#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|১৭|
আজকাল দিন কাটে শূন্যতায় ভর করে। যদিও একলা বাড়িতে আদ্রিকার দিন কাটতে চায় না৷ হাতের কাজগুলো শেষ করে রোজ খোলা ছাদে হাত দুটো পেছনে মুড়ে হেঁটে হেঁটে আকাশে মেঘের খেলা দেখে৷ আজকাল পরখকে খুব একটা ঘরে দেখা যায় না। আদ্রিকা ঘুম থেকে উঠে দেখে পরখ বেরিয়ে গেছে৷ ফিরে আসতে আসতে দুপুর দু’টো বেজে যায়৷ খাওয়ার পর রেস্ট নিয়ে আবার বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে সন্ধ্যায়৷ একলা একাকী ঘরবন্দী আদ্রিকার এখানে কি করার আছে? ছাদময় পায়েচারি করতে করতে সে ভাবছে, কীভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখা যায়?
চোখের সামনে ধূ ধূ মাঠ। বসন্তের প্রেমময় বাতাসে চারদিকে সবুজ ঘাস লাবণ্য ছড়াচ্ছে। বাড়ির সামনের আম গাছটায় এই কয়েকদিনেই মুকুল থেকে আমের গুটি হয়েছে৷ এখন আর ফুলের ঘ্রাণ আসে না। সময়ের সাথে প্রতিটি বস্তু নিজের রুপ বদলায়৷ ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায় নজরকাড়া সৌন্দর্য। দর্শনকারী আগ্রহ হারায় কিংবা অভ্যস্ত হয়ে যায়৷
আদ্রিকাও এই বাড়িতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ঘরের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি বস্তু চেনা হয়ে যাওয়ার পর আগ্রহটা হারিয়ে গেছে৷ তাই বোধহয় সময় কাটতে চায় না। আদ্রিকার মন একটা বাহানা খুঁজে, চোখ দুটো কিছু একটাতে আটকাতে চায়। কিন্তু সেটা কি?
ছাদ থেকে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে প্রতিটি বস্তু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকল৷ এই চেয়ার, টেবিল, জানালার পর্দা, সিমেন্টের মেঝে থেকে শুরু করে খসে যাওয়া সিলিং – সবকিছুই আদ্রিকার মুখস্ত৷ আর বাকি আছে কি?
হেঁটে হেঁটে পুরো বাড়ি ঘুরে সে আটকায় রান্নাঘরে৷ যেখানে সে কখনো যেত না৷ শখ করেও কখনো চুলায় হাঁড়ি না বসানো মেয়েটি এই সংকীর্ণ রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকলে ভুলে যায় সমস্ত দুঃখ, বেদনা। সময়ের চাকা কোনদিক দিয়ে ঘুরে ফিরে অস্ত যায়, সে টেরই পায় না৷ একাকীত্ব দূর করার এর থেকে সহজ, সুগম পথ আর কি হতে পারে?
অভিশপ্ত জীবনে নতুন মনুষ্যসঙ্গী খুঁজে গায়ে অপবাদ মাখার থেকে ঘরকন্নায় নিজেকে ব্যস্ত রাখা হাজারগুনে ভালো৷
আজকাল আদ্রিকার বেশিরভাগ সময় কাটে ইউটিউবে রান্নার ভিডিও দেখে৷ দিনের অর্ধেক সময় ব্যয় করে সেইসব রেসিপি দেখে রান্না করে। প্রথমবারে সেগুলো মুখের দেওয়ার অযোগ্য হয়। আদ্রিকা হার মানে না৷ স্বল্প পরিমাণ উপাদান ব্যবহার করে একটুখানি রান্না। সেটা নষ্ট হয়ে গেলে আবারও কোমর বেধে রান্নায় লেগে পরে৷ যতক্ষণ না ঠিকঠাক হচ্ছে রাঁধতেই থাকে। হিসাব ছাড়া সময় এবং গাদি গাদি বাজার-সদাই অপচয় করার পর শেষ পাতে যখন সুস্বাদু খাবারটি মুখে দেয়, তখন যে তৃপ্তি পায় সেটার সাথে কোনোকিছুর তুলনা হয় না৷ অপার্থিব সেই আনন্দের নেশায় আদ্রিকা ছুটে চলে নিরন্তর।
ম্লান আলো কোথাও হারিয়ে গিয়ে ঘন আঁধারে প্রকৃতি ঢেকে গেছে৷ কয়েকটি কাক কা কা স্বরে চিৎকার করে বাড়িটির উপর দিয়ে চলে গেল। আজকের মতো পড়াশোনার পাটচুকিয়ে লাইব্রেরি থেকে ক্লান্ত পরখ বাড়ি ফিরল। বাইকটি গ্যারেজে রেখে শুকনো ঠোঁট জোড়া জিহ্বার সাহায্যে ভিজিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল। ছাদের বাতিটি বন্ধ থাকায় অন্ধকার জাল বিছিয়ে রেখেছে৷ পরখের জীবনটাও এমন আঁধারে ঢাকা। সেখানে আলো জ্বালানোর কেউ নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেয়ালে অবস্থিত সুইচবোর্ডের সুইচ টিপে বাতি জ্বালিয়ে দিল। ছাদের রশিতে শুকনো কাপড় ঝুলছে৷ সন্ধ্যের স্যাঁতসেতে আবহাওয়ায় সেগুলো নেতিয়ে পরেছে। মনোক্ষুণ্ণ হলেও পরখ কিছু বললো না। কাপড়গুলো তুলে নিয়ে ভেতরে চলে গেল।
পরখ ফিরে আসার সময় হয়েছে দেখে তাড়াহুড়ো করে কাজ গুছাচ্ছে আদ্রিকা৷ আজকে সে নতুন রেসিপি শিখেছে। সেটার যোগাড় করতে বেশ দেরী হয়ে গেছে৷
পরখের জন্য পাকোড়া বানাচ্ছে৷ কড়াইয়ে তেল গরম করতে দিয়ে পাকোড়ার মিশ্রণ হাতে তুলে তেলে ছাড়তে যাচ্ছিল তখনি খট শব্দ হলো৷ স্লাইডিং ডোর সরিয়ে প্রবেশ করল পরখ৷ রান্নাঘর থেকে একপলক চেয়ে দেখে আদ্রিকার তাড়াহুড়ো আরও বেড়ে গেল। তেলে পাকোড়া ছেড়ে দিতেই গরম তেল ছিটকে এসে হাতে পরল৷ আর্তনাদ করে উঠল আদ্রিকা৷ তালুর উল্টোপিঠে তৎক্ষণাৎ কয়েকটি লাল ক্ষতের সৃষ্টি হলো।
ওর চিৎকার শুনে পরখের পা থমকাল। ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়ে দেখল আদ্রিকা দিকে। নিজেকে সামলে আদ্রিকাও চাইল পরখের দিকে৷ অবচেতন মন হয়তো ভেবেছিল পরখ এগিয়ে আসবে৷ কিন্তু সে এলো না। হাতের কাপড়গুলো সোফার উপর রেখে গটগট করে নিজের কক্ষে চলে গেল।
সেই দৃশ্য দেখে আদ্রিকার চোখ ভরে এলো জলে। পরখের প্রতি অভিমানের পাহাড় এতোটাই ভারী হলো যে তার নিচে চাপা পরে গেল নিজের প্রতি যত্নশীলতা৷ হাতের পোড়া যন্ত্রণা নিয়ে পাকোড়া ভাজতে থাকল।
ক্ষতে না পানি দিল, না ঘষল বরফ। ঔষধপত্র সবকিছুর প্রতি উদাসীনতা দেখিয়ে নিজেরই ক্ষতি করল।
পাকোড়া ভাজা শেষ। চাইলেই সেগুলো পরখের পড়ার টেবিলে পৌঁছে দেওয়া যায়৷ কিন্তু আদ্রিকার মন খারাপ এপর্যায়ে পৌঁছে রাগে পরিণত হয়েছে।
নিজের নতুন রেসিপিটি পরখের উপর প্রয়োগ করার এক পৈশাচিক আগ্রহ জন্মেছে৷ সে করলার বাটিটি হাতে নিয়ে ভাবতে লাগল। করলাগুলো লম্বালম্বি ভাবে পাতলা করে কে টে রেখেছিল। এখন তাতে পিয়াজ বাটা, রসুন বাটা, আদা বাটা এবং জিরা বাটা দিল। সামান্য গুড়া মরিচ, হলুদ গুড়া দিয়ে করলাগুলো মাখিয়ে নিল। আরেকটি বাটিতে একটু কনফ্লাউয়ার গুলিয়ে নিয়ে মাখানো করলাগুলো তাতে দিল। কড়াইয়ের গরম তেলে সেগুলো ভালো করে ডুবো তেলে ভেজে নিল। পাকোড়ার বাটিটি সরিয়ে রেখে করলার চপ এবং এক কাপ চা নিয়ে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে পরখের কক্ষে গেল।
