#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|১৫|
উনিশ শতকের শুরুর দিকে জমিদার পুত্রের শখ হলো নৌকা ভ্রমণ করবেন। আদেশ মাত্র জমিদার বাড়ির সম্মুখে বয়ে চলা পদ্মা নদীর বুকে বিশাল এক নৌকা ভাসানো হলো। সামান্য কিছু সৈন্য সামন্তের সাথে রওনা দিলেন জমিদার পুত্র৷ পদ্মার শীতল জলের উপর নৌকার পাটাতনে বসে জমিদার পুত্র খোলা আকাশ দেখেন। পাশেই রান্নার আয়োজন চলে। সময় পেলে জমিদার পুত্র নিজেই নদীর জলে নেমে মাছ ধরার চেষ্টা করেন। যদিও খুব একটা ধরতে পারেন না। কিছুক্ষণ ব্যর্থ চেষ্টা পর নদীতে স্নান সেড়ে তিনি আবার নৌকায় উঠে বসেন। সৈন্য সামন্ত নদী থেকে মাছ তুলে রান্নার আয়োজন করে৷
নদীর দুপাশে ঘন জঙ্গল, কোথাও আবার ধূ ধূ মাঠ। লোকালয় নজরে আসে যৎসামান্য। উদ্দেশ্যহীন বয়ে চলে জমিদার পুত্রের নৌকা। পূর্ণিমা রাতে নৌকার পাটাতনে শুয়ে আকাশ ভরা তারার দিকে উদাস নয়নে চেয়ে দেখে জমিদার পুত্র তার প্রিয় সখাকে বলেন,
‘একটা গান ধরো।’
গানের আসরে রাত বয়ে যায়; জমিদার পুত্রের আঁশ মেটে না। তিনি কীসের আশায়, কীসের খোঁজে, কোথায় চলেছেন নিজেও জানেন না। শুধু জানেন উনাকে ছুটতে হবে। নিজ বাড়িতে তিনি আর প্রশান্তি খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই তো প্রশান্তির খোঁজে এই উদ্দেশ্যহীন যাত্রা।
কথিত আছে, জমিদার পুত্র সেই প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন মনতরীর তীরে৷ উনার নৌকা যখন মনতরীর শুভ্র কাশবনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন আকাশ নীল। থোকায় থোকায় তুলোর মতো মেঘ জমে আছে নীলের বুকে। মনতরীর পতিত জমিতে বেপরোয়া ঘাসের বুকে সাদা কাশবন; রঙ তুলির আঁকা চিত্রকর্ম যেন। নদীর জলে ভেসে উঠা নীল আকাশে সাদা মেঘের প্রতিবিম্ব এবং মনতরীর তীরের কাশবনের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।
জমিদার পুত্র এই পাড়েই নৌকা ভিড়িয়েছিলেন৷ এলোমেলো পায়ে মনতরীর তীরে ঘুরতে ঘুরতে সূর্য অস্ত গেলে এখানেই তাবু ফেলেন। সে রাতে উনার গভীর ঘুম হলো। যা অনেকদিন, অনেক ঔষধ পথ্য সেবনেও সম্ভব হয়নি।
ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে মনতরীর বুকে সূর্যের কোমল প্রতিচ্ছবি উনার চোখে এমন এক ঘোর সৃষ্টি করেছিল যে উনি তখনই সৈন্যদের আদেশ দিলেন,
‘যাও, এই জায়গা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে এসো। কে এখানকার জমিদার? তার কাছে আমার বার্তা নিয়ে যাও। আমি এখানে বসত গড়তে চাই।’
বল্লম হাতে সৈন্যদল ছুটে গেল। সারাদিন অক্লান্ত চেষ্টা করে তারা নিরাশ হয়ে ফিরে এসে জানাল,
‘এ স্থান জনমানবশূন্য। যতদূর চোখ যায় শুধু খোলা মাঠ। কোথাও ঘন জঙ্গল। সারাদিন খুঁজে একটি মানুষের সন্ধান পাইনি।’
সৈন্যের কথায় জমিদার পুত্র বেশ খুশি হলেন। উনার মুখের বিস্তৃত হাসি দেখে প্রিয় সখা অবাক হয়ে শুধাল,
‘এমন পরিস্থিতিতে তুমি হাসছ, ভূবন? জনমানবশূন্য ভূমিতে যেকোনো সময় হিংস্র জন্তু আক্রমণ করতে পারে৷ সৃষ্টিকর্তা সহায় ছিলেন বলে, কালরাতে কোনো বিপদে পরতে হয়নি৷ কিন্তু সব জেনে এখানে আর অবস্থান সম্ভব নয়৷ এখনি প্রস্থানের অনুমতি দেও।’
ভুবনেশ্বর রায় এবার সশব্দে হেসে উঠেন৷ সেই যুবকের নজরকাঁড়া মুখমন্ডলে হাসির উজ্জ্বলতা সূর্যের প্রথম কিরণের মতো মোহনীয়।
উপস্থিত সকলকে অবাক করে দিয়ে ভুবনেশ্বর রায় সেই রাতটি মনতরীর তীরে কাটিয়ে পরের দিন নিজ গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন৷ তারপর কোনো এক রূপকথার মতো বদলে যায় মনতরীর চিত্র৷
জমিদার পুত্র এখানে নিজের সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। লোকবল দ্বারা তৈরি করেন সুবিশাল জমিদার বাড়ি৷ নিজ গ্রাম থেকে প্রয়োজনীয় প্রজা নিয়ে এসে মনতরীর তীরে লোকালয়ের সূচনা করেন৷ ধীরে ধীরে অন্য স্থান থেকেও লোকজন এসে এখানে বসত গড়তে শুরু করল।
নাম না জানা মনতরীর তীরের এই লোকালয়টি ধীরে ধীরে পরিচিতি পেলো ভূবনভোলা নামে৷ বর্তমানে ভূবনভোলার চিত্র দেখে কেউ বিশ্বাসই করবে না, এই ভূমি কখনো জনমানবহীন পরেছিল।
সময়ের প্রয়োজনে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে ভূবনভোলায় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, আশ্রমসহ অনেককিছু গড়ে উঠেছে৷ যার প্রায় সবকিছু জমিদার বাড়ির উদারতার পরিচয় বহন করে৷
ভূবনভোলার সবচেয়ে প্রাচীন স্কুলটির নাম ভূবনভোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়। যা ভুবনেশ্বর রায়ের পুত্র নির্মাণ করেছেন। এরপর কলেজ প্রতিষ্ঠাকালে ভুবনেশ্বর রায়ের কন্যা ভূমতি রায় নিজ অংশের অনেকখানি জমি কলেজ নির্মাণে দান করে দেন৷ পরবর্তীতে যখন সরকার কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের প্রস্তাব উত্থাপিত হয় তখন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য এতোখানি ফাঁকা জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। সকলের অনুরোধ এবং জমিদার বংশের বর্তমান উত্তরাধিকার ভূপতি রায় কলেজের দুই তৃতীয়াংশ স্থান বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য ছেড়ে দেন।
অদ্ভুতভাবে একই সীমানার মধ্যে নির্মাণ করা হলো, ভূবনভোলা সরকারি কলেজ এবং ভূবনভোলা বিশ্ববিদ্যালয়। দুই মিলে লোকমুখে প্রচারিত হয় ভূবনভোলা একাডেমি নামে। পুরনো ঐতিহ্য রক্ষাকারী ভূবনভোলা কলেজের প্রাচীন প্রবেশদ্বারটি ভেঙে ফেলার পক্ষপাতি কেউ ছিল না। তাই তো আজও সগৌরবে সেটি দাঁড়িয়ে পথচারীকে কুর্নিশ জানায়৷
দুপাশের মোটা দুটো খাম্বার মাথায় শুড় উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা হাতির মূর্তির দিকে তাকিয়ে পরখ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সার্টিফিকেট নিয়ে চলে যাওয়ার সময় সে ভেবেছিল আর কখনও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখবে না। অথচ নিয়তের কী অদ্ভুত লীলাখেলা! সকল দ্বার বন্ধ হয়ে গেলেও ভূবনভোলা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার আজও তার জন্য দু হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে৷
ঝাউগাছের দেয়াল পেরিয়ে অপরপাশে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। মুক্তমঞ্চ, ক্রিকেট মাঠ, ফুটবল মাঠ, অডিটোরিয়াম, ডিবেটিং ক্লাব থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অবস্থিত। কলেজ চত্বরের জায়গা খুব বেশি নয়৷ চারকোনে চারটি বড় বড় ভবন এবং মাঝখানে একটি মাঠ৷ এতোটুকুই কলেজের সীমানা।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর সুবিশাল৷ প্রথমেই চোখে পড়ে প্রশাসনিক ভবন।
পার্কিংয়ে বাইক রেখে পরখ চলে গেল নিজের বিভাগীয় ভবনে৷ বিভাগীয় প্রধান পিয়াস লহরী পরখকে দেখে অবাক হলেন। পুরোদম ক্লাস চলছে দেখে তিনি এই সময়টা নিজের অফিসে থাকেন৷ তাই পরখ সহজেই উনার সাথে দেখা করার অনুমতি পেল।
‘পরখ যে! কোথা থেকে এলে?’
পিয়াস লহরী বয়সে চল্লিশোর্ধ্ব পুরুষ। আর দু এক বছর পার হলেই পৌঢ় হিসেবে পরিচিতি পাবেন। অমায়িক ব্যবহার এবং সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রীর কারনে তিনি পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচিত। কুশলাদি বিনিময় পর্ব শেষে পরখ খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে বলল,
‘স্যার, আপনি আমাকে একটি অফার দিয়েছিলেন ফ্যাকাল্টি হিসেবে জয়েন করার। সেটি কি এখনও আছে?’
পিয়াস লহরী খানিকটা স্তম্ভিত হলেন। ডিপার্টমেন্ট ফাস্ট হিসেবে এই প্রস্তাবটি পরখ নিজেই অর্জন করেছে। সার্টিফিকেট নেওয়ার দিন তাকে জানানো হলে সে বিনয়ের সঙ্গে নিজের অপারগতা স্বীকার করে প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়। তবে আজ নিজেই কেনো সে কথা তুলছে?
