শেষ থেকে শুরু পর্ব-২০+২১

0
447

#শেষ_থেকে_শুরু
#পর্ব_২০
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

পুরো একদিন একরাত কেটে গেছে আয়ানের কোনো খোঁজ খবর নেই।
মোবাইল ও বন্ধ!
শায়েলা সিদ্দিকী সন্দিহান দৃষ্টিতে জবার দিকে কয়েকবার তাকালো।

অভ্র কে কুলসুম বেগম ড্রয়িং রুমে ডেকেছেন।আজ বিয়ের তৃতীয় দিন চলছে। সকল মেহমান চলে গেছে। আয়ানের বিয়ের পর মৌরির অবস্থা খুব খারাপ দেখা গেছে। সেই ছোট থেকে মনে প্রাণে আয়ান কে ভালোবেসে এসেছে মেয়েটা চোখের সামনে আয়ানকে অন্য কারো হয়ে যেতে দেখলো অথচ কিছুই করতে পারলো না। অসুস্থ হয়ে পড়েছে কান্না করতে করতে মৌরি তাই ওর আম্মু মাহা তালুকদার মৌরি কে সাথে করে নিয়ে গেলো।

অভ্র টাউজারে হাত ঢুকিয়ে আস্তে ধীরে নিচে নেমে আসলো।

কুলসুম বেগম হাতের ইশারায় পাশে বসতে বললেন।

অভ্র আস্তে করে বসলো, ওইরাতে গরম চা পড়ায় হাঁটুর উপরে অনেক পুড়ে ফসকা পরে গিয়ে ছিল ইচ্ছে করে অভ্র কোনো মলম বা ঔষধ দেয়নি। কিছু কিছু জিনিসের যন্ত্র করে ” দাগ” পরতে দেওয়া উচিত, কিছু কিছু যন্ত্রণা আনন্দ দেয়। আজও বসতে গিয়ে চিনচিন ব্যাথা করে উঠলো তবে অভ্র কাউকে বুঝতে না দিয়ে আড়চোখে চারপাশে তাকালো কোথাও জবা নেই। ওই রাতের পর আর এই মেয়েকে দেখা হয়নি কে জানে কি প্লান সাজাচ্ছে।

ড্রয়িং রুমে শায়েলা সিদ্দিকী, শফিক, রফিক সাহেব, শার্লিন বেগম উপস্থিত।

সবাই কুলসুম বেগম কি বলেন তার অপেক্ষা করছেন।

অভ্র ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বললো,’ জলদি বলুন আম্মু আমার যেতে হবে।’
কুলসুম বেগম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে।
শার্লিন বেগম কিছু বলার জন্য হাসফাস করছেন৷ এমন না যে আয়ান কে উনার পছন্দ না, আয়ান কেও উনার ভীষণ পছন্দ কিন্তু কখনো মেয়ের স্বামী হিসেবে কল্পনা করেননি।

কুলসুম বেগম নিরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলেন,’ বিয়ের আগমুহূর্তে তুমি কোথায় চলে গিয়ে ছিলে.?’
‘ একটা কাজ পরে গিয়ে ছিল আম্মু’
কুলসুম বেগম রেগে হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন,’ এমন কি কাজ পরে গিয়ে ছিল যে তোমার আমাদের মানসম্মানের কথা একবার ও মনে আসেনি.? তোমার হবু বউ স্টেজে বসে ছিল তোমার একবার বেলীর কথাও মনে পরেনি.? তুমি ওকে অপমান করেছো অভ্র!’

অভ্র ওর আম্মুর থেকে চোখ সরিয়ে গম্ভীর মুখে সবার দিকে তাকিয়ে বললো,’ আপনাদের আর কিছু বলার আছে.?’
সবাই হতভম্ব হয়ে গেলো! সবাই জেনো অভ্রের কথা শুনে মুখে আশা কথা গুলো গিলে নিলো।

কুলসুম বেগম অভ্রের দিকে তাকিয়ে বললো,’ আমার কথা এখনো শেষ হয়নি অভ্র! তুমিও আসিফের মতো অবাধ্য হয়ে গেছো!’

