#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৩২|
পরখ এবং রুমির অক্লান্ত পরিশ্রম এবং অভূতপূর্ব পরিকল্পনার দরুণ মাত্র এক সপ্তাহে উদ্বোধন সম্ভব হলো রেস্তোরাঁর। দশজন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করল নতুন রেস্তোরাঁটি। স্বল্প আয়োজনে অনাড়ম্বে যাত্রা শুরু করলেও অনলাইনের সুবাদে প্রথমদিনেই বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে শহরজুড়ে। খাবারের মান নিয়ে পরখের চিন্তা নেই। পশ্চিমা খাবার তৈরিতে রুমির জুড়ি মেলা ভার। সূচনায় খাবারের পদ রাখা হয়েছে সামান্য কিছু। খাবারের পাশাপাশি সাজসজ্জায় জোর দিয়েছে পরখ। আজকাল বাইরে খাবার খেতে যাওয়া বাহানামাত্র। লোকে আসে ছবি তুলতে এবং রিফ্রেশমেন্ট এর জন্য। তাই নানান আলোকসজ্জায় সজ্জিত রেস্তোরাঁয় রাখা হয়েছে কিছু ফটোবুথ।
প্রথমদিনে ক্রেতাদের প্রতিক্রিয়ায় সন্তুষ্ট রেস্তোরাঁর মালিকপক্ষ। সবাই মিলে হৈ-হুল্লোড়, কাজেকর্মে একটি পুরোদিন চোখের পলকে কেটে গেল।
সব গুছিয়ে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছে পরখের। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে পরখ আরেকবার সময় দেখে নিল। রাত দশটা বাজে। দুপুরের দিকে আদ্রিকা কয়েকবার কল দিয়েছিল। স্ক্রীনে ওর ফোন নম্বর দেখে প্রথমে বেশ অবাক হয়েছিল পরখ। হঠাৎ কল দিচ্ছে কেনো? কল রিসিভ করতেই যাচ্ছিলো তখনি রুমি ডাক দিল। ফোন সাইলেন্ট করে কাজে ফিরে গিয়েছিল পরখ। এরপর আরও কয়েকবার আদ্রিকা কল দিয়েছিল, পরখ রিসিভ করতে পারেনি। সঙ্গত কারনে কলব্যাক করাও সম্ভব হয়নি। কাজের মাঝে সেসব কথা ভুলেও গিয়েছিল পরখ। এখন বাড়ি ফিরে মনে পরল।
দরজা খুলে বাড়ির ভেতরের থমথমে পরিবেশ পরখকে খানিকটা বিচলিত করল। এই সময়টা আদ্রিকা রান্নাঘরেই থাকে। আজকে নেই। নিশ্চয়ই নিজের কক্ষে বই পড়ছে। তাকে বিরক্ত না করে বিনা সাড়াশব্দে পরখ নিজের কক্ষের দিকে চলে গেল। কক্ষের দরজা খুলে স্বাগত জানাল অন্ধকার। পরখ হাত বাড়িয়ে সুইচবোর্ডের সুইচ চেপে আলো জ্বালাল। এক পা বাড়িয়ে বিছানার দিকে তাকাতেই চমকে গিয়ে গা কেঁপে উঠল পরখের। আকস্মিক এহেন দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে ভয় পেয়ে দু পা পিছিয়ে গেল।
বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে আদ্রিকা। হাঁটুর উপর কনুই রেখে হাতের মুঠোয় মুখ রেখে মাথা নিচু করে বসেছিল। পরখ আলো জ্বালাতেই মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়েছে।
আদ্রিকাকে নিজের কক্ষে আশা করেনি পরখ। তাও আবার বাতি না জ্বালিয়ে অন্ধকারে বসে আছে! ভূত দেখার মতো চমকেছে সে। পরখ নিজেকে সামলে নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে বলল,
‘তুমি এখানে?’
আদ্রিকা জবাব দিল না। আগের মতোই এক দৃষ্টিতে পরখের দিকে তাকিয়ে রইল। গলার টাই সামান্য টেনে ঢিলা করে নিয়ে পরখ এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে। ল্যাপটপ ব্যাগটি টেবিলের উপর রেখে গায়ের কোর্ট খুলে হ্যাংগারে ঝুলিয়ে রাখল। দেয়ালে একটা মাঝারি আয়না ঝুলানো আছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে গলার টাই খুলতে খুলতে ঘাড় ফিরিয়ে আদ্রিকাকে দেখে নিল। সে এখনো কঠোর দৃষ্টি মেলে পরখকে দেখছে। সারাক্ষণ বকবক করে মাথা ধরিয়ে দেওয়া মানুষটি আজ এমন নীরবতা পালন করেছে কেনো? বেশ চিন্তিত দেখাল পরখকে। শুকনো জামাকাপড় হাতে নিয়ে আদ্রিকাকে আবারও প্রশ্ন করল,
‘কি হয়েছে? এভাবে বসে আছো কেনো? কলেজ থেকে ফিরে ফ্রেশ হওনি? এখনো বাইরের পোশাক পরে আছো!’
জবাব দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করল না আদ্রিকা। শুধু আরও শক্ত হলো ওর চোখ মুখ। মাথা উঁচু করে যেভাবে আদ্রিকার বড় বড় চোখ দুটো অপলক চেয়ে আছে, বেশ অস্বস্তি হলো পরখের। সরু চোখে আদ্রিকাকে পর্যবেক্ষণ করে পরখ বলল,
‘আজব! কিছু বলবে তো। এমন চুপ করে থাকার মানে কি?’
পরখ বিরক্ত হয়ে চলে গেল ফ্রেশ হতে। কক্ষে ফিরে দেখল পায়েচারি করছে আদ্রিকা। এবার পরখ আর বিশেষ ধ্যান দিল না। বই, খাতা নিয়ে বিছানায় শুয়ে হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল নিজের কাজে।
আদ্রিকা নিজের মতো কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে কথা গুছিয়ে নিল। দুপুরে যতটা রাগ লেগেছিল এখন আর ততোটা লাগছে না। সময়ের সাথে অনুভূতিগুলো ফিকে হয়ে যায়। আদ্রিকারও রাগ পরে গিয়ে কেমন নির্লিপ্ত লাগছে।
সে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে পরখের পাশে বসল। তড়িৎ গতিতে তৎক্ষণাৎ সামান্য সরে গেল পরখ। তীব্র অপমানবোধ করলেও সহ্য করে নিল আদ্রিকা। হতাশামূলক শ্বাস ফেলে শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইল,
‘ভার্সিটিতে আপনার ক্লাস শেষ হয় কয়টায়?’
হঠাৎ এমন প্রশ্নের কারন খুঁজে পেল না পরখ। আদ্রিকার অদ্ভুত আচরণের কারনও তার জানা নেই। সে বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে জবাব দিল,
‘সেটা তোমার কি প্রয়োজন?’
‘অবশ্যই আমার জানার প্রয়োজন আছে। আমি জানতে চাই ভার্সিটিতে আপনার কি এমন কাজ থাকে যে আপনি বাড়িতে এসে লাঞ্চ করার সময় পর্যন্ত পান না। আমি জানতে চাই আপনি রাত নয়টা পর্যন্ত বাইরে কি এমন কাজ করেন।’
পরখ মুখ তুলে আদ্রিকার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘তুমি বোধহয় তোমার অধিকারের সীমা ভুলে গিয়েছ। এই বাড়িতে থাকতে দিয়েছি বলে ভেবো না, আমার জীবনে তোমাকে ঠাঁই দিয়েছি। আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি তোমার সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক স্থাপনের কোনো ইচ্ছে কিংবা রুচি আমার নেই। এ বাড়িতে থাকো, খাও-দাও, নিজের কাজ করো। আমার জীবনে নাক গলাতে আসবে না। এই কথাগুলো আমি তোমাকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম, এখন আবার এসব নিয়ে কেনো কথা উঠছে আমি বুঝতে পারছি না।’
আদ্রিকা নিজের দু হাতে বাড়িয়ে খপ করে পরখের হাতের বইটি কেড়ে নিয়ে তা দ্বারা পরখের বুকের অনবরত আঘাত করতে করতে চিৎকার করে বলল,
‘বাকি সব বললেও আপনি এটা তো বলেননি, বাইরে মেয়ে দেখে ছুকছুক করার স্বভাব আছে আপনার। কেন বলেন নি? নিজের মুখে স্বীকার করতে লজ্জা লাগছিল?’
আকস্মিক ঘটনায় হতবাক পরখ। নিজের সাথে কি ঘটছে তা বুঝে উঠতে কিছুক্ষণ সময় লাগল। দু হাতে নিজেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টার পাশাপাশি জানতে চাইল,
‘হোয়াট ইজ ছুকছুক? আরে হয়েছে কি তোমার? এমন করছো কেনো?’
‘যেটা আপনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঐ মেয়েটার সাথে করতেছিলেন, ওটাকেই ছুকছুক করা বলে। নির্লজ্জ, বেহায়া পুরুষ মানুষ। হাসতে হাসতে অন্য মেয়েরগায়ের উপর পরার আগে একবারও মনে পরে না, বাড়িতে আপনার একটা বউ আছে?’
