#পরিণয়ে_নোলককন্যা
|৩৫|
বন্ধ দরজাটি হাত দিয়ে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল আদ্রিকা। কক্ষের ভেতরে পরখ এবং রুমিকে দেখা যাচ্ছে। চেয়ারে মুখ গোমড়া করে বসে আছে রুমি, পাশে দাঁড়িয়ে পরখ ওকে বুঝানোর চেষ্টা করছিল। আদ্রিকার আগমনে পরখ এবং রুমি দুজনে পেছন ফিরে তাকাল।
আদ্রিকাকে দেখে রুমির থমথমে মুখে সহসাই বিস্তৃত হাসি দেখে দিল। কক্ষের ভেতর প্রবেশ করে আদ্রিকা বলল,
‘অনেকক্ষণ থেকে একলা বসে থেকে বোর হচ্ছিলাম।’
রুমি উঠে দাঁড়িয়ে একটি চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘দাঁড়িয়ে কেনো? বসুন না।’
আদ্রিকা বসল। বিষন্নভাবে জানত চাইল,
‘আপনি কি আমার উপরেও রেগে আছেন?’
মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিমা করে রুমি বলল,
‘আপনার উপর রাগ করবো কেন? নিজের বন্ধুই যখন পর করে দিল, সেখানে আর কীসের দাবিদাওয়া।’
আদ্রিকা বিজ্ঞজনের মতোন উত্তর দিল,
‘উনি ভীষণ অন্যায় করেছেন। অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত। তবে আপনি আমার উপর রেগে থাকবেন না। খালি মুখে সুসংবাদ জানিয়ে দিলাম বলে মন খারাপও করবেন না। একদিন বাড়িতে আসুন। মিষ্টি মুখ করিয়ে দিব। আমি অনেক ভালো রাধতে পারি।’
‘তাই নাকি! তবে আসতেই হয়। মিষ্টি আমার ভীষণ পছন্দ।’
‘উনার সাথে একদিন চলে আসবেন। আর একটা অনুরোধ। আমাকে তুমি বলে ডাকবেন। আমি আপনার অনেক ছোট।’
রুমি চোখ রাঙিয়ে পরখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘জুনিয়র থেকে কিছু ভদ্রতা শিখ। বন্ধুকে কীভাবে প্যাম্পার করতে হয়, সেটা জীবনেও শিখতে পারলি না৷ এখন অন্তত বউয়ের থেকে যদি কিছুটা শিখতে পারিস। অসামাজিক কোথাকার!’
নীরব পরখ বন্ধুর নাটুকে স্বভাবের বিপরীতে দুদিকে মাথা নেড়ে বিরক্তি প্রকাশ করল।
আড্ডা মাঝে হঠাৎ উপস্থিত হলো অনু। উদ্বিগ্ন অনু রুমির দিকে করুণ চোখে চেয়ে বলল,
‘স্যার, কিছু বললেন না যে। এখন আমি কী করব?’
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াল রুমি। চিন্তিত কণ্ঠস্বরে জানতে চাইল,
‘উনারা এখনো চলে যায়নি?’
‘না স্যার। সবগুলো মেন্যু দেখালাম, একটাও পছন্দ হচ্ছে না। আবার চলেও যাচ্ছে না।’
‘আচ্ছা মুশকিল হলো।’
পরখ এগিয়ে এসে জানতে চাইল,
‘কী হয়েছে?’
সমস্ত অভিমান ভুলে রুমি পরামর্শ চাইল পরখের নিকট।
‘আর বলিস না। কোন যেনো এলাকার এমপি আসছে পাশের জর্জ কোর্টে। লাঞ্চের পর শুনানি। উনারা এখন আমাদের রেস্টুরেন্টে বসে আছে। খাবার অর্ডার করার নামে নানান তালবাহানা শুরু করে দিয়েছে।’
‘কি করেছে?’
‘লাঞ্চ করবে কিন্তু আমাদের মেন্যু পছন্দ হচ্ছে না আবার চলেও যাচ্ছে না।’
পরখ অনুর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কি বলতেছে উনারা?’
অনু জবাব দিল,
‘দুপুরের জন্য খাবার চাচ্ছে। আমাদের আইটেম দেখে বলছেন, লাঞ্চে কেউ ফাস্টফুড খায়? বাঙালি খাবার নিয়ে আসুন। এতো করে বুঝাচ্ছি, স্যার আমাদের এখানে শুধু মাত্র ফাস্টফুড আইটেম অ্যাভেইলেবল। উনারা কিছুতেই বুঝতে চাইছেন না। কিছুক্ষণ পর পর ওয়েটারদের ধমক দিচ্ছেন।’
‘নিচে চলো। আমি কথা বলে দেখছি।’
অনুর সাথে পরখ দোতলার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। আদ্রিকা উদাস মুখে রুমির কাছে জানতে চাইল,
‘এতো বড় রেস্টুরেন্ট অথচ কয়েকজন মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করতে পারছে না। ছাতার মাথার রেস্টুরেন্ট দিয়ে রাখছে। বাংলাদেশে বাঙালির খাবার পাওয়া যায় না। এদের নামে কেস করে দেওয়া উচিত। ওই এমপির সাথে আমার আলাপ থাকলে, উনাকে বলতাম যাওয়ার সময় যেনো রেস্টুরেন্টের মালিকের নামে থানায় কেস করে যায়। এদের ধরে ধরে জেলে ভরা উচিত।
কে দিয়েছে এমন রেস্টুরেন্ট?’
আদ্রিকার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে রুমি। প্রশ্ন শুনে খুক খুক করে কেশে উত্তর দিল।
‘নিজের স্বামীকে জেলে ভরবার ফন্দি আটছো! তুমি দেখছি ভীষণ ডেঞ্জারাস মেয়ে।’
এবার আদ্রিকার চমকিত হওয়ার পালা। চেয়ারে বসেই রুমির দিকে ঝুকে ফিসফিস করে জানতে চাইল,
‘এটা পরখের রেস্টুরেন্ট?’
