#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৪৪|
শ্রাবণের শুরুটা হয়েছে ঝুম বৃষ্টি মাধ্যমে। প্রকৃতির বুকে এতো অভিমান লুকিয়ে আছে কে জানত! দিনরাত নিরবধি চলছে তার বর্ষণ। চারদিকের গুমোট আবহাওয়ার দিকে তাকিয়ে চঞ্চল কিশোরীর মন ভার হয়ে আসার উপক্রম। উচ্ছ্বল, দুরন্ত কিশোরটাও বন্ধ ঘরে আটকা পরে আছে। খোলা জানালা দিয়ে মলিন মুখে তাকিয়ে দেখছে প্রকৃতিকন্যার অবিরাম জলধারার নাচন।
মায়ের বকা এড়িয়ে সে হয়তো ঘর ছেড়ে আজ বাইরে বেরিয়ে পরত। ঘরবন্দী জীবনযাপনে সে ক্লান্ত। বাইরে ঘাস ভরা মাঠ জলে থইথই করছে৷ একটু কষ্ট হলেও এমন আবহাওয়ায় ফুটবল খেলতে দারুণ মজা হতো। কিন্তু থেকে থেকে দূর আকাশ হতে আলোর ছটা ধেয়ে আসছে। আকাশ পাতাল এক করে চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ। চোখ ধাধানো সেই আলো দেখে কিশোরের আর সাহসে কুলায় না। সে শুধু জানালার ধারে দাঁড়িয়ে অবিরাম বর্ষণ দেখে৷
এমনি এক খোলা জানালার ধারের টেবিলে বসে আছে আদ্রিকা৷ একটু আগে আকাশে যে বিকট শব্দ হলো, সেটা শুনতে পেলে এতোক্ষণে তার প্রাণপাখিটা বোধহয় উড়ে যেতো। কিন্তু আদ্রিকার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বলে সেই শব্দ আদ্রিকা শুনতে পায়নি। পাবেই বা কি করে! এই মুহুর্তে সে টেবিলে মাথা এলিয়ে দিয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন। ঘুম এতোটাই গভীর যে বাইরে থেকে ভেসে আসা ডাকও তার কর্ণগোচর হচ্ছে না।
চুলা থেকে চায়ের পাতিল নামিয়ে দুটো কাপে চা ঢেলে নিল পরখ। আরেকবার উচ্চস্বরে ডাকল,
‘আদ্রিকা?’
এবারও কোনো জবাব না পেয়ে কপালে গভীর ভাঁজের সৃষ্টি হলো৷ পড়াচোর মেয়েটি নিশ্চয় এই অবেলায় ঘুমাচ্ছে। অবশ্য ঘনঘোর বর্ষার বাতাসে যে আলস্য ভেসে বেড়াচ্ছে, তাতে বেশিরভাগ মানুষ বোধহয় একমুহূর্তে গভীর ঘুম মগ্ন। কিন্তু আদ্রিকার ঘুমানো উচিত হয়নি। এটা মোটেও অলসতা করার সময় নয়।
ডাইনিং টেবিলের উপর চায়ের কাপ দুটো রেখে পরখ এগিয়ে গেল আদ্রিকার কক্ষের দিকে। বন্ধ দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল, তার সন্দেহ ঠিকই ছিল। বইপত্র খোলা রেখে এলোমেলো টেবিলে মাথা রেখে গভীর ঘুমে মগ্ন আদ্রিকা। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে আদ্রিকার পাশে দাঁড়াল পরখ। গাঢ় স্বরে ডাকল,
‘আদ্রিকা?’
ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় ভীষণ বিরক্ত হলো আদ্রিকা। কপালে বিরক্তির রেখা দেখা দিল। ঠোঁট উল্টে একটুখানি নড়েচড়ে আবারও তলিয়ে গেল ঘুমের দেশে। আদ্রিকার এমন প্রতিক্রিয়ায় আরও তপ্ত হলো পরখের মেজাজ। ওর বাহু ধরে ঝাঁকি দিয়ে জোরালোভাবে ধমক দিল।
‘এই মেয়ে, উঠো বলছি৷ এই তোমার পড়াশোনার নমুনা?’
তৎক্ষণাৎ চোখ মেলে তাকাল আদ্রিকা৷ সামনে পরখকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তড়াৎ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। পরখের শক্ত চোয়াল, দৃপ্ত চোখজোড়া আদ্রিকার হৃদয়ে শীতল হাওয়া বইয়ে দিল। হাত দ্বারা দু চোখ কচলে শুকনো ঢোক গিলে বলল,
‘ঘুমাচ্ছিলাম না। পড়তে পড়তে হুট করে চোখ লেগে এসেছিল মাত্র।’
পরখ উত্তর দিল না। কিন্তু তার নীরব চাহনি যেনো অনেককিছু বলে দিল। ভয়ার্ত আদ্রিকা মুখে গাঢ় আঁধার নামিয়ে ফের বসে পরল চেয়ারে। বিরস মুখে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,
“হায়, তাত, উচিত কি তব এ কাজ,
নিকষা সতী তােমার জননী, সহােদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ?
শূলিশম্ভুনিভ কুম্ভকর্ণ? ভ্রাতৃপুত্র বাসববিজয়ী!
নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?
চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?”
একবার নয়, বারংবার একই লাইন পড়ে যেতে থাকল আদ্রিকা। তবুও কিছুতেই মনে থাকছে না। বিরক্ত হয়ে দু হাতে মাথার চুলগুলো টেনে ধরল।
পরখ তখনো কক্ষ ত্যাগ করেনি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখছিল আদ্রিকার কার্যকলাপ। এমন চুল টানাটানি করে এই প্রথমবার কাউকে পড়াশোনা করতে দেখে যারপরনাই অবাক হলো। পড়াশোনা করছে নাকি যুদ্ধ লড়ছে!
‘চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। খেয়ে এসে পড়তে বসো।’
পেছন থেকে ভেসে আসা শীতল কণ্ঠস্বরে আদ্রিকা আরেকবার চমকে পেছন ফিরে তাকাল। ততোক্ষণে দরজা পেরিয়ে পরখ বেরিয়ে গেছে।
আদ্রিকার পরীক্ষার কারণে আজকে রেস্তোরাঁয় যায়নি পরখ। কেউ পাহারায় না থাকলে এই ফাঁকিবাজ মেয়ে যে পড়াশোনা করবে না সেটা সে ভালো করেই জানে। রেস্তোরাঁয় না যাওয়ার ফলস্বরূপ এখন বাড়িতে বসেই কাজ করতে হচ্ছে তাকে।
ম্লান হয়ে আসা সন্ধ্যায় নিজ কক্ষের জানালার ধারের টেবিল চেয়ারে বসে রসনাবিলাসীর ওয়েবসাইটের কিছু কাজ করছিল পরখ৷ তখনি দরজায় উঁকি দিল আদ্রিকা৷ দুরুদুরু বুকে সাহিত্যপাঠ বইটি চেপে ধরে সতর্কতার সাথে বলল,
‘পরখ, আসব?’
পরখ ঘাড় ঘুরিয়ে আদ্রিকাকে দেখে অবাক হলো। পড়াশোনা রেখে এই মেয়ে এখানে কেনো এসেছে? আদ্রিকা যতোবারই পরখের কক্ষে আসে, কোনো না কোনো ঝামেলা বেঁধে যায়। অন্তত পরীক্ষার আগেরদিন পরখ কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাইছে না। তাই কারণ শুধাল,
‘কি চাই?’
আদ্রিকা ভদ্রলোক বলেই অনুমতি চেয়েছে৷ অন্য কেউ হলে খোলা দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে কক্ষে প্রবেশ করত। কিন্তু পরখ সে ভদ্রতার মান রাখল না। প্রশ্নের জবাবে আরেকটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে রীতিমতো আদ্রিকাকে অপমান করল। তাই আদ্রিকাও বিনা অনুমতিতে ধুপধাপ কক্ষে প্রবেশ করে পরখের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আমার একলা পড়ার অভ্যাস নেই। সবসময় আপুর সাথে পড়তে বসতাম। এখন একলা পড়তে বসলে ঘুম পাচ্ছে। ঘুমিয়ে গেলে আপনি আবার বকা দিবেন।’
বুকের উপর দু হাত ভাঁজ করে পরখ জানতে চাইল,
‘তো আমি এখন কি করতে পারি?’
‘আমি কিছুক্ষণ আপনার রুমে পড়ি? আপনাকে একদম ডিস্টার্ব করব না। মনে মনে পড়ব। একটুও শব্দ হবে না। আপনি আপনার কাজ করুন, আমি আমার পড়া পড়ি।’
প্রস্তাবটি রেখে ভীষণ আশা নিয়ে পরখের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল আদ্রিকা। কিন্তু পরখ কোনো উত্তর দিল না। শুধু আগের মতোই সূক্ষ্ম চোখে চেয়ে রইল। আদ্রিকা ভেবেই নিল, পরখ তাকে এই কক্ষে ঠাঁই দিবে না। সেটা পড়াশোনার জন্য হোক কিংবা অন্য কোনো কাজে। পরখের কক্ষে, পরখের জীবনে আদ্রিকার বিশেষ কোনো স্থান নেই৷ সত্যটি মেনে নিয়ে মাত্রই কক্ষ ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিয়েছে আদ্রিকা, তখনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল পরখ৷ টেবিল হতে নিজের ল্যাপটপটি তুলে নিয়ে বলল,
‘টেবিল চেয়ারে বসে পড়ো।’
চাঁদের হাসির মতো স্বচ্ছ হাসি খেলে গেল আদ্রিকার মুখে। অন্ধকার আকাশের উজ্জ্বল তারার মতো মিটমিট করে জ্বলতে লাগল তার চোখ দুটো। চঞ্চল ঝর্ণার মতো কলকল করতে করতে পরখের চেয়ার টেবিলে নিজের জায়গা করে নিল সে।
মস্ত বড় রকিং চেয়ারটিতে বসে নিজেকে চুনোপুঁটি মনে হল আদ্রিকার। আরামে গা এলিয়ে দিল চেয়ারে। ঘূর্ণন চেয়ারটির হাতলে হাত রেখে ডানে বামে ঘুরে আদ্রিকা খিলখিল করে হেসে উঠল।
‘ ওয়াও! এটা গোল গোল ঘুরতেছে।’
বিছানায় আসনরত পরখ আদ্রিকার শিশুসুলভ আচরণে আলতো হাসল। কয়েক মুহূর্ত বাদে কণ্ঠে ছন্দ রাগ নিয়ে বলল,
‘পড়াশোনা করতে এসেছো নাকি ফাজলামি করতে? এই বয়সে এসে বাচ্চামী করছ। লজ্জা করে না?’
