পরিণয়ে নোলককন্যা পর্ব-৩৬+৩৭+৩৮

0
429

পরিণয়ে_নোলককন্যা

|৩৬|

চঞ্চল চড়ুই অনবরত ঠোকর দিচ্ছে ল্যাম্পপোস্টের কাঁচে। ম্লান হয়ে আসা বিকেলটা ঢেকে আছে ভ্যাবসা গরমে। রোদের প্রখরতা কমে গেলেও দাপট কমেনি৷ পিচঢালা উত্তপ্ত সড়কপথে ক্লান্ত পথচারীর ঘর্মাক্ত শরীর ছুটে যেতে চাইছে নিজস্ব নীড়ে। কিন্তু শহরে বাড়ন্ত জ্যামের মুখে সবাইকে থমকে দাঁড়াতে হয়।

চকচকে আকাশে মেঘের কোনো চিহ্ন নেই। চোখ তুলে আকাশ পানে চেয়ে সূর্যের অহং দেখে মুখে আঁধার নামল পরখের। হেলমেটের আড়ালে টপটপ করে ঘাম বেয়ে পরছে কপালের দু পাশে৷ কে বলবে এটা বর্ষাকাল! একবেলা বৃষ্টি নামলে বাকি দু’বেলা সূর্যের তাপে নিষ্পেষিত হচ্ছে জনজীবন।

ট্রাফিকের নির্দেশনা পাওয়ামাত্র অন্য সবার মতো পরখও ছুটল নিজস্ব গন্তব্যে। রুমিকে রেস্তোরাঁর কাজ সঁপে দিয়ে আজ অবেলায় বাড়ি ফিরছে সে।

সোফায় বসে মোবাইলে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে আদ্রিকা। পরখকে প্রবেশ করতে দেখে একবার মাথা তুলে তাকিয়ে আবারও মোবাইলের স্ক্রীনে মুখ গুঁজে দিল।

যা দেখে গতি পরখের চলার গতি মন্থর না হলেও কক্ষে প্রবেশের পূর্বে ভেসে এলো অসন্তোষ কণ্ঠস্বর।

‘সামনে পরীক্ষা, অথচ সারাক্ষণ মোবাইলে মুখ ডুবিয়ে আছে। পড়াশোনা করার ইচ্ছে না থাকলে শুধু শুধু পরীক্ষা দেওয়ার নাটক কেনো!’

আদ্রিকার কর্ণকুহরে শব্দমালা পৌঁছালে আড়ালে ভেংচি কেটে মোবাইল রেখে উঠে দাঁড়াল।

জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে গোসলের উদ্দেশ্যে ওয়াশরুমের দিকে যাত্রারত পরখ দরজা পেরোনোর সময় দেখল ডাইনিং টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিকা৷ মুখে তার চোরা হাসি। চোখে খেলা করছে উচ্ছ্বাস। অতি চঞ্চল, উত্তেজিত আদ্রিকাকে নিয়ে পরখের যতো ভয়।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে পরখ অনুসন্ধানী কণ্ঠে জানতে চাইল,

‘কি হয়েছে?’

চোখে রাজ্যের রহস্য লুকিয়ে আদ্রিকা দু দিকে মাথা দোলালো৷ কিছু হয়নি। কিন্তু তার অস্থির ভঙ্গিমা বলে দিচ্ছে, তার মনের ভেতর বিশেষ কিছু চলছে৷ পরখ গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলেও ওর দৃষ্টি আদ্রিকার দিকে। দুজনার মধ্যে সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে অতি সাবধানে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল৷

কিন্তু গোসল শেষ করে বের হওয়ার পরও দেখা গেল আদ্রিকা পরখের পিছু পিছু ঘুরছে৷ পরখ দেখেও না দেখার ভান করে নিজের পড়ার টেবিলে বসল। আদ্রিকাও পা ঝুলিয়ে বসে পরল পরখের বিছানায়। পরখ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল কিন্তু আদ্রিকা তখনো চুপচাপ বিছানায় বসে আছে৷ এই মেয়ের সাথে বসবাসের কুফল স্বরূপ পরখও বোধহয় ধৈর্যহারা হয়ে গিয়েছে৷ তা না হলে লেকচার তৈরির কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না কেনো?

বইয়ের দু পৃষ্টার মাঝখানে কলম রেখে চেয়ার ঘুরিয়ে পরখ তাকাল আদ্রিকার দিকে৷ শান্ত, শীতল কণ্ঠে বলল,

‘অযথা বিরক্ত না করে কি বলতে এসেছো সেটা বলে বিদায় হও।’

আদ্রিকা অবাক হওয়ার ভান করে বলল,

‘আমি কখন বিরক্ত করলাম? চুপচাপ বসেই আছি ’

‘বসে বসে পা নাচাচ্ছো। আমার কনসেনট্রেশন ব্রেক হচ্ছে।’

‘এতো ঠুনকো আপনার মনোযোগ!’

পরখ তর্কে গেল না। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে রইল। যার অর্থ সে এই মুহূর্তে যথেষ্ট বিরক্ত হচ্ছে৷ তাই আদ্রিকা আর বেশি দুষ্টুমি করল না। সরাসরি কাজের আলোচনায় এলো।

‘রুমি ভাইয়া বলেছেন, আমি চাইলে আপনাদের রেস্তোরাঁয় বাঙালি খাবার রান্না করতে পারি।’

আদ্রিকার কথা শুনে পরখ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। আগের মতো চেয়ে রইল যেন আরও কিছু শোনার অপেক্ষা করছে। অথচ আদ্রিকা মূল তথ্য জানিয়ে দিয়েছে। আর কি শোনা বাকি? পরখকে চুপ থাকতে দেখে আদ্রিকার মুখে আঁধার নামল। উনি কি কোনোভাবে রাগ করল? একজন আদর্শ স্ত্রীতে পরিণত হওয়ার চেষ্টারত আদ্রিকা কোনোভাবেই পরখের বিরক্তি এবং রাগের কারন হতে চায় না৷ তাই সে ভীষণ ভয় নিয়ে প্রশ্ন করল,

‘আমি কোনো উত্তর দেইনি। আপনি যেটা বলবেন সেটাই হবে।’

পরখের মুখমন্ডলে বিরক্তিসূচক দুটো ভাজ দেখা দিল। চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে পরখ বলল,

‘এখানে আমার বলা, না বলার প্রশ্ন আসছে কেনো?’

আদ্রিকা অবাক হয়ে উত্তর দিল,

‘আপনার অনুমতি না নিয়ে আমি কী করে কোনো সিদ্ধান্ত নেই! আপনি আমার স্বামী, আমার অভিভাবক।’

‘লিসেন আদ্রিকা, আমি তোমাকে আগেও অনেকবার বলেছি, এখন আরও বলছি। তুমি কারো স্ত্রী, এই কথাটি নিজের মাথা থেকে মুছে ফেলো।যেখানে আমি এই বিয়েটা মানছি না, সেখানে তুমি কেনো এই বিয়ের উপর পুরোপুরি নির্ভর করে আছো? হাজারবার তোমাকে বলেছি, আমাদের সম্পর্কটা ক্ষণস্থায়ী। আর মাত্র তিনটা মাস আমি এখানে আছি, এরপর চলে যাব। অথচ তুমি এখনও বিয়ে নামক ভ্রমে ডুবে আছো। হয় তুমি আমার কথা ঠিকভাবে বুঝতে পারনি, অথবা বুঝেও না বুঝার চেষ্টা করছ। চোখ বন্ধ করে থাকলে সত্যটা মিথ্যে হয়ে যাহ না।
ভ্রমের দুনিয়া থেকে বের হও। ওয়েক আপ। রিয়েলিটি বুঝার চেষ্টা করো। আমি তোমার কেউ না। আমার উপর ডিপেন্ডেবল হয়ে নিজের ক্ষতি করছ।’

আদ্রিকা একগুঁয়ে মেয়ে। সেই একই জায়গায় আটকে রেখেছে নিজেকে। বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,

‘আমিও আপনাকে বলেছি, আপনার চলে যাওয়া নিয়ে আমার সমস্যা নেই৷ যাওয়ার সময় হলে যাবেন। আমি বাধা দিব না। কিন্তু যতোদিন আছেন, ততদিন আমি সংসার করে যেতে চাই।’

‘সংসার করো। আমিও তোমাকে বাধা দিচ্ছি না৷ কিন্তু নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্তত ভাবো। আমি চলে গেলে তোমার মাথার উপর থেকে ছায়া উঠে যাবে। তখন কি করে টিকে থাকবে, সেটা নিয়ে তোমাকে এখনি ভাবতে হবে। রুমি তোমাকে একটা সুযোগ দিয়েছে, তোমার উচিত সেটা লুফে নেওয়া। অথচ তুমি এসে আমার মতামত জানতে চাইছ। এমন একটা মানুষের উপর নির্ভর করছো, সে কিছুদিন পর তোমাকে একা ফেলে চলে যাবে। ডোন্ট ডু দিস। আমার উপর ভরসা করে তুমি নিজের ক্ষতি করছ। আমি তোমার লাইফে কোনো ভূমিকাই রাখি না। আ’ম নো বডি ফর ইউ।’

আদ্রিকা থমথমে চেহারা নিয়ে পরখের দিকে কঠিন একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিল।

‘তবে আমাকে সাহায্য করছেন কেনো? আপনি নিজেও রেস্টুরেন্টের মালিক। আপনার অনুমতি ছাড়া রুমি ভাইয়া একার সিদ্ধান্তে আমাকে কাজের প্রস্তাব দেয়নি৷ অবশ্যই আপনার মদদ রয়েছে। তাই না?’

