#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৫৩
— আমরা কোথায় যাচ্ছি?
তৌসিফে’র পায়ের শুকনো ক্ষততে লোশন লাগাতে লাগাতে প্রশ্নটা করে পৌষ। ক্ষতটা শুকালেও দাগ যাচ্ছে না। তারমধ্য তৌসিফ প্রচুর খুঁতখুঁত স্বভাবের। দাগ নিয়ে খুবই চিন্তিত৷ কাঁচ দিয়ে কাটা দাগ যাচ্ছেও না সহজে। ডারমাটলজিস্ট দেখিয়ে এই লোশনটা আনানো হয়েছে দাগ যাওয়ার জন্য।
পৌষ পা ছেড়ে পিঠের দাগের দিকে এগিয়ে এলো। তৌসিফ উত্তর দিলো,
— আস্ট্রেলিয়া।
পৌষ’র মাঝে কোন উত্তেজনার দেখা মিললো না। তৌসিফ এতে খানিকটা অবাকই হলো। এমনটা হওয়ার কথা না। পৌষ হচ্ছে চঞ্চলা এক প্রাণ। তার তো ঘুরতে যাওয়ার কথা শোনা মাত্রই খুশিতে লাফানো উচিত ছিলো। তৌসিফে’র গলা জড়িয়ে শপিং এর বায়না করার কথা ছিলো কিন্তু এমন কিছু হচ্ছে না বরং মনে হচ্ছে খানিকটা বিরক্ত ও। তৌসিফ ওর হাত ধরে নিজের কাছে টানে। হাতের উল্টো পিঠে চুমু দিয়ে জিজ্ঞেস করে নরম স্বরে,
— মন খারাপ?
— না তো।
চোখ দুটো পিটপিট করে পৌষ। তৌসিফ ওকে চেনে। জানে। পুণরায় জিজ্ঞেস করে,
— কি হয়েছে হানি? আরেন্ট ইউ হ্যাপি?
— এত দূর গিয়ে কি হবে?
— হানিমুন পাওনা আমার। এখনও যাই নি। ঝামেলা কাল সব মিটি যাচ্ছে… তাই এই সপ্তাহের শেষ দিন যাচ্ছি৷ তোমার পাসপোর্ট রেডি।
— সব তো হয়েই গিয়েছে হানিমুনে গিয়ে কি হবে?
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে পৌষ। তৌসিফ হেসে ফেলে। বউয়ের গাল দুটো টেনে কপালে আদরের সহিত হাত বুলায়। আজ অনেকদিন পরে তৌসিফ তার চিরায়ত থুতনির চুমুটা দিয়ে বললো,
— তোমাকে নিয়ে আমার আজীবন হানিমুন হবে পৌষরাত।
— দেশেই থাকি। সিলেট যাই? চা বাগানে? ওখানে গিয়ে চা পাতা আনব নে? নাহয় চলুন কক্সবাজার যাই? শুটকি আনব এত এত। আপনাকে ভর্তা বানিয়ে খাওয়াব।
তৌসিফ এবার এক টানে বুকের উপর নিলো ওকে। কপালে চুমু দিয়ে বললো,
— আচ্ছা যাব।
— অস্ট্রেলিয়া ক্যান্সেল?
— উহু। বললাম না হানিমুন করব।
— টাকা এতই বেশি আপনার? দান করে দিন। কি দরকার যাওয়ার? ভালো লাগে না।
পৌষ মুখে বিতৃষ্ণা। তৌসিফ বুঝেও না বুঝার মতো আচরণ করে। নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে,
— গেলেই ভালো লাগবে। এখন ওখানে স্নো ফল হচ্ছে। ইউ উইল লাভ ইট হানি।
পৌষ’র ততটা হেলেদুল দেখা গেলো না। সে বুকে চুপ করে রইলো। তৌসিফ ওর চুলে হাত বুলায়। শান্ত স্বরে বলে,
— চুলগুলো ঝরঝরে হচ্ছে আবার। শ্যাম্পুটা কাজ করেছে তাহলে। এরপর থেকে চুলের অযত্ন আমি একদমই সহ্য করব না হানি।
— হুম।
তৌসিফ চুল ছেড়ে গালে হাত বুলায়। এই দফায় বলে,
— খাওয়া দাওয়ায় অমনোযোগী তুমি হানিই।
— এই খাই তো। আজ ডিম খেয়েছি কুসুম ছাড়া।
ফটাফট উত্তর এলো। তৌসিফ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
— কুসুম ছাড়া?
— ফ্যাট তো।
— তাতে কি…..
বলতে গিয়েও থেমে গেলো তৌসিফ। নিশ্চিত ডক্টর পরামর্শ দিয়েছে ফ্যাট কাট আউট করার জন্য। এজন্য উঠে পরে লেগেছে পৌষ। তৌসিফ খেয়াল করেছিলো রাতে খাওয়ার সময়ও গরুর ভুনাটা পৌষ খায় নি। হাজার বলেও খাওয়ানো যাচ্ছিলো না। যেই তৌসিফ নিজের প্লেট থেকে তুলে দিলো তখন গিয়ে খেলো। এমনি সময় খাবার তুলে দিলো পৌষ যতটা খুশি হয় আজ তা হয় নি। তৌসিফ চট করে ধরে ফেললো সবকিছু। এখনই সঠিক সময় পৌষ’কে বুঝানোর। তাই বুকে থাকা পৌষ’কে নিয়েই উঠে বসে তৌসিফ। সোনালী রঙের লাইট গুলো জ্বলে উঠে সুইস চাপতেই। ঝলমলিয়ে উঠে তৌসিফে’র বিলাসবহুল মাস্টার বেডরুম।
পৌষ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
— কি হলো?