‘ এখন কি আমাকেও আসিফের মতো পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে.?’
অভ্রের মুখে এমন কথা শুনে পরিবেশ একদম থমথমে হয়ে গেলো।
অভ্র বসা থেকে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরলো আর পেছনে রেখে গেলো হাজার খানেক প্রশ্ন!

নিজের রুম থেকে খিলখিল করে হেঁসে উঠলো এক কিশোরী সে ড্রোনের মাধ্যমে ওদের সব কথা শুনতে চেয়ে ছিল কিন্তু অভ্র এত শটকার্ট কথা শেষ করে দিবে ভাবতে পারেনি। ভেবে ছিল মেঝো আব্বু, ছোট আব্বু, কুলসুম বেগম তাদের থেকে প্রচুর বকা খাবে অভ্র অথচ সে বুঝতে পারলো তারা নিজেরাও অভ্র কে কিছু বলতে ভয় পায়!
সে বেশ মজা পাচ্ছে বাড়ির এক এক জনের করুন দশা দেখে। এখনো ত কিছুই না সামনে সবার জন্য সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে।

______________________

বেলী নিজের রুমে নিজেকে বন্দী করে রাখে সব সময়।

আজ রাতে শায়েলা সিদ্দিকী বেলীর রুমে আসলো। চারপাশ তাকিয়ে বললো, ‘ কি অবস্থা করে রেখেছো বেলী সোনা.?’
বেলী একবার চোখ তুলে শায়েলা সিদ্দিকীর দিকে তাকিয়ে আবার দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বই সামনে ধরলো।
‘ এভাবে নিজেকে ঘর বন্দী করে নিলে চলে.! তুমি আমার একমাত্র ছেলের বউ। তোমার এই অবস্থা আমি মেনে নিতে পারছি না। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করো। সবকিছু মেনে মানিয়ে নাও। আয়ান খারাপ ছেলে নয় বেলী, আমার ছেলে বলে বলছি না এটা তুমিও জানো।’

বেলী তখনো বইয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
শায়েলা সিদ্দিকী বুঝলেন বেলী এখন কথা বলতে চাচ্ছে না৷
‘ বেলী আজ থেকে তুমি আয়ানের রুমে থাকবে এটা বড় ভাবির আদেশ ‘
বেলীর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করলো না। তবে সে আয়ানের রুমে যাবে না।

শায়েলা সিদ্দিকী চলে গেলো।
বেলী অবাক হলো। শায়েলা সিদ্দিকী কয়েকদিন আগেও জবা কে বউ করার জন্য এত পাগল ছিল এতো সহজে বেলীকে মেনে নিল!
বেলী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মনে মনপ বললো ‘ বড় আম্মুর আদেশ হয়তো সেই জন্যই, সবাই ত বড় আম্মুকে ভীষণ ভয় পায়!’

বেলী চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো। রাতে না ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করতেই ঘুম চলে আসলো।

_____________

জবা কে একটা ছেলের সাথে দেখে অভ্র গাড়ি দাঁড় করিয়ে তাকিয়ে রইলো।
জবা আলিফের পেছনে বাইকে বসে আছে।
আলিফ বলে উঠলো, ‘ নিরু আপু কোন দিকে যাব.?’
‘ সোজা বা দিকে চলো’

ওদের পিছু পিছু গেলো অভ্রের গাড়ি।

জবা বুঝতে পারলো ওদের কেউ ফলো করছে, এমনি এমনি তে ত সিআইডি অফিসার হয়নি!

জবা আলিফকে বললো রাস্তার সাইডে আমাকে নামিয়ে দাও আর তুমি চলে যাও।
আলিফ মনে মনে খুশি হলো ওর গার্লফ্রেন্ড ওকে বার বার মেসেজ দিচ্ছে দেখা করার জন্য । আলিফ কথা না বাড়িয়ে জবা কে নামিয়ে দিয়ে বললো,’ কোনো সমস্যা হলে আপু আমাকে কল দিবেন!’

আলিফ চলে যেতেই জবা মাস্ক পড়ে রিক্সা ডাকলো।

বাড়ির পেছনে রিক্সা থেকে নেমে জবা শাড়ি পড়ে পাইপ বেয়ে উপরে উঠে আসলো।
দূর থেকে সবকিছু খেয়াল করলো অভ্র সে অবাক হয়ে বলে উঠলো, ‘ এটা মেয়ে নাকি বাঁদর ছিল.?’