পরখ ক্ষণকাল চুপ করে আদ্রিকার প্রশ্নযুক্ত মুখপানে চেয়ে রইল। রান্নায় আদ্রিকার আগ্রহের বিষয়টি পরখ অনেক আগেই নিশ্চিত হয়েছিল। অপটু আদ্রিকা যখন দিনরাত এক করে রান্নাঘরে অদ্ভুত সব রান্না করত, পরখ তখনি আদ্রিকার সুপ্ত প্রতিভা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে। তাই তো বাড়তি বাজার-সদাই নিয়ে পরখ কখনো অভিযোগ করেনি৷ রান্নায় উৎসাহ দিতে বিস্বাদের খাবারগুলোও চুপচাপ খেয়ে নিয়েছে৷

আজকে আদ্রিকা চলে আসার পর অনেকক্ষণ রুমির সাথে পরখের আলাপ হয়। আদ্রিকার প্রতিভা কাজে লাগিয়ে রসনাবিলাসী কীভাবে লাভবান হতে পারবে তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা শেষে বিজনেস প্ল্যানও তৈরি করা হয়েছে৷ সেসব কথা আদ্রিকা জানতে পারলে পরখের প্রতি আদ্রিকার আগ্রহ বাড়তে, আশা আকাংখা সৃষ্টি হবে। যা পরখের জন্য ক্ষতিকর।

পরখ ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে জবাব দিল,

‘দেখো, আমি চাই তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াও। তার জন্য যতোটুকু পারি সাহায্য করার চেষ্টা করছি।’

‘কেনো করছেন? আপনার কীসের দায়?’

‘অবশ্যই আমার দায় আছে। আমি চাইলেই অস্বীকার করতে পারি না। আমি জানি আমি স্বার্থপরের মত নিজের ক্যারিয়ারের জন্য তোমার উপর অবিচার করছি৷ কিন্তু আমি নিরুপায়। আমার লাইফের প্ল্যান আমি অনেক আগেই করে রেখেছি এবং সেটা আমি তোমার জন্য বাতিল করতে পারি না৷ তাই বলে তোমার উপর এতোটা অন্যায় করাও আমার ঠিক হবে না। আমি চলে গেলে তুমি যাতে নিজের মত চলতে পারো, সেটা নিশ্চিত করে যাওয়া আমার দায়িত্ব।’

‘সেজন্য আপনি চাইছেন আমি ব্যবসা করি?’

‘আমার বলছ, আমি চাইছি। আমার চাওয়াতে কিছু এসে যায় না। তোমাকে চাইতে হবে৷ আমি কি চাই সেটা ম্যাটার করে না৷ আমার চাওয়ার উপর তুমি ডিপেন্ড করতে পারো না। নিজের উপর ডিপেন্ড করো৷ আত্মবিশ্বাসী হও। আমি তোমার পার্টনার হিসেবে তোমার পাশে দাঁড়াতে পারব না। কিন্তু আমি তোমার সাব অর্ডিনেট হতে পারব। প্রয়োজন অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব সাপোর্ট দিতে পারব। এর বেশি কিছু আমার থেকে আশা করো না৷’

আদ্রিকার যা জানার ছিল, জানা হয়ে গেছে৷ পরখ চাইছে, আদ্রিকা নিজের পায়ে দাড়াক৷ তাই আদ্রিকা দাঁড়াবে। ‘আমি চাই, তুমি নিজে চাও আত্মনির্ভরশীল হতে।’- এতো কঠিন কথা আদ্রিকা বুঝতে পারে না, বুঝতে চায়ও না।

আদ্রিকা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন করল,

‘ঠিক আছে। কালকে সকাল থেকে রেস্টুরেন্টে যাব। ব্যাস হয়ে গেল৷ এতো কথা প্যাচানোর কি আছে! সহজ ভাবে বললেই হয়ে যেত, হ্যাঁ যাও। রেস্টুরেন্টের ব্যবসায় যুক্ত হও। এইটুকু না বলে শুধু এতো বকবক করলেন।’

আদ্রিকাকে বুঝানো আর দেয়ালে মাথা ঠুকা একই জিনিস৷ পরখ প্রতিবার এই ভুলটাই করে এবং পরিশেষে হতাশ হয়৷ এবারও হতাশ হয়ে নিজেকে শুধালো, ‘কী দরকার ছিল অযথা এতো বকবক করার‍! এই মেয়ে তাই বুঝে যা সে বুঝতে চায়।’

আদ্রিকা কক্ষ ত্যাগ করার আগে পরখ বলল,

‘সকালবেলা কলেজে যাবে তারপর রেস্টুরেন্ট।’

ঠোঁট ফুলিয়ে আদ্রিকা অসন্তোষ প্রকাশ করল,

‘আবার কলেজ কেনো?’

‘পরীক্ষায় পাশ করতে হবে, তাই।’

‘কাজের ব্যবস্থা হয়ে গেল, পড়াশোনা করে কি হবে?’

‘সেটা আমার টাকা দিয়ে ফরমফিলাপ করার আগে ভাবা দরকার ছিল।’

‘হাড়কিপ্টা মানুষ।’

মুখ কুচকে পরখের কক্ষ থেকে বিদায় নিল আদ্রিকা।

*****

বর্ষাকালের আবহাওয়া কিশোরীর উড়নচণ্ডী হৃদয়ের থেকেও নড়েচড়ে। দুপুরের স্বচ্ছ আকাশ এখন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। প্রচন্ড গরম আবহাওয়ায় এখন খেলা করছে দুরন্ত বাতাস।

প্রধান দরজার কাঁচ সরিয়ে বাতাস প্রবাহ সহজ করে দিয়েছে আদ্রিকা। শনশন করে হাওয়া এসে প্রবেশ করছে ঘরে। সেই সাথে উপরি পাওয়া হিসেবে এসেছে ধুলোবালি, শুকনো পাতা।

পরখ অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করে এবার আর চুপ করে থাকতে পারল না। বাইরে এসে নিজ হাতে দরজাটি বন্ধ করে দিয়ে আদ্রিকাকে ধমক দিল,

‘ধুলো ময়লায় ঘর ভরে যাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছো না?’

আদ্রিকা মুখ ফুলিয়ে বলল,

‘কী সুন্দর বাতাস আসছিল! থাকুক না খোলা। পরে পরিষ্কার করা যাবে।’

‘বাতাস খাওয়ার এতো শখ জাগলে ছাদে গিয়ে বসে থাকো।’

আদ্রিকাও জেদ দেখিয়ে সত্যিই বাইরে বেরিয়ে এলো। ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে বুকে ভরে নিল শীতল বাতাস। দেখতে দেখতে আকাশে মেলা বসল ঘন কালো মেঘের। পলকা মেঘ জমে জমে ভারী মেঘপুঞ্জে পরিণত হল।

আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ জোড়া বন্ধ করে বাতাসের ঘ্রাণ নিচ্ছিল আদ্রিকা। এক ফোটা বৃষ্টি টুপ করে এসে পরল আদ্রিকার কপালের ঠিক মাঝখানে। হকচকিয়ে চোখ মেলে তাকাল আদ্রিকা। পরপর আরও কয়েক ফোটা বৃষ্টি ছুয়ে দিল আদ্রিকার গাল, চোখ, ঠোঁট। বিস্ময়াভিভূত আদ্রিকা খিলখিল করে হেসে উঠল।

দূর হতে ঝমঝম শব্দ হুড়মুড় করে ভেসে আসছে। আদ্রিকা পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার আগেই চোখের সামনে কুয়াশার চাদর এগিয়ে আসতে দেখল৷ মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দূরপ্রান্ত থেকে ধেয়ে আসা মাতাল বৃষ্টি ভিজিয়ে দিল আদ্রিকার সারা গা।

কিছু বুঝে উঠার আগে এক ছুটে আদ্রিকা চলে এল ঘরের ভেতর। জোরে শ্বাস নিতে নিতে স্লাইডিং ডোরের ওপারে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির বড় বড় ফোটা দেখে আদ্রিকার মনে নতুন খেয়াল এলো।

আদ্রিকা ছুটে গেল নিজের কক্ষে। এখনও আলমারিতে কাপড় রাখার সৌভাগ্য হয়নি৷ নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় ভাজ করে রাখা হয় টেবিলের একপাশে। বাকিগুলো একটি কাপড়ের ব্যাগে ভরে রাখা আছে খাটের নিচে৷ সেখান থেকে একটি শাড়ি বের করল। দ্রুত গতিতে শাড়ি পরে সুনিপুণ কুচি তুলল শাড়ির ভাজে৷

ঘরে আয়না নেই। বেসিনের দেয়ালের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে গাঢ় করে কাজল দিল। কপালের মাঝে একটি ছোট কালো টিপ, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দিয়ে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে সলাজে হেসে উঠল। চুলে নিরাবরণ খোঁপা বাধতে বাধতে সুর তুলল,

পাত্তোণ কা হ্যায় জিসম জানম
ভীগ জানে দো
পাতা ঝরা বৃষ্টি
বলো কেনো এনেছো

এক দিন যদি সবই
সবই যদি হতো
ঢেউ কেউ বলে এখন
দুনিয়াটা কি ছোট….

