শেষ থেকে শুরু পর্ব-০৪

0
1187

#শেষ_থেকে_শুরু
#পর্ব_৪
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

সময় কারো জন্য থেমে থাকে না।দিনের পর রাত আর রাতের পর আবারও নতুন সকালের আগমন।

সপ্তাহ খানেক কেটে গেছে অভ্র তেমন কারো সাথে কথা বলেনি। আসিফের এমন মৃত্যু অভ্র কে ভেতর থেকে ভেঙে দিয়েছে। এতো এতো স্মৃতি ভালোবাসা কাটিয়ে উঠতে পারছে না।

অভ্র আজ সকাল সকাল নাস্তার টেবিলে এসে বসলো।

আজ নাস্তা শায়লা সিদ্দিকী আর কুলসুম বেগম মিলে বানিয়েছেন পাশে ভীতু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাজের মহিলা লতিকা।
আজকাল লতিকার রান্না কেউ খেতে পারছে না হয়তো লবন বেশি না হয় জ্বাল। লতিকার পাশাপাশি আরও একজন রান্নার জন্য মহিলা রাখা হলো কিন্তু তার রান্না আরও বাজে তাই বাধ্য হয়ে আজ দুইজন রান্নায় লেগেছে।
শায়েলা সিদ্দিকীর রান্নার হাত তেমন ভালো না। উনি সব কাজ করতে পারবেন শুধু এই রান্নায় এসে আঁটকে যান।
কুলসুম বেগম নিজ হাতে সবটা করলেন।
শায়েলা একটা জিনিস দেখলে অবাক হন একটা মানুষ এতো পারফেক্ট কিভাবে হয়.? কুলসুম বেগম এমন কিছু নেই পারেন না। এই কোম্পানি সবটা নিজ হাতে সামলান সাথে বাড়ির সব খবর রাখেন। কোথায় কি হচ্ছে সবার আগে উনার কানে চলে যায় অবশ্য এই কাজ করে শার্লিন। কোথায় কে কি ভুল করলো সবার আগে মুখে নিয়ে বসে থাকে বড় ভাবিকে বলার জন্য এই বুঝি কোনো প্যাচ লাগাতে পারলো।

শার্লিন বেগম হেলেদুলে নিচে নেমে অভ্র কে দেখে মুচকি হেঁসে পাশে বসে বললো,’ অভ্র তোমাকে ত দেখাই যায় না, সারাদিন রুমে বসে থাকো বাহিরে এসে সবার সাথে গল্প করতে পারো।’

কুলসুম বেগম ছেলের সামনে কফি রেখে বললো,’ ওর একটু রেস্ট নেওয়া দরকার ছোটো, এই পাঁচটা বছর ত কম দৌড়তে হয়নি৷ আর এখন ত… যাক সেই সব আমার ছেলের যতদিন ইচ্ছে নিজের মতো থাকুকু।’

অভ্র মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,’ আজ আমি হসপিটাল জয়েন করছি আম্মু। ‘
‘ সে কি! সত্যি.? ‘
‘ হুম’
‘ আমাকে আজ বলতে হলো!’
‘ মন খারাপ করো না আমিও রাতেই কথা বলেছি’
কুলসুম বেগম বেশি কিছু বললেন না। সময় দেখে বললেন,’ কখন যাবি.?’
‘ দশটায়’
‘ তাহলে দুইজন এক সাথেই চলে যাবো।’
অভ্র কফি তে মুখ দিয়ে মোবাইলের দিকে তাকালো।

বেলী রাগে ফুসতে ফুঁসতে এসে চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘ আম্মু ওই হনুমান কে বলো আমার রুম থেকে সবকিছু নিয়ে যেতে ‘
শার্লিন বেগম কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,’ হনুমান! কি বলিস মা হনুমান কোথায় থেকে আসলো.? আর তোর রুমেই কেন.?’
কিছু একটা ভেবে শার্লিন বেগম বলে উঠলো, ‘ ছেলে হনুমান নাকি মেয়ে.? ‘
মায়ের এমন কথা বেলী আরও রেগে গেলো। এমন একটা সময়ও মা এমন ভাবে প্রশ্ন করছে.?
‘ এই বাড়িতে ত একটাই হনুমান আছে তারপর ও তুমি আমাকে কিভাবে জিজ্ঞেস করছো.?’

শায়েলা সিদ্দিকী রান্না ঘর থেকে বের হয়ে বললেন,’ কি হয়েছে বেলী আয়ান আবার কি করেছে.?’
‘ দেখো না মেঝো মা আমি রুমে ঢুকে দেখি বিছানার উপর বিড়াল তুমি ত জানো আমি বিড়াল কতো ভয় পাই তার উপর সাথে কি ছিল জানো,..?’
‘ কি.?’
‘ সাথে একটা তেলাপোকা, বিড়ালটা তেলাপোকা খাচ্ছে তাও আমার বালিশের উপর ‘
বেলী রাগে দুঃখে কান্না করে দিলো।
শায়েলা সিদ্দিকী জানেন এটা আয়ানের কাজ নিশ্চয়ই আয়ান ইচ্ছে করেই এমনটা করেছে। এই বাড়িতে কেউ তেমন বিড়াল পছন্দ করে না একমাত্র আয়ান ছাড়া। আয়ানের বিড়াল সারাদিন ওর রুমে বন্দী থাকে। মাঝে মাঝে বিড়াল পাওয়া যায় বেলীর ঘরে হয়তো ইদুর নিয়ে না হয় টিকটিকি,তেলাপোকা সাথে। অবশ্য বেলীকে জ্বালানোর জন্যই আয়ান এমনটা করে।

আয়ান কানে ইয়ারফোন দিয়ে কান শুনতে শুনতে নামছে। সাথে নিজেও সুর মেলাচ্ছে…

” চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো.?’

