প্রেমসুধা পর্ব-৭৬

0
1070

#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৭৬

বৈচিত্র্যতা মানুষের জীবনে এক ধ্রুব সত্য। এটা অবহেলা করা যায় না। চাইলেই এরিয়ে যাওয়া যায় না। মানুষের জীবনে আসা প্রতিটা ঋতু তাদের মাঝে পরিবর্তন এনে যায় ঠিক প্রকৃতির মতো। গ্রীষ্মের দুপুর আর বর্ষার বিকেল যেমন এক নয় ঠিক তেমনই পৌষের সকাল এক না। প্রতিটাই যেন পূর্বের থেকে ভিন্নতায় ভরপুর। তৌসিফ যেন ঠিক তেমনই। তার কঠিন রুপ ভেঙে গিয়েছে। নমনীয়তা তাকে স্পর্শ করেছে। ও খুব করে খেয়াল করলো ওকে দুই একজন ধমক দিয়েও চলে গেলো অথচ তৌসিফ নির্বিকার। চোটপাট দেখাচ্ছে না সে। কমলতায় ঘিরে উঠেছে তার চারপাশ। ঐ ডাক্তার মেয়েটা তার সাথে ঝাঁঝালো গলায় আবারও কথা বলে গিয়েছে। আশ্চর্য তৌসিফ প্রতিক্রিয়া সরুপ বাজে ব্যবহার করে নি৷ ওয়ার্ড বয় না বুঝে তাকে ধাক্কা দিয়ে গেয়েছে। তৌসিফ ধমক দিলো না বরং কিভাবে জানি পাশ কাটিয়ে এসে পরলো। তার মনে হয় সে আগের মতো নেই। বাবা বাবা এক আবেগ বা অনুভূতি তার মাঝে জাগ্রত হচ্ছে। তার পিতৃত্ববোধ তাকে বদলে দিচ্ছে। তার মাঝে হঠাৎ আসা এই পরিবর্তন দেখে সকলেই অবাক। তায়েফা কাল থেকে তাকে খোঁচাচ্ছে। তৌসিফ উত্তর দেয় না। তার ধ্যান সেখানে থাকলে তো? তৌসিফ আছে তার সন্তান নিয়ে। কাজ-কাম সব ছেড়ে আজ দুইদিন ধরে হাসপাতালের পরে আছে। তায়েফা ঠেললেও যাবে না।
আজ যেহেতু রিলিজ ডেট তাই সব গোছগাছ হচ্ছে। হক বাড়ীর সকলে এসে ভীর করে মাত্র বিদায় নিলো। মেহেদী,সোহা এসে দেখা করে গিয়েছে। তারা বেশিক্ষণ থাকে নি। ছোট্ট বাচ্চা বাসায় রেখে এসেছিলো। তৌসিফ তাদের বাসায় যেতে বলেছে। মেহেদী হেসে জানিয়েছে তারা আসবে।

আপাতত ছেলেকে কোলে নিয়ে পায়চারি করছে তৌসিফ। তার মেয়ে তখন খাচ্ছে। কাল থেকে পৌষ ভালোই খাওয়াতে পারছে কিন্তু এটা যথেষ্ট না৷ পেট ভরে দুই ভাই-বোন খেতে পারে না। দেখা যায় একজন খেলে আরেকজন কাঁদে। কাঁদে তো কাঁদে আধ পেট খাওয়াটাও কাঁদে। জমজদের এটা হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু তৌসিফ এতে খুবই কষ্ট পাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে পৌষ নিজেই মনমরা হচ্ছে। তায়েফা নানাভাবে সান্ত্বনা দিলেও মাঝেমধ্যে কেঁদে ফেলে পৌষ। তার মন ভালো থাকে না। হাজার চেষ্টায়ও মন খারাপ হচ্ছে।
ডাক্তার সবে মাত্র চেক করলেন। পৌষ’কে দেখে বাচ্চা দুটোকে দেখতেই মেয়েটা কেঁদে উঠলো। তৌসিফ দেখে মেয়ে থামছেই না। বারবার ডাক্তারকে বলে যাচ্ছে,

— ও কি ব্যথা পাচ্ছে? কেন কাঁদছে? মনে হয় সমস্যা হচ্ছে। আমাকে দিন তো।

তায়েফা দিলো এক ধমক। মহা বিরক্ত করছে তৌসিফ। পৌষ’র কোলে তখন ছেলে। এরা মা-বাবা দুটোই বাচ্চা পা’গল। কেউ ছাড়ে না৷ তায়েফা সহ ডাক্তার হেসে মজা নিলো বিষয়টা নিয়ে। তৌসিফ পাত্তা দেয় না। মেয়ের কান্না থামতেই জিজ্ঞেস করে,

— আরেকদিন থাকা যায় না?