ছাদে এলোমেলো পায়ে হাটতে হাটতে গুনগুন করে গান গাইছিলো আদ্রিকা। গলার স্বর কখন তীক্ষ্ণ হয়েছে সে জানে না। আদ্রিকা আপন মনে গাইছে এবং বৃষ্টিতে ভিজছে৷
পরনে তার সাদা রঙের একটা শাড়ি। যা বৃষ্টির পানিতে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। দেহের দ্বিতীয় আবরণের মতোন লেপ্টে আছে সারা গায়ে। শাড়ির পাড় বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পানি লুটিয়ে পরছে ছাদের মেঝেতে৷
খোঁপা আলগা হয়ে আদ্রিকার খোলা চুল লেপ্টে আছে গ্রীবা দেশে। কাজল ছড়িয়েছে চোখের নিচে। সেসব নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয় আদ্রিকা। চক্ষু মুদে সে নিজস্ব জগতে বিভোর।

কাচের স্লাইডিং ডোরে হেলান দিয়ে বৃষ্টিস্নাত যুবতীর অপরুপ সৌন্দর্য উপভোগ করছে পরখ। হঠাৎ আদ্রিকা পেছন ফিরে চাইলো। পরখকে দেখে খুব স্বাভাবিক ভাবে পরখের চোখে চোখ রেখে মিষ্টি করে হাসল। যেনো সে জানতো পরখের এখানে দাঁড়িয়ে তাকেই দেখভহে। হয়তো অনুভব করেছিল পরখের উপস্থিতি।

উচ্ছল আদ্রিকা পরখের চোখে চোখে রেখেই গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো পরখের দিকে। হাত বাড়িয়ে পরখের হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো খোলা ছাদে।

পরখ যেভাবে নির্দ্বিধায় ওর সাথে পায়ে পা মিলিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে চলে এলো। ঝুম বৃষ্টির বড় বড় পানির ফোটা পরখকে ভিজিয়ে দিল মুহূর্তেই। সেদিকে ধ্যান নেই পরখের। সে গভীর চোখে দেখছে আদ্রিকাকে। যার দেহ প্রস্ফুটিত গোলাপের সিক্ত পাপড়ির ন্যায় হাসছে।
পরখের দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুনত্ব আদ্রিকার মনে অপ্রত্যাশিত আনন্দ, আবেগের সৃষ্টি করছে৷
চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে ভ্রম মনে হচ্ছে আদ্রিকার৷ পরখ কবে থেকে তার ডাকে সাড়া দেওয়া শুরু করলো? তার সামনে আবেগঘন দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি সত্যিই কি পরখ? বিশ্বাস হতে চায় না আদ্রিকা।

হাত বাড়িয়ে পরখের তীক্ষ্ম চোয়াল ছুঁলো আদ্রিকা।
ওকে আরেকদফা অবাক করে দিয়ে পরখ ওর কোমরে হাত রেখে সাড়া দিল। সেই মুহূর্তে সকল সন্দেহকে আপাতত ছুটি দিয়ে শুধুমাত্র এই মুহুর্তটি পৃথিবীর একমাত্র সত্য বলে বিবেচনা করে নিল আদ্রিকা।

চারপাশে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ। গোমড়ামুখো আকাশ প্রাণ খুলে বিসর্জন দিচ্ছে তার সমস্ত অভিমান। কেঁদেকেটে আজ সে খানিকটা হালকা হবে। বিশাল আকাশ ভার মুক্ত হতে চায়। তাই তো এ নিরন্তর বর্ষণ। তার অভিমানে আজ সিক্ত হচ্ছে দুজন নর-নারী। দুজনে খুব কাছাকাছি সামনাসামনি।

ঢেউয়ের মতো বাক নেওয়া আদ্রিকার মসৃণ কোমরে পুরুষালি রুক্ষ হাত।
পরখের চওড়া কাঁধ জড়িয়ে ধরে আছে সিক্ত শীতল দুটো পেলব হাত।
দুজনের স্থির চোখে বৃষ্টির ফোটা পরছে। ঝাপসা হয়ে আসছে দৃষ্টি। তবুও তারা একে অপরের দিকে চেয়ে আছে। মাঝেমধ্যে পলক ফেলে জলের ফোটাকে বিতাড়িত করছে ঠিকই। কিন্তু ধ্যানভঙ্গ হচ্ছে না কারোও।

বারিধারার আবাসস্থল সেই দূর নীলাম্বরে। তার আজ ভীষণ মন খারাপ। অথচ তারই ছায়াতলে দাঁড়িয়ে দুজন মানব মানবী একে অপরের দৃষ্টিতে হারিয়ে গেছে। এই মনোযোগহীনতা, এই অবহেলায় নীলাম্বর বেজায় রুষ্ট হলো। রেগে মেগে গড়গড় শব্দ করতে শুরু করলো।

হঠাৎ মেঘের গুড়গুড় শব্দ শুনে কেঁপে উঠল আদ্রিকা। ভয়ে চোখ বন্ধ করে খামচে ধরলো পরখের কাঁধ।
কোমরে জড়িয়ে ধরে ওকে আরও কাছে টেনে নিলো পরখ৷ আশ্রয় পেয়ে আদ্রিকা মুখ লুকাল পরখের বুকে। একহাতে ওর চিবুক ধরে মুখ উঁচু করে ধরল পরখ। চোখ নামিয়ে তাকালো আদ্রিকার সিক্ত অধর জোড়ার দিকে৷

নেশাতুর সেই দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো আদ্রিকা। পরখের কী হলো কে জানে৷ সামান্য নিচু হয়ে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিল আদ্রিকার সিক্ত ওষ্ঠে। তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের পিপাসা নিবারণে ব্যস্ত হলো আদ্রিকার সিক্ত অধরপল্লবে জমে ধারা বারিধারা শোষণ করে।

শীতল ওষ্ঠাধরে পরখের উষ্ণ ছোঁয়ায় আদ্রিকার আবেগ, অনুভূতি ঘনীভূত হয়ে হৃদয়ে প্রলংয়কারী ঝড়ের উৎপত্তি ঘটাচ্ছে৷ সে নিজের দেহের ভার ছেড়ে দিল পরখের দেহের উপর। কাঁধ ছেড়ে পরখের পিঠ আঁকড়ে জাহির করল আরও ঘনিষ্ঠতার আবদার।
চুম্বনরত অবস্থায় পরখ ওকে তুলে নিল কোলে। প্রকৃতির নীরব অভিমান, শত আবেগ উপেক্ষা করে তারা চলল নিজস্ব জগতে। যেখানে তারা নিজেদের দেহজুড়ে বহমান অস্থির আবেগ সামলাতে ব্যস্ত সময় কাটাবে।

চলবে..
#অক্ষরময়ী

#পরিণয়ে_নোলককন্যা

|৩৭|

রতিক্রিয়া সম্পন্ন দুটো ক্লান্ত, নিস্তেজ দেহ আশ্রয় নিয়েছে এলোমেলো চাদরের নিচে। হৃদপিণ্ডের তীব্র গতির সাথে তাল মিলিয়ে দ্রুত উঠানামা করছে তাদের বক্ষদেশ। অতিবাহিত সময়ের সাথে দ্রুততর শ্বাস-প্রঃশ্বাস ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসে।

চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে পরখ। পাশেই উপুড় হয়ে শুয়ে আছে আদ্রিকা। বালিশের উপর এক হাতের ভাঁজ করে রেখে তার উপর মাথা রেখেছে। একপাশে কাঁধ করে রাখা মুখটি। দু চোখের দৃষ্টি পরখের মুখ মন্ডলে নিবদ্ধ। সে দৃষ্টি সহজে অনুভব করা যায়।

দৃষ্টির বন্দীদশা অনুমান করেও পরখ তার দীপ্ত চক্ষু দুটি বুজে নিসংকোচ আদেশ জারি করল।

‘অনেক রাত হয়েছে। তোমার রুমে যাও।’

হতবাক আদ্রিকা ভ্রু কুচকাল। নিজেই আদ্রিকাকে কোলে করে এই রুমে বয়ে নিয়ে এসে এখন এসব কী ধরনের ফাজলামি? জিহ্বার ডগা পর্যন্ত কিছু কথা এলেও সেগুলো উচ্চারণ করল না আদ্রিকা। স্বামীর সাথে বেয়াদবি করে নিজের পাপ বাড়াতে চায় না সে। খানিকটা এগিয়ে এসে পরখের উন্মুক্ত বুকে মাথা রেখে মৃদু স্বরে আদ্রিকা বলল,

‘যাবো না। আমি এখানেই ঘুমাব। আপনার সাথে।’

দেহে আদ্রিকার ছোঁয়া পাওয়া মাত্র চোখ মেলে চাইল পরখ। আদেশের বিপরীতে আদ্রিকার একগুঁয়ে জবাব শুনে হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। আদ্রিকার মধ্যে কোনো হেলদোল না দেখে তাড়া দিতে রুক্ষ স্বরে ডাকল,

‘আদ্রিকা?’

ঘুমের অপেক্ষায় মুদিত চক্ষুসমেত আদ্রিকা জবাব দিল,

‘কি?’

‘নিজের রুমে গিয়ে ঘুমাও।’

‘এখানে কি সমস্যা? আমি এখানেই ঘুমাব।’

আদেশ অমান্য করায় মুহূর্তেই ক্ষেপে গেল পরখ। অন্তরের সমস্ত ঘৃণা কণ্ঠে ঢেলে বিদ্রুপের স্বরে বলল,

‘তুমি কীভাবে এতো স্বাভাবিক আছো? নিজেকে বিকিয়ে দিতে তোমার বিবেকে বাঁধছে না?’

চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে পরখের দিকে চাইল আদ্রিকা। এমন বিশ্রী অপমানে আদ্রিকার চোখের ঘুম ছুটে গেছে। খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো, আমাকে কোলে তুলে নিয়ে আসার সময় আপনার বিবেক কোথায় ছিল? বালিশের তলায় রেখে গিয়েছিলেন?

