প্রেমসুধা পর্ব-৭২+৭৩+৭৪

0
93

#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৭২

পূর্ব আকাশে লাল আভা ফুটতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে অন্ধকার। পুকুর পাড়ে আজ জাল ফালানো হয়েছে। বাড়ির মানুষদের জন্যই মাছ তোলা হচ্ছে। সেই সুবাদে ওখানে শব্দ হচ্ছে। মানুষ জনের কথা শোনা যাচ্ছে। পৌষ কপাল কুঁচকে চোখ খুললো। তার রাতে ভালো ঘুম হয় নি। তৌসিফ কাল খুব করে জ্বালালো। এখনও গুটিশুটি মে’রে বুকে ঘুমাচ্ছে। এত বড় মানুষ এভাবে ঘুমালে কেমন লাগে? পৌষ সরাতে চাইলো। ভাবলো ডাকবে কিন্তু কেমন একটা মায়া কাজ করলো তার। পৌষ ভাবলো তৌসিফে’র সাথে কথা বলবে। তৌসিফে’র মতো মানুষ কেঁদেছে এটা নিশ্চিত করে যে বিষয়টা খুবই জটিল হয়ে গিয়েছে। পৌষ আজ কথা বলবেই। তার ভেতরে অসস্তি লাগছে। গতরাতে তৌসিফে’র ওভাবে করা গুমরে কান্না তার সহ্য হচ্ছিলো না। ভেতর ভেতর কেমন যে লাগলো তা পৌষ প্রকাশ করতে পারবে না। তার মনে হচ্ছিলো তৌসিফ বোধহয় এখনই মা’রা যাবে। বড় দেহটা কেমন কুঁকড়ে গিয়েছিলো। পৌষ হাত দিলো ওর কপালে। এখনো যথেষ্ট গরম। চুলে হাত বুলালো বেশ সময় নিয়ে। একটা মানুষ যে কিনা শক্তপোক্ত, চালচলন অনুসরণীয় সে যদি কেমন করে তাহলে কেমন লাগে?
পৌষ আস্তে করে ডাকলো,

— শুনছেন? উঠবেন না।

তৌসিফ জবাব দিলো না। ও বুকের মধ্যে মুখ গুজেই রইলো। পৌষ’র ময়া হলো। ভীষণ মায়া। কষ্টে তার ভেতর ফেটে যাচ্ছে। আস্তে ধীরে ঠেলে সরালো তৌসিফ’কে। এমন গভীর ঘুম কোনদিনই তৌসিফে’র ছিলো না। তার ঘুম পাতলা। পৌষ নড়লেই সে নড়েচড়ে উঠে। ঠোঁট কামড়ে ধরে পৌষ। এদিক ওদিক তাকিয়ে ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে মোটা কম্বল দিয়ে গলা পর্যন্ত ঢেকে দেয় তৌসিফ’কে। উঠে দাঁড়াতে তার কষ্টই হলো। কোমড় ধরে গিয়েছে যেন। মুখ ধুঁয়ে একটু বারান্দায় আসতেই ঠান্ডা বাতাসে দেহ প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়ার যোগাড় হলো তার। এটা শীতের নয় বরং আগত বসন্তের বাতাস। পৌষ ভালো লাগলো যদিও বসন্ত কোনদিনই তার পছন্দের তালিকায় ছিলো না। বসন্ত আসা মানেই শীতের বিদায়। শীত ভালোবাসা মানুষগুলোর কাছে বসন্ত যেন এক আতঙ্ক। সে আসা মানেই শীত পোটলা বেঁধে চাঁদের দে-শে পালাবে। একদম ধরা ছোঁয়ার বাইরে যাকে হাত ছানি দিয়ে ডাকলেও কাছে আসবে না। ধরা দিবে না। মাছ ধরার ওখানে দাঁড়িয়ে তদারকি করছে তৌফিক তালুকদার। পৌষ মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলো।
রান্না ঘরে এসে ফুরফুরা মেজাজে গরুর গোশত কষালো। একদম ঝাল করে। তৌসিফে’র জ্বর। এখন ঝাল খেলে কিছুটা ভালো লাগবে। বুয়া’কে পরোটা বানাতে বলে দারোয়ান দিয়ে ডাক্তার ডাকালো। কেন জানি পৌষ যা করছে সবটা শান্ত ভাবেই করছে। অন্য সময়ের মতো ছটফট তার মাঝে দেখা যাচ্ছে না। এটা কি? মাতৃ কালীন আসা কোন পরিবর্তন নাকি পৌষ দমিয়ে রাখা অনুভূতি পৌষ বুঝে না।
ডাক্তার দেখেই জানালেন জ্বর একশ’রও উপর। মাথায় পানি দিয়ে বলে ঔষধ দিলেন লিখে। পৌষ স্বাভাবিক ভাবেই আড়ালে ছিলো। সবটা শুনলো সে অতঃপর ফোঁস করে শ্বাস ফেললো। এই ব্যাটাকে শিক্ষা দিতে মানুষ আনাচ্ছে পৌষ৷ একা পেয়ে পৌষ’কে অনেক জ্বালাচ্ছে সে। এখন কি তার অসুস্থ থাকার? লজ্জা করা উচিত তার।

তৌসিফে’র মাথায় এতক্ষণ পানি ঢেলেছে পৌষ। জামাই এর সেবা করতে তার এবার রাগ উঠেছে। সে সেবা করছে এদিকে তৌসিফ ফুঁপিয়ে উঠছে খানিকক্ষণ পরপর। এই আচরণের মানে কি? আচমকা পৌষ থমকে গেলো যখন গুঙিয়ে উঠে তৌসিফ তার মা’কে ডাকলো। পৌষ’র ভেতর চুরমার হয়ে এলো। তার মা নেই। মা বলতে কাউকে মনেও নেই। তারাতাড়ি তৌসিফে’র মাথাটা ও বুকে জড়ালো। আদুরে ভাঙা গলায় বললো,

— কি হয়েছে? এই তো আমি আছি তো। আমি দোয়া করি আপনার মা ফিরে আসুক। এতদিন ইচ্ছে ছিলো আমার বাবা আসুক কিন্তু এখন থেকে আপনার জন্য হলেও চাইব মা আসুক। দুটোই মা আসুক। আপনি এভাবে কেন কাঁদছেন? শুনুন না?

পৌষ’র গলা রোধ হয়। তৌসিফ এই এতক্ষণে একটু চোখ খুলে। পৌষ ওর কপালে চুমু দিয়ে বললো,

— শোধ নিচ্ছেন এভাবে অসুস্থ হয়ে?

