শেষ থেকে শুরু পর্ব-০৯

0
648

#শেষ_থেকে_শুরু
#পর্ব_৯
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

এই মেয়ে মায়ার মেয়ে তাই না.? ”
ছোট বোনের কথায় চমকে উঠে শায়লা সিদ্দিকী।
হানা কিছু সময় বড় বোনের চমকে ঐঠা মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,’ তুমি চোখ থেকেও অন্ধ নাকি? মেয়েটার দিকে ভালো করে তাকাও’
” মায়ার স্বভাব কেমন ছিল তুই ভালো করে জানিস সেখানে জবা একদম বিপরীত স্বভাবের ”
” এমন ত হতে পারে স্বভাব আফজালের পেয়েছে”
” আফজাল কোথায়.? আর এই মেয়ের কোনো পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি আমরা শিউর কিভাবে হব.?”
” তুমি আসলেই বোকা আপা হতে পারে মেয়েটা ইচ্ছে করে পরিচয় গোপন করে এই বাড়িতে ঢুকেছে ”
” কিন্তু কেন.?”

__________

জবা আস্তে করে ডায়রীটা বন্ধ করলো। চোখের জল এক হাতে মুছে বাহিরের দিকে তাকালো। কান্না করলে চলবে না এই ডায়রীর শেষটা খুঁজে বের করতে হবে। কি হয়ে ছিল শেষটায়.? কেন শেষটা লেখা নেই.? শুধু কিছু শব্দ ” আপনি মানুষ যখন ধোঁকা দেয় মানুষ তখনি মৃত হয়ে যায়! আজ তোমাকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই আমার কাছে আফজাল, আজ তোমার প্রেয়সীর শরীর অপবিত্র হয়ে গেছে আমাকে কি তুমি ক্ষমা করবে.? আমি নিজেকে পবিত্র রাখতে পারিনি! তারা আমাকে অপবিত্র করে ফেলেছে আফজাল! আমার মেয়েটা হাসতে শিখেছে অথচ সেই হাসি দেখার ভাগ্য আমার হলো না!”

লাস্ট পৃষ্ঠায় লেখা ” নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু কে.? আরেকজন নারী”

কি হয়ে ছিল জবার মায়ের সাথে.? কারা করে ছিল.? ” তারা” বলতে কি একের অধিক ছিল.? জবা আর ভাবতে পারছে না মাথা ভনভন করছে। এটা জবার মায়ের ডায়রী আজ বাইশটা বছর এটাকে যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছে জবা। আফজাল অর্থাৎ জবার বাবা ছাড়া এই ডায়রীতে আর কারো হাত পরেনি, পরতে দেয়নি জবা বা আফজাল কেউই। আফজাল জবাকে সব সময় একটা কথাই শিখিয়ে ছিল ” অনেক বড় হতে হবে তোকে ঠিক তোর মা’য়ের মতো! অন্য কারো উপর নয় শুধু মাত্র নিজের উপর ভরসা রাখতে হবে,নিজেকে নিজে সামলে নেওয়া শিখতে হবে সারাজীবন ত আমি পাশে থাকবো না রে মা! তোর মায়ের মতো সাহসী নারী হয়ে সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে। আচ্ছা তাহলে জবার মা কেন শেষ বেলায় এই সমাজের মানুষের সামনেই মুখ লুকিয়ে দুনিয়ার মায়া ছাড়তে হয়ে ছিল.? সমাজ আমাদের ভালোর সময় হাত তালি দিবে আমাদের পাশে আর সেই সমাজ একটু কিচ্ছু না হতেই ছিঃ ছিঃ করলে দোষ আসলে কার সেটা খুঁজবে না। দোষ একটাই তুমি মেয়ে! তুমি ঘরে থাকবে তোমার পা বাহিরে কেন.? দোষ তোমার! ”