পিয়াস লহরী দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
‘হ্যা, হ্যা। আমার মনে আছে। এখনও কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি৷ তোমার মতো যোগ্য কাউকে পেলাম কই! কিন্তু তোমার না হায়ার স্টাডিজ এর জন্য সুইজারল্যান্ড যাওয়ার কথা? সেটার কি হল? এডমিশন হয়নি?’
নিজের দূর্ভাগ্যের কথা বলতে পরখের ভীষণ বিরক্ত লাগে। অসফলতা নিয়ে ভাবতে থাকলে কখনও সফলতা লাভ করা সম্ভব নয়৷
অতীতকে পেছনে ফেলে বর্তমানকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সে বিশ্বাসী। শুধু আদ্রিকার ক্ষেত্রেই কেনো যেনো অতীতকে স্মৃতি থেকে মুছতে পারছে না। আবার বর্তমানকে নিয়েও বাঁচতে পারছে না৷ এর দায় অবশ্য পরখ আদ্রিকাকেই দেয়। আদ্রিকা স্বয়ং অতীত হয়ে চোখের সামনে ঘুরাঘুরি করলে পরখ কি করে বিস্ময় এবং আদ্রিকার আবেগঘন দিনের কথা ভুলে যাবে? বাড়িতে আদ্রিকা না থাকলে পরখ কখনোই বিস্ময় এবং আদ্রিকাকে নিয়ে ভাবত না। নিজের জীবনের এক সেকেন্ডও সে অতীতের পেছনে ব্যয় করতে নারাজ।
তবুও নিজ প্রয়োজনে পিয়াস লহরীকে জানাতে হচ্ছে৷
‘এডমিশন হয়েছিল৷ এই সপ্তাহের ফ্লাইট বুকিং পর্যন্ত শেষ। কিন্তু কিছু ফ্যামিলি ইস্যুর কারনে যাওয়া সম্ভব হলো না।’
পিয়াস লহরী কিছুক্ষণ পলকহীন চেয়ে রইলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের কলমটি টেবিলের উপর রেখে বললেন,
‘সুযোগ চোখের সামনে দেখা মাত্রই খপ করে মুঠোবন্দি করে নিতে হয়৷ সময় নিয়ে, ভেবেচিন্তে দেখার অপেক্ষা করলে সুযোগ হাত ফসকে বেরিয়ে যাবে। এই কয়েকটা বছর আমি তোমাকে খুব কাছ থেকে অবজার্ভ করেছি৷ তুমি সকল কাজ অনেক ভেবেচিন্তে করো। তোমার মধ্যে অনেক দ্বিধা। করব কি করব না?
লিসেন মাই বয়, এভাবে ভাবতে গিয়ে তুমি জীবনের অনেক সুযোগ হারিয়ে ফেলবে। আমাদের জীবনে কিছু সিদ্ধান্ত হুটহাট নিতে হয়৷ জিতে গেলে ভালো৷ কিন্তু হেরে গেলেও ক্ষতি নেই। অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী হল৷
কিন্তু তুমি যেভাবে সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাও, এভাবে শুধুই আফসোস মিলবে।
ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে যতোক্ষণে তুমি ভাববে, কোন বগিতে উঠব ততোক্ষণে হুইসেল দিয়ে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করবে। অথচ তুমি সেখানেই দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকবে, ইশ! ট্রেনটা মিস হয়ে গেল। এর থেকে ভালো হত না, যদি যে কোনো একটা বগিতে উঠে পরতে?
অতিরিক্ত ভাবতে গেলে কখনও কখনও শুধু হতাশ হতে হয়৷ আগেপিছে না ভেবে সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে সাহস করে এক কদম ফেলে দেখো, সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব এমনিতেই চলে যাবে৷ তোমার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের বড় অভাব, পরখ। সাহসী হও, আত্মবিশ্বাসী হও। তবেই স্বপ্নকে ছুঁতে পারবে, সফলতা ধরা দিবে৷ দু একটা বাঁধা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে না পারলে সফল হবে কি করে? জীবনে এমন অনেক ইস্যু আসবে৷ কোনটাকে গুরুত্ব দিতে হয়, কোনটাকে এড়িয়ে যেতে হয় সেটা তোমাকে জানতে হবে। কিছু ক্ষতি ফিরে এসেও পূরণ করা যায়৷ কিন্তু তুমি আজকে যে সুযোগটি সামনে দেখেও মুঠোয় ভরে নিতে পারলে না, সেটার ক্ষতিপূরণ কি সম্ভব?’
পরখ জানে, সম্ভব নয়। ভার্সিটিতে মেইল করার পরে এখন পর্যন্ত কোনো উত্তর আসেনি৷ বাধ্য হয়ে সেখানের আশা বাদ দিতে হয়েছে৷ এ কথা সে কাউকে জানায়নি৷ ইবনূল ইবতেহাজ এমন একটি খবরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন। ভার্সিটির ভর্তি বাতিল হওয়া মাত্র তিনি পরখকে নিয়ে গিয়ে উনার অফিসে বসিয়ে দিবেন। পরখ আটকা পরে যাবে বাবার রাজত্বে। যা সে কখনও চায়নি। নিজের পরিচয় তৈরি করে বাবাকে দেখাতে হবে সে কোনো অংশে কম নয়। কারো সাহায্য ছাড়া সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু এ যাত্রায় প্রতি পদে পদে ইবনূল ইবতেহাজ বিশাল বাঁধা হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। এবারে উনার পরিকল্পনা পরখকে পুরোপুরি নিঃশেষ করে দিয়েছে৷ আবার উঠে দাঁড়াতে হলে শুণ্য থেকে শুরু করতে হবে৷ পরখ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
‘এডমিশন ক্যান্সেল হয়নি এখনও। পরের সেমিস্টার থেকে জয়েন করব। প্রায় ছয়মাস যেহেতু দেশেই আছি, ভাবছি বসে না থেকে এখানে জয়েন করি৷ এতে সিভিতে ওয়ার্কিং এক্সপেরিয়েন্স যুক্ত হবে৷ বাইরের দেশে ওয়ার্কিং এক্সপেরিয়েন্স এর অনেক ডিমান্ড। আমার স্কলারশিপ, রিসার্স, আর্নিং সোর্সে এটা অনেক হেল্প করবে।’
পরখের সুদূরপ্রসারী চিন্তায় পিয়াস লহরীর এতোক্ষণের হতাশাযুক্ত চেহারায় হাসি ফিরে এলো৷ নিজ বিভাগের একজন ভালো ছাত্র উপস্থিত জ্ঞান এবং সাহসের অভাবে জীবন যুদ্ধে পিছিয়ে যাচ্ছে এটা তিনি কিছুতেই মানতে পারেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন একাডেমিক কারিকুলাম ছাড়া এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটিসে পরখকে খুব একটা দেখা যায়নি৷ যাবো নাকি যাবো না ভাবতেই ডেডলাইন পার হয়ে যেত। প্রফেসর কিংবা বন্দুরা জোর করে যদি কোথায় নাম লিখিয়েছে তবেই সেখানে পরখকে দেখা যেত। সে নিজে আগ্রহ করে কখন কোথাও যায়নি।
পিয়াস লহরী বিচক্ষণ, চৌকস মানুষ। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের আচার আচরণ সকল দিকেই উনি নজর রাখেন, সাইকোলজি বুঝার চেষ্টা করেন৷ আজ পরখ নিজে থেকে ফ্যাকাল্টি নিযুক্ত হতে এসেছে, অর্থ্যাৎ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক দ্বিধা কাটিয়ে তবেই সে নিজের জন্য কিছু চাওয়ার চেষ্টা করছে৷ একজন যোগ্য শিক্ষক হিসেবে পিয়াস লহরীর উচিত নিজের শিক্ষার্থীকে সাহায্য করা। আজ সফল হলে, ভবিষ্যতে সে আরও নিজের প্রয়োজনে সাহায্য চাইতে উৎসাহি হবে৷ কিন্তু আজ পিয়াস লহরী ওকে ফিরিয়ে দিলে হয়ত এখানেই প্রচেষ্টা থেমে যাবে৷
তিনি হাসি মুখে বললেন,
‘কবে জয়েন করতে চাও?’
‘আপনি বললে আজ, এখনি৷ আমার হাতে এখন অফুরন্ত সময়।’
‘কালকে থেকে এসো। আপাতত প্রথম এবং দ্বিতীয় সেমিস্টারের দুটো ক্লাস নেও৷ ভালো লাগলে পরে আরও বাড়িয়ে দেওয়া হবে৷ বেতন কিন্তু যৎসামান্য। তোমার যোগ্যতার থেকে অনেক কম হয়ে যাবে জানি।’
‘সেটা ব্যাপার না। যে প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছি, সেখানেই শিক্ষকতা করার মতো সম্মানের সাথে অর্থের পরিমাপ সম্ভব নয়।’
________
সকালবেলা পরখ কখন বেড়িয়ে গেছে আদ্রিকা টের পায়নি। ঘুম থেকে উঠে দেখে ঘড়িতে সময় আট বেজে বিশ মিনিট৷ উঠতে গিয়ে টের পেল মেঝেতে শোয়ার কারনে কোমর এবং পিঠে সামান্য ব্যথার সূত্রপাত ঘটেছে। সারাজীবনে যে কষ্টগুলো সে করেনি, বিয়ের পর এখন সেগুলো করতে হচ্ছে। এরজন্য কি লোকে বিয়ে করে? সুখের জীবন ছেড়ে দুঃখের সাগরে ঝাপ দিতে?
একদিন পরিশ্রম করেই শরীর এতো দুর্বল লাগছে! না জানি ঘরের বউরা দিনের পর দিন কীভাবে এতো পরিশ্রম করে! ঘুম ভাবটা কাটিয়ে চেতনা জাগাতে চা পানের বিকল্প নেই। ফ্রিজ থেকে দুধের বোতল বের করে আদ্রিকা দেখল কাচের বোতলে সাদা দুধ দেখতে কী সুন্দর লাগছে! সংসারের মাঝে এতো সুন্দর জিনিসপত্র লুকিয়ে থাকে সে আগে খেয়াল করেনি৷ আজকাল যা দেখছে তাই সুন্দর লাগছে৷ গতকাল বাজারের গিয়ে সবজির দোকানের চিত্র এখনও ভুলতে পারছে না। অথচ তাদের বাড়িতে সারা বছর এসব সবজি চাষ করা হয়। কই? আগে কখনও গাজর, টমেটো এতো সুন্দর লাগেনি৷ তবে আজ কেনো? নিজের সংসার বলে?
