#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৭৭
চু চু শব্দ হচ্ছে ঘরটায়। তৌশি খাচ্ছে কম শব্দ করছে বেশি। তায়ু চুপচাপ বাবা’র বুকে মুখ দিয়ে আছে। তৌসিফ বসে বসে খুবই শান্ত দৃষ্টিতে দেখছিলো। মূলত সে তার সুখের সংসার দেখছিলো। গভীর ভাবনায় ভাবছিলো তার ছন্দপতন ঘটা জীবনটা সম্পর্কে। এক গন্তব্যহীন পথিক হঠাৎ করেই গন্তব্য পেয়ে বসলো। স্টেশনে অপেক্ষায় বসে থাকা যাত্রীর ট্রেনটি আচমকাই স্ব জোরে সাইরেন বাজাতে বাজাতে চলে এলো। তৌসিফ তাতেই চরে বসে। ছুটে চলে অদম্য আগ্রহের সাথে। প্রকাণ্ড উচ্ছাসের সাথে। আচমকা দাঁড়িতে থাবা বসায় তৌশি। তৌসিফে’র ভাবনায় ছেদ পড়ে। মেয়ের ছোট্ট হাতের মুঠোয় তার দাঁড়ি ভর্তি। তৌশি যে খুব মজা পাচ্ছে তা তার চেহারার চাকচিক্য দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বাবা’কে সে খুব ভালো করে চিনে। তায়ু তখনও চুপচাপ। পৌষ তৌশি’র হাত ধরে ছাড়াতে চায়। চার মাসের বাচ্চাটা এত সুন্দর করে হাসে পৌষ কিছুই বলতে পারে না। এই তো তাকে বাবা’র সামনে ধরা মাত্রই সে হামলে পড়েছে। পৌষ ধরে হাত ছাড়াতে নিতেই তৌসিফ হেসে বললো,
— থাকুক না।
— ব্যথা লাগে না?
— লাগুক।
— আহা! কি আদর৷ দিব নাকি টেনে?
তৌসিফ মৃদু শব্দ করে হাসলো। ফিসফিস করে জানালো,
— কম টানো তুমি?
— কবে দাঁড়ি টানি হ্যাঁ? আমি শুধু ঐ একটু আধটু চুলকে দেই…
তৌসিফ বাঁকা হেসে পৌষ’র গাল ছুঁয়ে দিলো। পৌষ ভালোই লজ্জা পেলো। অজানা কারণে তার ইদানীং লজ্জা পেয়ে যায়। কেমন নতুন নতুন লাগে। মন অন্দরে এক মৃদুমন্দ বাতাস লাগে। সেই বাতাস দুলিয়ে দিয়ে যায় পৌষ’কে। পৌষও দুলে ঠিক যেমন কচুরিপানার উপর পানির বিন্দু। তৌসিফ ওর ফুলা গালের রাঙা লজ্জা দেখে আস্তে করে বললো,
— গাল দুটো তো রসগোল্লা বানিয়ে রেখেছো এখন আবার লজ্জা পেয়ে তা বানাচ্ছো লাল। এত অবিচার কেন?
— ধুর!
বলেই তৌশি’কে তৌসিফে’র কাছে দিয়ে উঠে গেলো পৌষ। পরণের জামাটা ঠিক করে দুই হাতে চুল পেঁচিয়ে খোঁপা বাঁধে। তৌসিফ আস্তে করে মেয়ের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তাকে বিছানায় রেখে কোলে থাকা ঘুমন্ত তায়ু’কে রাখলো মাঝ বরাবর। তৌশিও ঘুমে ঢুলুঢুলু অবস্থা। আরেকটু, শুধু আরেকটু নরম ছোঁয়া পেলেই সে ঘুমাবে। বাবা তাকে একটু বুকে নিলেই তার বাকি ঘুম টুকু চলে আসবে। ব্যাপারটা ঘটলোও তাই। তৌসিফ মেয়ে’কে কোলে তুললো। নিজের শক্ত হাত দ্বারা অতি নরম ভাবে মেয়ের গালে হাত ছোঁয়ালো। অল্পস্বল্প কথা বললো। মিষ্টি করে হাসি দিলো। তৌশি’র ঘুমন্ত মুখের গালে সামান্য হাসি দেখা গেলো। তার ঘুম পাখি চলে এসেছে। চোখ দুটো আর তার খোলা রাখা গেলো না। চুপচাপ ঘুমিয়ে পরলো সে। তার আগে তার প্রিয় বাবা’র মুখের দাঁড়ি আবার চেষ্টা করলো নিজের ছোট্ট থাবায় পুরে নিতে।
তৌসিফ হাসলো। তার ছোট্ট মা, তাকে ছাড়া যার আজকাল সময় কাটছে না। তৌসিফ মৃদু হাসে। তার বুকে অপার শান্তি বিরাজ করে। প্রশান্তিময় এক শান্তি।
তৌশি’কে বিছানায় রেখে দুই ভাই বোনকে তুলার নরম বালিশ গুলো দিয়ে আটকে দিলো তৌসিফ। ধীর পায়ে উঠে এলো বিছানা থেকে। মৃদু আলো জালিয়ে বাচ্চাদের মশারী ফুটিয়ে তা দিয়ে ঢেকে দিলো। তৌসিফ জানে তাদের রুমে মশা নেই তবুও সে সামান্য বিষয়ে খুব সচেতন।