আদ্রিকার অভিযোগ শুনে এক মুহূর্তে পরখ থমকে গেল। কিন্তু আদ্রিকা থেমে নেই। ওকে থামাতে পরখ ধমক দিল।
‘একদম বাজে কথা বলবে না। ওসব তোমার স্বভাব।’
‘হ্যাঁ। দুনিয়ার সব বাজে স্বভাব তো আমারই। আর আপনি দুধে ধোয়া তুলসি পাতা। বাড়ি আসলে উনার মুখ দিয়ে একটা কথা বের হয় না। সারাদিন প্যাঁচার মতো মুখ গোমড়া করে ঘুরবে। আর বাইরে মেয়ে মানুষ দেখা মাত্র উনার মুখের হাসি যেনো ধরে না যেনো। সব পুরুষ মানুষ এক। ধোঁকাবাজ, বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক, প্রতারক।’
আর সহ্য হলো না পরখের। আদ্রিকার হাত দুটো নিজের দু হাতে বন্দী করে নিল। এক ঝটকায় পরখের বুকের উপর আছড়ে পরল আদ্রিকা। বুকের উপর হতে মাথা তুলে দেখল রক্তচক্ষু মেলে তাকিয়ে আছে পরখ। কঠোরভাবে হুঁশিয়ারি জানাল।
‘আর একটা বাজে কথা বললে খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু। থাপ্পড় খাবে আমার হাতে।’
আদ্রিকা আজ ভয় পেলো না। মুখ উঁচু করে পরখের চোখে চোখ রেখে বলল,
‘আপনি একটা চরিত্রহীন, লম্পট।’
ঘৃণায় মুখ বিকৃত হলো পরখের। এক হাতে ধাক্কা দিয়ে আদ্রিকাকে নিজের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে গ্রীষ্মের খরার মতো শুকনো মুখটি অন্যদিকে ফিরিয়ে বলল,
‘তুমি বের হও আমার রুম থেকে। এই মুহূর্তে বের হয়ে যাও। তুমি আমার সামনে থাকলে আমি কি করবো নিজেও জানি না।’
আদ্রিকা গেল না। পরখের পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পরে রইল। রাগ, হতাশা, দুঃখ মিলিয়ে ঝরতে লাগল অশ্রুকণারা। যা ধীরে ধীরে হাউমাউ কান্নায় পরিণত হল।
‘আমি কাছে গেলে এমনভাবে দূর দূর করে যেনো এক মহান সন্ন্যাসী, মনীষী। আমি উনার সাধনা ভঙ্গ করতে এসেছি। অথচ তিনি নিজেই রাস্তাঘাটে ন্যাকামী করে বেড়ায়। লজ্জা করে না আপনার? কাজের কথা বলে দিনরাত বাইরে ফষ্টিনষ্টি করে বেড়ান। ছি! মানুষ কাকে বিশ্বাস করবে!
এই সমাজে কি একটাও ভালো ছেলে নাই খোদা? সবাই এমন ক্যারেক্টারলেস কেনো? আমার কপালটাই খারাপ। যাকেই ভরসা করি সেই ধোঁকা দেয়।’
পরখ মূর্তির ন্যায় বসে আছে। নড়াচড়াও করতে পারছে না। বিরক্তিতে চোখ দুটো বুজে কপালে হাত রেখেছে। আদ্রিকা আরও কিছুক্ষণ কাঁদল। কান্নার এক পর্ব শেষ করে হঠাৎ উঠে সোজা হয়ে বসল। দু হাতের উল্টোপিঠে ভেজা চোখ মুছে নিজেই নিজেকে বলল,
‘যখন তখন কান্না করাও তো বারণ। গ্রীষ্ম, বর্ষা সব আবার এক করে দিচ্ছি আমি। নাহ, একদম কাঁদা যাবে না। আমি কাঁদছি কেনো? আমি কী অন্যায় করেছি! যে অন্যায় করেছে সে জোর গলায় কথা বলছে, আর আমি অযথা কেঁদেকেটে মরছি।’
জামাকাপড় ঝেড়ে চট করে দাঁড়িয়ে পরল। পরখের দিকে তাকাল না। চুপচাপ নিজের কক্ষে গিয়ে পোশাক পাল্টে একটা শাড়ি পরে নিল। আজকে আর সাজল না। চুলগুলো কোনোরকমে খোঁপা বেঁধে চলে গেল রান্নাঘরে। দুপুরে খাওয়া হয়নি। এখন জম্পেশ ক্ষুধা লেগেছে।
ফ্রিজে ঠান্ডা পোলাও রাখা আছে। সেগুলো দিয়ে চট করে ফ্রাইড রাইস করে নেওয়া যায়। সবজিগুলো ভালোভাবে ধুয়ে চপিংবোডে কাটতে শুরু করল।
পরখ কিছুক্ষণ অযথা বইপত্র নাড়াচাড়া করে বিছানা থেকে নামল। আদ্রিকা তাকে কোথায় দেখে ফেলেছে, সে বুঝতে পারছে না। আদ্রিকার থেকে আরও কিছু তথ্য জেনে নিলে বুঝতে সুবিধা হবে। কিন্তু ও এমন আবেগী হয়ে আছে যে কথা বলার আগে হাত পা ছুঁড়ছে।
পরখ কক্ষ ত্যাগ করল। রান্নাঘরে এসে দেখল আদ্রিকা সবজি কাটছে। বুকে দু হাত ভাঁজ করে রেখে রান্নাঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পরখ স্বাভাবিকভাবে জানতে চাইল,
‘এমন অদ্ভুত আচরণের মানে কি?’
আদ্রিকার হাতের ছু/ড়ি থেমে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে সে পরখের দিকে তাকাল। ডাকিনীর সেই দৃষ্টি দেখে পরখ সামান্য ঘাবড়ে গেলেও প্রকাশ করল না। সামান্য কঠোরতা প্রকাশ করতে হুমকি দিল।
‘আমার বাড়িতে থাকতে হলে ভদ্রভাবে থাকবে। এমন পাগলের মতো আচরণ আমি কিছুতেই বরদাস্ত করবো না। ’
কিছুক্ষণ কটমট করে তাকিয়ে থেকে আচানক হাতের কাছে সবজিগুলো একটা একটা করে তুলে নিয়ে সজোরে ছুঁড়ে মারতে শুরু করল আদ্রিকা। একটি টমেটো সোজা এসে আঘাত হানল পরখের কপালের ঠিক মাঝখানে। সেই আঘাত সামলে উঠার আগেই একটি গাজর এসে লাগল বুকে, অন্যটি পেটে। সামান্য ঝুঁকে এক হাতে পেট চেপে ধরে অন্যদিকে সরে দাঁড়িয়ে ব্যথায় কুকড়ে যাওয়া পরখ আর্তনাদ করে উঠল।
‘হোয়াট দ্যা হেল! আর ইউ আউট অফ ইউর মাইন্ড?’
সেই ধমকে কোনো কাজ হলো না। একের পর এক সবজি ছুঁড়ছে আদ্রিকা। পরখ ধমক দিল।
‘স্টপ ইট আদ্রিকা।’
সবজিগুলো রেখে আদ্রিকা এগিয়ে এসে পরখের সামনাসামনি দাঁড়াল। চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করল,
‘ওই মেয়েটা আমার থেকেও বেশি সুন্দর? চোখের মাথা খেয়েছেন আপনি? ভালোভাবে তাকিয়ে দেখেন আমার দিকে। ওই মেয়ের থেকে হাজারগুণে ভালো আছি আমি। এতো সুন্দর চেহারা! ফিগারও মাশাআল্লাহ।
কিন্তু ভালোকিছুতে আপনাদের মতো পুরুষ মানুষের রুচে না। ঘরের বিরিয়ানি নষ্ট পুরুষের ভালো লাগবে না। সে বাইরে গিয়ে পঁচা পান্তা ভাতটাই খাবে। যতো যাই করা হোক, নর্দমার কীট নোংরার কাছেই যায়। আপনার হয়েছে একই দশা। পার্থক্য শুধু আপনার এই ইনোসেন্ট চেহারায়। দেখলে বুঝা যায় না, আপনার মনের ভেতরে এতো নোংরামি।’
পরখ স্থির নয়নে শান্তভাবে কিছুপল আদ্রিকাকে পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে নিল। এক হাত রাখল আদ্রিকার গালে। অন্য হাত বাড়িয়ে আদ্রিকার কোমর ধরে ওকে নিজের কাছে নিয়ে এলো। ঠোঁটের সাথে ঠোঁট ছুঁই ছুঁই দূরত্ব বজায় রেখে বলল,
‘সবাইকে তোমার বয়ফ্রেন্ডের মতো ভেবে নিচ্ছো কেনো?’
রাগে আদ্রিকার শরীর কাঁপতে লাগল। গাল থেকে পরখের হাতটি সরিয়ে দিয়ে নিজেদের মধ্যকার দূরত্ব বাড়ানোর চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে গেল সে। কিন্তু পরখ হাত সরাল না। উল্টো কোমরে হ্যাচকা টান দিয়ে আদ্রিকাকে আরও কাছে টেনে নিয়ে বলল,
‘সবাই তোমার মতো সারাক্ষণ বিছানায় যাওয়ার পায়তারা করে না। আমাকে তোমাদের ভাবার ভুল করবে না। আমার ক্লাস তোমাদের থেকে অনেক উপরে।’
আদ্রিকার ইচ্ছে করল, এই অসভ্য লোকটার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয়। কিন্তু তার মায়ের শিক্ষা এ বিষয়ে কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
পরখের মুখে বিদ্রুপের হাসি আদ্রিকার সারা শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দিল। বুকের ভেতরটায় রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। কিন্তু সে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে, কারনে অকারনে কাঁদবে না। কান্না গিলে ফেলে পরখের চোখে চোখ রাখল। চোখ জোড়া সামান্য কুঞ্চিত করে বলল,
‘বাইরে থেকে ফিরেই সোজা গোসলে ঢুকলেন কেনো? কি করে এসেছেন? এতোক্ষণ কি ওই মেয়েটার বিছানায় ছিলেন? শুয়েছেন ওর সাথে?’
পরখের মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়ে মূহূর্তেই আঁধার নেমে এলো। রাগে চোখ মুখ কুঁচকে গেলো। আদ্রিকাকে পেছনের দিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। নিজে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
‘হোয়াট রাবিশ! একদম আজেবাজে বকবে না। আমি রোজ অফিস থেকে ফিরে শাওয়ার নেই। আজকে নতুন দেখছ?’
শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে নিয়ে কোমরে হাত রেখে দাঁড়াল আদ্রিকা। সন্দিহান কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
‘কোন অফিস রাত নয়টা পর্যন্ত চলে?’
পরখের কাছে কোনো জবাব নেই। তবুও সে আত্মবিশ্বাস নিয়ে আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে আছে। আদ্রিকা খুব ভালো করে জানে, পরখ যখনি বাড়ি ফিরুক না কেনো গোসল করে তবেই বিছানায় যায়। তবুও সুযোগের সৎ ব্যবহার করে বলল,
‘পিউ মাকে কল দিয়ে জানাই? উনার গুণধর পুত্র ভার্সিটির নাম করে রাত নয়টায় বাড়ি ফিরে। ভরা বাজারে অন্য মেয়ের গায়ের সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে থাকে। হা হা হি হি করে। চা খায়। আর বাড়ি ফিরে বউয়ের চরিত্র নিয়ে উলটাপালটা কথা বলে।’
‘ডোন্ট ইউ ডেয়ার।’
দাঁতে দাঁত চিপে শাসাল পরখ। বিপরীতে বাঁকা হেসে নিজের কাজে ফিরে গেল আদ্রিকা। খাবার প্রস্তুত করে একাই খেতে বসল। পরখকে ডাকল না। তবে টেবিলের উপর সশব্দে থালা-বাটি রাখায় যে শব্দ সৃষ্টি করছে তাতেই পরখের নিকট সংবাদ পৌঁছে গিয়েছে।
পরখ নিজেই এসে খাবার টেবিলে বসল। তার আয়ের টাকায় তৈরি খাবার। আমন্ত্রণের প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে! খাবার তুলে নিয়ে নীরবে খাবার খেলো দুজনে।
পরখের যা জানার ছিল, তা জানা হয়ে গেছে। আদ্রিকা তার মাকে কল করবে না, সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত। কল করতে হলে এতোক্ষণে করে ফেলত। চিন্তামুক্ত হয়ে সে ঘুমাতে চলে গেল। কিন্তু ঘুম আসছে না আদ্রিকার।
পরখের সাথে মেয়েটি কে ছিল, তা না জানা পর্যন্ত শান্তি মিলছে না। সে যতোই চিল্লিয়ে বলুক, সে বেশি সুন্দর। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আদ্রিকাও জানে সেই মেয়েটি যথেষ্ট সুন্দর ছিল। একনজরে যে কেনো পুরুষের পছন্দ হয়ে যাওয়ার মতো চেহারা।
রাত যতোই বাড়ছে আদ্রিকার পেট গুড়গুড় করছে। কক্ষ জুড়ে পায়েচারি করেও শান্তি মিলল না। এক সময় বাধ্য হয়ে কক্ষ ত্যাগ করল। ধীর পায়ে উপস্থিত হলো পরখের কক্ষে। সে মহাশয় নিশ্চিন্তে পাড়ি জমিয়েছে ঘুমের দেশে। নিশ্চয়ই সেই মেয়েটিকে নিয়ে কোনো সুখ স্বপ্ন দেখছে। তা না হলে মুখে এতো প্রশান্তির ছাপ থাকবে কেনো!
আদ্রিকার হঠাৎ মনে পরল, সে পরখের কাছে গেলে পরখ কিরকম গুটিয়ে যেতো। এর পেছনে কি ওই মেয়েটি রয়েছে? পরখ কি মেয়েটিকে ভালোবাসে? বাসে হয়তো। তাইতো আদ্রিকার সাথে ঘনিষ্ট হওয়াতে আগ্রহ দেখায় না।
নিজেকে খুব ছোট মনে হতে লাগল আদ্রিকার। সে কি কোনোভাবে দুজন ভালোবাসার মানুষের মাঝখানে চলে এসেছে? এমন যদি হয় তবে ব্যাপারটি আদ্রিকার জন্য ভীষণ লজ্জাজনক। পরখের সাথে ঘনিষ্ট সময় কাটানোর মুহূর্তগুলো হঠাৎ করে আদ্রিকাকে ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলে দিল।
কিন্তু ওর দোষটা কোথায়? নিজের স্বামীর কাছাকাছি যাওয়ার বাসনা অন্যায় হলো কবে থেকে! সে যদি জানত, পরখের গার্লফ্রেন্ড আছে তবে সে কখনোই জোর করে কাছে যেত না। এখানেও দোষ পরখের।
পরখের পাশের ফাঁকা স্থানটিতে আরাম করে বসে একদৃষ্টিতে পরখের ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে আদ্রিকা। এ কক্ষের জানালাটি সবসময় খোলা থাকে। রাতের বেলায় অবলীলায় কক্ষ জুড়ে খেলা করে চাঁদের আলো। আজও চাঁদের আলোয় আলোকিত কক্ষটি। রুপালি আলোয় পরখের হালকা বাদামি ত্বক উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে।
পুরুষালী রুক্ষ সৌন্দর্য্যে বিভোর হয়ে আদ্রিকা হাত বাড়িয়ে পরখের গাল ছুঁলো। পরখের ঘুম বেশ হালকা। চকিতে চোখ মেলে চাইল সে। হঠাৎ করে চোখের সামনে আদ্রিকাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে পরখ ভীষণভাবে চমকে গিয়ে নিজের জায়গায় স্থির হয়ে রইল।
পরখকে জেগে যেতে দেখেও ভাবান্তর হলো না আদ্রিকার। সে আগের মতোই নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে বলল,
‘কবে যেনো আমি আপনাকে বালিশ চাপা দিয়ে মে রে ফেলি।’
ততোক্ষণে পরখের অস্থির হৃদপিণ্ড শান্ত হয়ে এসেছে। বিরক্তিতে বুঁদ পরখ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘আমি মোটেও অবাক হবো না।’
ক্লান্ত চোখ জোড়া বন্ধ করে ঘুমের দেশে ফিরে যাওয়ার আগে আদ্রিকার উদ্দেশ্যে পরখ বলল,
‘দেখে মন ভরে গেলে নিজের রুমে ফিরে যেয়ো। এখানে ঘুমানোর চিন্তা একদম করবে না।’
পরিস্থিতি ভিন্ন হলে পরখের এমন আদেশ জারির পর আদ্রিকা জেদ দেখিয়ে এখানেই ঘুমিয়ে যেত। কিন্তু আজকে ইচ্ছে হলো না। নিজেকে নেহাৎ একজন তৃতীয় ব্যক্তি মনে হচ্ছে। কোনো সম্পর্কে উপস্থিত তৃতীয়ব্যক্তিকে সে আজীবন ঘৃণা করে এসেছে। নিজে কীভাবে সেই তৃতীয়ব্যক্তিতে রুপান্তর হবে? অসম্ভব। এমন নিম্নমানের কাজ তার দ্বারা সম্ভব নয়। সে ধীরেসুস্থে বিছানা থেকে নেমে চলে গেল নিজের কক্ষে।
চলবে…
#অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা
|৩৩|
বালিশের নিচে চাপা পরেছে মোবাইলটি। কানের নিকটে ভোঁ ভোঁ শব্দ করে কেঁপে উঠা মাত্র পরখের ঘুম ছুটে গেল৷ আকস্মিক কম্পনে সে খানিকটা ঘাবড়ে গেছে৷ তাই এলার্ম বন্ধ করে ধাতস্থ হতে কিছু সময় ব্যয় করল। আজকাল হুটহাট অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হওয়ার কারনে যে হারে হৃদপিণ্ডের উপর চাপ পরছে তাতে একদিন হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেলেও পরখ অবাক হবে না।
আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ত্যাগ করে বাইরে এসে দেখল আদ্রিকার কক্ষের দরজা এখনো বন্ধ। এদিকে টিকটিক করে বয়ে চলেছে ঘড়ির কাটা৷ রান্নাবান্না কখন করবে কে জানে! ঘুম থেকে উঠেছো তো? ও কি কলেজে যাবে না?
ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হওয়ার সময় পরখ আরেকবার আদ্রিকার কক্ষের দরজার দিকে তাকাল৷ আদ্রিকার দেখা না পেয়ে সে নিজেই পোশাক পরিধান করে চলে গেল রান্নাঘরে৷ রুটির ডো তৈরি করে রাখা আছে ফ্রিজে৷ দুজনের জন্য দুটো ডিম, পরোটা ভেজে টেবিলের উপর রেখে খানিকটা ইতস্ততভাবে আদ্রিকার দরজায় কড়া নাড়ল। ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ এলো না, দরজাও খুলল না। এর বেশি কিছু করা পরখের পক্ষে সম্ভব নয়। সে ফিরে এসে খাবার খেতে বসল।
কলেজর উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার একদম নির্দিষ্ট সময় দরজা খুলে বের হলো আদ্রিকা৷ বেগুনি রঙের একটি থ্রি পিস ওর গায়ে৷ চুলগুলো বেণি করেছে৷ কানে এক জোড়া ঝুমকা৷ দুই হাতে দুটো চিকন চুড়ি৷ কলেজ ব্যাগ এক কাঁধে ঝুলিয়ে গটগট করে হেঁটে পরখকে পাশ কাটিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷ তা দেখে পরখ বলল,
‘নাস্তা করে যাও।’
ঘাড় ফিরিয়ে কটমট করে চাইল আদ্রিকা৷ জিহ্বার ডগা পর্যন্ত কিছু কথা এসেছে। কিন্তু সকালবেলা আজেবাজে কথা বলতে মন সায় দিল না৷ নীরব দৃষ্টি দ্বারা ক্রোধ প্রকাশ করে সে আবারও হাঁটতে শুরু করল। স্লাইডিং ডোর খুলে বাইরে পা রাখতেই পরখ বলল,
‘দাঁড়াও।’
আদ্রিকা দাঁড়াল। ধীরেসুস্থে চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এলো পরখ। পকেট থেকে টাকা বের করে আদ্রিকার পেছনে দাঁড়িয়ে ব্যাগের চেইন খুলে তাতে টাকা রেখে দিয়ে চেইন বন্ধ করে দিল।
প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আদ্রিকা। তা দেখে পরখ বলল,
‘রিক্সা ভাড়া৷’
আদ্রিকার ইচ্ছে হল সেই টাকা পরখের মুখে ছুড়ে মারতে৷ কিন্তু টাকাটা ওর দরকার। বাড়ি থেকে না খেয়ে বেরিয়ে গেলেও কলেজে পৌঁছে নাস্তা করে নিতে হবে৷ ইতোমধ্যে ক্ষুধায় পেট গুড়গুড় করা শুরু করে দিয়েছে৷ রেগে গেলে আদ্রিকার প্রচন্ড ক্ষুধা লাগে৷ যতো বেশি রাগ ততো বেশি ক্ষুধা৷ গত রাতে একটুও ঘুম হয়নি৷ একটু পরপর ক্ষুধা লাগতেছিল।
শেষরাতে খাবারের খোঁজে গিয়েছিল রান্নাঘরে৷ ফ্রিজে তেমন কিছু রাখা নেই জানার পরেও সেখানে সন্ধান চালিয়েছে৷ আদ্রিকার কপাল ভালো ছিল বোধহয়। ফ্রিজ খুলে একটি এক পাউন্ডের ভ্যানিলা কেক পেয়ে গেল৷ ক্ষুধার চোটে এক বসায় পুরোটা খেয়ে নিয়েছে৷ খাওয়ার পর আদ্রিকার মনে হয়েছে, কেকের হাত পা নেই যে নিজে থেকে এসে ফ্রিজে ঢুকে বসে থাকবে৷ নিশ্চয়ই পরখ নিয়ে এসেছিল৷ কিন্তু সে রাক্ষসের মতো পুরোটা একাই খেয়ে নিল। পরখ যদি কেকের খোঁজ করে তখন কি বলবে?
সেই কেক নিয়ে সে এখনো যথেষ্ট ভয়ে আছে৷ এই বুঝি পরখ কেকের খোঁজ করল।
সকালবেলা ক্যান্টিনে সবজি খিচুড়ি পাওয়া যায়৷ যদিও খিচুড়িটা বেশ পাতলা। আদ্রিকার খুব একটা পছন্দ না৷ তবুও ক্ষুধার তাড়নায় গপগপ করে খাচ্ছে৷ সামনে বসে আছে আদ্রতা। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
‘না খেয়ে এসেছিস কেনো?’
‘রান্না করার সময় পাইনি।’
‘আস্তে খা৷ গলায় লাগবে।’
‘সময় নেই৷ ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।’
‘কি নিয়ে এতো রেগে আছিস?’
খাওয়া থামিয়ে মুখ তুলে আদ্রতার দিকে চাইল আদ্রিকা৷ গ্লাস থেকে পানি পান করে বলল,
‘রাগবো কেনো! আজব!’
‘এমন রাক্ষসের মতো খাচ্ছিস, তাই জিজ্ঞাসা করলাম৷’
‘খাওয়ার সাথে রাগের কি সম্পর্ক? ক্ষুধা লেগেছে তাই খাচ্ছি৷’
‘রাগ করে থাকলে তোর বেশি ক্ষুধা পায়।’
আদ্রিকাকে ওর নিজের থেকেও বেশি চিনে আদ্রতা। তাই অযথা তর্কে গেল না৷ খাওয়ায় ফিরে গিয়ে বলল,
‘বিশেষ কোনো কারনে রাগ করে নেই। যাস্ট একটা কথা ভাবছিলাম।’
‘কি কথা?’
‘ছেলেরা ঘরের বাইরে অনবরত কথা বলে, আড্ডার আসরে সবাইকে মাতিয়ে রাখে। আবার সেই ছেলেটাই বাড়ি ফিরলে মুখ গোমড়া করে থাকে কেন? বাড়িতে তার কি সমস্যা? বাড়ির লোকেদের সাথে কীসের শত্রুতা?’
‘কি জানি! ছেলেদের ব্যাপার ছেলেরা ভালো বলতে পারবে। কিন্তু তুই এ নিয়ে ভাবছিস কেন? পরখ কি কথাবার্তা খুব কম বলে?’
‘যেটুকু বলে তাই সহ্য করা যায় না৷ সে যতো কম কথা বলবে ততোই ভালো। আমার হঠাৎ মনে হলো আরকি। একটা মানুষের আচরণ বন্ধুমহলে একরকম, আবার বাড়িতে আরেকরকম। বন্ধুরা বলে ফানি, পরিবারের লোক বলে রাগী৷ কেন?’
‘এটার কারন হতে পারে পরিবেশ, পরিস্থিতি, আবহ। বন্ধুদের আড্ডায় যে মহল থাকে, তা বাড়িতে থাকে না৷ বন্ধুরা তাকে যেভাবে বুঝে বাড়ির লোকজন সেভাবে বুঝে না৷ হতে পারে সে বন্ধুদের সাথে যতোটা আন্তরিক, পরিবারের লোকজনের সাথে ততোটা নয়। বাড়িতে আমরা ভদ্রতা, শিষ্টাচারসহ কিছু নিময়কানুন মেনে চলতে বাধ্য থাকি৷ কিন্তু বন্ধুমহলে নিয়মনীতির বালাই নেই৷ জাজ করার কেউ নেই৷ তাই বন্ধুমহলে আমরা নিজের উচ্ছ্বলতা প্রকাশ করি নির্দ্বিধায়।’
‘বাড়িতেও যদি একই পরিবেশ তাদের দেওয়া হয় তবুও তারা হাসবে না। বেশিরভাগ কর্মজীবী মানুষ লটকানো মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরে৷ এই ক্যান্টিনের মামাকে দেখো। সারাদিন আমাদের সাথে হাসি মুখে কতো কথা বলে, অথচ তার বাড়িতে গিয়ে দেখো খোঁজ নেও। সে যে হাসতে জানে সেটাই বোধহয় তার পরিবারের লোকজন জানে না।’
‘আমার কি মনে হয় জানিস, প্রতিটি মানুষের কথা বলার একটি নির্দিষ্ট সীমা আছে। সারাদিন একটি নির্দিষ্ট সংখ্যাক কথা বলার পর আমাদের আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না৷ তখন আমাদের মস্তিষ্ক বিশ্রাম চায়। আমরা বাইরে কথা বলে নিজের লিমিট শেষ করে ফেলি৷ এরপর ক্লান্ত মস্তিষ্ক নিয়ে বাড়ি ফিরি৷ তখন আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না, হাসতে ইচ্ছে করে না৷ মস্তিষ্ক বিশ্রাম চায়। তাই বাড়ি ফিরে বেশিরভাগ মানুষ চুপ হয়ে যায়।’
‘এতে পরিবারের লোকজনের সাথে অন্যায় হয়ে গেল না?’
‘হলে হলো৷ এতো কিছু কে ভাবে!’
‘চুপচাপ মেনে নিতে বলছ?’
‘এছাড়া কোনো উপায় আছে?
‘কোনো সমাধান নেই?’