তৌসিফ পৌষ’র হাত দুটো ধরে। এই প্রথম দৃঢ় কণ্ঠে চোখে চোখ রেখে তৌসিফ বলে,
— তখন বিকেলে আমি কিছুই বলতে পারি নি পৌষরাত। এরমানে এটা না যে আমি তোমার কাছে জবাবদিহি চাইব না। আমার অনুমতি ছাড়া কিভাবে বাইরে যাও তুমি? তাও আমাদের পার্সোনাল ব্যাপারে?
মাথাটা সহসা নামিয়ে নিলো পৌষ। বুকটা সমানতালের ছন্দপতন ঘটিয়ে এলোমেলো ছুটছে। তৌসিফ বুঝলো। ভয় পাওয়াতে চায় না সে কিন্তু একেবারে নরম স্বর আবার পৌষ বুঝবে না।
হাতে মৃদু ঝাঁকি দিয়ে পুণরায় জিজ্ঞেস করতেই গড়গড় করে পৌষ বলে উঠলো,
— আম.আমি ভেবেছিলাম আমার কোন সমস্যা আছে তাই ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম। আপনি তো বাবু চাইছিলেন তাই আমিও পিল খাই না কিন্তু তবুও….
— কে বলেছে তুমি পিল খাও না?
গভীর অথচ তীক্ষ্ণ প্রশ্ন। পৌষ আমতা আমতা করে বলে,
— খাই না তো।
— আমি খাওয়াই তো রোজ সকালে দুধের সাথে।
পৌষ যেন আকাশ থেকে পরলো। ও তো পিল ছেড়েছে যবে প্রথম তৌসিফ বাচ্চার কথা বলেছিলো। তৌসিফ’কে খুশি রাখতে সদা গতিশীল পৌষ। যেহেতু তৌসিফ খাওয়াবেই তাহলে পৌষ’কে কেন বলেছিলো বাবুর কথা? প্রশ্নটা অবশ্য করা লাগলো না। তৌসিফ নিজ থেকেই বললো,
— তোমাকে বাবুর কথা বলেছিলাম যাতে তুমি নিজেকে প্রস্তুত রাখো পৌষরাত আর কিছু না। আমার যদি ওতই তারাহুরো থাকতো তাহলে আমি নিজ থেকেই কনসালটেন্টের পরামর্শে যেতাম। তোমার শরীর দেখেছো? একেতো আয়রন ডেফিসিয়েন্সি তারমধ্য এবার গেলো ডেঙ্গু। আমি বউ মে’রে বাচ্চা নিব পৌষরাত? আমার সেন্স নেই? বিবেক নেই আমার? তুমি কোন সাহসে আজ ডাক্তারের কাছে গেলে? হাত লুকিয়ে আছো কেন? হাত সামনে আনো। সূচের খোঁচা ইচ্ছে করে খেয়েছো। এখন হাত নাড়াতে পারো না।
বলেই হাতটা টেনে ধরে তৌসিফ। পৌষ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। তৌসিফ হাত ছাড়ে না। না ই নরম আচরণ করে। কত বড় সাহস একা একা গিয়ে টেস্ট করায় ও? পৌষ মিনমিন করে হাত ছাড়াতে চাইলেও তৌসিফ ছাড়ে না। পৌষ অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে,
— ছড়ুন না। হাতে ব্যথা পাই তো।
— তখন পাও নি।
— আমি… আমি…
বলতে বলতে হু হু করে কেঁদে উঠে ও। সেকেন্ডর ব্যবধানে তৌসিফে’র বুকটায় ঠাই হয় কিন্তু কণ্ঠ শক্তই থাকলো। পৌষ বুকে নাক ঘঁষে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
— মাফ করে দিন না। আর যাব না।
— যাওয়ার আগে মনে পরে নি।
— আমি শুধু আপনাকে খুশি করতে চাইছিলাম।
— আমি তোমাকে নিয়েই খুশি পৌষরাত। প্লিজ আমার কষ্ট বাড়িয়ো না।
পৌষ চুপ করে রইলো। তৌসিফ শক্ত হাতে ওকে বুক থেকে তুলে বললো,
— আমি তোমার নাড়ী নক্ষত্র চিনেছি পৌষরাত। আমার উপর যাওয়ার চেষ্টা করো না।
পৌষ মাথাটা নামিয়ে রাখলো। এই ভয়টা ও তৌসিফ’কে পায়। তৌসিফ ওর থুতনি ধরে মুখটা তুলে বললো,
— এই ভুল যাতে আর না হয়। মনে থাকবে?
— হুম।
— ঠিক করে বলো।
— মনে থাকবে।
তৌসিফ ওকে ছেড়ে উঠে গেলো। পৌষ আটকে রাখা শ্বাস ত্যাগ করে। নজর দেয় তৌসিফে’র দিকে। বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরিয়েছে সে। পৌষ’র চোখ দুটো ভরে উঠে। তৌসিফ এত কেন রাগ দেখাচ্ছে? সে কি বাচ্চা চায় নি? একবার না বরং কয়েকবার চেয়েছে। পৌষ কিভাবে বুঝতো ওটা কোনরূপ চাওয়া ছিলো? তার মাথায় তো অত গভীর ভাবনা ঢুকে না। ধপ করে মাথাটা বালিশে দিয়ে রাখে ও। যাবে না তৌসিফে’র কাছে। এত রাগ কেন দেখাচ্ছে? কি ই বা এমন করলো পৌষ?