বাচ্চাদের সব গোছগাছ করে তৌসিফ গেলো বাথরুমে। হাত-মুখ ধুয়ে প্রায় আধ ঘন্টা লাগিয়ে সে রূপচর্চা করলো। গালে থাকা খামচির দাগ দেখে মনে পরলো তায়ু’র নখ কাটতে হবে কাল। ভালো খামচি দেয় সে। মায়ের মতো হয়েছে। তৌসিফ হাসলো কথাটা ভেবে। চুল গুলোকে ভেজা হাতে নেড়েচেড়ে শ্যাট করে ঘাড়-গলা মুছতে মুছতে আয়নায় নিজেকে দেখলো। সুখী একজন পুরুষের অবয়ব দেখা গেলো। তৌসিফ নিজেকেই হিংসা করে শাঁসালো,
— খবরদার, নজর দিবি না!
নিজের এসব কর্মকাণ্ডে তৌসিফ মাঝেমধ্যে হতবাক হয়। ভাবে পৌষ’র আত্মা তার মাঝে কিভাবে এলো?
তৌসিফ বেরিয়ে এসে ভেজা টিশার্ট বদলালো। পাতলা টাউজার পরলো। হালকা গরম পড়ছে এখন। নিজেকে একদম টিপটপ করে আয়নায় দেখে আবার সুগন্ধি লাগালো। একবার নিজের দাঁতগুলোও দেখে নিলো। বউয়ের সামনে পরিপাটি থাকা ভালো। বয়স লুকানোর আশ্রয়টা তৌসিফ রূপচর্চার কাছেই নিয়ে থাকে। তার ভাবনা বউ তাকে সুন্দর দেখালে নিজেই গলে যায়।
তৌসিফ নিজেকে পুরো দমে প্রস্তুত করে হাঁটা দিলো বারান্দায়। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে লাস্যময়ী এক নারী। তার বালিকা দেহ এখন নারী নারী ঘ্রাণে মৌ-মৌ করে। দুই সন্তানের জননী হয়ে তার রুপ রং খুলেছে। দেহ আগের থেকে সুন্দর হয়েছে। ছিপছিপে শরীরটা এখন মাতৃত্বের স্বাদ পেয়ে বাঁধ ভাঙা জোয়ারে ভেসে বেড়াচ্ছে। তৌসিফ তাতে গলে মোম। তার আজকাল বউ নিয়ে বহুত জ্বালা৷ এই জ্বালা মনের জ্বালা। এত সুন্দর বউ তার। মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায় যেন৷
তৌসিফ দেখলো পৌষ ঘাটের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘাটটা তাদের রহস্যে ঘেরা। প্রচুর কাহিনি একে ঘিরে। তৌসিফ ভুতে বিশ্বাসী না হলেও জিনে বিশ্বাসী। কুসংস্কার না মানলেও তৌসিফ মানে এই ঘাটের সাথে জড়িত সকল পুরাতন কাহিনি। রহস্যময় ঘাটের পানিটাও কেমন রহস্যে ঘেরা। পৌষ’র আবার এই পুকুর অতি প্রিয়। সুযোগ পেলেই লুকিয়ে চলে যাবে। বিয়ের সেই প্রথম থেকে তৌসিফ তাকে ধমকে হোক বা প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে হোক পুকুর থেকে দূরে রেখেছে অথচ ও খেয়াল করে দেখেছে পৌষ’র অতি প্রিয় এক জায়গা এই পুকুর ঘাট।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পা বাড়ালো তৌসিফ। পৌষ’র পেছন দিকটা দেখা যাচ্ছে। রেলিং ধরে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে পৌষ। পরণে সিল্কের নাইটি। প্রেগন্যান্সির ড্রেস বাতিল করলেও বাচ্চাদের খাওয়াতে প্রচুর ঝামেলা হয় তাই তৌসিফ রাতের জন্য নাইটি গুলো এনেছিলো। দেখা যায় ঝামেলা বেড়েছে। বউ’কে এসব কাপড়ে দেখে তৌসিফে’র মাথাটা উল্টো খারাপ হয়। ভেতর ভেতর আগুন জ্বলে। পৌষ’র কথায় সেক লাগে বুকে। ছ্যাঁত করে উঠে তখন।
পেছন থেকে তৌসিফ ওর কোমড় জড়িয়ে ঘাড়ে মুখ গুজে দিতেই পৌষ লজ্জায় মিহিয়ে গেলো৷ হালকা স্বরে বললো,
— এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন?