ঘাড় ঘুরিয়ে পরখের দিকে তাকিয়ে মুখ ফুলাল আদ্রিকা। খোলা চুলগুলো হাত খোঁপা করে মনোযোগ দিল বইয়ের পাতায়৷ কোনোরকম পাঁচ মিনিট পড়ার পর বিরক্ত হয়ে স্বগতোক্তি করল,
‘পঙ্কজ-কানন আগে নাকি পঙ্কিল সলিল?রাজহংস নাকি মৃগেন্দ্র কেশরী? বীরকেশরী, শৃগাল – সবই একই লাগে। কে আগে, কে পরে? ইয়া মাবুদ, এসব মনে রাখতে গিয়ে আমি পাগল হয়ে যাবো৷ চুলগুলো উঠে গিয়ে মাথায় টাক পরে যাবে৷ কবিতা নাকি শব্দের খেলা! পড়াশোনা এতো কঠিন কেনো খোদা?’
নিজের কাজ রেখে হতবিহ্বল পরখ আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে রইল। সামান্য এক কবিতা পড়তে গিয়ে এই মেয়ের এমন হাল হলে পরীক্ষায় পাস করবে কীভাবে?
‘মুখ বন্ধ রেখে পড়ো। বেশি কথা বললে রুম থেকে বের করে দিব।’
মুখ ফিরিয়ে আদ্রিকা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
‘এতো পড়ে কি হবে? কেনোই বা পরীক্ষা দিতে হবে? আমার এসব কিছুই মনে থাকছে না।’
‘তোমার মতো হাজারো স্টুডেন্ট এই কবিতা মুখস্থ করে বসে আছে৷ তুমি গর্দভ, ফাঁকিবাজ বলেই কয়েকটা মাত্র লাইন মনে রাখতে পারছ না।’
পরখের অপমানের বিপরীতে মুখ কুঁচকে বইয়ের পাতায় ফিরে গেল আদ্রিকা। কোমর বেঁধে লেগে পরল কাজে৷ অন্য সকল অধ্যায় জলে যাক, কিন্তু আজকে এই কবিতা সে মুখস্ত করেই ছাড়বে৷ তাকে গর্দভ বলা! রান্নার কতো কতো মশলার নাম, কতোগুলো স্টেপ! সব আদ্রিকার মনে থাকে৷ কখন কোনটা দিতে হবে, কোনটার পরে কোনটা দিতে হবে সব আদ্রিকার নখদর্পনে। এই সামান্য কবিতা কী এমন কঠিন জিনিস!
রাতের রান্নাটা আজকে পরখ করেছে। বেগুন ভাজি, পাতলা ডাল, ডিম ভাজি। খেতে বসে আদ্রিকা বড্ড দুঃখ করে বলল,
‘উপকারের নামে বেগম রোকেয়া আমাদের কতো বড় ক্ষতি করে গেছেন সেটা আজকে বুঝতে পারলাম।’
পরখ বিশেষ আগ্রহ দেখাল না। আদ্রিকা ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে দেখে দায়সারাভাবে জানতে চাইল,
‘কি ক্ষতি করে গেছেন উনি?’
‘মেয়েদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা, নারীবাদী সত্তা জাগ্রত করা। উপকারের নামে চাপে ফেলে দিয়ে গেছেন। উনার জন্য এখন এতো কষ্ট করে লেখাপড়া করতে হচ্ছে। মেয়েরা বাইরে বের হচ্ছে রোজগারের জন্য। আগে যেমন ঘরের কাজ করত, এখনো সেটাই করছে। উপরন্তু যুক্ত হয়েছে বাইরের কাজ। এতে কী লাভ হলো বলুন? ঘরের কাজ করো, বাইরের কাজও করো। এই যে মেয়েরা সমান অধিকারের নামে ঘরে বাইরে সমান সুযোগ চাইল, আসলে কি সেটা পেয়েছে? একটা ছেলে অফিসে কাজ করে, ঘরে এসে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বলে, এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও।
অন্যদিকে একটা মেয়ে অফিস থেকে এসে ব্যাগটা রেখে ছুটে যায় রান্নাঘরে। স্বামীকে একগ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে তারপর নিজের শুকনো গলা ভেজায়। এই হলো সমান অধিকারের নমুনা।
সমান অধিকার চাইলে এমনভাবে চাও, যেনো অফিস থেকে ফিরে সংসারের কাজ দুজনে ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়৷
নির্বোধের দল। স্বাধীনতা চাইতে গিয়ে ঘাড়ের উপর দ্বিগুণ বোঝা তুলে নিয়েছে। এখন ঘরেও কাজ করো, বাইরেও কাজ করো। তারপর পড়াশোনা নামক এক ঝামেলা তো আছেই৷’
আদ্রিকার কথায় পরখ ভ্রু কুচকে শীতল চোখে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা ঠিক কি বলতে চাইছে?
‘হোয়াট ইউ মিন বাই দিস?’
‘কতো কথাই তো বললাম! কোনটার কথা বলছেন?’
‘ঘরে-বাইরে কাজের যে তুলনাটা তুমি দিলে, সেটা কেনো দিলে? যাস্ট বিকজ, আই ফোর্স ইউ টু ওয়ার্ক আউটসাইড। আই টোল্ড ইউ টু মেক ইউর য়োন আইডেন্টিটি। তোমার মনে হচ্ছে, আমি নারী পুরুষ সম অধিকারের ফায়দা নিচ্ছি। তোমাকে দিয়ে ঘরে বাইরে উভয় কাজ করাচ্ছি?’
পরখের কথায় আদ্রিকা থমথমে খেয়ে গেল। সে কখন এমন অভিযোগ করল? এতোক্ষণের উচ্ছ্বসিত পরিবেশে হঠাৎ করে যেনো দমকা হাওয়া বয়ে গেল। আমতা-আমতা করে আদ্রিকা বলল,
‘ওটা তো যাস্ট কথার কথা বললাম। যাস্ট অ্যা এক্সামপল।’
‘নো। ইটস নট যাস্ট অ্যা এক্সামপল। তুমিও বাইরে কাজ করো, আমিও করি। বাড়ি ফিরে আমি কখনো তোমার কাছে পানি চাইনি। কখনো কোনো কাজের জন্য তোমাকে হুকুম করিনি৷ যখন তুমি রেস্তোরাঁয় কাজ করতে না, তখনও আমি তোমাকে কোনো কাজের আদেশ দেয়নি। রান্নাবান্না যা করার তুমি নিজে করেছো। নিজের চাহিদায় করেছো। আই ডিডেন্ট ফোর্স ইউ। যদি তোমার চাপ মনে হয় তবে করো না। এ বাড়িতে তুমি আসার আগে সব কাজ আমিই করতাম। এখনো করতে পারব। হাত গুটিয়ে থাকার মত মানুষ আমি নই। বরং নিজের কাজ, আমি নিজেই করতে পছন্দ করি। তোমার সাহায্যের আমার প্রয়োজন নেই।’
এতো এতো কথা শোনার পর আদ্রিকা হতবাক হয়ে গেল। পরীক্ষা নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তার ফলে সে না হয় ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে কিছু কথা বলে ফেলেছে। সেগুলো বাড়িয়ে ছড়িয়ে কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে পরখ? ছলছল চোখে পরখের কঠোর মুখটির দিকে তাকিয়ে সিক্ত কণ্ঠে আদ্রিকা বলল,
‘এমন কোনো অভিযোগ আমি করিনি। রান্নাবান্না করা, ঘর গুছানো, কাপড় ধোয়া এসব নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। সংসারের কাজ করতে আমার ভালো লাগে বলেই করছি৷ আমরা মেয়েরা ভালোবেসে সংসার করি, কোনো দায়িত্ববোধ থেকে নয়।’
‘ওহ, তবে রেস্তোরাঁর কাজটা তোমার উপর আমি চাপিয়ে দিয়েছি৷ তাই তো? পড়াশোনা চাপিয়ে দিয়েছি। এটাই বলতে চাইছ? বেগম রোকেয়াকে নিয়ে একটু আগে যা বললে, সেটা বেগম রোকেয়ার সময়কালে জন্মালে অবশ্যই বলতে না৷ উনার লেখা অবরোধবাসিনী বইটি একবার পড়ো। সেযুগে মেয়েদের অবস্থা কতোটা করুণ ছিল সেটা আগে জেনে নিও। তাহলে নারী শিক্ষার মর্ম বুঝবে।
আর আমি জোর করেছি বলে, তোমাকে নিজ ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করতে হবে না। আমি বলেছি বলে তুমি কেনো কিছু করবে? হু আই আম টু ইউ? আ’ম নো বডি। আমাদের মাঝে কোনো প্রকার সম্পর্ক নেই, সেটা আগেও হাজারবার তোমাকে বলেছি। আমাকে কেন্দ্র করে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়া বন্ধ করো।’
হতভম্ব আদ্রিকাকে টেবিলে বসিয়ে রেখে এঁটো প্লেট হাতে নিয়ে পরখ উঠে গেল। আদ্রিকার আর খাওয়া হলো না। নিশ্চল বসে রইল আরও কিছুক্ষণ।
পরখের সাথে মন খুলে কোনো কথা বলা যায় না। দুজনের যে কোনো আলোচনা কোনো না কোনোভাবে ঝগড়ার দিকে চলে যায়। স্বামী স্ত্রী যদি নিজেদের মধ্যে মন খুলে কথাটুকুও বলতে না পারে, তবে সেটা কেমন সম্পর্ক হলো? এতোটাই ঠুনকো বন্ধনের উপর ভর করে আদোও জীবন চলে?