কিন্তু সে কথা শুনে পরখ যদি আরও বেশি ক্ষেপে যায়? আর কখনো যদি আদ্রিকার কাছে না আসে? তবে আদ্রিকার কি হবে? বিরুপ প্রতিক্রিয়ার ভয়ে দমে গেল আদ্রিকা। নিজ প্রয়োজনের তাগিদে অপমান গায়ে মাখলো না। সিদ্ধান্ত বদলে পরখের চোখে চোখ রেখে বললো,

‘নিজের স্বামী কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছি।আবেগ-বিবেক সবটাই স্বামীর পক্ষে৷’

‘যেমনটা প্রথমজনকে দিয়েছিলে, এখন আমাকে দিচ্ছো। ভবিষ্যতে তৃতীয় নাম্বার স্বামীকে দিবে।’

চোয়াল শক্ত করে পাথুরে মুখে জানাল পরখ। চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল আদ্রিকা। ছলছল নয়নে শুধু চেয়ে রইল পরখের ঘৃণামাখা ওই চোখজোড়ার দিকে। মনে মনে ভীষণ আঘাত পেয়েছে সে। পরখ কি করে পারল এই কথা বলতে! তবে মুখে কিছু প্রকাশ করল না৷

কিছুপল নিস্তব্ধতায় কেটে গেল। নিঃশ্বাসও বুঝি শব্দ করতে ভয় পাচ্ছে। হার মেনে নিল আদ্রিকা। মুখ ফিরিয়ে পরখের বুক থেকে সরে গিয়ে উল্টোদিকে ঘুরে পাশের বালিশে চুপচাপ শুয়ে পরল।

খুব নিশ্চুপে কয়েক ফোঁটা জল টপটপ করে ঝরে পরে বালিশ ভেজাল। কিছু সময় ব্যয় করে কষ্টগুলো ঝরে ঝরে বিদায় নিলে বুকটা হালকা হয়ে এলো। আদ্রিকার খোলা চোখের অমনোযোগী দৃষ্টি জানালার মরিচাধরা লোহার পাতে। খানিকবাদে সে স্বাভাবিকভাবেই পাশ ফিরে তাকাল পরখের মুখের দিকে। পরখ তাকিয়ে আছে সাদা সিলিং এ ঝুলন্ত স্থির পাখাটির দিকে।

পাথরের মতো নিশ্চল পরখের দিকে চেয়ে রয়ে আদ্রিকা বলল,

‘রাস্তার একটা কুকুর কিংবা বিড়াল জোর করে বাড়িতে আশ্রয় নিলে প্রথম কয়েকদিন বাড়ির মালিক বিরক্ত হয়। তারপর দয়ার খাতিরে কিছুটা খাবার ছুঁড়ে দেয়। দয়া একসময় একটু একটু করে অভ্যাসে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে তারা একে অপরের সাথে জুড়ে যায়।
একটা জন্তুর মায়াজালে মানুষ আটকে যেতে বাধ্য থাকে, সেখানে আমি তো একটা জলজ্যান্ত মানুষ। আমার মায়ার বাঁধনের সাথে যুদ্ধ করতে আপনাকে বেশ কসরত করতে হয়, তাই না?’

পরখ তাকাল না। প্রতিক্রিয়াহীন রইল পুরোটা সময়। খানিকটা থেমে আদ্রিকা আবারও বলল,

‘আপনি খুব চেষ্টা করেন আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার। সব সময় সতর্ক থাকেন, যাতে আমার প্রতি আপনার সামান্যতম মায়ার সৃষ্টি না হয়। এজন্য নিজের চারপাশে উঁচু, শক্ত দেয়াল তুলে রেখেছেন। যাতে আমি আপনাকে ছুঁতে না পারি। কেনো এতো সতর্কতা, কীসের এতো ভয় আমি জানি না। কিন্তু আমি এটা জানি, কখনো কখনো আপনার চারপাশের শক্ত দেয়ালটা দূর্বল হয়ে পরে। তখন আমার প্রতি আপনার অনুভূতি জন্মায়। সেই অনুভূতি দয়া নাকি মায়া আমি জানি না। তবে ভালোবাসা নয় সেটা নিশ্চিত। কিন্তু নিজের সামান্য দয়া, মায়াও আপনি আমাতে ব্যয় করতে নারাজ।
তাই ভুলেও কখনো অনুভূতি ব্যয় করে ফেললে আপনার আফসোস হয়৷ নিজে প্রতি রাগ, ক্ষোভ জন্মায়। সেজ রোষ আপনি আবার আমার উপরেই মিটান। আমাকে বাজে কথা বলেন, গালাগালি করেন।

এবার পরখ পাখা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আদ্রিকার দিকে তাকাল। সেখানে পরখ স্পষ্ট দেখতে পেল নিজস্ব চিন্তাভাবনা নিয়ে আদ্রিকার আত্মবিশ্বাস। আদ্রিকা জানে, তার কথাগুলো কতোটা সত্যি। পরখের স্বীকারোক্তির তার প্রয়োজন নেই। তবুও অকারন প্রশ্ন করছে। পরখ উত্তর দিল না। ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদ্রিকার মুখে সামান্য বিজয়ীর হাসি দেখা দিল।

তাচ্ছিল্য স্বরুপ বলল,

‘নিজের দেয়াল রক্ষা করতে না পারার ব্যর্থতা আমার উপর জাহির করে কি লাভ? উল্টো নিজের ক্ষতি করছেন। কারন এভাবেও আমাদের মধ্যে একটি সম্পর্কের তৈরি হয়ে যাচ্ছে। নিজের নিষ্ফল আক্রোশ জাহির করার মাধ্যমে আপনি আমার আরও কাছাকাছি চলে আসছেন। সেটা কি আপনি জানেন?’

খুব ধীরে বাম হাতটি বাড়িয়ে পরখের সিল্কি চুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে শান্ত, সতেজ, মধুর কণ্ঠে আদ্রিকা বলল,

‘আপনি ইচ্ছে করে আমাকে এভাবে অপমান করেন। আমি বুঝি। কিন্তু আপনি বুঝতে পারেন না, আপনার এই কথাগুলো আমাকে কতোটা কষ্ট দেয়৷’

আদ্রিকার কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রইলেও চোখের মধ্যে জল চিকচিক করছে। ঝরে পরার ঝুকি নেই যদিও। জলের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়ে নিজের মাথা থেকে আদ্রিকার হাতটি সরিয়ে দিয়ে পরখ বলল,

‘তবে এসো না আমার কাছে।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদ্রিকা জবাব দিল।

‘আমার জীবনের এক আকাশসম আফসোস হচ্ছে, আমি চাইলেও আপনার থেকে দূরে থাকতে পারিনা। আপনি আমার অভ্যাসে মিশে গেছেন।’

দীর্ঘ সময় পেরিয়েও পরখকে দেখা গেল সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকতে। ঘুমের এক অধ্যায় শে৬করে আদ্রিকা পাশ ফিরে পরখকে জেগে থাকতে থেকে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। রাতের অর্ধেক পেরিয়েছে। ঘড়ির কাটা দুইয়ের ঘরে। সব ভুলে আদ্রিকার মস্তিষ্কে নতুন চিন্তার উদয় হল। সকালে পরখকে ভার্সিটি যেতে হবে এরপর আবার রেস্টুরেন্টে। অথচ মানুষটা এখনো ঘুমাচ্ছে না। অযথা জেদ দেখিয়ে নিজের ক্ষতি করছে। এগুলো কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কাজ হতে পারে!

পরখের দিকে চেয়ে আদ্রিকা চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করল,

‘আপনি ঘুমাবেন না?’

‘নাহ।’

‘এখানে আমি আছি বলে ঘুম আসছে না?’

‘হুম।’

‘ঠিক আছে। আমি চলে যাচ্ছি। আপনি প্লিজ ঘুমিয়ে পরুন।’

বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে গা থেকে চাদর ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল। বুক পর্যন্ত নেমে আসা মাত্র আদ্রিকার খেয়াল হল, তার গায়ে পোশাক নেই। আশেপাশে কোথাও তাদের দেখাও যাচ্ছে না। এখন নিজের কক্ষে কীভাবে যাবে? আদ্রিকা যখন চর্তুদিকে চোখ ঘুরিয়ে পোশাক খুঁজছিল, পরখ তার শার্টটি এগিয়ে দিল।

আদ্রিকা একপলক থমকে চেয়ে দেখে হাত বাড়িয়ে শার্টটি নিয়ে গায়ে জড়াল। উঠে বসে শার্টের বোতাম লাগাতে গেলে পরখ নিজেই উঠে বসে শার্টের বোতামগুলো লাগিয়ে দিল।
থমকানো আদ্রিকার নিশ্চলা চোখ বেয়ে টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে গাল বেয়ে নিচে নামতে থাকল। শার্টের বোতাম লাগানো শেষ করে পরখ তাকাল আদ্রিকার মুখের দিকে। আদ্রিকাকে তার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতে দেখে পরখ আলতো করে ওর গালের উপর জমে থাকা অশ্রুকণা মুছে দিল।

*****

খাবার টেবিলে বসে চুপচাপ নাস্তা খাচ্ছে পরখ। পাশের চেয়ারে বসে আছে আদ্রিকা। একটি প্লেটে আলু নিয়ে সেগুলো ছুলছে। ওর গায়ে গাঢ় খয়েরি রঙের একটি শাড়ি। চিকন সবুজ পাড়। ভেজা খোলা চুল থেকে টুপটাপ পানি ঝড়ে পরে গায়ের সবুজ ব্লাউজটি ভিজে গেছে। তবুও নির্বিকার ভঙ্গিতে ছু/রি দিয়ে আলু ছুলে চলেছে।
অনেকক্ষণ উসখুস করার পর পরখ জিজ্ঞেস করেই ফেলল,

‘তুমি কলেজে যাবে না?’

নিজের কাজে ব্যস্ত থাকা অবস্থায় আদ্রিকা জবাব দিল,

‘নাহ।’

‘কেনো?’

‘ঘুম পাচ্ছে। গতরাতে ঘুম হয়নি। এখন দুপুরের রান্না শেষ করে ঘুমাবো। তাই কলেজে যাবো না।’

হাতের আলু, ছু রি প্লেটের উপর রেখে পরখের দিকে বিরক্তিময় দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে আদ্রিকা আবারও বলল,

‘কেনো ঘুম হয়নি সেটাও বলল?’