বেলী একটা আপেল নিয়ে সেটা ওর দিকে ছুড়ে মেরে বললো,’ তোর বেলা কে আজ আমি শোনাচ্ছি বেয়াদব, হনুমান! তুই চাকরি কেন নোবেল পেলেও বেলা তোকে বিয়ে করবে না ‘
আপেল আয়ানের হাতে, আয়ান মুচকি হেঁসে আপেলে কামড় বসিয়ে বেলীর দিকে তাকিয়ে আবার বললো,’ চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলী শোনছো.?’
বেলীর রাগ আরও বাড়লো।
আয়ান অভ্রর পাশে বসে আপেলে আরেক কামড় বসিয়ে বললো,’ তোর এমন পুচকি পুচকি হাতের আপেলে আমার মতো বীরপুরুষের কিছু হবে না। এমন হাতে তুড়ি মেরে দেখিয়ে বললো, ‘ এভাবে শেষ করে নিব, আর ছোটো মা আপনি ত একটু ওকে আদব জ্ঞান শিখান। বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় এটাও এখনো শিখেনি।’
শার্লিন বেগমের মনে হলো এটা খুব পুরনো কথা। আয়ান সব সময় এই একই কথা বলে থাকে।
‘ তোর থেকে আমার মায়ের জানতে হবে আমার আদব জ্ঞান আছে কিনা? ‘
‘ আমি তোকে কোলে নিয়ে হেঁটেছি এবার বুঝতে পারছিস আমার বয়স কত.?’
বেলী তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলো, ‘ বুড়ো দামড়া একটা ‘
‘ এই তুই আমাকে বুড়ো কেন বললি.?’

অভ্র ওদের এইসব ছোটো বাচ্চাদের মতো ঝগড়া দেখে বিরক্ত হয়ে বললো,’ এখনো এভাবে ঝগড়া করার তোমাদের বয়স আছে.? ‘
আয়ান বেলী দুইজন চুপ হয়ে গেলো।
বেলী আবার অভ্রর কাছে বলতে শুরু করলো, ‘ আমি কিছু করিনি ত আয়ান নিজেই…
‘ আয়ান তোমার ছোট নাকি বড়.?’
বেলী এবার ভীষণ লজ্জা পেলো। আল্লাহ মাটি ফাঁক হোক আমি লুকিয়ে পড়ি। ভাই থুক্কো ক্রাশের সামনে কোন ঝগড়া করতে গেলাম!
অভ্র কিছু না বলে উঠে গেলো।
ওদের কারো মুখে কোনো কথা নেই৷
শার্লিন বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,’ আরও বলো, একদম বেশ হয়েছে তোমার জন্য অভ্রর মতো একজন প্রয়োজন। ‘
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে বেলীর সকল মন খারাপ নিমিষেই দূর হয়ে গেলো। খুশিতে লাফিয়ে বলতে ইচ্ছে করলো,’ অভ্রর কপি আমার প্রয়োজন নেই আম্মু অভ্র কেই প্রয়োজন! কিন্তু লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বেলীর আর বলা হলো না। ‘

কুলসুম বেগম অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে জবার রুমের সামনে দাঁড়ালেন।
লতিকা কে ইশারা করতেই বাহির থেকে দরজার তালা খুলে দেওয়া হলো।
কুলসুম বেগম রুমের ভেতর প্রবেশ না করেই ভীষণ মিষ্টি একটা ঘ্রাণ পেলেন।
উনার ইচ্ছে হলো ভেতরে দেখার কিসের এতো সুন্দর ঘ্রাণ.? এই রুম থেকে ত বিশ্রী গন্ধ আশার কথা৷ আজ একমাস এই রুম সব সময় বন্ধ থাকে। বন্ধ ঘর থেকে এমনিতেও একটা বাজে গন্ধ আসে অথচ রুমের দরজা খুলতেই মনে হলো এমন মিষ্টি ঘ্রাণ কুলসুম বেগম আর কোনো দিন কোথাও শুনেন নি। হাজার স্প্রে কে,ফুলের ঘ্রাণ কে হার মানায় এই ঘ্রাণ।
কুলসুম বেগম নিজেকে কঠিন থেকে কঠিন রাখার চেষ্টা করে বিষয়টা কাউকে বুঝতে দিলেন না।
জবাকে বললেন বের হয়ে আসতে।
জবা বের হয়ে আসলো।
সাদা শাড়ি এক ফোঁটা ময়লার দাগ নেই,নেই কালচে রং। মনে হচ্ছে এই বুঝি ভাজ থেকে খুলে পড়েছে। মুখে নেই কোনো সাজসজ্জা, গয়না অথচ এই সাদা শাড়িতে কি স্নিগ্ধ লাগছে এই মেয়েকে।
কুলসুম বেগম জবার মুখের দিকে এক মিনিট তাকিয়ে রইলেন৷ কিছু কি বুঝার চেষ্টা করলেন.? নাকি পড়ার.? অথচ এই মেয়েকে পড়া, বুঝা ত এত সহজ নয়! নেই চোখে ক্লান্তি, নেই ঠোঁটে হাসি,নেই মুখে দুঃখের আবাস এ কেমন মেয়ে.?

