পরিণয়ে নোলককন্যা পর্ব-৪৭+৪৮

0
122

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

|৪৭|

দুপুর থেকে নিজ কক্ষে থমথমে মুখে বসে আছে পরখ। দুপুরের খাবারের জন্য একবার ডাকতে এসেছিল রুমি। খিদে নেই বলে তাড়িয়ে দিয়েছে পরখ। অন্ধকারাচ্ছন্ন মুখটি দেখে রুমি আর বিরক্ত করেনি। বিকাল পর্যন্ত যখন পরখ নিজ কক্ষ থেকে বের হলো না, রুমির খানিক চিন্তা হলো। রেস্তোরাঁয় তখন সন্ধ্যাকালীন ব্যস্ততা। শেফকে দায়িত্ব বুঝে দিয়ে রুমি বেরিয়ে এলো।

‘অনু, পরখের রুমে দু কাপ কফি দিয়ে যাবেন প্লিজ।’

অনু সহাস্যে সায় জানাল। সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে নিজের কক্ষে না গিয়ে রুমি চলে গেল পরখের কক্ষে। ল্যাপটপের সামনে বসে আছে পরখ। কাজের কাজ কিছু না করে অহেতুক ওয়েবসাইটে স্ক্রলিং করতে দেখে রুমি একটি চেয়ার দখল করে পরখের সামনে বসে পড়ল। সন্দিহান গলায় জানতে চাইল,

‘কি হয়েছে তোর?’

ল্যাপটপের স্ক্রীন থেকে চোখ না সরিয়ে পরখ দায়সারাভাবে জবাব দিল,

‘কিছু না। কী আবার হবে!’

‘এমন থম মেরে বসে আছিস কেন? দুপুরেও কিছু খেলি না।’

‘এমনিতেও শরীর ভালো লাগছে না।’

‘সেকি! জ্বর বাঁধিয়েছিস নাকি?’

‘নাহ। জ্বর নেই।’

‘যা অনিয়ম শুরু করেছিস আজকাল! তোর মতো গোছানো ছেলেটা এমন উদাসীন হয়ে গেলো কীভাবে, বুঝে উঠতে পারি না।’

‘আজকাল নিজেই নিজেকে বুঝে উঠতে পারছি না।’

অনু দু কাপ কফি নিয়ে এসে টেবিলের উপর রেখে চলে গেল। একটি কফির কাপ পরখের দিকে এগিয়ে দিয়ে রুমি বলল,

‘কফিটা অন্তত খা। ভালো লাগবে।’

কাপ হাতে নিলেও তাতে চুমুক দিল না পরখ। দু হাতে যত্ন করে ধরে রেখে খানিক অস্বস্তি নিয়ে রুমির কাছে প্রশ্ন রাখল,

‘আদ্রিকা কোথায়?’

কাজের চাপে আদ্রিকার কথা রুমি ভুলেই গিয়েছিল। পরখের প্রশ্ন শুনে ঝট করে মনে পড়ে গেল। কফির কাপ টেবিলে রেখে দ্রুত পকেট থেকে মোবাইল বের করতে কর‍তে বলল,

‘দেখছিস, একদম ভুলে গিয়েছিলাম। আমার অসাবধানতায় মেয়েটার হাত দুটো কতোখানি পুড়ে গেল অথচ আমি একবার খোঁজ নিলাম না৷ কী ভাববে মেয়েটা!’

পরখ কোনো জবাব না দিয়ে শান্ত চোখে রুমির উদ্বিগ্নতা দেখল। পরপর দু’বার কল দেওয়ার পরেও কল রিসিভ করল না আদ্রিকা। এবার রুমিকে বেশ চিন্তিত দেখাল। অতি উৎসাহ নিয়ে পরখের কাছে আদ্রিকার খোঁজ চাইল।

‘তোর সাথে ওর কথা হয়েছে?’

পরখ শান্ত স্বরে জবাব দিল,

‘নাহ।’

‘তুই কল দিসনি?’