মাথাটা বালিশে দিলেও তেমন একটা শান্তি পাওয়া গেলো না। পৌষ উঠে দাঁড়ালো। ভয় লাগছে তার তৌসিফে’র কাছে যেতে। বিয়ের পর ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতা আছে তার। ঢোক গিললো পৌষ। পা টিপে টিপে রুম থেকে বের হতে নেয়া মাত্র বারান্দা থেকে গম্ভীর কণ্ঠে শোনা গেলো,
— সাইড টেবিলে ব্রেড রোল ঢেকে রাখা আছে।
পৌষ অসহায় অনুভব করলো। তৌসিফ তাহলে ভেবেছে পৌষ’র ক্ষুধা লেগেছে। পা ঘুরিয়ে এই দফায় বারান্দায়ই যায় ও। তৌসিফ তখন দূরে তাকিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে। পৌষ নিজেও তাকালো। ঘন কালো কুচকুচে চারপাশ। পুকুরটায় আবারও কচুরি জমা হয়েছে। পাশেই ইট পাথর দিয়ে কাজ চলছে। এই দিক দিয়েই বাজার। মেইন রোডের রাস্তা। ভ্রু উঁচু করে পৌষ ভাবে কতদিন বারান্দায় আসে না ও। বেশ ভালোই দিন হলো পৌষ এখানে আসে না তাই হয়তো এই কাজ ধরার ব্যাপারটা দেখে নি ও। ওখানকার গাছগুলো কি তাহলে কেটে ফেলবে? পৌষ ভাবুক হয়। আস্তে করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তৌসিফ’কে। তৌসিফ মুখ ভর্তি ধোঁয়া ছাড়ে বাতাসে। ঠান্ডা বাতাস বইছে তখন। পৌষ’র লোম দাঁড়িয়ে গেলো। তৌসিফে’র সাথে আরেকটু লেগে যায় ও। খুক খুক কাশির শব্দ হতেই সিগারেটটা অ্যাশ ট্রে তে পিষে ফেলে তৌসিফ। যথাসম্ভব কাঁশি চাপে পৌষ যার দরুন চোখ দুটো লাল হয়ে উঠে ক্রমশ। তৌসিফে’র বুকের দিকে আরেকটু চেপে ধরে পিঠে ঠোঁট ছোঁয়াতেই তৌসিফ বলে,
— ভেতরে যাও।
— উহু।
— ঠান্ডা লাগবে।
— লাগুক।
তৌসিফ ফিরে দাঁড়িয়ে বুকের মাঝে নিলো পৌষ’কে। চুলের ভাজে আঙুল চালিয়ে বাঁকা হাসলো। এইটুকু ছিলো পৌষ’র ভাষায় বউকে হাতের মুঠোয় রাখার টোটকা যা তৌসিফ খুব নিদারুণ ভাবে করেছে।
তৌসিফ সফলও বটে। এখন সময় বউকে আদর আদরে আহ্লাদী করা। ভয়ে বুকেই মুখ লুকিয়ে আছে। তৌসিফ ঠান্ডা স্বরে বলে,
— শীত লাগছে না?
— না তো।
— এত বাতাস তবুও লাগছে না?
— উহু।
— কারণ?
— আপনি আছেন না।
— তাহলে আরেকটু উষ্ণতা দেই?
বুক থেকে মুখটা তুলে যেই না কিছু বলবে ওমনিই তৌসিফ ওকে পাঁজা কোলে তুলে। রুমে ঢুকে বিছানায় সযত্নে ওকে রেখে নিজেও পাশে এলো। পৌষ’র দৃষ্টি এলোমেলো তখন। তৌসিফে’র গাঢ় চোখের চাহনি তার আবদার জাহির করে বারংবার। পৌষ সেই দৃষ্টিতে বোধহারা হয়৷ বাকশক্তি হ্রাস পায় তার। হীম হওয়া শরীরটা তখন আগ্নি তাপে ধীরে ধীরে উষ্ণ হয়। গভীর ভাবে যখন দু’জন মিশে যায় তখন প্রকৃতি নাটকীয় ভাবে আবহাওয়ার প্রতিকূলতা বৃদ্ধি করে। বাতাস আরেকটু শীতল হয়। তৌসিফ ঠিক ততটাই উষ্ণতা ছড়ালো পৌষ’র মাঝে। আবেগে গা ভাসায় পৌষ৷ ভুলে যায় কিছুক্ষণ পূর্বের স্বামীর হুমকি ধামকি।
_____________________
— মিনু’কে এখানে নিয়ে আসি?
এই নিয়ে পঞ্চম বার সোহা মেহেদী’কে বললো কথাটা।
মেহেদী প্রথম দিন ভাবছি বললেও এরপর থেকে আর কিছু বলছে না। হু হা কোনটাই না৷ সোহা উত্তর না পেয়ে পুণরায় বলে,
— মেহেদী আপনি শুনছেন? মিনু’কে আনার কথা ছিলো তো।
মেহেদী তখন কিছু খাতা দেখছে। সোহা উত্তর না পেয়ে বাথরুম গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। মেহেদী’র জন্য চা এনে টেবিলে দিতেই মুচকি হাসলো ও। সোহা আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— হেল্প করব?
— আরে না। হয়ে গেলো বলে।
সোহা ভাবলো কাজটা শেষ হলে বলবে। আজ মেহেদী’র মন ভালো। সকালে সোহা’র চুলে ফুলের মালা পেঁচিয়ে সে মাফ চেয়েছে। সোহা’র মনে কথাটা যদিও এখনও গেঁথে আছে তবুও মৌখিক মাফ সে করেছে। মেহেদী যতক্ষণ খাতা দেখলো সোহা পাশে বসে রইলো। একবার গিয়ে শাশুড়ীকে দেখে এসেছে। তার কোমড়ের ব্যথা সারে নি এখনও।
অনেকটা সময় পর মেহেদী’র খাতা দেখা শেষ হতেই সে সব গুছালো। বিছানাটা ঝাড়তে ঝাড়তে সোহা বললো,
— এসে পরুন। গোছানো শেষ।
মেহেদী মা-বাবা’কে দেখে দরজার লকটা চেক দিয়ে এলো। চোর বাড়ছে ইদানীং। মেহেদী বিছানায় উঠতেই সোহা পা তুলে বসে। মেহেদী লাইট নিভিয়ে কাছে টানতেই সোহা বলে,
— বললেন না?
মেহেদী ওর হাতটা নিজের বুকে রেখে বলে,
— কি বলব সোহা রাণী’কে?