জবা ডায়রীটা হাজার বার পরেছে এখানে মায়ের স্কুল জীবন, প্রেম,সুন্দর একটা ফ্রেন্ডসার্কেল, কারো মন ভাঙার গল্প, হাসি, কান্না, দুঃখ জীবনের প্রতিটা গল্প এই ডায়রীর প্রতিটা পাতায় লেখা। জবা পড়তে পড়তে মুচকি হাসে আবার কাঁদে আর গম্ভীর হয়ে বলে ম্যাজিক থাকলে একটু চেঞ্জ করে দিতাম। তবে শেষের কয়েকটা পাতা পড়লে জবার হাউমাউ করে কান্না আসে মা কে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে বাবার প্রতি রাগ হয়, কেন সেই সময় বাবা মায়ের পাশে থাকলো না.? মা কে একা করে কেন কাজে চলে যেতে হলো.? জবা একজন কপও ছাড়বে না শুধু সবগুলো অপরাধী কে খুঁজে বের করতে হবে। শান্তি জবা নিজ হাতে দিবে যেভাবে ওরা ওর মা কে দিয়ে ছিল!

জবার মা একজন সৎ উকিল ছিলেন। সবাই বেশ সম্মানের চোখে দেখতেন উনাকে। এই যে জবা বাবার কথা রেখেছে আজ লোকে জবার দিকে তাকিয়ে বলে ঠিক তুমি তোমার মা’য়ের মতো হয়েছো! এটাই ত ওর জীবনে পাওয়া সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

জবা এইসব ভাবতেই ওর রুমের দরজা খট করে খুলে কেউ রুমে প্রবেশ করলো। কেউ দেখার আগেই দরজার ছিটকানি লাগিয়ে দিল।
জবা পেছন ফিরে অবাক হলো। অভ্র ওর রুমে কি করছে.? জবার ভাবনার মাঝেই অভ্র জবার বাহু শক্ত করে চেপে ধরলো।
জবা থমথমে মুখে নিজের দুই বাহুর দিকে তাকিয়ে রেগে গেলো। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলেও বুঝতে দিল না। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিল।

” তোমার সাহস কি করে হয় আমাকে হুমকি দেওয়ার!
..?”
জবা এতোক্ষণে বুঝলো অভ্রর এই হঠাৎ রাগের কারণ। ঠোঁটে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বললো,’ কেন খুশি হননি.?”
অভ্র জবার চোখে তাকিয়ে বললো,’ তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি!’
‘ আমার সাহস সম্পর্কে ত আপনি খুব ভালো জানেন অন্তত আপনার মুখে এটা মানায় না!’
‘ তোমার কি মনে হয় আমি তোমাকে ভয় পাই.?’
‘ না পেলে চোখ সরিয়ে নিয়েছেন কেন.? চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস হয় না কেন.? কাপুরুষ! ‘
অভ্রর চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো,কপালের রগ ফুলে উঠলো। জবা ওকে ” কাপুরুষ বলেছে! সে চাইলেই এখন বুঝিয়ে দিতে পারে কাপুরুষরা কেমন হয়.? তাদের হিংস্রতা কেমন! কিন্তু সে এমন কিছুই করবে না, কারণ সে কাপুরুষ নয়!’

