প্রেমসুধা পর্ব-৫০+৫১+৫২

0
394

#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৫০

বহু যুদ্ধের পর শেষ ক্ষণে জয়ী হলো পৌষ। তৌসিফ বলেছে ওরা যাবে হেমন্ত’র বাবু দেখতে। পৌষ খুশি হলেও ততটা হতে পারলো না কারণ মন থেকে বলে নি তৌসিফ। তার চোখ মুখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিলো সে না পারতিতে রাজি হয়েছে। পৌষ যে বুঝে না তা কিন্তু না। পৌষ বুঝে কিন্তু প্রকাশ করতে চায় না। তৌসিফে’র অনুপস্থিতে চাচারা ততটা এগিয়ে আসে নি যদিও তাদের এগিয়ে আসায় কোন ফল হতো না। বড় চাচা ফোন দিয়েছিলেন৷ পৌষ’কে সেখানে যেতেও বলেছিলেন। ছোট চাচা দুই বার ফোন করেছিলো। ভাই-বোন গুলো ছোট ছোট। তারা আদৌ কতটা জানে পৌষ জানে না। ওদিকে শ্রেয়ার অবস্থা ছিলো ভয়ংকর খারাপ। হেমু ভাই যে এসেছিলো তাই তো বেশি। এই তো একটু আগেও ফোন দিলো হেমু ভাই। কিছুটা রাগ তারা। ইনি, মিনি আর পিহা জানে না। তারা বায়না ধরে এখানে আসার কিন্তু বড়রা আসতে দেয় না। এটার কারণ আছে। এ বাড়ীর মানুষ জনের মুখ ছুটা। কখন, কে, কে বলে ফেলে বলা মুশকিল। তৌসিফ’কে তারা ভয় পেলেও একা পেলে তাদের কথার ঝুলি খুলে বসে যেন।
জৈষ্ঠ্য আর চৈত্র প্রায়ই ফোন করে। যেতে বলে কিন্তু পৌষ তো পারে না।
পৌষ ছোট থেকে চাচা,চাচিদের এই রুপ ব্যবহারই দেখে আসছে। এখানে কাউকে সে দোষ দেয় না। তার কপালে নেই সেই আদর। মা নেই, বাবা নেই তাকে এতটা বছর পেলেছে এটাই বা কম কিসের?
পৌষ’র অবশ্য এখন আর আফসোস নেই। তৌসিফ তাকে সবটা দিয়েছে। এত আদর পৌষ ইহকালে পাবে তা কোনদিনই ভাবে নি।
তৌসিফ চাচাদের গা ছাড়া ভাব দেখেই ও বাড়ী মুখী হতে চায় না কিন্তু পৌষ তো মনকে মানাতে পারে না। তার মন কিছুতেই মানে না। বেহায়া মনটা শুধু ছুটতে চায় ঐ বাড়ী। তার আপন নীড়ে।

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তায়েফা। হাতে গরম গরম কিছু তৈরী করে এনেছে। পৌষ হাসিমুখে বললো,

— আপা ভেতরে আসুন না।

— বারান্দায় কি তোর? ঠান্ডা কত? তুসু দেখলে ধমক খাবি।

পৌষ চাপা হাসলো। “তুসু” নামটা তার দারুণ লেগেছে। ভেবেছে মাঝেমধ্যে “তুসু ভাই” বলে ডাকবে।
মামাতো ভাই ডাকলে তার সে কি রাগ! “তুসুভাই” ডাক শুনলে এবার পৌষ’কে কাঁচা না চিবুলেই হলো।
তায়েফা এগিয়ে এলো। পৌষ তায়েফা’কে বসার জায়গা দিয়ে বললো,

— কি এনেছেন আপা?

— তোর জামাই ফোন দিলো। কঠিন ভাবে বললো তার বউকে গরম কিছু খাওয়াতে।

পৌষ’র চোখ দুটো আকারে বড় হলো। লোকটা এত কেন পা’গল? তার পা’গলামির শেষটা কোথায়? মিনু হাতে করে কাপড় এনে পৌষ’র বিছানায় রেখে জিজ্ঞেস করলো,

— ছোট ভাবী, এগুলো কি আলমারিতে রাখব?

তায়েফা হ্যাঁ বলার আগেই পৌষ না করে দিলো। তার পছন্দ না কেউ তৌসিফে’র কাপড় ধুরুক। আলমারিতে প্রয়োজনীয় কত কাপড় থাকে। পৌষ একদমই চায় না কেউ ধরুক সেগুলো।
মিনু চলে যেতেই পৌষ তায়েফা’র আনা স্যুপের বাটিটা নিজের কাছে নিলো। তায়েফা নজর দিলো পৌষ’র দিকে। অসুস্থ চেহারাটা ভাঙা ভাঙা৷ এজন্য সে কি রাগ তৌসিফে’র।
তায়েফা দোয়া করে তার ভাই ভালো থাকুক। সুখী হোক। গলা হালকা করে তায়েফা বললো,

— শরীর এখন কেমন পৌষ?

— আলহামদুলিল্লাহ আপা। ভালো তো।

— আজ বেরুচ্ছিস?

— হ্যাঁ। বাড়ী যাব।

— থাকবি?

— উনি তো যেতেই দেন না সেখানে থাকব কিভাবে?

পৌষ’র মনটা খারাপ হয়। তায়েফা ওর হাত ধরে বলে,

— তুই জানিস ও তোকে কতটা চায়?

— জানি তো আপা। আমিও তাকে চাই খুব করে।

তায়েফা’র ভালো লাগে। মেয়েটা অনুভূতি চাপিয়ে রাখে না৷ সব বলে দেয়। মনের মধ্যে কোন প্যাঁচগোচ নেই। তায়েফা বললো,

— শুরুর দিকে তোকে বলেছিলাম বাচ্চার কথা। জানি তখন তুই রেগেছিস আমার উপর। ভেবেছিস কেন এতটা পার্সোনাল কথা আমি বললাম। দেখ পৌষ, আমি তো আজ থাকব কাল চলে যাব। তুই তো আজীবন থাকবি সোনা। তৌসিফটার বয়স হয়েছে বাবা হওয়ার। তার কি সখ হয় না বল? ও তোর কাছে সরাসরি চাইছে নাকি চাইবে না তা আমি জানি না কিন্তু আমি চাই তুই ওকে বুঝার চেষ্টা কর। তোকে পা’গলের মতো ভালোবাসে। নিজেদের মধ্যে ঝামেলা থাকলে মিটিয়ে ফেল। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ফেল এখনই। এখন যদি তোকে ও বুকে করে রাখে তাহলে তখন রাখবে মাথায় করে। তোর পড়াশোনায়ও ক্ষতি হতে দিবে না। তুই কি বুঝতে পারছিস? এখন কত কত সমস্যা মানুষের। এখনই উচিত সময়।

পৌষ মাথা নিচু করে সবটা শুনলো। বাচ্চা তো তৌসিফ চেয়েছে অনেক আগেই। সে জাহির করেছে সে ভালোবাসে বাচ্চাকাচ্চা কিন্তু কি করবে যদি বাবু না হয়? পৌষ কোথা থেকে আনবে বাবু? চোখ দুটো ছলছল করে উঠে ওর। বুকটা কামড়ে উঠে। তাহলে কি পৌষ’রই কোন সমস্যা আছে? কলিজাটা যেন মোচড় দিলো। মাথা তুলে তাকাতেই তায়েফা চমকালো। বলে উঠলো,

— এই কি হয়েছে? কেন কাঁদছিস? কষ্ট পেলি সোনা? আমি তো….

