে টেনে নেওয়ায়।”

দিব্যর র/ক্ত যেন মুহূর্তেই টগবগ করে ফুটতে লাগল। চোখ দুটো রক্তিম হয়ে উঠল রাগে। শক্ত হাতে নিতির দুই কাঁধ আঁকড়ে ধরে এক ঝটকায় কাছে টেনে নিয়ে চিৎকার করে বলল,

-” স্টপ, নিতি.. স্টপ। আর একটাও শব্দ নয়।”

দিব্যর রাগে, চিৎকারে নিতি এতটুকু ভ’য় আজ আর পায়নি। বরং মেয়েটার কণ্ঠে জমে থাকা অভিযোগ গুলো একসঙ্গে উগড়ে এল,

-” একদম চিৎকার করো না! ভালোবাসো তুমি আমায়? থাক, সেটা বাদ দাও।”

এক মুহূর্ত থামল, তারপর আঙুল তুলে মেয়ের দিকে ইশারা করে বলল,

-” মেয়েকে ভালোবাসো? আমার তো তা মনে হয় না! যদি ভালোবাসতে, তাহলে সেই মুহূর্তে একবারও কি ওর কথা মনে পড়ত না? যদি তোমার কিছু হয়ে যেত…”

কথাটা শেষ না করেই নিতির গলা কেঁপে উঠল। চোখের কোণে জল চিকচিক করছিল। তবুও নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা চালায়। দিব্য দাঁত কটমট করে বলল,

-” কী বলতে চাইছিস তুই?”

-” কিছুই না। বাদ দাও।”

-” নিতি, আমি জানি তুই আমাকে খুব বেশিই ভালোবাসিস। আমাকে হারানোর ভয়ে তোর মাথা খারাপ হয়েছে , তাই এমন বলছিস। আজ যদি ইয়ানের জায়গায় নাতাশা থাকত। তাহলে আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করি আমি যেটা করেছি ইভান তাইই করত। আমার যদিও মনে নেই মাম্মা আর দিদুনও বলে; আমার বড়মা আমাকে সেভ করতে গিয়ে প্রাণ হারায়।”

-” আজ বুঝি তারই প্রতিদান দিতে যাচ্ছিলে। আর..আর দুপুরে বলা সব কথা সত্যি করতে যাচ্ছিলে। এই তোমার প্রমিজ ছিলো, নিজেকে বিসর্জন দিয়ে আমার অভিযোগ থেকে মুক্তি পাওয়া।”

দিব্যর রাগ তরতরিয়ে বাড়ল। এক ঝটকায় নিতির কাধ ছেড়ে দেয়। রাগের বশে সেন্টার টেবিলে লাথি মা°রে। টেবিলটা কেঁপে উঠল। উপরে থাকা কাঁচের গ্লাস গড়িয়ে মেঝে নামল। কাঁচ ভাঙার শব্দে নিতি কেঁপে উঠল। ঘুমন্ত নাতাশাও কিছুটা নড়েচড়ে উঠল। দিব্য রাগ দমাতে না পেরে ফের টেবিলে লাথি মা”রার প্রস্তুতি নিল; তবে চোখ পড়ল মেয়ের দিকে। নাতাশার শান্ত ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে, এই চিন্তা মাত্র এক নিমেষে দিব্যকে থামিয়ে দিল। পা থেমে গেল। দুই আঙুলে কপাল স্লাইড করে রাগ কমানোর চেষ্টা করে দিব্য। নিতি কথা না বলে পা বাড়ায়। দু’পা ফেলতেই মৃদু আর্তনাদে বেরোয় নিতির ঠোঁটের ফাঁক গলে,

-” আহ্।”

দিব্য তৎক্ষণাৎ পিছন ফিরে দেখে, নিতির পায়ে কাঁচের টুকরো বিঁধে গেছে। সাদা টাইলসে ছড়িয়ে পড়ছে র°ক্তে°র লাল ফোঁটা। এক সেকেন্ড বিলম্ব না করে, দ্রুত নিতির সামনে বসে। এক মুহূর্তের জন্য নিতির মুখে চোখ রেখেই, তারপর চুপচাপ মেয়েটার ফর্সা পায়ের দিকে নজর দিল। কোনো কথা না বলে, নিঃশব্দে নিতির পা তুলে নিজের হাঁটুর উপর রাখল। একটানে কাঁচের টুকরোটা বের করে দিল। ব্যথায় নিতির চোখ-মুখ কুঁচকে গেল। নিতির দিকে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দিব্য বলল,