জবা রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে বসতেই ওর রুমের দরজায় টোকা পরলো।
জবা দরজা খুলতেই দেখলো অভ্র বাঁকা হেঁসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

জবা ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অভ্র ওর রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
জবা অভ্রের এমন আচরণে রেগে আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে কিছু বলতে চাইলে অভ্র ওর হাত চেপে ধরে নিজের একদম কাছে নিয়ে আসে।

জবা রেগে ছটফট করে ছুটার চেষ্টা করে বললো,’ নির্লজ্জ ছেলে আমার থেকে দূরে থাকো! কতবার নিষেধ করেছি আমাকে ছুঁবে না অসভ্য ‘
অভ্র বাঁকা হেঁসে বললো,’ এখনো ত কিছুই করলাম না অথচ অসভ্য তকমা দিয়ে দিচ্ছ.? অথচ একই পাশে, একই বাইকে, ঘাড়ে হাত রেখে অন্য ছেলেদের সাথে ত ভালোই ঘুরে বেড়াতে পারো। আমি রুমের ভেতর হাত ধরলেই অসভ্য হয়ে গেলাম.?’

অভ্র আমি তোমার সাথে কোনো তর্কে যেতে চাই না আমাকে ছেড়ে দূরে দাঁড়াও। তোমার ছোঁয়াতেও আমার ঘৃণা লাগে। ‘
অভ্র রেগে গেলো জবার কথা শুনে। রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরে বললো,’ ছেলেটা কে ছিল.?’
জবা আরও তেজ দেখিয়ে বললো,’ বলবো না তোমাকে! ‘
‘ কেন বলবে না.?’
‘ আমার ইচ্ছে ‘
‘ এতে কিন্তু ছেলেটার সমস্যা হবে’
‘ ওকে তুমি কিছুই করবে না’
অভ্রের মুখের বাঁকা হাসি দেখে ভয় পেয়ে গেলো জবা।
‘ ওর কিছু হলে আমি তোমাকে ছাড়বো না বলে দিচ্ছি অভ্র! ‘
‘ ছেড়ো না প্লিজ দুই হাতে যত্ন করে আঁকড়ে গলায় জড়িয়ে থেকো’
জবা শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে অভ্র কে ছাড়িয়ে দূরে সরে দাঁড়ায়।
‘ তোমার মতো ছেলেদের আমি ঘৃণা করি। যেই ঘৃণা আজ থেকে ছয় বছর আগে ছড়িয়ে ছিলে আজও তার বেড়েই চলছে।’

অভ্র দুই পা এগিয়ে এসে জবার দিকে ঝুঁকে গেলো।
জবা পিছিয়ে গেলো না ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো।

অভ্র ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,’ যেই মনে এতো ঘৃণা একদিন সেই মনে প্রেমের ফুল ফুটবে, একটু ভালোবাসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে তোমার হৃদয়। আমি প্রমাণ করে দিব অভ্র চৌধুরী এতোটাও কারেক্টারলেস নয়! তার রক্তজবার হাত ছাড়া সে কখনো দ্বিতীয় কারো হাতও স্পর্শ করেনি।’
জবা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলো, ‘ জানেন ত মিস্টার অভ্র চৌধুরী কয়লা ধুলে কখনো ময়লা যায়না!.?’
জবা কি ইঙ্গিত করেছে অভ্র খুব সহজে বুঝতে পারলো।

‘ আমি ভেবে ছিলাম তুমি অন্তত আমাকে বিশ্বাস করবে অথচ আমি সব সময় ভুল ছিলাম! ‘
অভ্র আর কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

জবা ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,’ আমার সত্যি জানার কোনো ইচ্ছে নেই, আমার উদ্দেশ্য তুমি না, তোমার পরিবার অপেক্ষা করো আগামীকাল তোমার পরিবারের জন্য সারপ্রাইজ আছে। আমি পেরেছি হ্যা আমি পেরেছি সব প্রমাণ জোগার করতে। ভালো মানুষের আড়ালে মুখোশ গুলো টেনে বের করার সময় এসেছে। যে মন কাঁটায় জর্জরিত সেই মনে কখনো প্রেমের ফুল ফুটবে না! আমি ফুটতে দিব না’