— মিনুকে আনার কথা।
— ঘুমাবে আসো।
বলেই বুকে টেনে নিলো। সোহা কথা বলার চেষ্টা করেও পারলো না। মেহেদী এরিয়ে যাচ্ছে কথাটা বারবার।
_______________
ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে দুটো হাঁচি দিলো পৌষ। বুকের মাঝখানে চেপে ধরলো ততক্ষণই। হাঁচির দাপটে ব্যথা হচ্ছে বুকে। তৌসিফ তখন গরম পানি হাতে এলো। পৌষ’কে জোর করা লাগলো পানিটুকু খেতে। তৌসিফ ভাবলো ধমক একটা লাগাবে। ট্যাবটা ঘুরালেই গরম পানি আসে তবুও এই মেয়ের ত্যড়ামি। গরম পানি দিয়ে গোসল করলে নাকি গোসল গোসল লাগে না৷ কি আশ্চর্য কথাবার্তা। পানি খেয়েই পৌষ কাঁপতে কাঁপতে বলে,
— ক্ষুধা।
তৌসিফ শুনতে পেলো গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে বউয়ের পেটে। রোল গুলো নিয়ে নিজেও কম্বলের নীচে ঢুকে পৌষ’র মুখে তুলে দিলো। গরম করে এনেছে মাত্র আবার।
তৌসিফ নিজেও মুখে তুলে। “সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে” তৌসিফ এটা হারে হারে টের পেলো। যেই তৌসিফ খাওয়া নিয়ে এতটা কনসাস ছিলো সে কি না দিন দাহারে এমন হাবিজাবি খাচ্ছে। পৌষ তৌসিফ’কে খেতে দেখে খুশি হলো। উঁচু এক ঢেকুর তুলে বললো,
— সস দেই?
তৌসিফ মলিন চোখে তাকালো। পৌষ নিজেই সস দিতে দিতে বললো,
— এই সস কিন্তু আমি বানিয়েছি। একদম হোম মেইড যেমন আমি।
তৌসিফ পলকহীন তাকিয়ে রইলো। একটু আগে কাকে ধমকালো, কাকে উঁচু স্বরে শাসালো, কাকে ই বা এত কথা শোনালো বিনা দোষে। এই মেয়ে দিব্যি তৌসিফে’র ন্যাওটা এখনও। তৌসিফ পাশ থেকে টিস্যু দিয়ে পৌষ’র মুখ মুছে দিতে দিতে বললো,
— সকালের খবর দেখবে। ভালো একটা হেডলাইন পাবে তাতে।
পৌষ গোটা গোটা চোখে তাকিয়ে রইলো। তৌসিফ চোখে হাসলো। কাল বড় এক ঝামেলার সমাপ্তি হবে।
#চলবে….
#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৫৪
হাতে, পায়ে মুজা পরে গায়ে মোটা এক সোয়েট শার্ট পরা সত্বেও ঠান্ডায় যেন পৌষ’র দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। এয়ারপোর্টে নামা মাত্রই পৌষ’র শরীর অচল হয়েছে। প্লেনে ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা হলো ওর। বমি করেছে তিনবার। ফ্লাই করার সময় যখন প্রথম ধাপে বমিটা হলো তখন তৌসিফ বেচারা প্রতিপক্ষ থেকে নিজেকে বাঁচাতে সময় পায় নি। হুটহাট করেই যেন বমির দৃশ্যটা হলো। পৌষ হয়তো নিজেও বুঝতে পারে নি এমন কিছু হবে। তৌসিফ খুঁতখুঁত করা পুরুষ। সে নাক কুঁচকালো না। বমির টক গন্ধেও তার যেখানে নিজের বমি পাওয়ার কথা সেখানে কি না তৌসিফ ছিলো বিচলিত। কতক্ষণে পৌষ’কে ধরবে এটাতেই মগ্ন ছিলো ও। দ্বিতীয় দফায় প্লেন একবার ঝাঁকি খেলো তখন পৌষ তলিয়ে দিলো যদিও ততটা না। তৃতীয় বমি হলো ল্যান্ডিং এর সময়। শরীর কহিল হলেও সদা সচেষ্ট ছিলো পৌষ তার জামাই এর টাকা উসুল করতে। এই যেমন প্লেনে যতবার খাবার সার্ভ করা হয়েছে ততবারই একটার জায়গায় দুটো নিয়েছে ও। তৌসিফ যা খাবে না তা সহ নিয়েছে। নিজের ব্যাগে যতটা পেরেছে শুকনো খাবার ভরেছে। মাঝে চকলেট সার্ভ করা হয়েছিলো পৌষ দুটো নিয়ে আবার ডেকে দুটো নিলো। তৌসিফ না পেরে একবার চাপা স্বরে ধমকালেও পৌষ দ্বিতীয় বেগে বলে উঠে,
— লাখ টাকার সোধ আমি তুলব না? আমি তো পারলে এদের দিয়ে হাত-পা টিপিয়ে নিতাম। আশ্চর্য আমার আর বমি কেন আসছে না? ওরা পরিষ্কার করবে। টাকা আমি উসুল করেই যাব। আমার জামাই এর হালাল টাকা।
তৌসিফ এহেন পা’গলামি দেখে বিরক্ত হয় না। তার ভালোলাগে সবটা৷ এই দুষ্ট পাখি কতক্ষণই বা টইটই করবে? একটু পরেই ক্লান্ত হয়ে যাবে। তৌসিফ তখন অতীত থেকে ঘুরে আসে একটু আকটু। পিয়াসী অবশ্য এসবে কোনরূপ পাত্তা দিতো না। দুই মাস অন্তর তাদের একটা করে ট্রিপ দেয়া হতো। প্রতি মাসে তাকে স্বর্ণ দেয়া হতো। মূলত পিয়াসী ছিলো বিলাসীতা প্রিয়। তৌসিফও দুই হাত খুলে উজাড় করে দিয়েছিলো। নিজের সবটা ভালোবাসা দিয়ে ফেলেছিলো। হাজার চেয়েও ছোট্ট একটা তৌসিফ ও পায় নি। হয়তো ভাগ্যে ছিলো এই দুর্দান্ত পৌষরাত যার ঔরসে আসবে তৌসিফে’র সন্তান।
আপাতত তৌসিফে’র এক বাহুর ভাজে পৌষ’র এক হাত ঢুকানো। তৌসিফ অন্য হাতে ফোনে কাউকে কল দিচ্ছে। পৌষ পরপর দুটো হাঁচি দেয়া মাত্রই তৌসিফ ওকে টেনে কাছে নিলো। নিজের পরণে থাকা জ্যাকেটের জিপ এক টানে খুলে পৌষ’র মাথাটা নিলো সেখানে। উষ্ণ, তপ্ত একখানা বুক। শক্ত অথচ অতি কোমল পৌষ’র জন্য। পৌষ নাক টেনে শ্বাস নিলো। তৌসিফে’র ঘ্রাণ তখন পৌষ’র নাসারন্ধ্র ভেদ করে হৃদপিণ্ড দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তৌসিফ ওকে ওভাবে নিয়েই ফোনে গম্ভীর কণ্ঠে শুধু বললো,
— কাম ফাস্ট।
অপর পাশের ব্যাক্তির কথা শোনা গেলো না। পৌষ কাঁপতে কাঁপতে বললো,
— কে আসবে নিতে? এখানে কেউ চেনা আছে আপনার?