‘নাহ।’

‘কী আজব! অসুস্থ মানুষটা একলা বাড়িতে আছে অথচ তুই একবার কল দিয়ে খোঁজখবর নিসনি! দিনদিন কেমন চণ্ডালের মতোন হয়ে যাচ্ছিস তুই। অসামাজিক হচ্ছে তোর আচরণ।’

বন্ধুর মুখে এমন অভিযোগ শুনে পরখ সরু চোখে চাইল। বন্ধু বলেই পরখের আচরণের এমন সহজ স্বীকারোক্তি দিল রুমি? পরখকে এমন আশ্চর্যান্বিত হতে দেখে রুমি নিজ অভিযোগের বিশ্লেষণ দর্শানোর চেষ্টা করল।

‘মেয়েটা দুটো হাতে আঘাত পেয়েছে৷ দুপুরে কিছু খায়ও নি। স্বামী হিসেবে তোর কি উচিত ছিল না, এই সময় ওর পাশে দাঁড়ানো? অথচ দেখ, তুই এখানে অযথা ল্যাপটপে মুখ গুজে বসে আছিস। কলেজে থাকতে আমরা ভাবতাম, তুই একদম বউ দুলালি জামাই হবি। অথচ তুই হয়েছিস উল্টো। একদম বউ জ্বালানি জামাই।’

রুমি একেকপর এক বিস্ফোরক মন্তব্যে হতবিহ্বল পরখ বিস্মিত স্বরে বলল,

‘তুই আমাকে এভাবে বলতে পারলি?’

‘নিজের চোখে না দেখলে, আমি বিশ্বাসই করতাম না তুই এমন কাঠখোট্টা স্বামীতে পরিণত হয়েছিস। তোদের দুজনকে দেখে মনে হয়, বিয়ের যুগ যুগ পেরিয়ে গেছে৷ কে বলবে তোদের নতুন বিয়ে হয়েছে! রেস্টুরেন্টের অনেকে তো জানেই না, তোরা জামাই-বউ। এতোটাই দূরত্ব রেখে চলাফেরা করিস তোরা। অথচ নিউ কাপলরা হয় অতিমাত্রায় বেপরোয়া। তাদের আশেপাশে থাকলে মানুষকে প্রায় অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়৷ আমার মনে পড়ে না, আমি তোদের দুটোকে কখনো কাছাকাছি দাঁড়াতে দেখেছি৷ আদ্রিকার মতো প্রাণোচ্ছল মেয়ে তোর সাথে হেসেখেলে সংসার করছে, এই ঢের৷ অন্য কেউ হলে কেঁদেকেটে দুকূল ভাসাতো।
সত্যি করে বলতো, তোর কি হয়েছে? সারাক্ষণ এমন গম্ভীর মুখ নিয়ে কেনো ঘুরিস?
একটুও রসকষ অবশিষ্ট নেই তোর মধ্যে। কাকে সব দান করে এসেছিস?’

এতোক্ষণ মনোযোগ দিয়ে রুমির অহেতুক অভিযোগ শুনলেও শেষ বাক্যে পরখ খেকিয়ে উঠল।

‘যতোসব অদ্ভুত কথা! যা, বের হ তুই আমার রুম থেকে। আমার মাথা ধরিয়ে দিয়েছিস তুই।’

পরখের ঢং দেখে রুমি ঠোঁট উলটে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কফির কাপ হাতে নিয়ে বলল,

‘দুপুরের খাবার খেয়েছে কিনা খোঁজ নিয়ে দেখ৷ ইউজলেস হাসবেন্ড।’

*****

শো শো করে হাওয়া বইছে৷ মাথার উপরে পড়ন্ত বিকেলের আকাশে অবান্তর ছুটোছুটি করছে মেঘদল। তারই নিচে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিকা। হাওয়ায় উড়ছে তার বেগুনি রঙের ল্যাভেন্ডার শেডের শাড়ির আঁচল। ছাদের রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। দৃষ্টি দূর আকাশে। মনটা আজ বড্ড বিক্ষিপ্ত। কোনোকিছু ভালো লাগছে না।