____________

বেলী বিরক্ত হলো ঘুম থেকে উঠে দেখে সবকিছু ওর রুম থেকে লতিকার আম্মা আয়ানের রুমে নিয়ে এসেছে।
কুলসুম বেগম এসে ওকে আদেশ করলো ওর রুমে চলে যেতে।

বেলী কুলসুম বেগমের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলো না। এই কিছু না বলতে পারার জন্য নিজের প্রতি নিজের ভীষণ রাগ হলো।

সে বাড়ির কোনো খবর জানেনা। অভ্র কি বাড়িতে বিয়ের পর আর ফিরেছে.? সে কি জানে বেলী আজ কার বউ.? বেলী এই তিনদিন রুমে নিজেকে বন্দি রেখেছে। কারো সাথে কোনো রকম কথা বলেনি, কেউ বলতে চাইলেও রুম থেকে বের করে দিয়েছে।

তখন হয়তো রাত দশ কি বারোটা বেলী ধীর পায়ে নিজের চিরচেনা রুম থেকে বের হয়ে একবার আশেপাশে তাকালো। অভ্রের রুমের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল কিছু সময়। দরজা দেখে বুঝতে পারলো অভ্র বাড়িতে।
সে অভ্রের দরজা দেখলে বুঝতে পারে সে বাড়িতে কিনা। সে যে ছোট থেকেই এই মানুষটাকে সব সময় বুঝতে চেয়েছে। কখনো কি প্রয়োজন বেলীর থেকে ভালো কে জানে.? শুধু অভ্রের মনের খবরটা বেলী আজীবন জানতে পারলো না। তবে সে মুখোমুখি হবে, জিজ্ঞেস করবে কেন সে এমনটা করলো.? কেন এতো এতো স্বপ্ন দেখিয়ে বিয়ের পিরিতে বসালো.? প্রথম নিষেধ করতে পারতো অন্তত বেলী অন্য কারো না হতো। আজ অভ্রের জন্য আয়ানকে বিয়ে করতে হয়েছে সে ক্ষমা করবে না অভ্র কে কখনো করবে না।

মধ্য রাতে বাড়িতে ফিরেছে আয়ান৷ লতিফা আয়ানকে দেখে খুশিতে বলে উঠলো, ‘ স্যার আপনার আম্মাকে ডাকমু.?’
আয়ান নিষেধ করে দিয়ে বললো’ ঘুমাতে যাও কাউকে ডাকতে হবে না’

আয়ান নিজের রুমের সামনে এসে পকেট থেকে চাবি বের করে রুমে ঢুকে পরলো।
রুম আবছা অন্ধকার, ড্রিম লাইট জ্বলছে। আয়ান আর লাইট জ্বাললো না।
সে এসেছে বারেকের বাসা থেকে, এতোদিন বারেকের বাসায় ছিল। সে সোজা এসে বিছানায় শুয়ে পরলো।
কোলবালিশ ভেবে হাত পা ছড়িয়ে রাখতেই বেলীর ঘুম ভেঙে গেলো।
নিজের উপর এমন শক্ত হাত পা বুঝতে পেরে ভয়ে গলা শুকিয়ে আসলো। হঠাৎ চিৎকার দিয়ে লাথি মারলো।

হঠাৎ শরীরে লাথি পরতেই তাল সামলাতে না পেরে আয়ান ধপাস করে বিছানা থেকে নিচে পরে গেলো। ব্যাথায় কোমর চেপে ধরলো।

বেলী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আবার চিৎকার করার আগেই আয়ান দ্রুত উঠে এসে ওর মুখ চেপে ধরলো।

চলবে,
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

#শেষ_থেকে_শুরু
#পর্ব_২১
লেখিকা #Sabihatul_Sabha

আয়ান রেগে কোমরে হাত দিয়ে বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে ।
বেলী আয়ানকে দেখেই নিজের সামনে বালিশ এনে বলে উঠলো, ‘ আয়ানের বাচ্চা তুই কোন সাহসে আমার শরীরে হাত দিয়েছিস.? তুই আমার থেকে দশহাত দূরে থাক! খবরদার দ্বিতীয় বার আমার শরীরে হাত দেওয়ার চেষ্টা করলে তোর হাত ভেঙে দিব!’