কুলসুম বেগম বেশি কিছু ভাবতে চাইলেন না কঠিন কন্ঠে বলে উঠলেন,’ অনেক ত বসে বসে খাওয়া হলো আজ থেকে রান্না ঘরের সব দায়িত্ব তোমার। রান্না ঘরে কেউ প্রবেশ করবে না আমার আদেশ। সব রান্না, কাজ তুমি নিজ হাতে করবে কোনো কিছু জেনো ভুল না হয়।একটা কিছু ভুল হলে তার শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে।’

জবা শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো কুলসুম বেগমের দিকে।

কুলসুম বেগম চলে যেতেই আয়ান জবার সামনে এসে বললো,’ অনেক দিন পর দেখা হলো, এক সপ্তাহ হবে..’
জবা কিছু বললো না।
‘ আপনি এভাবে তাকিয়ে কেন আছেন.? বড় আম্মু কিছু বলেছে.? ওই দিন কিন্তু আমি উওর পাইনি।’

ওই দিন আয়ান প্রশ্ন করে ছিল,’ আপনি রাজি.?’
এর বিপরীতে জবা বলে ছিল, ‘ আপনার বিড়ালটা সুন্দর তবে ভয়ংকর ‘

আয়ান অবাক হয়ে পেছন ফিরে দেখলো ওর বিড়াল জবার রুমে চলে এসেছে।
আয়ান বিড়ালকে আদর কে হানি বলে ডাকে।
‘ আপনি আমার বিড়াল কে চিনেন.? ‘
জবা বিড়ালটার দিকে তাকিয়ে বললো,’ আমি এই বাড়ির প্রতিটা জিনিস সম্পর্কে জানি’

আয়ান আর কিছু বলার আগেই লতিকা চলে এসেছিল। আয়ানের ইচ্ছে থাকলেও লতিকার এমন শিকারী চাহনি দেখে কথা না বাড়িয়ে চলে এসেছিল। তারপর অবশ্য আয়ান কম বাহানা খুঁজেনি জবার সাথে কথা বলার জন্য। লতিকা নিশ্চয়ই গিয়ে কুলসুম কে বলে ছিল কুলসুম তালা ঝুলিয়ে দিল দরজায় আর সুযোগ হয়নি কথা বলার।

আয়ান ভাবনা থেকে বের হয়ে জবাকে বললো,’ আপনি এমন রোবটের মতো সব সময় থাকেন কেন.? আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল যদি বাহিরে কোথাও বসে বলা হয় ভালো হবে।’
জবা আয়ানের কথার পিঠে বলে উঠলো, ‘ আমার বাহিরে বের হওয়া নিষেধ। ‘
‘ আমার সাথে বের হবেন, আপনি আমার হবু স্ত্রী সেটা সবাই জানে’
জবা মনে মনে হেঁসে উঠলো। মুখ সেই আগের মতো রেখেই বললো,’ আচ্ছা ‘
আয়ান খুশি হয়ে মাথা চুলকে বললো,’ তাহলে আজ’
‘ আপনার ইচ্ছে ‘
জবা খুব ভালো করেই জানে আয়ান হাজার চাইলেও জবার বের হওয়া সম্ভব নয়।

আয়ান নিজেই অফিসের উদ্দেশ্যে বের হতে নিয়ে বললো,’ বড় আম্মু কি বলেছে.?’
জবা সোজাসাপটা উত্তর দিল,’ রান্না ঘরের দায়িত্ব ‘
আয়ান বুঝতে পারলো না।

আয়ান চলে গেলো।

জবা নিজের রুমের দিকে গেলো। দুপুরের রান্না নিশ্চয়ই সে করতে হবে। এই বাড়িতে এসেছে আজ দুই মাস হলেও রান্না ঘরে কখনো প্রবেশ করা হয়নি।

জবা রুমে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করার সময় চোখ গেলো সিঁড়ির দিকে। এক মিনিটের জন্য মনে হলো ও চোখে ভুল দেখছে। চোখ কচলে আবার তাকালো…

অভ্র হসপিটালের জন্য রেডি হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। সিড়ির শেষ মাথায় এসে এই নিষিদ্ধ ঘরের দিকে তাকালো চোখে চোখ পরতেই শ্বাস আঁটকে আসলো জবার ঠাসসস করে চোখের সামনে দরজা বন্ধ করে দিলো।

চলবে,
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।