অনেকদিন পর আবারও নিজেকে ভীষণ একা মনে হলো আদ্রিকার। এই চার দেয়ালের মাঝে তার নিজের বলে কেউ নেই। যাকে নিজের মনের কথা বলা যায়। কোনোরকম নিয়ম কানুন, ভদ্রতার বাচবিচার না করে মনের দরজা খুলে দেওয়া যায়। নিজেকে সবচেয়ে দুর্বলভাবে তার সামনে তুলে ধরা যায়। নাহ, এমন কেউ নেই আদ্রিকার জীবনে। সবার সাথে আদ্রিকাকে অভিনয় করে চলতে হয়।
নিজ পরিবারের সামনে দাম্পত্য জীবনে সুখী হওয়ার অভিনয়, শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সামনে যোগ্য বউ হওয়ার অভিনয়, স্বামীর সামনে একজন পরিপক্ক মানসিকতাসম্পন্ন জীবনসঙ্গী হওয়ার অভিনয় করে যেতে হয়। কেনো একজন নারী নিজ অসম্পূর্ণতা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না? কেনো তাকে শুধুমাত্র পরিপূর্ণ, পূর্ণতাপ্রাপ্ত হতে হবে?
তীক্ষ্ণ দন্তের মাঝে অধর চেপে ধরে কান্না আটকাল আদ্রিকা। কিন্তু চোখের জল আটকানোর মতো পরিপক্কতা সে এখনও অর্জন করতে পারেনি। তাই চক্ষু জলে কপোল ভেসে গেল।
এই মুহুর্তে পরখের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও হাতের কাজগুলো গুছিয়ে পরখের কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো আদ্রিকা। পরখের পড়ার টেবিলে ওর বইপত্র রয়েছে, ওগুলো নিয়ে আসতে হবে৷
সকালে ভার্সিটির জন্য ব্যাগপত্র গোছাচ্ছিল পরখ৷ আদ্রিকাকে ক্লান্ত পায়ে কক্ষে প্রবেশ করতে দেখেও যেন দেখল না।
অথচ একটু আগে যার মুখদর্শন করতেও ইচ্ছে হচ্ছিল না, এই মুহুর্তে তার সাথে কথা বলার জন্য আদ্রিকার বেহায়া মন উশখুশ করতে লাগল৷ কিন্তু না, সমস্যা আরও গাঢ় করার ইচ্ছে আদ্রিকার নেই। সে নিজের মনকে কড়া চোখ রাঙানি দিয়ে সোজা হেঁটে গিয়ে বসল চেয়ারে৷
বিক্ষিপ্ত মনে বইয়ের সমস্ত লেখা বিষাক্ত ঠেকছে। একেরপর এক পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছে আদ্রিকা। কোনোকিছু পড়তে ইচ্ছে করছে না। বইয়ের পাতায় মনোযোগ ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না৷ মনটা বারবার ছুটে যাচ্ছে কক্ষে অবস্থিত অন্য ব্যক্তিটির দিকে৷ সে ল্যাপটপ ব্যাগের চেইন আটকাচ্ছে, পানির বোতল হতে ঢকঢক করে পানি খাচ্ছে, মোবাইলটি টেবিলের উপর রাখছে – সবকিছুতেই আদ্রিকার মনের আগ্রহ অপরিসীম। এখানে মনোযোগের কোনো কমতি নেই৷
পরখ বিছানায় শুয়ে হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে মোবাইলটি হাতে নিল। আদ্রিকা দু চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ার ঘুরিয়ে পরখের দিকে তাকিয়ে বিরক্তিমাখা সুরে বলল,
‘কালকে আমার পরীক্ষা,পরখ।’
পরখ মোবাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আদ্রিকার দিকে তাকাল। এই মেয়ের হয়েছেটা কি? ওর যে পরীক্ষা সেটা কি পরখ জানে না! নতুন করে বলার কি আছে? হেয়ালি করে পরখ বলল,
‘তাই নাকি?’
নিচের ঠোঁট ফুলিয়ে আদ্রিকা অভিমান মিশ্রিত সুরে বলল,
‘কালকে পরীক্ষা, এখনও আমার কত্তো পড়া বাকি! অথচ আমি একটা লাইনও পড়তে পারতেছি না। আজকের দিনটা ঝগড়াঝাটি না করলে আপনার চলছিল না? পুরো মুডটাই নষ্ট করে দিলেন। আমরা এখন অন্তত ঝগড়া স্থগিত করে রাখি? পরীক্ষা শেষে আবার সচল করা যাবে, প্লিজ।’
আদ্রিকার কথা শুনে সরু চোখে তাকিয়ে রইল পরখ৷ ঝগড়াঝাটি কি কোনো খেলা? যেটা ইচ্ছে করলেই স্থগিত করে রাখা যায়। আবার যখন ইচ্ছে পুনরায় চালু করা যায়। আদ্রিকার মতিগতি নিরীক্ষণ করে কোনো জবাব না দিয়ে পরখ ফের মনোযোগ দিল মোবাইল ফোনে।
উত্তপ্ত মস্তিষ্কে পড়াশোনা করা সম্ভব না। ওদিকে ঝামেলা মিটানোর কোনো সম্ভাবনা পরখের তরফ থেকে দেখা যাচ্ছে না৷ হতাশ আদ্রিকা বইপত্র গুছিয়ে নিল। চুলোয় যাক অপয়া পড়াশোনা। জীবনের সমস্ত শান্তি এই পড়াশোনার পেছনে জলাঞ্জলি চলে যাচ্ছে।
আদ্রিকা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ানো মাত্র পরখ বলল,
‘পড়া শেষ করে যাও।’
আদিখ্যেতা দেখে গা জ্বলে উঠল আদ্রিকার৷ এবার সে নীরব থেকে উত্তপ্ত চাহনি ফিরিয়ে দিল পরখকে৷ তারপর গটগট করে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে নিজের বিছানায় ধপাশ করে শুয়ে পরল। তাকে ওভাবে বেরিয়ে আসতে দেখে পরখের মুখটি হয়েছিল দেখার মত৷ সেই হতবাক মুখটির কথা ভাবতেই আদ্রিকার ভীষণ শান্তি লাগল। প্রশান্ত মনে একসময় সে ঘুমিয়ে গেল।
আজ আদ্রিকার উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা। পরীক্ষার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে দুপুর বারোটায়। এমন অদ্ভুত সময়ে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার কথা ভেবেই আদ্রিকার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
প্রতিদিনের মতো আজও ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে পরখ। তবে যাওয়ার আগে আদ্রিকার জন্য সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার তৈরি করে রেখেছে। পরখ যখন ভার্সিটির জন্য তৈরি হচ্ছিল আদ্রিকা তখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। কে বলবে এই মেয়ের পরীক্ষা? অথচ সে সিলেবাস শেষ না করে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ভার্সিটির উদ্দেশ্য বের হওয়ার আগে পরখ গেল আদ্রিকার কক্ষে৷ বকে ধমকে আদ্রিকাকে বিছানা থেকে তুলে দিল।
খাবার টেবিলে একগাদা খাবার দেখে আদ্রিকা অবাক হয়ে তাকাল পরখের দিকে৷ পরখ অবশ্য অভিব্যক্তিহীন মুখে জানাল,
‘খেয়েদেয়ে পড়তে বসো। পরীক্ষা শুরু হওয়ার আধাঘন্টা আগে বাড়ি থেকে বের হবে। অবশ্যই লাঞ্চ করে তবেই যেও৷’
আজ সকালে সূর্য কোনদিকে উঠেছে ভেবে অবাক হলো আদ্রিকা৷ পূর্বেই উঠেছে কি? কাল রাতের ঝামেলার পর সকালবেলা পরখের এতো সভ্য আচরণ আদ্রিকার বিশ্বাস হতে চাইছে না। মনে হচ্ছে সবটাই ভ্রম৷
মুখে স্নিগ্ধ হাসি ঝুলিয়ে বইপত্র নিয়ে সে চলে গেল পরখের পড়ার টেবিলে৷ একটানা কয়েকঘন্টা পড়াশোনা করে পরখের নির্দেশনা মোতাবেক দুপুরের খাবার খেয়ে আধাঘন্টা আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরল।
যথারীতি না ভালো, না খারাপ মানের পরীক্ষা দিয়েছে আদ্রিকা৷ যাকে সহজ ভাষায় মোটামুটি বলা হয়। পরীক্ষা শেষে উৎসাহিত তরুণ তরুণী কলকল করতে করতে একাডেমির প্রাঙ্গণ ত্যাগ করছে৷ কয়েকজনের সাথে তাদের বাবা মা এসেছে। সযত্নে সন্তানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মমতাময়ী মা। টেস্ট পরীক্ষায় এমন অবস্থা হলে না জানি ফাইনাল পরীক্ষায় এরা কী করে!
প্রধান ফটকের দিকে হাঁটতে শুরু করল আদ্রিকা৷ হঠাৎ কোথা থেকে দৌড়ে এলো ইফফাত।
‘এই আদ্রিকা, কোথায় যাচ্ছো?’
‘বাড়ি। পরীক্ষা শেষ করে মানুষ কোথায় আর যাবে!’
‘ওপাশে চলো, ওখানে সবাই নৈর্ব্যক্তিক উত্তর মেলাচ্ছে।’
অনতিদূরে একটি জটলায় বেশ কয়েকজন সহপাঠীকে দেখে আদ্রিকার মুখে ফ্যাকাশে হাসি দেখা দিল। বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল,
‘পরীক্ষা পর প্রশ্নপত্র নিয়ে আলোচনা করলে আমার মাথা ঘুরায়। যা লেখার লিখছি, এখন উত্তর মিলিয়ে কি লাভ? আমার উত্তর মেলানোর দরকার নাই। উত্তর সঠিক হলে ভালো। কিন্তু ভুল উত্তর দিলে, সেটা জানার পর মন অস্থির হয়ে থাকবে। আগামীকালকে পরীক্ষার জন্য ভালোভাবে পড়তে পারব না। আমার দরকার নাই এসব ঝামেলার। তোমরা দেখো।’
‘আর ইউ শিওর?’
