#শেষ_থেকে_শুরু
#পর্ব_২
লেখিকা #Sabihatul_Sabha
জবা ঝাপসা চোখে অন্ধকার রুমে কারো পায়ের শব্দ পেতেই বলে উঠলো, ‘ কে.? কে এখানে!!?’
বেলী রুমের একটা জানালা খুলে দিলো। বাহির থেকে হাল্কা রুমে আলো আসতেই ফিসফিস করে জবার কানে বেলী বলে উঠলো, ‘ হুসসস চুপ! আমি বেলী। বড় মায়ের নিষেধ তোমার রুমে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না আমি রুমের দ্বিতীয় চাবি চুরি করে এসেছি। তোমার রুমের পাহাড়ায় আছে ছোট মা, একটু শব্দ পেলেই বড় আম্মু কে বলে দিবে।
জবা কিছু বলতে চেয়েও পারলো। শরীর ক্রমশ খারাপ হয়ে আসছে,সারা শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা আর নিতে পারছে না জবা।
বেলী হাল্কা আলোয় বুঝার চেষ্টা করলো জবার কি অবস্থা! গায়ে হাত দিতে দিতে বললো,’ তোমার আর আমার মধ্যে একটা মিল কি জানো.? আচ্ছা আমিই বলি,আমাদের মধ্যে মিল হলো আমাদের দু’জনের নাম ফুলের নাম।
জবার গায়ে হাত দিতেই বেলী চমকে উঠলো। ঘা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
বেলী দ্রুত পানি এনে মাথায় ঢালতে শুরু করলো। কিছু সময় যেতেই বেলীর চিন্তা বাড়তে শুরু করলো। জবার গায়ে, গালে চাপর দিয়ে হাল্কা করে ডাকতে শুরু করলো জবার শ্বাস চলছে হুশশ নেই।
বেলী কি করবে বুঝে না পেয়ে রুম থেকে বের হয়ে দ্রুত দুই তলার দক্ষিণ পাশের রুমটায় গিয়ে ধাক্কা দিলো।
রাত তখন প্রায় তিনটা বাজে।
দ্বিতীয় বার ধাক্কা দেওয়ার আগেই রুমের দরজা খুলে গেলো। সামনে এসে দাঁড়ালো অভ্র এখনো সন্ধ্যার শার্ট জড়ানো, চোখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে,চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালের উপর লেপ্টে আছে।
বেলী অভ্র কে দেখেই পেছনের দিকে ফিরে বুকে হাত রেখে লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে হুশে আনার চেষ্টা করলো। এই একটা মানুষ যে বেলীর সামনে আসলেই বেলী কথা বলতে ভুলে যায়,মাঝে মাঝে শ্বাস নিতেই ভুলে যা, আঁটকে থাকে বুকের পাশে।
অভ্র গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো, ‘ এত রাতে দরজা কেন ধাক্কা দিচ্ছিস.? বাসায় যখন আছি সকালেও ত কথা বলা যেতো। ‘
অভিমানে ভাড় হয়ে গেলো বেলীর মন। এতোগুলা বছর পর দেশে আসলো রাত হোক আর দিন দেখে ত খুশি হয়ে কেমন আছে জিজ্ঞেস করার কথা উল্টো এমন কথা বলছে!
অভ্র আবার বলে উঠলো, ‘ এভাবে উল্টো দিকে ঘুরে থাকবি নাকি দরজা বন্ধ করে দিব.? ‘
বেলীর মনে পরলো সে কেনো এখানে এসেছে, অভিমান লুকিয়ে পেছন ফিরে মাথা নিচু করে বললো,’ অভ্র ভাই আমার সাথে একটু নিচে যাবে!.? প্লিজ!’
অভ্র দরজা লাগাতে লাগাতে বলে উঠলো, ‘ সকালে কথা বলছি বেলী ঘুমাতে যা।’
বেলী দরজা আটকে বলে উঠলো, ‘ ভীষণ প্রয়োজন ভাইয়া না হয় ও বাঁচবে না’
অভ্র বিরক্ত হলো বেলীর এমন লজিক ছাড়া কথায়, এত রাতে কে বাঁচবে না.?