রুমি নিজেও সামান্য ঝুকে এসে ফিসফিস করে জবাব দিল,
‘আমাদের দুজনের। ফিফটি ফিফটি পার্টনারশিপ।’
আদ্রিকা সোজা হয়ে বসে অবিশ্বাসের সুরে বলল,
‘ওয়াও! আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।’
আদ্রিকার শিশুসুলভ আচরণ দেখে রুমি মুচকি হাসছে। মেয়েটা বড্ড সরল। কিছু আড্ডাবাজও বটে। রুমির বেশ ভালো লাগল।
‘তুমি জানতে না?’
আদ্রিকা মুখখানা ভার করে ভেংচি কেটে বলল,
‘আমাকে কখনো কিছু বলে নাকি! কোথায় যায়, কী করে সেই জানে। কোনোদিন আরেকটা বউ নিয়ে বাড়ি ফিরলেও আমি অবাক হবো না।’
রুমি সশব্দে হেসে ফেলল।
‘তাহলে আজকে প্রথম দেখলে! আমাদের রেস্টুরেন্ট কেমন লাগল? পছন্দ হয়েছে।’
‘দেখতে সুন্দর। কিন্তু উপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাটের মতোন দশা।’
‘সেকি! কেনো এমন মনে হলো?’
‘একজন এমপিকে আপ্যায়ন করতে পারছেন না, অথচ সাজগোছ এমন করেছেন যেনো দেশের প্রধানমন্ত্রীকে আপ্যায়ন করার অপেক্ষা করছেন।’
‘আমাদের এখানে শুধুমাত্র ফাস্টফুড পাওয়া যায়। উনারা ভাত খেতে চাইছেন। কোথা থেকে আয়োজন করবো? কে রান্না করবে?’
‘শুধু ফাস্টফুড কেনো? ভাত নিয়ে কেনো?’
‘সবেমাত্র চালু হলো। আস্তে-ধীরে সব হবে। একদিন দেখবে ভূবনভোলায় রাজ করবে আমাদের রেস্টুরেন্ট। সবার মুখে মুখে থাকবে রসনাবিলাসীর নাম।’
আদ্রিকা চোখ দুটো সরু করে রুমির কথা বুঝার চেষ্টা করল। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে প্রশ্ন করল রুমিকে,
‘কীসের নাম?’
‘রসনাবিলাসী! আমাদের রেস্টুরেন্টের নাম।’
আদ্রিকা কিছু পল ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল রুমির দিকে। রুমি কিছু বুঝতে না পেরে বিব্রতভাব নিয়ে প্রশ্ন করল,
‘কি হয়েছে? বেশি আশা করে ফেলেছি? তোমার সত্যি মনে হয় আমাদের রেস্টুরেন্ট সুদূরপ্রসারী হবে না?’
আদ্রিকা ম্লান হেসে জবাব দিল,
‘ইনশাআল্লাহ। অবশ্যই হবে।’
‘ইনশাআল্লাহ।’
ক্ষণকাল নীরবতা পেরিয়ে আদ্রিকা সামান্য দ্বিধা নিয়ে জানতে চাইল,
‘রসনাবিলাসী। রেস্টুরেন্টের নামটা সুন্দর। নামকরণ কে করেছে?’
রুমি হাসল। সগৌরবে জবাব দিল,
‘পরখ দিয়েছে। সুন্দর না নামটা? আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।’
আদ্রিকা আদ্র চোখ দুটো নিচু করে উত্তর দিল,
‘হুম। খুব সুন্দর।’
পরখ ফিরে এলো চিন্তিত মুখ নিয়ে। রুমির পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে হতাশা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
‘এখন ভাত পাই কোথায় বল? উনারা কিছুতেই এখান থেকে নড়বে না। ক্ষুধায় নাকি হাঁটা চলা করতে পারছে না। কী মুশকিল হলো!’
রুমি নিজেও চিন্তিত। চাইলেই একজন এমপিকে জোর করে বের করে দেওয়া যায় না।
‘এখন কি করবি?’
‘কাউকে পাঠিয়ে পাশের কোনো হোটেল থেকে ডাল-ভাত যা পায় নিয়ে আসতে বল।’
‘আশেপাশে কোনো ভালো হোটেল আছে? সস্তা হোটেলের স্বাদহীন খাবার।’
‘এছাড়া কোনো উপায় নাই। উনারা না মানলে আমাদের কি করার আছে! যা পারিস, খাইয়ে বিদায় কর। এতো প্যারা নিতে পাচ্ছি না।’
পরখের ক্লান্তিময় চিন্তিত মুখশ্রী দেখে ভীষণ মায়া হলো আদ্রিকা। এই মানুষটার মুখ ভার থাকলে আদ্রিকার বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে। অথচ পরখ তার সামনে বেশিরভাগ সময় মুখটা বাংলা পাঁচের মতো করে রাখে৷ কিন্তু এই মুহূর্তে আদ্রিকা পরখের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা অনুভব করছে৷ আদ্রিকা জানে, মুখে স্বীকার না করলেও আদ্রিকার অতি ক্ষুদ্র বিষয়ের প্রতি পরখ নজর দেয়।
রসনাবিলাসী নামটি কি তারই উদাহরণ নয়?
পরখের মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড সময় ব্যয় করে আদ্রিকা তাদের দুজনকে নিয়ে ভাবল৷ একদম শুরু থেকে শেষটা পর্যন্ত। কতোশত বার ভঙ্গুর আদ্রিকাকে পরখ ঠাঁই দিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই৷ হয়তো দু হাতে আগলে নেয়নি কিন্তু পেছনে দাঁড়িয়ে ছায়া দিয়েছে। ভালোবেসে দুটো কথা বলেনি কিন্তু কটুবাক্য বাণ ছুঁড়ে দিয়ে ধ্বংসের দিকে আদ্রিকার উদ্যত চরণ রুখে দিয়েছে৷
সেই ঋণের দায় থেকেই বোধহয়, আদ্রিকা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পরখের দিকে তাকিয়ে প্রস্তাবটি রাখল,
‘আমি কিছু একটা রেঁধে দেই?’