আয়ান প্রথম রেগে থাকলেও বেলীর কথা শুনে গা দুলিয়ে হেঁসে উঠলো।

” ছিঃ কি বিশ্রী হাসি!”
আয়ান বাঁকা হাসি দিয়ে বেলীর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,’ তুই আমার বিয়ে করা বউ শরীর ত ছুঁতেই পারি’
” তোর উপর ঠাডা পরবো আয়ান আমার দিকে আসলে”
” তুই আমার কোমর ভেঙেছিস আর আমি তোর কোমর ভাঙবো না!.?”
” আমার থেকে দূরে থাক! কাছে আসবি না,আমি চিৎকার করছি!”
” হ্যাঁ কর চিৎকার! ড্যাং ড্যাং করে ত বিয়ের আসনে বসে পরলি জামাই পালায় গেছে সেই খবর নাই.? তোর জন্য আমার জীবনডা শেষ হয়ে গেল! আমার স্বপ্ন, আমার জবা, আয়ান রাগে ছটফট করতে করতে বলে উঠলো, ‘ আমি তোকে ছাড়বো না বেলী, আমি তোকে সত্যি আজ গলা টিপে খু’ন করবো।’

আয়ানের চোখ ছলছল করছে, জ্বলজ্বল করছে চোখের তাঁরা বেলী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পেছন থেকে আয়ানের রিভলবার কাঁপা হাতে ওর সামনে ধরে বললো,’ আয়ান তুই আমার সামনে আসলে আমি সুট করবো, দূরে থাক!দূরে থাক বলছি!’
আয়ান রেগে বলে উঠলো, ‘ তুই এটা পেলি কোথায়.? ‘
তোতলাতে তোতলাতে বেলী বলে উঠলো, ‘ এই রুম থেকে খুঁজে বের করে রেখে ছিলাম! ‘
” বেলী, বেলী শোন এটা আমার হাতে দে ”
” একদম না তুই এই রুম থেকে বের হ”
” বেলী লাস্ট বার বলছি এটা আমাকে ফিরিয়ে দে না হয় ভালো হবে না”
বেলী দিলো না আয়ান রেগে এগিয়ে এসে ওর বালিশে হাত দেওয়ার আগেই চোখ বন্ধ করে বেলী রিভলবারে টিপ দিল, সাথে সাথে বিকট শব্দ হলো স্তব্ধ হয়ে গেলো পরিবেশ, ভয়ে কেঁদে উঠলো বেলী, তখনো বেলীর চোখ বন্ধ। মাথায় খেলে গেলো আয়ানের বুকে কি লেগেছে.? আয়ান ঠিক আছে ত.? চটজলদি চোখ খুলে সামনে তাকালো বেলী।

_________________

জবা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে ডায়েরির দিকে।
ব্যাগ থেকে মায়ের বহুপুরোনো একটা শাড়ি বের করে গায়ে জড়িয়ে নিল।
বাবার মুখে শুনেছিল মায়ের ভীষণ পছন্দের শাড়ি ছিল এটা।
কারণ এটা নাকি তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর দেওয়া।
জবা শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখে নিল। চোখ বন্ধ করে মায়ের গায়ের গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,’ তোমার সাথে যে তোমার গায়ের গন্ধ ও হাওয়ায় মিশে গেছে মা! এই শাড়ি গায়ে যে তোমার গায়ে শেষ জড়ানো ছিল মা! আমি কাউকে ছাড়বো না মা! কাউকে না….’
জবার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরছে।

জবা শাড়ি গায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসছে।
প্রথম জবার দিকে চোখ পরলো লতিফার।
লতিফা হা করে তাকিয়ে রইলো জবার দিকে।
লতিফাকে ডাকতে ডাকতে রান্না ঘর থেকে খন্তি হাতে বেরিয়ে আসলো শার্লিন বেগম।
লতিফা কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজেও তাকালো সিঁড়ির দিকে।
শার্লিনের মুখ আপনার আপনি বলে উঠলো, ‘ এই শাড়িতে তোমাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে’
জবা ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠলো, ‘ আমার মায়ের শাড়ি, মায়ের শাড়ি ত সব সময় মেয়েকে সুন্দর লাগে, মনে হয় মা জড়িয়ে রেখেছে ।
শার্লিন বেগমের ইচ্ছে করলো এই প্রথম জবার গালে হাত রেখে বলতে, ‘ মা কে ভীষণ ভালোবাসো.?’
কিন্তু মনের কথা মনেই রয়ে গেল। এখনো ত জবার পরিচয় কেউ জানে না। কি জানি মা আছে কিনা!