অভ্র প্রশ্ন করতে গিয়েও করলো না।
বেলী নিজ থেকে বলে উঠলো, ‘ ভাইয়া জবা ভাবির শরূর ভীষণ খারাপ, ভাবির ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তুমি ত ডাক্তার একটু দেখে যাও না ভাবি কে।’
অভ্র জবার নাম শুনতেই থমকে গেলো। দরজা লাগাতে গিয়েও ছেড়ে দিলো। কিছু একটা ভেবে বলে উঠলো, ‘ কি হয়েছে.? ‘
বেলী~ জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।
অভ্র~ আম্মুকে গিয়ে বল ডাক্তার ডেকে আন।
বেলী চুপ করে মাথা নিচু করে রাখলো।
অভ্র দরজা বন্ধ করে দিলো বেলীর মুখের উপর।
বেলী দরজার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘ তোমরা সবাই খুব খারাপ, বড় আম্মু, ছোট আম্মু মেঝো আব্বু, তুমি সবাই খারাপ। ভাবির অভিশাপে সব শেষ হয়ে যাবে দেখে নিও।’
বেলী রাগে আবলতাবল বলে আস্তে ধীরে নিচে নেমে আসলো। আশেপাশে তাকিয়ে জবার রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিবে তখনি দরজায় কেউ হাত দিয়ে থামিয়ে দিলো।
ভয়ে জমে গেলো বেলী,আজ বুঝি ওর শেষ দিন! বড় আম্মু হলে ওকে ত বাড়ি থেকেই বের করে দিবে আর জবা! জবাকে ত আরও শাস্তি দিবে।
বেলী ভয়ে ভয়ে দরজার বাহিরে তাকিয়ে দেখে অভ্র দাঁড়িয়ে আছে।
বেলীর চিন্তিত মুখে হাল্কা হাসি ফুটে উঠলো।
অভ্র সে দিকে পাত্তা না দিয়ে রুমে ঢুকে গেলো। আবছা অন্ধকার রুম।
অভ্র বেলীকে বললো,’ রুমের লাইট নেই.?’
বেলী~ আছে তবে লাইট জ্বলে উঠলে আম্মু আসবে দেখতে রুমে কেউ এসেছে কি না!
অভ্র জেনো সবকিছুর মধ্যে কেমন একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে।
অভ্র দ্বিধায় পড়ে গেলো সে কি করবে!
আবছা আলোয় জবার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ বেলী তুই কি এখন আমাকে কিছু মেডিসিন এনে দিতে পারবি.?’
বেলী~ এত রাতে কিভাবে.?
অভ্র~ এইগুলো এখন প্রয়োজন উনার অবস্থা ভালো না।
বেলী কিছু একটা ভেবে বলে উঠলো, ‘ আচ্ছা কি কি আনতে হবে বলো।
অভ্র একটা কাগজে কিছু মেডিসিন লিখে বেলীকে দিলো।
বেলী মোবাইল বের করে আয়ান কে কল দিলো।
তিনবার রিং হওয়ার পর আয়ান ঘুমঘুম চোখে ফোন কানে দিয়ে বললো,’ তোর কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই.? এত রাতেও কেন আমাকে বিরক্ত করতে হবে.?
বেলী খ্যাক করে রেগে গেলো, ‘ আমি তোকে বিরক্ত করি.? নিজেকে একবার আয়নায় দেখেছিস.? খবিশ কোথাকার!
আয়ান~ আমি ঝগড়া করার মুডে নাই, আমি ঘুমাবো।
বেলী নিজেকে যথা সম্ভব ভদ্র মেয়ে বানিয়ে বলে উঠলো, ‘ ভাই আমার জান,প্রান শোন,আমাকে একটা হেল্প করে দে।
আয়ান বিরক্ত হয়ে বললো,’ শয়তানের মুখে আজ এত মধু বেপার কি.? কি ফন্দি করে কল দিয়েছিস.?