— আপা…..

— হ্যাঁ বল।

— আমার মনে হয় সমস্যা আছে।

— মানে? কিসের সমস্যা?

— বাবুর সমস্যা। এতদিন হয়ে গেলো এখনও কেন কিছু হলো না।

বলতে বলতে ঝরঝরে কেঁদে উঠলো পৌষ। তায়েফা মাথায় হাত দিলেন। বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন,

— আরে পা’গল আগে তো চেক করতে হবে।

— উনি একবার করেছিলো আপা। কিছুই হয় নি। আমার মন বলছে আমার সমস্যা আছে। উনি যদি আমাকে ছেড়ে দেন?

— থাপ্পড় খাবি৷ পা’গল কোথাকার। আচ্ছা থাম তো আগে। আমি দেখি একটা গাইনোকজিস্টের সাথে কথা বলি। তোকে নিয়ে দেখিয়ে আনব৷

— ওনাকে বলব না?

— না। দরকার নেই। আমি তো দেখি।

পৌষ’র মন অশান্ত। কি হলো এটা? তার মাথায় কেন আগে এলো না? বুকটা ভয়ে টিপটিপ করছে।
_________________

— তোমার মনটা ভার দেখাচ্ছে।

— কই না তো।

বলতে বলতে কাপড়গুলো ভাজ করে আলমারিতে তুললো সোহা। মেহেদী সেদিকে তাকিয়ে বললো,

— মন খারাপ?

— না।

— মিথ্যা বলো না সোহা।

— সত্যি বলছি।

— তাহলে চোখের দিকে তাকিয়ে বলো।

— দেখুন…

— দেখাও।

— আমি বলছি রাগ করে নেই আমি।

মেহেদী ওকে টেনে কাছে নিলো। গাল দুটো হাত দিয়ে ধরে বললো,

— অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো ঘটনাটা৷ আম্মা কতটা ব্যথা পেলো।

সোহা চুপ রইলো৷ মেহেদী ওর হাতটা নিজের বুকে জড়িয়ে বললো,

— আমরা আরেকদিন যাব…

— তার প্রয়োজন নেই। টাকা জমানো উচিত।

— তুমি এখনও রেগে…

সোহা ঝট করে উঠে গেলো। কিছুটা তেজী গলায় বললো,

— কেন মনে হচ্ছে রেগে আছি আমি? কখন বলেছি রেগে আছি আমি? কেন বারবার একই কথা বলছেন বলুন? দোষী করছেন আমাকে?

— দোষী করছি মানে? কি বলছো?

— ঠিক বলছি, আপনার মা ভাবছে আমি ইচ্ছে করে ফেলেছি তাকে। ঐ বাথরুমে একবারও যাই নি আমি। উনি তবুও বারবার বলছেন আমিই নাকি করেছি কাজটা। বাংলা ছবির কাহিনী শুরু করেছেন সবাই।

মেহেদী চমকে তাকালো। অবক স্বরে বললো,

— মা বলেছে?

— একবার না বারবার বলছেন। যে বাড়ীতে আসছে তাকেই বলছেন। বিয়ের কয়দিন হলো আপনার মা আমাকে পছন্দই করতে পারছেন না। কি সমস্যা তার?

— সোহা! আস্তে।

সোহা রাগে ফুঁসতে লাগলো। মেহেদী উঠে দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরতে নিলেই ঝটকা মা’রে সোহা। মেহেদী রাগী কণ্ঠে বলে,

— কথা বলছি।

— দূর থেকেই বলুন।

— আশ্চর্য!

— হ্যাঁ, আশ্চর্যই আমি। ছুঁবেন না।

— ও তাই নাকি? আমার ছোঁয়া থেকে এত তারাতাড়ি মন উঠে গেলো?

সোহা আচমকা থমকে গেলো। শুধু জিজ্ঞেস করলো,

— কি বললেন?

— কেন ভুল বললাম?

— কার সাথে খারাবি দেখেছেন আমার?

— পুরো এলাকায় গুঞ্জন হতো তোমার।

— জেনে শুনে বিয়ে করেছেন। ওওও এক মিনিট, এজন্যই আপনার মা আমাকে পছন্দ করে না৷ আগে বললেই হতো। কষ্ট করে কেন বিয়ে করলেন? দয়া কেন দেখালেন?

মেহেদী সোহার চোয়ালটা চেপে ধরে। চিবিয়ে বলে,

— মন চেয়েছে তাই।

— ছাড়ুন আমাকে।

“মেহেদী” “মেহেদী”……

মায়ের ডাক কানে আসতেই মেহেদী থমকে গেলো। কি করছিলো মাত্রই? কি ই বা বলে ফেললো? এসব তো মনের কথা না তার তাহলে মুখে কেন এলো?

ওপাশ থেকে আবারও শোনা যাচ্ছে বাবার গলা,

— চিল্লাপাল্লা কিসের মেহেদী?

মেহেদী সোহা’র চোয়াল ছেড়ে দিতেই সোহা দূরে সরলো। শ্বাস টানলো অবিরত। মেহেদী’র বুকটা জ্বলে উঠে। ও তারাতাড়ি করে চলে গেলো ওখান থেকে। সোহা ধপ করে বসে পরে। তার সুখ নেই। থাকবেও না। অন্যের খারাপ চাওয়া এবং খারাপ করা মানুষদের সাথে ভালো হয় না। পৌষ’কে নানান ভাবে জ্বালিয়েছে সোহা। তার সংসার জীবনে নানান ঝামেলা করার চেষ্টা করেছে। তার কুফল এখন সোহা’র কপালে এলো বলে। মেহেদী আজ বলেই ফেলেছে। এলাকার সবাই গুঞ্জন তুলে কিন্তু এ ঘটনার সত্যতা কারো জানা নেই। কেউ জানে না। তৌসিফ তাকে দয়া বাদে কিছুই করে নি। না কখনো করবে।

#চলছে….

#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৫১

— তুমি কিছু লুকাচুরি করছো হানি?

গায়ে টিশার্ট জড়াতে গিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করে তৌসিফ। হঠাৎ প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো পৌষ৷ পেছন থেকে তৌসিফে’র টিশার্ট টেনে নামিয়ে দিয়ে নিজেকে সামলে পাল্টা প্রশ্ন করে,

— আমাকে চোর মনে হয় আপনার?

— হওয়ার কি আছে। চুন্নি ই তো তুমি।

দুই কদম পেছনে সরে পৌষ। অবাক স্বরে বলে,

— আপনার সংসার থেকে কয় পয়সা হাতিয়ে বাপের বাড়ী পাঠালাম আমি যে এই কথা বলছেন? কখন দেখেছেন কিছু ধরতে? ভালোই হলো কথাটা বলে দিলেন। আজ থেকে সাবধান থাকব।

ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে কথাগুলো বললেও তৌসিফ ভ্রু কুঁচকালো৷ ভালো লাগে নি তার কথাগুলো। ফাইজলামি করে বললেও ভালো লাগে নি। এটা কেমন কথা? পৌষ’র পিছনে হাত দিয়ে মাথায় করা ঝুটিটা ধরে তৌসিফ। আলতো হাতে চাপ দিয়ে নিজের কাছে এনে মুখটা নামিয়ে বলে,

— চোরকে চোর বলেছি তাতে এত রাগ কিসের?