‘ইয়াহ। ইউ গো। আই উইল বি ফাইন।’
‘ওকে, সি ইউ।’
ইফফাত চলে যেতেই প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল আদ্রিকা। প্রশ্নপত্র নিয়ে ওদের কাড়াকাড়ি দেখেই আদ্রিকার মাথা ঘুরাচ্ছে। সে দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল।
একাডেমির মূল ফটকে আদ্রিকার জন্য অপেক্ষা করছিল একটি অসম্ভবপ্রায় ঘটনা। যার সম্মুখীন হওয়া মাত্র থমকে গেল আদ্রিকার পা জোড়া।
চলবে…
#অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৪৫|
রেস্তোরাঁয় আজ উপচে পরা ভীড়। শহরের নামকরা ব্যবসায়ীর মেয়ের জন্মদিন বলে কথা। অর্ধশতাধিক বন্ধু বান্ধব সাথে নিয়ে চলছে জন্মদিনের উদযাপন।
বর্তমান সময়ে ভোজনরসিকদের আলোচনায় রয়েছে রসনাবিলাসী। তাই জন্মদিনের অনুষ্ঠানের জন্য এই রেস্তোরাঁটি নির্ধারণ করেছে জারা। বিশাল একটি কেক নিজে বানিয়েছে রুমি। মাঝখানের একটি টেবিলে কেকটি রাখা হয়েছে।
কয়েকজন মিলে ইতিমধ্যে রেস্তোরাঁর সাজসজ্জার কাজ সম্পূর্ণ করে ফেলেছে। জারা এবং তার বন্ধুরা রসনাবিলাসীর অসাধারণ সাজসজ্জা এবং আয়োজনে প্রসন্ন। রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করেই তারা হৈ হৈ রৈ রৈ করে সকলে ছবি তোলার কাজে লেগে গেল।
রেস্তোরাঁর সকল কর্মীদের অতিথিদের আপ্যায়নে ব্যস্ত কাটাচ্ছে। পরখ নিজেও আয়োজনের তদারকিতে ব্যস্ত ছিল। আপাতত বাকি কাজ রুমির হাতে সঁপে দিয়ে অফিস সংলগ্ন ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল।
বাইকের চাবি হাতে বাইরে বেরিয়ে যেতে নিলে সামনে এসে দাঁড়াল জারা। ত্রুটিহীন রূপবতী মোহনীয় হাসি হেসে বলল,
‘আপনি এখনি চলে যাচ্ছেন?’
সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা যুবতীর অসংলগ্ন পোশাকের কারণে তারদিকে সরাসরি তাকানো যায় না৷ পরখ এমনিতেও খুঁতখুঁতে স্বভাবের। অতিরঞ্জিত যেকোনো কিছুর প্রতি তার প্রচুর বিরক্তি। সে ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,
‘জ্বি। জরুরি কাজ আছে।’
জারা অভিমান করে মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘গেস্ট রেখে কেউ এভাবে চলে যায়?’
‘আপনাদের যেকোনো প্রয়োজনে রুমি রইল। এছাড়াও এখানে অনেকে আপনাদের সহযোগিতার জন্য রয়েছে। আমার বিশেষ প্রয়োজন পড়বে না।’
‘আমার আর কোনোকিছুর প্রয়োজন হবে না। আপনাদের সার্ভিস যথেষ্ট ভালো। যা চেয়েছিলাম, তার থেকে বেশি পেয়েছি।’
‘থ্যাঙ্কিউ। আমার একটু তাড়া আছে। ইনজয় ইউর ডে।’
‘এক্ষুণি কেক কাটা হবে। তারপর যাবেন।’
‘স্যরি। আমাকে এক্ষুণি বেরিয়ে যেতে হবে।’
‘অতিথির এইটুকু আবদার রাখবেন না?’
অনেক কষ্টে পরখ নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখল। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান না হলে ভদ্রঘরের এই মেয়েটির এমন হ্যাংলাপনার উচিত জবাব সে দিত। মুখে যথেষ্ট হাসি টেনে পরখ বলল,
‘জন্মদিনের কেক কাটার সময় রেস্টুরেন্টের মালিককে উপস্থিত থাকতে হবে, এমন কোনো সার্ভিসের প্রতিশ্রুতি আমাদের রেস্টুরেন্ট নিশ্চয়ই দেয়নি?’
জারার রঞ্জিত ঠোঁটে বিস্তৃত হাসি দেখা গেল। খিলখিল করে হেসে পরখের আরেকটু কাছে এসে বলল,
‘রেস্টুরেন্ট অনার হিসেবে নয়, একজন বন্ধু হিসেবে ইনভাইট করছি।’
বন্ধু! এই মেয়ের সাথে পরখের আজ প্রথম দেখা হলো। অথচ এক দেখায় সে পরখকে বন্ধু বানিয়ে ফেলল! পরখের খুব জানতে ইচ্ছে করল, এই বন্ধুত্বটা কবে হলো? কিন্তু জারার সাথে কথা বাড়ানোর ইচ্ছে হলো না। সে হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বলল,
‘আই হ্যাভ টু গো। ইটস অলরেডি লেইট।’
জারাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে জারা দ্রুত পরখের ডান হাতের বাহু ধরে ফেলল। পরখ থমকে দাঁড়িয়ে তাকাল নিজের হাতের দিকে। যেখানে সাড়াশির মতো জড়িয়ে আছে জারার হাত। জারা দ্রুত হাত ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘স্যরি।’
পরখ ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে জানতে চাইল,
‘আর কিছু বলবেন?’
‘পাঁচ মিনিট দাঁড়ানো যায় না?’
‘এক মিনিটও সম্ভব নয়।’
‘আপনি ফিরবেন কখন?’
‘এক্সকিউজ মি?’
কল আসার বাহানা দেখিয়ে পরখ পকেট থেকে মোবাইলটি বের করে নিজেই রুমিকে কল দিল। রুমি কল রিসিভ করা মাত্র পরখ হড়বড় করে বলল,
‘হ্যাঁ, এই তো বের হচ্ছি। রেস্টুরেন্টে একজন ক্লায়েন্টের সাথে কথা বলছিলাম তো৷’
কলটি কেটে দিয়ে জারার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আপনি কী যেনো বলছিলেন?’
জারা ভীষণ মায়া নিয়ে শুধাল,
‘আপনি ফিরবেন কখন?’
‘আজকে আর আসব না।’
‘আপনার কনটেক্ট নাম্বারটা দেওয়া যাবে?’
আর কতোক্ষণ ভদ্রতার আড়ালে অনিয়ন্ত্রিত মেজাজকে লুকিয়ে রাখা যায়! পরখ এবার জোরালোভাবে কিছু বলতেই যাচ্ছিল৷ ত্রাণকর্তা হয়ে দ্রুত পায়ে উপস্থিত হলো রুমি৷
‘সেকি! তুই এখনও যাস নি? দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
কলে পরখের কথা শুনে রুমি কিছুটা আন্দাজ করে নিয়েছিল। হাতের কাজগুলো রেখে বাইরে এসে জারাকে পরখের সাথে কথা বলতে দেখে বাকিটা বুঝে নিতে দেরী হয়নি। রুমিকে দেখে পরখ যেন অকূল দরিয়ায় কূল খুঁজে পেল। তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যেতে নিয়ে বলল,
‘এই তো যাচ্ছি।’
জারাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পরখ চলে গেল। মুখে আঁধার নামল জারার। রাগ জন্মালো রুমির উপর৷ কটমট করে রুমির দিকে তাকালে, রুমি মিষ্টি হেসে বলল,
‘ভাবি ভীষণ রাগী মানুষ। একটু দেরীতে পৌঁছালে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিবে৷ এই যে পরখ দেরী করল, এখন উনাকে দু মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হবে৷ এই নিয়ে আমার বন্ধুটির কপালে আজকে শনি নামবে।’
জারার চোখ দুটো মার্বেলের মতো গোল হয়ে গেল৷ বিস্মিত স্বরে জানতে চাইল,
‘উনার বিয়ে হয়ে গেছে!’
রুমি ঠিক ততখানি উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ। সেই কবে! ভাবি মানে পরখের স্ত্রী, শি ইজ ভেরি ডেঞ্জারাস।’
জাঁদরেল বউয়ের সাথে বন্ধুর সংসার নিয়ে দুঃখী রুমির চেহারায় আফসোসের স্পষ্ট চিত্র দেখে জারা শুকনো ঢোক গিলল। ভাগ্যিস কনটেক্ট নাম্বার নেয়নি। না হলে দেখা যেত, পরখের বউ কল রিসিভ করে আরেক ঝামেলা বাঁধিয়ে দিয়েছে।
আদ্রিকার পরীক্ষা শেষ হলো বিকাল তিনটায়। একাডেমির প্রধান ফটকে যখন এসে দাঁড়াল তখন ঘড়িতে সময় তিনটা কুড়ি৷ পিপীলিকার মতোন পিলপিল করে হাঁটছে শতাধিক পরীক্ষার্থী। অটো, রিকশার টুংটাং শব্দ, চালকদের ব্যস্ত হাঁক, পরীক্ষার্থীদের বাড়ি ফেরার তাড়া। এমন চঞ্চলতার সম্মুখে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিকা৷
ভিড়ভাট্টা আদ্রিকার একদম পছন্দ নয়৷ অনেকটা বাবার স্বভাব পেয়েছে সে৷ কোলাহল থেকে দূরে আপনজনদের নিয়ে সময় কাটাতে ভালো লাগে৷ মোকাররমের পুরোটা যেমন নীহারকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে তেমনি আদ্রিকাও পরখকে কেন্দ্র করে বাঁচতে চায়।
নিজের এমন চাহিদা সম্পর্কে বেশ কিছুদিন আগেই নিশ্চিত হয়েছে আদ্রিকা৷ মোকাররমের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বলে নীহারের মতো জীবনসঙ্গিনী পেয়েছে। যে শত ঝড়ঝাপ্টা সহ্য করেও মোকাররমের হাত ছাড়েনি৷ কিন্তু আদ্রিকার ভাগ্য তেমন সুপ্রসন্ন নয়৷
জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বরাবর তার ভাগ্য মন্দ। বিস্ময়কে নিজের দুনিয়া ভেবে নিয়ে একবার ঠকেছে। এবার পরখকের উপর নির্ভরশীল হয়ে আরেকবার নিঃশেষ হতে যাচ্ছে৷ নিজের ভবিষ্যৎ সুস্পষ্ট দেখতে পেলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নেই আদ্রিকার। পরখের মোহ কাটানো তার পক্ষে অসম্ভব প্রায়।
একাডেমির প্রধান ফটকের সামনে ব্যস্ত সড়ক। সড়কের ওপাশে গিয়ে রিক্সা নিতে হবে আদ্রিকাকে। পিচঢালা রাস্তায় বিরতিহীনভাবে চলছে যানবাহন। আদ্রিকা একবার ডানে বামে দেখে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। ভীড় কমে গেলে তবেই সে রাস্তা পার হবে।
উদাস নয়নে রাস্তার অপরপাশে তাকাতেই আদ্রিকা থমকে গেল। হতবিহ্বল স্থির দৃষ্টিতে সে শুধু তাকিয়ে রইল। রাস্তার অপরপাশে বাইক থামিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল পরখ। আদ্রিকাকে দেখতে পেয়ে পরখ সোজা হয়ে দাঁড়াল। পরখ ভেবেছিল আদ্রিকা ওকে দেখতে পেয়ে রাস্তা পার হয়ে আসবে। কিন্তু মেয়েটা কেমন ভ্যাবলার মতোন তাকিয়ে আছে। নড়াচড়া তো দূরের কথা চোখের পলকটাও ফেলছে না।
পরখ বিরক্ত হয়ে নিজেই রাস্তা পার হতে শুরু করল। আদ্রিকা তখনো হতবাক, বাকরুদ্ধ। পরখ তাকে নিতে আসবে এমনটা সে কখনো ভাবেনি। এতোখানি কল্পনা করার দুঃসাহস তার নেই।
আদ্রিকা শুধু কল্পনাতীত ঘটনাগুলো নিজের সাথে ঘটতে দেখে যাচ্ছে।
পরখ রাস্তা পেরিয়ে আদ্রিকার কাছে এলো। গম্ভীরমুখে কি যেনো জানতে চাইল। আদ্রিকা ঠিকঠাক শুনতে পেল না। সে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে পরখকে দেখছে।
জবাব না পেয়ে পরখ ওকে বলল,
‘দাঁড়িয়ে রইলে কেন? চলো।’
আদ্রিকাকে অনড়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পরখ ওর হাত ধরে রাস্তা পার করতে লাগল।
আদ্রিকা মুগ্ধ নয়নে একবার পরখের হাতে নিজের ডান হাতের কবজি দেখল। আরেকবার চোখ তুলে পরখের ক্লান্ত মুখশ্রীর দীপ্ত, চঞ্চল চোখজোড়া দেখল। কী পরম ভালোবাসায় আদ্রিকার হাত আঁকড়ে পরখ এগিয়ে যাচ্ছে!