জবা গেলো রান্না ঘরে শার্লিন বেগম কে হেল্প করতে।

শার্লিন বেগম নিষেধ করলো কুলসুম জানতে পারলে রাগ করবে। জবার এখন রেস্ট নেওয়া জরুরি।
জবা তাও আজ নিজ হাতে রান্না করলো।
শার্লিন বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,’ আজ যদি হয় এই বাড়িতে আমার শেষ দিন তাহলে আপনি অনেক খুশি হবেন তাই না.?’
শার্লিন বেগম চমকে তাকালেন জবার দিকে জবা তখনো ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছে শার্লিন বেগমের মুখের দিকে।

____________________

বেলী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সামনে তাকিয়ে দেখলো আয়ান রাগী তবে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে বেলীর দিকে।
বেলী এলোমেলো ভাবে আয়ানের দিকে এগিয়ে এসে ওর বুক, হাত, শরীরে দেখতে লাগলো।
আয়ান রেগে বলে উঠলো, ‘ এই এই কি করছিস!.? লজ্জা করছে না একজন ছেলেকে এভাবে দেখতে। ‘
‘ চুপ থাক আয়ানের বাচ্চা কোথাও লাগেনি ত.?’
‘ আমি তোর থেকে বড় বেলী ভুলে যাস না! আমি এখন গিয়ে সবাই কে বলবো অভ্র এই গুন্ডি মেয়েকে বিয়ে না করে ত বেঁচে গেলো এখন আমার কি হবে.? প্রথমেই বউ জামাই কে খু’ন করার চেষ্টা করেছে। আরেকটু হলে এখন আমি উপরে চলে যেতাম।

বেলী ভয়ে চুপসে বললো,’ বাসার কাউকে কিছু বললে আমিও বলে দিব তুই আমার শরীরে হাত পা দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিস!’
আয়ান গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো, ‘ ছিঃ বেলী তোর মিথ্যা বলতে বুক কাঁপবে না.? আমি চাইলে এখনি তোকে আমাকে মারার জন্য জেলে পুরে দিতে পারি, মিথ্যা বলার জন্য কারাগারে পাঠিয়ে দিতে পারি সারাজীবনের জন্য। ‘
বেলী এইসব বিষয় ভীষণ ভয় পায়। সে তার সারাজীবন জেলে, কারাগারে কাটাতে চায় না। এমনিতেই জীবনটা কারাগারের থেকে কঠিন হয়ে গেছে ভাবতেই মলিন হেঁসে আয়ানের দিকে হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’ ফাঁসি হবে না.? প্লিজ আয়ান জীবন ত এমনিতেই কারাগারের থেকেও কঠিন হয়ে গেছে, জীবনের যখন বেঁচে থাকার কারণ হারিয়ে যায় তারপর কি আর কোনো কিছু কারাগারের থেকে কম লাগে.? আমি এই যন্ত্রণা নিতে যে পারছি না, পারছি না এক বাড়িতে তার সামনে শ্বাস নিতে এর থেকে ভালো আমাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দে প্লিজ।’

বেলীর অসহায় চোখের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিল আয়ান।

_______________

অভ্র হসপিটাল থেকে এসে সোফায় বসে লতিকা কে ডাকলো।
‘ জ্বে ভাইজান বলেন’
অভ্র খেয়াল করলো আজ রান্না ঘরে জবার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
” তোমার ভাবিকে বলো এক গ্লাস পানি দিতে”
” ভাইজান আমি দেই.?”
অভ্র কপালে দুই আঙ্গুল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেই বললো,’ লতিকা আমি কি বলেছি.?’
অভ্রর কন্ঠ শুনেই বুঝলো লতিকা অভ্র রেগে আছে।
লতিকা জবার পেছনে দাঁড়িয়ে মিনমিনে সুরে বললো,’ ভাবি ছোট্ট ভাইজান বলছিল তারে আমনে পানি দিতেন।’
জবা ভ্রু কুঁচকে ড্রয়িং রুমে তাকিয়ে বুঝলো কথা না বাড়িয়ে গ্যাস কমিয়ে রান্না ঘর ছাড়লো।