তৌসিফ বউয়ের লাল হয়ে আসা নাকটা টেনে ধরে। বরফের মতো ঠান্ডা সেটা। তৌসিফ ঝুঁকে আলতো চুমু দিলো তাতে। পৌষ সরে যেতেই ওকে টেনে কাছে নেয় ও। পৌষ কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
— এখানে কত মানুষ।
— ইটস অস্ট্রেলিয়া হানি।
— তাতে কি? লজ্জা শরম ভুলে গুলিয়ে খেয়ে ফেলবেন আপনি?
— যার যার হক বুঝে নিতে হয়।
— শুনেছি বুড়োরা বউ আদর করে বেশি।
ঝলমলে, গ্লোয়িং তৌসিফে’র মুখটায় আচমকাই আঁধার ছেঁয়ে গেলো। সুন্দর ঠোঁটটায় থাকা হাসিটুকু যেন গিলে ফেললো ও। পৌষ অবাক হয়ে সেকেন্ডের ব্যবধানে তৌসিফে’র পরিবর্তন দেখে। অবাক হতে গিয়েও যেন হয় না। জামাই তার এসব নিয়ে খুবই সচেতন। পৌষ হাত উঁচু করে তৌসিফে’র গালের দাঁড়িতে রেখে হেসে দিয়ে বললো,
— মাফ চাইছি ভাই। আপনি জোয়ান। আমি বুড়ি। কুড়িতে এমনিতেই মেয়েরা বুড়ি। আমার তো কুড়ি পার হয়েছে।
তৌসিফে’র আধার সরলো না। পৌষ হাসতে হাসতে লুটিয়ে পরে বুকে। তৌসিফ এক হাতে ধরে ওদের সামনে থামা গাড়িতে উঠলো। পৌষ তৌসিফে’র গা ঘেঁষে বসে একদম। তৌসিফ মানুষটা গরম গরম। আশেপাশে প্রচুর ঠান্ডা সাথে বাতাস বইছে। সুন্দর রাস্তা দেখে পৌষ অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। বাড়ী-ঘর খুব কম এখানে। মাঝে শুধু গাছপালা। রাস্তাটাও ফাঁকাই বলা চলে। মাঝেমধ্যে দুই একটা গাড়ি যাচ্ছে। তৌসিফে’র বাহু বন্ধনে থেকে এতটুকুই দেখে পৌষ।
.
হোটেলে পৌঁছাতেই পৌষ অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়। এটা মূলত তার কাছে হোটেল লাগছে না। আলিসান বাড়ীই বলা চলে। চার নাম্বার ফ্লোরে লিফট থামতেই পৌষ দেখলো কিচেন সহ একটা এক রুমের বিশাল জায়গা। বাথরুম দেখে দুটো ঢোক গিলে ও। কাঁচের গ্লাসের বাইরে দৃষ্টি দিয়ে আরেক দফা অবাক হলো পৌষ। চোখ জুড়ানো এক সুন্দর দৃশ্য। সময়টা রাত হওয়াতে আগুন জ্বালিয়ে কেউ কেউ ড্রিংক করছে। খাওয়া দাওয়াও চলছে। তৌসিফ গায়ের কোর্ট খুলতে খুলতে ডাকলো,
— হানিই?
— হুঁ?
অমনোযোগী উত্তরে তৌসিফ এগিয়ে এলো। জুতা খুলে দিতে বলতেই পৌষ ফিরে ওর দিকে। পিটপিট করে তাকিয়ে বসে জুতা খুলতে খুলতে বলে,
— হানিমুনে বউ দিয়ে কেউ কাজ করায়?
— আমার বউ করে।
— জামাই করায়।
— বাইরে কি দেখছিলো আমার তোতাপাখি?
— ওখানে পার্টি হচ্ছে মনে হয়।
— হ্যাঁ। আমরাও ইনভাইটেড। হোটেলের তরফ থেকেই এটা।
পৌষ এক জুতা খুলেই লাফিয়ে উঠে। ঝলমলে গলায় বলে,
— চলুন তাহলে।
তৌসিফ এক ভ্রুঁ উঁচু করে বললো,
— হুয়াই?
— পা*গল আপনি? দাওয়াত দিলো যাব না? ওখানে খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে। রাতে ওখানে খেলাম তাহলে টাকা বাঁচলো তো নাকি? এখানে আর খাব কেন?