ফ্রেশ হয়ে এসে পড়ার টেবিলে বসেছিল পরখ। আদ্রিকাকে দেখে ঘাড় ফিরে তাকাল। আদ্রিকা যখন টেবিলের উপর প্লেট এবং চায়ের কাপ রাখল তখন পরখের দৃষ্টি ছিল ওর হাতের দিকে। ফর্সা ত্বকে লালচে ক্ষতগুলো স্পষ্ট। সেগুলো ধীরে ধীরে কালচে রঙ ধারণ করবে এবং তাতে ফোস্কা পরবে৷ পরখ অবাক হলো ওর খামখেয়ালিপনা দেখে।
খাবার রেখে আদ্রিকা চুপচাপ চলেই যাচ্ছিল। হঠাৎ পিছু ডাকল পরখ।
‘এটা নিয়ে যাও।’
বইয়ের দিকে তাকিয়ে পরখের স্বাভাবিক কণ্ঠের আদেশ শুনে আদ্রিকা কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। ভেবেছিল পরখ হয়ত একবার মুখ তুলে তাকাবে৷ কিন্তু তেমন কিছু দেখতে না পেয়ে নিজেই এগিয়ে গেল। চায়ের কাপের কাছে বার্নার জেলটি দেখে পরখের পিছু ডাকের কারন বুঝে গেল।
ঠোঁট চিপে সামান্য হেসে আদ্রিকা তুলে নিল জেলটি। রান্নাঘরে ফিরে এসে যত্ন করে ক্ষতে জেল লাগাল। পাকোড়ার বাটিটি দেখে মন ভার হয়ে এল। ওর যে কোনো রান্না প্রথমবার মোটেও ভালো হয় না৷ আদ্রিকা নিজেই মুখে দিতে পারে না। সে নিশ্চিত করলার চপটি খেতেও জঘন্য হয়েছে। পরখের উপর রেগে পাকোড়া না দিয়ে করলা দেওয়া মোটেও ঠিক করে নি। এখন আকণ্ঠ আফসোসে ডুবে যাচ্ছে।
এখন যদি পাকোড়া দেওয়া হয়, পরখ দুটো কথা শুনিয়ে দিবে। সেটাও সে শুনতে রাজি নয়। পরখ তার হাতের অখাদ্য চুপচাপ সোনামুখ করে খেয়ে নিবে সেটা সে জানে। কিন্তু পরখ সেগুলো খাচ্ছে ভাবতেই আদ্রিকার ভীষণ খারাপ লাগছে৷
কি করা যায় সে ভেবে কূল পেলো না।
শব্দহীন পায়ে চুপিচুপি পরখের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিল। পরখ আপনমনে পড়ছে এবং নাস্তা খাচ্ছে। মুখটি প্রতিক্রিয়া শুণ্য। আদ্রিকার আর সহ্য হলো না। সশব্দে দরজা খুলে গটগট করে পরখের পড়ার টেবিল থেকে নাস্তার প্লেটটি তুলে নিল। অবাক পরখ হঠাৎ এহেন আচরণে ভড়কে গিয়ে ভ্রু কুচকে তাকাল ওর দিকে।
ওমন দৃষ্টির সামনে আদ্রিকা বরাবর ভীষণভাবে ঘাবড়ে যায়। আজও গেল। কণ্ঠস্বরের কাঁপন নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
‘নিজের জন্য রাখতে ভুলে গিয়েছিলাম৷ সবগুলো আপনার প্লেটে দিয়ে দিয়েছি৷ আপনি দেখছি সব খেয়ে নিচ্ছেন৷ আমি কি খাবো সেটা তো ভাববেন না।’
আদ্রিকা খেয়েছে নাকি খায়নি সে প্রশ্ন পরখ কখনো করেনি। আজও করবে না সেটাই স্বাভাবিক, তাই না? ওর খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে পরখ কোনো নিয়ম জারি করেনি। বরং পুরো বাড়িটাই ওকে ছেড়ে দিয়েছে। যখন যেটা চাইছে সেটাই এনে দিচ্ছে। আর কি চাই এই মেয়ের? আজকাল একটু বেশিই আবদার করা শুরু করে দিয়েছে। ব্যাপারটি পরখের মোটেও পছন্দ হলো না। ওর মুখটা ঘনঘোর আষাঢ়ের মেঘের মতো আঁধারে ডুবে যেতে দেখে আদ্রিকা শুকনো ঢোক গিলে পরখের হাতের আঙ্গুলের মাঝে ধরে রাখা করলার টুকরোটি ছিনিয়ে নিয়ে বলল,
‘অনেক খেয়েছেন। আর খেতে হবে না।’
তারপর হুড়মুড় করে প্রায় দৌড়ে কক্ষ ত্যাগ করল। সেদিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল পরখ। এমন অদ্ভুত আচরণ কেউ কখনো ওর সাথে করেনি৷ হাতের খাবার ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো অপমানে ওর মুখখানা চুপসে গেল৷ পরক্ষণে পাগলের অদ্ভুত কর্মকাণ্ডকে পাগলামি ভেবে উড়িয়ে দিয়ে আবারও নিজের কাজে মনোনিবেশ করল।
রান্নাঘরে পৌঁছে করলার চপ মুখে দিয়ে আদ্রিকা থু থু করে মুখের খাবার বেসিনে ফেলে দিল। তেতো স্বাদে মুখটা বিগড়ে গেছে৷ পানি দ্বারা কুলি করে করলার প্লেটটি উল্টে দিল ডাস্টবিনে। সেই সাথে গরম পাকোড়াগুলোর স্থান হলো ওই নোংরার ঝুড়িতে৷ নাহ, রেসিপিটি ঠিকঠাক হয়নি। আবার চেষ্টা করতে হবে। এবার করলার টুকরোগুলো লবণ মাখিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিয়ে পানি ঝরিয়ে নিবে৷
আদ্রিকা আবার ফিরে গেল পরখের কক্ষে৷
সবে মাত্র পড়ায় মনোযোগ বসিয়েছিল, তাতে বিঘ্ন ঘটায় পরখ বিরক্ত হল। ঝাঁঝালো স্বরে বলল,
‘আবার কি চাই?’
‘করলা আনতে হবে।’
‘ঘরে আর কোনো সবজি নেই? যা আছে তাই রাঁধো।’
‘আছে কিন্তু করলাও লাগবে।’
‘মাত্র দু দিন হলো বাজার করে নিয়ে এলাম। এখনি আবার বাজারের কথা বলছ!’
‘এমন কিপ্টুসের মত কথা বলছেন কেন? লাগবে বলেই তো আনতে বলছি। এনে না দিতে পারলে বলে দিন।’
‘পারব না, যাও।’
‘আপনার আসলে বিয়ে করাই উচিত হয়নি৷ বউয়ের কোনো দায়িত্ব নিতে পারবেন না অথচ সে মহাশয় নাচতে নাচতে বিয়ে করে বউ নিয়ে এলো।’
পরখ কিছু বলতে উদ্যত হওয়া মাত্র আদ্রিকা হাত উঁচু করে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘থাক, আপনি কি বলবেন আমি জানি। আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাননি। আপনার বাবা মা জোর করে বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমাকে বিয়ে না করলেও অন্য কাউকে তো বিয়ে করতেন। সেই মেয়েটার দূর্দশা কল্পনা করেই আমি শিউরে উঠছি৷ আমি না হয় পাপী তাপী মানুষ। নিজের পাপের শাস্তি পাচ্ছি। মেঝেতে ঘুমাচ্ছি, এবেলার খাবার ওবেলা খাচ্ছি। এই শশ্বানে একলা ভূতের মতো পরে থেকে দিন কাটাচ্ছি। এখানে আমি মরে পরে থাকলেও লোকে জানতে পারবে না, এক অভাগা মেয়ের আত্মা এই পরিত্যক্ত বাড়িটিতে ঘুরঘুর করছে৷
তবুও প্রায়শ্চিত্ত ভেবে নিজের দূর্দশা আমি মেনে নিয়ে এভাবেই দিন কাটাচ্ছি। কোনো ভালো ভদ্র ঘরের মেয়ে আপনার বউ হয়ে এলে আপনার সাথে একদিনও সংসার করতে পারত না। আমি বলেই আপনার সংসার করছি। কি খাচ্ছি, কি পরছি, কীভাবে আছি সেসব নিয়ে কোনো অভিযোগ করছি না। অন্য কেউ হলে কবেই সব ছেড়ে নিজের রাস্তা মাপতো। আসলেই আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী। জেনে বুঝেই আপনার গলায় আমাকে ঝুলিয়ে দিয়েছেন।’
‘তোমার জ্ঞান দেওয়া শেষ হয়েছে?’
‘ওসব মুখস্ত বিদ্যা জীবনের কোনো কাজে আসে না। আমি যা বলছি সেগুলো আপনার ওই বইয়ের লেখার থেকে বেশি মূল্যবান। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। ফ্রিতে জ্ঞান দিচ্ছি, তবুও শুনে রাখুন।’
পরখ বিরক্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘কতো কেজি করলা লাগবে তোমার?’