ডাক্তার ঘুরে দাঁড়ালেন৷ হাসিমুখে বললেন,

— চাইলে তো সারাবছরই থাকতে পারো। কি থাকবে?

— তা না। আসলে এখানে থাকলে আপনারা ছিলেন। বাসায় যদি সমস্যা হয়?

— তৌসিফ নরমালে বেবি হয়েছে। সি সেকশন হলে কথা ছিলো। তাও দুই থেকে তিনদিন যথেষ্ট। বিনা কারণে বউ,বাচ্চা হাসপাতলে রাখার কারণ দেখছি না।

তৌসিফ মাথা নাড়ে। ডাক্তার বিদায় জানিয়ে চলে যায়। তৌসিফ এসে পৌষ’কে উপর দিয়ে বোরকা পরালো। মাথাটা ঢেকে দিয়ে দুই হাত ধরে দাঁড় করিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,

— হানি, স্ট্রেচারে নেই?

পৌষ ফিসফিস করে উত্তর দিলো,

— আমি কি লুলা নাকি টুন্ডা?

তৌসিফ চোখ পাকায়। পৌষ মুখ ভেঙায়। বলে,

— কোলে নিন তাহলে।

— বাবুদের তাহলে আগে গাড়িতে আপার কাছে দিয়ে আসি?

পৌষ হেসে তৌসিফে’র হাত ছাড়লো। তৌসিফ কাঁধ জড়িয়ে ধরলো। হেমন্ত ছুটন্ত পায়ে এসে জানালো,

— গাড়ি রেডি। চলে আসুন।

তায়েফা’র কোলে ছেলে আর হেমন্তের কোলে মেয়ে। তৌসিফ বউ’কে সাবধানে নিয়ে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে পৌষ বললো,

— বাসার কথা খুব মনে পরছে। আমরা দু’জন বের হলাম কিন্তু বাসায় ঢুকব চারজন। দারুণ না বিষয়টা?

— খুব।

— আচ্ছা, ওদের নাম রাখব কবে?

— সাত দিনের দিন। তুমি ভেবেছো কিছু?

— না তো। আপনি ভেবেছেন?

— ভাবছি।

— বলুন।

— উহু। সময় হোক।

___________________________

রাত বাজে আড়াইটা। তালুকদার বাড়ীর বাম পাশের ফ্ল্যাটে কান্নার শব্দ আসছে। মিনু দৌড়াদৌড়ি করছে। তায়েফা রুম থেকে বেরিয়ে এলো। দেখা গেলো বাচ্চা দুটোই কাঁদছে। পৌষ অবাক হয়ে বসে আছে। তৌসিফ কাকে কাকে ফোন দিচ্ছে তো আবার জোরে ডাকছে,

— আপা?

আবার এক হাতে ছেলের বুকে চাপড় দিচ্ছে। নতুন মা-বাবা অনভিজ্ঞ হয় তাই বলে এমন এলোমেলো হয়? তায়েফা অবাকই হলো। এগিয়ে এসে ছেলেটাকে কোলে তুললো। তৌসিফ’কে চোখ গরম দেখিয়ে ধমকে বললো,

— সোজা বারান্দায় যাবি। দশ মিনিট পর আসবি।

তৌসিফ বড় বোনের ধমক খেয়ে তারাতাড়ি গেলো অথচ দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। মিনিট খানিকের মাঝে মেয়ে, ছেলে দুটোকেই পৌষ’র কোলে তুলে দিলো। সুন্দর করে দেখালো একসাথে কিভাবে খাওয়াতে হবে। পৌষ’র চোখ দুটো ঘুমে ঢুলুঢুলু। তায়েফা’র মায়া লাগলো। বললো,

— ঘুমা৷ আমি আছি।

— ওরা ঘুমায় না কেন আপা?

— ঘুমাবে। তুই ঘুমা৷ চোখ বুজ।

পৌষ চোখ বন্ধ করলো। ওর চোখ বন্ধ হতেই অন্ধকার দেখলো। সেই অন্ধকারে হাজারও প্রজাপতি উড়ে যাচ্ছে। রঙিন প্রজাপতি। পৌষ অবাক হয়ে হাত মেলে দিলো। ধরা দিলো দুটো। পৌষ হেসে ফেললো। চোখ খুলতেই দেখলো তৌসিফ বসা পাশে। পৌষ’র চুলে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— হাসছো যে?

— ভালো লাগছে।

— আমার কেমন লাগছে জানো?

–কেমন?

