পরিণয়ে নোলককন্যা পর্ব-৯+১০

0
207

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

[৯]

পশ্চিমাকাশে সমান্তরাল একটি লাল রেখা চলে গেছে অনেক দূর৷ যা ধীরে ধীরে প্রখর আলোর মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। সবুজ গাছপালার ভেতর থেকে যে আলোর উৎসটি উঁকি দিচ্ছিল তা এখন স্পষ্ট। কমলা রঙা বাস্কেটবলের মত উজ্জ্বল একটি বৃত্ত। শুধু আকারে আরেকটুখানি বড়৷ সে দিকে তাকিয়ে মোকাররম চোখ জোড়া বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিল। আর কিছুক্ষণ পর মায়াবী আলোর উৎসটির দিকে সরাসরি তাকানো যাবে না। তেজীয়ান সূর্যের প্রখরতার সম্মুখে চোখ তুলে তাকাবে সে স্পর্ধা কার আছে?

পাশেই হৈ চৈ জুড়ে দিয়েছে নীহার৷ অচেতন আদ্রিকার মাথাটি কোলের মধ্যে নিয়ে ঘাসের উপর বসে হাউমাউ করে কাঁদছে। মোকাররম চোখ খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকিয়ে ধমক দিল,

‘চিৎকার চেঁচামেচি বন্ধ করো, গর্দভ মহিলা।’

নীহার চোখের পানি মুছে মোকাররমের দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর আবারও নিজের কোলে শুয়ে থাকা আদ্রিকার নিষ্প্রাণ চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘মেয়েটা এখনও চোখ মেলে তাকাচ্ছে না।’

‘অতিরিক্ত মানসিক চাপে জ্ঞান হারিয়েছে। আহামরি তেমন কিছু হয়ে যায়নি৷ কান্নাকাটি থামাও৷’

যেন কিছুই হয়নি, এমনভাবে নিজের বক্তব্য রাখল মোকাররম। অযু করার একটি পাত্রে পানি এনে রওশন আলী আদ্রিকার চোখে মুখে ছিটিয়ে দিল।

আদ্রিকা চোখ খুলে স্থির দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল কিছুপল। ভয়ানক স্বপ্নটির কথা মনে করে সে আরেকবার কেঁপে উঠল। উফ! কী ভয়টাই না পেয়েছিল! একদম জীবন্ত মনে হচ্ছিল সবকিছু। চোখের সামনে একটি রাগান্বিত মুখশ্রী। নিশাচর শিকারীর মত জ্বল জ্বল করছে তার দৃষ্টি।

গালে নীহারের ছোঁয়ায় ধ্যান ভাঙ্গ। কি যেনো বলছে! শোনা যাচ্ছে না কিন্তু ঠোঁটের নড়াচড়া দেখা যায়। আদ্রিকা একদৃষ্টিতে মায়ের অনবরত নড়তে থাকা ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করল। শব্দগুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে৷

‘আদ্রিকা, আদ্রিকা৷ এই শুনতে পাচ্ছিস না?’

‘হুম।’

নরম ঘাসের উপর হাত রেখে আদ্রিকা উঠে বসে সে জবাব দেয়। আশেপাশে কয়েক জোড়া পা। পাদুকা হতে ধীরে ধীরে মুখশ্রীর দিকে নজর বুলিয়ে নিতে নিতে সে উঠে দাঁড়াল।
শাড়ি পরিহিতা একজন ভদ্র মহিলা খানিকটা এগিয়ে এসে গালে হাত রেখে বললেন,

‘ঠিক আছ তুমি? হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে গেলে। ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।’

মহিলার কথা শুনে আদ্রিকা নিজেই ভয় পেল। সেসব না স্বপ্ন ছিল? উনি এসব কি বলছেন! সে কি এখনও স্বপ্ন দেখছে? কিন্তু সে যে উনার হাতে ছোঁয়া স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য নিজের এক হাত তুলে গালের উপর রাখা ভদ্রমহিলার হাতটি ছুঁলো। একি! সে হাত ধরতে পেরেছে! তবে কি সবকিছু সত্যি ছিল?
ওর বিয়ে হয়েছে পরখের সাথে?

আদ্রিকা ঝট করে মায়ের দিকে তাকাল। একে একে চর্তুদিকে নজর ঘুরিয়ে সবকটি উদ্বিগ্ন মুখ দেখে নিল। একেকটি মুখের অভিব্যক্তি একেক রকম। বিরক্তিভরা নয়নে চেয়ে আছে মোকাররম। রওশন আলীর মুখে সামান্য হাসি৷ নীহারের মুখভরা অস্থিরতা। ইবনূল ইবতেহাজ এর মুখমণ্ডল স্বাভাবিক। অন্যদিকে পাথরের মতো শক্ত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই রঙ্গমঞ্চের প্রধান চরিত্র।
শীতল সেই দৃষ্টির দর্শন মাত্র আদ্রিকা কেঁপে উঠল।

এভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উঠায় উদ্বিগ্ন পর্তুলিকা বললেন,

‘কি হল? খারাপ লাগছে?’

আদ্রিকা মাথা দুলিয়ে না জানিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকাল। ঠোঁট উল্টে যেন এখনি কেঁদে ফেলবে। নীহার এগিয়ে এসে মেয়েকে নিজের কাছে টেনে নিল।

‘এবার আমাদের রওনা দেওয়া উচিত।’

ইবনূল ইবতেহাজ এর প্রস্তাবে মোকাররম বড় বড় কদম ফেলে এগিয়ে এসে তোড়জোড় শুরু করে দিল।

‘সেই ভালো। বেলা বাড়ছে। চলো নীহার, ওকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসি৷’

নীহার ও আদ্রিকা একে অপরের গায়ের সাথে আরও লেপ্টে গেল। বিচ্ছেদের ভয়ে দুজনে তটস্থ। বাস্তবিক জ্ঞান নীহারের আছে৷ তবুও বলল,

‘এখনি যেতে হবে? এমন হুট করে হল বিয়েটা।’

মোকাররম চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল। এই মহিলার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। না এমন কথা সে কী করে বলে!

‘মেয়ের বিয়ে দিয়ে এখন ঘরে সাজিয়ে রাখব? বোকার মত কথা বলিও না। তোমার এসব কথা শুনে মেয়ের মাথায় না আবার কুবুদ্ধি চাড়া দিয়ে উঠে।’

আদ্রিকার হাত ধরে ওকে গাড়ির দিকে নিয়ে যেতে যেতে ওর উদ্দেশ্যে বলল,
‘মায়ের কথা শুনে উল্টাপাল্টা কিছু যেনো মাথায় না আসে। এই যে বিদায় দিচ্ছি, আর আমার বাড়ির দিকে যেনো পা না উঠে৷ শ্বশুরবাড়ি থেকে কোনো অভিযোগ যদি আসে, আমার মানসম্মান যদি ডুবাস তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না৷ তোর বোনের ঘটনার পর যেটুকু মানসম্মান অবশিষ্ট আছে, তার উপর ভত করে তোর বিদায় দিছি৷ আশা করব, তার মান তুই রাখবি। মন দিয়ে সংসার করবি।’

ওদের পিছু পিছু পরখের পুরো পরিবার এগিয়ে আসছে। আদ্রিকা বাবার হাত ধরে হাঁটছে ঠিকই কিন্তু বারবার পিছন ফিরে মায়ের দিকে তাকাচ্ছে৷ স্বামীর উপর নীহার ভীষণ বিরক্ত। এভাবে ধরে বেঁধে মেয়ের বিয়ে দিল, এখন আবার মেয়ের সাথে ওকে কথা বলতেও দিচ্ছে না৷ যেনো নীহার নিজের মেয়েকে কোনো কুমন্ত্রণা দিবে।

গাড়ির সামনে পৌঁছে মোকাররম এবং আদ্রিকা দাঁড়াল। ড্রাইভার নিয়ে আসা হয়নি। ইবনূল ইবতেহাজ নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছেন। তিনি আবারও ড্রাইভিং সীটে আসন গ্রহণ করলেন। বাবার পাশে বসল পরখ। পর্তুলিকা গাড়িতে উঠার আগে আদ্রিকাকে বললেন,