একহাতে আদ্রিকার হাত, অন্য হাত বাড়িয়ে দ্রুতগামী গাড়িকে গতি কমানোর নির্দেশনা দিচ্ছে।
রাস্তার পার করে পরখ আদ্রিকার হাত ছেড়ে
বাইকে উঠে বসল। আদ্রিকাকে তখনো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
‘কী হলো? দাঁড়িয়ে রইল কেনো? উঠো।’
‘ঝালমুড়ি খাবো।’
অসময়ে এমন অদ্ভুত আবদার শুনে পরখ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। এবেলা ঝালমুড়ি কে খায়! আশেপাশে তাকিয়ে ঝালমুড়ির কোনো দোকান দেখতে পেল না পরখ। কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে বলল,
‘এখানে ঝালমুড়ির দোকান কোথায়? আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।’
আদ্রিকার দৃষ্টি তখনও নত। ওভাবেই বলল,
‘একাডেমির ভেতরে আছে।’
রাস্তার পার হয়ে এসে এখন বলছে ঝালমুড়ি খাওয়ার কথা! স্বভাবতই পরখের রাগ হলো। একটা ধমক দিয়ে ঝালমুড়ি খাওয়ার প্রস্তাব নাকচ করতে যাচ্ছিল পরখ। কিন্তু আদ্রিকার ছলছল দৃষ্টি দেখে আর কিছু বলল না। হঠাৎ মেয়েটার কী হয়েছে কে জানে! মুখগোমড়া করে আছে, প্রয়োজনের বাইরে তেমন কোনো কথাও বলছে না।
এখন ঝালমুড়ি খেতে হবে না, বললে কান্নাকাটিও শুরু করে দিতে পারে। উন্মাদিনীর পক্ষে কোনো কিছু অসম্ভব নয়।
পরখ চুপচাপ বাইক থেকে নেমে পড়ল। ঝালমুড়ি খাওয়ার খুশিতে কারো মুখে এমন হাসি ফুটতে পারে, জানা ছিল না পরখের। আদ্রিকার উচ্ছ্বসিত মুখটির দিকে আরেকবার তাকিয়ে সে রাস্তা পার হওয়ায় মনোযোগ দিল।
ব্যস্ত রাস্তায় এক পা ফেলতেই পরখ খেয়াল করল, আদ্রিকা খপ করে ওর হাত ধরে ফেলেছে। মুহূর্তেই জারার কথা মনে পড়ল পরখের। বেয়াদব মেয়েটা তখন পরখের হাতটি এভাবেই ধরেছিল।
একাডেমির ভেতরে প্রধান ফটকের পাশেই ঝালমুড়ির দোকান। বৃদ্ধ বিক্রেতার চারপাশে উঠতি বয়সী মেয়েদের ভীড়। সবাই উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে ঝালমুড়ির পটের দিকে।
সামান্য দূর থেকে পরখ উঁচু কণ্ঠে একটি ঝালমুড়ির অর্ডার দিল। পুরুষালি কণ্ঠে সকলে পেছন ফিরে তাকাল। পরখ খেয়াল করল কয়েকটি মেয়ে তাকে দেখে একপাশে সচেতন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্ধ হয়েছে তাদের নিজেদের মধ্যে হাসিহাসি। গলার স্বরও এখন কানে বাজছে না।
ওদের চাহনি দেখে পরখ নিশ্চিত হলো, মেয়েগুলো পরখের ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট। ফ্যাকাল্টিকে দেখে নিজেদের উদ্ধৃত আচরণে নিয়ন্ত্রণ এনেছে।
কয়েকটি মেয়ে বারবার আড়চোখে পরখের দিকে তাকাচ্ছে। তখনি পরখ খেয়াল করল, আদ্রিকা এখনো পরখের হাত জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
আদ্রিকার লোভাতুর দৃষ্টি ঝালমুড়ির পটের দিকে। পছন্দের খাবারটি এক্ষুণি খেতে পারছে না বলে কেমন ঠোঁট ফুলিয়ে রেখেছে।
এমন সরল চেহারার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ আগে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার যে চাহিদাটি পরখের মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল, তা বাতিল করল পরখ।
ঝালমুড়ি তৈরি হওয়া মাত্র আদ্রিকা ছুটে গিয়ে ঝালমুড়ি নিয়ে এলো। দাম পরিশোধ করে পরখ বলল,
‘চলো যাই।’
শক্ত কাগজে ঝালমুড়ি তুলে মুখে পুরে আদ্রিকা বলল,
‘খেয়ে তারপর যাবো। আপনি খাবেন?’
‘নাহ।’
আদ্রিকা আর সাধল না। নিজে বেশ আয়েশ করে ঝালমুড়ি খেতে থাকল।
একাডেমি হতে বের হওয়ার সময় আদ্রিকার সামনে দিয়ে একটি ছোট শিশু এলোমেলো পায়ে হেঁটে চলে গেল। শিশুটির গায়ে পাশের কেজি স্কুলের ইউনিফর্ম। এক হাতে একটি ঝিলিমিলি বেলুন৷ অন্য হাতটি শক্ত করে ধরে রেখেছে শিশুটির বাবা। মধ্যবয়স্ক পুরুষটির কাঁধে শোভা পেয়েছে শিশুটির স্কুলব্যাগ।
একহাতে ছেলের হাত ধরে, অন্য হাতে ছেলের স্কুলব্যাগ সামলে লোকটি ধীর পায়ে প্রফুল্লচিত্তে বাড়ির দিকে ফিরে যাচ্ছে।
রোজকার দিনের খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। অথচ ভীষণ আগ্রহ নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে আদ্রিকা। চেয়ে থাকতে থাকতে কখন চোখে জল জমেছে আদ্রিকা বুঝতে পারেনি। পরখের ডাকে হুশ ফিরল।
ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ে দেখল পরখ কেমন চিন্তিত দৃষ্টি মেলে তাকেই দেখছে৷ আদ্রিকার মনোযোগ ফিরে পাওয়া মাত্র পরখ জিজ্ঞাসা করল,
‘কি দেখছ ওদিকে?’
আদ্রিকা আনমনে খানিক হেসে বলল,
‘ওই যে বাচ্চাটা, ওর বাবার সাথে বাড়ি ফিরছে। কী সুন্দর দেখাচ্ছে দেখুন। কোনো বাচ্চাকে তার বাবার সাথে এভাবে দেখলে আমার এতো ভালো লাগে!’
পরখ ভীষণ অবাক হয়ে দেখল, সত্যিই আদ্রিকার চোখ মুখ হাসছে। এই সামান্য ঘটনায় এতো খুশির হওয়ার কি আছে? ভাবতে লাগল পরখ৷ তখনি আদ্রিকা বলল,
‘আমার আব্বু কখনো আমাদের সাথে কোথাও বের হতো না। কখনো আমাদের নিয়ে ঘুরতে যেত না। আমার খুব শখ ছিল জানেন, একদিন আব্বুর হাত ধরে স্কুলে যাব। কয়েকবার আবদারও করেছিলাম। আব্বু এমন ধমক দিয়েছিল! ভয়ে আর কখনো আবদার করিনি।
আমার আবদার পূরণ করতে আদ্রতা আপু আমার হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যেত, নিয়ে আসত। কিন্তু বাবার অপূর্ণতা কেউ কি কখনো পূরণ করতে পারে?’
উত্তরের আশায় আদ্রিকা প্রশ্নটি করেনি। কারণ উত্তরটি তার জানা আছে। ইচ্ছে করেছে তাই প্রশ্নটি সে রেখেছে পৃথিবীর কাছে। পরখ জবাব না দিয়ে রাস্তার ধার দিয়ে হেঁটে যাওয়া পিতা-পুত্রের জুটিটিকে দেখল।
একটা বয়স পর্যন্ত ইবনূল ইবতেহাজ এভাবেই পরখকে স্কুলে নিয়ে গিয়েছে৷ এরপর পরখ বড় হলো, নিজস্ব গণ্ডিতে আটকা পড়ল। নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা তৈরি হলো, মতামত জানাতে শিখল। ধীরে ধীরে বাড়ল পিতা-পুত্রের মধ্যকার দুরত্ব।
শিশুকালের সেই সোনালি অতীত স্মরণ করে ক্ষণিকের জন্য পরখ ভাবাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। পাশ থেকে আদ্রিকা বলল,
‘বাচ্চাকে বাবা-মায়ের কাছাকাছি থাকতে দেখলে আমার খুব ভালো লাগে।’
ধ্যানমগ্ন পরখ ঘাড় ফিরিয়ে দেখল আদ্রিকা কেমন বোকাবোকা হাসছে। পরখ ওর মানসিক অবস্থা খানিকক্ষণ নিরীক্ষণ করে বলল,
‘তুমি যে তোমার বাবাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো সেটা জানো?’