‘আধা কেজি হলেই চলবে। খুব বেশি খরচ হবে না আপনার। এমন কিপ্টা লোকের পাল্লায় পরেছি জানলে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতাম।’
বাইকের চাবি হাতে নিয়ে পরখকে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে দেখে আদ্রিকা জানতে চাইল,
‘কোথায় চললেন?’
‘তোমার করলা আনতে।’
‘এখন যেতে কে বলেছে? কালকে নিয়ে আসবেন।’
‘এক্ষুণি প্রয়োজন না হলে এতোক্ষণ ধরে আমার মাথা খাচ্ছিলে কেনো?’
‘আমি কখন বলেছি এখনি লাগবে? শুধু বলেছি করলা লাগবে। আপনি যদি ভেবে নেন এক্ষুনি লাগবে, সেটা আমার দোষ। নিজেই আকাশকুসুম ভেবে নিয়ে আমাকে এতোগুলো কথা শুনিয়ে দিল।’
পরখ ফিরে এসে আদ্রিকার সামনে দাঁড়িয়ে চোয়াল জোড়া শক্ত করে ওর দিকে রক্তচক্ষু মেলে তাকিয়ে বলল,
‘এই মুহূর্তে আমার রুম থেকে বের হও। আর একবার অকারন বিরক্ত করতে এলে আজকেই বাড়ি থেকে বের করে দিব৷ যাও বলছি৷’
চোখ পাকিয়ে আদ্রিকা ধুপধাপ কদম ফেলে বেরিয়ে গেল। নেহাৎ করলার চপ আবার বানাতে হবে৷ না হলে এই কাঠখোট্টা, কিপ্টুস লোকটার সামনে সে কখনোই যেত না।
______
লোকে জ্ঞান দেওয়ার আগে দু’বার ভাবে না। কাউকে উপদেশ দেওয়ার আগে সেটি নিজেকে মানতে হয়। তবেই না অন্যকে উপদেশ দেওয়ার উপযুক্ত হবে তুমি। কিন্তু আজকাল সেসব কে মানে? নিজে দেদারসে মিথ্যে কথা বলে, অন্যকে জ্ঞান দেয় ‘সদা সত্য কথা বলবে।’
এই যে কয়েকদিন আগেই আদ্রিকার মা নীহার ওকে বলল, অসময়ে কল দিয়ে আদ্রিকা মোটেও ঠিক কাজ করেনি। অথচ আজকে এই সকালবেলা সে নিজেই কল দিয়েছে।
বেসিনে নোংরা থালাবাসন পরিষ্কার করতে গিয়ে আদ্রিকার নাভিশ্বাস দশা৷ গতকাল রাত্রে ক্যারামল টি বানাতে গিয়ে পাতিলের গায়ে চিনির সিরা শক্ত হয়ে বসে গেছে। সেগুলো তুলতে গিয়ে হাত ব্যথা হয়ে গেল। এরমাঝে মোবাইলটি তারস্বরে চিৎকার করে যাচ্ছিল। ওই পোড়ামুখো যন্ত্রটাকে আদ্রিকা কখন, কোথায় রেখে দেয় নিজেই জানে না। কোন গর্ত থেকে চিৎকার করছে কে জানে! অনেক খুঁজে ওকে পাওয়া গেল আদ্রিকার বিছানার চাদরের নিচে।
কল রিসিভ করে কাঁধ দ্বারা মোবাইলটি কানে চেপে আদ্রিকা নোংরা থালাবাসন ধুতে থাকল। এসব পরিষ্কার করে নাস্তা তৈরি করবে তারপর খাবে। এতো কাজের মাঝে ওর কি দুদন্ড স্বস্তি নেওয়ার ফুসরত আছে নাকি!
পানির কলকল শব্দ শুনে নীহার জানতে চাইল,
‘কী করতেছিস?’
‘থালাবাসন ধুই।’
‘এতো তাড়াতাড়ি রান্নাবান্না শেষ! ঠান্ডা হয়ে যায় না?’
‘কীসের রান্নার কথা বলছ? দুপুরের?’
‘হ্যাঁ। ’
‘রাতের নোংরা থালাবাসন ধুইতেছি। সকালের নাস্তা বানাবো এখন।’
নীহার আঁতকে উঠে বলল,
‘ এবেলা সকালের নাস্তা! ক’টা বাজে?’
‘নয়টা।’
‘নবাবের বাচ্চা, তুই ঘুম থেকে উঠছিস কখন?’
‘ এই সাত সকালে উঠে বকতেছো কেন? একটু আগেই উঠলাম। ফ্রেশ হয়ে, ঘর গুছিয়ে তারপর রান্না করতে আসছি। এজন্যই দেরী।’
‘কোন বাড়ির বউ এতো বেলা করে ঘুম থেকে উঠে! শ্বশুরবাড়িতে আমার মানসম্মান কিছু রাখল না আর। এই মেয়েকে নিয়ে আমার এ কী জ্বালা হলো আল্লাহ! এই গাধাটা মানুষ হবে কবে!’
‘সকালবেলা কী শুরু করলা! এমন কি মহাপাপ করে ফেললাম?’
‘মাঝ দুপুরে ঘুম থেকে উঠে আবার বড় বড় কথা বেরোচ্ছে কোন মুখ দিয়ে? লজ্জা করে না তোর? জামাই কই? তাকেও এখনো না খাইয়ে রাখছিস?’
‘আরে নাহ। উনি এখনো বাড়িতে থাকে নাকি! সেই সকালে বেরিয়ে গেছে।’
‘প্রতিদিন না খেয়ে চলে যায়?’
‘হ্যাঁ। ওতো সকালে আমি কীভাবে রান্না করব!’
‘আল্লাহ মাফ করো। একটা অমানুষকে পেটে ধরছি, পেলেপুষে বড় করছি। জামাইকে না খাইয়ে ঘর থেকে বিদায় দেয়। ছি! ছি! লজ্জা করে না তোর? মানুষটা আয় রোজকার করে এনে দিচ্ছে বলে দু মুঠো খেতে পারতেছিস। সেই মানুষটাকে তুই না খাইয়ে কোন আক্কেলে বিদায় দিস? ওই খাবার তোর মুখে উঠে?’
‘আজব! ওতো সকালে আমি উঠতে পারি! সে কখন বেরিয়ে যায় আমি টেরই পাই না।’
‘কেন উঠতে পারবি না? কোন জমিদারের বাচ্চা তুই? আমি উঠি না? প্রতিদিন তোদের নাস্তা বানায় দিতাম সেগুলো খেয়ে স্কুলে যাইতি। তোর বাপ এখনও সকালবেলা উঠে বেরিয়ে যায়। মাঝেমধ্যে ফজরের পরেই চলে যায় নার্সারির গাছ আনতে। তবুও মানুষটাকে আমি খালি মুখ ঘর ছাড়তে দেই না। আর তুই! অলক্ষ্মী, অপয়া কোথাকার। এই তুই আগে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতি না? আটটায় গিয়ে ক্লাস ধরতি। আর এখন বিয়ের পর নবাবগিরী দেখাচ্ছিস? নেহাৎ ভালো একটা মানুষের সাথে ঘর করতেছিস। তা না হলে তোদের এইসব জমিদারি লোকে বরদাস্ত করতো না। কবেই ঝাটা মেরে বিদায় করে দিত।’
‘এই সকালবেলা উঠে তুমি এজন্য আমাকে কল দিছো?’
‘আমি কি জানতাম, আমার মেয়ে এমন অনাসৃষ্টি কাজকর্ম করতেছে। লজ্জায় আমার মাথা কা টা যাচ্ছে। ছি! ছি! ভাবছিলাম বিয়ের পর মানুষ হবি। সে আর হলো কই! আগে যেই গরু ছিলি, এখনও তাই আছিস।’
‘আচ্ছা বাবা হইছে। আর কতো বকবা! আমার কানটা গরম হয়ে গেল। কালকে থেকে সারারাত না ঘুমিয়ে রাত জেগে তোমার জামাইকে পাহারা দিব। সে বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে রাজভোগ রান্না করে তার সামনে হাজির করব। এখন চুপ যাও প্লিজ। এমনতেই ক্ষুধায় আমার পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। এখন নাস্তা বানাবো, আবার দুপুরের রান্না আছে৷ কি রাধব সেই নিয়ে আরেক চিন্তা৷’
‘রান্নাবান্না পারিস এখন? ঠিকঠাক হয়?’
‘মোটামুটি। সপ্তাহে সাতটা দিন মাছ, মাংস রাঁধছি। ভালো না হয়ে যাবে কই!’
‘দেখে শুনে খরচ করিস। এনে দিচ্ছে দেখে তুইও রেধে ফেললে হবে না। রোজ মাছ, মাংস খেতে হবে কেনো? দু একদিন শাক সবজি দিয়েও ভাত খাওয়া যায়।’
‘যা এনে দেয় তাই রাধি। এখানেও আমার দোষ দিবা না।’
‘তুই নিজে বাজারসদাই করতে পারিস না?’