পৌষ ঢোক গিললো। তৌসিফে’র মেজাজ বিগড়েছে এটা বুঝতে তার সময় লাগে নি৷ পৌষ ঠোঁটটা চওড়া করে হাসতে চাইলো কিন্তু তার আগেই তৌসিফ বলে উঠলো,

— আমার ভালোবাসা চুরি করেছো তুমি।

পৌষ আড় চোখে তাকাতেই তৌসিফ বললো,

— এভাবে চোখের ইশারা দিয়ে আর কত মা’রবে আমাকে হু?

পৌষ মাথাটা নিচু করে হালকা স্বরে বলে,

— আমি কি আপনার মেজাজ খারাপ করে দিলাম?

— তোমার কি মনে হয়?

— হ্যাঁ মনে হয়।

— কথা বলার সময় বুঝে বলা উচিত। এই যে কথা দিয়ে আঘাত দিলে কতটা ব্যথা পেলাম। কোনদিন বলেছি কিছুতে হাত দিও না বা কোন জিনিস তোমার না? বলি নি। এ-র মানে আমার সবটাই তোমার পৌষরাত।

— আমি কিন্তু….

— তুমি সেভাবে না বললেও ইট ডাজেন্ট সাউন্ড গুড হানি।

— আচ্ছা। মাফ চাইছি। খুবই দুঃখীত।

— এত সোজা?

ঠোঁট উল্টে পৌষ জিজ্ঞেস করে,

— কি করতে হবে?

— দাঁড়াও সোজা হয়ে দেখাচ্ছি আমি।
.
মাথা নিচু করে রুম ত্যাগ করে পৌষ। ভালোই লজ্জা পেলো সে। তৌসিফ পেছন থেকে হাতে একটা শাল দিয়ে এলো। বাইরে এখন ভালোই ঠান্ডা। কুয়াশায় আচ্ছন্ন চারপাশ। তায়েফা’কে বিদায় জানিয়ে ওরা বেরিয়ে এলো। উদ্দেশ্য তৌসিফে’র শশুর বাড়ী। বউয়ের আবদার ফেলতে না পেরে এই যাত্রা নাহয় ও বাড়ীতে নিজের পায়ের ধুলা দিতে কোন ভাবেই রাজি না তৌসিফ। পৌষ’র চাচারা যে স্বার্থপর তা ঢের জানা আছে তার।
এজন্যই তৌসিফ পৌষ’র দূরত্ব বাড়িয়েছে ও বাড়ী থেকে। যদিও এতে পৌষ’র মন খারাবি তার নজরে পরে কিন্তু করার কিছুই নেই। ভাই-বোনদের সাথে পৌষ ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বললেও তৌসিফ না করে না কিন্তু ঐ যে, সরাসরি দেখা সেটও করতে দেয় না থাকাতো পরের কথা।

গাড়িতে উঠেই পৌষ জিজ্ঞেস করলো,

— আমি সোজা ওখানে যাচ্ছি তাই না?

— হ্যাঁ।

পৌষ নজর ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখলো। সামনে ড্রাইভার। আগে পরে কোন প্যাকেট তো দূর পানির বোতল বাদে কিছুই নেই। অল্প লজ্জা পেলো পৌষ। ইনি, মিনির জন্য অন্তত চিপস নেয়া যেতো। বাবুর হাতেই বা কি দিবে পৌষ? তৌসিফ তো কিছুই বললো না। হঠাৎ নিজের গলায় হাত যেতেই মনটা উৎফুল্ল হলো। পাতলা একটা সোনার চেইন। এটা পৌষ’র নিজের। গলা থেকে খুশি হাসিমুখে এটাই দিবে পৌষ। চেইনটা তার খুবই প্রিয়, মায়ের কি না। পৌষ ভাবলো হাসিমুখে দিতে দিতে বানিয়ে ছানিয়ে কিছু বলে দিবে। কেউ বুঝবে না। কাজটা অবশ্য তৌসিফে’র অগোচরে করা দরকার। যদি বুঝে আবার মাইন্ড করে। পৌষ অবশ্য আশা রাখে না তাই হতাশ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে অতি সূক্ষ্ম এক আশা তো ছিলো যে তৌসিফ নতুন বাবুকে ফুপা হিসেবে কিছু দিবে।

আলতো হাতে নিজের কাছে টানলো তৌসিফ। পৌষ মাথাটা কাঁধে রাখতেই তৌফিক জিজ্ঞেস করলো,

— তখন বললে না কি লুকাচ্ছিলে?

পৌষ যেন মহা বেকায়দায় পরলো। এই লোক এত চতুর। তায়েফা’কে বলে পৌষ কাল ডেট নিয়েছে। ডাক্তার দেখাবে। তার মনটা কু ডাকছে। মনে হচ্ছে নিশ্চিত কোন সমস্যা আছে তার।
তৌসিফে’র শক্ত হাতের মাঝে নিজের ছোট হাত রাখে পৌষ। ছোট্ট করে বলে,

— একটা তুলতুলে হাত দরকার মাঝখানে।

— হুম।

— আপনার বাবু অনেক পছন্দ।

— অনেক।

— আমাদের বাবু আসলে আমার আদর কম পরবে না তো?

— প্রশ্নই উঠে না। উল্টো বাবু তোমাকে আদর করবে। ভালোবাসবে।

পৌষ ক্ষুদ্র শ্বাস ফেললো। তার ভেতরটা চুপসে যাচ্ছে বারংবার।
.
গেটের সামনে গাড়ি থামতে না থামতেই হুরমুর করে বাচ্চাগুলো ছুটে এলো। আপা ডাকের বন্যা বয়িয়ে দিয়ে তারা একসাথে জড়িয়ে ধরলো আদরের বোনকে। নিখাঁদ এক ভালোবাসা এদের। পৌষ কেন জানি কেঁদে ফেললো। ওর বুকটা হু করে উঠলো। হাজার স্বামী ভালোবাসুক কিন্তু এদের ভালোবাসা তো ভিন্ন। ছোট থেকে এখনে বড় হলো পৌষ অথচ এখন দিনের পর দিন এদের দেখা মিলে না। চাইলেও তৌসিফ করতে দেয় না।
ইনি, মিনিকে একসাথে কোলে তুলে তৌসিফ। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে চাচিরা সহ হেমন্ত বেরিয়ে এলো। বাড়ীতে ভালোই আয়োজন হচ্ছে। পৌষ অবাকই হলো। মুখে এখনও কিছু বলতে পারলো না ও। কেন জানি মুখ দিয়ে কথা বেরুয় না।
পিহা ওকে জড়িয়ে ধরেই আছে। কান্নারত গলায় ডাকে,

— আপা?

— হু।

— তোমার কাছে কত যেতে চাইলাম কেউ নিলো না আপা। জৈষ্ঠ্য ভাই দুই দিন খায় নি। চৈত্র ভাইকে গালিগালাজ করেছে চাচা।

পৌষ চাপা স্বরে বলে,

— কেন?

— তোমার কাছে যেতে চাইছিলো বলে।

পৌষ’র গলা ধরে আসে। জৈষ্ঠ্য গম্ভীর অথচ বোনের হাতটা ধরে আছে। চাচিরা হাসিমুখে ভেতরে নিতেই পৌষ বসলো না বরং হেমন্তকে জিজ্ঞেস করলো,

— ভাবী তোমার রুমে?

— হ্যাঁ।

পৌষ তৌসিফে’র দিকে তাকিয়ে বললো,

— আপনি একটু বসুন আমি দেখে……

–আমিও দেখব।

পৌষ ঢোক গিললো। তৌসিফ গেলে গলার চেইনটা কিভাবে দিবে ও? না দিলেও তো খারাপ দেখায়।
ঠোঁট কামড়ে এগিয়ে গেলো পৌষ। শ্রেয়া ওকে দেখা মাত্রই হাত বাড়ালো। বাড়ন্ত হাতটা ধরে পৌষ। ছলছল চোখে দু’জন কথা বলে কিন্তু কণ্ঠনালী ভেদ করে কথা আসে না। হেমন্ত বুঝে। তৌসিফ’কে বসতে দিয়ে বলে,

— আমার ছেলে দেখবি না?