-” মাথার সাথে সাথে তোর চোখটাও দেখছি যাচ্ছে। কোন দিকে তাকিয়ে চলিস, হ্যা।”

নিতি কিছু বলে না। তবে অভিমানের বরফ যেন গলতে থাকে। মেয়েটার চোখের ভাষা অনেক কিছুই বলে। নিতি রাগের বশে কথাগুলো বলে ফেলেছে, তবে অতটাও সেলফিশ নয়। নিতির ইচ্ছে করছে ওভাবে বলার জন্য দিব্যকে স্যরি বলতে। নিতি কিছু বলবে সেই সময় দিব্য আদেশের সুরে বলল,

-” বেডে বস।”

নিতি ঠোঁট উল্টে খুঁড়িয়ে বেডে গিয়ে বসে। দিব্য ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আসে। প্রথমে এন্টিসেপটিক লাগিয়ে, তারপর মনোযোগী আলতো হাতের ছোঁয়ায় অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দেয়। নিতির চোখে, দিব্যর যত্নের প্রতিটি মুহূর্ত স্বর্গীয় সুখানুভূতি দেয়। নিতি আবেগপ্রবণ হয়ে নির্নিমেষ দিব্যর দিকে চেয়ে রয়।
.
.
রাত গভীর। আকাশজুড়ে পূর্ণিমার চাঁদ ঠিক যেন রুপোর থালার মতো ঝলমল করছে। ছাদের চারপাশে সারি সারি বড়বড় ক্যান্ডেল জ্বলছে। আলো-আঁধারির মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বাতাসে হালকা দুলে উঠছে শিখাগুলো। ধীরপায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দরজার এপাশে এসে দাঁড়ায় নিতি। কিছুক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল নিতি। হঠাৎ ফোনে কল আসে। ঠান্ডা স্বর,

-” কাম টু দ্য রুফ ইন ফাইভ মিনিটস। দেয়ার্’স আ সারপ্রাইজ‌। কাম সুন।”

ওপাশ থেকে কিছু বলার আগেই দিব্য কল কা’টে। এখন এখানে এসে নিতির বিস্ময় আকাশ ছুঁলো। চেয়ারে বসে দিব্য। পরনে নীল রঙের জিন্স আর সাদা শার্ট। চোখদুটো বুজে গিটারে আঙুল চালাচ্ছে। শার্টের উপরের তিনটি বোতাম খোলা, কপালে সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা। রাতে ক্যান্ডেলের মৃদু আলোয় দিব‌্যর মুখের ছায়া আর আলো এক অভিনব রূপে মিলেমিশে গেছে। গিটারের টুংটাং শব্দগুলো বাতাসে মিশে স্নিগ্ধ, সফট রোমান্টিক সুরে রূপান্তরিত হচ্ছে। নিতি যেন কোথায় হারিয়ে যায়। পরপর নিজেকে ধাতস্থ করে এগোয়। একপাশে টেবিল, উপরে কিছু রাখা। এত সব আয়োজন দেখে নিতি আর বিস্ময় চেপে রাখতে পারল না। প্রশ্ন করে উঠল,

-” হঠাৎ, এসব কিছু! কিন্তু কেনো?”

দিব্যর আঙুল থেমে যায়। উঠে দাঁড়িয়ে ধীরসুস্থে গিটারটা চেয়ারে রাখে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একপল নিতির দিকে তাকায় পরপর দৃষ্টি সরিয়ে জ্ব’লন্ত ক্যান্ডেলের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” তোকে বলেছিলাম না আজকের পর তোর অভিযোগ আর রাখব না। তারজন্য এসবের আয়োজন।”

নিতি নির্বোধের মতোন চাইল। বলল,

-” মানে?”