পরখ কিছু বলল না। চমকাল না, বিচলিত হল না। শুধু শীতল দৃষ্টি মেলে আদ্রিকার দিকে চেয়ে রইল। সেই দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল আদ্রিকার। এই বুঝি রুমির সামনেই একটা ধমক দিয়ে বসে। ভয়ার্ত মুখটি লুকাতে সে মুখ নামিয়ে নিয়ে মিনমিন করে বলল,
‘না মানে, আপনি চাইলে আমি দু তিনটে পদ রেঁধে দিতে পারি।’
লজ্জিত রুমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি সামলে নিতে বিনয়ী স্বরে বলল,
‘তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি কাউকে পাঠিয়ে পাশের হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে নিচ্ছি।’
আদ্রিকা করুণ চোখে পরখের দিকে চাইল। পরখ তখনও শীতল দৃষ্টি মেলে তাকেই দেখছে৷ খুব কি রেগে গেছে? বুঝতে পারল না আদ্রিকা। শেষ চেষ্টা করে বলল,
‘যেমন তেমন হোটেলের খাবার উনাদের পছন্দ হবে? আমি সত্যিই ভালো রাঁধতে পারি৷ বিশ্বাস করুন।’
রুমি বিব্রতবোধ করল। পরখ কিছু বলছে না কেনো?
‘কিন্তু এতোগুলো মানুষের খাবার তুমি কীভাবে রাঁধবে? আগে কখনো এতোগুলো মানুষের জন্য রাঁধো নি নিশ্চয়ই।’
আদ্রিকা দুদিকে মাথা দুলিয়ে অপারগতা স্বীকার করে নিল।
আদ্রিকার প্রস্তাব পুরোপুরি বাতিল করে দিতে যাচ্ছিল রুমি। তার আগেই পরখের শীতল কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
‘ও পারবে৷ অনুকে বল রান্নায় ওকে হেল্প করতে।’
রুমির মুখে বিস্ময় খেলা করলেও আদ্রিকার মুখে দেখা দিল বিজয়ের হাসি। এতোক্ষণ আদ্রিকার মনে যেটুকু ভয় ভীতি কাজ করছিল সেটা আর রইল না। পরখ বলেছে, আদ্রিকা পারবে। তার মানে আদ্রিকা পারবেই।
নিজের থেকেও বেশি পরখের উপর বিশ্বাস কবে জন্মেছে আদ্রিকা জানে না। কিন্তু এই মুহূর্তে সে কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে ঝাপিয়ে পরল রান্নার কাজে৷
সময় বেধে দেওয়া হয়েছে স্বল্প। রান্নার সামগ্রীও সামান্য। তাই দিয়েই কয়েকটি পদ রেঁধে সামনে দেওয়া হলো।
ধোঁয়া উঠা গরম ভাত, পাতলা ডাল, ঝাল বেগুন ভর্তা, মাছ ভাজি, গরুর গোশত এবং সালাত দিয়ে আয়েশ করে দুপুরের খাবার খেলেন এমপি মহোদয়।
সেই সকালবেলা বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। ভূবনভোলায় এসে নাস্তা করতে ঢুকেছিলেন একটি হোটেলে। সবাই মিলে ডাল-পরোটা খেতে বসলেন। ডালের মধ্যে কাঁচা গন্ধটি রয়ে গিয়েছে। লবণ হয়েছে কম। বাকিরা সামান্য খেলেও এমপি মহোদয় কিছুই খেতে পারেননি। লাঞ্চের আগেই কেসের শুনানি হওয়ার কথা ছিল। হঠাৎ করে সেটি পিছিয়ে গিয়ে লাঞ্চের পরে দেওয়া হলো।
কোর্টের পাশে নতুন রেস্তোরাঁ দেখে সেই যে এসে বসলেন, ইচ্ছে করেই আর উঠলেন না।
একদিকে ক্ষুধা, সকালের হোটেল মালিকের উপর রাগ, জজ কোর্টের নিয়মকানুনের অবহেলার প্রতি আক্রোশ সব ঘিরে ধরেছিল উনাকে। যথাযথ খাবার না পেলে সব রাগ উগড়ে দিতেন রসনাবিলাসী রেস্তোরাঁর মালিকের উপর। কিন্তু ভাগ্য ভালো ছিল বলে সবাই বেঁচে গেল।
খাবার শেষে সমস্ত রাগ পরে গেল এমপি মহোদয়ের। তিনি খুশিতে গদগদ হয়ে ওয়েটারকে বললেন,
‘খাবার বেশ সুস্বাদু ছিল। তোমাদের অনেক জ্বালাতন করেছি। রেস্তোরাঁর মালিককে ডাকো। উনার সাথে কথা বলে ক্ষমা চেয়ে নেই।’
এতোক্ষণ ধমক খেয়ে সবাই ভয় পেয়ে গেছে। তাই এমপির আদেশ শোনা মাত্র ওয়েটার ছুটে গেল রুমির কাছে। খবর পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো রুমি। এমপি মহোদয় ক্ষমার চাওয়ার পাশাপাশি রুমির বেশ প্রশংসা করলেন। রুমির বেশ সুবিধাবাদী মনে হলো নিজেকে। শেষ পর্যন্ত নিজেকে আটকাতে না পেরে সে বলেই ফেলল,
‘আমাদের রেস্টুরেন্টে ফাস্টফুড ছাড়া অন্য সার্ভিস এখনও চালু হয়নি। এগুলো আমার পার্টনারের ওয়াইফ আপনাদের জন্য স্পেশালি রান্না করেছে। আপনাদের ভালো লেগেছে শুনলে সে ভীষণ খুশি হবে।’
এমপি মহোদয় বললেন,
‘কোথায় সে? ডাকো তাকে। আমাদের জন্য এতো কষ্ট করলো, আমি নিজে তাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।’
খবর শুনে আদ্রিকার মাথায় হাত। ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে বলল,
‘আমার যাওয়ার কী দরকার? পরখকে বলুন, উনি গিয়ে কথা বলে নিক।’
রুমি নাছোড়বান্দা। এমপির মুখের উপর সে না বলে কী করে!