তৌসিফ চোখ বুজার আগেই কাঠখোট্টা গলায় পৌষ বলে উঠলো,

— খবরদার! ফ্যাচফ্যাচ করবেন না। আপনার মা আছে না পেটের ভেতর? তার যত্ন না করে এভাবে খাটাচ্ছেন আমাকে?

মুহুর্তেই যেন কণ্ঠে নমনীয়তা এলো। পৌষ কাতর স্বরে বলে উঠলো,

— অ্যাই মামাতো ভাই, এমন কেন হলো?

— হাসবেন্ড হই তোমার। মামাতো ভাই না।

গতকাল থেকে আজ, এই পর্যন্ত ভাঙা জড়ানো গলায় এই প্রথম গোটা একটা লাইন বললো তৌসিফ। পৌষ হেসে ফেললো। বললো,

— লাইনে এসেছেন। দেখি উঠে বসবেন এখন। আমার কলিজায় টুকরো জামাইটাকে এভাবে মানায় না। আপনার পছন্দের গরু ভুনা করেছি।

— ব্রাশ করব।

— লাগবে না।

— পা’গলামি করো না হানি। কাউকে ডাকো। আমি উঠতে পারছি না।

পৌষ কটমট করে চাইলো। ধারালো কণ্ঠে বললো,

— বাহ বাহ! জামাই আমার অথচ ডাকব কি না আরেকজনকে তাকে টানতে? দেখি উঠুন। ভং হলো অনেক।

তৌসিফ মাথা নেড়ে হাসলো অল্প। পৌষ’র হাত ধরে উঠে টলতে টলতে বাথরুমে যেতেই পৌষ তাকে ব্রাশ করতে সাহায্য করলো। তৌসিফ’কে ভেতরে দিয়ে কঠিন গলায় বললো,

— আছি। দরজা লক করবেন না।

বাইরে থেকে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো পৌষ। খানিক বাদে তৌসিফ ডাক দিতেই দেখলো বেসিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে তৌসিফ। তার মাথা ঘুমাচ্ছে। এত দূর্বল কিভাবে হলো সে? মানুষিক বিষাদ কি মানুষকে এতটাই দূর্বল করে দেয়? পৌষ ওকে বিছানায় হেলান দিয়ে বসালো। বুয়াকে ডেকে খাবার রুমে আনিয়ে মুখে তুলে খাওয়াতে খাওয়াতে বললো,

— কেমন হয়েছে?

— আমার পৌষরাতের হাতের রান্না কখনো খারাপ হয়? তুমি খেয়ে সাথে সাথে হানি।

— খাব। শুনুন?

— শুনছি।

— এসব ভংচং বাদ দিন৷ একদিন সময় দিলাম সুস্থ হন৷ আপাকে কাল কল দিয়েছি। টিকিট কেটে আসতে যতক্ষণ। যদি সুস্থ না হন বাপের বাড়ী চলে যাব।

বউ এর হুমকিতে তৌসিফ একটু হাসলো। সে কিনা যাবে বাপের বাড়ী অথচ তৌসিফ ছাড়া থাকতে পারে না। পৌষ ওকে খায়িয়ে ঔষধ খাওয়ালো। এতেই যেন ওর বারোটা বেজে গেলো। এই তৌসিফ বাচ্চাদের হার মানাবে। এত বড় দামড়া লোক ঔষধ খেতে চায় না। পৌষ’র যেন একদিনেই ডুগডুগি বাজিয়ে ছাড়ছে তৌসিফ।
_____________________

সোহা’র ডেলিভারি ডেট এগিয়ে এসেছে। মেহেদী আজ এসে মিনু’কে নিয়ে গেলো। সোহা অবাক হয়ে তাকিয়েই ছিলো মিনু’কে দেখে। মিনু যখন আপা ডেকে ঝাপ্টে ধরলো তখন সোহা’র ধ্যান ভাঙলো। তার হাত-পা কাঁপতে লাগলো। কত হাসিখুশি তার বাচ্চাটা। সারাদিন ওর সাথে থেকে রাতে মিনুই বায়না ধরলো চলে যাবে। পৌষ’র সাথে ভালোই খাতির তার। সোহাও মানা করলো না। যেতে দিতো। মেহেদী নিজে গিয়ে মিনু’কে দিয়ে আসতে আসতে দেখলো বাড়ীতে কান্ড ঘটে গিয়েছে। সোহা’র চিৎকারে চারপাশ গমগম করছে। আশেপাশের মহিলারা ওদের ঘরে। মেহেদী ঘড়িতে দেখলো রাত দশটা। ত্রস্ত পায়ে ঘরে ঢুকতেই টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে বসা বাবা’কে দেখলো। হরবরিয়ে ডাকলো ও,

— সোহা? সোহা কোথায়? ও কাঁদছে কেন?

মেহেদী’র বাবা মাথা তুলে ছেলেকে ধরে বসালেন। জানালেন সোহা’র ব্যথা উঠেছে আধ ঘন্টা আগে। মেহেদী বের হওয়ার পরপর। তখন বাসায়ই ওর মা চেষ্টা করছেন। মেহেদী’র গা হিম হয়ে গেলো। বাসায় কিন্তু কেন? মেহেদী টাকা রেখেছো তো। ওর চোখ ভর্তি পানি জমলো। তারাতাড়ি ঐ দিকে পা বাড়িয়ে ডাকলো,

— মা? মা? সোহাকে হাসপাতালে নিব। ওকে তুলো।

ভেতর থেকে যা শুনা গেলো তাতে জমে গেলো মেহেদী। কান্নার শব্দ আসছে। ছোট্ট একটা চিকন মিহিয়ে যাওয়া কণ্ঠ। সোহা’র শব্দ আসছে না আর। ভয়ে আত্মা কেঁপে উঠে মেহেদীর। কিছু কি খারাপ হলো? ততক্ষণে হাসিমুখে একজন মহিলা বাইরে এসে জানালেন,

— মেহেদী, আব্বা তুমি তো মেয়ের বাবা হয়ে গেলো। ঘরে বরকত এসেছে।

আরেকজন ভেতর থেকে বললো,

— মেয়ে তো তাই বাবার টাকা বাঁচালো।

মেহেদী শুনলো না। ওর মুখে শুধু জিজ্ঞেস এলো,

— সোহা কি করছে?

জানা গেলো সোহা জেগেই আছে। মেয়ে হয়েছে শুনার পর থেকে চুপ আছে। মেয়ে আপাতত তার দাদির কোলে। মেহেদী’র কোলে দেয়া মাত্রই মেহেদী শার্টে দুই হাত মুছলো। মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক। তার ভেতর থেকে কান্না পাচ্ছে। মেয়েকে বুকে নিয়ে ভেতর ঢুকলো ও। ওদের আলাদা থাকতে দিয়ে সবাই বের হলো। মেহেদী সোহা’র পাশে বসেই ডাকলো,

— জান আমার?