আল্লাহর নাম জপতে জপতে গ্যাসের চুলার কালো চাবিটি ভেতরের দিকে চেপে ধরে জোরে একটু ঘুরাতেই ধক করে আগুন জ্বলে উঠল। চমকে ইন্না-লিল্লাহ বলে চিৎকার করে আজও সে দু পা পিছিয়ে গেছে। খেয়াল হতেই আশেপাশে তাকিয়ে দেখল। কেউ দেখে ফেলেনি তো? ভাগ্যিস পরখ বাড়িতে নেই৷ না হলে আজকেও খোঁচা মেরে দুটো কথা শুনিয়ে দিত।
ইউটিউবে চা বানানোর ভিডিও চালু করে আদ্রিকার মাথায় হাত৷ চায়ে এত মশলা দিতে হয় সেটা সে জানত না। মাকে কখনও এত মশলা দিতে দেখেনি৷ আদ্রিকা মনে করে দেখল, চা বানাতে গেলে মা শুধুমাত্র চা-পাতার পটটি র্যাক থেকে নিচে নামাত৷ আর হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে চিনি, লবণ বেশি কম নিয়েও কথা হত৷ ভিডিও এর এতো মশলা বাদ দিয়ে সে লবণ, চিনি, চা-পাতা দিয়েই ভিডিও অনুযায়ী চা বানিয়ে ফেলল। কিন্তু দুধ মিশানোর পর চায়ের রঙ হয়ে গেল ফ্যাকাশে৷
চায়ে লিকার কম হলে নাকি এমন ফ্যাকাশে হয়৷ গুগল যেহেতু বলেছে, ঠিকই হবে৷ আদ্রিকা তার বুদ্ধি কাজে লাগল। নতুন পাতিলে সামান্য পানি দিয়ে তাতে বেশি করে চা-পাতা দিয়ে কড়া লিকারের চা বানাল। তারপর সেই চা ঢেলে দিল নিজের চাপের কাপে। রঙ খুব একটা ভালো না হলেও আগের তুলনায় ভালো হয়েছে৷
খুশিতে নাচতে নাচতে চায়ের পাতিল দুটো বেসিনে রাখতে গিয়ে গরম পাতিল খালি হাতে ছুঁতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলল। ভাগ্যিস উত্তাপ একটু কম ছিল। তবুও ছ্যাঁকা ভালো মতন খেয়েছে।
চা বিস্কুট খেয়ে ঘর গুছিয়ে আজ সে তাড়াতাড়ি দুপুরের রান্নার আয়োজন করতে শুরু করে দিল।
ফ্রিজ থেকে মাছ বের করল। ভাগ্যিস পর্তুলিকা মাছ পরিষ্কার করিয়ে নিয়েছিল। এগুলো পরিষ্কার করতে গেলে আদ্রিকার জীবন বেড়িয়ে যেত৷
বাটিতে মাছ রেখে পেয়াজ, মরিচ কাটল। আলু ভাজির জন্য আলু কেটে মাছের কাছে গিয়ে দেখে মাছ থেকে এখনও বরফ ছাড়েনি৷ তখনি মনে হল, মাছগুলো পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা দরকার ছিল। এখন পানি দিলে বরফ কখন ছাড়ে কে জানে৷
‘বরফ ঠান্ডা। গরম পানি পেলে নিশ্চয়ই তাড়াতাড়ি গলে যাবে। ট্রাই করে দেখি।’
ঝটপট গরম পানি করে নিয়ে মাছের মধ্যে ঢেলে দিল। দ্রুত গলে গেল মাছে জমে থাকা বরফ৷ কিন্তু আদ্রিকা মুখ কুচকে চিন্তিত স্বরে বলল,
‘এই যাহ! মাছের গায়ের রঙ বদলে গেল কেনো? গরম পানি পেয়ে মাছ সেদ্ধ হয়ে যায়নি তো আবার। মা মাছ ভেজে রান্না করে। তোরা সেদ্ধ হয়ে গেলি কেনো? ধুর! নষ্ট হয়ে গেল সব।’
মাছ ভাজতে গিয়ে সে আরেক বিড়ম্বনা। কড়াইয়ে মাছ লেগে যাচ্ছে৷ খুন্তি দিয়ে উল্টাতে গিয়ে কয়েকবার হাতে ছ্যাঁকা খেল। তেল ছিটকে এসে সোজা মুখের উপর পরছে৷ চিৎকার করে লাফাতে লাফাতে মাছ ভাজার সে দৃশ্য বর্ণনা করার মতো নয়। ভাগ্যিস ঘরে কেউ নেই। এ দৃশ্য দর্শনকারী হেসেই খুন হয়ে যেত৷
খুন্তি এবং চামচের সাহায্য মাছ উল্টানো হলো। কিন্তু অর্ধেক মাছ কাঁটা থেকে খুলে আলাদা হয়ে গেছে। মাছ ভাজি প্লেটে রাখার পর তাদের আর মাছ বলে চেনা যাচ্ছে না। কিছু অংশ গুড়ো হয়ে গেছে। প্রত্যেকের কাঁটা দৃশ্যমান। এর থেকে গতকালের মত ঝুরি করে দিলেই ভালো হত। কিন্তু ডিমের ঝুরি দেখে পরখ যেভাবে চোখ উল্টে তাকাল! মাছের ঝুরি দেখে না জানি আবার কি করে!
মাছ ভুনা করার রেসিপি মোটেও কঠিন মনে হল না। পেয়াজ মরিচ এর সাথে মশলা কসিয়ে ভাজা মাছ ছেড়ে দিলেই হয়ে গেল। আজ রান্না শেষে গতকালের মতো ভুল না করে আদ্রিকা নিজেই আগে খেয়ে দেখল। লবণ যাতে কম না হয় তা খেয়াল রাখতে গিয়ে আজকে বেশি হয়ে গেছে। হলুদের গন্ধটাও নাকে লাগছে৷
পর্তুলিকা বলেছে, সব সমস্যার সমাধান ইউটিউব নামক জাদুর অ্যাপে পাওয়া যায়। সেখানে অনুসন্ধান করে পাওয়া গেল, লবণ বেশি হলে আগুনে খুন্তি গরম করে তরকারির মধ্যে ডুবালে লবণ কমে যায়। ভিডিও দেখে আদ্রিকাও একই রকম ভাবে গ্যাসের চুলায় খুন্তি পুড়িয়ে তরকারিতে ডুবাল। গরম খুন্তি তরকারির ঝোলে ডুবান মাত্র ছ্যাঁত করে একটা শব্দ হচ্ছে। বেশ লাগছে শুনতে।
আজকাল আদ্রিকা দরজা লক করে না৷ তবুও স্লাইডিং ডোর খুলতেই যে শব্দ হলো তাতে সে বুঝে গেল, পরখ বাড়ি ফিরেছে৷ চুলার জ্বাল কমিয়ে সে দৌড়ে পরখের কক্ষে গিয়ে হড়বড়িয়ে বলল,
‘শুনুন, একটা হেল্প লাগত।’
গলা থেকে টাই খুলতে গিয়ে আদ্রিকার কথা শুনে পরখ পেছনে তাকাল। আগুনের কাছাকাছি অনেকক্ষণ কাটানোর ফলে আদ্রিকার মুখমণ্ডল কিঞ্চিৎ লাল দেখাচ্ছে। মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। তীক্ষ্ণ নাক এবং ঠোঁটের ঠিক মাঝখানে ছোট গর্তে এক ফোঁটা ঘাম চিক চিক করছে। নোলকের নিচে ঝুলে থাকা ছোট পানপাতাটি সবসময় আদ্রিকার উপরের ঠোঁট ছুঁই ছুঁই থাকে৷ পরখ আগে খেয়াল করেনি৷ এখন চোখে পরা মাত্র মাথায় চিন্তা এলো,
‘ওর অস্বস্তি হয় না?’
পরখকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদ্রিকার কপালে ভাঁজ পরল। ওদিকে তরকারি না আবার পুড়ে যায়৷ সে গলা স্বর উঁচু করে ডাকল,
‘পরখ, শুনছেন?’
পরখের ধ্যান ভাঙ্গল। সেই সাথে নিজের দৃষ্টির মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় ভীষণ বিরক্ত হল। সেসব আদ্রিকাকে বুঝতে না দিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল,
‘চিল্লাচ্ছো কেনো? কি হয়েছে?’
‘টাই খুলবেন না।’
‘কেনো?’
‘একটু বাজারে যেতে হবে।’
‘কালকেই বাজার করা হয়েছে। ঘরে যা আছে তাই রান্না করো।’
‘রান্না আমি করেছি। জরুরি ভিত্তিতে ছোট আলু আনতে হবে।’
গতকাল কি কি বাজার হয়েছে সেসব পরখ দেখেনি৷ তবে বাজারে গেলে যে কেউ প্রথমে আলু কিনে। তাই সে নিশ্চিত পর্তুলিকাও অবশ্যই আলু কিনেছে। টাই খুলে বিছানার উপর রেখে সে সরু চোখে চেয়ে বলল,
‘ঘরে আলু নেই?