‘তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে। পরখ গিয়ে কি করবে?’
‘আমার সাথে কীসের কথা?’
‘তোমার রান্না ভালো লেগেছে৷ ধন্যবাদ জানাতে চাইছে।’
‘সেটা পরখকে বলে দিলেই তো হয়।’
‘কী আশ্চর্য! পরখকে বলবে কেনো? তুমি আর পরখ কি এক হলে? রান্না তুমি করেছো, কষ্ট তুমি করেছো। পরখ কেনো ক্রেডিট নিবে? এতো ভয় পেতে হবে না। আমি তোমার সাথে যাচ্ছি। এসো।’
‘যেতেই হবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘এক মিনিট দাঁড়ান। খালি হাতে কীভাবে যাই! আপনার জন্য ছানার পায়েস রেঁধেছিলাম। খানিকটা উনাদের জন্যেও নিয়ে যাই।’
‘তানজিমের হাতে দেও। ও নিয়ে আসছে।’
আদ্রিকাকে দেখে এমপি মহোদয় নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। একজন পৌঢ় আদ্রিকাকে এতোটা সম্মান দিচ্ছে, মানতে কষ্ট হচ্ছে আদ্রিকার। ভয়ও লাগছে খানিকটা। আশেপাশে তাকিয়ে পরখকে খুঁজল কিন্তু পেল না। টেবিলটি শক্ত করে চিপে ধরে আদ্রিকা মনোযোগ দিলো এমপির কথায়।
‘ক্ষুধা লাগলে খাবারের প্রয়োজন বুঝায় যায়। তোমার কাছে মনে হতে পারে, সামান্য রান্না নিয়ে এতো আদিখ্যেতার কি আছে? কিন্তু তুমি জানো না, সামান্য ভালো খাবারের জন্য সকাল থেকে আমরা কতোটা ভুগেছি। ছোট থেকে মায়ের হাতের খাবার খেয়েছি। বিয়ের পর আমার বিবির হাতের রান্না ছাড়া বাইরের খাবার আমার মুখে উঠেনি। বিশেষ কাজের উদ্দেশ্যে লম্বা সফরে গেলে সেইদিনগুলি আমার বড্ড কষ্টে কাটে। কাছাকাছি কোথাও গেলে বিবি অবশ্য টিফিনবাক্স হাতে ধরিয়ে দেয়। আজকেও হয়ত দিত। কিন্তু আমি বলেছি, লাঞ্চের আগেই ফিরে আসব। সরকারি কাজের অনিয়মে আটকে গেলাম।
তুমি মা, আজকে কয়েকজন অভুক্তের মুখে আহার তুলে দিয়ে বড় পূণ্যের কাজ করেছো। তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমার কার্ডটা রাখো। প্রয়োজনে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। যথাসাধ্য সাহায্যের চেষ্টা করব।’
রুমির দিকে ফিরে এমপি বললেন,
‘তোমাদের অনেক বিরক্ত করেছি। অকারণ রাগ দেখিয়েছি, জেদ করেছি। কিছু মনে করো না।’
এমপি মহোদয় চলে গেলেন। আদ্রিকা দু হাতে তালি দিয়ে একটা লাফ দিয়ে খিলখিল করে হেসে বলল,
‘দেখলেন, আমার রান্নার কতো প্রশংসা করল! আপনি বিশ্বাসই করছিলেন না, আমি ভালো রান্না করতে পারি।’
রুমি দু হাত জোর করে মাথায় ঠেকিয়ে বলল,
‘আমার বড্ড ভুল হয়ে গেছে। এই যে এখন থেকে বিশ্বাস করলাম। শাস্তিস্বরূপ কিচেনের একটা চুলা ছেড়ে দিচ্ছি। রোজ এসে রান্নাবান্না করো। ব্যবসার দাঁড় তোমার জন্য উন্মুক্ত।’
আদ্রিকা তার এলোমেলো চুলগুলো পিঠের দিকে ছুড়ে দিয়ে খানিকটা ভাব নিয়ে বলল,
‘আমি অনেক ব্যস্ত মানুষ। পুরো একটা সংসার সামলাতে হয় আমাকে। ব্যবসার সময় কোথায় আমার! আপনার বন্ধু শুধু খায় আর ঘুরে বেড়ায়। সংসারে কোনো মন নেই। সব কাজ আমাকেই দেখতে হয়।’
আদ্রিকার কথা শুনে রুমি হো হো করে হেসে উঠল। ওর সাথে গা দুলিয়ে হেসে উঠল আদ্রিকা এবং রেস্তোরাঁর বাকি সদস্যরা।
ওদের চোখের আড়ালে তিনতলার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আদ্রিকার কোমর দুলিয়ে হাঁটা দেখে মৃদু হাসল পরখ।
চলবে…
#অক্ষরময়ী
পরিণয়ে_নোলককন্যা
|৩৬|
চঞ্চল চড়ুই অনবরত ঠোকর দিচ্ছে ল্যাম্পপোস্টের কাঁচে। ম্লান হয়ে আসা বিকেলটা ঢেকে আছে ভ্যাবসা গরমে। রোদের প্রখরতা কমে গেলেও দাপট কমেনি৷ পিচঢালা উত্তপ্ত সড়কপথে ক্লান্ত পথচারীর ঘর্মাক্ত শরীর ছুটে যেতে চাইছে নিজস্ব নীড়ে। কিন্তু শহরে বাড়ন্ত জ্যামের মুখে সবাইকে থমকে দাঁড়াতে হয়।
চকচকে আকাশে মেঘের কোনো চিহ্ন নেই। চোখ তুলে আকাশ পানে চেয়ে সূর্যের অহং দেখে মুখে আঁধার নামল পরখের। হেলমেটের আড়ালে টপটপ করে ঘাম বেয়ে পরছে কপালের দু পাশে৷ কে বলবে এটা বর্ষাকাল! একবেলা বৃষ্টি নামলে বাকি দু’বেলা সূর্যের তাপে নিষ্পেষিত হচ্ছে জনজীবন।
ট্রাফিকের নির্দেশনা পাওয়ামাত্র অন্য সবার মতো পরখও ছুটল নিজস্ব গন্তব্যে। রুমিকে রেস্তোরাঁর কাজ সঁপে দিয়ে আজ অবেলায় বাড়ি ফিরছে সে।
সোফায় বসে মোবাইলে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে আদ্রিকা। পরখকে প্রবেশ করতে দেখে একবার মাথা তুলে তাকিয়ে আবারও মোবাইলের স্ক্রীনে মুখ গুঁজে দিল।
যা দেখে গতি পরখের চলার গতি মন্থর না হলেও কক্ষে প্রবেশের পূর্বে ভেসে এলো অসন্তোষ কণ্ঠস্বর।
‘সামনে পরীক্ষা, অথচ সারাক্ষণ মোবাইলে মুখ ডুবিয়ে আছে। পড়াশোনা করার ইচ্ছে না থাকলে শুধু শুধু পরীক্ষা দেওয়ার নাটক কেনো!’