সোহা তাকালো। মেহেদী দেখলো ওর দৃষ্টি। ব্যস্ত হয়ে বললো,

— কি হয়েছে সোহা? তোমার খারাপ লাগছে? ডাক্তার ডাকব?

— ও মেয়ে কেন?

বলেই কেঁদে উঠলো। মেহেদী অবাক হলো। নিজের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রাখলো আরেকটু। সোহা’কে সান্ত্বনা না দিয়ে বড় বড় পা ফেলে বাইরে চলে এলো।

__________________

পৌষ’কে ফাঁকি দিয়ে তৌসিফ বাইরে গিয়েছিলো। রাগে থম ধরে থাকা পৌষের রাগ ধুয়েমুছে সাফ হলো যখন দেখলো দু’জন ধরে ভেতরে আনছে তৌসিফ’কে। পৌষ প্রথমে ভাবলো হয়তো উলোটপালোট গিলে এসেছে তৌসিফ কিন্তু না শুনা গেলো গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে মাথা ঘুরেছে তার। পৌষ চুপচাপ ওর পাশে বসলো। ডিম সেদ্ধ খায়িয়ে মুখটা মুছে দিতেই তৌসিফ জানালো তার শরীর ব্যথা করছে। পৌষ যতখানি পারলো ওর ঘাড় থেকে নিয়ে পা পর্যন্ত টিপে দিলো। এক জীবনের সবটুকু সেবা যেন পৌষ করে যাচ্ছে। তৌসিফ ঘুমাতেই ওর মাথায় হাতালো পৌষ। ফোনে সময় দেখে তা রাখতেই বেজে উঠলো। অপর পাশ থেকে তায়েফা জানালো সে এয়ারপোর্টে আছে। চলে আসবে ঘন্টা খানিকের মাঝে।

তৌসিফে’র ঘুম ভাঙতেই পৌষ’কে পাশে বসা পেলো। খারাপই লাগলো ওর। মেয়েটাকে অতিরিক্ত চাপ দেয়া হচ্ছে। পৌষ’কে টেনে বুকে নিলো তৌসিফ। কপালে সময় নিয়ে চুমু দিয়ে বললো,

— হানি, আ’ম সরি।

— কেন?

— সবকিছুর জন্য।

— সরি বলার মতো কিছু হয় নি।

পৌষ উঠে বসতেই তৌসিফও হেলান দিয়ে বসলো। পৌষ ওর চোখে সরাসরি তাকিয়ে চোখ নামালো। তৌসিফে’র ডান হাতের তালু নিজের গালে ঠেকিয়ে প্রশ্ন করলো,

— কি হয়েছে বলুন তো আমাকে। আপনি ওভাবে কেন কাঁদছিলেন? আপনি কি জানেন আপনাকে ওভাবে দেখে আমার কেমন লাগছিলো?

পৌষ’র গলা ধরে এলো। তৌসিফ চোখ বুজলো অতঃপর খুলেই সরাসরি আর্জি জানালো,

— আগের মতো হয়ে যাও পৌষরাত। তুমিও বাচ্চা চাইতে তাহলে ওদের কথা জানার পর থেকে এতটা চুপসে গেলে কেন? কেন আমার থেকে গুটিয়ে যাচ্ছো? কেন চঞ্চলতা দেখছি না? আমার পৌষরাত তো এমন না। সে তো দূরন্ত।

পৌষ’র চোখ ভরে এলো। আস্তে ধীরে বলা শুরু করলো,

— যেদিন শুনলাম ওরা আছে আমার ভেতর তখন আমার পৃথিবী যেন থমকে ছিলো। যাকে আপনি খুব করে চাইতেন তাকে আমিও চাইতে লাগলাম। শুনলাম তারা দু’জন। আমার প্রতিক্রিয়া কি হবে নিজেই বুঝলাম না। চারপাশে যেন বদলে গেলো সব। আমার ধ্যান ধারণা বদলে গেলো। আমি জানিই না এসময় কেমন লাগে। বুঝতেই পারছিলাম না কি করব। পেটের ভেতর দুটো জান। এদের দায়িত্ব কিভাবে নিব? আমার না রাগ হচ্ছিলো না কষ্ট। আমার অনুভূতি থমকে ছিলো। আমি প্রকাশ করতে পারছিলাম না। আপনার শাসন আমাকে কখনোই কষ্ট দেয় নি। অধিকার নিয়ে কেই বা শাসন করেছে আমাকে? কে ই বা এত যত্ন করেছে? বাচ্চাগুলোর কথা ভাবলেই আমার কেমন লাগে। আমি তো এলোমেলো হয়ে যাই। সব যেন এলোমেলো। আমিও এলোমেলো হয়ে যাই। ওদের নিয়ে ভাবতে গিয়ে বারবার হারিয়ে যাই। খেই হারিয়ে ফেলি। আমি জানি না কেন এমন হয়? আমি সত্যিই জানি না। আমি আপনাকে কখনোই কষ্ট দিতে চাই নি৷ অবহেলা করার সাধ্য আমার নেই। বিশ্বাস করুন।

পেটে হাত দিয়ে আজ এতদিন দিন কাঁদলো পৌষ। তৌসিফ ঝট করে ওকে টেনে বুকে নিলো। ডাক্তার বারবার বলেছিলো ওকে এসব স্বাভাবিক কিন্তু তৌসিফই মানতে পারে নি। ওর এত সাধের পৌষরাত, এভাবে কষ্ট তো তৌসিফ দিতে চায় নি। ওর কপালে চুমু দিয়ে তৌসিফ কাতর স্বরে বলে উঠলো,

— মাফ করে দাও। আমাকে মাফ করে দাও। প্রথমবার আব্বু হব তো তাই বুঝতে পারছিলাম না। অভিজ্ঞতা নেই একদমই।

পৌষ’র রাগ হলো পরক্ষণেই হাসি পেলো। পেটে চিনচিন ব্যথা হচ্ছে তবুও পৌষ হাসছে। হাসতে হাসতে তৌসিফে’র গলা জড়িয়ে গালে ঠৌঁট ছোঁয়ালো। দাঁড়ির মাঝে এক কড় সমান আঙুল দিয়ে চুলকে দিতে দিতে বললো,