‘আছে। কিন্তু ছোট আলু নেই।’
‘কি এমন দরকার যা বড় আলু দিয়ে হবে না। ছোট আলু-ই লাগবে।’
আদ্রিকার হাতে এতো সময় নেই। পরখকে বুঝাতে গেলে অনেক সময় ব্যয় হয়ে যাবে। কিন্তু তার যে কপাল খারাপ। বিয়ে করেছে এক বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ছেলেকে৷ সব বিষয়ে তার খবরদারি চাই।
সে দুই হাত নাচিয়ে হড়বড় করে বলল,
‘ওহো! আমার তরকারি পুড়ে যাবে।’
কথা শেষ করে একছুটে বেরিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে। কথার মাঝখানে কাউকে এভাবে ছুটে চলে যেতে দেখে পরখ অবাক এবং বিরক্ত হল। আজকাল এমনিতেই মেজাজ ঠিক নেই৷ তারপর এই মেয়ের অদ্ভুত কাজ দেখলে মেজাজ আরও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পরে। সেও আদ্রিকার পেছনে কক্ষ থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল। আদ্রিকা তরকারি নেড়ে দিয়ে পরখকে দেখে খুশি হল। আবার তরকারি রেখে পরখের কাছে যেতে হবে না। এতো ছোটাছুটি করে রান্না হয় নাকি!
‘কালকে লবণ কম হওয়ায় আজকে একটু বেশি দিলাম, তাতেই ঝামেলা বেজে গেল। এখন তরকারিতে অতিরিক্ত লবণ হয়ে গেছে। তবে আপনি চিন্তা করবেন না৷ ইউটিউবে আমি লবণ কমানোর সমাধান পেয়ে গেছি। এখন লবণ একদম ঠিকঠাক। কিন্তু আরেকটা সমস্যা রয়ে গেছে৷ তরকারিতে না হলুদটাও বেশি হয়েছে। সেটারও অবশ্য সমাধান আছে। একটা ছোট আলু কেটে তরকারিতে দিলে হলুদ কমে যাবে৷ কিন্তু ঘরে ছোট আলু নেই।’
পরখের ইচ্ছে হলো নিজের মাথাটা দেয়ালে ঠুকে দেয়। কিন্তু নির্বোধের সাথে তর্কে গিয়ে সময় নষ্ট করতে চাইল না। সে ধীর পায়ে রান্নাঘরের ভেতরে প্রবেশ করল।
রান্নাঘরের স্থান সংকীর্ণ। কোনোমতে একজন মানুষ চলাচল করতে পারে। পরখকে জায়গা দিতে গিয়ে আদ্রিকা একপাশে চেপে দাঁড়াল। তবুও পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আদ্রিকার পিঠে পরখের বাহু ছুঁয়ে গেছে। পরখ কিছু অনুভব করতে পেরেছে কিনা আদ্রিকা জানে না। তবে আদ্রিকা নিজের জায়গায় বরফের মতো জমে গেল। একটা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে কোমর থেকে সোজা ঘাড়ে এসে থামল। আদ্রিকা স্পষ্ট টের পাচ্ছে তার ঘাড়ের ছোট ছোট লোমগুলো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পরেছে। সে রান্নার শেলফ দু হাতে চিপে ধরে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইল।
শেলফের নিচে ঝুড়িতে বড় বড় আলু রাখা৷ একটা আলু হাতে নিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে ছু/রি দিয়ে কেটে ছোট একটি টুকরো আলু আদ্রিকার সামনে ধরে বলল,
‘এই নেও ছোট আলু।’
আদ্রিকা তখনও নিজস্ব ঘোরে আবদ্ধ। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে দেখে পরখ নিজেই আলুর টুকরোটি তরকারিতে দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল।
আদ্রিকা বারংবার অতীতে ফিরে যায়। তবে সে স্মৃতি থাকে বিস্ময়কে ঘিরে৷ আজ প্রথম আদ্রিকা ফিরে পেল এমন এক স্মৃতি যেখানে সামনে দাঁড়িয়ে আছে পরখ৷ ওর গাঢ় নিঃশ্বাস আছড়ে পরছে আদ্রিকার মুখে। কাঁপতে থাকা ঠোঁটে পরখের বৃদ্ধাঙ্গুল ঘষে ঘষে লিপস্টিক ছড়িয়ে দিচ্ছে।
দুপাশে মাথা ঝাঁকিয়ে সেসব স্মৃতিকে দূরে ঠেলে আদ্রিকা বর্তমানে ফিরে এল। তরকারি হয়ে গেছে। কড়াই নামিয়ে আলু ভাজি বসিয়ে বেসিনে গিয়ে মুখে পানি দিল। বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। চোখে পানি দেখল পরখ আবার উল্টাপাল্টা কথা শুনিয়ে দিবে। তাই পানি দিয়ে পানি লুকানোর চেষ্টা।
এবার লবণ, হলুদ একটু একটু করে দিল যাতে কোনোটা বেশি না হয়ে যায়৷ যতক্ষণ না ঠিকঠাক হল, দিতেই থাকল। আলু সেদ্ধ হচ্ছে না অথচ নিচে পুড়ে যাচ্ছে। ভিডিওতে মহিলাটি আলুতে পানি দেয়নি৷ ঢাকনা দিয়ে রেখেছে তাতেই আলু সেদ্ধ হয়ে গেল। অথচ আদ্রিকার আলু সেদ্ধ হচ্ছে না। এতো ঝামেলা ভালো লাগছে না ওর। পরখের আগমনে ভালো মনটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে৷ পানির জগ হাতে নিয়ে আলুতে পানি ঢেলে দিলো। কি হবে দেখা যাবে।
আলু সেদ্ধ হলো। কিন্তু ভিডিও এর মতো আলুভাজি লালচে হয়নি। আলুগুলো কেমন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।
‘সেদ্ধ হয়েছে মানে খাওয়া যাবে। তাকিয়ে থাকলেও কিছু করার নেই। কোনো জাদুবলে ওদের আলু ভাজি দেখতে এতো সুন্দর হয় সেটা তো ভিডিওতে বলে দেয়নি৷ এখন আমার কি করার!’
বিরক্ত হয়ে সে ওভাবেই আলু ভাজি নামিয়ে ফেলল। রান্না গুছিয়ে রেখে গোসলে ঢুকতে গিয়ে দেখে পরখ আগেই ওয়াশরুমে ঢুকে বসে আছে৷ ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে সেখানে বসল। পরখ বেরিয়ে আসা মাত্র শুকনো কাপড় নিয়ে সে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে গেল। পরখ ভেবে পায়না, এই মেয়ে সারাক্ষণ এমন ছুটাছুটি করে কেনো? একটু ধীরেসুস্থে হাঁটাচলা করলে কি হয়? ওকে দেখলে মনে হয় ওর ট্রেন ছুটে যাচ্ছে।
ওয়াশরুমে ঢুকে আদ্রিকা আরেকদফা বিরক্ত হলো৷ চার দেয়ালের ভেতর বাতাসে পরখের গায়ের ঘ্রাণ। আদ্রিকার কেমন দম বন্ধ লাগছে। মন মস্তিষ্ক জুড়ে অদ্ভুত উন্মাদনা। কেউ যেনো জোর করে ওর হৃদয়ে পরখকে ঢুকিয়ে দিতে চাইছে৷ কে সে?
আদ্রিকার মনে পরে আদ্রতার কথা। আদ্রতার এক বান্ধবীর বিয়েতে গিয়েছিল ওরা। আদ্রতা আবার বোনকে ছাড়া কোথায় যায় না। মাত্র দু দিনের আলোচনায় বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো আদ্রতার বান্ধবীকে। আদ্রিকা অবাক হয়ে বোনকে ফিসফিসিয়ে বলেছিল,
‘চেনা নেই, জানা নেই হুট করে একটা মানুষের সাথে এক ঘরে থাকতে তোমার বান্ধবীর খারাপ লাগবে না? এমন করে কেউ বিয়ে দেয়! অপরিচিত একটা মানুষের সাথে আমাকে একঘরে করে দিলে আমি দম আটকে ম/রে যাব।’
ওর কথা শুনে আদ্রতা হাসতে হাসতে প্রায় গড়াগড়ি দেয়। মজা করে বলে,
‘তোকে আমরা একদিনের পরিচয়ে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিব। ধর তুই ঘুমাচ্ছিস, আমি হুট করে ঘুম থেকে ডেকে দিয়ে বলব, উঠ ছুড়ি তোর বিয়ে৷ তারপর বিয়ে দিয়ে সোজা ঢুকিয়ে দিব বাসর ঘরে।’
‘এহ! বললেই হল। আমি এভাবে বিয়েই করব না। আগে কয়েকদিন প্রেম করব। চিনব, জানব তারপর বিয়ে। এভাবে বিয়ে দিলে ভয় হয় না বুঝি?’
‘বিয়ে ব্যাপারটা মোটেও ভয়ের নয়। আল্লাহকে সাক্ষী রেখে অপরিচিত একটা মানুষকে কবুল বলার পর সে আর অপরিচিত থাকে না। সেই মুহূর্ত থেকে ওই একটি ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি পরিচিত, সবচেয়ে বেশি কাছের হয়ে উঠে। এটা আমি বানিয়ে বলছি না৷ আল্লাহ নিজে দায়িত্ব নিয়ে সেই ব্যক্তিটির প্রতি তোর হৃদয়ে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিবেন। এজন্যই যুগ যুগ ধরে দুজন অপরিচিত মানুষ বিয়ের পর নির্বিঘ্নে সংসার করে যাচ্ছে৷ একবার বিয়ে হোক, তারপর তুই আমার কথা বুঝবি। কবুল বলার পর দেখবি তোর চোখ দুটো ওই মানুষটিকে খুঁজছে। তোর মন চাইছে ওই মানুষটির পাশাপাশি থাকতে, তার কাঁধে মাথা রেখে একটু কাঁদতে।’
‘সে বিয়ে করে নিয়ে যাচ্ছে বলেই তো আমাকে কাঁদতে হচ্ছে। যে আমার দুঃখের কারন তার কাঁধে মাথা রেখে আমি কাঁদব? কখনো না।’
‘সেসব তোর বিয়ের পর দেখা যাবে। যখন দেখব আমার বোনটা পুরো জামাই পাগল হয়ে গেছে তখন এসব কথার জবাব চাইব৷’
নেহাৎ গায়ের কাপড় ছেড়ে ওড়না জড়িয়েছে। না হলে এক্ষুণি এই বন্দীশালা থেকে সে ছুটে পালাতো। নিজের মনের বাঁধাহীন ছুটে চলা, নিয়ন্ত্রণহীন আচরণে সে ক্লান্ত। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে বসে পরে শীতল জলে ভিজতে শুরু করল।
দরজায় ঠকঠক আওয়াজে আদ্রিকা ঝটপট উঠে দাঁড়িয়ে শাওয়ার বন্ধ করে। ওপাশ থেকে পরখ বলল,
‘সারাদিন ধরে গোসল করার প্ল্যান আছে নাকি?’