পরখ থমথমে খেয়ে গেল। কোনোরকম দু’পাশে মাথা নেড়ে দ্রুত চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে আলুর দমের পুরো বাটি তার গায়ের উপর পরে গেল।
সাদা শার্ট পুরো তেলে মাখামাখি হয়ে বিশ্রী অবস্থা। পরখ হকচকিয়ে গেলেও আদ্রিকা নির্বিকার ভঙ্গিমায় তখনও চেয়ারে বসে।

‘শীট! পুরো শার্ট নষ্ট হয়ে গেল।’

পরখের আফসোসের বিপরীতে স্বাভাবিকভাবে আদ্রিকা জানাল,

‘শার্ট পাল্টে ওয়াশরুমে রেখে দিন। আমি ধুয়ে দিব।’

‘তরকারির ঝোলের দাগ উঠবে না। সাবান দিলে উল্টো হলুদ রঙ হয়ে যাবে। বাদ দেও।’

‘রেখে যান। আমি দাগ তুলে ফেলব।’

ভার্সিটির ক্লাস তাড়াতাড়ি শেষ করে পরখ আজকে বাড়ি ফিরল। বাড়িতে লাঞ্চ করে আদ্রিকাকে বলল,

‘দুপুরের খাবারের জন্য তিনতলায় সেটআপ করা হচ্ছে। দোতলায় ফাস্টফুড থাকবে, তিনতলায় মেইন কোর্স। এতে তোমার কাজ করতে সুবিধা হবে।’

আদ্রিকা শুধু মাথা দুলিয়ে সায় জানাল। এতোটুকু উত্তরে সন্তুষ্ট হলো না পরখ। জিজ্ঞাসা করল,

‘তোমার কোনো চাহিদা থাকলে বলতে পারো।’

‘কী ব্যাপারে?’

‘তিনতলার সাজসজ্জায়। মেইন কোর্সের পুরো দায়িত্ব রুমি তোমাকে দিতে চাইছে। দুটো ফ্লোর ও একা সামলাতে পারবে না।’

‘রুমি ভাইয়া বলেছে নাকি আপনি বলছেন?’

‘রুমিই বলেছে। এসবের মধ্যে আমাকে টানছ কেনো? আমি কিছু জানি না।’

‘আপনি নেই কেনো? ফিফটি পার্সেন পার্টনারশীপ আপনার অথচ আপনি কিছু জানেন না। ওখানে করেন কি আপনি? সব কিছু রুমি ভাইয়াকে একা সামলাতে হবে কেনো? দুটো ফ্লোর দুজন সামলাতে পারছেন না?’

‘রুমির সাথে আমার এ ব্যাপারে আগেই কথা হয়েছে। রেস্টুরেন্টের অভ্যন্তরীণ কাজে আমি নিয়মিত সময় দিতে পারব না। তাই মেইন কোর্স চালু করতে হলে, তোমাকে পুরো ফ্লোরের দায়িত্ব নিতে হবে। রান্না থেকে শুরু করে কর্মকর্তা এবং ক্রেতারও।’

‘কীভাবে সম্ভব! কখনো করেছি আমি? কোনো অভিজ্ঞতা নেই আমার। আমি পারব না।’

‘রুমি তোমাকে সাহায্য করবে। কাজ শিখে নিতে বেশি সময় লাগবে না। আপাতত রেস্টুরেন্টে যেকজন কর্মকর্তা আছে তাদের দিয়ে কাজ চালাও। কয়েকদিন পরে নতুন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নতুন লোক নিবে।’

‘কে নিবে? আমি?’

‘হ্যাঁ। ওদের সাথে তুমি কাজ করবে, তাই নিয়োগের কাজ তোমাকেই করতে হবে। ভয় নেই, রুমি থাকবে তোমার সাথে।’

আদ্রিকার জানতে ইচ্ছে হলো, রুমি থাকতে পারলে পরখ কেনো থাকতে পারবে না? যে কাজ রুমি শিখিয়ে দিতে পারবে সেটা পরখ কেনো পারবে না?

কিন্তু গতরাতের ঘটনার পর নতুন করে আর কোনো তর্কে যেতে ইচ্ছে করল না।

রেস্তোরাঁয় যাবার আগে পরখ জানতে চাইল,

‘শার্টের কিছু হলো? ওটা ঠিক না হলে, নতুন একটা হোয়াইট শার্ট বানাতে হবে।’

‘দরকার নেই। দাগ উঠে গেছে।’

পরখ বিশ্বাস করতে চাইল না৷ ছাদ থেকে আধা ভেজা শার্টটি এনে পরখের সামনে মেলে ধরে আদ্রিকা বলল,

‘দেখুন, কোথাও কোনো দাগ আছে? কোন হলুদ ভাব আছে?’

চোখের সামনে সাদা শার্টটিকে চকচক করতে দেখে পরখ অবিশ্বাসের সুরে জানতে চাইল,

‘কীভাবে তুললে?’

‘হারপিক দিয়ে।’

‘হোয়াট?’

‘হ্যাঁ। তরকারির দাগের উপর খানিকটা হারপিক ঢেলে ঘষা দিতেই সব দাগ গায়েব হয়ে গেল।’

‘ছি! তুমি আমার শার্টে টয়লেটের হারপিক দিয়েছো?’

‘এমন নাক মুখ কুচকানোর কি আছে? এমন ভাব করছেন যেনো হারপিকে টয়লেটের ময়লা লেগে আছে। ইনটেক্ট হারপিক ছিল। জীবাণুনাশক দেওয়ায় দাগ উঠানোর পাশাপাশি অন্য জীবাণু মরে গিয়েছে।’

‘সে যাই হোক, এই হারপিক দেওয়া শার্ট আমি পরবো না। আমার দরকার নাই।’

পরখ পরবে না বললেই আদ্রিকা মানবে কেনো? শার্ট শুকিয়ে যাওয়া মাত্র সেটিকে আয়রন করে সুন্দর করে ভাঁজ করল। পরখের আলমারিতে আরও কয়েকটি সাদা শার্ট আছে। নিত্যদিন ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য চারখানি সাদা শার্ট বানিয়ে রেখেছে। চারটে একই রকম সাদা শার্ট একখানে রাখলে সেখান থেকে হারপিক দিয়ে ধোয়া শার্ট বের করার সাধ্য পরখের নাই।

তাই পরখকে বিরক্ত করতে ভাঁজ করা শার্টটি বাকি তিনটের সাথে মিলিয়ে যত্ন করে তুলে রাখল আলমারির ভেতর।
এবার শার্ট খুঁজে বের করে দেখান মহাশয়।

শার্ট রেখে আলমারি বন্ধ করতে গিয়ে আদ্রিকার নজরে এলো একটি বিশেষ বস্তু। শার্টের পাশের র‍্যাকে রাখা আছে একটি ডায়েরি। গাঢ় নীল রঙের ডায়েরিটিকে আগে কখনো দেখেনি আদ্রিকা। আলমারির ভেতর এমন সযত্নে রাখতে দেখে ডায়েরির প্রতি বিশেষ আগ্রহ জন্মালো। ডায়েরিকে বের করে নিয়ে আলমারি বন্ধ করে দিয়ে এসে বসল পরখের বিছানার উপর।

ডায়েরি খুলে প্রথম কয়েকটি সাদা পাতা দেখা গেল। কিছু পাতা পেরিয়ে একটি দাগটানা সাদা পাতার উপর লাল, নীল, বেগুনি, গোলাপি, কমলাসহ বিভিন্ন রঙে একটি শব্দকে বারংবার লেখা হয়েছে। যা দেখে আদ্রিকা থমকাল।

পুরো পাতা জুড়ে গোটাগোটা অক্ষরে শুধু একটি শব্দ লেখা। “শুদ্ধতা, শুদ্ধতা, শুদ্ধতা।”

অজানা ভয়৷ আশংকায় আদ্রিকার বুকের ভেতর আলোড়ন সৃষ্টি হলো। বুকের ঢিপঢিপ শব্দ, শুকিয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বর, কাঁপতে থাকা হাত নিয়ে কিছুসময় আদ্রিকা নিশ্চুপ বসে রইল। ডায়েরির পাতা উল্টাতে ভয় হচ্ছে। না জানি কোন রহস্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে আদ্রিকার। আদ্রিকা পারবে তো সেই ঝড় সামলাতে? সে কি মানসিক ভাবে প্রস্তুত?

উত্তর মিলল না। কাঁপা হাত বাড়িয়ে ডায়েরির পাতায় লেখা শব্দগুলোকে ছুঁয়ে পরখের অনুভূতি বুঝতে চেষ্টা করল। প্রতিটি শব্দ খুব যত্নসহকারে লেখা হয়েছে, দেখেই বুঝা যায়।

আদ্রিকা লম্বা শ্বাস নিয়ে বুকের ভেতর অক্সিজেন ভরে নিল। দ্রুত পাতা উল্টাতেই দেখা মিলল সাদা পাতার। পাতা উল্টাতে থাকল আদ্রিকা। পরপর কয়েকটি পাতা উল্টানোর পর একটি পাতায় কিছু শব্দের দেখা গেল।

গোটাগোটা অক্ষরে লেখা পঙতিমালা।

“প্রিয় শুদ্ধতা,
তুমি নীলাম্বরের শুভ্র মেঘমালার মতো স্নিগ্ধ। মেঘের মতো ছুটে চলো, রেখে যাও একরাশ মুগ্ধতা।”

চলবে..
#অক্ষরময়ী

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

|৩৮|

“শুদ্ধতা,
ফুল ভালোবাসো? বাসবে নিশ্চয়ই। তোমার সাথে যতোবার দেখা হয়েছে, সেই তো ফুলের আশেপাশেই তোমাকে পেয়েছি।”

ডায়েরির শেষাংশে লেখা শব্দমালা পড়ে আদ্রিকার চোখ হতে টপটপ করে অশ্রু গড়াতে লাগল। পরখের ডায়েরিতে পানি পরে আবার পাতা ভিজে না যায়, তাই মুখ তুলে আশেপাশে তাকিয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে আবারও ডায়েরির পাতা উল্টানো শুরু করল। একটি করে পাতা খতিয়ে দেখার ধৈর্য্য আদ্রিকার নেই৷ সে এলোমেলোভাবে ডায়েরির পাতা উল্টাচ্ছে।

“শুদ্ধতা,

পদ্মফুল চেনো নিশ্চয়ই। দেবী দূর্গার পুজোয় অনেক পদ্মফুলের প্রয়োজন হয়, জানো?