— অ্যাই মামাতো ভাই, মমো খাব।

#চলবে……

#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৭৩

সোহা-মেহেদীর মেয়ের আজ পৃথিবীতে আসার সপ্তাহ গড়ালো। আজ আকিকা দিয়ে নাম রাখা হবে। মেহেদী খাসি এনেছে। মেয়ের নাম রাখা হয়েছে মাকরুর। সোহা’র সাথে তার দুই দিন গড়াতেই মন কালো কেটেছে। সোহা ভেবেছিলো শাশুড়ী বুঝি মেয়ে দেখে রাগ। এতমাস শাশুড়ী থেকে মায়ের আদর পেয়ে মেয়ে হওয়াতে সেই আদরে ভাটা পরবে এমনটা ভেবেই সোহা প্রথমদিন মেহেদীকে উক্ত কথা বলেছিলো। দেখা গেলো শাশুড়ী মহা খুশি। সোহা বেয়াক্কল বনে গিয়েছিলো। সবটা জানিয়ে মেহেদী থেকে মাফও চেয়েছে। মেহেদী মুখ গোমড়া করে রেখেছিলো। তার সদ্য ভূমিষ্ট মেয়ে নিয়ে ওমন উক্তি তার মোটেও পছন্দ হয় নি। সোহা কথা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বামী তার রেগে নেই জানে, সে ফুলে আছে। সোহা ফুলা বেলুন ফাটাতে জানে।
মেহেদী, সোহা’কে অবাক করে দিয়ে ওদের বাড়ীতে এই প্রথম পা ফেললো তৌসিফ যার ডান হাতে ধরা পৌষ’র হাত। সাথেই মিনু। মেহেদী হা করে তাকিয়ে রইলো প্রথমে অতঃপর দ্রুত পদচারণ করে এগিয়ে এলো। হাসিমুখে সালাম জানাতেই তৌসিফ উত্তর নিয়ে বললো,

— ওকে বসাব। ফাঁকা জায়গা হবে?

ড্রয়িং রুমটায় মানুষ। নিজের মায়ের রুমে নিয়ে পৌষ’কে বসালো মেহেদী। সোহা এগিয়ে আসতেই পৌষ ওকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে,

— কেমন আছেন আপু?

সোহা চমকিত দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে রইলো অতঃপর নিজেও দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো। শক্ত করে। ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে বললো,

— ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?

পৌষ মুচকি হাসলো। তৌসিফ পৌষ’র পেছনে দুটো বালিশ দিয়ে আরামদায়ক করে দিতে দিতে মেহেদী’র মা শরবত হাতে এগিয়ে এলেন। পৌষ হাত বাড়িয়ে গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে গিলে নিলো। তৌসিফ বাচ্চাটাকে এসেছে থেকে কোলে নিয়ে বসে আছে। বাবুটাও একদম চুপ করে দেখছে ওকে। তৌসিফ ঠোঁট নেড়ে কথা চালালো তার সাথে। সাত দিনের ছোট্ট একটা জান। মেহেদী কি যে কি করবে বুঝতে পারছে না। বারবার ভাই ভাই করছে। তৌসিফ ওর সাথে বাইরে এসে বললো,

— এত ব্যাস্ত হচ্ছো কেন মেহেদী?

— ভাই…

— কি? মেয়ের বাবা থাকবে শান্ত। এত অশান্ত ভাব মানায় বলো? আসো দেখি কি হচ্ছে। কতদূর আগালো কাজ?

বলতে বলতে এগিয়ে গেলো তৌসিফ।
সোহা’র সাথে বেশ হাসিমুখে কথা বলছে পৌষ। এতে করে যেন সোহা’র ভেতরে খারাপ লাগা কাজ করলো। না পেরে পৌষ’র হাত চেপে ধরে ও। মুখে কিছু বলতে চায় তার আগেই চোখে হাসে পৌষ। ও যেন চোখের ইশারায়ই বলছে তৌসিফ আমার, আমি আপনাকে মাফ করে দিয়েছি।

_______________________

সোহাদের থেকে বিদায় নিয়ে তৌসিফ পৌষ’কে নিয়ে বেরিয়েছে। পৌষ’র বের হওয়া হয় না অনেকদিন। আজ তাকে ঘুমাচ্ছে তৌসিফ। এর অবশ্য আরেকটা কারণ আছে। এই মাসের পর থেকে পৌষ’কে বের করবে না ও। ইদানীং এত সুন্দর দেখায় পৌষটাকে। রুপ যেন তার খয়ে খয়ে পরে। চুলগুলোর ঘনত্ব বাড়ছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তার সৌন্দর্য। তৌসিফ যে কি কষ্টে নিজেকে সামলায় তা কেবল সে নিজে জানে। বউটা নিজের রুপ দিয়ে তাকে ঘায়েল করে ছাড়ছে। তৌসিফকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। শুধুমাত্র বউকে ভালোবাসে বলে সে চুপচাপ সয়ে যায়। রা করে না।
পৌষ তৌসিফে’র কাঁধে মাথা দিয়ে রেখেছে। তৌসিফে’র এক হাত ওর পেটে। পৌষ জিজ্ঞেস করলো,

— আমরা কোথায় যাচ্ছি?

— আমার এক ফ্রেন্ডের বিবাহ বার্ষিক।

— আমার ভালো লাগে না।

— কি?

— আপনার ওই বুইড়া বুইড়া বন্ধু।

পৌষ মুখ ভেংচি কাটলো। তৌসিফ মৃদু হাসলো। তখনই ফোন এলো বাড়ীতে তায়েফা এসেছে। এসেছে থেকে নিজের শশুর বাড়ী গিয়েছিলো আগে। তৌসিফ ফোন দিতেই এক দফা ঝেড়েছিলো তায়েফা। বাড়ীতে এসে নিশ্চিত আরেকদফা ঝাড়বে।
গাড়ি থামতেই তৌসিফ বউ নিয়ে নামলো। বন্ধুদের সাথে কুশলাদি করেই আগে পৌষ’কে নিয়ে বসালো। অসমবয়সী দম্পতিদের সুন্দর মুহুর্তে বাকিরা যোগ দিলো। সবাই তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে৷ পৌষ যেন লজ্জায় মা’রা যাবে। বয়সে এত বড় বড় মানুষ এভাবে খোলামেলা জিজ্ঞেস করলে কেমন লাগে?
তৌসিফ একটু সাইডে যেতেই পৌষ তারাতাড়ি কল লাগালো। তৌসিফ ভ্রু কুঁচকে তাকালো পেছনে। বুঝে গেলো পৌষ’র চোখের ইশারা। এত ছোট মেয়ে অথচ তৌসিফ’কে চোখে শাসাচ্ছে যাতে উলটো পাল্টা না গিলে সে। তৌসিফ মাথা নাড়ে ভদ্র মতো। গতবারেরও ইচ্ছে করে সে খায় নি ওসব।

পৌষ’র হাত নিশপিশ করছে। দামড়া মহিলাগুলো তাকে নানাবিধ পরামর্শ দিচ্ছে। যার কোনটাই পৌষ’র ভালো লাগছে না৷ একজন বললো,

— যেই রুপ খুলেছে তোমার। তৌসিফ তো লাড্ডু হয়ে যাচ্ছে। বেচারা কতই না কষ্টে আছে। তুমি কিন্তু মাঝেমধ্যে ধরা দিও। পুরুষ মানুষ বলে কথা!