আদ্রিকার কর্ণকুহরে শব্দমালা পৌঁছালে আড়ালে ভেংচি কেটে মোবাইল রেখে উঠে দাঁড়াল।
জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে গোসলের উদ্দেশ্যে ওয়াশরুমের দিকে যাত্রারত পরখ দরজা পেরোনোর সময় দেখল ডাইনিং টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিকা৷ মুখে তার চোরা হাসি। চোখে খেলা করছে উচ্ছ্বাস। অতি চঞ্চল, উত্তেজিত আদ্রিকাকে নিয়ে পরখের যতো ভয়।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে পরখ অনুসন্ধানী কণ্ঠে জানতে চাইল,
‘কি হয়েছে?’
চোখে রাজ্যের রহস্য লুকিয়ে আদ্রিকা দু দিকে মাথা দোলালো৷ কিছু হয়নি। কিন্তু তার অস্থির ভঙ্গিমা বলে দিচ্ছে, তার মনের ভেতর বিশেষ কিছু চলছে৷ পরখ গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলেও ওর দৃষ্টি আদ্রিকার দিকে। দুজনার মধ্যে সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে অতি সাবধানে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল৷
কিন্তু গোসল শেষ করে বের হওয়ার পরও দেখা গেল আদ্রিকা পরখের পিছু পিছু ঘুরছে৷ পরখ দেখেও না দেখার ভান করে নিজের পড়ার টেবিলে বসল। আদ্রিকাও পা ঝুলিয়ে বসে পরল পরখের বিছানায়। পরখ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল কিন্তু আদ্রিকা তখনো চুপচাপ বিছানায় বসে আছে৷ এই মেয়ের সাথে বসবাসের কুফল স্বরূপ পরখও বোধহয় ধৈর্যহারা হয়ে গিয়েছে৷ তা না হলে লেকচার তৈরির কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না কেনো?
বইয়ের দু পৃষ্টার মাঝখানে কলম রেখে চেয়ার ঘুরিয়ে পরখ তাকাল আদ্রিকার দিকে৷ শান্ত, শীতল কণ্ঠে বলল,
‘অযথা বিরক্ত না করে কি বলতে এসেছো সেটা বলে বিদায় হও।’
আদ্রিকা অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
‘আমি কখন বিরক্ত করলাম? চুপচাপ বসেই আছি ’
‘বসে বসে পা নাচাচ্ছো। আমার কনসেনট্রেশন ব্রেক হচ্ছে।’
‘এতো ঠুনকো আপনার মনোযোগ!’
পরখ তর্কে গেল না। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে রইল। যার অর্থ সে এই মুহূর্তে যথেষ্ট বিরক্ত হচ্ছে৷ তাই আদ্রিকা আর বেশি দুষ্টুমি করল না। সরাসরি কাজের আলোচনায় এলো।
‘রুমি ভাইয়া বলেছেন, আমি চাইলে আপনাদের রেস্তোরাঁয় বাঙালি খাবার রান্না করতে পারি।’
আদ্রিকার কথা শুনে পরখ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। আগের মতো চেয়ে রইল যেন আরও কিছু শোনার অপেক্ষা করছে। অথচ আদ্রিকা মূল তথ্য জানিয়ে দিয়েছে। আর কি শোনা বাকি? পরখকে চুপ থাকতে দেখে আদ্রিকার মুখে আঁধার নামল। উনি কি কোনোভাবে রাগ করল? একজন আদর্শ স্ত্রীতে পরিণত হওয়ার চেষ্টারত আদ্রিকা কোনোভাবেই পরখের বিরক্তি এবং রাগের কারন হতে চায় না৷ তাই সে ভীষণ ভয় নিয়ে প্রশ্ন করল,
‘আমি কোনো উত্তর দেইনি। আপনি যেটা বলবেন সেটাই হবে।’
পরখের মুখমন্ডলে বিরক্তিসূচক দুটো ভাজ দেখা দিল। চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে পরখ বলল,
‘এখানে আমার বলা, না বলার প্রশ্ন আসছে কেনো?’