— বুঝলে কিভাবে হানি?
— সুগন্ধি দিয়ে গোসল সেরেছেন নাকি? এত ঘ্রাণ আসছিলো।
— হুম।
— এত আয়োজন কেন?
— তোমার জন্য।
— পুরাতন তো ভাই। এত খাতিরের কি দরকার?
— ভাই ডাকলে খবর করে ছাড়ব পৌষরাত।
— তুসু ভাই, মামাতো ভাই তো আপনি আমার। ভুলে গেছেন?
তৌসিফ এক ঝটকায় পৌষ’কে সামনে ঘুরালো। বুকের সাথে চেপে ধরে চোখে চোখ রাখলো। দৃষ্টিতে ভরপুর দুষ্টামি পৌষ’র। তৌসিফ বুঝলো ওকে ক্ষেপানোর পায়তারা এটা। সুযোগ বুঝে পৌষ’কে খুব করে ঝটকা খাওয়ালো তৌসিফ। পৌষ হাত ছুঁড়ে মা’রে। তৌসিফ ছেড়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলে,
— বললে না পুরাতনের জন্য আয়োজন কেন? কারণ হচ্ছে এটা। পুরাতনে স্বাদ বেশি ঠিক পুরাতন অ্যালকোহলে যেমন নেশা বেশি।
পৌষ ভয়ংকর লজ্জা পেলো। তার লজ্জায় ভীষণ হাত ঘামছে। তৌসিফ ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে কাছে টানে আরো। কপালে দীর্ঘ এক চুমু দিয়ে বলে,
— রুমে নেই?
পৌষ কথা বললো না। পৌষ’র লজ্জা উপেক্ষা করে তৌসিফ ওকে পাজা কোলে তুললো। বারান্দা আটকে ওকে নিয়ে গেলো পাশের রুমে। বদ্ধ ঘরে তখন জোনাকি এলো। আলো দিলো টিমটিম। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বয়ে গেলো মিষ্টি বাতাস। সেই বাতাস দুলিয়ে দিয়ে গেলো দুটি দেহকে। তৃপ্ত দুটি আত্মা’কে।
.
রাত তখন প্রায় দুটো। রান্নাঘরে টুংটাং শব্দ হচ্ছে। সেই সাথে ঘর থেকে তায়ু’র কান্নার শব্দ। তায়ু’র কান্না অবশ্য থামলো। আধ রাতে তার ক্ষুধা লাগে। পৌষ খাওয়াতেই ও থেমে গিয়েছে। তৌসিফ এটা দেখলেই বলে,
— মায়ের মতো হয়েছে।
পৌষ মুখ বাকায় সবসময়। হাতে এক বাটি নুডলস নিয়ে তৌসিফ রুমে ফিরে এলো। সাইড টেবিল থেকে পানি নিয়ে বসে জিজ্ঞেস করলো,
— থেমেছে তাহলে? ঘুম নাকি?
— থামলো মাত্র। ঘুমাচ্ছে।
— মুখে তুলে দিব?
— কি রাঁধলেন?
— নুডলস করলাম।
— ঝাল দিয়েছেন?