দিব্য উত্তর দেয় না। নিতি ফের বলল,

-” এসব কিছু কখন আনলে? আর কেনই বা? আই ডো’ন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড।”

-” নো প্রোবলেম, আই’ল এক্সপ্লেইন। বিকেলে ঘুরতে যাওয়ার আগে হাফিজ সাহেবকে বলে রেখেছিলাম।”

-” হুয়াই?”

দিব্য জ্ব’লন্ত ক্যান্ডেলের শিখায় আঙুল এগিয়ে দেয়। বলে,

-” তোর বড্ড অভিমান, অভিযোগ আমাকে নিয়ে। চাইছিলাম না তোর অভিযোগটা রাখতে, আর না তো বাড়তে দিতে।”

এই বলে দুই আঙুল জ্ব’লন্ত শিখার দু’পাশ দিয়ে চেপে ধরার মত ধরে। দপ করে ক্যান্ডেল নিভে যায়। দু’পা এগিয়ে ফের জ্ব’লন্ত শিখায় দুই আঙুল এক করে ছোঁয়ায়। নিতির বুকটা কেঁপে উঠল। তৎক্ষণাৎ দিব্যর হাতের উপর হাত রাখে। চোখে ছলছল জল নিয়ে ইশারায় বারণ করে। ভেজা গলায় বলল,

-” স্টপ। স্টপ দিস।”

দিব্যর চোখে এক অদ্ভুত উন্মাদনা। নিতির চোখের দিকে কিছুপল চেয়ে থাকে। পরপর নিজের হাত ছড়িয়ে উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়াল। দু’হাত ছড়িয়ে দিলো দু’পাশে। আকাশের দিকে মুখ তুলে পরপর চোখ বুজল। তারপর এক গভীর নিশ্বাস নিয়ে চিৎকার করে বলল,

-” আন্ডার দিস ওপেন স্কাই, উইদ দ্য ফ্রি এয়ার অ্যাজ আ উইটনেস, আই সে; ও ওপেন স্কাই অব দ্য নাইট, ও ফ্রি এয়ার, অ্যান্ড দ্য নকটার্নাল ক্রিয়েচার্স। লিসেন! লিসেন….আই লাভ মাই ওয়াইফ সো মাচ! আই লাভ দ্য মাদার অব মাই চিলড্রেন! আই লাভ হার আ লট, আ লট, আ লট!”

দিব্যর কণ্ঠ যেন আকাশকেও স্পর্শ করল। নিস্তব্ধ চারিপাশে শব্দগুলো প্রতিধ্বনি তুলল। ধীরে ধীরে তা বাতাসে মিশে এক অন্যরকম আবহ সৃষ্টি করল। ঠিক তখনই নিতি পিছন থেকে দিব্যকে জড়িয়ে ধরল। গাল ঠেকল দিব্যর পিঠে। মৃদু কাঁপা কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে,

-” লাভিউ টু।”

দিব্য নিতির দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। নিতির একটি হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে সেই হাতটি স্বীয় বুকের বাম পাশে রাখে। তারপর, নিতির চোখে চোখ রেখে, এক একটি শব্দ যেন হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসে,

-” তুই আমার হৃদয়ের সবচেয়ে নরম এক কোণ। তোর ভালোবাসাই আমার অস্তিত্বের কারণ।”

নিতির অনুভূতি যেন মুহূর্তে এক বিস্ময়কর নিরবতার মধ্যে ঢেকে যায়। মন এক টুকরো অমলিন শান্তি ও গভীর ভালোবাসায় ভরে ওঠে। দিব্যের মৃদু স্পর্শ, গা ঘেঁষে থাকা হাত, এবং সেই পরম আকাঙ্ক্ষিত কোমল কথা, সব কিছু মিলিয়ে নিতির মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগ্রত হয়। চোখে আলো জ্বলতে থাকে, একটি অবর্ণনীয় সুখের আভা ছড়ায়। নিতি ঝট করে দিব্যর বুকে মাথা রাখে। দিব্য শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিতিকে। দিব্যর পিছনের শার্ট শক্ত করে পুরে বুকে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে ওঠে নিতি। কিছুপল নীরবতা চলে। নীরবতা ভেঙে নিতির মুখটা তুলে ধরে, আঙুলের ডগা দিয়ে চোখের কোণের পানি ফেলে দেয় দিব্য। নিতি ফুঁপিয়ে বলে ওঠে,