‘আছে হয়তো৷ তবে সমাধান চাইলে দু’পক্ষকেই কিছু ছাড় দিতে হবে৷ পুরুষেরা সামান্য এনার্জি জমিয়ে রাখল বাড়ি ফিরে ব্যয় করার জন্য। ঘরের ভেতর ঢুকে সবার দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত মুখে মুচকি একটি হাসি দিল৷ বিনিময়ে পরিবারের লোকজন শান্ত একটি পরিবেশ দিল পুরুষটিকে৷ রাতের বেলা ঘুমানোর আগে পুরুষটিকে তার পরিবারকে আধাঘন্টা সময় দিতে পারে, গল্প করতে পারে৷ প্রতিদিন সময় দিতে না পারলে সপ্তাহ শেষে অন্তত শুক্রবার পরিবারের সবার সাথে সময় কাটাতে পারে৷ পরিবারের লোকজন না হয় তাকে বাকি ছয়টি দিন ছুটি দিল। মূলত দু পক্ষের ছাড় দেওয়া, মানিয়ে নেওয়া জরুরি।’
‘তুমি যতো যাই বলো, সংসারের মূল স্তম্ভ কিন্তু পুরুষ। সে চাইলে সবাইকে সুখে রাখতে পারে আবার সবার অশান্তির কারনও হতে পারে৷ কারণ পরিবারের প্রতিটি মানুষ তার উপর নির্ভরশীল। তাই তার কথা মানতে বাধ্য থাকে।’
‘আবার একটি পুরুষকে একটি নারী নিজের ইচ্ছে মতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে৷ নারী-পুরুষ একে অপরের বিপ্রতীপ কোণের মতো। একজনের প্রভাব আরেকজনের উপর সরাসরি পরে৷ নারী পুরুষ একে অপরের গুরুত্ব বুঝলে সংসারে কোনো ঝামেলাই হতো না৷
আমাদের বাবা মায়ের কথা চিন্তা কর৷ বাবাকে ছাড়া মায়ের কোনো অস্তিত্ব নেই। এটা মা জানে৷ তাই সবার উপরে রেখেছে তাকে৷ আবার মাকে ছাড়া বাবাও অচল। কিন্তু সে সেটা মানতে চায় না। এই বোধটা তার নেই বলেই নিজের স্ত্রীকে সে দূরছাই করে৷’
ক্লাসের পুরোটা সময় আদ্রতার কথাগুলো আদ্রিকাকে ভাবাল। পরখকে ছাড়া সে অচল কিন্তু পরখ? সে আদ্রিকাকে ছাড়া দিব্যি টিকে থাকতে পারবে। এটা পরখ জানে। তাই আদ্রিকাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় না। আদ্রিকার উচিত পরখের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠা। কিন্তু কীভাবে? এখন আবার এক শাকচুন্নির খোঁজ মিলেছে। যার কথা ভাবতেই আদ্রিকার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
সকালে ভরপেট খাওয়ার ফলে টিফিনের সময় ক্যান্টিনে না গিয়ে ক্লাসে বসে আছে আদ্রিকা৷ ছেলে মেয়েরা খাওয়া শেষ করে হেলেদুলে ক্লাসে ঢুকছে৷ কয়েকজনের দৃষ্টি শেষ বেঞ্চে বসে থাকা আদ্রিকার দিকে। আদ্রিকা স্পষ্ট বুঝতে পারছে, ওরা আদ্রিকাকে নিয়ে বিদ্রুপ করছে। আদ্রিকা গুরুত্ব না দিয়ে নিজের খাতায় নোট করতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
একটি মেয়ে এগিয়ে এসে আদ্রিকার পাশে বসে পরল৷ ন্যাকামি করে প্রশ্ন করল,
‘বিয়ে করেছিস নাকি? হাতে চুড়ি পরেছিস দেখছি।’
আদ্রিকা উত্তর না দিয়ে হাতটি সরিয়ে নিল। সামনে বেঞ্চে এসে যে মেয়েটি বসেছে সে আদ্রিকার নাকের ডগায় আঙ্গুল দিয়ে টোকা দিয়ে বলল,
‘তুই এই গরুর দড়িটা এখনো খুলিস নি! গাভীর মতো দেখাচ্ছে এখন।’
পুরো ক্লাস জুড়ে হাসির রোল পরে গেল। ফিসফিস শব্দে মুখোরিত পুরো ক্লাসরুম। আদ্রিকা রাগান্বিত দৃষ্টি মেলে সবাইকে একবার দেখে নিয়ে সামনে বসে থাকা মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল,
‘নোলক পরে আমাকে কেমন দেখাচ্ছে সে কথা আমি তোমার কাছে জানতে চেয়েছি? তুমি আগবাড়িয়ে জানাতে আসছ কেনো? আমাকে গরুর মতো দেখাক আর গাভীর মতো দেখাক তাতে তোমার কি? তোমাকে বিশ্বসুন্দরী দেখাচ্ছে সেটা নিয়ে খুশি থাকো। আমাকে জ্ঞান দিতে আসবে না।’
মেয়েটি হকচকিয়ে বান্ধবীদের দিকে তাকাল সাহায্যের আশায়। কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না। সাহস হারিয়ে ফেলল মেয়েটি। অপমানিত বোধে মাথা হেঁট হয়ে এলেও জবাব দিতে ভুলল না।
‘বাজে দেখাচ্ছে বলেই জানালাম৷ আজকাল দেখছি মানুষের উপকার করতে নেই।’
‘কেউ চেয়েছে তোমার উপকার? আমি বলেছি, এসো আমার উপকার করো? অন্যের জীবনে নাক না গলিয়ে নিজের চড়কায় তেল দেও।’
পাশের মেয়েটি ঝট করে দাঁড়িয়ে বলল,
‘তুমি এমন অভদ্রের মতো কথা বলছো কেনো? আমি ম্যামকে বলে দিবো, তুমি আমাদের উপর চিৎকার চেচামেচি করেছো।’
‘যাও গিয়ে বলো৷ ম্যাম নিশ্চয়ই জানতে চাইবে কেনো তোমাদের সাথে চিৎকার করে বলেছি৷ আমিও বলবো, তোমরা আমাকে টিজ করছিলে।’
‘আমরা কখন টিজ করলাম! তোমাকে ভালো দেখাচ্ছে তাই জানাতে এলাম। বন্ধুদের সাথে নর্মালি কথা বলাও যাবে না? তোমার ফ্যাশন সেন্সের সাথে তোমার আচরণও জঘন্য৷’
‘প্রথমত তোমরা আমার বন্ধু নও, সহপাঠী মাত্র৷ দ্বিতীয়ত, আমার সাজসজ্জা নিয়ে কথা বলা আমার পছন্দ না। যেটা তোমরা এর আগেও করেছো। অনেকক্ষণ থেকে তোমরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিলে। কী ভেবেছো আনি লক্ষ্য করিনি? আমি ঠিকই দেখেছি। কিন্তু গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করিনি৷ আলোচনা করার শখ থাকলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করো। আমি কিছু বলবো না। কিন্তু আর কখনো আমার সাথে এসব ফাজলামি করতে আসবে না। আমার মেজাজ আজকে এমনিতেই ভালো নেই৷ বিরক্ত করতে এসো না৷ যাও এখান থেকে।’
বন্ধ খাতাটি খুলে আবারও লিখতে শুরু করল আদ্রিকা। ছেলে মেয়েরা আগ্রহ হারিয়ে যে যার মতো নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।
ছুটির ঘন্টা পরা মাত্র ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলো আদ্রিকা৷ আজকের দিনটাই খারাপ। সকালে যেটুকু মেজাজ খারাপ ছিল, ক্লাসের বেয়াদবগুলো সেটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে৷ মাথার ভেতর শিরাগুলো দপদপ করছে। কাউকে দু চারটে চটকানা মারতে পারলে ভালো লাগত৷ গতকালকে পরখকে মেরে রাগটা কিছুটা কমেছে৷ আজকেও মারতে পারলে ভালো হতো। চট করে রাগ কমে যাবে৷
বাড়ি ফিরে ঝগড়া বাধানোর বাহানা খোঁজা লাগবে৷ কিন্তু কষ্টের বিষয় হচ্ছে, চাইলেই পরখের সাথে ঝগড়া বাঁধানো যায় না৷ দশটি কথার বিপরীতে পরখ জবাব দেয় একটি৷ দুজন ব্যক্তি মনোযোগ দিয়ে তর্ক বিতর্ক না করলে ঝগড়াটা ঠিক জমে না৷
ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে প্রধান ফটকের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে আদ্রিকা। পেছন থেকে দৌড়ে এসে আদ্রিকার পাশে হাঁটতে শুরু করল একটি ছেলে। আদ্রিকা পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল। ছেলেটিকে সে চিনে৷ আদ্রিকার ক্লাসেই পড়ে। ওর নাম ইফফাত।
ক্লাস ক্যাপ্টেন ইফফাত আদ্রিকার পাশে দাঁড়িয়েছে বিশ্বাস হচ্ছে না আদ্রিকার। ইফফাতের নিজের বন্ধুমহল আছে৷ মোট ছয়জন ছেলে ওদের দলে। এর বাইরে ওরা কারো সাথে বিশেষ কথাবার্তা বলে না।
আদ্রিকা থমকে দাঁড়াতে দেখে ইফফাত আলতো হেসে বলল,
‘অনেকদিন পর কলেজে এলে।’
ইফফাত ওকে খেয়াল করেছে ভেবেই আদ্রিকার হৃদয় উৎফুল্ল হলো। ক্লাসের কেউ ওর সাথে কথা বলে না, মিশে না। বন্ধুহীন আদ্রিকা ইফফাতের বন্ধুভাবাপন্ন আচরণে ভীষণ খুশি হলো। ইফফাত জ্ঞানী এবং গুণী। ফুটবল খেলে, ক্লাসের সবসময় টপ করে। উচ্চতায় বেশ লম্বা, শক্তপোক্ত শারীরিক গঠন। বালকসুলভ সৌন্দর্য খোলস ছাড়িয়ে যুবকের কাঠিন্য প্রকাশ পেয়েছে মাত্র৷ এমনিতেই ইফফাত সবসময় চর্চায় থাকে ওর গাম্ভীর্যপূর্ণ আচরণের কারনে৷ মেয়েদের সাথে খুব কম কথাবার্তা বলে সে৷ পড়াশোনা, খেলাধুলা নিয়ে সদা ব্যস্ত ইফফাত নিজে থেকে এসে আদ্রিকার সাথে কথা বলতে পারে, তা কল্পনার বাইরে ছিল আদ্রিকার৷
সামান্য ঘাবড়ে গিয়ে আদ্রিকা জবাব দিল,
‘কয়েকমাস পর।’
‘দাঁড়িয়ে পরলে কেনো? বাড়ি ফিরবে না?’
‘হ্যাঁ।’
‘চলো একসাথে যাই।’
হাঁটতে গিয়ে পরখের কথা মনে পরে গেল আদ্রিকার। ইফফাতের সাথে ওকে দেখে ফেললে আবার নিশ্চয়ই উল্টাপাল্টা কথা শোনাবে৷ যার মানসিকতা নিম্নমানের, সে যা দেখে তাতেই নোংরামি খুঁজে পায়।
ইফফাতের আগমনে আদ্রিকার মনে বন্ধুত্বসুলভ যে অনুভূতি জন্ম নিয়েছিল, তা পরখের প্রতিক্রিয়ার কথা স্মরণ করে মিইয়ে গেল। স্বচ্ছল, নির্মল মনের আদ্রিকা খানিকটা কঠিনভাবে চিন্তা করতে বাধ্য হলো। সাবধানতা অবলম্বন করে দুজনের মধ্যে সামান্য দুরত্ব রেখে হাঁটতে থাকল সে।
ইফফাত হঠাৎ প্রশ্ন করল,
‘এতোদিন কলেজে আসোনি কেনো?’
মুখে জোরপূর্বক হাসি ঝুলিয়ে আদ্রিকা বলল,
‘ফ্যামিলি প্রবলেম।’
‘সামনে পরীক্ষা। যে ক্লাসগুলো মিস দিয়েছো সেগুলো কভার করতে পারবে?’