তৌসিফ নাক কুঁচকে হাসলো। পৌষ সেইদিকে তাকিয়ে রইলো। এভাবে তৌসিফ যখন হাসে তখন তাকে মারাত্মক লাগে। পৌষ অবাক হয়ে তখন সেই হাসি গিলে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই পুরুষ এত সুন্দর কেন? কোন কপাল পুড়ি একে ছেড়ে গেলো? তার কি মন চায় না এই হাসি আজন্মভর তাকিয়ে দেখতে? তার কি বুকে উত্তাল প্রেমের ঢেউ উঠতো না এই হাসি দেখে? পৌষ তো পা’গল বনে যায়। তার আত্মাটা কেমন ছলকে উঠে। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়। মন চায় সেই অনুভূতি পুষে রেখে দিতে। বড়ই সুন্দর এক অনুভূতি। প্রমময় অনুভূতি।
#চলবে….
#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৫৫
চোখ, মুখ উল্টে ত্যাড়া হয়ে শুয়ে আছে পৌষ। তার মাথায় অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তা কাজ করছে। যদি এখান থেকে পালিয়ে যায় তখন তৌসিফ চমকাবে। ভাববে অচেনা জায়গায় পৌষ কোথায় ই বা গেলো। তখন সে ভাঙা হারিকেন দিয়ে বউ খুঁজবে। পৌষ আবার চালাক। চতুরতা তার হাড্ডি-গুড্ডিতে ভরপুর। পৌষ লুকাবে বিশাল বড় এই আলমারির পিছনে। তৌসিফ যখন বউ খুঁজতে খুঁজতে পা’গল তখন পৌষ ফ্রীজে থাকা দামি দামি ফলগুলো খাবে আর টিভি ছেড়ে মনমতো একটা জাপানিজ কার্টুন দেখবে। বিষয়টা মন্দ না। করাই যায়। এতটুকু শাস্তি তো তৌসিফে’র হক। হক মা’রা পৌষ পছন্দ করে না। সে খুব করে চায় যার যার হক সে সে পাক।
এই শাস্তিটা তৌসিফ পাবে সদ্য অপরাধের জন্য। এই ভয়ংকর ঠান্ডায় সে পৌষ’কে গোসল করতে বাধ্য করেছে। পৌষ নাকি ময়লা হয়ে গিয়েছে। এই পুরুষটা প্রচুর খুঁতখুঁত করে। তার খাবারে খুঁতখুঁত। মানুষে খুঁতখুঁত। এমনকি তার পরিবেশের উপরও এক খুঁতখুঁত স্বভাব আছে। এই যেমন যেখানে সেখানে সে থাকতে পারে না। পৌষ’র মনে হয় এটা একটা রোগ। এই রোগের নাম খুঁতখুঁতানি রোগ। এই রোগের কোন ঔষধ নেই। আছে শুধু ঝাড়ফুঁক। পৌষ ভাবলো এই দফায় একদিন দেশে ফিরে তৌসিফ’কে ঝাড়াবে। ঝাড়ুর দুই বারি খেলেই সে ঠিক হয়ে যাবে। তারকাঁটার মতো সোজা হয়ে যাবে। এই ঠান্ডার মধ্যে কেউ বউ গোসল করায়। আরে ভাই, প্লেনে করে এসে কে ই বা ময়লা হয়? আশ্চর্য!
পৌষ যখন আকাশ-পাতাল উদ্ধার করে চিন্তা করতে করতে ডুবে যাচ্ছিলো তখন তার পথভ্রষ্ট করতে তৌসিফ হাজির হলো। পৌষ’কে গোসল করিয়ে এখন নিজেও গোসল করে এসেছে। এসেছে তো এসেছে খালি গায়েই রুম জুড়ে পায়চারি করে যাচ্ছে। এতে অবশ্য পৌষ’র সমস্যা হচ্ছে। তার মনোযোগ ঠিক থাকছে না। রাগ গুলো ধরে রাখা যাচ্ছে না। পৌষ বিরক্ত হয় নিজের উপর। রাগ কেন ধরে রাখা যাবে না। রাগকে ধরে রাখতেই হবে। তৌসিফ তালুকদারকে বশে আনতেই হবে। তার বুঝতে হবে শীতের দেশে গোসল করা বাধ্যতামূলক না। গোসলে পানি নষ্ট হয়। দেশে পানির বড়ই আকাল। না জানি কবে পানি ফুরিয়ে যায়? পৌষ বড়ই চিন্তিত। ওর চিন্তার ফাঁকে হঠাৎ গায়ে কিছু পরতেই কম্বলের নীচ থেকে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে পৌষ। ভেবেছিলো গায়ের উপর পোকামাকড় কিছু বুঝি পরলো কিন্তু না তেমন কিছু না। তৌসিফ লোশন ছুঁড়ে দিয়েছে। পৌষ হাতে নিয়ে তা তৌসিফে’র দিকে ফিঁকে মা’রে। ক্যাচ ধরে সগর্বে হাসে তৌসিফ। কোমড়ের টাউজারটা টেনে কাছে এগিয়ে এসে পৌষ’র সম্মুখে দাঁড়িয়ে আদেশ ছুঁড়ে,
— লোশন লাগিয়ে দাও।
পৌষ সাদা সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বলে,
— আমি তো পারি না।
— আসো শিখিয়ে দেই।
— শিখতেও চাই না।
— মানুষ শীতের দিনে শরীরে কিছু তো লাগায় নাকি? দেখেছো নিজেকে তুমি। শরীরের কি অবস্থা হানি।
বিষন্ন গলায় পৌষ বললো,
— হুঁ।
ব্যাস এতটুকুই। হাঁটু ভাজ করে তাতে মাথা ঠেকিয়ে শরীরে কম্বল টানতেই তৌসিফ কেড়ে নিলো তা। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
— কি?
পৌষ উত্তর করে,
— কই কিছুই না।
— আশ্চর্য! তুমি কোথায় তাকিয়ে আছো পৌষরাত?
— কোথায় তাকালাম আবার? আপনার দিকেই তো তাকিয়ে আছি।
— পৌষরাত!
— বলুন।
— তুমি কি দেখছো?