এই লোকটা এতো ত্যাড়া কথা কেনো বলে কে জানে? অথচ চেহারা দেখে মনে হয়, উনার থেকে ভদ্র মানুষ এ জগতে খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ পুরুষ মানুষের প্রকৃত আচরণের খবর একমাত্র তার ঘরের বউ ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না। পরখের প্রকৃত চেহারাটি এতোদিনে আদ্রিকা অনেকটাই জেনে গেছে।
ঝটপট গোসল শেষ করে বাইরে এসে দেখল পরখ ডাইনিং টেবিলে বসে ফোনে কিছু একটা দেখছে।
আদ্রিকাকে খাবার নিয়ে আসতে হল না। পরখ নিজেই সব খাবার ডাইনিং টেবিলে নিয়ে এসেছে৷ চাইলে সে খাবার তুলে নিয়ে খাওয়া শুরু করতে পারত। কিন্তু আদ্রিকার জন্য অপেক্ষা করছে দেখে ওর খুব ভালো লাগল। চেয়ারে বসে প্লেটে ভাত তুলতে তুলতে বলল,
‘আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন?’
ফোন পকেটে রেখে পরখ বলল,
‘বলা যায় না, এই খাবার খেয়ে যদি অসুস্থ হয়ে যাই। জ্ঞান হারানোর সময় আশেপাশে কেউ থাকাটা ভালো।’
ভাতের প্লেটে মাছের তরকারি তুলে দিতে গিয়ে আদ্রিকা নিজেই অস্বস্তিতে পরে গেল। চামচ তুলেছে এখন রেখেও দিতে পারছে না। চামচে মাছটি তুলে পরখের প্লেটে রাখা মাত্রই পরখের চোট দুটো গোল গোল হয়ে গেছে।
ওর প্লেটে শোভা পাচ্ছে একটু মাঝারি আকৃতির পুঁটি মাছ। যার মাথাটি অক্ষত থাকলেও দেহের অবস্থা শোচনীয়। মাথার নিচে লম্বা কাঁটা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। মনে হচ্ছে কেউ মাছ খেয়ে কাঁটা রেখে দিয়েছে। আদ্রিকা সেটা বোনপ্লেট থেকে তুলে এনে রেঁধে ফেলেছে।
দু আঙ্গুলে মাছটির লেজের কোনা ধরে তুলে আদ্রিকার সামনে লটকিয়ে পরখ বলল,
‘এটা মাছ ভুনা? খাওয়ার কিছু বাকি আছে এখানে?’
তরকারির বাটিতে চামচ রেখে সেটি পরখের দিকে ঠেলে দিয়ে আদ্রিকা বলল,
‘নিজেই তুলে নিন।’
অনেক খুঁজেও পরখ মাছ পেলো না। সবগুলো মাছের দেহের অংশ ঝোলের মধ্যে সাঁতার কাটছে। মাছের ভুনা না হয়ে এগুলো মাছের ডাল হয়ে গেছে। আলু ভাজিটা যা একটু সেদ্ধ হয়েছে। সেদ্ধের পর সেটাকে যে আবার ভাজতে হয় সেটা বোধহয় রাঁধুনি ভুলে গেছে। তাও ভালো এটাতে লবণ, হলুদ ঠিক আছে। মাছের ডালটা পোড়ার গন্ধের কারনে মুখে দেওয়া যাচ্ছে না। লবণ, হলুদ কমাতে কোন পদ্ধতি অবলম্বন করেছে সেই জানে। পরখের মনে হচ্ছে, এসব খাবার খেলে সে বেশিদিন সুস্থ থাকতে পারবে না। শীঘ্রই রাধুনির একটা ব্যবস্থা করা দরকার।
চলবে…
#অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|১৬|
চঞ্চলা কিশোরীর ভারী অভিমান হয়েছে৷ মুখ গোমড়া করে আছে প্রকৃতি। ম্লান হয়ে আসা রোদ্দুর জানালার গা এলিয়ে কক্ষের ভেতর উঁকি দিচ্ছে৷ জীর্ণশীর্ণ কক্ষের মেঝেতে অবহেলায় পরে আছে একজন যুবতী। ক্লান্ত তার মুখশ্রী। নিঃশ্বাসের তালে উঠানামা করছে বক্ষপিঞ্জর। বাতাসে কান পাতলে তার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়৷ জগৎ সংসারের সমস্ত চিন্তার অপারে পৌঁছে নিশ্চিন্তপুরে তার বাস। নিদ্রাদেবীর কৃপায় বিশ্ব চরাচরের পঙ্কিলতা এই মুহূর্তে তাকে ছুঁতে পারছে না। সে সমস্ত কিছুর উর্ধ্বে শান্তিপুরের কোমল পালংকে নিদ্রারত। সেখানের পরিবেশ এমন মলিন নয়। সেথায় পুষ্পময় প্রকৃতি। বাতাসে বসন্তের নবধারা।
সিমেন্টের মেঝের উপর শক্ত তক্তাপোষ, পুরনো বিছানার চাদর, সুতি ওড়না গায়ে জড়িয়ে ঘুমন্ত আদ্রিকা সামান্য নড়েচড়ে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে গেল। ঘুমের মাঝে সে অনুভব করল, শিয়রে বসে কেউ একজন পাখা বাতাস করছে৷ মৃদু বাতাস গায়ে শিরশির অনুভূতি ছড়ায়। চারপাশে অপরিচিত মিষ্টি সুবাস৷ ঘুমের মাঝে সেই ঘ্রাণ স্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছে৷ আদ্রিকার মুখে খেলা করছে অস্পষ্ট হাসি৷ তার সুখের কলস পরিপূর্ণ।
কেউ একজন ওর পাশে এসে বসল। হয়তো ঝুঁকে আছে ওর মুখের উপর৷ আদ্রিকার মুখে আছড়ে পরছে কারো গাঢ় নিঃশ্বাস। প্রগাঢ় নিঃশ্বাসের নিচে চাপা পরে যাচ্ছে বাতাসের মিষ্টি ঘ্রাণ। আদ্রিকা অনুভব করল একটি হাত আলতো করে ওর উন্মুক্ত কোমর ছুঁলো। চিরচেনা স্পর্শ। আদ্রিকা বিরক্ত হলো না। বরং বিস্তৃত হলো মুখের হাসি৷ সে ভীষণ আরামবোধ করছে৷ ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে সে ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল। বিস্ময় বসে আছে ওর খুব কাছে। মোহনীয় দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে ওরই দিকে৷
মুখে পরিতৃপ্তির হাসি নিয়ে ওরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে৷ আদ্রিকা হাত বাড়িয়ে বিস্ময়ের গাল ছুঁতে চাইল। এই তো আর একটু হলেই ছুঁয়ে ফেলা যাবে বিস্ময়ের রুক্ষ চোয়াল। ঠিক তখনি ঘুম ভেঙে গিয়ে সে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে৷
বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডের অস্বাভাবিক চলাচল। ধুক ধুক শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে৷ জোরালো শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে আদ্রিকা নিজের চারপাশে তাকাল। নাহ, এখানে কেউ নেই৷ পরিত্যক্ত কক্ষের এক কোণে মেঝেতে বিছানা পেতে সে ঘুমিয়ে ছিল। গায়ের ওড়নাটি সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। খোলা জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ক্লান্ত বিকেলের বিদায়ী সূর্য।
কাঠের পাল্লা টেনে জানালা বন্ধ করে দিল। এতোক্ষণ বাতাসে মৃদু ঘ্রাণ ছিল। এখন সেটা আর পাওয়া যাচ্ছে না। স্বপ্নে চিনতে না পারলেও এখন চেনা যাচ্ছে। বাড়ির সামনের আম গাছে নিশ্চয়ই আমের মুকুল এসেছে। তারই ঘ্রাণ ছড়িয়েছে আশেপাশে।
দুপুরের খাওয়ার পর করার মতো কোনো কাজ ছিল না। মোবাইল নিয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল। এই যন্ত্রটির প্রতি আদ্রিকার কখনোই কোনো আগ্রহ ছিল না। বাবার স্বভাব পেয়েছে সে৷ আধুনিক যন্ত্রপাতির থেকে প্রকৃতির কোলে থাকতে বেশি পছন্দ করে৷ কিন্তু এ বাড়িতে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। মোবাইল হাতে নিয়ে সহজেই তলিয়ে গিয়েছিল ঘুমের দেশে৷ তারই ফলাফল, এক বিশ্রী স্বপ্ন। যা কিনা একসময়ের সোনালী অতীত।
আদ্রিকা নিজেই নিজের উপর বিরক্ত হয়। পুরনো স্মৃতি ভুলবার কম চেষ্টা সে করছে না। তবুও কেনো তারা বারবার ফিরে আসতে চায়? নাহ, অলসতায় গা ভাসালে চলবে না। তাকে ব্যস্ত থাকতে হবে। আরও ব্যস্ত।
হাত, মুখ ধুয়ে পরখের কক্ষের দিয়ে তাকাল। এখনও ঘুম থেকে উঠেনি মনে হয়। কীভাবে এতোক্ষণ ঘরবন্দী থাকে সেই জানে। আদ্রিকার তো দম বন্ধ হয়ে আসে।
শীত পেরিয়ে গেলেও বাজারে এখনও শীতের সবজি বিদ্যমান। ছোট একটি বাধাকপি দেখে আদ্রিকা হাতে তুলে নিয়েছিল। সে বরাবর বড় বড় বাধাকপি দেখে এসেছে। এত ছোট বাধাকপি পাওয়া যায় সে জানত না। ওর আগ্রহ দেখে পর্তুলিকা কয়েকটি বাধাকপি কিনে নিয়েছিল। সেখানে থেকে একটি বের করে কুচি কুচি করে কেটে নিল।
ঘুমানোর আগে বাধাকপি দিয়ে পরোটা বানানোর রেসিপি দেখেছিল। সেটাই বিকালের নাস্তা হিসেবে তৈরি করা যায়।
কিন্তু রান্না না জানার আক্ষেপ তাকে প্রতি পদে পদে হেনস্তা করে ছাড়ছে। চিকন করে কাটতে চেয়েছিল কিন্তু সেটা আর হলো কই! একেকটা একেক সাইজের হয়েছে। মনে পাথর চেপে সেগুলোই কাচা মরিচ কুচি এবং লবণ দিয়ে মাখতে শুরু করল। মেখে পানি ঝরানোর কাজটি দেখতে সহজ মনে হলেও এতোক্ষণ ধরে মাখতে মাখতে আদ্রিকার হাতে ব্যথা ধরে গেছে।
ময়দা যোগ করে রুটি জন্য ডো তৈরি করে নিল। পরখের রান্নাঘরে কোনোকিছুরই অভাব নেই; শুধুমাত্র একজন পরিপক্ক রাধুনি ছাড়া। যা একদিন সে হয়ে উঠবে বলেই তার বিশ্বাস। রুটি তৈরির বেলন চাকতিতে রুটি বেলতে গিয়ে আদ্রিকা নিজেই লজ্জা পরে গেল। বাংলাদেশের মানচিত্রের থেকেও বেশি কোণাকৃতির হয়ে গেছে তার রুটি। অথচ আদ্রিকা দেখেছে তার মা রুটি বেলতে গেলে চাকতির উপর রুটি নিজে থেকেই ঘুরতে থাকে।
আদ্রিকা নিজের হাতে রুটিকে এপাশ ওপাশ করে দিয়েও গোল আকার দিতে পারছে না। আপাতত হাতে অঢেল সময়। সে বার কয়েক চেষ্টা করে কিছুটা উন্নতি করল। চারটে রুটি তৈরি করে সেগুলোর পরোটা ভাজতে গেলে পরে গেল আরেক ঝামেলায়। যেই প্লেটের উপর রুটি রেখেছিল তার সাথে রুটি আটকে গেছে। তুলতে গিয়ে রুটির আকারের বাজে অবস্থা।
গাধার মতো সেগুলো আরেক দফায় বেলতে হলো। আদ্রিকার গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু পরখের ঘুম ভেঙে যাবে বলে সে চিন্তা বাদ দিয়ে পরোটা ভাজায় মনোযোগ দিল।
এখন আদ্রিকা চা’টা ভালোই তৈরি করতে পারে। কাপে মেপে পানি দেয়। দু কাপ চায়ে দু চামচ চিনি, দু চামচ চা পাতা। পরিমাপ সে বুঝে গেছে। চা বানিয়ে চুলা বন্ধ করে পরখকে ডাকতে গেল।
দরজা বন্ধ নেই, তবুও সে দরজা থেকেই ডাকল,
‘শুনছেন?’