‘ওসব আমি পারি না। উনি নিয়ে আসে।’
‘তাহলে কি কি আনতে হবে তুই বলে দিবি।’
‘এই সিজনে কি কি পাওয়া যায় তাই জানি না।’
‘এখন আর সিজন মেনে শাক সবজি পাওয়া যায় নাকি! সবকিছু হরহামেশাই পাওয়া যাচ্ছে। সবজি বাগানে এখনও লাউ, কুমড়ো ঝুলে আছে। ভাবছি বাড়ির পেছনের লাল শাকগুলো তুলে পুইশাক লাগাব। একটু সার দিলে এই সময়েও গাছ হয়ে যাবে।’
‘তোমার বাগানে এখনও লালশাক আছে! কতদিন লালশাক খাই না। তুমি আমাকে একবারও বাড়িতে যেতে বলো না। বাড়ির শাকসবজি কতো মিস করি!’
‘এখন আসার দরকার নাই। মাহিনের মা, ভাবির বকাবকি চলতেই আছে। আমাকে দেখলেই ওদের বকাবকি শুরু হয়ে যায়। নতুন জামাই নিয়ে এসে আরেক মুসিবত। এদিকটা সামলে উঠি তারপর নিয়ে আসব।’
‘তোমার কাছে শাকের কথা শুনে আমার শাক খাইতে ইচ্ছা করতেছে। আজকে আনতে বলতে হবে।’
‘আমি তুলবোই এগুলা। এখান থেকে এখন পাঠায় দিচ্ছি।’
‘কার দ্বারায় পাঠায় দিবা? আব্বু নিয়ে আসবে?’
‘এত ভালো কপাল নিয়ে তোরা জন্মাইস নাই। নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, শাক পাঠাচ্ছি শুনলেই বকাবকি শুরু করে দিবে। তোর বাপের হচ্ছে একটুখানি কলিজা। কাউকে কিছু দেওয়ার মত বড় মন তার নাই। নিজের জিনিস পঁচায় ফেলবে তাও কাউকে দিতে দিবে না। ছোট মন মানসিকতার লোক একটা।’
‘তাহলে দেওয়ার দরকার নাই। শুধু শুধু ঝামেলা বাড়বে। আমি পরখকে বলব, উনি নিয়ে আসবে এখন।’
‘কেন দরকার নাই? হক আছে তোদের। যতদিন আমি আছি, তোরা নিয়ে যাবি। আমি না থাকলে এইসব ধন সম্পত্তি ওর ভাই, ভাতিজারা লুটেপুটে খাবে। সবাই শুধু ওত পেতে আছে। অভিমান করে হাত গুটিয়ে থাকলে নিজের লস। যা পাবি, হাত বাড়িয়ে নিয়ে যাবি। কে কি বলতেছে সেসব শুনে মন খারাপ করা যাবে না।’
আদ্রিকার মন মানল না। সে তবুও না করে দিল। মোকাররম কাউকে কিছু দিতে চায় না। বাড়িতে ফকির আসলেও সে ফিরিয়ে দেয়। নীহার যতোটুকু পারে লুকিয়ে চুপিয়ে দান করে। তবুও অন্যকে দেওয়া আর নিজের মেয়ে দেওয়া কি এক হলো? আদ্রিকার অবাক লাগে। বাবার বাড়ি থেকে শাক নিয়ে এলে বাবা যদি রাগ করে, তাহলে সে শাক খেয়ে আদোও আত্মা তৃপ্ত হবে?
নীহার সেসব শুনলো না। শাক তুলে ব্যাগে ভরে রওশন আলীর হাতে দিয়ে আদ্রিকার বাড়িতে পাঠিয়ে দিল।
রওশন আলী কল দিয়ে আদ্রিকার থেকে ঠিকানা জেনে নিল। ছোট ট্রাকটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হর্ণ দেওয়া মাত্র আদ্রিকার ভেতরকার চঞ্চল কিশোরীটি যেন জেগে উঠল। মাথায় ওড়না চাপিয়ে হুড়মুড় করে নেচে নেমে দেখল, রওশন আলীর ট্রাকটি আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে।
গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে রওশন আলী হাসছে। আদ্রিকা বলল,
‘চাচ্চু, ভেতরে আসেন।’
‘না মা। আজকে না।’
ব্যাগটি নামিয়ে দিলে আদ্রিকা হাত বাড়িয়ে সেটি নিল। মুখ গোমড়া করে বলল,
‘বাড়ি সামনে থেকে এভাবে চলে যাবেন! আসলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?’
‘মাল আনতে যাইতে হবে। বাড়ির ভেতর ঢুকলে দেরী হয়ে যাবে। এখন বাড়ি চেনা হয়ে গেল, যখন তখন আসা যাবে।’
দেয়ালের উপর থেকে বাড়ির দিকে তাকিয়ে রওশন আলী বলল,
‘উপরে উঠাইতে পারবি? ব্যাগ বেশি ভারি না তো?’
‘পারব। অল্প ওজন।’
‘জামাই ভালো?’
‘হ্যাঁ।’
‘মন দিয়ে সংসার কর। আজকে যাই।’
পথের ধুলো উড়িয়ে রওশন আলীর ট্রাকটি চলে গেল। ওখানেই দাঁড়িয়ে নির্নিমেষ চেয়ে রইল আদ্রিকা। অকারন চোখে জল নামছে। নিজের বাড়ি, সামনের আঙ্গিনায় বাগান, ছাদবাগান সবকিছু ভীড় জমালো মন মস্তিষ্কে।
বিয়ের পর বাবার বাড়ি সম্পর্কিত যেকোনো স্মৃতি এমন আবেগপ্রবণ করে তোলে যে বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আসে। চোখে জল জমে না কিন্তু পাথর চাপা পরা বুকটায় ক্ষুদ্র একটি ব্যথা জেগে উঠে৷ না কেউ সহস্র বছরের জমানো পাথরগুলো সরায়, না চোখের কোল ছাপিয়ে জলের ধারা কষ্টগুলো ধুয়ে মুছে দেয়। শুধু সংসারের ব্যস্ততায় ব্যথাটা কোথাও একটা হারিয়ে যায়। হয়তো নতুন কষ্টের নিচে চাপা পরে যায় অপ্রয়োজনীয়, অতিক্ষুদ্র এই ব্যথা।
আদ্রিকা প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে। ভারী ব্যাগটি টেনে হিচড়ে উপরে তুলে নিয়ে যায়। ছাদে আসন পেতে বসে ব্যাগ খুলে দেখে নীহার এলাহি কান্ড বাধিয়েছে। লাল শাকের সাথে আরও কতো কিছু তুলে দিয়েছে! ছোট আলু, মিষ্টি আলু, কাঁচা কলা, কচুর মুখি, কচু পাতা, কুমড়োর ফুল, কয়েকটা কাঁচা মরিচ, লেবু। লোকে দেখে হয়তো হাসবে। কিন্তু শুধুমাত্র মা-মেয়ে জানে এই অহেতুক জিনিসপত্রের মধ্যে কতো স্নেহ, কতো মমতা, কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কে বলে মেয়ের বাড়িতে দামী জিনিসপত্র না পাঠালে সম্মান যায়? ঘরের কোণে জন্মানো শাক পাতা মা যদি তার মমতায় মুড়ে পাঠিয়ে দেয়, সেসব মেয়ের হৃদয়ের কতোখানি গভীরে পৌঁছায় লোকে তা জানো না। তাই তো তারা নাক ছিটকায়। লোকের কথায় মায়ের কী এসে যায় বলো? মা কেবল মেয়ের অন্তরের শীতলতা চায়।
আদ্রিকার কচু পাতার ভর্তা ভীষণ পছন্দ। তাই তো ওদের বাড়িতে সারা বছর দেয়ালের পাশে কচু গাছ লাগানো থাকে। নীহার সেখান থেকে কচু পাতা তুলে পলিথিনে ভরে দিয়েছে। ভর্তা করলে লেবু লাগবে। মনে করে লেবু গাছ থেকে কয়েকটি লেবু ছিড়ে দিয়েছে৷
বাড়ির সবজি বাগানে কীটনাশক বিহীন সবজি চাষ হয়। সেখানের তাজা কাঁচা মরিচগুলো দেখে কচকচ করে খেতে ইচ্ছে করে।
এককোণে কলা গাছের ঝোপ আছে। বেশ বড়সড় কাঁচা কলা হয়৷ সেগুলোর চপ ভেজে দিলে দু বোনের মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে যেত৷ নীহার নিজে হাতে একটু খানি জায়গায় মিষ্টি আলু চাষ করেছিল। আদ্রিকাও মায়ের সাথে কয়েকটি মিষ্টি আলু পুঁতে দিয়েছিল মাটিতে। মেয়েকে রেখে সেই মিষ্টি আলু নিশ্চয়ই নীহারের গলা দিয়ে নামবে না। তাইতো কয়েকটি ব্যাগে ভরে দিয়েছে। কুমড়ো ফুলের বড়া কার না পছন্দ! বেসনে চুবিয়ে ভেজে দিলে আদ্রিকার মুখে হাসি ফুটত।
এতোদিন আদ্রিকা ভাবত, মা তার পছন্দ অপছন্দের বিশেষ খেয়াল করে না। তাদের রান্নাঘরে কখনও বিশেষ কিছু রান্না হত না। মা কখনও বলত না, ছোট আলুর ভাজি আদ্রিকার পছন্দ। আজকে এটাই রাঁধি। আদ্রিকার ভারি অভিমান হত। মা কখনো ওদের দিকে বিশেষ ধ্যান দেয় না। কিন্তু আজ এই খোলা ছাদের নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা শাক-সবজির মাঝখানে বসে মায়ের মমতায় ডুবন্ত আদ্রিকা প্রাণভরে কাঁদল। লোকে দেখলে হয়তো তাকে পাগল ভাববে। ভাবলে ভাবুক। আজ সে কারো পরোয়া করবে না। অনেকক্ষণ কেঁদে মন হালকা হয়ে এলে সে বেশ যত্ন সহকারে শাক-সবজিগুলো নিয়ে রান্নাঘরে গেল।
পরখের নিয়ে আসা বাজার সদাই ওভাবেই ফ্রিজে পরে রইল। লাল শাকগুলো কুটে নিয়ে আদ্রিকা আবারও নীহারকে কল দিয়ে বলল,
‘মা, লাল শাকের ঝোল করে কীভাবে?’