আচ্ছা, পদ্মফুলের গোলাপী আভায় তুমি কি নিজেকে খুঁজে পাও? আমি কিন্তু পাই। সেদিন গোলাপী ওড়নায় মাথা ঢেকে দাঁড়িয়ে ছিলে। গোধূলি বেলায় বিদায়ী সূর্যটা নিজের সবটুকু উত্তাপ তোমার মাঝে বিলিন করে দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল৷ তোমার সেই আগুন উত্তাপে সেদিন এক প্রেমিক পুরুষ জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেছে৷ অথচ তুমি রুপবতী, ফুল নিয়ে খেলায় ব্যস্ত। আমার মতোন পথের ধারের প্রেমিক পুরুষের দিকে তাকানোর সময় কোথায়? কিন্তু এই প্রেমিক পুরুষটা তার হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা একাগ্র করে সেদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার সৌন্দর্যের উপমা খুঁজছিল। তখন অবশ্য খুঁজে পাইনি।

অপলক চেয়ে দু চোখের কোটরে অপার্থিব সেই সৌন্দর্য বন্দী করে আমি ফিরে এলাম আপন নীড়ে। যেখানে তুমি নেই৷

তুমিহীনা আমার চারপাশ খাঁ খাঁ করে৷ তৃষ্ণার্ত মরুভূমিতে আমি আরেক তৃষ্ণার্ত পথিক। নির্ঘুম রাত জেগে তোমার সৌন্দর্যের উপমা খুঁজি।

রাত পেরিয়ে ভোর এলো। পূর্ব আকাশে সূর্যটা যখন নিষ্পাপ, পবিত্র শিশুর মতো মায়াবী রুপে ধরণীর বুকে প্রথম শ্বাস নিল তখন আমি চেয়ে দেখলাম আরেক অপরুপ দৃশ্য। খুঁজে পেলাম নশ্বর পৃথিবীর অপার্থিব সৌন্দর্যের উপমা।

আমার বাড়ির সামনের কাঁচা রাস্তায় গতরাতের সামান্য বর্ষণের ছাপ রয়ে গেছে। জল জমে কাঁদা মাটি চলাচলের প্রায় অযোগ্য হয়ে গেছে৷ তারই বুকে শক্ত কদম ফেলে হেঁটে যাচ্ছে দুরন্ত এক বালক৷ তার উন্মুক্ত বক্ষে তখনও জলের ধারা। কোমরের নিচে কোনোরকম ঝুলে থাকা হাফপ্যান্টটি বোধহয় নীল রঙের ছিল। পানিতে ভিজে জবজবে সেই প্যান্টটি তখন কালচে দেখাচ্ছে। কাঁদায় পায়ের থাবা পরতেই ময়লা পানি ছিটকে পরছে ছেলেটির পায়ে৷ পায়ের পাতা থেকে পিঠ পর্যন্ত ছুঁয়ে যাচ্ছে কাদা জলের ফোঁটা।

সেদিকে খেয়াল নেই দুষ্টু ছেলেটির। তার মুখে রাজ্য জয়ের হাসি। সারা দেহে উচ্ছ্বাস। তার এক হাতে উঁচু করে ধরে রাখা কয়েকটি পদ্মফুল। যেনো তরবারি উঁচু করে যুদ্ধ জয়ের ঘোষণা দিচ্ছে। আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখলাম একজন ক্ষুদে যোদ্ধার যুদ্ধ জয়ের উচ্ছ্বাস, আনন্দ।
তার স্বচ্ছ হাসি দেখে আমার মুখেও হাসি ফুটল। নিকষকালো দীর্ঘ রাত পেরিয়ে আমি খুঁজে পেলাম আমার কাঙ্ক্ষিত উত্তর। বালকটির সেই তরবারিসম পদ্মফুলের মাঝে আমি খুঁজে পেয়েছি তোমায়। একগুচ্ছ পদ্মের হাসির আড়ালে আমি স্পষ্ট দেখেছি নির্মল, পবিত্র হাসির তোমাকে।

বালকটির হাতে ধরে রাখা পদ্মফুলগুলো বোধহয় আশেপাশের কোনো ডোবা থেকে তোলা। বালকটির দেহের মতোই পদ্মফুলের গোলাপী অঙ্গে তখনও জড়িয়ে আছে জলের ধারা। ভোরের মিষ্টি আলোয় মুক্তোর মতো চিকচিক করছিল সুক্ষ্ম জলের ফোঁটা।….. ”

বাকিটুকু পড়ার ইচ্ছে অবশিষ্ট রইল না। বিছানার উপর ডায়েরিটি ছুড়ে ফেলে আদ্রিকা উঠে দাঁড়াল। পরখের মতো অনুভূতিহীন, জড় বস্তুও প্রেমে পরতে পারে, সে ভাবনা কখনও আদ্রিকার মনে উদিত হয়নি। অথচ তেমনটি হয়েছে। পুড়েছে আদ্রিকার কপাল। আদ্রিকা এলোমেলো পা ফেলে পরখের টেবিলের সামনে উপস্থিত হল।
কে এই শুদ্ধতা? জানতে হবে আদ্রিকাকে। টেবিলের উপরে থাকা পরখের বইপত্র ঘাটতে শুরু করল। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে কোথাও না কোথাও শুদ্ধতার একটি ছবি সে অবশ্যই পেয়ে যাবে।

***

পরখ বসে আছে বীনব্যাগের উপর। কোলের উপর রাখা ল্যাপটপে পরদিনের পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করছে। আজকে বাড়ি ফিরে আদ্রিকার থমথমে মুখ দেখে পরখ সামান্য বিভ্রান্ত হয়েছে। কিন্তু কিছু বলেনি। এমনিতেই গতরাতের ঘটনার পর সে নিজেও সামান্য বিব্রত। নারীর সৌন্দর্যের বিমোহিত হয়ে তার দ্বারা এমন অবিবেচনাপ্রসূত কর্ম সম্পন্ন হতে পারে, তা পরখের এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না৷
রাতের কথা মনে পরলেই নিজেকে খুব নিকৃষ্ট জীব মনে হচ্ছে৷ তাই অতীতকে যতোটা সম্ভব এড়িয়ে থাকার চেষ্টায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে৷ এরমধ্যে আদ্রিকা নিজে থেকে দুরত্ব বজায় রাখাটা পরখের পক্ষে সুবিধাজনক হয়েছে।

খুব সাবধানে শব্দহীন দরজা খুলে কক্ষে প্রবেশ করল আদ্রিকা। সন্তপর্ণে এসে বসলো পায়ের কাছে মেঝেতে। পরখের দিকে মুখ উঁচু করে চেয়ে গাল রাখলো ওর হাটুতে৷ আলতো ত্বকের ছোঁয়ায় পরখ চোখ তুলে চাইল। এক মুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গেল সে। চোখের ভাষায় খেলা করল প্রশ্ন। কিন্তু নিস্তব্ধতার দেয়াল কেউ টপকাল না। দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে পরখ ফের মনোযোগ দিল কী-বোর্ডের বাটনে।

নিজের প্রতি পরখের এতো স্বল্প আগ্রহ দেখে আদ্রিকা ম্লান হাসল। মাত্র দু মিনিট সময় পরখ তার জন্য ব্যয় করেছে। এরপর ফিরে গেছে নিজের কাজে। আদ্রিকা হঠাৎ তার পায়ের কাছে চুপচাপ বসে রইল কেনো, তা জানার কোনো প্রয়োজন সে বোধ করেনি৷ আদ্রিকা জানত, এমনটাই হবে। তাই খুব বেশি দুঃখ পেল না। যতটুকু পেল তা পূর্বের তুলনায় খুব সামান্যমাত্র।

পরখের হাঁটুতে গাল ঠেকিয়ে আদ্রিকা চোখ বুজে মৃদুস্বরে বলে উঠল,

‘একবার কি হয়েছে জানেন? আমি কলেজ থেকে বের হয়েছি বাড়ি ফিরব বলে। ভর দুপুরে রিক্সা পাচ্ছিলাম না। আমি সচরাচর আমার বোনের সাথে চলাফেরা করি। একা চলার অভ্যাস আমার ছিল না, এখনও অবশ্য একাকিত্বে অভ্যস্ত হতে পারিনি।

সেদিন আপুর খুব জ্বর ছিল। একা কলেজে যাওয়ার ইচ্ছে আমার একদম ছিল না। একা থাকা আমার একদম পছন্দ নয়। সঙ্গের অভ্যাসে অভ্যস্ত আমাকে বকাঝকা করে মা জোর করে একলাই কলেজে পাঠিয়ে দিল। একবারও ভাবল না, যাকে আমি কখনও সাঁতার শিখাইনি, তাকে আজকে হঠাৎ করে মাঝদরিয়ায় ছেড়ে দিচ্ছি। মেয়েটা টিকে থাকবে কীভাবে?