আরেকজন যেন বেশ অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ। সে বললো,

— ইনার পরিও না এখন পৌষ। তৌসিফ’কে বলে ম্যাটার্নিটির পোশাক পরিও। ইনার পরা এই সময় ক্ষতিকর।

এমন নানান কথা তারা বলে যাচ্ছে যা পৌষ’র ভালো লাগছে না। ও দেখলো তৌসিফ এদিকেই আসছে। হাতে ফলের প্লেট। সবার মাঝখানে নিজে বসে বললো,

— স্পেস দাও ওকে।

একে একে সবাই যেতেই দম ছাড়ে পৌষ। তৌসিফ ওর মুখে আপেল দিতেই পৌষ বললো,

— ক্ষুধা লেগেছে।

— এটা খাও।

— এটা খেলে ক্ষুধা যাবে না তো।

— আচ্ছা, আমি দেখছি।

তৌসিফ বলায় এক ঘন্টা পরের খাবার আগেই সার্ভ করা হলো। তৌসিফ দেখলো রোস্ট দিয়ে পৌষ খাচ্ছে। অন্য কিছু দিলেও ধরছে না। ওর নাকি এটা মজা লেগেছে। অবাক করা বিষয় তিন পিস খেয়েও ও রোস্টই খাবে। তৌসিফ আনিয়ে দিতেই পৌষ অসহায় চোখে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,

— আমার না লজ্জা লাগছে।

তৌসিফ এক ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করে,

— কেন?

— এত খাচ্ছি যে। মন ভরে না আবার পেটও ভরে না।

ওর চোখে লজ্জা। তৌসিফ বুঝে গেলো মুড সুইং হচ্ছে। ও পৌষ’র গাল টেনে দিয়ে ফিসফিস করে বললো,

— এদের জামাই-বউকে লাখ টাকার একটা পারফিউম আর স্বর্ণের রিং দিয়েছি গিফট। উসুল করো হানি। রোস্ট দিয়ে হলেও উসুল করতে হবে। আমরা চারজন মিলে সবটুকু উসুল করব।

সরাসরি টিটকারি মা’রলো নাকি পৌষ’কেই পৌষ’র ভাষায় সান্ত্বনা দেয়া হলো তা বুঝে এলো না। পৌষ রোস্টে কামড় দিলো। তৌসিফ মৃদু হাসলো। তার জানটার নাকি এত ভালো লেগেছে।
তৌসিফ বন্ধুকে ডেকে বললো,

— রোস্ট প্যাক করে দে।

— এখানে তো প্যাক করার নিয়ম নেই দোস্ত।

তৌসিফ বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো,

— পলিথিন নেই? পলিথিনে করেই দে।
.
রাত সাড়ে তিনটা। রোস্ট গরম করে এনেছে তৌসিফ। বন্ধু বহু কষ্টে প্যাক করিয়ে পাঠিয়েছে। তৌসিফ ঐ শেফের নাম্বার নিয়েছে। গরম ভাত দিয়ে রোস্ট খাচ্ছে পৌষ। মাঝে তৌসিফ’কে খায়িয়ে দিচ্ছে। ওর কাছে যেন অমৃত লাগছে এই রোস্ট। এক প্লেট ভরে ভাত খেয়ে ঢেকুর তুলে বললো,

— কাল আবার খাব। আছে?

তৌসিফ হেসে ফেলে। বলে উঠে,

— মুরগীরও ডিম পেড়ে বাচ্চা ফুটাতে কষ্ট হয় হানি। একদিনে ছয়টা রোস্ট খেয়েছো।

পৌষ তেঁতে উঠলো। বললো,

— একা খাই? আপনার দুই পেটুক খায় না? তিনজন দুই পিস করে ছয় পিস খেয়েছি। আপনি আমাকে খাওয়ার খোঁটা দিচ্ছেন।

প্রথম দিকে রেগে গেলেও শেষের দিকে কেঁদে ফেললো। তৌসিফ হতভম্ব। আধ রাতে বউ কাঁদছে। তৌসিফ নাকি তাকে খাওয়া নিয়ে কথা শুনায়? প্লেট রেখে বউকে বুকে জড়ালো আগে। কপালে চোখে মুখে চুমু দিয়ে শান্ত করলো। বউ এখন কিটকিট করে হাসছে। ভাবা যায়, রাগ, কান্না, হাসি একসাথে। তার পৌষরাত দিয়েই সম্ভব।

___________________

তায়েফা এখানে থাকছে আজ দুই মাস। সাত মাস শেষের দিকে পৌষ’র। ইদানীং বেশ ঝামেলা হচ্ছে তার। তায়েফা থাকাতে বেশ উপকার হয়েছিলো তৌসিফে’র৷ তবে আজ ওকে যেতে হবে শশুর বাড়ী। শাশুড়ী নাকি পা ভেঙেছে। তৌসিফের মনে হচ্ছে ও মাঝ সমুদ্রে পড়েছে। তায়েফা অবশ্য যাওয়ার আগে তৌসিফ’কে হাজার বার বললো সে শিঘ্রই আসবে। পৌষ সেই থেকে কাঁদছে। তার ভালো লাগে না ইদানীং। তায়েফা ওর মাথা হাতড়ে ঘুম পাড়িয়ে গেলো। তৌসিফ ফোনে কথা বললো ডাক্তারের সাথে। পৌষ কান্নাকাটি করছে অতিরিক্ত। এরমধ্যে ভয়ে হাত-পা খিঁচে যায় ওর। মাঝেমধ্যে তৌসিফে’র গা শীতল হয়ে আসে। বিনা কারণে আধ রাতে উঠে কাঁদবে। তৌসিফে’র মনে হয় এর থেকে চুপ করা পৌষ ভালো। এমন কাঁদলে তৌসিফে’র দম আটকে আসে। বুকে জ্বালা হয়।