‘চেষ্টা করছি। সময় একটু বেশি দিতে হবে মনে হচ্ছে।’
‘কোথাও আটকে গেলে আমাকে জানিও। আমার কাছে নোট করা আছে।’
‘ঠিক আছে।’
বাইরে এসে ইফফাত নিজেই আদ্রিকার জন্য একটি রিক্সা ডেকে দিল। চলে যাওয়ার আগে আদ্রিকার উদ্দেশ্যে বলল,
‘নোলক পরে তোমাকে খুব সুন্দর দেখায়। ওরা এমনিতে মজা করছিল।’
আদ্রিকা লাজুক হেসে নাকের নোলকটি ছুঁয়ে দেখল। আদ্রিকার রিক্সাটি চলে গেলে ইফফাত সেখানে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। যতোক্ষণ আদ্রিকার রিক্সাটি দেখা গেল, সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মৃদু হাসল।
চলবে..
#অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা
|৩৪|
সারাদিন ভ্যাপসা গরমের পর বিকালবেলা শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। স্লাইডিং ডোরে হেলান দিয়ে বৃষ্টি দেখছে আদ্রিকা। সকালের তপ্ত মন জমিনে এখন শীতল বাতাস। কারো সাথে কথা বলতে পারলে আদ্রিকার মন ভালো হয়ে যায়। দুঃখ, কষ্ট, রাগ, হতাশা – সে যে কোনো অনুভূতি হোক না কেনো, জাহির করা মাত্র ফিকে হয়ে আসে৷
কলেজ থেকে বের হওয়ার সময় ইফফাতের সাথে কথা বলার ফলে মনটা এখন বেশ ফুরফুরে। কিছুক্ষণ বৃষ্টি দেখে আদ্রিকা ঘরে ফিরে গেল। বৃষ্টির দিনে ঝাল জাতীয় কিছু খেতে ইচ্ছে করে৷ আদ্রিকা চাল এবং বাদাম ভেজে পেয়াজ, মরিচ, সরিষা তেল দিয়ে মাখল৷ চুলায় চায়ের পানি বসিয়েছে মাত্র, তখনি আধভেজা হয়ে বাড়ি ফিরল পরখ। মাথার চুল থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। শার্টটা আধভেজা।
আদ্রিকার দিকে একনজর তাকিয়ে পরখ সোজা চলে নিজের কক্ষে। ভেজা জামা কাপড় থেকে পানি ঝরে মেঝে ভিজে গেছে। আদ্রিকার ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এগুলো আবার পরিষ্কার করতে হবে। ব্যাগপত্র রেখে পরখ ওয়াশরুমে প্রবেশ করতে যাওয়ায় পুরো বসার ঘর ভরে গেল ভেজা পায়ের ছাপে৷
পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে পরখকে আদ্রিকা নিশ্চিত একটা ধমক দিতো৷ কিন্তু আপাতত পরখের সাথে আদ্রিকার কথাবার্তা বন্ধ৷ তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কিছু বলা হলো না। শুকনো ন্যাকড়া দিয়ে দ্রুত মেঝে মুছে নিল৷
ওয়াশরুম থেকে পরখ বের হলো মাথা মুছতে মুছতে৷ কক্ষে যেতে যেতে দুটো হাঁচিও দিল৷ তা দেখে ভীষণ মায়া হলো আদ্রিকার৷ চায়ের পাতিলে আরেক কাপ পানি ঢেলে দিল৷ মশলা দিয়ে কড়া লিকারের চা বানিয়ে চালভাজা মাখাসহ নিয়ে গেল পরখের কক্ষে৷
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল আঁচড়াচ্ছিল পরখ৷ গটগট করে হেঁটে কক্ষে প্রবেশ করে সশব্দে চায়ের কাপ টেবিলের উপর রাখল আদ্রিকা৷ চমকে উঠে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল পরখ। আদ্রিকা কোনোদিকে তাকাল না৷ পাথুরে মুখে কক্ষ ত্যাগ করছিল তখনি বিছানার উপর পরখের মোবাইলটি বেজে উঠল৷
না চাইতেও আদ্রিকার নজর চলে গেল সেখানে। হোয়াটসঅ্যাপে অডিও কল এসেছে৷ তাতে আদ্রিকার আগ্রহ নেই৷ ওর সমস্ত আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হলো কলার আইডির ছবিটি৷ শাড়ি পরিহিতা হাস্যোজ্জ্বল রমণীর ছবি দেখে থমকে চোখজোড়া স্থির হলো৷ সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে সেদিনের মেয়েটির সাথে মিলানোর চেষ্টা করল কিন্তু মিলল না৷ এ আবার নতুন কে?
পরখ দেখল ওর মোবাইলের উপর ঝুঁকে সরু চোখে তাকিয়ে আছে আদ্রিকা। সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মোবাইলটি তুলে নিতেই সরু চোখ দুটো নিবদ্ধ হলো ওর দিকে। পরখ কলটি কেটে দিয়ে মোবাইলটি পকেটে রেখে বলল,
‘ওভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?’
বুকের উপর হাত দুটো ভাঁজ করে রেখে আদ্রিকা প্রশ্ন করল,
‘মেয়েটা কে?’
‘যেই হোক, তাতে তোমার কি?’
‘কল রিসিভ না করে কেটে দিলেন কেনো?’
‘আমার ইচ্ছে৷’
‘আমি সামনে আছি বলে কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছে? ওই মেয়ের সাথে কি এমন কথা বলেন যে আমার সামনে কথা বলা যায় না? একলা ঘরে আপনি এইসব করেন! এজন্য আমার সাথে শুতে আপনার নানান তালবাহানা।’
‘কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?’
‘যেখানকার কথা সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি৷ আমার সামনে সাধু সন্ন্যাসী সেজে ঘুরে বেড়ান আর ভেতরে ভেতরে এইসব। আজকে এই মেয়ে, কালকে ওই মেয়ে আর বাড়ি ফিরে বউয়ের সামনে উনি অলি আউলিয়া৷ বাহ রে বাহ! আমি উনাকে কী না কী ভেবে বসে আছি। উনি ভুলেও মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকায় না৷ কখনো একটু আধটু চোখ পরে গেলে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নেয়৷ মনে আছে সেদিন একটু ওড়না ছাড়া সামনে আসছিলাম জন্য কতো বিশ্রী ব্যবহার করছিলেন আমার সাথে? আমার সামনে আজাইরা নাটক করেন। বাজে লোক একটা। ভদ্র মানুষের মুখোশে আপনি একটা মেয়েবাজ পুরুষ।’
রেগেমেগে ফুলকো লুচির মতো মুখ নিয়ে বেরিয়ে গেল আদ্রিকা৷ বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে পরখের মুখ। এমন বিশ্রী অপবাদের বিপরীতে কী উত্তর বুঝে উঠতে পারল না। পকেটের মোবাইলটি আরেকবার বেজে উঠল।
কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সালাম দিল টেন ব্যাচের সিআর অর্পিতা। সালামের জবাব দিয়ে পরখ জিজ্ঞাসা করল,
‘সবার এসাইনমেন্ট কমপ্লিট হয়েছে?’
‘জ্বি স্যার।’
‘সাতটার আগেই সবাইকে মেইল করে দিতে বলবেন।’
‘ঠিক আছে স্যার।’
কল কেটে দিয়ে পরখ চায়ের কাপ এবং নাস্তার প্লেট হাতে নিয়ে বাইরে এলো। খাবারের টেবিলে বসে কুটকুট করে চাল চিবোচ্ছে আদ্রিকা৷ কাপ, প্লেট টেবিলের উপর রেখে দিয়ে পরখ বলল,
‘তোমার আচরণ এবং মুখের ভাষা দুটোই দিনদিন নোংরা হয়ে যাচ্ছে।’
কোনোদিকে না তাকিয়ে ওভাবেই বসে থেকে আদ্রিকা জবাব দিল,
‘সঙ্গদোষ। একটা নোংরা মানুষের সাথে বসবাস করার কুফল। তার মতো আমারও মুখের ভাষা এবং চিন্তাভাবনা কুৎসিত হয়ে গেছে। ’
পরখ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কক্ষের দিকে ফিরে যাওয়া জন্য উদ্যত হতেই আদ্রিকা আবারও বলল,
‘এই খাবার নষ্ট করলে আজকে থেকে আপনার খাওয়াদাওয়া বন্ধ৷ বান্ধবীদের বাড়ি থেকে খেয়ে আসিয়েন।’
পরখ ফিরে এসে চায়ের কাপ, চালভাজার প্লেট তুলে নিয়ে চলে গেল।
*****
গত দুটো দিন দারুণ কেটেছে পরখের৷ বাড়ির পরিবেশে শান্তির আবহ৷ কেউ কোনো কথা বলছে না, অকারণ বিরক্ত করতে আসছে না৷ আদ্রিকা রোজ এমন রাগ করে থাকলে বেশ হতো৷ পরখের আশেপাশে না এসে নিজের মতো থাকত, বেশি কথা না বলে মুখ গোমড়া করে ঘুরত। এর থেকে শান্তির আর কিছু হয় নাকি!