বেলী~ তুই আমাকে শয়তান বললি.? এভাবে বলতে পারলি.? আচ্ছা এর জন্য কান্না না হয় কালকে করবো আজ আমাকে এখন কিছু মেডিসিন এনে দে এটা তোর শাস্তি।
আয়ান~ বেলী সকালে আমি বড় আম্মুর কাছে তোর নামে নালিশ করবো।
বেলী ভয় পেলেও বুঝতে দিলো না, ‘ দেখ আমিও বড় আম্মুকে বলে দিব তুই একটা মেয়ের সাথে রাস্তার দাঁড়িয়ে ফুচকা খেয়েছিস।
আয়ান অবাক হয়ে বললো,’ ওটা আমার ফ্রেন্ড ছিলো টকবেল।’
বেলী~ আমার মেডিসিন গুলো প্রয়োজন আমি অসুস্থ।
আয়ান~ এত রাতে সব দোকান বন্ধ।
বেলী~ তোর ত পুলিশ না হয়ে চোর হওয়ার দরকার ছিল তাহলে যদি ভাই বোনদের একটু কাজে আসতি রাখ ফোন।
আয়ান সাথে সাথে ফোন কেটে আবার ঘুম, সকালে উঠে অফিসে যেতে হবে।
অভ্র এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জবার আবছা মুখের দিকে।সে একদম চিনতে ভুল করেনি।সে প্রথম দেখায় জবাকে চিনে ছিল, আজ ছয় বছর পর চিরচেনা সেই মুখ দেখেও সে চিনে ফেললো। সে ঝাপসা স্মৃতি, সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেলেও মানুষটা আজও ঝাপসা হয়নি। কিন্তু ওর আজ এই অবস্থা কেনো.?? অভ্রর মাথায় হাজার কথা ঘুরপাক খেতে শুরু করলো।
প্রথম দেখায় সে জবা কে চিনেছে, এই ত ওর রক্ত জবা, যার এক আঁড়চোখে তাকানো, বাঁকা হাসি, কৃষ্ণবরণ কালো চুলের ঢেউ অভ্র কে রক্তাক্ত করে ছিল, করে ছিল ক্ষতবৃক্ষত! আজ সেই মেয়ে ওর বড় ভাইয়ের বউ,বিধবা! ওর ভাইয়ের মৃত্যুর কারণ! কিভাবে এত এত সত্য বিশ্বাস করবে অভ্র.? জবা তড় কারো মৃত্যুর কারণ হতে পারে না,ও যে খুব ভালো করে এই মানুষটাকে চিনে, জবা হতে পারে কারো বেঁচে থাকার কারণ, মৃত্যুর কারণ নয়।জবা শুধু মাত্র রক্তাক্ত করার ক্ষমতা রাখে অভ্রকে সেই জন্যই ত অভ্র নাম দিয়ে ছিলো “রক্ত জবা!”
অভ্র বুঝলো জবা কিছু বলতে চাচ্ছে। অভ্র কান কাছে নিতেই শুনতে পেলো,’ আমার কপালে একটু হাত রাখবে বেলী!’
কথা স্পষ্ট নয় তবুও বুঝতে অসুবিধা হলো না অভ্রর।
অভ্র হাজার দ্বিধা পেরিয়ে নিজের অজান্তেই হাত রাখলো জবার কপালে।
জবার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। মনে হলো হিমালয়ের এক টুকরো বরফ কপাল ছুঁয়ে গেলো।
ভেতরের ছটফট নিমিষেই শান্ত হয়ে গেলো,শরীর যন্ত্রণারা ছুটি নিলো, মনে হলো শ্বাস ক্রমশ কমে আসছে, মনে হলো দেহ থেকে বুঝি রুহ টা বেরিয়ে গেছে আস্তে করে শ্বাসটা বন্ধ হয়ে গেছে!
কিছু সময় যেতেই বেলী সকল মেডিসিন নিয়ে এসে হাজির হলো।
অভ্র জিজ্ঞেস করলো না কিভাবে এনেছে সে দ্রুত জবার চিকিৎসা করতে শুরু করলো।
বেলী~ ভাবি নড়ছে না কেন.?