ডাক্তার সান্ত্বনা দিলো তৌসিফ’কে। ফোন রাখতেই শুনলো ঘুমের মধ্যে ব্যথায় গুঙিয়ে কাঁদছে পৌষ। তৌসিফ তারাতাড়ি ওর গালে চাপড় দিয়ে ডাকলো। ভয়ের চোটে এত জোরেই চাপড় দিলো যে পৌষ ঝট করে চোখ খুলে অ্যা অ্যা করে কেঁদে ফেললো। উঠতে চাইলো তবে পারলো না। পিঠের নিচে তৌসিফ হাত দিয়ে তুললেই উঠে বসে পেটে হাত দিলো। তৌসিফে’র চোখ লাল হয়ে আসছে ক্রমশ। পেটে নিজের হাত রাখলো। বাচ্চা দুটো ক্রমাগত নড়াচড়া করে যাচ্ছে। দাঁত খিঁচে পৌষ চুল টেনে ধরলো৷ তৌসিফ পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। মাথাটা বুকে নিয়ে বলে,

— কমে যাবে।

— অনেক ব্যথা।

— হ্যাঁ জান। আর কিছু দিন।

— বমি পাচ্ছে।

সারা প্রেগন্যান্সি জুড়ে প্রথম দিকে বমি ছিলো একটু আর এখন এই শেষ সময়ে এসে অতিরিক্ত বমি হচ্ছে ওর।
বমি করে ক্লান্ত পৌষ বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে বসেছে। তার পা ব্যথা করছে। তৌসিফ শক্ত হাতে নরম করে টিপে দিচ্ছে। ওর ভেতর যেন কেউ খুবলে খাচ্ছে। বারবার আফসোস হচ্ছে কেন মা নেই। আজ পৌষ বা ওর মা থাকলে তো এমন হতো না৷ তারা তো বুঝতো কি করতে হবে। টিশার্টের হাতায় চোখ ডলে তৌসিফ। পৌষ গুঙিয়ে কাঁদে।
পরণে ঢোলাঢুলা পোশাকটা হাঁটু পর্যন্ত তুলে তৌসিফ মলম লাগালো হাঁটুতে। জয়েন্টে ব্যথা নাকি। পৌষ ঘুমালো বেশ সময় নিয়ে। তৌসিফ চোখ ডলে ওকে ঢাকলো। পেটের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো কতক্ষণ। এত বড় পেট হয় তার জানা ছিলো না৷ ছোট্ট পৌষ’র বিশাল ফুলে উঠা পেট। তৌসিফের ভয় হয়। তার হাত-পা জমে যায়।
ওযু করে নামাজে দাঁড়িয়ে এবার কেঁদে উঠলো তৌসিফ। তার সত্যিই ভয় হচ্ছে। এমন ভয় আগে হয় নি।

#চলবে….

#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৭৪

সমান তালে পায়চারি করছে তৌসিফ। রান্নাঘর থেকে সুঘ্রাণ আসছে। পৌষ নিজ হাতে রান্না করছে। তৌসিফ এত নিষেধ করলো ও মানলো না৷ সকাল থেকে যথেষ্ট ফুরফুরে মেজাজে আছে পৌষ। তার মন ভালো খারাপ হোক চায় নি তৌসিফ তাই যা করতে চাইছে তাই করতে দিচ্ছে। তৌসিফ টাউজারের পকেটে হাত ভরে তো একবার টিশার্ট টেনেটুনে ঠিক করার এক অব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। অধৈর্য হয়ে এবার পৌষ’র পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো ও। কাচ্চি শেষ পথে। সেদ্ধ ডিমগুলো দিচ্ছে মাঝে। এর পরের চাল দিতে দিতে পৌষ বললো,

— এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? কাজ নেই আপনার? আপা কতদূরে?

তৌসিফ থতমত খেলো। ও তো চুপ করে এসে দাঁড়িয়েছিলো। পৌষটা এখন চালাক হয়েছে। সে তৌসিফে’র উপস্থিতি খুব সহজেই টের পেয়ে যায়। পৌষ হাতের কাজ শেষ করতে করতে টের পেলো খুব ধীরে সযত্নে কেউ তার পেটটা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে। আফসোস পুরোপুরি ধরা যায় না। পেটের ভেতর দুটো হানি লুকিয়ে আছে। তাদেরই আজ শখ জেগেছে বাবা’কে কাচ্চি খাওয়াবে। তাদের কথাতেই তাদের একমাত্র ফুপিকেও ডাকা হয়েছে। তাদের আরো ইচ্ছে আছে যা পেটে থাকতে থাকতে তারা পূরণ করবে। তৌসিফ মাথা ঝুকিয়ে রাখে পৌষ’র কাঁধে। আস্তে করে বলে,

— আর কতক্ষণ?

— হয়ে গিয়েছে।

— তাহলে চলো।

— কি দরকার?

— পৌষরাত দরকার।

— ওমা! আমি তো শুনেছি বাচ্চাকাচ্চা হলে জামাই এর আদর নাকি খাটের নীচে লুকিয়ে থাকে যা শুধু রাতে উথলে ওঠে কিন্তু আপনি তো দেখি এখনও বউ বউ করেন।

বলেই চাপা হাসলো পৌষ। দুধ ঢাললো চালের উপর। তৌসিফ অসন্তুষ্ট গলায় বললো,

— বেশি বুঝো তুমি। ফালতু কথাবার্তা সব। যার যাকে ভালোলাগে তার তাকে সবসময়ই ভালোলাগে।

— শুনেছি মন উঠে যায়।

— ওমন মন রাখার কি দরকার?

— হ্যাঁ, আমিও তো এটাই বলি। ওমন মনকে এক শার্ট মে’রে বুড়িগঙ্গায় ফেলা দরকার।

পৌষ’র কাজ শেষ। তৌসিফ যত্ন করে ওকে নিয়ে চুলার সামনে থেকে সরলো। সোফায় বসিয়ে ফ্যান ছেড়ে দিলো। পরণের জামাটা গলার দিকে বড়। তৌসিফ টেনে ধরতেই পৌষ ঝট করে চোখ খুললো। তার গাল দুটো ফুলে উঠেছে। সেই ফুলা গাল লাল হয়ে উঠেছে। তৌসিফ টিস্যু দিয়ে গলা মুছে একটু নিচে নামতেই পৌষ হাত ধরে ফেললো। তৌসিফ কপাল কুঁচকে তাকালো। বললো,

— কিহ?

— কিছু না।

— হাত ছাড়ো।

— উহু।

— কি সমস্যা?