রেসিপি বলে দেওয়ার পাশাপাশি নীহার সতর্কবার্তা দিল,
‘অনেকগুলো শাক আছে। একসাথে রাঁধিস না। মাত্র দুটো লোক খাবি। সবগুলো শাক বেছে নিয়ে অর্ধেকটা আজকে রান্না কর। বাকিটা কালকে।’
তেলে পেয়াজ-কাঁচা মরিচ ভেজে নিয়ে তাতে শাকগুলো দিয়ে সামান্য লবণ দিল। মা বলেছে,
‘অনেকগুলা শাক দেখে একগাদা লবণ দিয়ে রাখিস না আবার৷ শুকিয়ে একটুখানি হবে।’
কড়াইয়ে ঢাকনা চাপিয়ে সে ভাবল,
‘ভাজি না ঝোল হবে সেটা শাক নিজেই ঠিক করবে। সেদ্ধ হয়ে যাওয়া পর পানি থাকলে শাকের ঝোল, শুকিয়ে গেলে শাক ভাজি।’
লাল শাকের ঝোল দিয়ে লালচে ভাত খাওয়ার শখ এবেলা পূরণ হলো না। অতিরিক্ত তাপে শাকের ঝোল শুকিয়ে সেটা শাক ভাজি হয়ে গেল। তাতেও আদ্রিকার দুঃখ নেই। শাক ভাজি চুলা থেকে নামিয়ে কচু ভর্তা করল, কাঁচা কলার চপ ভাজল। পাতলা মসুর ডাল রান্নার পর কচুর মুখিগুলো তুলে রাখল অন্যদিন মাছ দিয়ে রান্না করবে বলে।
দুপুরে খেতে বসে পরখ অবাক চোখে টেবিলের উপর রাখা খাবারগুলো দেখল। ওর মুখভঙ্গি দেখে আদ্রিকা নিজেই বলল,
‘মা পাঠিয়েছে৷’
খাওয়া রেখে পরখ ক্রুদ্ধ চোখে আদ্রিকার দিকে চেয়ে শান্ত গলায় প্রশ্ন করল,
‘কেনো?’
আদ্রিকা হতভম্ব হয়ে জানতে চাইল,
‘কেনো মানে?’
‘কেনো পাঠিয়েছে? তুমি চেয়েছ?’
‘আমি চাইব কেন? মা নিজেই দিল।’
‘চাইতেই পারো। তোমার কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই৷’
‘সেদিনের বাজার নিয়ে কথাবার্তার কারনে আপনার মনে হচ্ছে আমি মায়ের থেকে এসব চেয়ে এনেছি?’
‘তোমাকে যতোটা বোকা ভেবেছিলাম, তুমি ততোটাও নও। আ’ম ইমপ্রেস। ’
‘আমি বোকাই ছিলাম। আপনার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে একটু চালাক হতে বাধ্য হয়েছি৷ এখন আঁকাবাঁকা মানসিকতায় ভাবতে হচ্ছে। আমার জীবনটা এখন যুক্তি তর্কময় হয়ে গেছে।’
‘কারো সাথে যুক্তি তর্কে যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। আমি একটু নির্বিঘ্নে, একটু শান্তিতে থাকতে চাই৷’
পরখ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঝগড়া ঝামেলা তার পছন্দ নয়৷ সে স্বল্পভাষী মানুষ৷ তবুও আদ্রিকার সামনে দাঁড়ালে কেনো যেনো দুটো কথা বরাবর বেশি বলে ফেলে। পরে অবশ্য আফসোসও হয়৷ কি দরকার ছিল এতো কথা বলার? আদ্রিকার সাথে অকারন তর্ক করে বিশেষ কিছু লাভ নেই৷ বরং সময় নষ্ট। সে ঠিক করেছে কথা বলতে গেলেই যেহেতু ঝগড়া শুরু হয়ে যায়, তাই এখন থেকে আদ্রিকার সাথে প্রয়োজনের বাইরে কোনো কথা বলবে না।
ও খাবার রেখে উঠে যাচ্ছে দেখে আদ্রিকা আশ্চর্য হলো। চোখ দুটো গোল গোল করে অবিশ্বাসের সুরে বলল,
‘এগুলো আমার মা পাঠিয়েছে বলে, আপনি না খেয়ে চলে যাচ্ছেন! পারলেন আমার মাকে এভাবে অপমান করতে? আপনার ব্যবহার দেখে আমি রীতিমতো অবাক হয়ে যাচ্ছি। বাইরে থেকে দেখে বুঝার উপায় নেই, আপনি এতোটা সংকীর্ণ চিন্তা ধারার মানুষ।’
ইচ্ছে করলেই এই অপবাদের বিপরীতে অনেক কথা বলা যায়। কিন্তু বিভিন্ন ঝামেলায় জর্জরিত পরখ সংসারে নতুন ঝামেলা সৃষ্টি করতে চাইল না৷ বোবা, বধির বেশ ধরে ফের চেয়ারে বসে সোনামুখ করে ভাত খেয়ে নিল। না একটিবার আদ্রিকার দিকে চাইল, না একটি কথা বলল।
চলবে…
#অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|১৮|
নির্ঘুম রাতের থেকে দীর্ঘ কিছু নেই৷ আদ্রিকা অবশ্য ঘুমাতেই চাইছে৷ কিন্তু মোবাইলে সকাল ছয়টার এলার্ম নির্ধারণ করে রাখার পর ঘুম যেনো কোন জানালা দিয়ে পালিয়ে গেলো। সকালবেলা উঠতে হবে এই বার্তাটি মস্তিষ্কে এমনভাবে গেঁথে গেছে যে একটু পর পর ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। চোখ খুলে আদ্রিকা মোবাইলে দেখল সবেমাত্র আধঘন্টা পেরিয়েছে, আবার ঘুমটা ভেঙে গেল। সে আবার চোখ বন্ধ করে ক্ষণ গুনতে শুরু করল।
আকাশে ধূসর আলো সবে উঁকি দিয়েছে। বিছানা ছেড়ে আদ্রিকা উঠে বসল। এলার্ম বাজতে এখনও আধা ঘন্টা বাকি। ওটা বন্ধ করে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। পরখ এখনোও ঘুম থেকে উঠেনি৷ সকালের নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে গেল সে৷
আড়মোড়া ভেঙে পরখ বিছানা থেকে উঠে বাইরে এসে রান্নাঘরে খুট খুট আওয়াজ শুনে সেদিকে উঁকি দিয়ে আদ্রিকাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। চুপিসারে সরেই আসছিল, আদ্রিকা পেছন ফিরে পরখকে দেখে স্নিগ্ধ হেসে বলল,
‘গুড মর্নিং।’
হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে নিজের গাম্ভীর্যতা ধরে রেখে পরখ উত্তর দিলো,
‘হুম, মর্নিং।’
স্বল্প সময়ের মধ্যে নিত্য দিনকার মতো কাজকর্ম সেরে পরখ ভার্সিটির উদ্দেশ্যে কক্ষ ত্যাগ করল। টেবিলে সব সাজিয়ে আদ্রিকা অপেক্ষা করছিল। সি গ্রিন শার্ট, সাদা প্যান্ট, কালো জুতা পায়ে পরখ গটগট করে হেঁটে যাচ্ছে৷ সেদিকে তাকিয়ে আদ্রিকা বলল,
‘নাস্তা খেয়ে যান।’
পরখ থামল। কয়েক পল আদ্রিকা এবং তার সামনে থাকা রুটি, আলু ভাজির দিকে তাকিয়ে বিনাবাক্যে চেয়ারে গিয়ে বসল।
চুলা থেকে চায়ের পাতিল নামিয়ে চায়ের কাপে ঢেলে নিয়ে এসে আদ্রিকা পাশের চেয়ারে বসা মাত্র ভক্ষণরত পরখ বলল,
‘আজ হঠাৎ নাস্তার আয়োজন?’