‘মায়ের থেকে বিদায় নিবে না? যাও মায়ের দোয়া নিয়ে এসো।’

পাশের দাঁড়িয়েছিল নীহার। আদ্রিকা দ্রুত এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। মোকাররম এগিয়ে যেতে চাইলে পর্তুলিকা বলল,

‘আপনারাও আমাদের সাথে আসুন। মেয়ের শ্বশুরবাড়ি দেখে আসবেন।’

বাঁধা পেয়ে মোকাররম থেমে গেল। কিন্তু চোখ দুটো তার নীহারের দিকেই। মেয়েকে উল্টাপাল্টা কিছু যদি বুঝায় তবে ঝামেলা হয়ে যাবে।

‘গতকাল দেখেই এলাম। আর কি দেখব! আপনাদের উপর ভরসা করে মেয়েকে হাতে তুলে দিয়েছি। বাকিটা আপনারা দেখবেন। মেয়ের বিয়ের আগ পর্যন্ত আমার দায়িত্ব ছিল। বিয়ে দিয়েছি এবার দায়িত্ব শেষ। আপনারা ওর জন্য যা ভালো মনে করেন, তাই করবেন। অন্যায় করলে শাসন করবেন, ভুল করলে শুধরে দিবেন, কিছু না পারলে শিখিয়ে পরিয়ে নিবেন। এমনিতেও ছোট মেয়ে তো, সংসারের তেমন কাজকর্ম করে নাই। তবে শিখিয়ে দিলে পারবে। প্রথম কয়েকটা দিন একটু হাতে ধরে শিখিয়ে দিবেন।’

‘সে নিয়ে আপনারা চিন্তা করবেন না। মেয়ে কেমন আছে, সেটা না হয় আপনারা নিজে গিয়ে দেখে আসবেন৷ আপনার স্ত্রীকে নিয়ে এর মাঝেই একদিন আসবেন কিন্তু। ’

‘মেয়ের শ্বশুরবাড়ি এভাবে যাওয়ার রেওয়াজ আমাদের নেই। তবুও এতো করে যখন বলছেন, মেয়ে সংসারে থিতু হোক, মন বসুক। তখন গিয়ে একদিন দেখে আসা যাবে।’

কথায় কথায় পর্তুলিকা ওকে আটকে রাখে। ওদিকে নীহার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নামিয়ে নিয়ে বলল,

‘এত কান্নাকাটি করার কিছু হয়নি। চুপ কর। রাতের বিয়ে সকালে হয়েছে। এ আর এমন কি! বিয়েটা তো হতেই হত।’

আদ্রিকা হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘এরা কারা? কোথা থেকে এলো,মা?’

‘জানি না। সব তোর বাপের কারসাজি। মাহিনকে রেখে হঠাৎ এই ছেলের কাছে কেনো বিয়ে দিলো জানি না। তবে ভালই হয়েছে। এদের দেখে কোনোভাবে মন্দ লোক মনে হচ্ছে না। বেশ ভালো ব্যবহার, বেশভূষা মার্জিত। ধনী পরিবারের ছেলে মনে হচ্ছে। শোন মা, যা হয়েছে, ভাগ্য বলে মেনে নে। মেয়ের মানুষের এটাই ভবিতব্য। বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া। এখন হয়তো কঠিন মনে হচ্ছে। কিন্তু মন থেকে একবার মেনে নিলে দেখবি আর কোনো কিছুই কঠিন মনে হবে না।

সংসারে ঝামেলা হবে, ঝগড়া হবে, মারামারি হবে। সব সংসারেই হয়। ছোটখাটো বিষয়কে কেন্দ্র করে কখনই সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসার কথা ভাববি না। এই যে যাচ্ছিস, ধরে নে এখন থেকে স্বামীর ঘরই তোর একমাত্র ঠিকানা। একমাত্র আশ্রয়স্থল কেউ কখনও ছাড়ে না? মোটেও ছাড়বি না। লড়াই করে টিকে থাকবি।’

‘কীভাবে কি করবো! অনেক ঝামেলা হবে মা। আমি পারব না। এভাবে সংসার করা অনেক কঠিন কাজ।’

‘কিচ্ছু কঠিন না। কোন কাজে ঝামেলা হয় না, সমস্যা সৃষ্টি হয় না? তুই যদি নিজেই ত্রুটি খুঁজতে থাকিস তাহলে কখনোই মানিয়ে নিতে পারবি না। ত্রুটিগুলোকে সামান্য চোখে দেখলে, স্বাভাবিকভাবে নিলে। সবকিছু সহ্যসীমার মধ্যে চলে আসে। বিকল্প কিছু খোঁজার ইচ্ছে জাগ্রত হয়না৷

যতদিন পানি মাথার উপর না উঠে যায় ততদিন হতাশ হবি না, চেষ্টা ছাড়বি না। কাঁদামাটি পেরিয়ে, জলে ভিজে এগিয়ে যাবি। যেদিন দেখবি পানি একেবারে মাথার উপর উঠে গেছে। টিকে থাকা আর সম্ভব হচ্ছে না। তখন তো আমি আছি। মেয়ে বিদায় দিচ্ছি, একেবারে ত্যাগ করছি না। তবে বাপের বাড়ি আছে, সেখানে মা আছে বলে সংসারে একটু খুটমুট হওয়া মাত্র নাচতে নাচতে চলে আসা যেনো না হয়। তোর বাপকে তো চিনিস। বাড়িতে পা রাখার আগেই তোর আর আমার দুজনেরই পা ভেঙ্গে রেখে দিবে।’

ঠাট্টার সুরে বললেও নীহার আদ্রিকা দুজনেই জানে এটা কতটা সত্য। মোকাররম এমন করার আগে দু’বার ভাববে না। গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কেমন চিলনজরে চেয়ে আছে মোকাররম। ওর সাথে চোখাচোখি হওয়া মাত্র নীহার মেয়েকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

‘যা এবার। দেরী হয়ে যাচ্ছে। সংসারে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করিস। কোথাও আটকে গেলে কল দিস৷ তবে রাতের দিকে দিস না। তখন আবার তোর বাবা বাড়িতে থাকে। জানিসই তো, ফোন হাতে দেখলে মানুষটা কেমন চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয়।’

___

পিচঢালা সড়কে একটি গাড়ি গড়গড় করে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ উল্টোদিক হতে প্রচুর গাড়ি ছুটে চলেছে বাজারের দিকে। ঘড়ির কাঁটা আটের ঘর পেরিয়েছে। কেউ ছুটছে স্কুলে, কেউবা অফিসে৷ যান্ত্রিক জীবনের কর্মময় সময়ের ঘন্টা বেজে গেছে। সবাই শুধু ছুটছে। ওদের বড্ড তাড়া৷ শুধু তারা নেই এই গাড়িটির৷ ইবনূল ইবতেহাজ খুবই ধীর গতিতে গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। পাশে বসে উশখুশ করছে পরখ। এখানে বসে না থেকে পায়ে হেঁটে গেলেও বুঝি তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাওয়া যাবে। অথচ গাড়ির ভেতরের প্রতিটি সদস্যের কেউ এ বিষয়ে চিন্তিত নয়। পেছনের সীটে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে আদ্রিকা। পর্তুলিকা সীটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে।

নিস্তব্ধ গাড়ির ভেতর পরখ বসে আছে থমথমে মুখে। চাইলেও এ নিস্তব্ধতা ভেদ করা সম্ভব হচ্ছে না। এখানে অবস্থানরত কোনো ব্যক্তির সাথে কথা বলার মত নূন্যতম রুচিবোধ হচ্ছে না তার। সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে ইবনূল। ইচ্ছে করেই এভাবে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সামনে দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি রেখেই পরখ তার গমগমে স্বরে জানাল,
‘গাড়িটা একপাশে দাঁড় করাও। আমি নেমে যাবো।’

গাড়ির ভেতর হঠাৎ বো/মা বি/স্ফোরণ ঘটল। প্রতিটি সদস্য ঝট করে সোজা হয়ে পূর্ণ মনোযোগ দিল পরখের দিকে। এতোগুলো উৎসুক দৃষ্টি পরখকে বিচলিত করতে পারল না। সে নিশ্চল চেয়ে আছে সড়কের দিকে।
পর্তুলিকা একপলক আদ্রিকার দিকে চেয়ে নিয়ে আবারও সামনে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,

‘কোনো? কোথায় যাবি তুই?’