আদ্রিকা অবাক হয়ে উত্তর দিল,
‘আপনার অনুমতি না নিয়ে আমি কী করে কোনো সিদ্ধান্ত নেই! আপনি আমার স্বামী, আমার অভিভাবক।’
‘লিসেন আদ্রিকা, আমি তোমাকে আগেও অনেকবার বলেছি, এখন আরও বলছি। তুমি কারো স্ত্রী, এই কথাটি নিজের মাথা থেকে মুছে ফেলো।যেখানে আমি এই বিয়েটা মানছি না, সেখানে তুমি কেনো এই বিয়ের উপর পুরোপুরি নির্ভর করে আছো? হাজারবার তোমাকে বলেছি, আমাদের সম্পর্কটা ক্ষণস্থায়ী। আর মাত্র তিনটা মাস আমি এখানে আছি, এরপর চলে যাব। অথচ তুমি এখনও বিয়ে নামক ভ্রমে ডুবে আছো। হয় তুমি আমার কথা ঠিকভাবে বুঝতে পারনি, অথবা বুঝেও না বুঝার চেষ্টা করছ। চোখ বন্ধ করে থাকলে সত্যটা মিথ্যে হয়ে যাহ না।
ভ্রমের দুনিয়া থেকে বের হও। ওয়েক আপ। রিয়েলিটি বুঝার চেষ্টা করো। আমি তোমার কেউ না। আমার উপর ডিপেন্ডেবল হয়ে নিজের ক্ষতি করছ।’
আদ্রিকা একগুঁয়ে মেয়ে। সেই একই জায়গায় আটকে রেখেছে নিজেকে। বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,
‘আমিও আপনাকে বলেছি, আপনার চলে যাওয়া নিয়ে আমার সমস্যা নেই৷ যাওয়ার সময় হলে যাবেন। আমি বাধা দিব না। কিন্তু যতোদিন আছেন, ততদিন আমি সংসার করে যেতে চাই।’
‘সংসার করো। আমিও তোমাকে বাধা দিচ্ছি না৷ কিন্তু নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্তত ভাবো। আমি চলে গেলে তোমার মাথার উপর থেকে ছায়া উঠে যাবে। তখন কি করে টিকে থাকবে, সেটা নিয়ে তোমাকে এখনি ভাবতে হবে। রুমি তোমাকে একটা সুযোগ দিয়েছে, তোমার উচিত সেটা লুফে নেওয়া। অথচ তুমি এসে আমার মতামত জানতে চাইছ। এমন একটা মানুষের উপর নির্ভর করছো, সে কিছুদিন পর তোমাকে একা ফেলে চলে যাবে। ডোন্ট ডু দিস। আমার উপর ভরসা করে তুমি নিজের ক্ষতি করছ। আমি তোমার লাইফে কোনো ভূমিকাই রাখি না। আ’ম নো বডি ফর ইউ।’
আদ্রিকা থমথমে চেহারা নিয়ে পরখের দিকে কঠিন একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিল।
‘তবে আমাকে সাহায্য করছেন কেনো? আপনি নিজেও রেস্টুরেন্টের মালিক। আপনার অনুমতি ছাড়া রুমি ভাইয়া একার সিদ্ধান্তে আমাকে কাজের প্রস্তাব দেয়নি৷ অবশ্যই আপনার মদদ রয়েছে। তাই না?’
পরখ ক্ষণকাল চুপ করে আদ্রিকার প্রশ্নযুক্ত মুখপানে চেয়ে রইল। রান্নায় আদ্রিকার আগ্রহের বিষয়টি পরখ অনেক আগেই নিশ্চিত হয়েছিল। অপটু আদ্রিকা যখন দিনরাত এক করে রান্নাঘরে অদ্ভুত সব রান্না করত, পরখ তখনি আদ্রিকার সুপ্ত প্রতিভা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে। তাই তো বাড়তি বাজার-সদাই নিয়ে পরখ কখনো অভিযোগ করেনি৷ রান্নায় উৎসাহ দিতে বিস্বাদের খাবারগুলোও চুপচাপ খেয়ে নিয়েছে৷
আজকে আদ্রিকা চলে আসার পর অনেকক্ষণ রুমির সাথে পরখের আলাপ হয়। আদ্রিকার প্রতিভা কাজে লাগিয়ে রসনাবিলাসী কীভাবে লাভবান হতে পারবে তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা শেষে বিজনেস প্ল্যানও তৈরি করা হয়েছে৷ সেসব কথা আদ্রিকা জানতে পারলে পরখের প্রতি আদ্রিকার আগ্রহ বাড়তে, আশা আকাংখা সৃষ্টি হবে। যা পরখের জন্য ক্ষতিকর।
পরখ ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে জবাব দিল,
‘দেখো, আমি চাই তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াও। তার জন্য যতোটুকু পারি সাহায্য করার চেষ্টা করছি।’
‘কেনো করছেন? আপনার কীসের দায়?’
‘অবশ্যই আমার দায় আছে। আমি চাইলেই অস্বীকার করতে পারি না। আমি জানি আমি স্বার্থপরের মত নিজের ক্যারিয়ারের জন্য তোমার উপর অবিচার করছি৷ কিন্তু আমি নিরুপায়। আমার লাইফের প্ল্যান আমি অনেক আগেই করে রেখেছি এবং সেটা আমি তোমার জন্য বাতিল করতে পারি না৷ তাই বলে তোমার উপর এতোটা অন্যায় করাও আমার ঠিক হবে না। আমি চলে গেলে তুমি যাতে নিজের মত চলতে পারো, সেটা নিশ্চিত করে যাওয়া আমার দায়িত্ব।’
‘সেজন্য আপনি চাইছেন আমি ব্যবসা করি?’
‘আমার বলছ, আমি চাইছি। আমার চাওয়াতে কিছু এসে যায় না। তোমাকে চাইতে হবে৷ আমি কি চাই সেটা ম্যাটার করে না৷ আমার চাওয়ার উপর তুমি ডিপেন্ড করতে পারো না। নিজের উপর ডিপেন্ড করো৷ আত্মবিশ্বাসী হও। আমি তোমার পার্টনার হিসেবে তোমার পাশে দাঁড়াতে পারব না। কিন্তু আমি তোমার সাব অর্ডিনেট হতে পারব। প্রয়োজন অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব সাপোর্ট দিতে পারব। এর বেশি কিছু আমার থেকে আশা করো না৷’
আদ্রিকার যা জানার ছিল, জানা হয়ে গেছে৷ পরখ চাইছে, আদ্রিকা নিজের পায়ে দাড়াক৷ তাই আদ্রিকা দাঁড়াবে। ‘আমি চাই, তুমি নিজে চাও আত্মনির্ভরশীল হতে।’- এতো কঠিন কথা আদ্রিকা বুঝতে পারে না, বুঝতে চায়ও না।
আদ্রিকা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন করল,
‘ঠিক আছে। কালকে সকাল থেকে রেস্টুরেন্টে যাব। ব্যাস হয়ে গেল৷ এতো কথা প্যাচানোর কি আছে! সহজ ভাবে বললেই হয়ে যেত, হ্যাঁ যাও। রেস্টুরেন্টের ব্যবসায় যুক্ত হও। এইটুকু না বলে শুধু এতো বকবক করলেন।’
আদ্রিকাকে বুঝানো আর দেয়ালে মাথা ঠুকা একই জিনিস৷ পরখ প্রতিবার এই ভুলটাই করে এবং পরিশেষে হতাশ হয়৷ এবারও হতাশ হয়ে নিজেকে শুধালো, ‘কী দরকার ছিল অযথা এতো বকবক করার! এই মেয়ে তাই বুঝে যা সে বুঝতে চায়।’
আদ্রিকা কক্ষ ত্যাগ করার আগে পরখ বলল,
‘সকালবেলা কলেজে যাবে তারপর রেস্টুরেন্ট।’
ঠোঁট ফুলিয়ে আদ্রিকা অসন্তোষ প্রকাশ করল,
‘আবার কলেজ কেনো?’