জম্পেশ একটা ঘুম দিয়ে সকালবেলা ঝরঝরে শরীর নিয়ে বিছানা ছাড়ল পরখ। রান্নাঘরে ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে আদ্রিকা। দু হাতে দুপুরের রান্না, সকালের নাস্তা তৈরি করতে গিয়ে নাভিশ্বাস দশা৷ পরখ চাইলেই সাহায্য করতে পারত। কিন্তু গতকাল আদ্রিকা ওকে মেয়েবাজ বলেছে, তাই সাহায্য করতে গেল না।
ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার আগে অবশ্য আদ্রিকার তৈরি নাস্তা খেতে ভুলল না।
একটি মানুষের সম্পূর্ণ বিপরীত দুটো সত্তার পরিচয়ে হতবাক আদ্রিকা৷ বাড়িতে পরখের আচরণ এবং বাইরে পরখের আচরণের মধ্যে আকাশ জমিন তফাৎ। আদ্রিকা ভেবেছিল, ওর সাথে ঘুমাতে পরখের অস্বস্তি হয়। জোর জবরদস্তির বিয়েতে অস্বস্তি হওয়া স্বাভাবিক। তাছাড়া আদ্রিকা খেয়াল করেছে পরখ বেশ খুতখুতে স্বভাবের। নিজের খেয়াল খুশি মতো চলতে পছন্দ করে৷ পরখের উপর কিছু চাপিয়ে দিলে তাতে হিতে বিপরীত হয়। মুখে কিছু বলে না, কিন্তু মনে তীব্র অভিমান বাসা বাঁধে। নীরবে সরে আসে সেখান থেকে৷
জোর করে পরখের পাশে জায়গা করে নেওয়ায় আদ্রিকার থেকেও যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়? যদি নীরবে সরে যায়? সেই ভয়ে আদ্রিকা খুব একটা জোর করেনি৷ মাঝেমধ্যে একটু জ্বালাতে অবশ্য মন্দ লাগে না। সেইটুকুতেই পরখ যা প্রতিক্রিয়া দেখায়, হজম করতে সপ্তাহখানেক লেগে যায় আদ্রিকার৷
ক্যান্টিনে বসে নিজের এলোমেলো জীবন নিয়ে ভাবছিল আদ্রিকা। ইফফাত এসে নীরবে পাশের স্থানটি নিজের দখলে নিল। আদ্রিকা কিছু অর্ডার করেনি দেখে ইফফাত বলল,
‘পড়াশোনার চিন্তায় এতোটাও মগ্ন থাকা উচিত নয় যে নাওয়াখাওয়া ভুলে যেতে হয়।’
ধ্যান ভাঙ্গল আদ্রিকার। ইফফাতকে দেখে ভীষণ খুশি হলো। মেঘলার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর ও আর কলেজে আসে না৷ পড়াশোনা বাদ দিয়েছে। কলেজে এলেও আদ্রিকা মনে হয় মেঘলার সাথে আগের মতো স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলতে পারত না। মেঘলা কলেজে না আসায় বরং ভালোই হয়েছে। কোনো অপ্রস্তুত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে না আদ্রিকাকে।
কিন্তু কলেজের এইটুকু সময় আদ্রিকা ভীষণ একাকিত্ব অনুভব করে। আশেপাশে সবাই দলেবলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আদ্রিকা সম্পূর্ণ একা। কেউ ওর দিকে ফিরেও তাকায় না। বন্ধুহীন শিক্ষাজীবন এর থেকে ভয়াবহ জীবন আর দুটো নেই। প্রতিমুহূর্তে অদ্ভুত হতাশা গ্রাস করে নেয় আদ্রিকাকে। তা থেকে মুক্তি দিতেই বুঝি ইফফাতের আগমন।
একটু অভিনয় মিশ্রিত মুখটি গোমড়া করে আদ্রিকা বলল,
‘আমি মোটেও এতো পড়ুয়া স্টুডেন্ট নই। সারাক্ষণ পড়াশোনা করলে তোমার মতো টপার হতাম।’
‘টপার হতে বেশি পড়াশোনা করতে হয় না। সিস্টেমিক ওয়েতে কিছুক্ষণ পড়াশোনা করলেই হয়ে যায়।’
‘টপার হওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। পাশ করতে পারলেই আলহামদুলিল্লাহ।’
‘তবে খাবার অর্ডার না করে কি নিয়ে এতো ভাবছিলে?’
‘ভাবছিলাম, রাতে কি রান্না করবো? বেগুন ভাজি নাকি আলু ভাজি?’
ইফফাত হো হো করে হেসে উঠল। আশেপাশের সবাইক ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ওদের দিকে৷ আদ্রিকা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে জানতে চাইল,
‘এতো হাসার কি হলো?’
হাসি থামিয়ে অবাক স্বরে প্রশ্ন করল ইফফাত,
‘তুমি রাধতে পারো?’
‘হ্যাঁ।’
‘সব রান্না পারো?’
‘মোটামুটি।’
‘চিকেন, মাটন, ফ্রাইড রাইস, পিজ্জা, বার্গার, মিটবল – সবকিছু?’
‘ঘরের সাধারণ রান্নাগুলো পারি। এসব পিজ্জা, বার্গার আমার জন্য না।’
‘ওয়াও! তুমি দেখছি ভীষণ গুণী।’
‘এখানের গুণের কি দেখলে?’
‘বাহ রে, এতো এতো রান্নাবান্না পারো। এটা গুণ নয়? আমি তো ডিমটাও ভাজতে পারি না।’
‘এ আর এমন কি! মেয়েরা রান্নাবান্না জানবে এটাই তো স্বাভাবিক। রান্না ছেলেদের কাজ নাকি?’
‘কেনো নয়? কোথায় লেখা আছে, রান্না শুধু মেয়েদের কাজ? বড় বড় হোটেল, রেস্টুরেন্টের বেশিরভাগ শেফ কিন্তু পুরুষ। অনুষ্ঠানগুলোতেও পুরুষ বাবুর্চি রান্নাবান্না করে৷’
‘ওহ হ্যাঁ। তাই তো। খেয়াল করিনি।’
‘তুমি নিজস্ব চিন্তার বাইরে আর কিছু খেয়াল করো?’
‘মানে?’
‘কিছু না। কি খাবে বলো?’
‘সমুচা৷’
‘আমি নিয়ে আসছি।’
কলেজ ছুটির পর আজকেও ইফফাত আদ্রিকাকে রিক্সায় তুলে দিয়ে তবেই গেল৷
রিক্সায় বসে আদ্রিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকাচ্ছে। আজকে পরখকে কোনো মেয়ের সাথে দেখলে সে রিক্সা থেকে নেমে হাতেনাতে ধরবে। দরকার পরলে ভরা বাজারে সিনক্রিয়েট করবে। তবুও এর একটা হেস্তনেস্ত সে করেই ছাড়বে। কি ভেবেছে পরখ ওকে? অসহায়, বোকা বলে যা খুশি তাই করবে? অসম্ভব। আদ্রিকা কিছুতেই মানবে না।
বাজার প্রবেশের মুখে দেখা মিললো পরখের। বাইক নিয়ে কোথায় যেনো যাচ্ছে। আদ্রিকা রিক্সাওয়ালা বলল,
‘মামা, ডানে নেন।’
রিক্সাওয়ালা অবাক হয়ে শুধালো,
‘আপনি যে কইলেন সোজা যাবেন।’
‘এখন আর যাবো না। ডানে নেন তাড়াতাড়ি। বাইকটা চলে যাচ্ছে তো।’
নিরুপায় রিক্সাওয়ালা ডানদিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল। এই রাস্তার শেষে জর্জ কোর্ট। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে চোর, পুলিশ, উকিল সবধরনের মানুষের আনাগোনা দেখা যায় এই স্থানে৷
ভীড় এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে পরখের বাইক। আদ্রিকার রিক্সা তার পেছনে। ইঞ্জিন চালিত রিক্সা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে দেখে আদ্রিকা বলল,
‘মামা, আস্তে যান৷ বাইকের পেছনে থাকেন।’
তিনতলা একটি ভবনের সামনে বাইক থামাল পরখ। ওকে ঝটপট ভবনের ভেতরে যেতে দেখে চলন্ত রিক্সা থেকে ঝাপিয়ে নামল আদ্রিকা। তড়িঘড়ি করে ভাড়া মিটিয়ে সেও ছুটল পরখের পিছু।
খোলামেলা ভবনটির সিঁড়ি মাঝখানে। পরখকে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে দেখে এককোনায় লুকিয়ে রইল আদ্রিকা। দোতলায় একটি রেস্তোরাঁয় পরখকে প্রবেশ করতে দেখে আদ্রিকার মাথার ভেতর আগুন জ্বলে উঠল। নিশ্চয়ই কোনো মেয়ের সাথে ডেটে এসেছে। এজন্য দুপুরের খাবার খেতে বাড়ি যায় না৷ অথচ আদ্রিকা ভেবেছিল পরখ ভার্সিটির কাজে ব্যস্ত। এই তার কাজের নমুনা!
আদ্রিকা ধপাধপ পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে একই রেস্তোরাঁর ভেতর ঢুকে গেল। বিশাল হলরুমের দু’পাশে টেবিল এবং সুউচ্চ সোফাসেট রাখা। একপাশে সুসজ্জিত বেলকনি, দোলনা দেখা যাচ্ছে। কোলাহলে পরিপূর্ণ রেস্তোরাঁর ভেতর প্রবেশ করে আদ্রিকার সমস্ত সাহস বেলুনের মতো ফুঁস করে উড়ে গেল। এতো এতো মানুষের ভিড়ে পরখকে খুঁজে পাচ্ছে না। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে আসবে ভাবতেই একজন ওয়েটার সহাস্যে উপস্থিত হলো।
‘ম্যাম, কিছু লাগবে?’
আদ্রিকার চেহারার সমস্ত রঙ উড়ে গিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ওয়েটারটি বোধহয় কিছু আন্দাজ করেছে। সে সবিনয়ে প্রশ্ন করল,
‘ম্যাম, কাউকে খুজছেন?’
আদ্রিকা সম্মতিসূচক মাথা দুলালো। ওয়েটার চারপাশে তাকিয়ে কোনো ফাঁকা টেবিল দেখতে না পেয়ে বলল,
‘ম্যাম, টেবিল বুকিং দেওয়া আছে কি?’