— আপনাকে দেখছি। খালি গায়ে আছেন। পরণে কালো টাউজার। গলায় টাওয়াল।
— দেখেতো হাতে কি।
— খালি।
তৌসিফ চিন্তিত হয়ে এগিয়ে এসে বিছানায় বসে। পৌষ’র মাথাটা ধরে নিজের মুখের সামনে এনে বলে,
— এখন?
— বড় আলমারিটা দেখা যাচ্ছে। এই যে।
আঙুল দিয়ে উল্টো দেখালো তৌসিফ’কে। তৌসিফে’র মাথাটা তখন ঝিমঝিম করতে লাগলো। পৌষ’র চোখে যে সমস্যা হচ্ছে তা বুঝে গেলো যেন কিন্তু হঠাৎ করে কিভাবে সম্ভব? পৌষ দেখলো তৌসিফ চিন্তায় মুখটা পাংশুটে করে তাকিয়ে আছে। ফোনটা হাতে তুলে ঝটপট কল লাগালো কাউকে।
মনে মনে ভীষণ মজা পেলো পৌষ। তৌসিফ’কে বোকা বানাতে পেরে তার বুকের ভিতর এক অজানা সুখ হচ্ছে। এই লোক মহা চালাক। ঠান্ডায় গোসল করানোর শাস্তি এটাই। কাল সকালে গিয়ে পৌষ ঠিক হবে।
পৌষ উঠে আলমারিতে গিয়ে ব্যাগ নিলো। তাকিয়ে রইলো তৌসিফে’র দিকে। চিন্তিত মুখে সে তখনও কল করছে। পৌষ প্লেন থেকে আনা চকলেট বের করে একটা নিজের মুখে দিলো। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে গিয়ে বসলো তৌসিফে’র পাশে। একটা চকলেট খুলে তৌসিফে’র মুখে দিতেই কাঙ্ক্ষিত কলটা রিসিভ হলো। তৌসিফ চকলেট চুষতে চুষতেই ডিনার দিতে বলে রেখে দিলো। পৌষ হা করে শ্বাস টানলো। এটা কি হলো? পৌষ তো ভাবলো তৌসিফ হয়তো ডাক্তারকে কল দিচ্ছে। ডাক্তার এলেও পৌষ কিছুক্ষণ তিড়িং বিড়িং করতো কিন্তু কোথায় ডাক্তার?
তৌসিফ ফোনটা রেখে লোশন এগিয়ে দিয়ে বললো,
— তারাতাড়ি লোশন দাও হানি।
পৌষ’র এত রাগ লাগলো যা বলার বাইরে। তার মন চাইলো এই লোকটাকে খামচে দিতে। ওরই দোষ। মনে রাখা উচিত ছিলো এটা তৌসিফ তালুকদার। দ্যা মোস্ট চালাক ব্যাটা। পৌষ মনে মনে গালি দিলো, “খাটাস ব্যাটা”।
— কি বিরবির করছো?
পৌষ মুখ লটকে তৌসিফ’কে লোশন লাগালো। এই লোক একটা অলস। এইসব কাজ সে নিজে করবে না। পৌষ’কে দিয়েই করাবে। পায়ে লোশন লাগিয়ে নখে আবার আলাদা জেল লাগায়। পৌষ মুখ কুঁচকেই রাখলো। কোন পুরুষ এতটা ঢং কিভাবে করতে পারে?
এমনিতেই এত সুন্দর তার উপর এসব ডলাডলি তার লাগবেই।
খাবার আসতেই তৌসিফ তা নিয়ে নিজেই সার্ভ করে। পৌষ’কে ডাকতেই গমগমে স্বরে শোনা গেলো,
— খাব না।
— উঠে এসো।
— ক্ষুধা নেই।
— আছে।
— বলেছি তো খাব না।
— হানিই আ’ম ঠু হাঙ্গরী।
পৌষ’র বুকে একটু একটু মায়া লাগে। উঠে বসে মাথা সহ কম্বলের নীচেই রেখে বলে,
— এখানে দিন।
— এখানে এসো।
— মোটেই না।
তৌসিফ বউ’কে আর খোঁচালো না। উঠে প্লেট নিয়ে বসে পৌষ’র হাতে দিলো। প্লেট নিয়ে অন্য দিকে মুখ করে খাচ্ছে ও। তৌসিফ শ্বাস টানলো। শুধু মাত্র গোসল করালো বলে এত রাগ। ভাবা যায়? হানিমুনে এসে যদি বউই রেগে থাকে তাহলে হানি যায় একদিকে মুন যায় আরেকদিকে। এ এক বিরাট মুশকিল। তৌসিফ অসহায় অসহায়বোধ করে। বউ নিয়ে বড় জ্বালায় আছে সে।
এই ফিলোসফির কোন ব্যাখা নেই। কেউ দিতে পারবেও না। যেই তৌসিফ তালুকদারের ধারে কাছে কেউ ঘেঁষার সাহস পায় না সেই তৌসিফ তালুকদার এখন বউয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। আদর-সোহাগ পাওয়ার জন্য ভেতর ছটফট করে তার। মন চায় এই আদর আদরটার সাথেই থাকতে। সারাক্ষণ চোখ ভরে একেই দেখতে।
বেল বাজতেই তৌসিফ উঠে দরজা খুলে। সাদা শার্ট কালো প্যান্ট পরে ফর্মাল লুকে একজন লোক এসে ওয়াইনের একটা বোতল এবং কিছু আইস কিউব সাইডে সাজিয়ে রেখে গেলো। ইংরেজিতে কোনরূপ জড়তা ছাড়াই হাসিমুখে তাদের স্বাগতম জানিয়ে কিছু সুন্দর বাক্য আওড়িয়ে গেলো। তার কথা ছিলো এই যেমন,
“আপনাদের রাত মিষ্টি মধুর হোক”
এছাড়াও হাংকি পাংকি আরো অনেককিছুই বলেছে সে। পৌষ উত্তরে চমৎকার এক মুখ ভ্যাংচি দিয়েছে। লোকটা থতমত খেলেও মুখ হাসি-হাসি রেখেছে। বলা যায় এটা তাদের দক্ষতা। কাজের ক্ষেত্রে এরা যথার্থ পটু। লোকটা যেতেই চোখ সিকায় তুলে পৌষ প্রশ্ন করলো,
— হানিমুনে এসেছে এসব গিলতে?