— লজ্জা লাগছে।

তৌসিফ ফিক করে হেসে ফেললো। পৌষ’র হাত ছাড়িয়ে নিজের কাজ করলো। পৌষ চুপ করে রইলো। তৌসিফ ওর গালে দাবিয়ে এক চুমু খেলো। বললো,

— হয়েছে তো। আর লজ্জা পেতে হবে না।

পৌষ ঠোঁট ফুলাতেই তৌসিফ ঠোঁটে চুমু খেলো। পৌষ মুখ সরিয়ে বললো,

— খালারা ওখানে।

— আচ্ছা।

বলেই গলার স্বর উঁচু করে তাদের সরতে বললো। পৌষ হতভম্ব। এভাবে বলার কি হলো? ওর ভাবনার মাঝেই তৌসিফ আচমকা এক কান্ড ঘটালো। পৌষ ওর পিঠ আঁকড়ে ধরে। তৌসিফ যেন পেয়ে বসলো। তার হাত দুটো অবাধ্য হয়। পৌষ’র দম ফুরায়। তৌসিফে’র বুকে মৃদু ধাক্কা দিতেই ও একটু ছাড়লো পরক্ষণেই চেপে ধরলো।
তৌসিফে’র বুকে মুখ গুজে চুপ করে আছে পৌষ। তৌসিফ ওর মাথায় চুমু খায়। আদুরে হাত বুলায়। খেয়াল করে পৌষ ঘুমিয়ে গিয়েছে। এতটুকু সময়ে মেয়েটা ঘুমে কাদা। তৌসিফ জাগালো না বুকে নিয়েই বসে রইলো। পা তুলে সোফার উপরে রাখা। মিনুকে ডেকে পায়ের নিচে বালিশ দিয়ে রাখলো। পায়ে পানি চলে এসেছে পৌষ’র।

কলিং বেল বাজতেই বুয়া এসে খুললো। তার মুখটা হাসি হাসি। তায়েফার থেকে ব্যাগ নিতেই ভেতর থেকে তৌসিফ জিজ্ঞেস করলো,

— কে এসেছে বুয়া?

— আপা এসেছে মামা।

তৌসিফ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। তায়েফা ঢুকছে। বোরকা খুলে ভাইয়ের পাশে বসে ঘুমন্ত পৌষ’র গালে হাত রাখলো। তৌসিফ পাশ থেকে ওরনা দিয়ে পৌষ’র বুক ঢেকে দিলো। এই পোশাকের গলাটা বড়। তায়েফা ভাইয়ের সতর্কতা দেখে সন্তুষ্ট হলো। জিজ্ঞেস করলো,

— কি অবস্থা ওর? কাল রাতে নাকি কাঁদছিলো?

তৌসিফ ক্লান্ত হয়ে উত্তর করলো,

— হুটহাট কাঁদে আবার ঠিক হয়ে যায়। ওর বাবা নাকি স্বপ্নে এসেছিলো অথচ চেহারা ঠিকমতো মনে নেই। আল্লাহ জানে, কাকে দেখেছে। সকালে আবার মন ভালো দেখলাম। তুমি আসবে বলে কাচ্চি রেঁধেছে নিজ হাতে।

তায়েফা অবশ্য হাসলো। বললো,

— আমার জন্য নাকি তোর জন্য।

— মজা নিচ্ছো।

— নিতেই পারি। বউয়ের আদর খাচ্ছিস। মোটা হয়ে যাবি।

— মজা নিও না আপা। আমার চিন্তা হচ্ছে।

— আচ্ছা রে বাবা। ও ঘুমালো কখন? উঠবে এখন?

— ডেকো না আপা। ঘুমাক। বাচ্চা দুটো বেশি নড়ে তো তাই ব্যথায় কাঁদে মাঝমধ্যে।

— কি ভাবলি ঐ বিষয়ে?

তৌসিফ ফোঁস করে শ্বাস ফেললো। সে তো আজকাল ভাবতে পারে না শুধু মন আর মস্তিষ্কের মাঝে যু’দ্ধ চলে। কেউ জিতে না আবার কেউ হারেও না। তৌসিফ ঝুলে যেন শুলের উপর।
তায়েফা ভাইয়ের চিন্তা বুঝে। পিঠে হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলে,

— তুসু সোনা আমার, এত ভাবিস না। সব ঠিক হবে।

— চিন্তা এসে পরে আপা। ওর কিছু হলে?

— পা’গল কি হবে? বয়স, স্বাস্থ্য সবই ঠিক আছে।

— তবুও।

তৌসিফে’র চিন্তার যেন অন্ত নেই। সি সেকশন করাবে নাকি নরমাল তার সিদ্ধান্ত ও নিতে পারছে না। একদমই না।

_____________________

বসন্ত আসাতে কৃষ্ণচূড়া গাছটায় কোকিল বসেছে। সেই যে ডাকাডাকি শুরু করলো থামার নাম নেই। পৌষ হাপিয়ে উঠেছে তবুও থামছে না। তৌসিফে’র হতভম্ব ভাব যেন কাটে না। কোকিল পাখিটা কু কু শব্দে ডাকছে। পৌষ শোনার পর থেকে পাখিটাকে বিরক্ত করতে মুখে কু কু শব্দ করছে। পাখিটা এতে ক্ষেপে গিয়ে আরো জোরে ডাকা ধরেছে। তৌসিফ এত থামাচ্ছে পৌষ থামে না।
বিকেলে পৌষ’র জোড়াজুড়িতে নিচে এসেছে ওরা। পুকুর পাড়ে বসেছিলো মাত্র। চারপাশে সুন্দর এক বাতাস। মিঠা অনুভূতি জোগানো এক বাতাস। তৌসিফ ভাবলো এতে বউটার মন ভালো হবে কিন্তু সে ভুলেই গিয়েছিলো তার বউ একটা ইতর-ভদ্র। তার রগে রগে ইতরামি। এখনও থামছে না। তৌসিফ এবার ধমক দিলো। পৌষ দাঁত বের করে হাসতেই তৌসিফ তাকিয়ে রয়। মেয়েটাকে এত সুন্দর দেখায় যা বলার বাইরে।
পৌষ জিজ্ঞেস করলো,

— এখানে মাছ নেই আর?

— আছে তো।

— ঐ দিন তুললো অনেক। আমি দেখেছি।

— হ্যাঁ বড় ভাই তুলেছেন।

— আমাদের দিলো না?

— চাষের মাছ আমার বউ-বাচ্চাকে খাওয়াব।

— একশত বার খাব।

— তাই? কে জানি মাছ দেখে আমার গায়ে বমি করেছিলো?

পৌষ তৌসিফে’র হাতে নাক ঘষে। বলে,

— একটু বমিই তো করেছি তুসু ভাই। বাবুরাতো হিসু করবে আবার পটিও করবে।

তৌসিফ হাসে শব্দহীনা। বুকে কেমন চিনচিন ব্যথা হয়। সুখ-দুঃখের মিশ্রিত ব্যথা। শব্দহীনা কান্না যাতে পানি দেখা যায় না আবার শব্দও হয় না।

পৌষ তৌসিফে’র এক হাত টেনে পেটে ধরে। তৌসিফ বলে,

— ভেতরে চলি?

— আরেকটু থাকি?