আদ্রিকা বোধহয় এবার কেঁদেই ফেলবে। টেবিল বুকিং দিয়ে আসতে হয় কে জানত! হঠাৎ করে পরখও গায়েব হয়ে গেল। কোন গর্তে গিয়ে লুকিয়েছে কে জানে! কেনোই বা পরখের পেছনে সে ছুটে এলো! এখন এখান থেকে ফিরে যাবে কি করে। এর যদি সন্দেহভাজন চিহ্নিত করে ওকে আটকে দেয়? আদ্রিকার কান দুটো মুহূর্তেই গরম হয়ে গেল।
এসির শীতল আবহাওয়ায় ওকে ঘামতে দেখে ওয়েটার ছেলেটিও ভড়কে গেছে। সে উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল,
‘ম্যাম, আর ইউ ওকে?’
আদ্রিকা ঠোঁট উল্টে কাঁদতেই যাচ্ছিলো তখনি সামনে থেকে পরখকে আসতে দেখা গেল৷ পরখের কপালে দুটো ভাঁজ, মুখমন্ডলে সমূহ কৌতুহল। আদ্রিকার সামনে দাঁড়িয়ে সবিস্ময়ে বলল,
‘তুমি এখানে কি করছ?’
হুট করে আদ্রিকা এগিয়ে এসে পরখকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দিল৷ পরখ স্পষ্ট অনুভব করল, আদ্রিকার সারা শরীর কাঁপছে৷ সে দু হাতে আদ্রিকাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করল,
‘কি হয়েছে?’
আকস্মিক ঘটনায় হতবাক ওয়েটারের দৃষ্টি তখনো পরখের বুকে মুখ লুকিয়ে থাকা রমণীর দিকে। পরখ বিরক্ত হয়ে ধমক দিল,
‘তানজিম?’
হকচকিয়ে গেল তানজিম। মাথা নিচু করে জবাব দিল,
‘জানি না স্যার। উনি অনেকক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ তাই জানতে চাইলাম কাউকে খুঁজছেন কিনা।’
‘ঠিক আছে৷ তোমার কাজে যাও।’
তানজিম চলে গেলে আদ্রিকাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে পরখ বলল,
‘ভেতরে চলো।’
পরখের বাহু জড়িয়ে ধরে গুটিগুটি পায়ে আদ্রিকা এগিয়ে গেল সামনে। হলরুমের শেষদিকে একটি ছোট সিঁড়ি বেয়ে ওরা চলে এলো তিনতলায়। এখানের বেশিরভাগ স্থান ফাঁকা। একপাশে কাঁচে ঘেরা অফিস রুম। একটি দরজা খুলে পরখ ভেতরে প্রবেশ করল। চেয়ারে আদ্রিকাকে বসিয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল। এতোক্ষণে আদ্রিকার কান্না থেমেছে। পানি পান করে উৎসুক নয়নে চারপাশ দেখছে৷ পরখ কিছুক্ষণ নীরবে পর্যবেক্ষণ করে প্রশ্ন করল,
‘এবার বলবে কি হয়েছিল? কাঁদছিলে কেনো?’
আদ্রিকা উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
‘আপনি ভার্সিটিতে না গিয়ে এখানে কি করছেন?’
হতাশাগ্রস্থ পরখ বলল,
‘তুমি আমার পিছু পিছু এখানে এসেছো?’
আদ্রিকা মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ জানাল। দাঁত দ্বারা নিচের ঠোঁট চেপে ধরে পরখ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে শীতল কণ্ঠে জানতে চাইল,
‘কেনো?’
আদ্রিকা জবাব দেওয়ার আগে দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। দুজনে তাকাল দরজার দিকে। কিছুপল বাদে দরজা খুলে প্রবেশ করল একটি মেয়ে। যাকে দেখে আদ্রিকার চক্ষুচড়কগাছ।
দুটো চেয়ারে সামনাসামনি বসে আছে আদ্রিকা এবং পরখ। যা দেখে মেয়েটি অপ্রস্তুত হয়ে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল,
‘স্যার আপনাকে ডাকছে।’
পরখ সোজা হয়ে বসে গম্ভীর স্বরে জবাব দিল,
‘অনু, আমি একটু ব্যস্ত আছি। রুমিকে বলুন কিছুক্ষণ পর আসছি।’
অনু দরজা বন্ধ করে চলে গেল। তৎক্ষণাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আদ্রিকা। পরখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এই মেয়েটা, সেই মেয়েটা না?’
পরখ কপাল কুঁচকে অবাক হয়ে জানতে চাইল,
‘কোন মেয়েটা?’
‘আরে ওই মেয়েটা৷ যার সাথে আপনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঢলাঢলি করতে ছিলেন।’
‘হোয়াট রাবিশ! ঢলাঢলি আবার কি?’
‘রাখেন আপনার রাবিশ। এই মেয়েটাই সে, আমি শিওর। একে তো আজকে আমি..’
মেয়েটির পিছু নিতে উদ্যত হলো আদ্রিকা৷ এই পাগল মেয়ে না জানি আবার কোন কান্ড বাঁধিয়ে ফেলে! পরখ দ্রুত ওর বাহু টেনে ধরে আটকে দিল।
দরজা খুলে এমন দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে গেল রুমি। অবাক স্বরে শুধালো,
‘এখানে কি হচ্ছে?’
অপরিচিত ব্যক্তির রাগান্বিত স্বরে খানিকটা ভয় পেয়ে পরখের কাছাকাছি দাঁড়াল আদ্রিকা। রুমি গটগট করে কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে পরখের সামনে জানতে চাইল,
‘এই মেয়ে কে? তোরা এক রুমে কি করতেছিস, পরখ?’
একের পর এক চাঞ্চল্যকর ঘটনায় পরখ ভারি বিরক্ত হলো। রুমির প্রশ্নের ভাবার্থ অনুমান করে বিরক্তির মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে বলল,
‘এক রুমে মানে?’
রুমি মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল। অনুর থেকে কিছুটা শোনার পর দরজা খুলে পরখকে একটি অপরিচিত মেয়ের হাত টেনে ধরতে দেখে বেশি কিছু না ভেবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে মেয়েটিকে পরখের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করতে দেখে সে খানিকটা বিব্রতবোধ করল।
‘অনু গিয়ে বলল, তুই নাকি অফিস-রুমে কোন মেয়ের সাথে কথা বলছিস। তানজিমও সেরকম কিছুই জানাল। স্যরি, নক না করে ঢুকে পরেছি। কিন্তু উনি কে?’
রুমির প্রশ্ন শুনে পরখের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাল আদ্রিকা। কি উত্তর দিবে পরখ?
পরখ ও রুমি আগ্রহভরে তাকিয়ে আছে পরখের দিকে৷ এমন দৃষ্টির সামনে পরে পরখ থমথমে খেয়ে গেল৷ আমতাআমতা করে জবাব দিল,
‘আমার ওয়াইফ।’
আদ্রিকার মুখে বিজয়ের হাসি ফুটলেও রুমির চেহারা হলো দেখার মতো৷ সে আদ্রিকার কাছ থেকে পরখকে টেনে নিয়ে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,
‘কি বললি মামা?’
পরখ ভারি বিব্রত হলো। আদ্রিকা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে৷ রুমির হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টারত পরখ বলল,
‘আরে কি করতেছিস!’
‘তুই বিয়ে করছিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘কবে?’
‘হবে কয়েকমাস।’
‘লুকায় বিয়ে করছিস?’
‘লুকিয়ে কেনো বিয়ে করব! আজব!’
‘তোর বাড়িতে সবাই জানে? একমাত্র আমি জানি না। ও মাই গড! আই ফিল বিট্রেইটেড। তুই আমার সাথে এইটা করতে পারলি, পরখ?’
‘তেমন কাউকে বলা হয়নি। কোনো আয়োজন করিনি।’
‘রাখ তোর আয়োজন। আমরা বেস্টফ্রেন্ড, এখন আবার বিজনেস পার্টনার। এরমাঝে তুই একবারও আমাকে জানানোর সুযোগ পাইসনি।’
‘আচ্ছা স্যরি। তোকে আমার জানানো উচিত ছিল।’
‘রাখ তোর স্যরি। এখন তোর স্যরি দিয়ে আমি কি করব?’
পরখের হাত ছেড়ে দিয়ে রুমি দ্রুত পায়ে চলে গেল। বিপাকে পরল পরখ। সে নিজে সময় সুযোগ মতো রুমিকে জানিয়ে দিত। আর কয়েকমাস গেলে হয়তো বিয়ের কথাটা রুমিকে জানানোর প্রয়োজনও হত না। এই তো আর দু তিনটে মাস। এরপর সে এইসব সম্পর্কের সুতো ছিড়ে পাড়ি জমাবে বিদেশে। কয়েকদিনের জন্য কেনো শুধু শুধু লোকমুখে প্রচার করা?
কিন্তু আদ্রিকা এভাবে হুট করে এসে হাজির হবে কেন জানত! পরখ আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে দেখল, সমস্ত ঘটনার সূচনাকারী ঠোঁট চিপে হাসছে। নিশ্চয়ই রুমির অভিমানের সামনে পরখকে বিব্রত হতে দেখে মজা পেয়েছে। পরখ আদ্রিকার উদ্দেশ্যে বলল,
‘তুমি একটু বসো। আমি নিচ থেকে আসছি।’
পরখ বেরিয়ে যেতেই আদ্রিকা ফিক করে হেসে ফেলল। এখন আর ভয় লাগছে না। ধূসর রঙা কক্ষটিকে বেশ আপন লাগছে৷ ডেস্কের অপরপাশের বড় চেয়ারটিকে আরাম করে বসে আনন্দে গোল গোল ঘুরতে থাকল সে।
চলবে…
#অক্ষরময়ী