— কিসব বলো তুমি হানি? বউ থাকতে আমি এসব ধরব?
— না থাকলে ধরেন?
— টুকটাক।
— বাহ্। ভালো তো। আসুন খাই।
অবাক কণ্ঠে তৌসিফ জিজ্ঞেস করে,
— কি খেতে চাও?
— মাগনা সবই খাব আমি।
তৌসিফ গরম পানির কেতলিটা চালু করে পর্দা টানতে টানতে বললো,
— এখানে কিছুই মাগনা না।
— তাহলে আপনি টাকা দিয়ে কিনে ছাইপাঁশ খাচ্ছেন? বাহ্। খুবই ভালো। এসব খেতেই এখানে এসেছেন? এখনই দেশে যাব আমি। আপনি থাকুন এখানে।
কেতলিতে পানি ফুটতে শুরু করেছে। তৌসিফ গিয়ে দুটো কাপে কফির স্লেশে ঢেলে গরম পানি দিলো। পৌঢ উত্তর না পেয়ে গমগমে স্বরে বললো,
— কথা বলেন না কেন হ্যাঁ?
তৌসিফ কাপ নিয়ে একটা পৌষ’র হাতে দিয়ে বললো,
— তুমি এত কথা কিভাবে বলো? আমার কি যে ভালো লাগে। মন চায় সারাটাক্ষন তোমাকে শুনি।
— আপনি কি আমাকে রেডিও বলে অপমান করছেন?
তৌসিফ বিছানায় পা তুলে বসে হাসলো। পৌষ’র গা ঘেঁষে বসে বললো,
— অনেক ঠান্ডা।
— তাহলে মরুভূমিতে যেতেন। গরম লাগতো।
— মরুভূমিতে হানিমুন। নট অ্যা ব্যাড আইডিয়া।
— যাবেন নাকি?
— কেন নয়?
— কবে যাবেন?
— নেক্সট হানিমুনে।
— এতই সোজা?
— বউ তো আমারই। সোজা না কঠিন তা আমি দেখে নিব।
— কফিটা মজা লাগছে।
— ল্যাটের টেস্ট ভালো।
— বিস্কুট নেই এখানে?
— ক্ষুধা লেগেছে?
— না কিন্তু এটার সাথে বিস্কুট ভালো লাগবে মনে হচ্ছে।
তৌসিফ ফোন হাতে তোলা মাত্রই পৌষ কেড়ে নিলো। তার মুখটা হাসি হাসি। তৌসিফ এক ভ্রুঁ উঁচু করে জিজ্ঞেস করে,
— কি হলো?
— পিঠ থাপ্রে দিন আমাকে।
— কিহ!
— আরে দিন না।
তৌসিফ ঠাই বসে রইলো। পৌষ নিজের পিঠে নিজেই থাপ্পর দিয়ে বাহবা দিলো। উঠে গিয়ে ব্যাগ থেকে দুটো বিস্কুটের প্যাকেট বের করে বললো,
— এটা প্লেন থেকে চুরি করে এনেছি। বাথরুমে যাওয়ার সময় সাইডে দেখেই দুটো তুলে নিয়েছিলাম। দেখলেন কিভাবে চলতে হয়? আমার জামাই….
— তোমার জামাই এর কষ্টের টাকা। জানি তো আমি। এসো এখানে। কফি ঠান্ডা হচ্ছে।
পৌষ মহা আনন্দ নিয়ে চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খেলো। তৌসিফ বউয়ের কপালে হঠাৎ নিজ থেকে চুমু দিতেই পৌষ চাইলো মুখ তুলে। তৌসিফ ওর গালে হাত রেখে বললো,
— সবসময় এমন থেকো পৌষরাত। কখনো বদলে যেও না। আমাকে ফেলে যেও না।
— কেন যাব?
— যেতেই দিব না।
তৌসিফে’র গালে হাত রাখে পৌষ। দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
— আপনি যে দেখতে অনেক সুন্দর তা কি জানেন?
— জানি।
— কে বললো?
— মা বলতো।
— শাশুড়ীর সাথে আমি একমত। আমি শুধু সুন্দর না বরং অতি সুন্দর। পুরুষদের এত সুন্দর হতে নেই।
তৌসিফ ওকে টেনে বুকে ফেলে। গলায় হাত দিতেই ঝটকা মে’রে উঠে বসে পৌষ। দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,
— ভুলে যাই নি কিন্তু। এখন নয় ছয় কিছুই মানব না। একটু আগে গোসল করেছি।
— কাম অন হানি……
— উঁহু।
— প্লিজ।
— কু’ত্তায় কামড়ালেও না।
— আজব কুকুর কেন কামড়াবে?
— ঘুমান সাহেব। আজ ডাল গলবে না কিছুতেই।
— রাগ পরে দেখিও তোতাপাখি।
তৌসিফ নানান কথা বললো। পৌষ অনড়ভাবে বসে রইলো। আচমকা টানে ওকে নিজের কাছে নিলো তৌসিফ। পৌষ গাঢ় চাহনি দিলো ওকে। তৌসিফ চোখে হাসে। অদ্ভুত ভাবে পৌষ’র রাগ পরে গেলো। যেন বরফের দেশে দ্বিপ্রহরের সূর্য উঁকি দিলো। টলমল করছে সমুদ্র। পৌষ বিগলিত হলো। নিজে আগ বাড়িয়ে তৌসিফে’র কপালে চুমু দিয়ে বললো,
— সুন্দর পুরুষ।
#চলবে…..