আবদার ফেলতে পারে না তৌসিফ। থাকে একটু। পৌষ ওর কাঁধে মাথা রাখে। নজর টলটলে পানিতে। আচমকা পৌষ জিজ্ঞেস করে,

— আপনি কি আমার উপর রেগে?

— পা’গল হলে? রাগব কেন?

— এই কয় মাস কত জ্বালালাম। হাত সরালেন কেন? পেটে রাখুন। ওরা বাবা’কে চাইছে।

— আমাকে রাগিও না পৌষ।

— শুনুন না?

— শুনছি।

— মীরা ভাবি থেকে মাফ চান। আমার কেমন ভয় লাগে। উনি যদি অভিশাপ দেয়? আমার বাবুর যদি কিছু হয়?

— ঠাটিয়ে চটকানা খাবে পৌষরাত? দিব? খাবে?

পৌষ চুপ করে যায়। মাথা তুলে কাঁধ থেকে। পেট থেকে হাত সরায় তৌসিফে’র। উঠতে নিলেই তৌসিফ শক্ত হাতে আটকায়। দেহটা জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে। নরম কণ্ঠে বলে,

— উল্টো পাল্টা কথা বলবে না হানি।

— বলব না।

— মুড ঠিক করো।

— করেছি।
.
তায়েফা আজ রাতে বিদায় নিলো। তৌসিফ ঘরে নেই। পৌষ ফোনে কথা বলছে শ্রেয়া’র সাথে। কথার মাঝে সে হাসছে বেশি। শ্রেয়া খুশি হলো। পরিকল্পনা কাল সবাই আসবে। ভিডিও কলের ওপাশে সবগুলো ঝুট ধরে আছে। শ্রেয়া মাঝেমধ্যে জ্ঞানবানী শোনাচ্ছে।

তৌসিফ দোতলায় আছে। তৌহিদ অবাক হয়ে দেখলো তৌসিফ মীরার কাছে মাফ চাইছে। মীরা’র চরিত্র বুঝা মুশকিল। ভালো তো ভালো আবার দুনিয়ার খারাপ।
তৌসিফ শুধু শেষে বললো,

— আমার সন্তান আর বউকে অভিশাপ দিও না মীরা।

তৌহিদ ভাইকে জড়িয়ে ধরে। পিঠ চাপড়ে ভরসা দেয়। তৌসিফ ফিরে আসতে দেখে পৌষ ফোন রাখছে। ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে এসে পৌষ’র পাশে বসতেই পৌষ মুখ বাকিয়ে বলে,

— চটকানা মা’রবেন আবার তো ঠিকই গেলেন।

তৌসিফ বুঝলো মিনু সাংবাদিক জানিয়েছে পৌষ’কে। ও সামান্য হাসলো। পৌষ’কে ঠিকমতো বসিয়ে বুকে মাথা রেখে বললো,

— পুরো দুনিয়া থেকে হেরে তোমার কাছে এসেছি আমি পৌষরাত। আমাকে যত্ন করে রেখে দাও।

পৌষ তৌসিফে’র কপালে চুমু খেলো। চুলগুলো টেনে দিলো কিছুক্ষণ। তৌসিফ উঠে একটু পর। পানি আনতে বাইরে যেতেই হঠাৎ পৌষ জোরে ডেকে উঠলো। তৌসিফে’র কলিজা কাঁমড়ে উঠে। দৌড়ে যেতেই দেখলো মেঝের মাঝখানে পৌষ দাঁড়িয়ে। তৌসিফ’কে দেখেই চিল্লিয়ে উঠলো। বাজখাঁই কণ্ঠে বলে উঠলো,

— ওখানে কি করেন? তারাতাড়ি ধরুন আমাকে। হাসপাতালে যেতে হবে।

তৌসিফে’র দুনিয়া দুটো চক্কর মা’রলো। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পৌষ একাই ব্যাগে হাবিজাবি তুলছে। তৌসিফ দৌড়ে এসে ওকে ধরতে নিলেই পৌষ খেঁকিয়ে উঠলো,

— ছাড়ুন৷ ধরুন এসব। গাড়ি বের করান৷

— পেইন উঠেছে?

— না বিলাই, কুত্তা উঠেছে। এখনও ঠিক আছি, ঠিক থাকতে থাকতে আমাকে নিয়ে চলুন।

তৌসিফ ধ্যানে ছিলো। তার ধ্যান যেন ভাঙলো৷ না এটা স্বপ্ন না। সত্যিই হচ্ছে। তৌসিফ তারাতাড়ি বুয়া বলে জোরে ডাকলো৷ সারা বাড়ীর মানুষ উঠে পরেছে। তৌসিফে’র দুই ভাইও উঠে এসেছে। পৌষ’কে গাড়িতে তুলে তৌসিফ ওর সাথে বসলো। পৌষ যথেষ্ট স্বাভাবিক। হাসপাতালে সব রেডি।
পৌষ তৌসিফ’কে বুঝ দিতে নিলেই তৌসিফ ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। ফিসফিস করে কানে বললো,

— যেভাবেই হোক ভোমরা যাতে ফুলে আসে। ফুল অপেক্ষায় থাকবে।

পৌষ মৃদু হাসলো। তার ব্যথা বাড়ছে। মুখটা বিবর্ণ হয়ে আসতেই তৌসিফ ড্রাইভারকে ধমকে উঠলো। গাড়ি চলছে দ্রুত বেগে সেই সাথে দ্রুত বেগে ছুটছে তৌসিফে’র হৃদপিণ্ড। সময় কাটছে না অথচ পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে পৌষ’র চিৎকার। তৌসিফ দিশাহারা হয়। তার অবস্থা শোচনীয়।
.
হাসপাতালে পৌঁছানো মাত্র ডাক্তার পৌষ’কে নিয়ে চলে গেলো। পৌষ ওখান থেকেই চিৎকার জুড়ে তৌসিফ’কে ডাকছে। তৌসিফ’কে নার্স ডাকলেও তৌসিফ যেতে চায় না। তার সাহসে কুলায় না। হক বাড়ীর সকলে উপস্থিত হয়েছে।
তৌসিফ ভেতরে ঢুকতেই ওর হাত-পা ঝিম ধরে গেলো। দৌড়ে বেরিয়ে এলো। তৌফিক তালুকদার ভাইকে ধরে বসায়। সাহস জোগায়। তৌসিফ মানে না৷ দূর থেকে দেখে তায়েফা দৌড়ে আসছে। তৌসিফ মিনমিন করে “আপা” ডাকে। তায়েফা আসতেই ভাইকে জড়িয়ে ধরে। তৌসিফ চুপ করে যায়। কথা বলে না। ভেতরে থেকে তখনও কান্নার শব্দ আসছে। পৌষ কাঁদছে।

#চলবে…..