ঠকঠক শব্দে পরখের ঘুম ভেঙে গেলেও আওয়াজ চিনতে কিছুক্ষণ সময় লাগল। অসময়ে ডাকাডাকিতে সে অভ্যস্ত নয়। বিছানা থেকে উঠে এলোমেলো পায়ে দরজা খুলে দিয়ে বলল,
‘কি হয়েছে?’
পরখের গায়ে ছাই রঙা ট্রাউজার, সাদা হাফ স্লিভের টি শার্ট, মাথার এলোমেলো চুলগুলো কপাল ছেয়ে আছে। ঘুমকাতুরে মুখটিতে ভীড় করেছে রাজ্যের মায়া। প্রথম নজরে আদ্রিকার বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল।
পরখ চেয়ে আছে উত্তরের আশায়। পলকহীন চোখে আদ্রিকাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সরু চোখে তাকিয়ে আবারও বলল,
‘আমার চেহারা দেখার জন্য ডাকছিলে?’
আদ্রিকার গলার ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। পরখের বিরক্তিভরা কথায় সেখানে বর্ষণ হলো। দৃষ্টি নামিয়ে বলল,
‘চা বানিয়েছি। খেতে আসুন।’
উত্তরের অপেক্ষা না করে ডাইনিং টেবিলে ফিরে এসে চায়ের কাপ সাজিয়ে রেখে বিড়বিড় করল,
‘পুরুষ মানুষের চেহারা আসলে সুন্দর হওয়া উচিত নয়। তাদের দেখতে হবে কালো মেঘের মতো। এক পলক তাকিয়েই যেন গুমোট বাতাসে মন ভার হয়ে উঠে। স্নিগ্ধ বাতাস সৃষ্টি হওয়ার কোনো সুযোগ যেন না থাকে।’
অথচ পরখকে দেখতে শরৎ এর আকাশের মতো উজ্জ্বল লাগছিল। একবার তাকালে বারবার তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়৷ অদ্ভুত প্রশান্তিতে ছেয়ে যায় মন-মস্তিষ্ক।
নিজের বেহায়াপনায় আদ্রিকা বেজায় বিরক্ত। পরখ এসে চেয়ারে বসার পর থেকে সে একবারও তার দিকে চেয়ে দেখেনি৷ মাথা নিচু করে পরোটা এগিয়ে দিয়েছে, কাপে চা ঢেলে দিয়েছে।
পরখ ভালোভাবে খাচ্ছে কিন্তু সে খেতে পারল না। এতোক্ষণ কাজেকর্মে থাকায় টের পায়নি। কিন্তু এখন গরম পরোটা ছুঁতেই হাত জ্বলে যাচ্ছে। তখন ইচ্ছেমতো কাচা মরিচ দিয়ে বাধাকপি মাখার ফলে হাত জ্বলছে ভীষণ।
একটু পরোটা মুখে দিয়ে সে চায়ের কাপে চুমুক দিল৷ হাতের জ্বলুনি প্রতিক্ষণে বেড়ে চলছে। সহ্য করতে না পেরে আদ্রিকার চোখের কোণে জল জমলেও সে ভাবলেশহীন বসে রইল। নাস্তা শেষ করে পরখ চলে যাওয়া মাত্র সে ছুটে গেল ঘরে।
মায়ের নাম্বারে কল করে তাকে প্রথমবার পাওয়া গেল না। দ্বিতীয়বার কল রিসিভ করে নীহার বলল,
‘কী রে? এই অসময়ে কল দিলি যে!’
‘তুমি ব্যস্ত ছিলে নাকি?’
‘এই সময় আমার বসে থাকার সুযোগ আছে! রাজ্যের গাছপালা নিয়ে এসেছে তোর বাপ। সেগুলোতে পানি দিতে দিতে আমার কোমর ব্যথা ধরে গেল।’
‘আবার নতুন গাছ এনেছে?’
‘ছাদটা গাছ দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছে। এখন বসেছে কলম কাটতে৷ ফোনের শব্দে ছাদ থেকে দৌড়ে নেমে এলাম। সে আবার একা কোনো কাজ করবে না৷ যেখানেই যাবে, আমাকেও পিছু ছুটতে হবে। তুই কেনো কল দিয়েছিস সেটা তাড়াতাড়ি বলে ফেল৷ কখন যেন আবার চিল্লানো শুরু করে।’
‘মরিচ লেগে হাত জ্বলছে। কিছুতেই কমছে না।’
‘এই হয়েছে নবাবের বেটি। সামান্য মরিচ ছুঁতে পারে না। বাপের বাড়িতে শুয়ে বসে দিন কাটালে শ্বশুবাড়িতে এই হালই হবে। পরের বাড়িতে না জানি আমাকে কতো কথা শোনাচ্ছিস! নিশ্চয়ই বলছে, মা কিছু শিখিয়ে পাঠায়নি। মায়ের কাছে যতোই অলসতা করো, নিজের সংসারে গিয়ে নিজেকেই খাটতে হবে৷ আগেই বলেছিলাম। এখন মজা বুঝ।’
‘খোঁচা না দিয়ে কি করবো সেটা বলো। সুযোগ পেলেই দুটো কথা শুনিয়ে দেও৷ আজও তোমার স্বভাব বদলালো না। বড় মেয়ে ভেগে গিয়ে বেঁচে গেছে, ফেঁসে গেছি আমি।’
‘আদ্রতাকে নিয়ে আমার চিন্তা নাই৷ ও তোর মতো অকর্মা নয়। সেখানেই থাকুক, দু হাতে করে খেতে পারবে। আমার সাথে ঘুরে ও সব শিখে নিয়েছে। তুই অকর্মা রয়ে গেছিস।’
‘আমিও শিখে নিচ্ছি। আমার সংসারের কাজ তুমি এসে তো করে দিচ্ছ না।’
‘সেই তো এখন হাত পা পুড়াতে হচ্ছে৷ আমি যখন বলতাম, এখনি শিখে নে। শ্বশুরবাড়িতে করে খেতে পারবি। তখন মায়ের কথা বিষের মতো লাগত৷ এখন ঠিকই হাত পা পুড়িয়ে রান্নাবান্না করা হচ্ছে৷ জামাইকে কী অখাদ্য-কুখাদ্য রান্না করে খাওয়াচ্ছিস তুই-ই জানিস! ভদ্র লোকের ছেলে না হলে এতোক্ষণে তোকে বাপের বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে যেত।’
‘খুবই ভদ্র লোকের ছেলে। একদম মাথায় তুলে নাচার মতো। এতো আফসোস করার দরকার নেই। তোমাদের জামাইকে আমি বিষ রেধে খাইয়ে মে/রে ফেলতেছি না। আমার সাধ্যের মধ্যে যতোটুকু পারি করে দিচ্ছি৷ তার না পোষালে হোটেলে গিয়ে খাক।’
‘সেই তো মুখে বড় বড় কথা৷ হোটেলেই যদি খাবে তাহলে তোকে বিয়ে করে কেনো নিয়ে গিয়েছে? শোকেসে সাজিয়ে রাখতে?’