জবা অভ্র কে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল।
‘ দ্বিতীয় বার আমার রুমে আসার আগে পারমিশন নিয়ে আসবেন মিস্টার রাফসান চৌধুরী অভ্র। ‘
অভ্র বুকে দুই হাত বেঁধে জবার দিকে তাকিয়ে বললো,’ আমি চাইলে এক তুরিতে আজ তোমার এটা শেষ রুম,বাড়ি হতে পারে! এক মিনিটে আমি তোমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করতে পারি কিংবা বের করে দিতে পারি। ‘
জবা শাড়ির আঁচল ঠিক করে অভ্রর সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বলে উঠলো, ‘ আমি নিজে না চাইতে কেউ আমাকে এই বাড়ি থেকে বের করতে পারবে না,এখন সবাই জানে আমি আসিফের বাচ্চার মা হতে যাচ্ছি! ‘
অভ্র জবার কানের কাছে একটু ঝুঁকে বললো,’ আর সত্যিটা আমি জানি!’
জবার বুক কেঁপে উঠল। অভ্র কি সত্যিটা সবাই কে বলে দিবে.? তাহলে ত কুলসুম বেগম জবাকে খু’ন করে ফেলবে।
জবার মুখ একটু ভীতু হতে দেখে অভ্র এক হাত বাড়িয়ে জবার চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বললো,’ বাচ্চা হতে সময় লাগে দশমাস তারপর তুমি কি করবে.? কি বলবে.? এর থেকে একটা ভালো আইডিয়া আমার মাথায় এসেছে ‘
জবা প্রশ্ন করলো ” কি আইডিয়া!.? ”
‘ এখন একটা জিনিস তোমাকে তোমার মঞ্জিল পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে তা হলো বাচ্চা চাইলে কেউ জানবে না তুমি আর আমি তোমাকে বাচ্চা…. ‘
অভ্র আর কিছু বলার আগেই ঠাসস করে গালে থাপ্পড় পরলো।
গালে হাআ দিয়ে রাগে দাঁতে দাঁত চেপে অভ্র বললো,’ থাপ্পড় কেন মারলে.?’
” আপনি আর আপনার এই নোংরা মন-মানসিকতার আইডিয়া নিয়ে আমার রুম থেকে বের হন!’
‘ অথচ তুমি আমার পুরোটা কথাই শুনলে না, আমি নোংরা কিছু বলিনি তোমার ভাবনা নোংরা জবা’
‘ আমার ভাবনা নোংরা.? এখনো এতো বড় কথা বলছেন.? জাস্ট বের হন আমার রুম থেকে, দ্বিতীয় বার মাথায় রাখবেন আমি আপনার বড় ভাইয়ের বড়,আপনার ভাবি যা মা’য়ের সমতুল্য। ‘
অভ্র রাগে হাত মুষ্টি বদ্ধ করে দেয়ালে আঘাত করলো। জবা ফিরেও তাকালো না।

অভ্র যেতে যেতে ফিরে তাকিয়ে বললো,’ তোমার সব সময় এই বেশি বুঝার জন্য পস্তাতে হবে একদিন, আমি অন্য দশটা ছেলের মতো নই,আমার ব্যাক্তিত্য এতোটা সস্তা নয়।’

অভ্র যেতেই জবা বিছানায় বসে পরলো। রাগে গজগজ করতে করতে বলে উঠলো, ‘ আসছে পীরহুজুর এতো ভালো ব্যাক্তিত্য হলে আমার রুমে কি.? ভালো করেছি হুমকি দিয়েছি আরও দিব! আমি আমার কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য সর্বোচ্চ করতে পারি সে যেই হোক।

__________

আয়ান ভয়ে ভয়ে আশেপাশে তাকালো কোথাও মৌরি আছে কিনা দেখার জন্য।
এই মেয়ে আসার পর থেকে ওকে জ্বালিয়ে মারছে। কোথাও একটু শান্তি নেই, রুমে গিয়েও শান্তি পাচ্ছে না ভাবছে যতদিন মৌরি থাকবে ততদিন সে আর বাড়িতে আসবে না। কিন্তু জবা কে না দেখেও যে থাকতে পারবে না। এই মেয়ের মধ্যে আল্লাহ এতল এতো মায়া দিয়ে দিয়েছে চাইলেও ভুলে থাকা যায় না। আয়ানের মতো একজন ছন্নছাড়া ছেলেকে যে মেয়ে মায়ায় বেঁধে ফেলেছে সেই মেয়ে ত সাধারণ কেউ হতে পারে না, সে সাধারণের মাঝে অসাধারণ একজন পরী, আয়ানের পরী।

কোথাও মৌরি কে না পেয়ে সামনে পা বাড়ালো কফি করে নিবে। দিন দিন লতিকার রান্না বান্না, কফি সবকিছু বিষাক্ত লাগে।