‘আমার বাসায় যাবো।’

হতবিহ্বল পর্তুলিকা ইবনূলের দিকে তাকাল। তার ছেলে এসব বলছে কি? ইবনূলও একনজর তাকালেন পরখের দিকে। আবারও সামনে তাকিয়ে বললেন,

‘বউ নিয়ে ওই মাঠে থাকবে?’

‘আমাকে যেহেতু বিয়ে করেছে, তাই আমি যেখানে থাকব সেও নিশ্চয়ই সেখানেই থাকবে৷ নিতান্তই যদি থাকার ইচ্ছে না থাকে, তবে তোমাদের শখের পুত্রবধূ তোমরা নিয়ে যাও। আমার আপত্তি নেই৷’

নতুন বউয়ের সামনে এসব আলোচনা বিব্রতকর। পিতা-পুত্রের নীরব ও অহেতুক কলহের সমাপ্তি ঘটাতে পর্তুলিকা সমাধা টানলেন।

‘সেসব নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। আগে আমরা বাড়ি ফিরি।’

‘এখানে আলোচনার কিছু নেই৷ আমি নিজের বাসায় ফিরছি এটাই ফাইনাল।’

‘আহ বাবু! সারারাত ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। সকালে উঠে আবার জার্নির উপরেই আছি৷ এখন এসব আলোচনা করতে ভালো লাগছে না। বাসায় যেতে চাস, ঠিক আছে যাবি। কিন্তু এভাবে নয়। মেয়েটা এই সকালবেলা ওখানে গিয়ে কি করবে? সারাদিন তোরা খাবি কি? বাড়ি চল। নাস্তা করে সবাই কিছুক্ষণ রেস্ট নেই। দুপুরে ভালোমন্দ কিছু রান্না করে নিজ হাতে বউকে খাওয়াই। তারপর চলে যাস। তাছাড়া তোর বাইকটাও তো বাড়িতে আছে৷ এখন বাসা যাবি কি করে? ওটা নিতে হবে না?’

প্রত্যুত্তরে পরখ কিছু না বলে সীটে গা এলিয়ে দিল। ওর চোখে মুখে বেদনার নীল ছাপ। কপালে কুঞ্চন রেখা স্পষ্ট। সেই আঁধার মুখের দিকে চেয়ে ইবনূল ইবতেহাজ দ্বিধায় পরে গেলেন। পরখ বরাবর চাপা স্বভাবের। কষ্ট পেলেও প্রকাশ করে না৷ পর্তুলিকা কীভাবে যেন বুঝে নিত। উনি পারতেন না৷ হয়তো বাবা বলেই তিনি সেই প্রতিভা অর্জন করতে পারেননি।
পরখের অভিমান হলে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে কক্ষ বন্দী হত৷ বাবার উপর রাগ, ক্ষোভ, অভিমান সব জমে জমে সুবিশাল পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে অথচ ইবনূল ইবতেহাজ টের পাননি। কারন কষ্ট পেলেও পরখ কখন কাঁদেনি। অভিমান হলে কখনও মুখ গোমড়া করেনি। শুধু নীরবে প্রস্থান করেছে৷

এবারও ছেলের এমন চুপচাপ হয়ে যাওয়া দেখে সন্দেহ হচ্ছে৷ অভিমান হলে ছোট পরখ এভাবেই নীরবতা পালন করত।

নিজের পছন্দের মেয়েটিকে বিয়ে করার আনন্দ ওর চোখে মুখে নেই কেনো? তবে কি নিজের ছেলেকে বুঝতে ইবনূল বরাবরের মতো ভুল করল? বাবা-মায়ের উপর অভিমান করেই কি পরখ বসেছে বিয়ের পিঁড়িতে?

__

প্রধান সড়কের পাশেই প্রাসাদসম শঙ্খরঙ্গা একটি ভবন। লোহার তৈরি বড় মূল ফটক পেরিয়ে গাড়িটি ভেতরে প্রবেশ করে ডানদিকের টানা বারান্দার নিচে থামল। বারান্দার মাঝখানে অন্দরে প্রবেশের দ্বার। অপরপাশে পরখের লাল-কালো রঙের বাইকটি সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে।

পর্তুলিকার মনে ভয় জাগ্রত হল। গাড়ি থেকে নেমে বাইকে উঠে পরখ না আবার প্রস্থান করে। তাই পরখ বের হবার আগেই তিনি গাড়ির দরজা খুলে বের হলেন। পরখ ও আদ্রিকার উদ্দেশ্যে বললেন,

‘দুজনে একসাথে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করবে। ঠিক আছে?’

মাথার ঘোমটা সামলে আদ্রিকা ঘাড় কাত করে সায় জানিয়ে পরখের পাশে এসে দাঁড়াল।

প্রকান্ড হলরুমে সাদা কালো মার্বেল পাথরের টাইলস। একপাশে ডাইনিং স্পেস, অন্যপাশে অনেকগুলো সোফাসেট দ্বারা সজ্জিত ড্রয়িংস্পেস।

আদ্রিকাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে পর্তুলিকা কাজের মেয়েটাকে ডাক দিলেন।

‘এক গ্লাস শরবত নিয়ে এসো।’

কিন্তু শরবতের অপেক্ষায় পরখ রইল না। আদ্রিকার সাথে ভেতরে প্রবেশের পরপরই সে গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিজের রুমে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে পর্তুলিকা ম্লান হেসে আদ্রিকার উদ্দেশ্যে বলল,

‘ওর কথা বাদ দেও। এখনও রেগে আছে মনে হয়। তুমি আরাম করে বসো।’

পাঞ্জাবীর হাত গুটিয়ে সোফায় হাত পা ছড়িয়ে বসে ইবনূল ইবতেহাজ বললেন,

‘তোমার ছেলের রাগের কারনটাই বুঝতে পারছি না, পিউ। পছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ে দিলাম অথচ তার মুখে হাসি নেই। কেনো?’

ঘোমটা সামলে আদ্রিকা সরু চোখে তাকাল শ্বশুর মশাইয়ের দিকে। পছন্দের শব্দটির সাথে উনি ‘অ’ শব্দটি ব্যবহার করতে ভুলে গেছেন। কি করে পারলেন এতো বড় ভুল করতে?
নতুন বউকে এমন ভ্যালভ্যাল করে চেয়ে থাকতে দেখে পর্তুলিকা বললেন,

‘গতকাল থেকে ছেলেটার পেছনে পরে আছো। এবার থাম। ওকে ওর মত থাকতে দেও। নিজের বাবা হয়েও ছেলেটাকে এতোগুলো কথা শুনালে। রাগ হবে না?’

‘শুধু বকা দিয়ে করে হাত গুটিয়ে বসে থাকিনি। তোমার ছেলের ইচ্ছেও পূরণ করেছি। ছেলে অন্যায় করলে বাবা শাসন করবে। আবার ছেলের প্রয়োজন সেই বাবা-ই সবার আগে এগিয়ে যাবে, ঢাল হয়ে দাঁড়াবে। তাই নয় কি, মা?’

শেষের বাক্যটি বলে ইবনূল ইবতেহাজ তাকালেন আদ্রিকার দিকে। আদ্রিকা কি জবাব দিবে ভেবে পাচ্ছে না। সোজা হয়ে বসে ইবনূল ইবতেহাজ সামান্য হাসলেন।

‘তোমাদের কি নিয়ে এতো ঝামেলা চলছে বলো তো? আমরা দুজন না হয় ওকে বকা দিয়েছি বলে রেগে আছে৷ কিন্তু তোমার উপর রেগে আছে কেনো? বিয়ের পুরোটা সময় কোনো উচ্ছ্বাস, উৎকন্ঠা দেখলাম না। এখনও দেখছি না। তোমার সাথেও একবার কথা বলল না। হয়েছে কি তোমাদের মধ্যে?’