পৌষ মাথা নাড়ে। পাশ থেকে ঘুমন্ত ছোট একটা জানকে কোলে তুলে হেমন্ত। পৌষ’র শরীরটা শিউরে উঠে। অতি নরম, ছোট্ট একটা দেহ। পৌষ হাত বাড়াতেই হেমন্ত দিয়ে দিলো। পৌষ মাশা আল্লাহ বলেই বললো,

— এত তোমার মতো হলো হেমু ভাই।

হেমন্ত মাথা নাড়ে। শ্রেয়া বলে,

— নাকটা তোর মতো।

তৌসিফ উঠে এলো। আগ্রহ নিয়ে বললো,

— আমার কাছে দাও।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে তৌসিফ কোলে তুলে চুমু দিলো কপালে। নরম সুরে নানান কথা বললো ছোট্ট ঘুমন্ত এক বাচ্চার সাথে। পৌষ’র বুক কামড়ে উঠে। যদি ওর বাচ্চা নাহয় তাহলে তৌসিফ কি করবে? ওকে ছেড়ে দিবে? দিতেই বা কি? যার টাকা আছে তার কি বউয়ের অভাব হয়? পৌষ’র মাথা ভনভন করছে। ও শ্রেয়ার পাশে বসে পরলো। মনে মনে বললো, “উনি তোকে ভালোবাসে। বাবুর জন্য ছাড়বে না”।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে পকেট থেকে একটা লাল বাক্স বের করে তৌসিফ যার ভেতরে ছোট্ট একটা চেইন জাতীয় কিছু। তৌসিফ দিতে দিতে বললো,

— ছেলেদের তো স্বর্ণ নিষিদ্ধ তাই প্লাটিনাম দিলাম। নিয়ম তো মুখ দেখে স্বর্ন দেয়া। তবে সেটা তোলা রইলো। ছেলের বউকে দিয়ে পুষিয়ে দিব।

বাচ্চাটাকে পুনরায় বুকে জড়ালো তৌসিফ। তাকে এই প্রথম এত কথা বলতে দেখলো হেমন্ত আর শ্রেয়া।

হাজারো বায়না, মুখ গোমড়া বা আবদার কোনটাই কাজে লাগলো না। চাচারা সহ অনুরোধ করলো থাকতে কিন্তু তৌসিফ অনড়। তার বউ অসুস্থ। কিছুতেই রেখে যাবে না আর না ই এখানে সে নিজে থাকবে।
পৌষ ভাই-বোনকে জড়িয়ে আদর করে বেরিয়ে গেলো। তৌসিফে’র দিকে তাকালো না অব্দি। পেছনে তৌসিফ বিদায় জানিয়ে নিজেও উঠলো। গাড়িতে বসা মাত্রই পৌষ একটু দূরে সরে বসে। তৌসিফ জানে রেগে ফুলে আছে তার বউ। এখন একে ঘটাতে গেলেই উল্টো তৌসিফ’কে ঘেটে দিবে। না জানি ড্রাইভারের সামনেই কি বলে ফেলে। ভরসা নেই তার বউকে।
তবুও তার ভালো লাগলো না দূরত্ব। নিজে কাছে যেতেই পৌষ আর নড়ে না৷ তৌসিফ আলগোছে পৌষ’র মাথাটা নিজের বুকে নিলো। আলতো হাত বুলালো গালে। কপালে চুমু দিয়ে বললো,

— আবার এসো।

— তার আর প্রায়জন হবে না।

ঠান্ডা স্বর। বড়ই ঠান্ডা যেন বরফ। তৌসিফ ভাবুক হলো। বউটা কি তাহলে বেশিই রেগে আছে? তার রাগ প্রকাশের মাধ্যম তো চিল্লাপাল্লা করা এভাবে ঠান্ডা হওয়া না৷ শালটা দিয়ে ভালো মতো পৌষ’কে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। পৌষ চুপ একদম। কথা বললো না। তৌসিফ বেশিই হাশফাশ করছে। একবার গালে হাত বুলাচ্ছে তো একবার মাথায়। তোতাপাখিদের তো চুপ থাকতে নেই। তারা বুলি ছড়াবে। সারাক্ষণ কথা বলবে।

_____________________

সোহা শাশুড়ী’র খাবারটা রুমে এনে দিতেই তিনি বললেন,

— স্বামী স্ত্রী ঝগরা লাগবেই। সেখানে শোনা যাবে একজনের গলা। দু’জন চিল্লাপাল্লা করলে আশেপাশের মানুষ কি বলবে?

সোহা চমকালো। শাশুড়ী তাকে পছন্দ করে না এটা তো স্পষ্টই। সোহা খাবার রেখে জিজ্ঞেস করলো,

— কিছু লাগবে আর?

— না। যাও এখন। তোমার শশুরকে খাবার দাও।

— আচ্ছা।

সোহা বেরিয়ে গেলো। টেবিলে খাবার দিতেই মেহেদীও চলে এলো। খেতে বসা মাত্রই শশুর ওকেও খেতে বলে। সোহা খায় না৷ জানায় পরে খাবে। অল্প খেয়ে মেহেদী উঠে গেলো। মায়ের কাছে গিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে বেরিয়ে গেলো মেহেদী। সোহা এসে আবার সবটা গুছিয়ে দিলো। জানালো,

— আজ আপনার সাথে ঘুমাই আম্মা। রাতে যদি সমস্যা হয়?

— দরকার নেই। ঘরে যাও।

সোহা তবুও শাশুড়ী’র পায়ের কাছে বসলো। মন চাইলো জিজ্ঞেস করতে, তার কেন অপছন্দ সোহা’কে কিন্তু প্রশ্ন করার প্রয়োজন পরলো না। সোহার ভেতরটা চিৎকার করে বললো, ” তুই নিজে ভালো যে কেউ তোর ভালো করবে?”

শাশুড়ীর ধমকে রুমে এলো সোহা। তার মনে হলো দাপট ধরে রাখা উচিত ছিলো। ঐ যে প্রথম রাতেই স্বামীর কাছে সবটা বিসর্জন দিলো তাই তো আজ মাস না গড়াতেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হচ্ছে তাকে।
সোহা ভাগ্যর উপর রাগ দেখালো। মিনু ফোন দিয়ে মন খারাপ করে। তাকে এখানে আনতে হবে। সোহা’র বাচ্চার মতো মিনু।
মেহেদী খাটের ওপর বসা ছিলো। সোহা’কে আসতে দেখেই উঠে দাঁড়ালো। সোহা ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে খাটের এক প্রান্তে শুয়ে পরে। মেহেদী কথা বলবে ভেবেছিলো কিন্তু হলো না। সে নিজেও সোহা’র পাশে শুয়ে পরে। রাত বাড়ে সেই সাথে পাল্লা দিয়ে ঠান্ডা। মেহেদী সোহা’র পিঠে হাত রাখতেই সোহা বলে উঠলো,

— শরীর ভালো না।

মেহেদী চমকালো। ওর বুকটা ধকধক করছে। ও তো তেমন কিছু ইঙ্গিত দেয় নি। সোহা তাকে ভুল ভাবছে। সে তখনকার কথা গুলো মন থেকে বলে নি। কিভাবে যেন বেরিয়ে গেলো মুখ থেকে।
মেহেদী হাতটা ধরে নিজের কাছে টানতেই সোহা এলো। স্থান পেলো বুকে অতঃপর ফুঁপিয়ে করা কান্না। এক ঝাক অভিযোগ।

_____________________

বিছানার উপর বসা পৌষ। তৌসিফ ওকে নামিয়ে দিয়ে বাইরে গিয়েছিলো। ফিরলো মাত্র। পৌষ খাবার আনলো না। নিজের কাজ সে নিজে করুক। পরক্ষণেই আর টিকতে পারলো না। উঠে গিয়ে খাবার বুয়াদের দিয়ে গরম করিয়ে টেবিলে রাখালো। তায়েফা ঘুমিয়ে যাওয়াতে পৌষ’র কথা হলো না।
মনটা বড্ড খারাপ হয়ে আছে কি না। তৌসিফ অবশ্য বুঝলো বউ এর মন খারাপ কিন্তু সে মানতে নারাজ।
টেবিলে বসেই বললো,

— তুমি বসছো না কেন?