‘আমি বউ নাকি কাজের মেয়ে, হ্যা? একটা মানুষ রান্না নাই জানতে পারে। তারজন্য এমন করে বলার কিছু নাই। সবাই সব বিষয়ে এক্সপার্ট হয় না৷’
‘হ্যাঁ। সে তো দেখতেই পাচ্ছি। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে আর কিছু না শিখলেই মুখ চালানো ঠিকই শিখছিস৷ মুখে এখন খৈ ফুটছে। পরের বাড়িতে এমনে মুখ চালাইলে থাপ্পড় খাবি। আগেই বলে দিলাম। পরে যেন আমার কাছে বিচার না আসে৷ তোর বাপ কিন্তু আগেই সাবধান করে দিছে৷’
‘তোমাকে কল দেওয়াই আমার ভুল হইছে৷ তুমি তো এখন আর আমার মা নাই। তুমি মেয়ে জামাইয়ের উকিল হয়ে গেছ। এখন আব্বু তোমাকে ডাকতেছে না?’
‘কথার তালে ভুলেই গেছিলাম। আল্লাহ জানে, একলা কি করতেছে ওখানে। তুই সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে, কাপড় দিয়ে মুছে সরষের তেল দে৷ কিছুক্ষণ পর কমে যাবে৷’
মায়ের কথামতো দু হাতে জবজবে করে তেল দিয়ে আদ্রিকা বসে ভাবছে, সত্যি কি সে এখন অতিরিক্ত কথা বলতে শুরু করেছে? হবে হয়ত। এর দায় অবশ্য পরখের। বিয়ের আগে সে যথেষ্ট ভালো ভদ্র একটা মেয়ে ছিল। সারাদিনে মনে হয় দুটো কথাও বলত না। নিজের মত করে সুখী জীবনযাপন করত। কিন্তু এখন পরখ তাকে এত পরিমাণ বিরক্ত করছে, যে সারাক্ষণ মেজাজ খারাপ হয়ে থাকে।
কিন্তু পরখ তো বেশির ভাগ সময় নিজের কক্ষে থাকে, নিজের মতো করে সময় কাটায়। তাকে বিরক্ত করছে কীভাবে?
আদ্রিকা নিজের মনে উত্তর খুঁজতে থাকল। আসলেই তো, সে বিরক্ত হচ্ছে কেনো? পরখ তার জীবনযাপনে কখনও বাধা প্রদান করেনি, রান্না বাজে হয়েছে বলে অভিযোগ করেনি, ভালো রাধতে হবে বলে জোর দেয়নি। এটা করা যাবে না, এটা করতে হবে – এমন কোনো নিয়ম জারি করেনি। তবে সে বিরক্ত হচ্ছে কেনো?
‘বাড়িতে সে ছাড়াও একটা মানুষ আছে, সেটা দেখেও না দেখার ভান করে থাকাটাও এক প্রকার বিরক্ত করা। আমাকে এড়িয়ে গিয়ে সে প্রতিনিয়ত আমাকে অপমান করছে। আসতে যেতে একবার তো নিজে থেকে কথা বলতে পারে। দুটো মানুষ একসাথে, একই ছাদের নিচে বসবাস করছে। আর কিছু না হোক, বন্ধুসুলভ আচরন তো করাই যায়। সারাক্ষণ এমন দূরছাই করার কি আছে!’
আদ্রিকা যখন আপন মনে ভাবছিল তখনি পরখ বেরিয়ে এল নিজের কক্ষ থেকে। তাকে বাইরের পোশাক পরে বাড়ি থেকে বের হতে দেখে আদ্রিকা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পরে জানতে চাইল,
‘এই রাতের বেলা কোথায় যাচ্ছেন আপনি?’
পরখ বিরক্তিভরা চোখে তাকিয়ে থেকে উত্তর দিল,
‘এখন কি তোমার থেকে পারমিশন নিয়ে বের হতে হবে?’
‘সে কথা আমি কখন বললাম! কোথায় যাচ্ছেন সেটা অন্তত বলে যাওয়া উচিত।’
‘তোমাকে কেনো বলতে হবে? বিয়ে করেছি বলে?’
‘একটা বাড়িতে একসাথে আছি। আপনি কোথায় গেছেন, কখন ফিরবেন সেটা আমার জানা থাকলে ভালো হয়।’
‘এত কিছু তোমার না জানলেও চলবে। রান্না করো, খাও দাও, ঘুমাও। এই নিয়েই সুখে থাকো। আমার উপর খবরদারি করতে এসো না।’
‘দেখুন, আপনার সাথে তর্কে যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। এই রাতের বেলা আমাকে এই ভূতুড়ে বাড়িতে একা রেখে বেড়িয়ে যাচ্ছেন বলেই জানতে চাইলাম।’
‘ভয় নেই। ভূতও তোমার ধারের কাছে আসতে ভয় পাবে।’
‘কোথায় যাচ্ছেন, সেটা বলবেন না?’
‘নাহ। আমি কোথায় যাচ্ছি, কোথা থেকে আসছি সেসব তোমার জানার দরকার নেই।’
‘ফিরবেন কখন সেটা অন্তত বলে যান।’
‘যখন মন চাইবো, ফিরে আসব।’
‘আপনি জানেন, আপনি একটা জঘন্য মানুষ?’
‘আগে জানতাম না, এখন জানলাম। জেনে ভালো লাগল।’
আদ্রিকাকে হতবাক করে দিয়ে পরখ বেরিয়ে গেল। আদ্রিকার আবারও ইচ্ছে করল, কাঠের চেয়ারটি তুলে ওই বদ লোকটার মাথায় বারি মারতে। কিন্তু সে ওটা তুলতে পারবে না। বেশ ভারী। তুলতে পারলে ঠিকই মারত।
______
খাবার টেবিলে সুস্বাদু খাবারগুলো ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে৷ বিরিয়ানি, চিকেন রোস্ট, কাবাব, তেতুলের চাটনীর দিকে তাকিয়ে মুখে লোল জমেছে। তবুও আদ্রিকা চুপচাপ চেয়ারে বসে গালের ভেতরটা দাঁতে পিষছে। সামনের চেয়ারে বসে আছে পরখ। এবেলা পরিবেশনের দায়িত্ব সে নিজেই নিয়েছে। প্যাকেট থেকে খাবার বের করে প্লেটে তুলে আদ্রিকার সামনে দিয়েছে৷ কিন্তু ও খাচ্ছে না দেখে পরখ বলল,
‘এগুলো খেতে ইচ্ছে না করলে ফ্রিজে মাছের ডাল, আলু সেদ্ধ আছে। সেগুলো নিয়ে এসে খেয়ে নেও৷ অবশ্য এসব খাবার তোমার পছন্দ হবে না, এটাই স্বাভাবিক। ভালো জিনিসে তোমার রুচি হয় না৷ অদ্ভুত পছন্দের অধিকারীনি কিনা।’
আদ্রিকার ইচ্ছে হলো, ফ্রিজ থেকে দুপুরের খাবার নিয়ে এসে খেতে বসে। কিন্তু জেদের বসে এমন লোভনীয় খাবারকে এড়িয়ে নিজের হাতের অখাদ্য খাবার খাওয়া মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না৷ সে নিজেকে বুঝালো, ‘সবসময় আত্মসম্মান দিয়ে বিবেচনা করতে নেই৷ মাঝেমধ্যে বুদ্ধি দ্বারা বিবেচনা করে নিজের লাভ-ক্ষতি নির্ধারণ করতে হয়।’
সে চুপচাপ খাবার প্লেট টেনে নিয়ে খেতে শুরু করল।
পরখ বেশি দেরী করেনি৷ ফিরে এসেছিল কিছুক্ষণ পরেই। ওর হাতে খাবারের প্যাকেট দেখে আদ্রিকা নিজের উত্তর পেয়ে গেছে৷ তার হাতের রান্না খেয়ে অতৃপ্ত আত্মা চলে গেছে খাবারের খোঁজে। এই কথাটি জানিয়ে গেলে, কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত কে জানে!
আদ্রিকা কিছু না বলে চুপচাপ নিজের কক্ষে চলে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে ডাইনিং টেবিল থেকে পরখের হাঁক আসে।
‘খেতে এসো।’
প্রথমে আদ্রিকা ভেবেছিল, যাবে না৷ কিন্তু পরখের মত ভাবধরা, অহংকারী মানুষ একবার ডেকেছে এই অনেক৷ বারবার সাধবে, এমন ভাবতে গেলে আদ্রিকার আর এবেলা খাওয়া হবে না৷
সে চুপচাপ এসে খাবার টেবিলে বসেছিল৷
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে রাত বাড়ছে৷ নিজের বিছানায় চুপচাপ বসে আছে আদ্রিকা। বিকালে ঘুমানোর মত ভুল সে আর এ জীবনে করবে না৷ ওবেলা ঘুমিয়ে এখন আর ঘুম আসছে না। পরখ নিশ্চয়ই নিজের কক্ষে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে৷ এদিকে সে অস্থির সময় কাটাচ্ছে।
কথায় আছে, অলস মস্তিষ্কে শয়তানের বাস। সে কথা আদ্রিকা হারে হারে বুঝতে পারছে।
এতোক্ষণ চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে ছিল। স্মৃতির খাতায় হা রে রে রে করে বাতাস লেগে উন্মুক্ত হলো অতীতের পাতা। যেথায় আছে এই বাড়ি, এই ডাইনিং, ড্রয়িং, কিচেন, ছাদ সবই। শুধু কক্ষটি ভিন্ন। নিঝুম দুপুরের সেই স্মৃতি আদ্রিকাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে৷
একটি হাতের ছোঁয়া; যা একদা পবিত্র ছিল। অথচ এখন তার ছোঁয়া অনুভব করে অপবিত্রতায় ছেয়ে যাচ্ছে আদ্রিকার সমস্ত শরীর৷
চোখ বন্ধ করলেই বিস্ময়ের হাসি মুখ সামনে ভাসছে। ঘুমের মাঝে জীবন্ত হয়ে উঠছে তার ছোয়া৷ আদ্রিকার নিজেকে বদ্ধ উন্মাদ মনে হচ্ছে৷ নিজের মনের সাথে লড়াইয়ে কে কবে জিতেছে? কিন্তু আদ্রিকাকে জিততে হবে। নিজের কাছে সে নিজেই প্রতিজ্ঞা করেছিল, বর্তমানকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবে।
প্রতিমুহূর্তে অতীত পিছু তাড়া করছে। তার থেকে মুক্তি পেতে আদ্রিকা ছুটছে প্রাণপণে।
বিছানা ছেড়ে প্রায় ছুটে কক্ষের বাইরে চলে এলো। পাশের কক্ষটি পরখের। তারই সামনে দাঁড়িয়ে উন্মাদিনী অনবরত বারি দিল বন্ধ দরজায়৷
দরজা খুলে বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে চাইল পরখ৷ সে শান্তিপ্রিয় মানুষ। এমন অনবরত শব্দে সে বেজায় বিরক্ত৷ ঝাঝালো কণ্ঠে জানতে চাইল,
‘কি হয়েছে? ঘরে ডাকাত পরেছে?’