-” স্যরি! আমি তখন ওভাবে বলতে চাইনি। আমার মাথা ঠিক ছিল না। তাই।”

দিব্য মুচকি হেসে নিতির নাকের ডগায় টোকা দিয়ে বলল,

-” নো এক্সপ্লেইন। আই নো। কজ তুই তো একটা পা’গ’লি।”

নিতি হেসে ফেলে। দিব্যর বুকে মুখ লুকিয়ে বলে,

-” হ্যাঁ, তোমায় ভালোবেসে হয়েছি।”

-” রাইট।”

সাদা টেবিলের উপর রাখা লাভ শেপ কেকটি একটি স্বপ্নের মতো দেখাচ্ছে। কেকটির উপরে গোলাপী ও সাদা আইসিং দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। মাঝখানে উজ্জ্বল স্টাইলে লেখা “Niti, I Love You” মিষ্টি অনুভূতির প্রতীক। কেকের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ফুলগুলো সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। দু’জনে একসাথে নাইফ ধরে কেকটি কে’টে, একে অপরকে খাইয়ে দেয়। পরপর টিস্যু দিয়ে হাত আর মুখ মুছে নেয় দিব্য। তারপর, একপাশ থেকে হাতে তুলে নেয় লাল গোলাপের তোড়া। নিতির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

-” তুই আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর আর দামী উপহার। তুই ছাড়া আমার জীবন অসম্পূর্ণ।”

নিতি হাসিমুখে হাতে নিয়ে ফুলের ঘ্রাণ নেয়। দিব্য শীতল কণ্ঠে বলল,

-” আমাদের প্রণয়ের বাঁধন এইভাবেই অটুট থাকুক। আই ওয়ান্ট, এই ভালোবাসা চিরকাল অমলিন আর অবিনশ্বর হোক।”

কথাটা কানে সুরের ন্যায় রিনিঝিনি বাজে নিতির। কয়েক সেকেন্ড পর, কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে শুন্যে আবিষ্কার করে নিতি। দিব্য এক ঝটকায় নিতিকে কোলে তুলে নেয়। ফিসফিসিয়ে বলে,

-” প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। কালকে রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয়নি। এদিকে রাত শেষ হয়ে আসছে। আই নিড রেস্ট।”

নিতি হইহই করে উঠল,

-” আরে..আরে..নামাও। তুমি এমনিতেই অসুস্থ। নামাও আমি হেঁটে যেতে পারব।”

-” দিব্য থাকতে ওর বউ পায়ে ব্যথা নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নামবে! নো নেভার।”

-” আমার পায়ে সামান্য, এটা কিছুই না। বরং তোমার কপ__।”

-” হুঁশ।”

দিব্য থামিয়ে দেয়। বলে,

-” তোকে কোলে তুলে নিয়ে যাচ্ছি, এর বিনিময় রিটার্ন গিফট পেলে আমি হ্যাপি।”

-” রিটার্ন গিফট! কী?”

দিব্য মাথাটা কিঞ্চিৎ নিতির দিকে ঝুঁকিয়ে একদম স্লো ভয়েজে কিছু বলে। নিতির গাল দুটো রেইনবোর সাত রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে দিব্যর বুকে মুখ লুকায়।

_________

সকালে ব্রেকফাস্ট শেষ করে ওরা মির্জা বাড়িতে চলে আসে। নিতি আর দিব্য ইভানকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল, তবে ইভান থাকার পক্ষে ছিল না। অন্যদিকে, নুরজাহান খবর পেয়ে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে ফোনে বলেন,” বাড়ির ছেলে-মেয়ে বাড়িতেই থাকুক, এত বড় একটা বিপদ কে’টে গেল!” এমনিতেই নুরজাহান কখনোই জন্মদিন পালন পছন্দ করেন না। তারপর কালকের ঘটনা শুনে ওদেরকে বাড়িতে ফেরার আদেশ করেন। মির্জা বাড়িতে জন্মদিনের অনুষ্ঠানটা ঘরোয়া পরিবেশেই অনুষ্ঠিত হয়। শিরিনও আর ইভানকে ফোনে চাপ দেয়নি, বরং মনের মধ্যে পরিকল্পনা করেছেন, “বাড়িতে আসুক, এখানেই সবকিছু হোক।”

.
.