তৌসিফ পানি পান করলো। এ-র মানে দেয় নি। পৌষ’র রাগ হয়। তৌসিফে’র উল্টা পাল্টা ধারণা সব। তার মনে হয় পৌষ ঝাল খেলে তা বাচ্চাদের পেটেও যাবে যেহেতু বাচ্চারা বুকের দুধ এখনো খায়। ডাক্তার দিয়েও পৌষ তৌসিফ’কে বলালো। বান্দা মানতে নারাজ। ঘাড়ের রগ তার ত্যাড়া।
পৌষ তখন ফিডিং করাচ্ছে বিধায় মুখে তুলে খাওয়ালো তৌসিফ। পৌষ চুপচাপ অর্ধেক খেয়ে বললো,
— খেয়ে ফেলুন।
তৌসিফ খেতে খেতে বললো,
— কাল বেশি ওয়ার্ক আউট করতে হবে। ভুরি বেড়ে যাবে নাহলে।
পৌষ আঙুল দিয়ে খোঁচা দিলো পেটে। বললো,
— জীবনে বাড়তে দেখলাম না। আমার তো তাও বেড়েছিলো।
তৌসিফ হাসলো। তৌশি ততক্ষণে ডায়াপার নষ্ট করেছে। তৌসিফ তা বদলে দিতে দিতে বললো,
— তায়ু’কে দাও।
— নষ্ট করে নি এখনও।
তায়ু ঘুমাতেই ওকে রাখা হলো বিছানায়৷ পৌষ’র ভেজা চুল গুলো তৌসিফ শুকাতে ব্যাস্ত হলো। এরমাঝেই দুইবার হাঁচি দিয়েছে পৌষ। তৌসিফ জিজ্ঞেস করলো,
— কাল ক্লাস আছে তোমার?
— হ্যাঁ।
— জরুরি?
— যেতে হবে।
— আচ্ছা।
পৌষ তৌসিফে’র গালে হাত রাখলো। তৌসিফ টেনে ওকে কোলে বসায়। পৌষ আগ বাড়িয়ে ওর কপালে চুমু দিয়ে বলে,
— এত টেনশন করেন আপনি! আমি যাব আর আসব।
— ওরা থাকবে কিভাবে তাই ভাবছিলাম।
— মিনু’র সাথে অনেক ভাব।
— বুয়া রাখি একটা।
— একদমই না৷
পৌষ বাচ্চাদের জন্য বুয়া রাখতে একদমই নারাজ। তৌসিফ মজার ছলে বললো,
— ন্যানি রাখতে পারি তাহলে।
— ওওও তাই নাকি? জোয়ান দেখে ন্যানি রাখি এরপর আপনি ছুঁকছুঁক করেন তার আগেপিছে। এতই সোজা মিয়া? আমি পৌষরাত হতে দিব এটা বেঁচে থাকতে!
তৌসিফ কপাল কুঁচকে শুনলো সবটা। বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কার পেছনে ছুঁকছুঁক করতে দেখলে?
— ও তাহলে দেখার জন্য বসে থাকব? আপনি দেখাবেন নাকি?
— পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করা কেউ তোমার থেকে শিখুক।
পৌষ তৌসিফে’র মুখ দেখে উচ্চস্বরে হেসে ফেললো। তৌসিফ ঝট করে ওর মুখ চেপে ধরে। তায়ু মাত্র ই ঠোঁট কাঁপাচ্ছিলো কাঁদবে বলে কিন্তু তা সম্ভব হলো না। তৌসিফ ছেলের বুকে মৃদু হাত চাপড় দিলো। তায়ু চুপ করে ঘুমালো।
তৌসিফ ফিসফিস করে বললো,
— জোরে হেসো না।
ওর মতোই ফিসফিস করে পৌষ বললো,
— তাহলে কি করব?
— আমি তোমার প্রেমসুধা পান করব।
— ব্যাটার লজ্জা নেই। ছাড়ুন।
পৌষ বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। তৌসিফ হেসে পাশে এলো। পৌষ’কে বুকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
— মানুষ বলে পৃথিবীতে সুখী মানুষ নেই।
— মিথ্যা বলে?
— হ্যাঁ। এই দেখো আমাকে কত সুখী।
পৌষ হাসলো। তৌসিফে’র বুকে মাথা রেখে ধীর কণ্ঠে বললো,
— প্রকৃত সুখী আমি। আমার ছন্নছাড়া জীবনে আপনি ছিলেন একমাত্র ব্যাক্তি যে আমাকে গুছিয়ে দিয়েছেন। আপনার রাগ হোক বা ভালোবাসা আমি মাথা পেতে নিয়েছি। আমি চাই আমাকে এই প্রেম রোগ কখনো না ছাড়ুক। আপনি আজীবন আমার প্রেমের সুধাই পান করুন।
তৌসিফ পৌষ’কে আরেকটু কাছে টানলো। আজ তার বেশিই সুখ লাগছে। এমন সুখ লাগা ভালো। একটু বেশিই ভালো।
#সমাপ্ত….