ইবনূল ইবতেহাজের কথায় আদ্রিকা এবার প্রকৃত পক্ষে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। ওকে দু হাতের আঙ্গুল খুটতে দেখে পর্তুলিকা স্বামীকে ধমক দিলেন।

‘তুমি যে কী শুরু করলে! ওদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে তোমার গোয়েন্দাগিরি না করলেও চলবে। ছেলের বিয়ে দিয়েছ এখন অন্তত ওকে রেহাই দেও। বিবাহিত ছেলের উপর নজরদারি করে ওকে বিব্রত করো না৷’

‘তুমি বলছ?’

‘হ্যাঁ আমি বলছি। ছেলে এখন বড় হয়েছে৷ নিজের সংসার হয়েছে৷ ওর ভালোমন্দ ও বুঝে নিতে পারবে। ওদের এখন একা ছাড়ো।’

‘বেশ তবে। তোমার যা ইচ্ছে। আমার পূর্ণ মনোযোগ এখন থেকে তোমার। গোয়েন্দাগিরটাও তোমার উপরেই করব।’

‘সেই ভালো। এখন নাস্তার টেবিলে চলো। আদ্রিকা তুমি শরবতটা খেয়ে নেও তো, মা। অর্ধেকটা খাবে কিন্তু।’

নাস্তার টেবিলে পরখকে পাওয়া গেল না। কাজের লোক ডাকতে গিয়েছিল কিন্তু সে আসেনি। আদ্রিকা ও ইবনূলকে নাস্তা শুরু করতে বলে সে নিজেই খাবারের ট্রে নিয়ে পরখের কক্ষে গেলেন। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। পর্তুলিকা ডাক দিলেন,

‘বাবু, দরজা খোল।’

ভেতর থেকে জবাব এলো তখনি। বিরক্তিভরা ক্লান্ত স্বর।

‘খাবো না মা।’

‘নিচে যেতে হবে না। খাবার নিয়ে এসেছি। ট্রে হাতে নিয়ে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না।’

পরখ উঠে এসে দরজা খুলে মায়ের হাত থেকে ট্রে-টি নিল। দরজা বন্ধ করে দেওয়ার আগে পর্তুলিকা কক্ষের ভেতর প্রবেশ করলেন।

‘এখন আর কিছু শোনাতে এসো না, মা। আমি ভীষণ ক্লান্ত।’

পর্তুলিকা ছেলের হাত ধরে বিছানার উপর বসালেন। মাঝখানে ট্রে রেখে নিজে বসলেন অপরপাশে। রুটি ছিড়ে কলিজা ভুনা তুলে নিয়ে পরখের মুখের সামনে ধরলেন। পরখ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখল। পর্তুলিকা স্মিত হেসে বললেন,

‘কি হলো? মুখ খোল।’

পরখ হাত বাড়িয়ে খাবারের টুকরোটা নিজের হাতে নিতে চাইলে পর্তুলিকা বললেন,

‘বাহ রে, বউ এসেছে বলে এখন আর মায়ের হাতে খাওয়া যাবে না।!’

ঝট করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল পরখ। মায়ের বিপরীত দিকে মুখ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,

‘আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। একটু ঘুমাব। তুমি প্লিজ এখন যাও।’

খাবার রেখে দিয়ে পর্তুলিকা উঠে দাঁড়ালেন। হাত টেনে জোর করে ওকে আবার বসালেন বিছানার উপর। নিজে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে ওর মুখটা আঁজলা ভরে ধরে প্রশ্ন করলেন,

‘কি হয়েছে বাবু? এতো রেগে আছিস কেনো?’

পরখ মুখ নিচু করে বলল,

‘রেগে নেই মা। কারো উপর আমার রাগ নেই। আমার সত্যি মাথা ব্যথা করছে।’

‘মায়ের উপর অভিমান হয়েছে? কি হয়েছে বলবি না? আমি তো কখনও জেনে-বুঝে তোকে কষ্ট দিতে চাইনি। কখন, কীভাবে দুঃখ দিয়ে ফেললাম?’

পরখ চুপ করে রইল। পর্তুলিকা জানেন, তার ছেলে অভিমানী। সেই সাথে ভীষণ আবেগী৷ মর্মে মর্মে মরে যাবে তবুও মুখে রা করবে না৷ তিনি মা, তাই প্রতিবার বুঝে নিতেন। কিন্তু এবার কি করে বুঝতে পারলেন না?
পরখের মুখটা আবারও উঁচু করে ধরে কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে রইলেন।

‘আদ্রিকার সাথে তোর কেমন সম্পর্ক? তোর বাবা যা বলেছে, সেসব সত্যি নয়?’

পরখ ম্লান হাসে। মায়ের হাত সরিয়ে দেয় মুখ থেকে। বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলে,

‘এখন এসব প্রশ্ন কেনো করছ? গতকালকে তো একবারও জানতে চাওনি৷ বাবা একটা অভিযোগ নিয়ে এলো, তুমি তাই সত্যি মেনে নিলে৷ একবারও আমার কাছে জানতে চাওনি, ঘটনা সত্যি কিনা? তুমি বিশ্বাস করে নিয়েছ, তোমার ছেলে চরিত্রহীন, ঠকবাজ।’

পর্তুলিকা ওর কাঁধ চেপে ধরে আবারও বসতে বাধ্য করলেন। উনার মুখে আঁধার নেমেছে। ছেলেকে অবিশ্বাসে বেদনা চোখে মুখে। সেখানে বেদনা ছাপিয়ে জন্ম নিচ্ছে দুশ্চিন্তা। তিনি বললেন,

‘আগে বলিসনি কেনো?’

‘বলে কি হত? তুমি জানতে চেয়েছ? একবারও বলেছ, আদ্রিকা মেয়েটির সাথে তোর কি সম্পর্ক? তোর বাবা যা বলছে সেসব সত্যি কিনা? আমি ভাবতাম, দুনিয়ার সকলে আমার বিরুদ্ধে চলে গেলেও আমার মা আমার পাশে থাকবে। কিন্তু তুমি আমাকে ভুল প্রমানিত করে দিলে। বাবার মত তুমিও আমাকে ভরসা করতে পার না।’

‘এমনটা নয় বাবু। তখন সিচুয়েশনটাই এমন ছিল। ছবিগুলো দেখে আমার খুব মন খারাপ হয়েছে৷ রাগ হয়েছ তোর উপর। কিন্তু তুই আমাকে একবার বলতি, এসব সত্যি নয়। তোর কিছু বলার থাকলে আমি কি শুনতাম না?’

‘হ্যাঁ, শুনতে। শুনতেই তো চাইছিলে। আমি কীভাবে এত বড় অপকর্মটি করলাম? এটাই প্রশ্ন করেছিলে তুমি? আমার স্পষ্ট মনে আছে৷ এই প্রশ্ন আমি কখনও ভুলব না, মা।’

পর্তুলিকা হতাশ হয়ে ছেলের পাশে বসলেন। চোখের জল পড়তে লাগল অনবরত। একপাশে বসে অঝোর ধারায় তিনি চোখের জল ফেলছেন। পাশে বসে থাকা পরখের বাম চোখ থেকে অনেক যুদ্ধ করে এক ফোটা জল নিচে নেমে গেল। যা লুকাতে সে মাথা নিচু করে নিল। পর্তুলিকা বিড়বিড় করে বিলাপ করছেন,

‘পরখ, তুই এতোটা চাপা স্বভাবের কেনো, বাবু? অভিমান করে মুখ বুজে থেকে নিজেরই ক্ষতি করে ফেললি। নিজের অধিকারের জন্য লড়তে হয়। এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলে না৷ কারো উপর অভিমান করে নীরব থেকে সব দোষ মাথা পেতে নিলে আমজনতার কিছু সে যায় না। দিনশেষে ক্ষতিটা নিজেরই হয়। তখন যদি জোর গলায় বলতি, এসব মিথ্যে। বিয়েটা তুই করবি না বলে প্রতিবাদ করতি তবে কি এই দিনটা দেখতে হত? নিজের অধিকারের জন্য, নিজের লাভের জন্য, ভালো থাকার জন্য লড়াই করতে হয়। চুপ করে বসে থাকলে কেউ এসে ভালো থাকার মন্ত্রণা দিয়ে যাবে না। নিজেরটা নিজেই বুঝে নিতে হয়। দরকার পরলে লড়াই করে আদায় করে নিতে হয়৷ আর কবে বুঝবি তুই? ইয়া খোদা! এই অভিমানী ছেলেকে নিয়ে আমি কি করবো?’