— পা’গল পা’গল।

পৌষ চোখের ইশারায় ওকে ডাকলো। আসতেই পৌষ ওর খাঁড়া নাকে চুমু দিলো। বললো,

— আমাকে এত ভালোবাসার জন্য আপনাকে ভালোবাসি।

তৌসিফ চোখে হাসে। বাচ্চাদের বিছানার মাঝে রাখে। বড় বিছানার মাঝে সুন্দর জায়গা হয়। তৌসিফ হেসে বলে,

— আরো দুটো হলে খাট ভরে যেতো।

বলেই হাসলো শব্দ করে। ছেলেটা নড়ে উঠতেই তৌসিফ চুপ করে গেলো। তাদের কপালে আলতো চুমু খেলো। মৃদু হাসে বাচ্চা দুটো ঘুমের মধ্যে। পৌষ প্রশান্তিময় হাসে। সুন্দর সেই হাসি। শান্তিময় হাসি।

_____________________

বাচ্চারা পৃথিবীতে আসার আজ সপ্তাহ হলো। আকিকার গরু দুটো জ’বাই হয়েছে। বাচ্চা দুটো টাক্কু হতেই গলা ফাটিয়ে কেঁদেছে। তৌসিফ দান-সাদকার কাজ সেড়ে আগে বাচ্চাদের কাছে এলো। তার মেয়ের নাম তৌশরাত তালুকদার আর ছেলের নাম তায়ুশ তালুকদার। মেয়েটার নাম ছোট্ট একটা তৌশি ডাকা হচ্ছে। তৌসিফ আজই নাম গুলো জানালো সবাইকে। হুজুর দোয়া করে বিদায় নিলেন মাত্র। বাড়ি-ঘর মানুষ দিয়ে গমগম করছে। ইনি, মিনি তৌশি আর তায়ুশ’কে দেখছে টুকুর টুকুর করে। বারবার বলছে,

— তৌশি খালামুনি ডাকো। তায়ু খালামুনিকে ডাকো তো বাবু।

তারা ডাকে না। বেল মাথা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। তুলনামূলক ভালোই ছোট হয়েছে। দেখতে এখনও ভীষণ ছোট। আন্ডার ওয়েট বাচ্চা দুটোই। পিহা বাবুদের হাত ছুঁয়ে দেখে। চৈত্র ধমক দেয় চাপা স্বরে,

— আস্তে ধর। ব্যথা পাবে।

জৈষ্ঠ্য বলে,

— কোলে নিব রে একটু চৈত্র। তুলে দে না।

চৈত্র দাঁত কটমট করে বলে,

— একদম না৷ ওরা ছোট।

ইনি, মিনি একসাথে আবদার ধরে,

— ইত্তু কোলে নেই?

চৈত্র চোখ রাঙিয়ে বললো,

— পরে যাবে। তোদের এতটুকু কোলে আটবে ওরা? চুপ থাক।

সবাই’কে ফাঁকি দিয়ে হেমন্ত এসে কোলে তুললো তায়ুশ’কে। সবাই হা করে তাকিয়ে দেখলো শ্রেয়া তৌশি’কে নিয়ে চলে গেলো। সবাই হা করে তাকিয়ে রইলো। ইনি,মিনি মুখ বেজার করে নিতেই ছুটন্ত পায়ে পৌষ এসে ধমকালো,

— এই তোরা খেয়েছিস একটাও? এখনই উঠ৷ খাবি আয়।
.
বাড়ী খালি হলো মাত্র। তৌসিফ পৌষ’কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,

— ফ্রেশ হবে না হানি?

— হ্যাঁ। বসুন ওদের পাশে। আসছি আমি।

পৌষ একেবারে গোসল করে এলো। ক্লান্ত হয়ে বিছানায় বসতেই তৌসিফ খাবার হাতে ফেরত এলো। নিজ হাতে খায়িয়ে দিতেই পৌষ বললো,

— আমার বাচ্চা দুটোকে টাক্কু বানিয়ে দিয়েছে।

তৌসিফ হেসে বললো,

— চুল এসে যাবে।

— হু। ওরা কত ছোট। আঙুলগুলো দেখুন।

তৌসিফ দেখে। ছোট্ট ঠোঁট দুটো নেড়ে মুখে শব্দ করছে তৌশি সাথে তাল মিলাচ্ছে তায়ু। তৌসিফ সুখ অনুভূতি পায়। তার জীবনে আর কিছু চাই না। যথেষ্ট পাওয়া হয়েছে। এদিকে পৌষ গভীর ভাবে ভাবছে ভিন্ন কিছু। তার মতিগতি তৌসিফ’কে চমকে দেয়া। খুব শিঘ্রই।

#চলবে…