এসব ঢং দেখলে আদ্রিকার ভীষণ রাগ পায়, মেজাজ খারাপ হয়৷ নাস্তা খেতে চাইলে সেটা নিজে মুখে বলবে না, আবার এখন এমনভাবে বলছে যেনো আদ্রিকা ইচ্ছে করেই তাকে খালি পেটে বিদায় দেয়। কই আদ্রিকা কি জানতে চেয়ে সে রোজ এতো সকালবেলা এমন সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছে? ভাগ্যিস আজকে সে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছে। না হলে জানতেই পারত না তার বিয়ে করা স্বামী এমন পটেরবিবি সেজে বাইরে যায়৷ পারফিউমের গন্ধে কাছে ঘেষা যাচ্ছে না৷
রাগটা চেপে রেখে আদ্রিকা বলল,
‘আপনাকে না খেয়ে বিদায় দিচ্ছে বলে আমার মায়ের পাপের পারদ তড়তড় করে বাড়ছে৷ সে পাপের বিনাশ করতে আমার উপর আদেশ জারি করা হয়েছে যাতে আপনাকে খাইয়েদাইয়ে তবেই বাড়ি ছাড়তে দেই।’
এমন অযৌক্তিক কথায় অবাক হলেও পরখ তার শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘আমার খাবারের সাথে তোমার মায়ের কী সম্পর্ক?’
‘আমার মায়ের মেয়ে তার জামাইকে মানে আপনাকে সকালবেলা নাস্তা তৈরি করে না দিয়ে স্ত্রী ধর্ম পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে৷ ফলে আমার মায়ের মেয়ের অর্থ্যাৎ আমার পাপ হচ্ছে৷ আমার জন্মদাত্রী হওয়ার সুবাদে সেই পাপের ভাগীদার আমার মা-ও হচ্ছে৷ তাই তার লালনপালনে যে প্রশ্নচিহ্ন উঠেছে তা মুছে দিতে আমার উপর আদেশ জারি করা হয়েছে। এবার বুঝেছেন?’
‘হুম। বুঝলাম। তবে স্ত্রী ধর্মের মধ্যে আরও অনেক কর্মকাণ্ড আছে। তোমার মা সেসবের খোঁজও রাখেন নাকি?’
‘আবার কি বাকি রয়ে গেছে?’
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ল্যাপটপ ব্যাগটি হাতে নিয়ে চলে যাওয়ার আগে পরখ বলল,
‘সেসব তোমার না জানলেও চলবে।’
আজ পর্তুলিকার জন্মদিন। ইবনূল ইবতেহাজ ঘুমাতে যায়নি। নিজের স্টাডিরুমে বসে বারবার ঘড়ি দেখছিলেন। কখন রাত বারোটা বাজবে৷ নির্ধারিত সময়ে পাচ মিনিট আগে হুড়মুড় করে নিজের কক্ষে ছুটে গিয়ে দেখলেন পর্তুলিকা ঘুমাচ্ছেন। তিনি আলতো ছোঁয়ায় পর্তুলিকাকে ঘুম থেকে জাগালেন। পর্তুলিকা বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘এখনও বারোটা বাজেনি। ঘুমাতে দেও৷’
ইবনূল ইবতেহাজ সে কথা মানলেন না। আসন পেতে বসলেন বিছানায়। ঘুমন্ত পর্তুলিকাকেও বসিয়ে রেখে বললেন,
‘আর পাঁচ মিনিট আছে। আমার সাথে বসে অপেক্ষা করো।’
অদ্ভুত মানুষটার এই পাগলামি পর্তুলিকা বছরের পর বছর উপভোগ করেছেন। মনে মনে আপ্লুত হলেও মুখ কুঁচকে বসে রইলেন। রাত ঠিক বারোটায় ইবনূল ইবতেহাজ শুভেচ্ছা জানানোর আগেই হঠাৎ করে পর্তুলিকার মোবাইলটি তারস্বরে চিৎকার করতে শুরু করলে পর্তুলিকা সেটি হাতে তুলে নিয়ে দেখলেন পরখের কল। রিসিভ করতে যাবেন সেই মুহূর্তে ইবনূল ইবতেহাজ বাঁধ সাধলেন। আঁজলা ভরে পর্তুলিকার মুখটি নিজের হাতে আবদ্ধ করে বললেন,
‘এই, এই আগে আমার কথা শুনো। এখনি কল রিসিভ করবে না। আগে আমি উইশ করবো।’
পর্তুলিকা বেজায় বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘কীসব পাগলামি করছ! বয়সের খেয়ালটাও একটু করো। এই বয়সে এসব মানায়!’
‘বয়সের গুনতি পরে হবে। আরে আরে বারোটা পেরিয়ে যাচ্ছে।’
‘এখন আমি কলটা ধরি?’
‘তোমার এডলিস্ট আমাকে ধন্যবাদ বলা উচিত।’
‘থ্যাঙ্কিউ ইবনূল ইবতেহাজ।’
‘প্রোপার থ্যাংকস।’
‘সেটা কীভাবে?’
‘ছোট্ট একটা চুমু দিতে পারো। নাহ, নাহ ঠোঁটে দিতে হবে না। এই যে এখানে, গালে দিলেও চলবে।’
‘যাও তো। সরো এখান থেকে।’
ইবনূল ইবতেহাজকে সরিয়ে দিয়ে পরখের কল রিসিভ করে কিছুক্ষণ কথা বলল।
শোরগোল পর্তুলিকার একদম পছন্দ নয়। ছোট্ট পরিবার নিয়ে হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করেন। কিন্তু পিতা-পুত্রের রেশারেশির মাঝখানে উনার সুখের সংসার ভেঙে দু টুকরো হয়ে গিয়েছে। ঘুম থেকে উঠে গাছে পানি দিচ্ছে পর্তুলিকা। দূর থেকে তাকিয়ে স্ত্রীর মন খারাপ সহজেই আন্দাজ করে ফেললেন ইবনূল৷ এমন একটি বিশেষ দিনে স্ত্রীর মন খারাপ তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। স্টাডি রুমে গিয়ে কল দিলেন পরখকে৷
‘আজকের দিনে অন্তত নিজের মাকে সময় দেওয়া তোমার উচিত ছিল। জন্মদিনে মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইটস হার ডে৷ মেক ইট স্পেশাল ফর হার।’
দুই ক্লাসের মধ্যকার বিরতিতে টিচার্সরুমে বসে ছিল পরখ। বাবার কথার প্রেক্ষিতে বিশেষ কিছু বলার ইচ্ছা থাকলেও পরিস্থিতি অনুকূলে নেই। মুখের গম্ভীর্যতা ধরে রেখে শান্ত স্বরে বলল,
‘মায়ের সাথে কথা হয়েছে৷ বিকালে যাব বলেছি।’
‘এখনি নয় কেনো?’
‘নিজস্ব ব্যস্ততা থাকতেই পারে।’
‘এখন তোমার কীসের ব্যস্ততা? পড়াশোনা শেষ, কাজকর্ম কিছু নেই৷ চাইলে এখনি আসতে পারো। কিন্তু তোমার ইচ্ছেশক্তির অভাব। আমার উপর জেদ করে তুমি তোমার মাকে কষ্ট দেও। কি ভেবেছো, আমি কিছু বুঝতে পারি না?’
‘বাবা, শুনো আমি একটু ব্যস্ত আছি। পরে কথা হবে।’
ইবনূল ইবতেহাজ মোবাইলটি কান থেকে নামিয়ে রেখে দ্রুত পায়ে ছাদে গিয়ে পর্তুলিকাকে বললেন,
‘তুমি জানো, তোমার ছেলে আস্ত একটা বেয়াদব।’
বনসাই গাছে পানি দিচ্ছিলো পর্তুলিকা। ইবনূল ইবতেহাজ এর কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক চোখে তাকাল। রাগে ইবনূলের মুখমণ্ডল লাল হয়ে গিয়েছে। তা দেখে ভ্রু কুচকে বললেন,
‘কি করেছে আমার ছেলে?’
‘কিছু না।’
বলে ইবনূল ইবতেহাজ আবার ছাদ থেকে নেমে গেলেন।
পরখ আজকে ভার্সিটি থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে। আদ্রিকার রান্না এখনও শেষ হয়নি। এরমাঝে পরখকে ফিরে আসতে দেখে বেশ চিন্তিত হলো। ওড়নায় ভেজা হাত মুছে পরখের কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে প্রশ্ন করল,
‘কিছু হয়েছে?’
হাত ঘড়িটি খুলে রেখে পরখ ফিরে তাকাল।
‘কি হবে?’
‘আজকে তাড়াতাড়ি ফিরলেন!’
‘আমার বাড়িতে আমি যখন ইচ্ছে তখন ফিরব। তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে?’
‘আজব! রেগে যাচ্ছেন কেনো? এমনিতেই জানতে চাইলাম। আপনাকে প্রশ্ন করাও যাবে না?’