পর্তুলিকাকে হু হু করে কাঁদতে দেখে পরখ নিজের দুঃখের কথা ভুলে গেল। এজন্য সে নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলে না। বলতে গেলে অপরপক্ষ এমন কষ্ট পায়, কান্না জুড়ে দেয় যে পরখের কষ্টটা ফিকে হয়ে পরে। নিজেকে ভুলে অন্যকে নিতে মাততে হয়।

সে নিজের চোখের জল মুছে মায়ের সামনে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসল। মায়ের হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে বন্দী করে নিয়ে বলল,

‘তুমি কাঁদছ কেনো? তোমার কি হয়েছে?’

‘আমার ছেলেটার জীবনটা আমি নিজে হাতে নষ্ট করে দিলাম। আমি কাঁদব না! ইবনূলের ওই গুপ্তচরের গর্দান নেবো আমি। ছুটাচ্ছি ওই মিনসে-টার গোয়েন্দাগিরি।’

মায়ের চোখের জল মুছে দিয়ে পরখ ম্লান হাসল।

‘থাক বাদ দেও। নিজের বাবা-মা যখন ভরসা করে না। অন্যকে দোষ দিয়ে কি লাভ! দূর থেকে দেখে ওদের যা মনে হয়েছে তাই শুনিয়ে দিয়েছে।’

‘পরখ, মাকে ক্ষমা করে দে বাবু।’

‘কীসব বাচ্চামি শুরু করে দিলে! তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাইছ কেনো?’

‘মা বুঝতে পারেনি, বাবু। আর কখনো এমন হবে না। এবারই শেষ। আমি তোর বাবার সাথে এখনি কথা বলব।’

‘বাদ দেও এসব। যা হবার হয়ে গেছে। এসব নিয়ে আলোচনা করে আমাকে আর বিব্রত করো না।’

‘ইবনূল এতো বড় ভুল করল, আর ওকে কিছু বলব না? এভাবে আমার ছেলেটাকে জোর করে ওই মেয়েটাকে বিয়ে করতে বাধ্য করল। আর আমি কিছু করব না?’

পরখ উঠে দাঁড়াল। খাবারের ট্রে নিয়ে এসে মায়ের সামনে রেখে নিজেও বসে বলল,

‘এখন কি করবে তুমি? বাবা কি করবে? বিয়ের পরে আমাদের কি করার আছে? মেয়েটাকে নিয়ে গিয়ে ওর বাবার বাড়িতে ফেরত দিয়ে আসি? গিয়ে বলি, আমাদের একটা ভুল বুঝাবুঝি কারনে আমরা আপনার কাছে প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলাম। আমাদের এখন ভুল ভেঙ্গে গিয়েছে। তাই আপনার মেয়ে ফেরত দিতে এলাম। নিন, ফেরত নিন আপনার মেয়েকে। ব্যাস, সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?’

‘তাহলে কি করবি তুই?’

‘বিয়ের পরে লোকে যা করে৷ সংসার করবো। আর কিইবা করার আছে।’

‘তোর পছন্দ হয়েছে ওকে?’

‘পছন্দ করার মত হলে পছন্দ হয়ে যাবে। তাছাড়া পছন্দ অপছন্দের আর কিছু তো বাকি নেই৷ তাই না? এসব বাদ দিয়ে তুমি খাবার খাইয়ে দেও।’

বাদ দিতে বললেই কি বাদ দেওয়া যায়? কই পর্তুলিকা যে বাদ দিতে পারছ না৷ সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ছেলের মলিন মুখ, বেদনায় কাতর দৃষ্টি। সেই সাথে চোখের কোণে ভেসে উঠছে আরেকটা মুখ। ছোট একটা শরীর জামদানী শাড়িতে মোড়ানো। হাতে, কানে, গলায় নেই কোনো গয়না৷ নূন্যতম সাজসজ্জা ছাড়াও মুখটিতে স্নিগ্ধতা উপচে পরছে৷ ভয়ে তটস্থ তার চঞ্চল দৃষ্টি। ভীড়ে মাঝে বারবার ছুটে যাচ্ছে মায়ের পানে।
অতল ভাবনায় পর্তুলিকা কোনো কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না।

চলবে….
#অক্ষরময়ী

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

[১০]

ভূবনভোলা বাজার পেরিয়ে একটু সামনে গেলে মস্ত বড় একটা বটগাছ দেখা যায়। প্রকান্ড সেই গাছটির বয়স সত্তর পেরিয়েছে। এই গাছটির কারনে ভূবনভোলার প্রধানসড়কটি দু ভাগে বিভক্ত হয়ে একট পর্তুলিকা ভবনের দিকে চলে গেছে। অন্য সড়কটি চলে গেছে গ্রামের দিকে। যেখানে পরখের বাসা।

প্রকান্ড বটগাছটির অর্ধ পরিক্রমা করে একটি বাইক গ্রামের নির্জন রাস্তাটির দিকে চলে গেল।
বাইকের পেছনে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে আদ্রিকা। নিঃশ্বাস নিতেও ভীষণ ভয় হচ্ছে৷ বিয়ের পর এখন পর্যন্ত পরখের সাথে তার একটি কথাও হয়নি৷ অথচ এই মুহুর্তে তারা দুজন একলা, এতো কাছাকাছি বসে আছে।

সকালে নিজের কক্ষে প্রবেশের পর পরখের সাথে আবার দেখা হয়েছিল দুপুরে খাবার টেবিলে। চুপচাপ খাবার খেয়ে আবারও সে নিজেকে করেছে কক্ষবন্দী৷
অন্যদিকে অযাচিত অতিথির মতো দিন কেটেছে আদ্রিকার। ছেলেকে নাস্তা খাইয়ে উদাস মুখে ডাইনিং টেবিলে ফিরে আসেন পর্তুলিকা। সবাইকে হাসিমুখে মনে হলেও প্রত্যকে একটুখানি খাবার মুখে দিয়েই উঠে পরেছিল।

এরপর আদ্রিকাকে বিশ্রামের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় গেস্টরুমে। পর্তুলিকা নিজেই ওকে নিয়ে যায়।
সুসজ্জিত কক্ষটিতে প্রবেশ করে সহাস্যে জানায়,

‘এমন হুট করে তোমাদের বিয়ে হয়ে গেল! দুজনেই মন হয় ঠিকঠাক মানিয়ে নিতে পারছ না। অস্বস্তি কাটতে একটু সময় তো লাগবে। ছেলেটা সেই যে গিয়ে নিজের রুমে ঢুকেছে! আর বের হচ্ছে না৷ কেমন মুখ গোমড়া করে আছে৷ এখন ওকে বিরক্ত করা যাবে না। মন ভালো হলে নিজেই বেরিয়ে আসবে৷ ততোক্ষণ তুমি গেস্টরুমে বিশ্রাম নেও।’

স্মিত হেসে সম্মতি জানিয়ে আদ্রিকার বিছানায় বসে। সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে পর্তুলিকা প্রশ্ন করে,

‘কিছু মনে করো নি তো?’

আদ্রিকা অবাক হয়। কী মনে করবে সে? অনেকটা সাহস যুগিয়ে ফিসফিসিয়ে জানতে চায়,

‘কি ব্যাপারে?’

‘এই যে শ্বশুরবাড়িতে এসে তোমাকে গেস্টরুমে থাকতে হচ্ছে।’

আদ্রিকার বলতে ইচ্ছে করল, গেস্টরুমে নিয়ে এসে বরং উপকার করেছেন। ওই লোকটার সঙ্গে এক ঘরে থাকতে হলে আমি দম আটকে মরে যেতাম৷ কিন্তু সেসব মনে চেপে রেখে দু দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘একটা রুম হলেই হল।’

ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পর্তুলিকা হাসে।

‘একটা দিনের ব্যাপার। বিকালে ও বাড়ি গিয়ে নিজের মতো করে সব গুছিয়ে নিও। এখন তুমি বিশ্রাম নেও। ওপাশে ওয়াশরুম আছে। ফ্রেশ হয়ে নিও। ম্যানেজারকে পাঠিয়েছি তোমার জন্য কিছু শপিং করে নিয়ে আসতে। তাড়াহুড়ায় তুমিও বাড়ি থেকে কিছু আনতে পারোনি। এদিকে আমরাও কেনাকাটার সুযোগ পেলাম কই!’