আদ্রিকা মাথা নিচু করে লাজুক হাসল।
‘জানি।’
‘তোমার বোনের থেকেও বেশি ভালোবাসো তোমার বাবাকে। অথচ তোমার বড়বোন তোমাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়ে গেছে। তুমি কিনা ভালোবাসলে তোমার উদাসীন বাবাকে।’
আদ্রিকা অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে রইল। ভালোবাসা আসে মন থেকে। নিয়ন্ত্রণহীন মনের কার্যকলাপের উপর কারো নিয়ন্ত্রণ কি করে চলবে!
মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে, আদ্রিকা প্রথমেই পরখের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসাকে নিয়ন্ত্রণ করত৷ কিন্তু হায়! তা সম্ভব নয়। বরং চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে সে ভালোবাসা। আজকের এই ছোট ঘটনার পর আদ্রিকার হৃদয়ে পরখ স্থায়ীভাবে বসত গড়ে নিল।এবার পরখ পৃথিবীর যে-কোন প্রান্তে চলে যাক, আদ্রিকা কিছুতেই পরখকে নিজের জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারবে না৷
পরখ বাইকের ইঞ্জিন চালু করে আদ্রিকাকে ইশারায় বাইকে উঠতে বলল। আদ্রিকা নিঃসাড় শরীরে ধীর পায়ে উঠে বসল বাইকে। বাইক ছুটতে শুরু করলে, পরখের পিঠে মাথা ঠেকিয়ে আদ্রিকা চোখ বন্ধ করে নিল।
পরখের প্রতি উথাল-পাতাল অনুভূতির জোয়ারে হাবুডুবু খেতে খেতে আজ আদ্রিকা বড্ড ক্লান্ত৷ বারংবার নিজের কাছে প্রশ্ন করছে, কী আছে এই সম্পর্কের ভবিষ্যতে?
আদ্রিকা জানে, এই যাত্রাপথ সামান্য, তবুও পরখের সাথে এতোটা মজবুত বাঁধনে সৃষ্টিকর্তা কেনো বাঁধছে তাকে?
চলবে…
#অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৪৬|
টেবিলের উপর অবিন্যস্ত বইপত্র। স্থির দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে আছে আদ্রিকা৷ দু হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে অনেকক্ষণ যাবৎ। অবশেষে দীর্ঘ ব্যর্থ চেষ্টার ইতি টেনে আদ্রিকা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমের আয়োজন করছিল পরখ৷ দরজা খুলে আদ্রিকা উঁকি দিল। নিচু স্বরে ডাকল,
‘পরখ আসব?’
শোয়া থেকে উঠে বসে পরখ জানতে চাইল,
‘কি চাই?’
আদ্রিকা হেলেদুলে কক্ষে প্রবেশ করে পরখের বিছানায় আয়েশ করে বসে বইপত্র রাখল সামনে। চোখের সামনে নিজ বিছানাটিকে পড়ার টেবিলে পরিণত হতে দেখে পরখ ভ্রু উঁচু করে তাকাল। তা দেখে আদ্রিকা বোকা হেসে বলল,
‘কালকে পরীক্ষা অথচ একটা ম্যাথ মিলছে না।’
পরখ নিজেও আদ্রিকার সামনে আসন পেতে বসে জানতে চাইল,
‘আইসিটিতে ম্যাথ!’
‘দ্বিতীয় অধ্যায়ের সংখ্যা পদ্ধতি। কিছুতেই মিলছে না।’
‘এগুলো এতোটাও কঠিন না৷ ক্লাস শেখানো হয়নি?’
আদ্রিকা এখন কি করে বলবে, সেসময় সে প্রেম সাগরে হাবুডুবু খেতে গিয়ে পড়াশোনার সর্বনাশ করে ফেলেছে। নিয়মিত ক্লাস করলেও আদ্রিকার সমস্ত মনোযোগ ছিল বিস্ময়ের দিকে৷ পড়াশোনার জন্য মস্তিষ্কে জায়গা কোথায়! যা পড়িয়েছিল, তা আদ্রিকার মস্তিষ্কে ঠাই নিতে পারেনি। এসব কথা নিশ্চয় পরখকে বলা যায় না৷ তাই দাঁতের নিচে কলম কামড়ে ধরে বলল,
‘ফাস্ট ইয়ারে পড়িয়েছিল। এতোদিন কী মনে থাকে! আপনি একটু বুঝিয়ে দিন না।’
‘এক বছর আগের পড়া তোমার মনে নেই, অথচ আমার মনে থাকবে?’
‘আপনি ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। আপনার ঠিকই মনে আছে। আমার মতো বোকাদের গতকালের পড়া আজকে মনে থাকে না।’
‘বোকা নয়, পড়াচোর।’
পরখের অপমানে আদ্রিকা মুখ ভেংচে মাথা নিচু করে ফেলল। পরখ হাত বাড়িয়ে আইসিটি বইটি তুলে নিয়ে দ্বিতীয় অধ্যায়ের পৃষ্ঠা বের করল৷ খাতার সাদা পাতায় কলমের কালো কালিতে একেরপর এক সংখ্যা অঙ্কিত হচ্ছে৷
পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আদ্রিকা চোরাচোখে বারংবার পরখকে দেখছে। পরখের দৃষ্টি খাতায় নিবদ্ধ থাকলেও আদ্রিকার চাহনি সে স্পষ্ট অনুভব করতে পেরেছে৷ হঠাৎ খাতা থেকে চোখ তুলে আদ্রিকার মুখে দিকে তাকাতেই সে ধরা পরে গেল পরখের নিকট। পরখের গম্ভীর মুখশ্রী, কঠোর চোখজোড়া দেখে আদ্রিকা আবারও বোকা হাসল।
‘আমার মুখের দিকে তাকিয়ে না থেকে খাতার দিকে তাকাও।’
আদ্রিকা মিনমিন করে স্বগোতক্তি করল, ‘টিচার এমন হ্যান্ডসাম হলে স্টুডেন্টের মনোযোগ টিচারের চেহারাতেই আটকে থাকবে।’
পরখ কিছু শুনতে না পেলেও স্পষ্ট দেখতে পেল আদ্রিকা কিছু একটা বিড়বিড় করছে। সে ধমক দিয়ে বলল,
‘খাতায় দেখো।’
আদ্রিকা বিনাবাক্য ডান দিকে ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানাল।
এক ঘন্টা ব্যয় করে পরখ যতটুকু দায়িত্ব নিয়ে পড়া বুঝিয়ে দিল, আদ্রিকাও ততখানি মনোযোগ দিয়ে বুঝার চেষ্টা করল। পুরনো পড়া আগেরবার বুঝিয়ে দেওয়ার সুবাদে খুব তাড়াতাড়ি আদ্রিকার আয়ত্তে চলে এলো বাইনারি, অক্টাল, হেক্সাডেসিমাল।
খাতায় কয়েকটি অঙ্ক লিখে দিয়ে তা আদ্রিকার দিকে এগিয়ে দিয়ে একজন জাদরেল শিক্ষকের মতো পরখ আদেশ করল,
‘এগুলো সলভ করো।’
আদ্রিকা মুখখানি মুহূর্তেই চুপসে গেল৷ শুকনো হেসে খাতাপত্র গুছিয়ে নিয়ে বলল,
‘নিজের রুমে গিয়ে করছি।’
‘এখানেই করো।’
শিরদাঁড়া সোজা করে বসে থাকা ব্যক্তিটিকে কলেজের শিক্ষকদের থেকে বেশি হৃদয়হীন মনে হলো আদ্রিকার৷ ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে রাত বারোটা। আদ্রিকার ঘুমকাতুরে চোখ দুটো কি পরখের নজরে আসছে না? কলেজের শিক্ষকগুলো না হয় শিক্ষার্থীদের কষ্ট বুঝে না। কিন্তু পরখের অন্তত নিজ স্ত্রীর কষ্টটুকু বুঝা উচিত।
আদ্রিকা মনে মনে ঠিক করল, এমন নিষ্ঠুরতম ব্যক্তির থেকে সে আর কখনো শিক্ষা গ্রহণ করবে না। ভুলেই একবার আবদার করে ফেলেছে। আর কখনো না।
বারংবার হাই তুলতে তুলতে আদ্রিকা কোনোরকমে অঙ্কের সমাধান করে খাতাটি পরখের হাতে তুলে দিয়ে বলল,
‘কাজ শেষ। এখন আমি যাই৷ খুব ঘুম পেয়েছে।’
খাতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সে প্রস্তাব পরখ নাকচ করে দিল।
‘চুপচাপ এখানে বসে থাকো।’
বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে খাতা দেখছে পরখ। অপরপাশে বসে পরখকে দেখে চলেছে আদ্রিকা। পরখের গভীর মনোযোগ খাতার পাতায়। বাদামী চোখজোড়া আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে৷ মাথার চুলগুলো এলোমেলো কিন্তু তাতেও যেন পরখের সৌন্দর্য দ্বিগুণ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে৷
ধূসর রঙ্গা টিশার্ট পরখের গায়ে৷ পোশাকের হাত ছোট বিধায় বাহুর হালকা স্ফিত পেশী অবলোকন করে নির্লজ্জের মতোন শুকনো ঢোক গিলল আদ্রিকা। নিমপাতার মতো তেতো জবানের একটা মানুষ দেখতে এতো আকর্ষণীয় হবে কেনো?