সময়টা সন্ধ্যার পরে, তনুজা রুমে রেডি হচ্ছে। সাজগোজ প্রায় শেষের দিকে। এমন সময় ইভান রুমে প্রবেশ করে শুধাল,

-” তনুজা!”

-” হুঁ।”

-” আমার ফোনটা দেখেছো? মনে পড়ছে না কোথায় রেখেছি।”

তনুজা একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে খোঁজে। চোখে পড়ে ওয়ারড্রোবের ওপর ফোনটা রাখা। ফোন হাতে নিয়ে, মিষ্টি হেসে তনুজা বলে,

-” এই তো, এখানে।”

হালকা সাজগোজে তনুজাকে অপ্রতিরোধ্য সুন্দর লাগছে। ইভান শুকনো ঢোক গিলে নেয়। ফোনটি হাতে নিয়ে, মৃদু হেসে বলে,

-” থ্যাংকস, ম্যাডাম।”

তনুজা বিনিময়ে স্নিগ্ধ হাসে। ইভান ফোনটা পকেটে গুঁজে, এক হাত তনুজার কোমড়ে রেখে কাছে টেনে বলে,

-” এই তুমি আজকে কী আমার মাথা ন’ষ্ট করার প্লান করেছো! তোমার কাজলকালো চোখে আমি হারিয়ে যাচ্ছি, তারপর তোমার মুখের স্নিগ্ধ হাসি। আমি তো ক্ষণেক্ষণে ঘা’য়ে’ল হচ্ছি।”

তনুজা দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,

-” আরে, ছাড়ুন তো! দরজা খোলা, বাচ্চারা চলে আসবে কেউ।”

ইভান তড়িঘড়ি বাম চোখ টিপল,

-” তাহলে লকড করে আসি!”

তনুজা কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

-” ধ্যাত!”

ইভান মৃদু হেসে বলে,

-” কপট রাগটাও ঠিকঠাক করতে পারো না।”

এমন সময়, ইয়ানের মিষ্টি কণ্ঠ শোনা গেল,

-” পাপা!”

ইভান তনুজাকে ছেড়ে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াতে শশব্যস্ত হয়ে পড়ল। তনুজা চোখ দিয়ে ইভানকে শাসায়, যেন আরেকটু হলেই লজ্জায় পড়তে হতো। ইভান মাথা চুলকিয়ে, ছেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-” হ্যা, বাবা?”

ইয়ান এগিয়ে এসে বলল,

-” দাদুভাই ডাকছে তোমাকে।”

ইভান ছেলের হাত ধরে এগিয়ে যেতে থাকে, পরপর দরজার কাছে ফিরে তাকিয়ে বলে,

-” নিচে অপেক্ষা করছি, দ্রুত এসো।”

মাথা নেড়ে ‘ঠিক আছে’ বোঝায় তনুজা।
.
.
চারপাশে বিভিন্ন রঙের বেলুন সাজানো। মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা বেলুন নিয়ে ইয়ান আর নাতাশা খেলছে। বাড়িতে আজ মানুষে ভরপুর। শাহারিয়ার মির্জা, নেওয়াজ করীম খোশ গল্প করছেন। নিকট কয়েকজন আত্মীয় স্বজন। শিরিন তাদের সাথে কথা বলছে। তনুজার দাদি এসেছেন। ছেলে গত হয়েছেন পাঁচ বছর খানেক আগেই। ইভানসহ বাড়ির সবাই খাতির যত্ন করছে।