পর্তুলিকা ফিরে যাওয়ার পর একলা ঘরে বসে আদ্রিকার হৃদপিণ্ডের গতি ধীর হল না। তখনও ধড়াস ধড়াস শব্দ শোনা যাচ্ছে। লম্বা লম্বা শ্বাস টেনে নিজের অস্থিরতা কমানোর চেষ্টা করেও লাভ হল কিছু হল না। নিস্তব্ধতা যেন তাড়া করছে। বদ্ধ ঘরে শ্বাস রোধ হয়ে আসতে চায়। দক্ষিণদিকে এগিয়ে ঘরের একমাত্র জানালাটি খুলে দিয়ে সতেজ বাতাস টেনে নেয় ফুসফুসে। খাচায় বন্দী পাখি, মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিয়েও খুশি হতে পারছে না। সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়ায় শিকারের ভয়।

হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দ হওয়ায় চমকে গিয়ে এক লাফে জানালা থেকে সরে আসে। ক্ষণপল অতিবাহিত হওয়ার পর মস্তিষ্ক পুনরায় স্থির হয়। আদ্রিকা ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেখে একজন পৌঢ়া দাঁড়িয়ে। এ বাড়ির কাজের মহিলা, সুষমা।
কিছু শপিংব্যাগ হাতে ঘরে প্রবেশ করে সেগুলো বিছানার উপর রেখে জানায়,

‘পর্তুলিকা ম্যাডাম এগুলো আপনার জন্য পাঠিয়ে দিলেন।’

আগমনের কারন দর্শিয়ে উত্তরের অপেক্ষা না করে ভদ্র মহিলা গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন।

কিছু রেডিমেড থ্রিপিস আনা হয়েছে। সেখান থেকে একটা বেছে নিয়ে আদ্রিকা ওয়াশরুমে নিয়ে গোসল সেরে থ্রিপিস পরে নিল।

বিয়ের পর নতুন বউয়ের আচরণ কেমন হওয়া উচিত সেটা কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না৷ পরিণত বয়সের যেকোনো নারী আশেপাশের নারীদের দেখে কিছুটা হলেও আন্দাজ করে নেয়। এছাড়াও সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষের মধ্যে না চাইতেও আচরণে পরিবর্তন চলে আসে। কোনো ভুল যাতে না হয়ে যায়, সে ব্যাপারে মন সতর্ক থাকে৷ একটা ভয় সারাক্ষণ তাড়া করে।

আদ্রিকা নিজেও তটস্থ হয়ে আছে। এভাবে ঘরে বসে থাকা ঠিক হচ্ছে না সেটা বুঝতে পারলেও, এখন তার কি করা উচিত সেটা বুঝতে পারছে না।

ভেজা চুলগুলো খোলা রেখে ওড়না টেনে মাথায় ঘোমটা দিয়ে কক্ষের বাইরে চলে এল। নিচতলার কিচেন থেকে খাবারের ঘ্রাণ আসছে৷ সেখানে কিচেন এপ্রোন পরিহিতা পর্তুলিকা ব্যস্ত হাতে খুন্তি দিয়ে কড়াইয়ে তরকারি নাড়ছেন৷ পেছনে সতর্কভাবে দাঁড়িয়ে আছে সুষমা এবং তার ষোল বছরের নাতনী সন্ধ্যামালতী৷ ভীত পায়ে কিচেনে এগিয়ে আদ্রিকাকে এগিয়ে যেতে সর্বপ্রথম সন্ধ্যামালতী-ই দেখল। স্বভাব স্বরুপ চঞ্চল মেয়েটি হড়বড় করে চিৎকার জুড়ে দিল।

‘ও মা! নতুন বউ আজকেই রান্না ঘরে আসতেছে, কাকী। কী সর্বনাশী কান্ডকারখানা!’

এমন চিৎকারে আদ্রিকা হকচকিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরল। চোখ বড় বড় তাকাল পর্তুলিকার দিকে৷ কিচেনে এসে কি তবে ভুল করল? পর্তুলিকা কি তাকে বকা দিবে?

কিন্তু পর্তুলিকা ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন,

‘কিচেনে এসো না। বিয়ের প্রথমদিনে আসতে নেই।’

সন্ধ্যামালতী তখনও আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে আছে। পর্তুলিকা বললেন,

‘তোকে কতোবার বলেছি, এভাবে চিৎকার করবি না! রান্নাটা হয়ে এসেছে। ঠিক দু মিনিট পর চুলা বন্ধ করে নামিয়ে ফেলবি।’

খুন্তি রেখে এপ্রোন খুলে কিচেন থেকে বেরিয়ে এসে আদ্রিকার হাত ধরে পর্তুলিকা বললেন,

‘তুমি আমার সাথে এসো।’

বিশাল শোবার ঘরের অর্ধেকটা জুড়ে ড্রয়িংস্পেস। একপাশের দেয়ালে বেশ কিছু বই রাখা৷ আরও আছে কয়েক জোড়া সোফা এবং টি টেবিল।

বাকি অর্ধেকটায় একটি বেড, দুপাশে ছোট দুটো বেড টেবিল।
কক্ষের বামদিকের একটা দরজা খুলে ভেতরে চলে গেলেন পর্তুলিকা। সোফায় বসে আদ্রিকা দেখল ওর ঠিক সামনের দিকের খোলা দরজাটি দিয়ে বেলকনি দেখা যাচ্ছে। ওখানে বেশ কিছু গাছে ফুল ফুটেছে। ওর ইচ্ছে করল একবার গিয়ে দেখে আসতে৷ কিন্তু পর্তুলিকা কী মনে করে ভেবে আর যাওয়া হল না।

একটি কাঠের বাক্স হাতে পর্তুলিকা বেরিয়ে এলেন। আদ্রিকার পাশে বসে বললেন,

‘নতুন বউ খালি হাত পা নিয়ে ঘুরছে। দেখতে ভালো লাগে!’

আদ্রিকা নিজের দিকে তাকাল। আসলেই তার গায়ে কোনো গয়না নেই। নিজের বিয়েতে বাবার বাড়ি থেকে কোনো গয়না নিয়ে না আসায় সে ভীষণ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল।

কাঠের বাক্স খুলে পর্তুলিকা কিছু গয়না বের করলেন।

‘এগুলো অনেক পুরনো গয়না। আমি পলিশ করিয়ে এনে রেখেছিলাম। এখন হালকা কিছু পরিয়ে দিচ্ছি। বাকিগুলো তুমি সাথে করে নিয়ে যাবে। বিশেষ বিশেষ অকেশনে পরবে।’

পর্তুলিকার সংগ্রহে বিভিন্ন ধরনের গয়না আছে। আদ্রিকার হাত দুটো টেনে কোলের উপর নিয়ে দুটো পাতলা সোনার চুড়ি বের করে পরিয়ে দিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে চুড়ি দুটো ওর হাতে ঠিকঠাক হয়েছে এবং বেশ সুন্দর লাগছে৷

একে একে কানে ছোট ঝুমকা, গলায় চিকন চেইন, হাতের অনামিকায় একটি আংটি শোভা পেল। ওর থুতনিতে হাত রেখে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে পর্তুলিকা বললেন,

‘নোলককন্যাটা তোমার নাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে৷ এটাই থাক৷ নাকফুল সাথে দিয়ে দিব। পরতে চাইলে পরে বের করে পরে নিও। এখন একদম নতুন বউয়ের মত লাগছে। মাশাআল্লাহ। কারো নজর না লাগুক।’

অজান্তেই ঠোঁটের উপরে হাত দিয়ে নোলকটি ছুঁয়ে দেখল আদ্রিকা। সত্যি কি নোলক পরে ওকে ভালো লাগে? পর্তুলিকার কথা কেনো যেনো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল। শাশুড়ির হাস্যোজ্জ্বল মুখটির দিকে তাকিয়ে আদ্রিকা বিনীত স্বরে বলল,

‘আব্বু হুট করে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে এল! গয়না সাথে নেওয়ার কথা মায়ের মনে ছিল না। আমি বললেই পাঠিয়ে দিবে।’

ওর কথা শুনে পর্তুলিকা ফিক করে হেসে ফেললেন।

‘তোমার বাড়ি থেকে গয়না এনে কি করবে? আমার বাড়ির বউকে গয়না পরানোর ক্ষমতা আমার নেই?’