একদিকে খুবসুরাত চেহারা কাছে টানে। অন্যদিকে কথার ছুরি হৃদয় ফালাফালা করে দেয়।
আদ্রিকা চোখ সরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকাল। ঝামেলা বাঁধল তখনি। কালো ট্রাউজার পরিহিত পরখের পা জোড়া একটির উপর আরেকটি রাখা। শেষাংশে চকচক করছে ফর্সা পা দুটো৷ পায়ের লম্বা আঙ্গুলে ক্ষুদ্র নখ৷ বোধহয় দুদিন আগেই নখ কেটেছে।
পায়ের পাতলা চামড়া ভেদ করে নীলচে শিখা উপশিরা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থেকে নেশাতুত আদ্রিকা ধীরে ধীরে নিজের পা জোড়া এগিয়ে নিয়ে গেল। আদ্রিকার বাম পায়ের ছোট বৃদ্ধাঙ্গুল দ্বারা খুব সাবধানে ছুঁয়ে দিল পরখের পায়ের অনামিকা।
আচানক স্পর্শে চমকে উঠল পরখ৷ তৎক্ষনাৎ পা সরিয়ে নিয়ে বিস্ফোরিত চোখে চাইল আদ্রিকার দিকে৷ চমকেছে আদ্রিকা নিজেও। লাজে মাথা নিচু করে কানের পিছনে চুল গুজে দিয়ে বলল,
‘স্যরি। ভুলেই পা লেগে গেছে।’
পরখ কিছুপল স্তব্ধ চেয়ে থেকে ফের খাতায় মনোযোগ দিল। তীব্র আড়ষ্টতা নিয়ে বাকি অঙ্কগুলো দেখে খাতাটি ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
‘সব ঠিক আছে। তোমার মেধা আছে, কিন্তু কাজে লাগাও না। পড়াশোনার ব্যাপারে যতো ফাঁকিবাজি।’
সামান্য প্রশংসা শুনে এক চিলতে রোদের মতো হাসি দেখা দিল আদ্রিকার মুখে। বইপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে বলল,
‘পড়াশোনা করতে আমার ভালো লাগে না৷’
পরখের রাগান্বিত দৃষ্টি অবহেলা করে আদ্রিকা নিজের মতো বইপত্র গুছিয়ে নিয়ে বিছানা থেকে নামল। বইগুলোকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে দরজা পর্যন্ত গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। পিছু ফিরে পরখের দিকে চেয়ে বলল,
‘টিচার দেখতে সুন্দর বলে এতোক্ষণ পড়ায় মনোযোগ ছিল। না হলে আমার আবার পড়াশোনায় বেশিক্ষণ মন টিকে না।’
আদ্রিকার এমন বিস্ফোরক মন্তব্যে বিস্মিত পরখ অবাক চোখে চেয়ে দেখল উন্মাদ মেয়েটিকে। পরখের এমন হতবাক দশায় আদ্রিকা ভীষণ মজা পেল। এক চোখ টিপে পরখকে আরেকধাপ হতবিহ্বল করে দিয়ে ফিরে গেল নিজ কক্ষে।
*****
আদ্রিকার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। সেই সাথে পাট চুকেছে পড়াশোনার। বইপত্রকে টেবিলের উপর অবহেলায় ফেলে রেখে সকালবেলা আদ্রিকা ছুটেছে রেস্তোরাঁয়। দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে নতুন বায়না নিয়ে কাজে ফিরেছে।
আজকে রেস্তোরাঁর খাবার আয়োজনে থাকছে বিভিন্ন পদের ভর্তা৷ আলু, মাছ, শুটকি, পটল, টমেটো, বেগুন, মিষ্টি কুমড়া, বাদামসহ নানান পদের ভর্তা বানিয়ে সাজানো হয়েছে ভর্তার প্লেট। চিকন চালের ধোঁয়া উঠা ভাতের সাথে একটু ঝাল দিয়ে ভর্তা, সাথে রয়েছে গাওয়া ঘি।
গরুর গোশত, মাছ ভুনাকে এড়িয়ে ক্রেতারাও আজকে আয়েশ করে ভর্তায় সাজিয়ে নিজের প্লেট।
আদ্রিকার আয়োজনের কথা শুনে সকালবেলা রেস্তোরাঁর অনেকে হেসেছিল। রুমি বলেছে,
পরিমাণে কম রেখো৷ দিনশেষে দেখা যাবে, ভর্তার প্লেট ওভাবেই পড়ে রয়েছে৷ লোকসান সামলাতে হলে একটু কম করে করাই ভালো৷
তবুও আদ্রিকা নিজস্ব উদ্যোগে অর্ধ শতাধিক লোকের জন্য ভর্তা তৈরি করেছে৷ যা দুপুর গড়াতেই শেষ হয়ে গেল।
ক্রেতারা অনেকে নারাজ হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অন্য পদ দিয়ে খাবার খেয়ে নিয়েছে। যাওয়ার আগে আদ্রিকার নিকট আবদার করে গেছে, আরও একদিন যেন ভর্তার আয়োজন করা হয়।
দ্বিতীয়তলার বাকি কাজ অনুর হাতে সঁপে দিয়ে রুমির খোঁজে বেরিয়ে পড়ল আদ্রিকা। অফিসে গিয়ে দেখল, রুমি সেখানে নেই।
আদ্রিকা নিচতলায় নেমে এলো। কিচেনে ব্যস্ত সময় কাটাতে দেখল রুমিকে। আদ্রিকাকে দেখে রুমি হেসে বলল,
‘তোমার ভর্তার কি অবস্থা?’
কিচেনে প্রবেশ করে কিচেনে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল আদ্রিকা। পাশেই সালাদের জন্য শসা কেটে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে একফালি শসা তুলে নিয়ে মুখে দিল।
‘সব শেষ হয়ে গেছে। প্লেট পরিষ্কার।’
পাস্তার বাটিটি ওভেনের ভেতর ঢুকিয়ে সময় ও তাপমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়ে রুমি হাতের গগলসটি খুলে রাখল। আদ্রিকার অপরপাশের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আফসোসের সুরে বলল,
‘আমাদের জন্য কিছু রাখো নি?’
‘উহু।’
‘একটুও না?’
‘প্লেট ধুয়ে অলরেডি র্যাকে রাখা হয়েছে।’
‘এটা ভীষণ অন্যায়। আমাদের হক ছিল।’
‘আমি নিজেই খেতে পারলাম না। সব দোষ আপনার। আপনি বলেছিলেন, কম করে বানাতে।’
‘আমি ভেবেছিলাম, কেউ খাবে না। এখন দেখছি রোজ মাছ গোশত খেতে খেতে সবার মুখের রুচি চলে গেছে।’
‘আমি ভেবেছি, এখন থেকে প্রতি মাসে একদিন ভর্তা আইটেম রাখব। যেদিন ভর্তার আয়োজন হবে তার আগের দিন পেজে এনাউন্স করে দেওয়া হবে।’
‘আইডিয়া খারাপ না। ট্রাই করে দেখতে পারো।’
আড্ডার মাঝে বিপ বিপ শব্দে নিজের অস্তিত্ব জানান দিল ওভেনটি৷ ওভেন বেকড পাস্তা তৈরি৷ আগে কখনো ওভেনে কাজ করেনি আদ্রিকা৷ আজকে এতো কাছ থেকে ওভেনটি দেখে রুমির কাছে জানতে চাইল,
‘এটা কীভাবে কাজ করে?’
‘তুমি কখনো কিছু বেক করো নি?’
‘উহু৷ আমার যতো কাজ সব চুলাতেই সীমাবদ্ধ। এসবের প্রয়োজন হয়নি।’
‘তবুও সব বিষয়ে জ্ঞান থাকা ভালো। কখন কোনটার প্রয়োজন পড়ে বলা যায় না। এখানে এসো তোমাকে দেখিয়ে দেই।’
আদ্রিকা ওভেনের পাশে এগিয়ে দিল। ভেতরে পাস্তার বাটিটি দেখে চট করে ওভেনের সামনের গ্লাসটি খুলে বাটিটি বের করার চেষ্টা করল। ঘটনাটি এতো দ্রুত ঘটল যে রুমি কিছু বলার সুযোগ পেল না। ততোক্ষণে গরম বাটিতে হাত লেগে পুড়ে গেছে আদ্রিকার হাত। আর্তনাদ করে বাটিটি ফেলে দিল হাত থেকে।
রুমি দ্রুত এসে আদ্রিকার হাত দুটো নিজের হাতে ধরে আতংকিত স্বরে বলল,
‘গরম বাটি কেউ খালি হাতে ধরে! ইশ! কতোখানি পুড়ে গেছে।’
আদ্রিকা তখনো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাস্তার দিকে তাকিয়ে আফসোস করে বলল,
‘সব নষ্ট হয়ে গেল।’
‘ছাড়ো ওসব। আবার তৈরি করা যাবে। এদিকে এসো৷ হাতে পানি দিতে হবে।’
বেসিনের ট্যাপ চালু করে ঠান্ডা পানির নিচে আদ্রিকার হাত দুটো রেখে রুমি দ্রুত গতিতে ছুটে গেল বার্নার ক্রিম খুঁজতে। আদ্রিকার চিৎকার শুনে অনেকে ছুটে এসেছে কিচেনে। সকলের চোখে সহানুভূতি।
আদ্রিকার দু হাতে তালু এবং চারটে আঙ্গুল অনেকখানি পুড়ে গেছে। হাতের সাদা তৎক্ষণাৎ লাল বর্ণে বদলে গেল। হাতের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আদ্রিকা সকলের উদ্বিগ্ন মুখের দিকে চেয়ে ম্লান হাসল। তখনি কিচেনের কাচের দেয়াল ভেদ করে নজরে এলো পরখ।
কিচেনের কাচের দেয়ালের অপরপাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। দূর হতে তাকিয়ে দেখছে আদ্রিকাকে। সকলে ছুটে এলেও পরখ আসেনি। সে নিজ স্থানে অনড়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এমন অবহেলায় সূক্ষ্ম ব্যথা সৃষ্টি হলো আদ্রিকার মনে।
রুমি ছুটে এসে আদ্রিকার হাতজোড়া আঁজলায় নিয়ে নরম তোয়ালেতে পানি মুছে দিল। লালচে ত্বকে যত্নসহকারে লাগিয়ে দিতে থাকল বার্নার ক্রিম।
আদ্রিকা তখনও অপলক চেয়ে আছে পরখের দিকে। ওর যন্ত্রণা কি পরখকে একটুখানি ছুঁতে পেরেছে?