ভরদুপুরে মাঝরাস্তায় একলা দাঁড়িয়ে আছি। একজন অটোচালক আমাকে ভরসা দিল, বাড়ি পৌঁছে দিবে। আমিও না সরল মনে ভরসা করে তার অটোতে চেপে বসলাম। অটো চলতে শুরু করল আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে।

আমার মনে সন্দেহ জাগেনি৷ আমি খুব সরল মনের সহজ ভাবনার মানুষ ছিলাম। কেউ অন্যায় করতে পারে এটা আমার জানা ছিল না। তবুও খানিকটা আগ্রহ থেকে প্রশ্ন করলাম, উল্টোদিকের রাস্তায় কেন যাচ্ছি?
অটোচালক বলল, ওদিকে তার একটু কাজ আছে। কাজ শেষ করে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিবে। আমি তাকে আরেকবার ভরসা করলাম৷

সেদিন সেই লোকটা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিল আমি জানি না। আমার সাথে কতোটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে পারতো সে কথা ভাবতে গেলে এখন গা শিউরে উঠে৷ ভাগ্যিস পথিমধ্যে রওশন চাচার সাথে দেখা হয়েছিল। চাচা আমার বাবার নার্সারির গাছপালা ডেলিভারির কাজ করে। ট্রাক নিয়ে বাড়ির পথে যাচ্ছিল। অটোতে আমাকে দেখতে পেয়ে সোজা এসে অটোর সামনে ট্রাক থামাল। সে এক সিনেম্যাটিক দৃশ্য। আমার কাছে জানতে চাইল, আমি এদিকে কোথায় যাচ্ছি। আমি তখনও নিশ্চিন্ত মনে অটোতে বসে আছি। চাচাকে সবটা বললাম।

আমার কথা শুনে আমাকে অটো থেকে নামিয়ে নিয়ে গিয়ে ট্রাকে বসিয়ে চাচা সেদিন বলেছিল, সরল মনে এভাবে সবাইকে বিশ্বাস করলে একদিন এমন ভাবে ঠকে যাবো যে পস্তানোর সুযোগ থাকবে না।

চাচার কথা সেদিন আমি বুঝিনি পরখ। যে আমার সাথে একটু হেসে কথা বলেছে, আমার প্রতি সামান্য আগ্রহ দেখিয়েছে তাকেই আমি আপন ভেবে নিয়েছি।

কেউ বলল বন্ধু হতে চায়, আমি তাকে প্রিয় বন্ধুর মর্যাদা দিলাম। কেউ এসে বলল, সারাজীবন আগলে রাখবে আমি তার হাতে নিজেকে তুলে দিলাম।

বারবার ঠকেছি, সরল মনে আবারও বিশ্বাস করেছি। যখনি কারো ছায়াতলে আশ্রয় পেয়েছি, আমি আমার সুরক্ষাচক্র ছেড়ে বেরিয়ে এসে হয়েছি সতর্কহীন। সেই সুযোগে ওরা আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।

সহজেই মানুষকে বিশ্বাস করার শাস্তি আমি আজও পাচ্ছি। ওরা কেউ আমার বিশ্বাসের মান রাখেনি, পরখ। সবাই ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে।

সবাই আমার সাথে এমন করে কেনো, পরখ? আমিই কেনো, পরখ? বারবার আমিই কেনো ঠকে যাই?’

কিছু মানুষ আছে যাদের মনটা কাদা মাটির মত। এরা সহজে অভিমান করে, আবার সহজে ভুলে যায়৷ আদ্রিকা তেমনি একটি মেয়ে। দীর্ঘসময় কোনো ক্লেশ মনে পুষে রাখা তার দ্বারা সম্ভব নয়৷ পরখ ওকে এর আগে বহুবার ভাঙতে দেখেছে, কাঁদতে দেখেছে৷ কিন্তু এতোটা নিস্তেজ হতে দেখেনি।
আদ্রিকার সর্বহারা কান্নার বহর পরখকে সামান্য চিন্তায় ফেলে দিল৷

পরখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তার পায়ের কাছে বসে আছে একজন নিঃস্ব, শুণ্য, সর্বহারা, দিশেহারা নারী। এই আদ্রিকাকে দেখে পরখের এবার খানিকটা ভয় হলো৷

কারন আদ্রিকাকে এখন জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত যোদ্ধার মত দেখাচ্ছে। যার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে৷ বেঁচে থাকার জন্য যে মানসিক শক্তি দরকার তা আদ্রিকার মাঝে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷

উদিত নতুন সমস্যায় বিরক্তবোধের থেকেও দুশ্চিন্তার পরিমাণ বেশি। এই মুহূর্তে কি বলে সান্ত্বনা দেওয়া উচিত বুঝতে পারছে না পরখ৷ আদ্রিকাকে হাটু থেকে সরিয়ে নিজে উঠে দাঁড়াল। ল্যাপটপটি বীনব্যাগের উপর রেখে আদ্রিকার দিকে তাকাল। মেঝেতে বসে একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে সে৷ পরখ নিজেও মেঝেতে হাটু গেড়ে বসে জানতে চাইল,

‘কি হয়েছে? এভাবে কাঁদছ কেনো?’

আঁচলের নিচ থেকে ডায়েরিটি বের করে পরখের সামনে ধরে আদ্রিকা জানতে চাইল,

‘শুদ্ধতা কে, পরখ?’

মুহুর্তে চেহারার রঙ উড়ে গেল পরখের। যেটুকু সহমর্মিতা ছিল তা উড়ে গিয়ে শক্ত হয়ে এলো চোয়াল। ছোঁ মেরে আদ্রিকার হাত থেকে ডায়েরিটি কেড়ে নিয়ে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আদ্রিকাকে বলল,

‘হাউ ডেয়ার ইউ? আমার জিনিসে হাত দিতে বারণ করেছি না তোমাকে? কোন সাহসে আমার ডায়েরি ধরেছো?’

হতবাক আদ্রিকা কান্না ভুলে পরখের দিকে চেয়ে রইল। পরখ ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে ডায়েরিটিকে যক্ষের ধনের মতো বুকে আগলে রেখে চলে গেল আলমারির সামনে৷ নির্দিষ্ট ড্রয়ারে ডায়েরিকে রেখে লক করে দিতে ভুলল না। আদ্রিকা অপলক চেয়ে দেখল, কীভাবে ওকে হেলায় ফেলে পরখ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷

মেঝেতে বসে থেকে আদ্রিকার কোমর ব্যথা ধরে গেছে। আদ্রিকার অসহায়ত্ব দেখার মত কেউ নেই। তাই নিজেই নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। বেসিনের আয়নায় নিজের চেহারা দেখে ম্লান হাসি দেখা দিল ঠোঁটে। চোখ জোড়া ফুলে গেছে। সাদা অংশে লালের ছটা। আঁজলা ভরে পানি নিয়ে যত্ন করে মুখ ধুয়ে নিল। শাড়ির আঁচলে চোখ-মুখ মুছে কক্ষের দিকে পা বাড়িয়েও থমকে গেল। বেহায়া মনটাকে মানানো যাচ্ছে না।

গুটিগুটি পায়ে বসার ঘর পেরিয়ে পা রাখল ছাদে। অন্ধকারে স্তব্ধ ছায়ামূর্তিকে দেখা যাচ্ছে যৎসামান্য। গভীররাত, প্রকৃতি খানিকটা শীতল। ঠান্ডা বাতাসে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। শাড়ির আঁচল চাদরের মতো মুড়ে আদ্রিকা পরখের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল। কানে এলো পরখের কণ্ঠের গুনগুন স্বর।

“দীর্ঘ তেপান্তরে বাঁধ ভেঙে যায়
কোনো এক আকাশ তাই, তোকে পেতে চায়।
তোর প্রেমে বুদ হয়ে এত আয়োজন।
মন খারাপের রাতে, তোকে প্রয়োজন
তাই এত আয়োজন, খুব তোকে প্রয়োজন।”

আদ্রিকা হাত বাড়িয়ে ছিল পরখের দিকে৷ গানের সুরে কণ্ঠের বেদনা অনুভব করতে পেরে হাতটি গুটিয়ে নিল। এখানে তার বিশেষ প্রয়োজন নেই৷ তাই ধীর পায়ে ফিরে গেল নিজের কক্ষে৷

*****

রসনাবিলাসী রেস্তোরাঁর দোতলার সিড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে আদ্রিকার পা থমকাল। তিনতলা থেকে নেমে আসছে পরখ। চোখে চোখ পরা মাত্র আদ্রিকা চোখ সরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকাল। পরখও দ্রুত পায়ে একপাশ দিয়ে চলে গেল নিচে।
সপ্তাহখানেক চলে চলল, দুজনের মধ্যকার কথাবার্তা বন্ধ। আদ্রিকার কষ্ট কমে গেলেও অভিমান এখনও তাজা। অন্যদিকে ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপের কারনে পরখ রেগে আছে। দুজনের কেউ হার মানতে নারাজ।

আদ্রিকাকে দেখে রুমি বিস্তৃত হেসে বলল,

‘সাজগোছ কেমন লাগছে?’

আদ্রিকা চারদিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখল। কাঠের তৈরি গোলটেবিল এবং চেয়ারে হলরুম সাজানো হয়েছে। বাঙলার ঐতিহ্যবাহী সরঞ্জামের চিত্র আঁকা দেয়াল জুড়ে। নানান রঙের হারিকেন ঝুলছে চার দেয়ালে। তাদের মিটিমিটি আলো দেখে মনে হচ্ছে সদ্য কিশোরী হাসছে৷
কাঠের টেবিলের উপর নীল রঙের কভার দেওয়া। তার উপরে রাখা হয়েছে কাঁসার তৈরি আসবাবপত্র।

আদ্রিকা এগিয়ে এসে একটি কাঁসার গ্লাস হাতে নিয়ে মুগ্ধ চোখে চেয়ে বলল,

‘অসাধারণ। এগুলো এতো সুন্দর! মনে হচ্ছে একসেট তুলে নিয়ে চলে যাই।’

একটি চেয়ার টেনে নিয়ে বসল রুমি। আদ্রিকাকেও বসতে বলল।

‘তাহলে দ্রুত সিসি ক্যামেরা লাগাতে হবে৷ কাস্টমার যদি মুগ্ধ হয়ে ব্যাগে ভরে নেয় তাহলে ব্যবসায় লাল বাতি জ্বলে যাবে।’

‘বাসনকোসন কে চুরি করবে!’

‘অনেকেই করে এবং করবে। সবাই তোমার মতো ভালো নাকি!’

বিপরীতে আদ্রিকা লাজুক হাসল। থালার সেটটিতে আদুরে হাত বুলিয়ে বলল,

‘আপনাকে বলার সময় আমি ভাবিনি, বাস্তবে এগুলো এতো সুন্দর দেখাবে। খুব সুন্দর এবং সিম্পল ডিজাইন চুজ করেছেন। কারিগরের হাতে জাদু আছে।’

‘আসবাবপত্র সম্পর্কে আমার একদম আইডিয়া নেই৷ পরখ আর অনু মিলে ডিজাইন চুজ করেছে। কারিগরের সাথে যাবতীয় শলাপরামর্শ ওরাই সামলেছে।’

‘ওহ। খরচ কেমন হলো?’