চোখের সামনে রিনঝিন শব্দে চুড়ি বেজে উঠতেই অভ্র চোখ তুলে তাকালো।
জবা পানি হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
অভ্র জবার দিকে একবার তাকিয়ে সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিল।
জবার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে পানি পান করে গ্লাস ওর হাতে দিতেই জবা জিজ্ঞেস করলো, ‘ আর কিছু লাগবে ছোট ভাই.? ‘
অভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,’ ছোট ভাই.?’
‘ সম্পর্কে ত ছোটই, বড় ভাইয়ের বউ আমি।’
অভ্র বাঁকা হেঁসে বললো,’ আচ্ছা! ‘
জবা সিরিয়াস মুখে বললো,’ হুম, আর কিছু লাগবে.?’
অভ্র জবার দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়ে এতো সাজগোজ কেন করেছে.? আর এতো খুশি খুশি ভাব কেন.? গোপনে গোপনে কি মতলব করছে.? কিছু ত একটা করেছে ওর মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।

অভ্র হাল্কা হেঁসে বললো, ‘ লাগবে ত অনেক কিছুই আপাতত আমার রুমে এক কাপ কফি নিয়ে আসেন। ‘

অভ্র রুমে চলে যেতেই জবা রান্না ঘরে গিয়ে ওর জন্য কফি করে নিয়ে গেলো।
অভ্র আবারও অবাক হলো কিছুটা এই ঘারত্যাড়া মেয়ে এতো ভালো কবে হলো.? এর এই ভালো হওয়ার আড়ালে কিছু ত একটা রয়েছে, কি করতে চাচ্ছে.?

অভ্র কফি হাতে নিয়ে জবার দিকে এক পা দুই পা করি এগিয়ে আসলো।
জবা অভ্রের তাকানো দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলো।
অভ্র ওর দিয়ে ঝুকে বললো,’ কফি তে চিনি কম হয়েছে ‘
জবা ভীতু কন্ঠে বলে উঠলো, ‘ আমি চিনি দিয়ে দিচ্ছি’
অভ্র বাঁকা হেঁসে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কফি জবার দিকে এগিয়ে ধরলো।
জবা এক চামচ চিনি দিলো। অভ্র বললো,’ আরও’
জবা আরও এক চামচ দিলো, অভ্র বলে উঠলো, ‘ আরও’
জবা আরও এক চাপচ দিলো, অভ্র আবারও বললো,’ আরও’
জবা রাগে অভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে।
অভ্র এক হাতে কপালে স্লাইড করে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,’ এইবার খেয়ে দেখো মিষ্টি হয়েছে কিনা!’
জবা রেগে বলে উঠলো, ‘ এক কাপ কফিতে পাঁচ চামচ চিনি দিয়েছি আপনার এখনো মনে হচ্ছে চিনি হয়নি.?’
‘ এক বার একটু দেখলে কি হবে.?’
‘ আমার খাওয়া কফি আপনি খাবেন.?’
অভ্র রেগে জবার বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠলো, ‘ এতো কথা কেন বলো তুমি.? মুখ বন্ধ রাখা যায় না.? যা বলেছি তাই করো!’
ব্যাথায় জবার চোখের কোনে জল জমা হয়।
অভ্রের হুশ ফিরতেই জবাকে ছেড়ে দিয়ে বলে উঠলো, ‘ সরি, সরি কান্না করো না প্লিজ’
জবা ছলছল চোখে কফির মগে এক চুমুক দিয়ে অভ্রের হাতে কফির মগ ধরিয়ে রুম থেকে এক ছুটে বেরিয়ে গেলো।
অভ্র নিজের এই কারণে অকারণে রাগ দেখে নিজেই বিরক্ত হলো।
কফির দিকে তাকিয়ে এক চুমুক দিয়ে চোখ মুখ খিঁচে ফেললো, এতো মিষ্টি! এমনিতেই এতো চিনি তার উপর এই মেয়ের এক চুমুকে কফি হয়ে গেছে মিষ্টির এক টুকরো খন্ড! ‘