— খাব না।

— না করার সুযোগ নেই।

— আপনার ইচ্ছে মতো খেতে হবে?

— অবশ্যই। চুপচাপ বসো এখানে।

তৌসিফ গম্ভীর কণ্ঠে বলায় পৌষ বসে। তৌসিফ নিজে মুখের সামনে ভাত ধরতেই পৌষ বললো,

— আমি হাত দিয়েই খাব।

— না শুনতে চাইছি না।

পৌষ মুখে দিলো যদিও বেশি খেলো না। ঘুমাতে গিয়েও তার রংঢং দেখা গেলো আজ। সে নাকি এই রুমে ঘুমাবে না। তৌসিফ ধৈর্য্যর পরিক্ষা বেশিক্ষণ দিলো না। দরজা আটকেই দিলো এক ধমক।
বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে দুই পা পিছু হটলো পৌষ। ভয় যে পেয়েছে তা তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তৌসিফ এগিয়ে এসে ওর হাতটা ধরতেই অভিমানে টইটম্বুর পৌষ হুহু করে কেঁদে উঠে। তৌসিফ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজের কাছে নিয়ে বিছানায় বসলো। মাথায় হাত বুলালো। বুকে ঠাই দিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বললো,

— ওই বাড়ীতে থাকতে দিলাম না বলে এত অভিমান?

— আমার ভালো লাগে না।

— তারা স্বার্থপর।

— স্বাভাবিক।

— এমন আত্মীয় দিয়ে কি হবে পৌষ? তোমাকে আমি ভালোবাসি না? বলো বাসি না? আমার ভালোবাসা এতই কম পরলো যে একদিন থাকতে না দেয়াতে তুমি এতটা কাঁদছো?

পৌষ’র কান্না থেমে গেলো হঠাৎ। তৌসিফ ওর ভেজা গাল মুছে দিলো। পুণরায় বললো,

— শুধু আমার প্রেমে মাতোয়ারা থাকো পৌষরাত। আমার হয়ে থাকো। আমি সারাজীবন তোমায় আমার করে রেখে দিব।

পৌষ শুধু বললো,

— আমি ছোট বেলা থেকে ওখানে থেকেছি। তারাই পেলেপুষে আমাকে বড় করেছে।

— অস্বীকার করছি না। তুমি কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি।

— আমি কিছুদিন থাকতে চাই ওখানে। আপনি কেন এমন করছেন?

— আমার কথা অমান্য করে যেতে চাইলে যাও।

পৌষ চুপ করে গেলো। তৌসিফ জানে কিভাবে কাকে থামাতে হয়। পৌষ’র আরো কাছাকাছি আসতেই পৌষ বলে উঠলো,

— আপনার ভাইদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিন।

মুখ তুলে তৌসিফ প্রশ্ন করে,

— কারণ?

— তারাও স্বার্থপর।

— কে বললো?

— আমি বললাম। তাদের কাছে সাহায্য চেয়েও পাই নি।

তৌসিফ পৌষ’কে নিয়ে শুয়ে পরলো। কপালে চুমু দিলো। গালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

— ভাই সবচাইতে বেশি সাহায্য করেছে। তারা জানতো আমি কোথায় আছি তাই তোমাকে কিছু বলে নি।

— বাহ। সবাই জানতো আমি বাদে।

— তুমি কথা এত প্যাঁচাচ্ছো হানি।

— আর বলব না।

— রেগে আছে আমার তোতাপাখি?

— না।

তৌসিফ ঐ দিকটা আর ঘাটলো না। পৌষ’র মন অন্যদিকে উদাসীন তা ভালোই টের পেয়েছে তৌসিফ। আরেক জায়গার চিন্তা ও এখানে দেখাচ্ছে।
তৌসিফ লোভী হলো। পৌষ’র পাশ ঘেঁষলো। চুলের ভাজে আঙুল চালিয়ে কানে ঠোঁট লাগিয়ে ফিসফিস করে বললো,

— প্রেমসুধা পানের অনুমতি পাব কি?

উত্তর অবশ্য আসে না। নীরবতার মাঝে তখন বাতাসের দাপটে পর্দা উড়ে। হুরমুর করে ঠান্ডা বাতাস ভেতর আসে। নভেম্বর রাতের সহনীয় ঠান্ডা কিন্তু প্রেমে মত্ত দু’জন ঠান্ডা বোঝে না। গভীর আলিঙ্গনে তারা উষ্ণতা ছড়ায়। দীর্ঘ বিরতির পরে আগমনটা অসহনীয় হয়ে উঠে। তারা ভালোবাসায় ডুব দেয়।
তৌসিফ আজও তৃপ্ত গলায় বলে,

— আমার বাবু চাই পৌষরাত।

— হু।

— সত্যি ই চাই। খুব করে চাই।

আধ ঘুমে পৌষ আবারও উত্তর দিলো,

— হু।

তৌসিফ ওকে বুকে জড়ায়। তার ভেতর চাপা এক উত্তেজনা কাজ করে।

#চলবে……..

#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৫২

জড়সড়ভাব নিয়ে চেয়ারটার এক কোণে বসা পৌষ। ডাক্তার রিপোর্ট দেখছেন। তায়েফা সেদিকেই তাকিয়ে আছে আশানুরূপ কিছু কথা শুনতে।
সকাল দশটা নাগাদ মিথ্যা বলে এখানে এসেছে পৌষ। তৌসিফ আজ নয়টায় বের হয়েছে। পৌষ তখন জানিয়েছে ভার্সিটি যাবে। ড্রাইভারকে বলে রেখে গিয়েছে তৌসিফ। ও যাওয়ার আগ মুহুর্তে পর্যন্ত পৌষ’কে জিজ্ঞেস করেছিলো, কোন সমস্যা কি না? পৌষ মাথা নেড়ে না বলেছে। তৌসিফ কিভাবে জানি বুঝে যায় সবটা। পৌষ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছিলো৷
সেই দশটায় এসে এখন বাজে দুপুর একটা৷ টেস্ট করে ঘন্টার মধ্যেই রিপোর্ট করিয়েছে তায়েফা। তৌসিফ বউ একা ছাড়ে না। এরমধ্যে তিনবার ফোন এসেছে। পৌষ’কে খেতে বলেছে তৌসিফ। দিন দুই ধরে তৌসিফ কিছু একটা করেছে যার ফলে সে ব্যস্ত নাহয় পৌষ’র মিথ্যা ধরতে তার ততটাও কষ্ট হতো না।
তায়েফা পৌষ’কে দেখেই হাত ধরলো। শান্ত স্বরে বললো,