‘পরীক্ষায় পাশ করতে হবে, তাই।’
‘কাজের ব্যবস্থা হয়ে গেল, পড়াশোনা করে কি হবে?’
‘সেটা আমার টাকা দিয়ে ফরমফিলাপ করার আগে ভাবা দরকার ছিল।’
‘হাড়কিপ্টা মানুষ।’
মুখ কুচকে পরখের কক্ষ থেকে বিদায় নিল আদ্রিকা।
*****
বর্ষাকালের আবহাওয়া কিশোরীর উড়নচণ্ডী হৃদয়ের থেকেও নড়েচড়ে। দুপুরের স্বচ্ছ আকাশ এখন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। প্রচন্ড গরম আবহাওয়ায় এখন খেলা করছে দুরন্ত বাতাস।
প্রধান দরজার কাঁচ সরিয়ে বাতাস প্রবাহ সহজ করে দিয়েছে আদ্রিকা। শনশন করে হাওয়া এসে প্রবেশ করছে ঘরে। সেই সাথে উপরি পাওয়া হিসেবে এসেছে ধুলোবালি, শুকনো পাতা।
পরখ অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করে এবার আর চুপ করে থাকতে পারল না। বাইরে এসে নিজ হাতে দরজাটি বন্ধ করে দিয়ে আদ্রিকাকে ধমক দিল,
‘ধুলো ময়লায় ঘর ভরে যাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছো না?’
আদ্রিকা মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘কী সুন্দর বাতাস আসছিল! থাকুক না খোলা। পরে পরিষ্কার করা যাবে।’
‘বাতাস খাওয়ার এতো শখ জাগলে ছাদে গিয়ে বসে থাকো।’
আদ্রিকাও জেদ দেখিয়ে সত্যিই বাইরে বেরিয়ে এলো। ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে বুকে ভরে নিল শীতল বাতাস। দেখতে দেখতে আকাশে মেলা বসল ঘন কালো মেঘের। পলকা মেঘ জমে জমে ভারী মেঘপুঞ্জে পরিণত হল।
আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ জোড়া বন্ধ করে বাতাসের ঘ্রাণ নিচ্ছিল আদ্রিকা। এক ফোটা বৃষ্টি টুপ করে এসে পরল আদ্রিকার কপালের ঠিক মাঝখানে। হকচকিয়ে চোখ মেলে তাকাল আদ্রিকা। পরপর আরও কয়েক ফোটা বৃষ্টি ছুয়ে দিল আদ্রিকার গাল, চোখ, ঠোঁট। বিস্ময়াভিভূত আদ্রিকা খিলখিল করে হেসে উঠল।
দূর হতে ঝমঝম শব্দ হুড়মুড় করে ভেসে আসছে। আদ্রিকা পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার আগেই চোখের সামনে কুয়াশার চাদর এগিয়ে আসতে দেখল৷ মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দূরপ্রান্ত থেকে ধেয়ে আসা মাতাল বৃষ্টি ভিজিয়ে দিল আদ্রিকার সারা গা।
কিছু বুঝে উঠার আগে এক ছুটে আদ্রিকা চলে এল ঘরের ভেতর। জোরে শ্বাস নিতে নিতে স্লাইডিং ডোরের ওপারে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির বড় বড় ফোটা দেখে আদ্রিকার মনে নতুন খেয়াল এলো।
আদ্রিকা ছুটে গেল নিজের কক্ষে। এখনও আলমারিতে কাপড় রাখার সৌভাগ্য হয়নি৷ নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় ভাজ করে রাখা হয় টেবিলের একপাশে। বাকিগুলো একটি কাপড়ের ব্যাগে ভরে রাখা আছে খাটের নিচে৷ সেখান থেকে একটি শাড়ি বের করল। দ্রুত গতিতে শাড়ি পরে সুনিপুণ কুচি তুলল শাড়ির ভাজে৷
ঘরে আয়না নেই। বেসিনের দেয়ালের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে গাঢ় করে কাজল দিল। কপালের মাঝে একটি ছোট কালো টিপ, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দিয়ে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে সলাজে হেসে উঠল। চুলে নিরাবরণ খোঁপা বাধতে বাধতে সুর তুলল,
পাত্তোণ কা হ্যায় জিসম জানম
ভীগ জানে দো
পাতা ঝরা বৃষ্টি
বলো কেনো এনেছো
এক দিন যদি সবই
সবই যদি হতো
ঢেউ কেউ বলে এখন
দুনিয়াটা কি ছোট….