আয়ান সামনে যেতেই জবা কে গ্লাসে পানি নিতে দেখে কেশে উঠলো।
জবা গ্লাস থেকে চোখ সরিয়ে আয়ানের দিকে তাকালো।
আয়ান সাথে সাথে চোখ সরিয়ে হাসি মুখে বললো,’ তুমি কি খুব বেশি ব্যস্থ.?’
জবা মাথা নেড়ে না বুঝালো।
আয়ান আস্তে করে অনুরোধের সুরে বললো,’ এক কাপ কফি করে দিবে.? মাথাটা ভীষণ ধরে আছে।’
জবার মায়া হলো আয়ানের ইনোসেন্ট মুখ দেখে।
‘ অবশ্যই আপনি বসুন আমি বানিয়ে আনছি।’
আয়ান সোফায় গিয়ে বসলো ঠিক রান্না ঘরের মুখোমুখি।
জবার গায়ে ছাই রঙা শাড়ি, খুব সাদাসিধা সাজগোজ, চুল বিনুনি করা।
আয়ানের মনে প্রশ্ন জাগলো। আচ্ছা চুল ছাড়া অবস্থায় জবা কে কেমন লাগে.? ভীষণ সুন্দর লাগবে হয়তো। সব সময় বিনুনি করে রাখে তাও চুল কতো বড় ছাড়া থাকলে ত ভাবতেই আয়ান আবার বলে উঠলো ‘ এখনি ঠিক আছে না হয় যে দেখত সাথে সাথে হার্ট অ্যাটাক করতো, ভাবত পৃথিবীতে সর্গথেকে পরী নেমে আসেছে।

একটা কথা কি জানেন.? আপনি যাকে ভালোবাসবেন তাকে আপনার চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ মনে হবে, মনে হবে তার তুলনা সে শুধুই নিজে দ্বিতীয় কেউ নেই। তাকে একটা ছ্যাড়া কাপরেও আপনার চোখে বিশ্ব রূপসী মনে হবে। আয়ানের অবস্থাও দিন দিন তাই হচ্ছে।

জবা কফি বানিয়ে এনে আয়ানের সামনে ধরতেই সে মুষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে নিল।
জবা ফিরে যেতে নিলে আয়ান পেছন ডেকে বলে উঠলো, ‘ তোমার জন্য কিছু এনে ছিলাম! ‘
জবার পা থেমে গেলো৷ পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলো আয়ান পকেট থেকে এক মুঠো কাঁচের চুড়ি বের করলো।
‘ কখনো তোমার হাতে চুড়ি পরতে দেখিনি, জানিনা চুড়ি পরলে তোমার হাত কেমন লাগে, তোমার হাতের রিনঝিন শব্দ কতোটা ঘোরে ফেলতে পারে। আমার এই সামান্য কিছু কি গ্রহণ করবে রাণী.?’
জবা কি বলবে.? কি করবে.? শ্লার একটু পটাতে চেয়ে ছিল অথচ এই ছেলে ত দিন দিন মজলু হয়ে যাচ্ছে…
জবা আশেপাশে তাকাতেই দুতলায় অভ্র কে দেখলো।
জবা হাসি মুখে চুড়ি গুলো হাতে নিল৷ আয়ান ভাবতে পারেনি জবা সত্যি নিবে। সে কফি হাতে নিল ভেতর ভেতর লুঙ্গি পরে ডান্স দিতে ইচ্ছে করছে।

” আমার জন্য এককাপ কফি হবে ভাবি..?”
রাগে ভেতর ফেটপ গেলেও উপর উপর হাসে ঝুলিয়ে বললো মৌরি।

” নিজে বানিয়ে খেয়ে নে মৌরি এটা জবার কাজ নয়!”
আগুনে জল না কেরাসিন যেনো ঢালা হলো৷
মৌরি রাগী চোখে আয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,’ বড় ভাইয়ের বউয়ের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় খালামুনি এখনো তোমাকে শিখায়নি.? জবা কি.? ভাবি বলতে শিখ আর খালামুনি না শিখালেও আমি চলে এসেছি সবকিছু শিখিয়ে দিব! আর রইলো এটা ভাবির কাজ নয় তাহলে নিজে কেন বানিয়ে নিলে না.? এই বাড়ির বড় বউ উনি সবকাজ, মেহমান আপ্যায়ন ত উনিই করতে হবে তাই না ভাবি.?’

চলবে,
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।