‘অকারণ আগ্রহ দেখাতে আসবে না। নিজের কাজ করো যাও।’
অপমানে আদ্রিকার মুখখানি চুপসে গেল। বাজে লোকটার সাথে কথা বলতে আসাই ভুল হয়েছে। সে মাথা নিচু করে রান্নাঘরে চলে গেল। মন খারাপ নিয়ে রাঁধতেও ভালো লাগে না। তবুও রান্না শেষ করে টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখে ভাবল পরখকে ডাকতে যাবে না। তার যখন মন চাইবে খেতে আসবে। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও আদ্রিকার প্রতিজ্ঞা বেশিক্ষণ টিকল না। মুখে বেদনার ছাপ অক্ষত রেখে সে পরখের কক্ষের দরজায় দুটো টোকা দিয়ে বলল,
‘টেবিলে খাবার দিয়েছি। যখন ইচ্ছে হবে খেয়ে নিবেন।’
মাথা নিচু করে নিজের কথা জানিয়ে টেবিলে ফিরে গেল।
আজকে ভার্সিটি থেকে ফিরে পরখ এখনও পোশাক পাল্টায় নি। উদাস মনে রকিং চেয়ারে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। আদ্রিকার ম্লান কণ্ঠস্বরের অভিমান সে বুঝতে পারল। তখন ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। হাজার হোক মেয়েটাকে তাকে তিনবেলা রেঁধে খাওয়াচ্ছে।
খাওয়ার টেবিলে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা। দুজনেই প্লেটের খাবার অকারন নাড়াচাড়া করছে৷ মুখে তুলছে না কেউই। ভিন্ন কারনে নিজস্ব ব্যথায় দুজনেই জর্জরিত। ভাতের প্লেট একপাশে রেখে পরখ প্রথম বলল,
‘আজকে মায়ের জন্মদিন। মায়ের সাথে দেখা করতে যাবো। যেতে চাইলে তৈরি হয়ে নেও।’
স্পষ্ট উচ্চারণে একটানা নিজের বক্তব্য জারি করে পরখ চলে গেলো হাত ধুতে৷ ব্যক্তিটি পর্তুলিকা না হলে এমন নিমন্ত্রণে আদ্রিকা কিছুতেই যেত না৷ আজকাল ঠেঁস দেওয়া কথাবার্তা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। কিন্তু এই ব্যক্তি খোঁচা মেরে কথা না বলে সহজ ভাবে কথা বলতে পারে না।
পর্তুলিকার কিনে দেওয়া একটি নীল জমিনে গোলাপি পাড়ের শাড়ি পরে আদ্রিকা বাইরে এলো।
পোশাক পাল্টে সাদা পায়জামা এবং কুসুম রঙা এক পাঞ্জাবি পরেছে পরখ। বসার ঘরের সোফায় অপেক্ষারত আদ্রিকাকে এক পলক দেখে নিয়ে গটগট করে বাইরে বেরিয়ে গেল। পিছু ছুটল আদ্রিকা৷
পরখের বাইকের পেছনের নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে ভীরু চিত্তে বসে আদ্রিকা প্রহর গুনছে৷ কখন পথ শেষ হবে, কখন সে এই অস্বস্তিকর যাত্রা হতে মুক্তি পাবে। বাড়ির সামনে বাইক থামানো মাত্র আদ্রিকা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। দ্রুত বাইক থেকে নেমে একপাশে দাঁড়াল। বাইক পার্ক করে পরখ বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলে সেও পিছু পিছু চলল।
মাত্র খেতে বসেছে ইবনূল এবং পর্তুলিকা৷ হঠাৎ ওদের দুজনকে দেখে পর্তুলিকার হৃদয় খুশিতে নেচে উঠল। মেঘের আড়ালে ঢেকে থাকা সূর্যের হাসি ঝলমল করে উঠতে দেখে ইবনূল ইবতেহাজ বেজায় খুশি। পর্তুলিকা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রথমে আদ্রিকাকে জড়িয়ে ধরল।
‘তোমাদের না বিকালে আসার কথা ছিল! একদম সারপ্রাইজড হয়ে গেছি।’
বিনিময়ে আদ্রিকা মিষ্টি করে হাসল। পরখ নিজে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা জানাল,
‘শুভ জন্মদিন, মা।’
‘এখন আর জন্মদিন পালন করার বয়স আছে! তোদের বাপ ছেলের আদ্যিখেতা দেখে বাঁচি না। তোরা খেয়েছিস নাকি? খেয়ে এলেও আবার খেতে হবে। বস আমাদের সাথে। আদ্রিকা এসো।’
মায়ের হাতের রান্না বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেলো পরখ। অন্যদিকে আদ্রিকার মনে হচ্ছে, অনেকদিন পর সে ভালো কিছু খাচ্ছে। নিজের হাতের অখাদ্য খেতে খেতে সে নিজেই অতিষ্ঠ৷
এই প্রথম পরখের শোবার ঘরে আদ্রিকা এলো। বেশ বড় একটি কক্ষের ঠিক মাঝখানে বিশাল এক বিছানা৷ একপাশে ওয়্যারড্রব, ড্রেসিং টেবিল, সোফা সেট, টেবিল, চেয়ার কি নেই এই কক্ষে! এমন আরামদায়ক জীবন ছেড়ে ছোট কক্ষবিশিষ্ট বাসাতে পরখ কেনো পরে থাকে ভেবেই অবাক হলো আদ্রিকা।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আদ্রিকাকে কক্ষে দেখে অবাক হলো পরখ। দেয়ালে বড় টিভিটি বিস্ময় নিয়ে দেখছিল আদ্রিকা। পরখের পায়ের শব্দে সেদিকে তাকিয়ে ওর দৃষ্টিতে কৌতূহল দেখে নিজেই উত্তর দিল,
‘পিউ মা, পাঠিয়ে দিল। এখানে বিশ্রাম নিতে বলল।’
পরখ তেমন কিছু বলল না। শুধু আদ্রিকার মুখে পিউ মা শব্দটি শুনে নিজেও সেটি বিড়বিড় করল।
বিছানায় আরাম করে শুয়ে মোবাইলে মনোযোগ দিয়েছে পরখ৷ অন্যদিকে কক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিকা। কি করবে বুঝতে পারছে না। দাঁড়িয়ে থেকে পায়ের ব্যথা হয়ে গিয়েছে। ভরা পেটে কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়! দ্বিধা ভরা কদম ফেলে সে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। পরখের অপরপাশে বসতে গিয়ে মনে হচ্ছিলো এই বুঝি পরখ একটা ধমক দিয়ে দিল। সত্যি বলে, এবেলা পরখ আরেকবার অপমান করলে আদ্রিকা ভীষণ কষ্ট পাবে। এমনিতে ওর পিরিয়ড চলছে। এ সময় মেজাজ খিটমিটে হয়ে থাকে। আবেগের মাত্রা এতোটাই বেশি থাকে যে সামান্য কথাতেও মনে জোরসে আঘাত লাগে।
বিছানায় বসে আদ্রিকা ভাবতে লাগল, আজ এখানে থেকে গেলে রাতের বেলা ওকে পরখের সাথে এই বিছানায় ঘুমাবে হবে। এর থেকে ভাল হত, পিউ মা যদি তাকে সেই গেস্টরুমে পাঠিয়ে দিত। সেখানে অন্তত প্রাণ খুলে শ্বাস নেওয়া যেত। এমন অস্বস্তিতে গাট হয়ে কতোক্ষণত থাকা যায়! অন্যদিকে পরখ নির্বাক। কক্ষে অন্য কারো অস্তিত্ব সে যেনো অনুভব করতেই পারছে না। একটা মানুষ কীভাবে নিজস্ব জগতে ডুবে থাকতে পারে, আদ্রিকা ভেবে পায় না।
অস্বস্তির অথৈ সাগর থেকে ওকে উদ্ধার করতে এ বাড়ির কাজের মেয়েটি এসে আদ্রিকাকে জানাল, পর্তুলিকা তাকে ছাদে ডাকছে। শোনামাত্র আদ্রিকা দ্রুত পায়ে ঘর ছাড়ল। পরখ শুধু চোখ তুলে একবার চেয়ে দেখল সে দৃশ্য।
পর্তুলিকার ছাদ বাগানে গাছের সমারোহ দেখে আদ্রিকার মাথায় হাত। এতো এলাহি কান্ডকারখানা।
‘এই সবগুলো আপনার গাছ!’