বাকিটা সময় পুরো বাড়ি ঘুরে ফিরে দেখে আদ্রিকার দিন কেটেছে। এইটুকু সময়ে পর্তুলিকার সাথে আদ্রিকার সম্পর্ক অনেকটা এগিয়ে গেছে। যদিও এর পুরো কৃতিত্ব পর্তুলিকার। উনি নিজেই বেশ আগ্রহ নিয়ে ওর সাথে গল্প করেছে। আদ্রিকা শুধু মনোযোগ দিয়ে উনার কথা শুনেছে।

বিকালবেলা পরখ গেল পর্তুলিকার কাছে। বাসায় ফেরার কথা জানাতেই উনি আবার তোড়জোড় শুরু করে দিলেন। খাবার প্যাকেট করলেন, আদ্রিকার কাপড়, গয়নার ব্যাগ গুছিয়ে দিলেন।

সবটাই নীরবে দেখে গেলেন ইবনূল ইবতেহাজ। শুধু বিদায় বেলায় আদ্রিকায় মাথায় হাত রেখে ম্লান হেসে বললেন,

‘কোনো সমস্যা হলে জানাবে।’

গাড়ি সাথে নেওয়ার প্রস্তাব দিলে পরখ এক কথায় জানিয়ে দিল,

‘লাগবে না।’

কিন্তু পর্তুলিকা ছাড়লেন না। খাবার, কাপড় ও গয়নার ব্যাগ ড্রাইভারের কাছে দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। যা এই মুহুর্তে ওদের বাইকের পিছু পিছু আসছে।

________

প্রধান সড়ক রেখে মাটির রাস্তা ধরে বাইকটি যতোই এগোচ্ছে, আদ্রিকার হৃদপিণ্ডের চলন ততোই দীর্ঘ হচ্ছে৷ শক্ত হাতে বাইকের পেছনের অংশ চেপে ধরে সে নির্জন রাস্তা দেখতে থাকল। ইচ্ছে করছে এক ছুটে পালিয়ে যেতে। এই রাস্তায় দিয়ে সে আরও কয়েকবার যাতায়াত করেছে। সে স্মৃতি নেহাৎ সুখের নয়। কিন্তু এই মুহুর্তে তা নিয়ে দুঃখবিলাস করা অসম্ভব।

মাঝারি আম গাছটির নিচে বাইক দাঁড় করিয়ে পরখ চুপ করে বসে রইল। আদ্রিকা অনেকক্ষণ ভ্যাবলার মতো পরখের পিঠের দিকে চেয়ে থেকে ভাবল,
‘হঠাৎ এই লোকের কি হল? কিছু কি বলতে চায়? তবে বলছে না কেনো!’

তারপর সে নিজেই উত্তর খুঁজে পেল। মুখে না বলে এভাবে চুপচাপ বসে থাকলে সে কীভাবে বুঝবে?

দেরীতে হলেও তবু আদ্রিকা বুঝে নিয়েছে পরখের অভিসন্ধি। বাইক থেকে নেমে একপাশে দাঁড়াতেই পরখ নেমে গেল বাইক থেকে৷ ছোট লোহার গেইটটি খুলে আবার ফিরে এসে বাইক নিয়ে ভেতরে চলে গেল।

বাইরে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল আদ্রিকা। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। তখনি কার থামিয়ে ড্রাইভার বেরিয়ে এল। ব্যাগ দুটো হাতে নিয়ে আদ্রিকার কাছে জানতে চাইল,

‘ম্যাডাম, এগুলো উপরে রেখে দিব?’

ঘরে প্রবেশের বাহানা পেয়ে লম্বা শ্বাস ফেলে ড্রাইভারের সাথে সেও ভেতরের দিকে পা বাড়াল।

এই বাড়ি, এই সিঁড়ি, এই ছাদ, এই দরজা সবটাই আদ্রিকার চেনা। তবুও আজ কেনো অচেনা ঠেকছে? কেনো এতো অস্বস্তি, ভয়, দ্বিধা ঘিরে ধরেছে ওকে?

স্লাইডিং ডোর খোলাই ছিল। যেন আদ্রিকার আগমনের অপেক্ষা করছে৷

ঘরে প্রবেশ করে কাউকে খুঁজে পেল না৷ ড্রাইভারের থেকে খাবার ব্যাগটি নিয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর রাখল৷ কাপড়ের ব্যাগটি স্থান পেল সোফার টেবিলে৷
ড্রাইভার চলে যাওয়ার পর নিস্তব্ধ ঘরে আদ্রিকা একলা বসে রইল৷ পরখের কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

কাল থেকে একের পর এক চাঞ্চল্যকর ঘটনায় মস্তিষ্ক শুধু ছুটছে৷ তারপর বিয়ে দিয়ে তাকে রেখে আসা হল অচেনা, অজানা একটি পরিবেশে৷ সেখানেও তটস্থ মস্তিষ্ক দুদন্ড স্থির হতে পারেনি৷ কিন্তু এই মুহুর্তে এই মলিন সন্ধ্যায় সম্মুখে তিনটে বন্ধ দ্বারের দিকে চেয়ে আদ্রিকার মস্তিষ্ক মৃদু পায়ে হেঁটে যেতে লাগল নিকটতম অতীতে৷

পশ্চাৎ পদচিহ্ন কতো অলিগলি পেরিয়ে উপস্থিত হল এক তপ্ত দুপুরে৷ সদ্য যুবতীর গায়ে লাল জামদানী থ্রিপিস, মুখে লাজুক হাসি। উচ্ছ্বসিত কদমে সিমেন্টের সিঁড়ি বেয়ে সে উপরে উঠছে। সেদিন বদ্ধ কামরায় তার একটুও দমবন্ধ অনুভব হয়নি।

বরং তার চোখে ছিল রঙিন ভবিষ্যতের স্বপ্ন। সম্পর্কের পবিত্রতায় ছেঁয়ে গিয়েছিল মন, মস্তিষ্ক। তারপর উৎফুল্ল মেয়েটি স্বহস্তে সংসার কর্মে লিপ্ত হল। পূর্ব জীবনের সমস্ত ধুলো ময়লা বেলচায় তুলে ডাস্টবিনে ফেলতে যেইনা হাত বাড়িয়েছে তখনি সম্মুখে স্পষ্ট হল আরেকটি অবয়ব৷ যার সূক্ষ্ম দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আদ্রিকা ঝট করে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো৷

অত্যাধিক গতিতে ছুটছে হৃদপিণ্ড। মনে হচ্ছে এখনি বিস্ফোরণ ঘটবে৷ আদ্রিকা অস্থির পায়েচারি করতে করতে বুকের বাম পাশে হৃদপিণ্ডের উপর হাত রেখে বিড়বিড় করছে,
‘এসব কেনো মনে পরছে! ক্ষমা করে দিও খোদা। আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ।’

সে এসব কি ভাবছে! ভাবনারা কেনো গিয়ে কড়া নাড়ছে ফেলে আসা বন্ধ পাতায়? এ যে ভীষণ অন্যায়। চোখ বন্ধ করে আদ্রিকা আজ সকালের ঘটনাটি আবার মনে করার চেষ্টা করল।
ধীরে ধীরে স্পষ্ট হল বিয়ের সম্মতি, স্বাক্ষর, বিদায়৷ আদ্রিকাকে নিজেকে প্রবোধ দিল,

‘এই আমার জীবনের একমাত্র সত্য।’

সবকিছু শান্ত হয়ে এলে সে চোখ খুলল। কিন্তু সম্মুখে পরখের তীক্ষ্ম দৃষ্টি দেখে অদৃশ্য এক ধাক্কা খেয়ে দু কদম পিছিয়ে গেল। টলতে টলত পরেই যাচ্ছিল কিন্তু ভাগ্য ভালো ছিল বলে শেষ মুহুর্তে নিজেকে সামলে নিল।

পরখ একদৃষ্টিতে আরও কয়েকপল তাকিয়ে থেকে মুখটা কুচকে চলে গেল ওয়াশরুমে৷ প্রকান্ড শব্দে দরজা বন্ধ করে ফেলল। বিকট সেই শব্দে আরও একবার কেঁপে উঠল আদ্রিকা।