ছাদে এলোমেলো পায়ে হাটতে হাটতে গুনগুন করে গান গাইছিলো আদ্রিকা। গলার স্বর কখন তীক্ষ্ণ হয়েছে সে জানে না। আদ্রিকা আপন মনে গাইছে এবং বৃষ্টিতে ভিজছে৷
পরনে তার সাদা রঙের একটা শাড়ি। যা বৃষ্টির পানিতে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। দেহের দ্বিতীয় আবরণের মতোন লেপ্টে আছে সারা গায়ে। শাড়ির পাড় বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পানি লুটিয়ে পরছে ছাদের মেঝেতে৷
খোঁপা আলগা হয়ে আদ্রিকার খোলা চুল লেপ্টে আছে গ্রীবা দেশে। কাজল ছড়িয়েছে চোখের নিচে। সেসব নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয় আদ্রিকা। চক্ষু মুদে সে নিজস্ব জগতে বিভোর।
কাচের স্লাইডিং ডোরে হেলান দিয়ে বৃষ্টিস্নাত যুবতীর অপরুপ সৌন্দর্য উপভোগ করছে পরখ। হঠাৎ আদ্রিকা পেছন ফিরে চাইলো। পরখকে দেখে খুব স্বাভাবিক ভাবে পরখের চোখে চোখ রেখে মিষ্টি করে হাসল। যেনো সে জানতো পরখের এখানে দাঁড়িয়ে তাকেই দেখভহে। হয়তো অনুভব করেছিল পরখের উপস্থিতি।
উচ্ছল আদ্রিকা পরখের চোখে চোখে রেখেই গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো পরখের দিকে। হাত বাড়িয়ে পরখের হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো খোলা ছাদে।
পরখ যেভাবে নির্দ্বিধায় ওর সাথে পায়ে পা মিলিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে চলে এলো। ঝুম বৃষ্টির বড় বড় পানির ফোটা পরখকে ভিজিয়ে দিল মুহূর্তেই। সেদিকে ধ্যান নেই পরখের। সে গভীর চোখে দেখছে আদ্রিকাকে। যার দেহ প্রস্ফুটিত গোলাপের সিক্ত পাপড়ির ন্যায় হাসছে।
পরখের দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুনত্ব আদ্রিকার মনে অপ্রত্যাশিত আনন্দ, আবেগের সৃষ্টি করছে৷
চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে ভ্রম মনে হচ্ছে আদ্রিকার৷ পরখ কবে থেকে তার ডাকে সাড়া দেওয়া শুরু করলো? তার সামনে আবেগঘন দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি সত্যিই কি পরখ? বিশ্বাস হতে চায় না আদ্রিকা।
হাত বাড়িয়ে পরখের তীক্ষ্ম চোয়াল ছুঁলো আদ্রিকা।
ওকে আরেকদফা অবাক করে দিয়ে পরখ ওর কোমরে হাত রেখে সাড়া দিল। সেই মুহূর্তে সকল সন্দেহকে আপাতত ছুটি দিয়ে শুধুমাত্র এই মুহুর্তটি পৃথিবীর একমাত্র সত্য বলে বিবেচনা করে নিল আদ্রিকা।
চারপাশে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ। গোমড়ামুখো আকাশ প্রাণ খুলে বিসর্জন দিচ্ছে তার সমস্ত অভিমান। কেঁদেকেটে আজ সে খানিকটা হালকা হবে। বিশাল আকাশ ভার মুক্ত হতে চায়। তাই তো এ নিরন্তর বর্ষণ। তার অভিমানে আজ সিক্ত হচ্ছে দুজন নর-নারী। দুজনে খুব কাছাকাছি সামনাসামনি।
ঢেউয়ের মতো বাক নেওয়া আদ্রিকার মসৃণ কোমরে পুরুষালি রুক্ষ হাত।
পরখের চওড়া কাঁধ জড়িয়ে ধরে আছে সিক্ত শীতল দুটো পেলব হাত।
দুজনের স্থির চোখে বৃষ্টির ফোটা পরছে। ঝাপসা হয়ে আসছে দৃষ্টি। তবুও তারা একে অপরের দিকে চেয়ে আছে। মাঝেমধ্যে পলক ফেলে জলের ফোটাকে বিতাড়িত করছে ঠিকই। কিন্তু ধ্যানভঙ্গ হচ্ছে না কারোও।
বারিধারার আবাসস্থল সেই দূর নীলাম্বরে। তার আজ ভীষণ মন খারাপ। অথচ তারই ছায়াতলে দাঁড়িয়ে দুজন মানব মানবী একে অপরের দৃষ্টিতে হারিয়ে গেছে। এই মনোযোগহীনতা, এই অবহেলায় নীলাম্বর বেজায় রুষ্ট হলো। রেগে মেগে গড়গড় শব্দ করতে শুরু করলো।
হঠাৎ মেঘের গুড়গুড় শব্দ শুনে কেঁপে উঠল আদ্রিকা। ভয়ে চোখ বন্ধ করে খামচে ধরলো পরখের কাঁধ।
কোমরে জড়িয়ে ধরে ওকে আরও কাছে টেনে নিলো পরখ৷ আশ্রয় পেয়ে আদ্রিকা মুখ লুকাল পরখের বুকে। একহাতে ওর চিবুক ধরে মুখ উঁচু করে ধরল পরখ। চোখ নামিয়ে তাকালো আদ্রিকার সিক্ত অধর জোড়ার দিকে৷
নেশাতুর সেই দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো আদ্রিকা। পরখের কী হলো কে জানে৷ সামান্য নিচু হয়ে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিল আদ্রিকার সিক্ত ওষ্ঠে। তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের পিপাসা নিবারণে ব্যস্ত হলো আদ্রিকার সিক্ত অধরপল্লবে জমে ধারা বারিধারা শোষণ করে।
শীতল ওষ্ঠাধরে পরখের উষ্ণ ছোঁয়ায় আদ্রিকার আবেগ, অনুভূতি ঘনীভূত হয়ে হৃদয়ে প্রলংয়কারী ঝড়ের উৎপত্তি ঘটাচ্ছে৷ সে নিজের দেহের ভার ছেড়ে দিল পরখের দেহের উপর। কাঁধ ছেড়ে পরখের পিঠ আঁকড়ে জাহির করল আরও ঘনিষ্ঠতার আবদার।
চুম্বনরত অবস্থায় পরখ ওকে তুলে নিল কোলে। প্রকৃতির নীরব অভিমান, শত আবেগ উপেক্ষা করে তারা চলল নিজস্ব জগতে। যেখানে তারা নিজেদের দেহজুড়ে বহমান অস্থির আবেগ সামলাতে ব্যস্ত সময় কাটাবে।
চলবে..
#অক্ষরময়ী