আদ্রিকা উত্তর দিল না। পরখকে এড়িয়ে এক হাতে দরজা ঠেলে আরেকটু ফাঁকা জায়গা তৈরি করে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে গেল।
টেবিলের উপর ল্যাম্প জ্বলছে। বইপত্র খোলা। পরখ ঘুমায়নি। পড়াশোনা করছিল। আদ্রিকা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন।
ওকে এমন হুড়মুড় করে প্রবেশ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পরখ অবাক হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে দু হাত বুকে ভাঁজ করে রেখে ওর দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল,
‘কি চাই?’
আদ্রিকা নিজস্ব ঘোর থেকে মুক্ত হয়ে সন্দিহান কণ্ঠে জানতে চাইল,
‘হুম?’
‘এতো রাতে এখানে কি চাই?’
‘ওহ, আসলে আমার ঘুম আসছিল না। বিকালে অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম।’
‘তো আমার কাছে কি? ঘুম পাড়িয়ে দিব তোমাকে?’
‘আপনি সবসময় আমার সাথে এভাবে কথা বলেন কেনো? একা বোর হচ্ছিলাম বলে আপনার রুমে এলাম।’
‘তোমার সাথে অকারণ আড্ডা দেওয়ার মতো সময় এবং ইচ্ছে কোনটাই আমার নেই। অনেক কাজ আছে আমার। বিরক্ত না করে নিজের রুমে যাও।’
‘আপনি করুন আপনার কাজ। আমি আপনাকে মোটেও বিরক্ত করছি না।’
আশেপাশে তাকিয়ে সে বীনব্যাগটি দেখতে পেল৷ সেটাতে ধুপ করে বসে পরে বলল,
‘এখানে চুপচাপ বসে আছি। একটুও বিরক্ত করব না।’
পরখ কিছু না বলে রক্তিম চোখে চেয়ে রইল। যা দেখে আদ্রিকা শুকনো ঢোক গিলে মুখটা আরও করুণ করে অনুরোধ করল,
‘ঘুম এলেই চলে যাব। সত্যি বলছি, একদম চুপচাপ বসে থাকব এখানে। একটুও কথা বলব না।’
পরখ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আগামীকাল ভার্সিটিতে প্রথম ক্লাস নিবে। ডিপার্টমেন্ট থেকে কোর্স এর ডিটেইলস মেইল করে দিয়েছে। সেগুলোই দেখছিল। এখন আগামীকালের জন্য লেকচার তৈরি করতে হবে। এর মাঝে কোথা থেকে এই আপদ এসে জুটল কে জানে! এমন ভাবে এসে বসেছে, দেখেই বুঝা যাচ্ছে সহজে বিদায় করা যাবে না।
পরখ নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। একটা কথা বললেই সে ওকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিবে৷
রিডিং গ্লাস চোখে দিয়ে সে ডুব দিল পড়াশোনার মাঝে। এই একটি কাজে সে বিশেষ আনন্দ পায়। বইয়ের পাতায় ডুব দিলে ভুলে যায় জীবনের সকল দুঃখ, সকল অপূর্ণতা, সকল হতাশা৷
আদ্রিকা বসে আছে পরখের পেছনে ঠিক বামপাশে। এখান থেকে পরখের একপাশ দেখা যাচ্ছে। খোলা জানালা দিলে শো শো করে বাতাস প্রবেশ করছে কক্ষের ভেতর। মৃদু হাওয়ায় পরখের কপালের উপর ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো দুলছে। চোখের রিডিংগ্লাসের উপর আলো পরায় নীলচে আলো প্রতিবিম্বিত হয়ে তীক্ষ্ম নাকের ডগায় পরেছে। সেদিকে পরখের মনোযোগ নেই। সে সাদা পাতায় খসখস করে কিছু একটা লিখে চলেছে। কখনো সামনে থাকা বইয়ের পাতা দেখছে, আবার কখনো পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে সাদা খাতার উপর কলম চালাচ্ছে।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মনের খাতায় সেই দৃশ্যের ছবি এঁকে নিচ্ছে আদ্রিকা৷ এর মাঝে কতোটুকু সময় গড়িয়েছে কারো খেয়াল নেই।
পরখের কাজ শেষ হওয়ায় সে টেবিল গুছিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠল। আড়মোড়া ভেঙে পেছনে তাকিয়ে চমকে উঠল। বীনব্যাগে গুটিশুটি হয়ে ঘুমাচ্ছে আদ্রিকা। ওর কথা পরখ ভুলেই গিয়েছিল।
টেবিল ঘড়িতে সময় দেখে নিল, রাত বারোটা। এখন না ঘুমালে সকালে ভার্সিটি যেতে দেরী হয়ে যাবে। চাকরীর প্রথমদিনে সে দেরীতে পৌঁছাতে চায় না। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে আদ্রিকাকে ডাকল,
‘আদ্রিকা, শুনছ? নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমাও।’
আদ্রিকা সেসব কথা শুনল না। সে নিজের ঘুমে ব্যস্ত। পরখ হাত বাড়াল। গালে হাত রাখার আগে মনে হল, ঘুমন্ত অবস্থায় ওকে ছুঁয়ে দেওয়াটা অন্যায় হবে। অনুমতিহীন নারী দেহ ছুঁয়ে দিতে সে নারাজ। হোক সে নিজের বিবাহিত স্ত্রী। সে হাত গুটিয়ে নিল। অদ্ভুত টানাপোড়েনের মাঝে বিছানায় গিয়ে বসে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ঘুমন্ত আদ্রিকার দিকে। একপাশে কাঁধ বাঁকিয়ে ঘুমানোর কারনে ওর নাকের নোকলটি একপাশে বেঁকে গেছে৷
পরখ দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ওর দিকে তাকানো মাত্র ওই নোলকটি ওকে বিশেষ আকর্ষণ করে। পরখের হাত শিরশির করে সেটি ছোঁয়ার বাসনায়।
কক্ষের আলো জ্বালিয়ে রেখেই পরখ শুয়ে পরল। যাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে আদ্রিকাকে ভীতিকর পরিস্থিতিতে পরতে না হয়।
আদ্রিকার ঘুম ভাঙল নিশীরাতে। একপাশে কাধ হয়ে ঘুমানোর কারনে ঘাড় ব্যথা করছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখে নিল। ক’টা বাজে কে জানে! খোলা জানালা দিয়ে এখনও রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখা যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে আদ্রিকা শিউরে উঠল। পাশের বিছানায় পরখ ঘুমাচ্ছে।
পাতলা চাদর গায়ে দিয়ে গুটিশুটি হয়ে বিছানার ঠিক মাঝখানে শুয়ে আছে।
ওর পায়ের দিকে অনেকখানি জায়গা ফাঁকা। আদ্রিকা বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে পরখের পায়ের দিকের সেই ফাঁকা অংশে প্রস্থ বরাবর শুয়ে পরল।
সময়টা বসন্তকাল। প্রকৃতিতে শীতের আমেজ একটুও নেই। তবুও নিজের গায়ের ওড়নাটা খুলে গায়ের উপর ছড়িয়ে দিয়ে বালিশ বিহীন ঘুমের দেশে পাড়ি জমাল।
পরদিন খুব ভোরে সকালের আবছা আলোর ছটা পরখের চোখে উপর পরা মাত্রই ওর ঘুম হালকা হয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে মোবাইলটি টেনে নিয়ে দেখল ছয়টা বাজতে চলেছে। আরও আধাঘন্টা ঘুমানোই যায়। মোবাইলটিকে নিজের জায়গায় রেখে ঘুমকাতুর চোখ জোড়া বন্ধ করেছে মাত্র; তখনই মস্তিষ্কে বার্তা পাঠাল স্নায়ুতন্ত্র।
দুম করে বালিশ ছেড়ে পিঠ সোজা করে উঠে বসল৷ ওর পা দুটো তখনও সামনের দিকে ছড়ানো। অবাক হয়ে দেখল ওর পা দুটো দু হাতে জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে আদ্রিকা। পায়ের তালু ঠেকেছে আদ্রিকার বুকে। বৃদ্ধাঙ্গুল দুটোয় আদ্রিকার থুতনির স্পর্শ অনুভব করা মাত্র সারা গা শিরশির করে উঠল।
ইচ্ছে করছে এক্ষুণি একটানে পা দুটো সরিয়ে নিতে৷ কিন্তু একজন ঘুমন্ত মানুষের সাথে এমন আচরণে সে মানসিক আঘাত পাবে সেইটুকু বুঝার সক্ষমতা পরখের আছে। আকস্মিক আক্রমণে ভয় পেয়ে হকচকিয়ে উঠে আবার কোন কান্ড বাধায় কে জানে!
পরখ কোমর ঝুকে দু হাত দ্বারা আলতো করে আদ্রিকার হাত দুটো ধরল। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে ওর নিজেরই হাত কাঁপছে। কম্পনরত হাত দ্বারা আদ্রিকার হাতের বাঁধন থেকে নিজের পা দুটো মুক্ত করা মাত্র সে বিছানা ছেড়ে হুড়মুড় করে নেমে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।
বন্ধ দরজার কাঠের পাল্লায় সামান্য শব্দ হয়েছে বটে। তবে তার আওয়াজে আদ্রিকার ঘুম ভাঙল না। সে নিজের কোলবালিশসম আশ্রয়টি হারিয়ে ভারি বিরক্ত হলো। ঠোঁট উল্টে দু হাত ছড়িয়ে দিয়ে আবার তলিয়ে গেল ঘুমের দেশে।
চলবে…
#অক্ষরময়ী