ইয়ান নেভি ব্লু শার্টের উপরে কালো কটি আর অফ হোয়াইট প্যান্টে সজ্জিত। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ভাঁজ করা, সিল্কি চুল কপালের উপর পরে আছে। মুখে মিষ্টি হাসি। বাচ্চা ছেলেটিকে আজ যেন আরও বেশি সুন্দর লাগছে। নাতাশাকে পিংক কালারের বার্বি ড্রেসে পরিপূর্ণ পরীর মতো লাগছে। নরম মুখাবয়ব যেন এক আদুরে ঝলমলে আভা ছড়াচ্ছে।

নৃত্য এদের দু’জনকে ডেকে বলল,

-” এইযে সোনারা, জলদি আসো। এখন কেক কা’টা হবে।”

বড় কেকটি অর্ডার করা হয়েছে। তবে প্রথমে নিতির হাতে বানানো কেকটা কা”টা হবে। নিতি ভালোবেসে তৈরি করেছে। তনুজা বলেছে প্রথমে নিতির বানানো কেক কাঁ’টা হোক।

ইয়ান আর নাতাশা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, ওদের বাবা-মা পিছনে দাঁড়িয়ে। নৃত্য ইয়ানের হাতে ছু/রি দেয়। ইয়ান কেক কা’টতে প্রস্তুত, হঠাৎ নাতাশা চিল্লিয়ে উঠল,

-” আমি… আমি…”

ইভান আলতো হেসে দু’জনের হাতটা একসাথে করে ছু”রি ধরিয়ে বলল,

-” একসাথে কা”টো কেমন!”

দু’জনেই ঘাড় কাত করে। নাতাশা মুখেও বলে,

-” আততা।”

কেক কাঁ’টা শেষে ইভান-তনুজা একসাথে ইয়ান আর নাতাশাকে কেক খাইয়ে দেয়। তারপর দিব্য-নিতি। নৃত্য এসকল দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দী করতে থাকে। এরমধ্যে নৃত্য বলল,

-” ইয়ান বাবা নাতাশাকে খাইয়ে দাও তো। একটা ছবি তুলে রাখি।”

ইয়ান বাধ্য ছেলের মত তাই করল। হঠাৎ করেই নাতাশা আঙুলে কেক জড়িয়ে ইয়ানের গালে ছুঁইয়ে দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। ইয়ানের মুখটা একদম গম্ভীর হয়ে গেল। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নেয়। নিতি টিস্যু দিয়ে ইয়ানের গাল মুছতে লাগল। নুরজাহান হঠাৎ মশকরা করে বললেন,

-” অ্যাই নিতি! তোর মেয়ে তো একদম দুষ্টু। এত রাগি, জিদি, দুষ্টু মেয়ে বিয়ে দিলে; তারা এক দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকাবে আর অন্য দরজা দিয়ে বের করে দেবে তো?”

নিতি হাসতে হাসতে উত্তর দেয়,

-” সে কারণেই তো আমি আগে থেকেই জামাই ঠিক করে রেখেছি। জামাই খুবই ধৈর্যশীল। মেয়ের শাশুড়ি নরম মনের, শ্বশুর কম বাবা হবে। তাই মেয়ে নিয়ে আমার আর কোনো চিন্তা নেই।”

উপস্থিত সবাই নিতির কথা না বুঝলেও তনুজাসহ বেশ কয়েকজন বুঝে নেয়। তনুজা মিটমিট করে হাসতে থাকে।

আজকের এই মুহূর্তটাকে স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখতে ফ্যামিলি ফটো তোলে। কয়েকটা ছবি তোলার পর নৃত্য বলল,

-“এবার মুরব্বি পার্টি বাদ। আমরা ছোটরা একটা সেলফি তুলি।”

ইয়ান এবং নাতাশা সামনে দাঁড়িয়ে, পাশে হাটু ভেঙে বসে নৃত্য। পিছনে তনুজা-নিতি দাঁড়িয়ে, ওদের পাশে বররা। তনুজার একটা হাত ইভানের হাতের মুঠোয়। ওদিকে দিব্যর আঙুলের ভাঁজে নিতির আঙুল। এক মুহূর্তে, যেন সময়টাও থেমে গেল! সুন্দর একটি বাঁধনে এই ছোট ছোট সম্পর্কগুলো মিলে এক দারুণ স্মৃতি হয়ে রয়ে গেল।

#সমাপ্তি