ওর গলা শুকিয়ে গেছে। পানি খাওয়া জরুরি। ডাইনিং টেবিলের উপর একটি প্লাস্টিকের জগ এবং কাচের গ্লাস দেখা যাচ্ছে। কাছে গিয়ে গ্লাস হাতে নিয়ে দেখল, সেখানে অর্ধেক পানি রয়েছে। হয়ত গতকালের বাসি পানি।

আশেপাশে তাকিয়ে দ্বিধায় নিমজ্জিত আদ্রিকা কিচেনে চলে গেল। বেসিনে গ্লাসটি পরিষ্কার করে পানি পান করে ফিরে এসে দেখল ওয়াশরুমের দরজা হাট করে খুলে রাখা। অন্যদিকে পরখের কক্ষ আবারও দ্বাররুদ্ধ।

আদ্রিকা ফিরে গেল সোফায়। সেখানে বসে থাকতে থাকতে সন্ধ্যা ঘন হল, রাত নামল। আশেপাশে বাতির সুইচ খুঁজে ঘরে আলো জ্বালিয়ে সে আবার ফিরে এল নিজের জায়গায়। কিছুক্ষণ বসে রইল, কোমর লেগে গেলে উঠে দাঁড়াল, পায়েচারি করল, ফের বসল।
সে তার জীবনকালে এমন বিশ্রী, বিরক্তিকর সময় কখনও কাটায়নি। সারাদিনের ভয়, শংকা, দ্বিধা বিলীন হয়ে এখন জাগ্রত হয়েছে বিরক্তি। কোনো স্বাভাবিক মানুষ এভাবে সময় কাটাতে পারে?

একটা অপরিচিত মেয়েকে ডাইনিং-এ এভাবে বসিয়ে রেখে কেউ কি করে ঘরের দরজা বন্ধ করে চুপ করে রয়? এগুলো আদোও ভদ্র লোকের আচরণ?

মনে মনে হাজার গজগজ করলেও বাস্তবে কিছু করার সাহস তার হল না। শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগল।

সামনের দেয়াল ঘড়িতে সময় তখন রাত নয়টা। এই ঘড়িটি না থাকলে আদ্রিকা বোধহয় বিশ্বাস করতে পারত না, বিকাল ছয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় একটি সোফায় বসে কাটিয়ে দেওয়া যায়।

যাই হোক, রাত নয়টায় অতি আকাঙ্খিত পরখ আবারও বাইরে এল। কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা খাবারের ব্যাগ খুলে খাবার বের করে নিজের জন্য পরিবেশন করে খেতে শুরু করল।

আদ্রিকা অবাক হয়ে দেখছে এই মানুষটির কাজকর্ম। এমন ভাব করছে যেনো সে ছাড়া এখানে আর কেউ নেই। এই ঘরে আদ্রিকা বোধ হয় অদৃশ্য এক আত্মা। যার উপস্থিতি সে বুঝতে পারছে না।

এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে আদ্রিকার বেশ সন্দেহ হল। সে আদোও বেঁচে আছে তো?

মায়ের হাতের পোলাও, কোরমা কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে অবশিষ্ট খাবার ফ্রিজে তুলে রেখে প্রশান্ত মুখে পরখ ফিরে যাচ্ছিল নিজের কক্ষে।

এ পর্যায়ে আদ্রিকা নিজের আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে ছুটে এসে ওর সামনে দাঁড়াল। পরখের খুনে দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুষ্কর। তবুও আদ্রিকা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ভীতু স্বরে প্রশ্ন করল,

‘আপনি আবারও আমাকে বাইরে রেখে চলে যাচ্ছেন! আমি এখানে কি করব?’

পরখের গায়ে টি শার্ট এবং ট্রাউজার। সেই ট্রাউজারের পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পরখ বলল,

‘সংসার করতে এসেছ। সংসার করবে।’

এমন তাচ্ছিল্যের কথা শুনে আদ্রিকার সাহস আরও কয়েক দফা নিচের দিকে চলে গেল। মিনমিন করে অনুরোধ করল,

‘রাত অনেক হয়েছে। কোথায় থাকব একটু বলে দিন। অনেকক্ষণ থেকে এখানে বসে আছি।’

পরখ ভীষণ অবাক হল। চোখ দুটো বড় বড় করে বলল,

‘সেকি! বসে ছিলে কেনো? তোমার রুমের দরজা তো খোলাই ছিল।’

আদ্রিকা চোখ তুলে পরখের বিদ্রুপে ভরা চেহারাটি দেখে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পরখের কক্ষের দ্বারের দিকে তাকাল। তা দেখে পরখ বলল,

‘ওদিকে কি দেখছ? ওটা আমার রুম। তোমার রুমের কথা তুমি ভুলে গিয়েছ? এই তো কয়েকদিন আগেই এসে যে রুমে ছিলে; তা এতো তাড়াতাড়ি কি করে ভুলে গেলে! যে রুমে প্রেমিকের সাথে রঙিন দিন কেটেছে তা এতো সহজে ভুলে যাওয়া যায়? অবশ্য তুমি ভুলে যেতেই পার। তোমার পক্ষে সবই সম্ভব। তুমি বরং একটা কাজ করো। ওই যে তোমার স্মৃতিমাখা বাসরঘর, যাও সেখানে গিয়ে প্রথম বাসরের স্মৃতিমন্থন কর।’

আজকের দিনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা বুঝি আদ্রিকা এবার খেল। ছলছল চোখে পরখের দিকে চেয়ে নিজের স্বপক্ষে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু মুখ ফুটে কোনো শব্দ বের হল না।

মাথা থেকে শাড়ির আঁচল সরে গিয়েছিল বলে হাত দিয়ে আবারও ঘোমটা টানার বাহানায় সে চোখ সরিয়ে নিল। তা দেখে প্রতিবাদ করে উঠল পরখ,

‘মাথায় ঘোমটা টেনে নিজের শালীনতাবোধ আমাকে দেখাতে হবে না। তুমি কতোটা সৎ, কতোটা পবিত্র সেটা আমার ভালোই জানা আছে। অন্তত আমার সামনে এসব নাটক করতে এসো না। মাথা থেকে আঁচল সরে যেতেই এতো ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই৷ তুমি তো দিনে দুপুরে গা থেকেও আঁচল সরাতে পারদর্শী। এসব তোমার কাছে সামান্য ব্যাপার মাত্র।’

আদ্রিকার দিকে অপমানের তীব্র বান নিক্ষেপ করে পরখ চলে গেল নিজের ঘরে৷
যে স্মৃতি থেকে আদ্রিকা পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, তারা এসে হা রে রে রে করে ঘিরে ধরল আদ্রিকাকে।

চোখের কোটর থেকে নীরবে জল গড়িয়ে পরতে পরতে এবার প্রচন্ড হেঁচকি উঠতে শুরু করল। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে ক্ষণে ক্ষণে প্রচন্ড কেঁপে উঠছে আদ্রিকার শরীর। মূর্তিমান দাঁড়িয়ে থেকে এভাবে কেঁদে একসময় চোখের জল ফুরিয়ে এলে কষ্টগুলো ফিকে হয়ে এলো। আদ্রিকাও ফিরে যায় নিজের জায়গায়।
সোফায় বসে ঘাড় বাঁকিয়ে কক্ষ তিনটির দিকে চাইল। একটি বন্ধ ভাঁড়ারঘর, আরেকটি পরিত্যক্ত স্মৃতির কক্ষ, অন্যটিতে স্বামী কর্তৃক সে বর্জিত।

আদ্রিকার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে৷ গতরাতে একটুও ঘুম হয়নি। অনবরত কান্নাকাটির ফলে চোখ দুটো ক্লান্ত। সব বাধা বিপত্তিকে তুচ্ছ করে তারা বিশ্রাম চাইছে৷

শাড়ি সামলে পা দুটো উপরে তুলে সে সোফায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পরল। এবার দ্রুত গতিতে এ অভিশপ্ত দিনটির শেষ অংশ; আঁধার রাতটুকু কেটে যাক।

চলবে…
#অক্ষরময়ী