— চিন্তা করিস না।

ফুলা চোখে তাকালো পৌষ। টেস্ট করার সময় থেকেই কাঁদছে ও৷ বুকটা ফেটে কান্না আসছে৷ মনে হচ্ছে রিপোর্ট খারাপ আসবে৷ যদি ও মা হতে না পারে তখন কি হবে? যদি তৌসিফ ছেড়ে দেয়? পৌষ তো এত ভালোবাসা ছাড়তে চায় না৷ তার মনটা দিন দিন লোভী হচ্ছে। ভালোবাসার লোভ তাকে আঁকড়ে ধরেছে।
ডাক্তার তাকালো পৌষ’র দিকে। পৌষ’র বুকটা তখন চিলিক দিয়ে উঠে। ডাক্তার শুধু বললো,

— মিসেস তালুকদার, আই থিংক আপনার ছোট্ট একটা সমস্যা হয়েছে।

মুখে হাত চেপে এবার কেঁদে উঠলো পৌষ। এতক্ষণের চেপে রাখা কান্নাটা এবার বেরিয়ে এলো। তায়েফা পৌষ’কে উঠে জড়িয়ে ধরেই টের পেলো সমান তালে কাঁপছে পৌষ।

তায়েফা ওকে শক্ত করে ধরে। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

— কি সমস্যা? কি হয়েছে?

ডাক্তার রায়া যেন বিপাকে পরলো৷ ঝটপট গলায় বললো,

— মিসেস তালুকদার প্লিজ শান্ত হন৷ আমার কথাটা শুনুন৷ ভয় পাওয়ার কিছু নেই। শুনতে পাচ্ছেন আপনি।

পৌষ তায়েফা’কে জড়িয়ে ধরেই বলে,

— আপা, আমার ভালো লাগছে না।

— আচ্ছা। বাড়ী যাব। রিপোর্টটা শুনে যাই। একটু বস সোনা।

পৌষ’র চোখ মুছিয়ে বসলো তায়েফা। ডাক্তার রায়া পৌষ’র দিকে তাকিয়ে বললো,

— এত ভীতু তুমি। আমি কিন্তু সাহসী ভেবেছিলাম। তৌসিফ তালুকদারের বউ এত নরম হলে হয়?

পৌষ মনে মনে বললো,

— জামাইকে তো আমি নাটাই এর মতো ঘুরাই। শুধু এখন একটু ভয়ে আছি।

ডাক্তার রায়া আবারও বললেন,

— তোমার তো আয়রন ডেফিসিয়েন্সি আছে। আই থিংক এটা জানো।

পৌষ মাথা নাড়ে। নাক টেনে বললো,

— উনি ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ খায়িয়েছেন। এখনও চলছে।

— গুড। এছাড়া আরেকটা সমস্যা হচ্ছে তুই যথেষ্ট দূর্বল পৌষরাত। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করো। তোমার বডি তৈরী নয় বেবি ক্যারি করার জন্য। কিছু মেডিসিন দিচ্ছি এগুলো স্টার্ট করে দাও। পনেরো দিন পর হাসবেন্ড সহ এসো।

পৌষ মাথা নাড়ে। সস্তির শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করে,

— বাবু হতে তো সমস্যা নেই তাই না?

— বোকা মেয়ে। কখন বললাম সমস্যা? এসব টুকটাক সমস্যা তো থাকেই। ফ্যাট জাতীয় খাবার একদমই ধরবে না কিন্তু স্বাস্থ্য সম্মত খাবার খাও৷ বডি আগে ঠিক করো। বাচ্চা তো আল্লাহ যখন খুশি হবেন তখন দিবেন।

পৌষ চুপ করে রইলো৷ তায়েফা আলাপ চালালো ডাক্তার রায়া’র সাথে। পৌষ এক ধ্যানে ভাইব্রেট হওয়া ফোনটা দেখছে। ওখানে ভেসে উঠছে তৌসিফের নাম্বার।
.
বিকেলে ঘুমেয়েছে পৌষ। বাইরে কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঘুমের ঘোরে অল্প কাঁপে পৌষ। জানালা খোলা থাকায় ঠান্ডা বাতাস বইছে। গায়ে কম্বলটা নেই। থাকলে হয়তো একটু আরাম লাগতো। অলস পৌষ উঠে না। গায়ে কিছুই নেয় না। ঠান্ডা বাতাসে আরেকটু কুঁকড়ে গিয়ে তৌসিফে’র বালিশে মুখ গুজে দিলো। এই চরম শীতল মুহুর্তে তৌসিফ নামক পুরুষটার কথা ভীষণ মনে পরলো ওর। মনে পরলো তাকে যত্নে আগলে রাখা ঐ উষ্ণ বুকটার কথা। সেই গভীর আলিঙ্গনের কথা। পৌষ মনে মনে বিষাদে পরিপূর্ণ হয়েও হলো না। বালিশ থেকে আসা ঘ্রাণটা যেন তাকে বার বার মনে করাচ্ছে তৌসিফ তার কাছেই আছে। অতি নিকটে।

ঘুমটা তখন আধ কাঁচা। না জাগ্রত না গভীর। ধুপধাপ পা ফেলে কেউ এসেছে তা টের পেলেও চোখ খুলার মতো ততটাও সজাগ নয় পৌষ। স্ব শব্দে যখন দরজাটা বন্ধ হলো তখন ঘুমের মাঝেই কেঁপে উঠে ও। পিলে চমকে উঠে হুরমুরিয়ে উঠে। চোখ তখনও বন্ধ। পৌষ চোখ খুলার আগেই ওর গালটায় চাপ পরে। আস্তে ধীরে চোখ খুলে মুখে “উউ” উচ্চারণ করলেও ছাড়া পেলো না বরং চাপটা একটু বাড়লো। দীর্ঘ দিন অসুস্থ থাকায় শরীরে বল পায় না পৌষ। চোখটা খোলা মাত্রই দৃশ্যমান হলো স্বয়ং তৌসিফ। পৌষ দুই হাত দিয়ে তৌসিফে’র কোমড়টা পেঁচিয়ে ধরে। হঠাৎ উঠায় ওর মাথা ঘুরছে। শরীর ছেড়ে দিয়ে তৌসিফে’র উপর জড়িয়ে যেতেই তৌসিফ গালটা ছেড়ে নিজের হাতটা রাখলো পৌষ’র মাথায়। সন্তপর্ণে ওকে নিয়ে শুয়ে পরলো। পায়ের জুতাটা তখনও পায়েই রয়ে গেছে। খোলার সুযোগ হয় নি তার।
পৌষ ছাড়ে না বরং আরেকটু ঘেঁষে মাথাটা পেট থেকে বুকে আনে। ভয়ে রীতিমতো ভেতরে ভূমিকম্প হলেও প্রকাশ করছে না। হাজার ফটর ফটর করুক না কেন পৌষ জানে সত্যি তো এটাই যে তৌসিফ’কে এখনও জমের মতো ভয় পায় সে।
আজ না বলে বাইরে গিয়েছিলো। তৌসিফে’র এত এত কল ধরা হয় নি। বাসায় এসে কল দিলেও তৌসিফ রিসিভ করে নি। বুয়ারা জানিয়েছে তাদের ফোন দিয়েই তৌসিফ জেনেছে যে তায়েফা’র সাথে গিয়েছে পৌষ। কোথায় গিয়েছে সেটা বোধহয় জানতে তার আর বাকি রয় নি তাই শেষ কলটা দিয়েছে। পৌষ তখন কলটা রিসিভ করে কানে ধরা মানেই শোনা গিয়েছে যথেষ্ট ঠান্ডা এক কণ্ঠ,