___________

আজ সবাই এক সাথে খাবার টেবিলে বসেছে।
শফিক সাহেব, রফিক সাহেব, শার্লিন বেগম, শায়েলা সিদ্দিকী, কুলসুম বেগম, আয়ান, অভ্র, বেলী।

কয়েক জোরা চোখ কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জবার শরীরে জড়িয়ে রাখা শাড়িটার দিকে।

জবা সবাই কে খাবার বেড়ে দিচ্ছে সাথে হেল্প করছে শার্লিন বেগম।
বেলী নিচের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সে আসতে চায়নি জবা জোর করে এনেছে।
বেলীর পাশের চেয়ারে বসে আছে অভ্র। বেলীর চোখ বার বার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, বেলী এক হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছছে সবার আড়ালে।
সবার আড়াল করতে পারলেও জবার চোখের আড়াল হলো না বেলীর ছলছল চোখ জোরা। নিজের এতো কাছে বসে আছে তার না হওয়া পাষাণ পুরুষটি, এতো বড় প্রতারণা করার জন্য বেলী কি শাস্তি দিবে তাকে.? অভ্র জেনো ওর পাশে বসে ওকেই শাস্তি দিচ্ছে!

লতিকা সবাই কে বললো আজ জবা নিজ হাতে রান্না করেছে।
আয়ান চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে গেলো। জেনো সে জবার সামনে থেকে পালিয়ে গেলো। সে ত কথা দিয়ে ছিল জবাকে কখনো ছেড়ে যাবে না অথচ ঘুম ভেঙে জবা হারানোর আগেই আয়ান অন্য কারো হয়ে গেলো। জবা কি অভিমান করেছে তার উপর নাকি রাগ করেছে.???’

আয়ানের পর বেলীও হাত ধুয়ে ভালো লাগছে না বলে চলে গেলো।
সবাই শুধু চুপচাপ ওদের দুই জনের চলে যাওয়া দেখলো।

অভ্র জবাকে একের পর এক হুকুম দিচ্ছে, যেমন কখনো এটা দাও, ওটা দাও, পানি দাও জবাও চুপচাপ সবকিছু এগিয়ে দিচ্ছে।
জবা অভ্রর খাওয়া দেখে বিরবির করে বলে উঠলো, ‘ কতোদিনের যে না খাওয়া এই লোক, দেখে মনে হচ্ছে সপ্তাহ খানেক এর পেটে খাবার পরেনি। অথচ রাতেও সে আমার সামনে খেয়ে ছিল আজ এতো কেন খাচ্ছে.? এর উপর অন্য কিছু বস করেনি ত.?? ভীতু চোখে জবা অভ্রর খাওয়া দেখছে।
কুলসুম বেগম খাওয়া শেষ করে অফিসের বিষয় শফিক সাহেবের সাথে কথা বলছে তখনি দারোয়ান ছুটে আসলো।
দারোয়ান কে এভাবে ছুটে আসতে দেখে সবাই দরজার দিকে তাকালো।

কুলকুল বেগম ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো, ‘ মিন্টু তোমার পেছনে পুলিশ কেন.?’

দারোয়ান মিন্টু মিয়া কিছু বলার আগেই পুলিশের পেছন থেকে একটা ছেলে বাড়িতে প্রবেশ করে বলে উঠলো, ‘ আমি বলছি আম্মু!’

পরিচিত কন্ঠ শুনে ভয়ে জমে গেলো কুলসুম বেগম, থমথমে মুখে বলে উঠলো তুমি!!।

জবা বাঁকা হেঁসে মনে মনে বলে উঠলো, ‘ প্রথম সারপ্রাইজ, দ্বিতীয়টা ত বাকি আছে এখনো!’

অভ্র অবিশ্বাস কন্ঠে বলে উঠলো, ‘ ভাই!’

চলবে,
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।