ওই বাদামী চোখজোড়ায় হাজার খুঁজেও বেদনার কোনো ছাপ দেখতে পেল না। চোখের অতল পর্যন্ত শুধুই নির্লিপ্ততা। যার সাক্ষ্যমাত্র আদ্রিকা তার হাতের যন্ত্রণা ভুলে হৃদয়ের যন্ত্রণায় কাতর হলো।
অবহেলিত আদ্রিকার চোখজোড়া খুব দ্রুত ভরে গেল জলে। টইটম্বুর দিঘির ছলছলে দৃষ্টির দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। অভিমানী চোখ দুটো ভিজিয়ে দিতে চায় পরখের শুষ্ক হৃদয়। পরখ দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে স্থান ত্যাগ করে চলে গেল নিজ কক্ষে।
বাম হাতে ক্রিম লাগানো শেষ হলে ডান হাতের দিকে হাত বাড়ালো রুমি। আদ্রিকা নিজের হাত গুটিয়ে নিয়ে বলল,
‘আমি ঠিক আছে ভাইয়া।’
রুমি হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে বলল,
‘ওই হাতে ঔষধ লাগাবে না?’
‘সামান্য একটু আঁচ লেগেছে। আমি নিজেই লাগিয়ে নিতে পারব।’
ক্রিমটি টেবিলের উপর রেখে রুমি চিন্তিত দৃষ্টিতে আবার আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তাড়াতাড়ি লাগিয়ে নিও। না হলে ফোস্কা পড়ে যাবে। আজকে আর এখানে থাকার দরকার নেই। বাড়ি চলে যাও।’
ঘাড় বাকিয়ে সায় জানিয়ে আদ্রিকা বলল,
‘পাস্তার বাটিটা..’
এবার রুমি সামান্য ধমক দিয়ে বলল,
‘আবার একই কথা! একটা বাটি ভেঙেছে তো কি হয়েছে? তোমার যন্ত্রণার তুলনায় এটা কিছুই না।’
‘আপনাকে এখন আবারও পাস্তা তৈরি করতে হবে।’
‘সেসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। এরপর থেকে সাবধানে কাজ করবে। রান্নায় এতো তাড়াহুড়ো করলে চলবে না। সুস্থ হয়ে ফিরে এসো। ওভেনের সব কাজ তোমাকে শিখিয়ে দিব।’
আদ্রিকা ক্রিমটি হাতে তুলে নিয়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো। ডান হাতে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে৷ জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে ভেতরটা। যন্ত্রণা চেপে রেখে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে পরখের অফিসকক্ষের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল।
পরখ নিজের চেয়ারে নেই। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দূর আকাশ দেখছে। নিজের বউয়ের প্রতি খেয়াল নেই, মহাশয় মেতে আছেন প্রকৃতিতে নিয়ে।
আদ্রিকা ধুপধাপ পা ফেলে পরখের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পরখের শান্ত মুখশ্রীর সামনে তুলে ধরল ক্রিমটি। যা দেখে পরখ প্রশ্নসূচক দৃষ্টি ছুড়ে দিল আদ্রিকার দিকে। নীরব প্রশ্নের জবাবে আদ্রিকা নিজেকের ডান হাতটি মেলে ধরল পরখের সামনে।
হাতের তালু এবং আঙ্গুলের লালচে ত্বক দেখে ক্ষণিকের জন্য পরখের দৃষ্টিতে সামান্য পরিবর্তন দেখার সৌভাগ্য হলো আদ্রিকার। মুহূর্তেই তা সামলে নিয়ে পরখের মুখখানা হলো ভাবগম্ভীর।
বিনাবাক্যে ক্রিমটি হাতে নিয়ে খুব আলতোভাবে আদ্রিকার ডানহাতে ক্রিম লাগিয়ে দিতে থাকল পরখ। প্রচন্ড যন্ত্রণায় চোখ মুখ কুচকে গেল আদ্রিকার৷ জ্বলুনি আড়াল করার প্রচেষ্টায় কাঁপছে তার হাত।
পরখ হয়তো আদ্রিকার যন্ত্রণা কিছুটা অনুধাবন করতে পারল। হালকা ঝুঁকে ধীরে ধীরে ফুঁ দিতে থাকল আদ্রিকার হাতের ক্ষতে।
জানালার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিকা এবং পরখ৷ পরখের দৃষ্টি জানালার বাইরের দূর আকাশে। আদ্রিকা জানালায় হেলান দিয়ে উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে পরখের মুখপানে।
ইচ্ছে থাকার সত্ত্বেও একজন অসুস্থ মানুষকে কক্ষ ত্যাগ করার কথা বলতে পারছে না পরখ। যার যথেষ্ট ফয়দা লুটছে আদ্রিকা।
আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে পরখ বলল,
‘রুমিকে তোমার কেমন মনে লাগে?’
প্রশ্নের কারণ বুঝতে না পেরে আদ্রিকার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল। দ্বিধাভরা সুরে বলল,
‘ভালোই। হঠাৎ আমার কাছে কেন জানতে চাইছেন?’
‘রুমি আমার কলেজ লাইফের ফ্রেন্ড। ওর বাবা এখানকার বেশ নামকরা ব্যবসায়ী। এককালে সরকারি চাকুরিও করতেন। তারপর শুরু করলেন রিয়েলস্টেড বিজনেস। ভূবনভোলায় ওদের সাততলা ভবন আছে। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, রুমি। বুঝতেই পারছ, ওর বাবার সবকিছুর উত্তরাধিকারী একমাত্র রুমি। রেস্টুরেন্ট বিজনেস ওর প্যাশন। দেখতে ভবঘুরে মনে হলেও রুমি আসলে আমার থেকেও ধনী পরিবারের সন্তান।’
কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে আদ্রিকা সোজা হয়ে দাঁড়াল। দু পা এগিয়ে পরখের সম্মুখে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,
‘এসব আমাকে বলছেন কেনো?’
আদ্রিকার উচ্চতা পরখের কাঁধ সমান। সামনাসামনি দাঁড়ালে পরখকে সামান্য ঝুকে আদ্রিকার মুখোমুখি হতে হয়৷ আকাশ হতে দৃষ্টি সরিয়ে পরখ তাকাল আদ্রিকার চোখের দিকে। চোখে চোখ রেখে দীপ্ত কণ্ঠে জানাল,
‘রুমি অবিবাহিত। ওর বাড়ি থেকে অবশ্য বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। অতিশীঘ্রই বিয়ের তোড়জোড় শুরু হবে। রুমি নিজেও তোমাকে বেশ পছন্দ কর। তুমি রুমিকে নিয়ে ভাবতে পারো। সুযোগ সামনে আছে, ট্রাই করতে সমস্যা কোথায়? আমার বিশ্বাস তুমি চাইলে পটিয়ে ফেলতে পারবে।’
রাগে তিরতির করে কাঁপছে আদ্রিকার শরীর। ফুলে উঠেছে নাকের পাটা। লালচে মুখ, জ্বলন্ত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে পরখের দিকে। পরখের এমন মন্তব্য বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে হতবাক আদ্রিকার
বিয়ের এতোদিন পরেও পরখ তার প্রতি এমন বিরূপ ধারণা পোষণ করে রেখেছে!
আদ্রিকা কি এতোটাই পুরুষ সঙ্গ প্রত্যাশী যে পরখ যারতার সাথে আদ্রিকাকে এভাবে জুড়ে দিচ্ছে! কী ভাবে সে আদ্রিকাকে? আদ্রিকার দৃষ্টিতে কি সত্যি এমন লোলুপতা প্রকাশ পায়? পুরুষ সঙ্গের প্রতি আদ্রিকার কাতরতা এতোটাই প্রবল?
আদ্রিকা অবিশ্বাস্য সুরে জানতে চাইল,
‘আপনাকে আমার সত্যিই এমন মনে হয়? এতোটা লোভী আমি?’
পরখ অনুভূতিহীন, নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিল,
‘মনে হওয়ার কিছু নেই। আমি চলে গেলে তুমি কীসের আশায় বসে থাকবে? মুভ অন করার জন্য রুমি বেটার অপশন। রূপ,গুণ, ধন, সম্পদ সবদিক থেকে রুমি পারফেক্ট। তোমাদের দুজনের বন্ডিং ও ভালো৷ বাকি রইল তোমার বিয়ের সমস্যা। এটা তেমন ইফেক্ট ফেলবে না। বিস্ময়ের মতো ছেলে তোমার জালে ফেঁসে গেছে, সেখানে রুমি আর এমন কি! তুমি ওকে দুদিনে পটিয়ে ফেলতে পারবে।’
পরখের মুখে এমন কথা শুনে আদ্রিকা হিতাহিতজ্ঞান ভুলে ডান হাতটি তুলে সজোরে থাপ্পড় দিল পরখের গালে। আঘাতপ্রাপ্ত হাতের যন্ত্রণায় সে নিজেই কুঁকড়ে গিয়ে হাত গুটিয়ে জানালায় আবারও ঠেস দিয়ে দাঁড়াল।
সম্মুখে হতভম্ব পরখ হতবিহ্বল তাকিয়ে আছে আদ্রিকার দিকে। ঠাস করে শব্দটা যখন হলো তখনো পরখের ঠিকঠাক বিশ্বাস হতে চাইছিল না। আদ্রিকা সত্যি তাকে এইমাত্র চড় মারল?
গালে কিছু অনুভব হচ্ছে না কেনো? অথচ পরখ স্পষ্ট দেখেছে, আদ্রিকার কম্পিত হাতটি সবেগে ছুটে আসছিল। পরখের মাথার ভেতর শো শো শব্দ করে হাওয়ার চাকা ঘুরছে। সে রক্তচক্ষু মেলে পলকহীনভাবে আদ্রিকার মুখটি দেখতে থাকল। যা ঘৃণায় কুঁচকে গেছে। অত্যাধিক রাগে আদ্রিকার শুভ্র মুখশ্রীতে স্থান নিয়েছে লালিত্য। যা বেশিক্ষণ পর্যবেক্ষণের সুযোগ মিলল না।
নিজেকে সামলে নিয়ে আদ্রিকা দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করে বাইরে বেরিয়ে গেল। কাউকে কিছু না জানিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে সবেগে রসনাবিলাসী রেস্তোরাঁর দমবন্ধকর পরিবেশ ত্যাগ করল।
চলবে..
#অক্ষরময়ী