“বাসায় যাও এখনই।”

পৌষ’র সারা শরীর তখন বরফের মতো ঠান্ডা হলো। দরদরিয়ে ঘাম ছুটে গেলো তখন। তারাতাড়ি তায়েফা’কে নিয়ে ছুটে এসেছে। সেই থেকে বাড়ী ফিরে কতই না কল দিলো রিসিভ হয় না।

বুকের ভেতর নাক, মুখ ঘঁষে পৌষ। চুলের ভাজে তখন তৌসিফে’র হাত। পৌষ হাত তুলে কোমড় থেকে এবার পিঠ জড়িয়ে ধরে। আস্তে করে গলায় মুখ গুজে রাখে। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে তৌসিফ নিজেকে শান্ত করে। পৌষ পিঠে হাত বুলায়। আস্তে করে হাত এগিয়ে এনে শার্টের বোতাম গুলো খুলতে থাকে। তৌসিফ কিছুই বলে না। বুক উন্মুক্ত করে মাথা রাখে সেখানে। তৌসিফে’র হাত তখন চুল ছেড়ে এলোমেলো বিলি কাটছে।
রাগটা হয় তো পরে গেলো এখানেই। কথার মারপ্যাঁচ কিছুই তাদের হলো না। যা হলো সবটা অতি শুভ্র, কোমল, নীরব এক উষ্ণ আলিঙ্গন। স্ত্রী খুবই দক্ষ হাতে সামাল দিলো তার রাগী স্বামী’কে। ভালোবাসে ছোট্ট একটু একটু টুকরো করা ভাঙা ভাঙা আদর উড়িয়ে দিলো কতশত রাগ, অভিযোগ।

তৌসিফ আদুরে গলায় ডাকলো,

— হানিই?

— হুম।

— ক্ষুধা লেগেছে।

— উঠুন। রান্না করেছি তো।

— কি কি রাঁধলে?

— শুধু মুড়িঘণ্টাটা আমি করেছি। ঐ দিন না খেতে চাইলেন?

— হুম। মা রান্না করতো। আপারও পছন্দ এটা।

— দেখি, উঠুন। দুপুর গড়ালো সেই কখন৷ আমারও ক্ষুধা লেগেছে?

— খাও তো নি। জানি তো।

— ঘুমিয়ে গেলাম কিভাবে জানি।

— আমি জানি তো কিভাবে ঘুমালে। আসো।

উঠে বসে পৌষ। তৌসিফ দেখলো গালে লাল হয়ে আছে ওর। বুক ফুলিয়ে শ্বাস টানে তৌসিফ। কথা আছে তার পৌষরাতের সাথে। এখন না বললেও তার বলতে হবে। আজই বলতে হবে।
পৌষ হাত বাড়ালো। গা এলিয়ে তখনও তৌসিফ আধ খোলা শর্ট নিয়ে শুয়ে আছে। পৌষ ঝুঁকে তৌসিফে’র জুতা, মুজা খুলতে খুলতে বললো,

— এই জুতাটা ভালো লাগে না আমার৷ কেমন একটা রং। বাঁশ কালার! আপনি দেখে মুখ ঠিক রাখলাম নাহলে এটাকে বাঁশ কালার বলে সম্মান করতাম না।

তৌসিফ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

— তাহলে কি কালার বলে অসম্মান করতে?

— * কালার বলে।

তৌসিফ হা করে তাকালো। পৌষ তখন খ্যাঁচখ্যাঁচ করছে সমান তালে। তৌসিফ বেচারা বউয়ের কথা হজম করতে পারলো না। নাক, মুখ কুঁচকে শুধু বললো,

— তুমি এত পাঁজি কেন?

পৌষ হাত বাড়িয়ে দিলো। ভাবখানা এমন সে টেনে তুলবে তৌসিফ’কে। তৌসিফ মাথার পেছনে হাত দিয়ে বললো,

— তুলতে পারবে আমাকে?

পৌষ ভ্রু কুঁচকে বলে,

— কোন সন্দেহ?

— একদমই না।

— তাহলে আর কি। হাত দিন… এক টানে উল্টে দিব আপনাকে। আমাকে দূর্বল ভাববেন না একদমই। আমি কিন্তু একবার এক বুইড়া ব্যাটা’কে দৌড়ানি দিয়েছিলাম। শা*লার ব্যাটা লুঙ্গি তুলে দৌড় দিতে গিয়ে উল্টে পরলো। সেই থেকে আমার সামনে আসে নি ভয়ে।

তৌসিফ ফাটা চোখে তাকিয়ে বললো,

— মানে কি? বুড়ো লোককে দৌড়ানি দিয়েছো কেন?

কোমড়ে হাত দিয়ে পৌষ কটমট করে বললো,

— বাড়ীর সামনের দোকানে দাঁড়িয়ে পান, চা গিলতো আর মেয়ে দেখলেই পুতুপুতু করতো। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েদের দেখে টিটকারি মা’রতো। একদিন দেখি পিহা’কে টিটকারি মা’রছে। আইক্কা ওয়ালা বাঁশ নিয়ে দিলাম দৌড়ানি। বারি একটা দিতে পারলে কলিজা আমার ঠান্ডা হয়ে যেতো। আহা….এখনও আশা নিয়ে আছি বুইড়াকে পেলেই ধোলাই দিব নাহলে আমার নামও পৌষরাত হক পৌষ না।

তৌসিফ মুখটা অসহায় করে তাকালো। বউ বলে কি এটা? আইক্কা ওয়ালা বাঁশ নিয়ে নাকি দৌড়ানি দিয়েছে? সেবার সিনিয়র এক ছেলেকে টুনটুনিতে কিক করেছিলো। সেটা আবার গর্ব করে বলে। পৌষ আবার ঝাঁকি দিয়ে বললো,

— কি হলো? হাত দিন।

মাথার পেছন থেকে হাত বের করে এগিয়ে দিলো তৌসিফ। পৌষ দিলো এক টান। তৌসিফ নড়লো না এক ইঞ্চি। পৌষ দাঁত কিটিমিটি করে। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে নিজেই বল দিয়ে উঠে তৌসিফ। পৌষ দাঁত বের করে হাসলো। ভ্রু উঁচু করে ইশারা করলো। তৌসিফ বুঝলো হয়তো বউ বলছে, “এই যে দেখলেন উঠালাম আমি”।

____________________

— শুনলাম দেশের বাইরে যাচ্ছিস?

তায়েফা’র প্রশ্নে তৌসিফ টিভি থেকে নজর সরালো। এক পলক দেখলো বারান্দায় থাকা পৌষ’কে। ভিডিও কলে শ্রেয়া’র সাথে কথা বলছে। নেটওয়ার্ক ইস্যু হওয়ার দরুন বারান্দায় যাওয়া তার। তায়েফা’র দিকে তাকিয়ে তৌসিফ বললো,

— সারাদিন বাসায়ই থাকে। ভাবলাম ঘুরিয়ে আনি।

— কোথায় যাওয়া হচ্ছে?

— অস্ট্রেলিয়া।

— হজ্জটা সেরে ফেলতি।

— ইনশা আল্লাহ আপা। ইচ্ছে আছে বাচ্চাকাচ্চা নিয়েই যাব।

— ইনশা আল্লাহ। তুসু একটা কথা ছিলো।

তায়েফা ইতস্তত করে কথাটা বললো। তৌসিফ এবার টিভির সাউন্ডটা মিউট করে দিয়ে ঘুরে বসে জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে আপা? সব ঠিক?