‘একটু বেশি হয়েছে। তবে মানানসই।’

‘এর থেকে কাঁচের কিনলেই ভালো হত৷ শুধু শুধু কাঁসার বায়না করে আপনার খরচ বাড়িয়ে দিলাম।’

‘আফসোস করবে না তো। এই স্বভাব আমার একদম পছন্দ নয়। যা হয়েছে তা নিয়ে আফসোস না করে, যা হতে চলেছে সেদিকে মনোযোগ দেও। এগুলো কাজে লাগিয়ে কীভাবে বিজনেস গ্রো করা যায় সেটা নিয়ে ভাবো। সিড়ির পাশের রুমটা তোমার অফিস। এই ফ্লোরের পুরো দায়িত্ব কাল থেকে তোমার। আমি তোমার ফ্লোরে আর আসব না। পুরোটা তোমাকে সামলাতে হবে কিন্তু।’

‘সেকি! আমি একা কীভাবে সামলাব?’

‘একাই সামলাতে হবে। এতোদিন আমার সাথে ঘুরে কি শিখলে, সেটা প্রমাণ করার সময় এসে গেছে।’

‘এডলিস্ট অনুকে আমার ফ্লোরে দেন।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। অনু তোমার সাথে থাকুক। বিকালের ইন্টারভিউ থেকে পাঁচজনকে সিলেক্ট করবে। সিভি তোমার অফিসে রাখা আছে৷ চেক করে নিও। তোমাকে হেল্প করার জন্য একজন শেফ আমি ঠিক করে রেখেছি। তাই আর শেফের প্রয়োজন হবে না।’

‘ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় আপনি থাকবেন না?’

‘তোমার ফ্লোরের লোকবল নিয়োগে আমার কি কাজ? ইন্টারভিউ তুমি একা নিবে।’

‘অসম্ভব। আমি একা পারব না। আপনিও সাথে থাকবেন।’

‘নাহ। একাই পারতে হবে।’

‘প্লিজ, প্লিজ ভাইয়া৷ আমি একা পারব না। আপনি অন্তত আমার পাশে বসে থাকবেন৷ যা প্রশ্ন করার আমি করব। আপনাকে কিছু বলতে হবে না, কিছু করতেও হবে না। তবুও আমাকে একা ছাড়বেন না। আমার ভয় লাগতেছে।’

‘ভয়ের কি আছে! ইউ আর দ্যা বস। তোমার অফিস, তোমার নিয়ম। এটা সবসময় মাথায় রাখবে। শুধুমাত্র নিজের বিবেক ছাড়া এখানে তোমাকে প্রশ্ন করার কেউ নেই। ফুল কনফিডেন্স নিয়ে মাথা উঁচু করে চলবে। বুঝেছ?’

‘জ্বি। কিন্তু তবুও ইন্টারভিউ রুমে আপনিও থাকবেন আমার সাথে।’

আদ্রিকার অনুরোধে রুমি ওকে সঙ্গ দিল। পাঁচজনের জায়গায় ছয়জনকে সিলেক্ট করল আদ্রিকা। ইন্টারভিউ শেষ হতেই রাত গড়িয়ে গেছে। বাকি কাজগুলো গুছিয়ে আদ্রিকা বলল,

‘ছয়জনকে কনফার্ম করলাম সমস্যা হবে না?’

‘রেস্টুরেন্ট জনপ্রিয় হয়ে গেলে ছয়জনও কম পরে যাবে। কালকের জন্য তৈরি হয়ে নেও। বিগ ডে ফর ইউ।’

আদ্রিকা দু হাত কচলে ভীতু স্বরে বলল,

‘নার্ভাস লাগছে ভাইয়া।’

‘কেনো? এতোক্ষণ অফিস রুমে শিরদ্বারা সোজা করে বসেছিলে। চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কন্ঠে প্রশ্ন করছিলে। সেই আদ্রিকা কোথায় গেলো?’

‘ওটা কাজের জন্য করতে হয়েছে৷ কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি অনেক ভয় পেয়েছি। আমি যতোই সাহসী, আত্মবিশ্বাসী হয়ে ঘুরে বেড়াই না কেনো, ভেতরে ভেতরে আমি সেই বোকা মেয়েটাই রয়ে গেছি। আসলে মানুষ চিরকাল একইরকম থাকে। পরিবর্তনের নামে সময় ও পরিস্থিতিভেদে মুখোশ পরতে বাধ্য হয় শুধু। শক্ত খোলসের আড়ালে খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেই ভীতু, আনাড়ি সত্তাটা মনের ভেতর কোনো এক অন্ধকার কুঠুরিতে ঘাপটি মেরে বসে আছে৷ পাছে কেউ দেখে ফেলে সেই ভয়ে সামনে আসছে না। নির্ভরযোগ্য মানুষ পেলে আমাদের সেই প্রকৃত সত্তা বেরিয়ে আসে। আমরা ভেঙে পরি, কান্না করি, ভয় পাই, শঙ্কিত হই। শত শত লজ্জাজনক কাজকর্ম করি।
সেগুলো কি সবার সামনে প্রকাশ করা যায়? নিজের মানুষের সামনে পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ দূর্বল, ভঙ্গুর। তাই নয় কি?’

‘নিজের মানুষ! এটা অবশ্য ঠিক বলেছো। তবে যার-তার সামনে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে যেও না। অকৃতজ্ঞ মানুষ তোমার গোপন কথা শুনবে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে। কিন্তু দিনশেষে সেই তোমার দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তোমাকে পাল্টা আঘাত করতে দ্বিতীয়বার ভাববে না। তাই সাবধান৷ এখানে সবার সাথে মিশবে, কথাবার্তা বলবে, ভালোবাসবে। কিন্তু কাউকে অন্ধবিশ্বাস করবে না। এমনকি আমাকেও না। অনেক রাত হয়েছে, তুমি এখন বের হও। দাঁড়াও, পরখ বের হবে কিনা জিজ্ঞাসা করি৷ ওর সাথে যাওয়াটাই ভালো হবে।’

পরখকে জিজ্ঞাসা করতেই সে জানাল, তার ফিরতে দেরী হবে৷ আরও কিছু কাজ বাকি আছে। অগত্যা রুমি নিজেই আদ্রিকাকে একটি রিক্সায় উঠিয়ে দিল।

ফিরে গিয়ে অফিস রুমে ঢুকে একটি চেয়ারে ধপ করে বসে রুমি বলল,

‘কি এমন জরুরি কাজ করতেছিস? সেই যে এসে রুমে ঢুকলি, একবার বেরও হইলি না।’

পরখের চোখ ল্যাপটপের স্ক্রীনে, কীবোর্ডে সচল আঙ্গুল। বলল,

‘স্যালারি শীটের কাজ করছি। তোদের ইন্টারভিউ কেমন গেল?’

‘দারুণ একটা ইন্টারভিউ নিলাম, মামা। তোর বউ তো পুরো আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এবার দেখে আসতে পারতি।’

পরখ মুখ তুলে রুমির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে আবার নিজের কাজে ফিরে গিয়ে বলল,

‘আগুন না ছাই। ভয় পেয়েছে নিশ্চয়ই?’

‘একদম না। তুই অযথা ওকে ভীতু বলিস। আজকে আদ্রিকাকে দেখে মনে হয়েছে, তুই ওর নামে রিউমারস ছড়াইছিস।’

‘ও কেমন ভীতু, লাজুক, অনিশ্চিত সেটা আমার থেকে বেশি কেউ জানে না। বোকার সর্দার একটা।’

‘তবে ব্রেন অনেক শার্প। খুব দ্রুত শিখে নেয়। আমার সাথে তিনদিন কাজ করছে। আমার চলাফেরা, কথা বলার ভঙ্গিমা, বসার স্টাইল পর্যন্ত সবকিছু আয়ত্ত করে নিয়েছে। আদ্রিকাকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি।’

‘শুধু পড়াশোনাটাই তার আয়ত্তে আসে না৷ পড়তে বসলে ঘুম পায়, ক্ষুধা পায়, মাথা ব্যথা করে।’

‘সবাই তোর মতো বইপড়ুয়া না। আমাদের মতো ফাঁকিবাজ স্টুডেন্টও দুনিয়ায় আছে।’

‘এজন্যই আদ্রিকার সাথে আমার যাচ্ছে না। তোদের ভালো মানাবে বুঝলি। দুজনে মিলে ব্যবসায় লাল বাতি জ্বালিয়ে দিবি।’

‘আমাদের ব্যাকআপ হিসেবে তুই আছিস না? আর কীসের চিন্তা!’

‘বেশি আশা করিস না। আদ্রিকাকে মেসেজ করে দেখ, বাড়ি পৌঁছেছে কিনা।’

‘এতো চিন্তা হলে নিজেই খোঁজ নে৷ আমাকে বলতেছিস কেন?’

‘আমি কাজ করতেছি, দেখতে পাচ্ছিস না?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। খুব দেখতে পাচ্ছি। কাজ করে একদম ভাসায় দিচ্ছো তুমি। বালের ব্যস্ততা দেখায়। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ কর। বাড়ি যাব।’

‘ডিনার রেডি করতে বল।’

‘বাড়ি গিয়ে খা।’

‘এখানে খাইলে কি সমস্যা?’

‘কোনো সমস্যা নাই। সেই তো তোর বউয়ের হাতের রান্না-ই। এখানেও যা, বাড়িতেও তা। নতুন দম্পতি, কোথায় বাড়িতে বসে রোমান্টিক ডিনার করবে, তা না রেস্টুরেন্টে খাচ্ছে।’

‘আজকাল খুব রোমান্টিকতা জাগতেছে তোর। ব্যাপার কি?’

‘কোনো ব্যাপার নাই। তোর বউ, তোর ডিনার। যা ইচ্ছা কর।’

চলবে…
#অক্ষরময়ী