পর্তুলিকা মুখে গর্বের হাসি। এই স্থানটি তার স্বস্তির একমাত্র জায়গা। ছেলে নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। ইবনূল ব্যস্ত অফিস নিয়ে। একা বাড়িতে পর্তুলিকার সময় কাটে গাছের সাথে।
গোলাপ, কাঠগোলাপ৷ গাঁদা, জিনিয়া, শিউলি, শ্বেতকাঞ্চন, কয়েক রঙের জবা, কামিনী, করবী, অলকানন্দা, জয়তী, হাজারপুটিয়া, নয়নতারা, নাগচাপা, চন্দপ্রভা, সন্ধ্যামালতা, নীলমনি লতা, স্বর্ণচাঁপা, কাঠাল চাপা, নাইট কুইন, জারুল, ছাতিম, বিচিত্রা, হংস লতা, দত্ত প্রিয়া, দোলনচাঁপা, অ্যারোমাটিক জুঁই, চামেলি জুৃই, ক্যামেলিয়া, পানিকা, বন টগর, কুর্চি, পানসি, পেটুনিয়া, পিওনি, ফুচিয়া, ল্যান্টানা, মস গোলাপ, ল্যাভেন্ডার, অ্যাস্টার, হাইড্রেঞ্জা, হলিহক, কোণফ্লাওয়ার ইত্যাদি ইত্যাদি গাছের মাঝে দাঁড়িয়ে আদ্রিকা পাগলপ্রায়।
উচ্ছ্বসিত তরুণী খিলখিলিয়ে হেসে চিৎকার করে আতিপাতি ঘুরতে ঘুরতে বলছে,
‘আমার ইচ্ছে করছে এখানেই থেকে যাই। এতো এতো ফুল! কাউকে আজকেই প্রথম দেখছি। এইযে এটার নামটাও আমি জানি না। কী মিষ্টি ঘ্রাণ এখানের বাতাসে! এটা একটা স্বর্গপুরী।’
একপাশে দাঁড়িয়ে আদ্রিকার উন্মাদনা উপভোগ করছে পর্তুলিকা। মেয়েটি প্রথমবার যখন এ বাড়িতে এসেছিল তখন কেমন ভীত, তটস্থ ছিল। একটু আগে পর্যন্ত ঠিকঠাক ডানা মেলতে ইতস্তত বোধ করছিল। অথচ এখন প্রজাপতির মতো উড়ছে। পর্তুলিকা নিজেও এখানে এলে কিশোরীর মতোন উচ্ছল হয়ে উঠেন।
‘ওটা গার্ডেনিয়া ফুল। এদিকে এসো। উপরের ছাদে তোমাকে একটা অদ্ভুত ফুল দেখাই।’
ছাদের উপরে আরেকটি ছোট ছাদ। পর্তুলিকার হাত ধরে লোহার সিড়ি বেয়ে আদ্রিকা উপরে চলে গেল। লাল রঙের একটি ফুল দেখিয়ে পর্তুলিকা মুখ চিপে হেসে বলল,
‘ওই ফুলটি দেখতে কেমন?’
‘দারুণ।’
‘কাছে গিয়ে দেখো।’
আদ্রিকা ছুটে ফুলটির কাছে গেল। কিন্তু বিশ্রী গন্ধে পেটের নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসার যোগাড়। দ্রুত পায়ে ফিরে এসে মুখ কুচকে বলল,
‘ইয়াক। কী বিশ্রী গন্ধ!’
এবারে হো হো করে গেসে পর্তুলিকা বলল,
‘ওর নাম ভুডু লিলি। দূর্গন্ধের জন্য বিখ্যাত।’
ওয়াক ওয়াক করতে করত্র আদ্রিকা ছাদের এককোণায় সরে গেল। মনে হচ্ছে এক্ষুণি বমে করে ফেলবে।
এপাশে একটি কাঠের বেঞ্চের উপর পর্তুলিকার কিছু রত্নকে যত্নে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কয়েকটি এডেনিয়াম বনসাই এর মাঝে একটি নির্দিষ্ট বনসাইকে দেখে আদ্রিকা থমকে গেল। বার কয়েক পলক ফেলে কম্পিত স্বরে আদ্রিকা ডাকল,
‘পিউ মা, এটা আপনার বনসাই?’
দুপুরের খাবারের পর থেকে আদ্রিকা নতুন নামে পর্তুলিকাকে ডাকছে৷ হয়তো ইবনূলের পিউ ডাক থেকে সে পিউ মা ডাকছে৷ শুনতে বেশ লাগছে পর্তুলিকার। সে এগিয়ে এসে আদ্রিকার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
‘এই বনসাইটি কয়েকদিন আগে কিনেছি। ফেসবুকে সেল পোস্ট দিয়েছিলো একটি নার্সারি। কয়েক রঙের ফুল আসে এই বাগানবিলাসে। দারুণ না?’
নিজের হাতে তৈরি বনসাইকে চিনতে আদ্রিকার খুব বেশি কষ্ট হলো না। হাত বাড়িয়ে পরম মমতায় ওর গা ছুয়ে দিতেই আদ্রিকার চোখের কোণে জল দেখা দিল। এতো আবেগ নিয়ে গাছটিকে ছুতে দেখে পর্তুলিকা বলল,
‘তোমার পছন্দ হয়েছে?’
‘হুম।’
‘তাহলে তুমি নিয়ে যাও।’
‘তাই হয় নাকি! এটাকে আমি কোথায় রাখব?’
‘ছাদে রাখবে। পরখের বাসার ছাদটা ফাঁকা পরে আছে। গাছ লাগাও না কেনো?’
‘লাগাব ভেবেছিলাম। কিন্তু কেনা হলো কোথায়! সময় পাইনি। তাছাড়া একা কোথায় যাবো গাছ কিনতে?’
‘আমি কিছু গাছ পাঠিয়ে দিবো। যাওয়ার সময় এই বনসাইটা নিয়ে যেও।’
‘উহু। ও থাক এখানে। আপনার কাছে যত্নে থাকবে।’
রাতে খাবার টেবিলে ইবনূল ইবতেহাজ বলল,
‘আজকের রাতটা এখানেই থেকে যাও।’
পর্তুলিকা ভয়ে ভয়ে তাকাল ছেলের দিকে। নতুন সদস্যের সামনে পিতা-পুত্র কোনো ঝামেলা না বাঁধালেই হয়। পরখ অবশ্য শান্ত ভাবেই জবাব দিল,
‘সম্ভব না। সকালে আমাকে কাজে যেতে হবে।’
‘কাজ! আজকাল কাজ করছো নাকি? বলোনি তো।’
‘তুমি জানো না? তোমার তো জানার কথা। আমার যাবতীয় সংবাদ আমার আগে তুমি পেয়ে যাও, এটা জানলে না কীভাবে? স্ট্রেঞ্জ!’
‘তোমার ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা ছেড়ে দিয়েছি। লিভ ইউর ওন লাইফ।’
‘হঠাৎ সুবুদ্ধি উদয় হলো যে! এতো উদারতার কারন?’
‘তোমার মা অনুরোধ করেছে। ছেলের বিয়ের পর তার ব্যক্তিগত জীবনের উপর নজরদারি মোটেও সমীচীন নয়। আশা করি নিজের স্বাধীনতার অপব্যবহার করবে না। ইউ নো, তোমার নামের সাথে আমার মান সম্মান জড়িয়ে আছে।’
‘তা কি ভুলতে পারি! না চাওয়া সত্বেও প্রতি মুহূর্তে তোমাকে নিজের সাথে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ইবনূল ইবতেহাজের ছেলে ইবতেহাজ পরখ।’
‘আই কান্ট হেল্প ইট। তা কি করছ আজকাল?’
‘শিক্ষকতা।’
‘কোথায়?’
‘আমার ভার্সিটিতে।’
‘নিজের বিজনেস ছেড়ে এই সামান্য স্যালারি জব করছ! চমৎকার।’
‘আমার সবচেয়ে বড় আফসোস কি জানো? তুমি কখনো আমাকে এপ্রিশিয়েট করলে না। হয়তো তুমি এপ্রিশিয়েট করতে জানোই না।’
‘এপ্রিশিয়েট করার মতো কাজ করলে অবশ্যই করতাম। আমার গর্ব করার মতো কোন কাজটা তুমি করেছো, বলতে পারবে?’
আলোচনা ক্রমশ উত্তেজনার দিকে মোড় নিচ্ছে দেখে উত্তপ্ত পরিবেশ শান্ত করতে পর্তুলিকা হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হলেন। ইবনূলের হাতে উপর হাত রেখে বললেন,
‘খাবার সময় আর কোনো কথা নয়। তোমরা কেনো যে খাবার টেবিলে বসে এসব আলাপ করতে শুরু করো! বাবু, তুই খাচ্ছিস না কেনো? চিংড়ির মালাইকারিটা একটু নে।’
পরখ শিক্ষকতা করছে, রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে ভার্সিটি যাচ্ছে সেই খবর আদ্রিকা জানে না। কয়েকবার জিজ্ঞাসা করার পরেও পরখ কখনও জানায়নি। উল্টো ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছে। আজ খাবার টেবিলে বসে কী অবলীলায় বলে দিল, সে শিক্ষকতা করছে। তবে আদ্রিকাকে জানাতে এতো কীসের সমস্যা?
আদ্রিকার ভীষণ মন খারাপ হচ্ছিলো। কিন্তু পর্তুলিকা মুখে বাবু ডাক শুনে সে স্থান, কাল, পরিস্থিতি ভুলে ফিক করে হেসে ফেলল। অন্য কেউ লক্ষ্য না করলেও পরখ ঠিকই লক্ষ্য করেছে। এবং আদ্রিকার হাসির কারন বুঝতে পেরে সে কটমট করে তাকাল। সেই দৃষ্টির সামনে মুহূর্তেই মুছে গেল আদ্রিকার মুখের হাসি। সে মাথা নিচু করে খাবারে মনোযোগ দিল।
চলবে…
#অক্ষরময়ী