অভ্র~ জ্বর ১০৪° এর উপরে, দরকার ছিল বিকেলেই হসপিটালে নিয়ে যাওয়া। উনি এত অসুস্থ কিভাবে হলো.?
বেলী মাথা নিচু করে বললো,’ আগে ভাবিকে সুস্থ করো তারপর সব বলবো।
____________
সকাল সকাল বাড়িতে হুলুস্থুল অবস্থা। কুলসুম বেগমের হুংকারে বাড়ির প্রতিটা দেওয়ার কেঁপে উঠল।
ঠাই দাঁড়িয়ে রইলেন শায়লা সিদ্দিকী। বেলী ভয়ে কাঁপছে শার্লিন বেগম মেয়ের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সবাই জানে এই বাড়িতে একজনই শুধু জবার কাছে যাবে সেটা বেলী। আর কারো সাহস হবে না কিংবা মায়া হবে না।
কুলসুম বেগম বললেন, ‘ আগে ওই মেয়েকে দেখে নিচ্ছি তারপর শার্লিন তোর মেয়েকে দেখে নিব।’
কুলসুম বেগম জবার রুমের দিকে যেতে নিলে সামনে পথ আঁটকে দাঁড়ালেন শায়েলা সিদ্দিকী।
কুলসুম বেগম রেগে বলে উঠলেন,’ মেঝো সামনে থেকে সর।’
শায়লা~ বড় ভাবি এখানে ত ওই নিষ্পাপ মেয়েটার কোনো দোষ নেই,তুমি সব সময় সবার রাগ ওর উপর কেন দেখাও!’
কুলসুম ~ এখন কি আমার তোকে জবাব দিহি করতে হবে.?’
শায়লা~ প্রয়োজন হলে তাই,এখানে আমাদের যেমন অধিকার ওর ও অধিকার আছে৷ আমাদের শশুর বাড়ি ওর ও শশুর বাড়ি পার্থক্য শুধু আমাদের মাথার উপর স্বামী নামক ছায়া আছে আর ওর নেই। তুমি ত জানো আসিফ জবা কে কতোটা ভালোবাসতো, আসিফ আমাদের মাঝে নেই দূর থেকে ওর ভালোবাসার মানুষের এমন কষ্ট দেখলে যে ও নিজেও কষ্টে থাকবে!
কুলসুম বেগম শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘ এতোই ওর কষ্ট বুঝলে নিজের ছেলেকে দিয়ে রেখে দে, আমি আজও ওকে এই বাড়ির বউ মানিনা আর কখনো মানবোও না। আমার ছেলে হারিয়েছে তোর না তাই তুই আমার কষ্ট বুঝবি না। পারলে নিজের ছেলেকে দিয়ে রেখে দেখা।
শায়লা সিদ্দিকী চুপ করে রইলেন।
কুলসুম তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে উঠলো, ‘ কি হাওয়া ঠুসস.? আমার কষ্ট বুঝতে হলে আমার পরিস্থিতিতে দাঁড়াতে হবে। ‘
কুলসুম শায়লা সিদ্দিকী কে সরিয়ে জবার রুমের দিকে যেতে নিলে পেছন থেকে শায়লা সিদ্দিকী বলে উঠলো, ‘ আর এক পা এগিয়ে ওই ঘরের দিকে যাবেন না ভাবি, ঠিক বলেছেন আপনার পরিস্থিতিতে যেতে হবে। আমি আমার আয়ানের সাথে জবার বিয়ে দিব। আজ এই মুহূর্ত থেকে জবা আমার ছেলের হবু স্ত্রী। আপনি কিংবা অন্য কেউ ওর শরীরে কেন ওর রুমে আঘাত করারও দুঃসাহস দ্বিতীয় বার করবেন না। আমি সজ্ঞানে বলছি আমার আয়ানের সাথে জবার বিয়ে দিব।
রুমের কারো মুখে কোনো কথা নেই,সবাই তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে আছে শায়লা সিদ্দিকীর দিকে।
পেছন থেকে নিজের রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ির কাছে এমন কথা শুনে থমকে গেছে আয়ান!
চলবে,
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।