— তোকে না বলে পৌষ’কে নিয়ে গেলাম। রেগে আছিস আপা’র উপর? আমি আসলে চাইছিলাম যাতে কোন সমস্যা না হয় তাই..

তায়েফা’র কথা থামিয়ে দিয়ে তৌসিফ বলে উঠলো,

— আমার বউ আমি বুঝে নিতাম আপা। তোমার কষ্ট করার দরকার ছিলো না। আমি জানি তুমি ভালোর জন্য করেছো কিন্তু জানো এখানে সমস্যাটা হবে কোথায়?

তৌসিফে’র কণ্ঠস্বর দৃঢ় এবং রুষ্ট। তায়েফা বুঝে গেলো চট করে। ভাই রেগে গিয়েছে। বউ নিয়ে সে অনেক সিরিয়াস। যাকে মন থেকে একবার গ্রহণ করে তাকে সে ছাড়তে পারে না। এই ক্ষেত্রে পৌষ’কে তৌসিফ একটু বেশিই আপন করেছে তা দেখা যায়। বুঝা যায়। লোকমুখে শোনা যায়।
তৌসিফ তায়েফা’কে উদ্দেশ্য করে বললো,

— আপা, ওর স্বভাব আমার জানা। ওর মাথা থেকে পা সবটা আমার মুখস্থ, ঠোঁটস্থ। এই যে এখন ডাক্তার দেখালে না তুমি, এখন ও এটা নিয়েই পরে থাকবে। সারাক্ষণ ওর মাথায় এটাই ঘুরবে। পা’গল হয়ে যাবে এটার জন্যই। ও আমাকে খুশি করার জন্য এই বাচ্চাই দিতে চাইবে এখন। ওর মাথায় ঢুকে গিয়েছে আমার বাচ্চা চাই। সেই সাথে আমি না বলাতেও নিজে নিজেই ভেবে নিয়েছে হয়তো বাচ্চা না হলে আমি ওকে অবহেলা করব৷ এখানে ওর দোষ নেই আপা। ছোট থেকে আমার তোতাপাখি এভাবেই বড় হয়েছে। ওই বাড়ীতে ওকে বসিয়ে খাওয়ানো হতো না। ওর চাচিরা হাসতে হাসতে হাতে কাজ তুলে দিতো। ওর রান্নার হাত দেখেছো? পাক্কা গৃহিণী। এই হাত শখ করে শেখা রান্নার হাত না। এই হাত চাপে পরে করা রান্নার। আমি চিনি। মায়ের হাতের স্বাদ পাই। ওর লবন দিতে চামচ লাগে না আপা। মায়ের মতো আন্দাজে দিয়ে দেয়। ওর চামড়ায় ছিটাফোঁটা দেখো। বহু বছর পুরাতন তেলের ছিটার দাগ। এগুলো তাহলে কবে থেকে করে আসছে ও বলো? নিশ্চিত স্কুলে থাকাকালীন সময় থেকে। ওর ভাই-বোনরা থাকায় আর চাচারা হয়তো কিছুটা সদয় ছিলো।
একবার ভাবো আমার মতো বিবাহিত, সংসার করা, এলাকায় যার নামে নারী ঘটিত ব্যাপার যারা মুখে মুখে তার কাছে কেউ মেয়ে দেয়? দেয় না কিন্তু ভাতিজী দিয়ে দিলো তারা। হ্যাঁ, আমি স্বীকার করি আমি অপরাধী। চাপ দিয়েছি কিন্তু কতটা আপা? ওটা চাপ না বরং লোভ ছিলো। তারা এখন বুক ফুলিয়ে হাঁটে আর বলে, “চাচা হওয়ার দায়িত্ব পালন করেছি। ভাতিজী বড় ঘরে দিয়েছে। সুখে আছে। ভরপুর সংসার”। কোথায় একটাবার নাহয় আমার অনুপস্থিতিতে সেই চাচারা জোর করেই নিয়ে যেতো। যেভাবে জোর করে বিয়ে দিলো।
ওকে আমি বিয়ের আগে ভালোবাসি নি আপা। ভালোবেসেছি বিয়ের পর। ওর প্রতি আমার ভালোবাসা পবিত্র। ওর সাথে জড়িয়ে আছে এমন সবটার দায়িত্ব আমার। বাচ্চা আমার চাই কিন্তু পৌষরাতের স্বাস্থ্যের বিপরীতে গিয়ে না। আমি চেয়েছি বাচ্চা যাতে ও প্রস্তুত থাকে কিন্তু এখন ও উঠেপড়ে লাগবে বাচ্চার জন্য। ওকে ফিরিয়ে দেয়ার সাধ্য আমি তৌসিফ হারিয়েছে বহু আগে। পাঁজি, দুষ্ট আর দূরন্ত এই তোতাপাখি আমি পুষে রাখি যত্নে আপা। ওর অযত্ন হবে এই দায় আমি নিতে পারব না। সৃষ্টিকর্তা সেই ক্ষমতা আমায় দেয় নি।

তায়েফা থম ধরে গেলো। আসলে ও বুঝতেই পারে নি তৌসিফ যে এভাবে ভেবেছে। মূলত স্বামী স্ত্রীর মাঝে ঢুকাটাই উচিত হয় নি। তায়েফা চেয়েছিলো একটু গুছিয়ে দিতে কিন্তু ঝামেলা পাকিয়ে যাবে এটা ওর ধারণার বাইরে ছিলো। তৌসিফ বুঝে তাই তায়েফা’র হাত ধরে বললো,

— আমি জানি তুমি ইচ্ছে করে করো নি।

— কি ঝামেলা পাকিয়ে দিলাম বল তো সোনা।

— কোন ঝামেলা না। বললাম না পুষে রেখেছি এই পাখি। আমি বুঝিয়ে বলব ওকে কিন্তু কথা হলো বিনিময়ে তোমার তুসু’র ডুগডুগি বাজাবে সে।

তায়েফা মৃদু হাসলো। তৌসিফ যে এতটা ভালোবাসে পৌষ’কে তা ধারণার বাইরে ছিলো ওর।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে পৌষ নাক টেনে বললো,

— ভাবী হেমু ভাইকে বলবে আমার এখানে আসতে তোমাদের নিয়ে।

— বলব তো। বাবুর চল্লিশ দিন হোক আগে।

— আচ্ছা ভাবী, বাবু জ্বালায় কেমন?

— এই যে সারারাত ঘুমায় নি৷ এখন ঘুমাচ্ছে। আবার রাতে উঠে যাবে। তোর ভাই হাঁটে কোলে নিয়ে। ইনি, মিনি এসেছে দেখ।

পৌষ দেখলো জমজ দুটো একসাথে ভাতিজার গালে চুমু দিচ্ছে। বুকটা জুড়িয়ে যায় এই দৃশ্য দেখে। পৌষ মনে মনে হাসে। তার বাচ্চা হলে সে কলিজায় পুরে রাখবে। তৌসিফ তখন আরো ভালোবাসবে। পৌষ আবার ভাবে, যদি বাচ্চা হতে গিয়ে সে ম’রে যায় তখন কিভাবে হবে ভালোবাসা? কতই তো খবর দেখায়। ইদানীং আবার এসবই মাথায় ঘুরে।
পৌষ ভয় পায় পরক্ষণেই ভাবে, “লাগলে ম’রণ হোক তবুও সে আমার হোক”।

#চলবে…..