আদ্রিকার মন সচরাচর এমন ভার হয়ে থাকে না। বেশিক্ষণ কষ্ট পুষে রাখার মেয়ে আদ্রিকা নয়৷ সমস্যাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে চলার মন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে জানে আদ্রিকা।

যা আদ্রিকার মস্তিষ্কে দুশ্চিন্তার জন্ম দেয়, তা নিয়ে আদ্রিকা ভাবেই না। নিজের বিয়ে নিয়ে আদ্রিকার হেলায়ি দেখে লোকে হয়তো হাসবে। হাসলে হাসুক, তবুও আদ্রিকা বর্তমানে বাঁচবে৷ ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে বসে বর্তমানকে হেলা করার পক্ষপাতিত্ব নয় সে।

তবুও আজ বর্তমানের আকাশ বড্ড ভারি হয়ে উঠেছে৷ অভিমানের ঘন মেঘ খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারে না আদ্রিকার মন আকাশে৷ আদ্রিকার বড্ড হাঁসফাঁস লাগে। খুব দ্রুত খুঁজতে থাকে পরিত্রাণের পথ৷

দূর হতে ভেসে আসছে বাইকের আওয়াজ। আদ্রিকা ঘাড় ফিরিয়ে বাড়ির সামনের মাটির রাস্তার দিকে তাকালো৷ অসময়ে ধেয়ে আসছে পরখের বাইক৷ এমন গুমোট আবহাওয়ায় মহাশয়ের উপস্থিতি মোটেও সুখকর নয়৷ আদ্রিকার মেঘাচ্ছন্ন মনকে আরও আঁধারে ডুবিয়ে দেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে পরখের৷ এক্ষুণি কিছু তেতো কথা বলে মেঘে মেঘে ঘর্ষণ সৃষ্টি করে ফেলবে। তাই আদ্রিকা সিদ্ধান্ত নিল কিছু সময়ের জন্য পরখের থেকে দূরেই থাকবে।

গ্যারেজে বাইক রেখে পরখ উঁকি দিয়ে ছাদের দাঁড়িয়ে থাকা আদ্রিকাকে একনজর দেখে নিল। সিমেন্টের সিঁড়ি বেয়ে ধীর পায়ে উপরে উঠতে উঠতে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ভাবতে লাগল। দুপুরের ঘটনার পর আদ্রিকার মুখোমুখি হওয়াটা পরখের জন্য বেশ বিব্রতকর।

পরখের কথায় আদ্রিকা ওমন রেগে যাবে, কে জানত! পরখ তো ওর ভালোর জন্যই রুমির কথা বলেছিল। অথচ মেয়েটা পরখকেই ভুল বুঝল। ঠিক এজন্যই পরখ যেচে কারো উপকার করতে যায় না।

ছাদে পা রেখে পরখ সরাসরি ঘরের দিকে গেল না। ছাদ বাগানে দাঁড়িয়ে থাকা আদ্রিকার দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইল। পরখের উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিকা৷ আদ্রিকার ল্যাভেন্ডার রঙের শাড়ির জমিনে সাদা সাদা ক্ষুদ্র ফুলের মতোই পাশের ফুলগাছে ফুটে আছে সাদা বনটগর। সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে চঞ্চল আঁচলের উদ্ধতা দেখল পরখ৷

তারপর কী যেনো ভেবে এক পা এগিয়ে গেল আদ্রিকার দিকে। ঠিক তখনি ঘুরে দাঁড়াল আদ্রিকা। পরখকে সম্পূর্ণ অবহেলা করে বড় বড় পা ফেলে চলল ঘরের দিকে৷

বিস্মিত পরখ কিছুক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে থেকে ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। খুব সাবধানে স্লাইডিং ডোর বন্ধ করে দিয়ে তাকাল আদ্রিকার কক্ষের দিকে৷ মেয়েটা এরই মধ্যে কক্ষে প্রবেশ করে দোর দিয়েছে।

ফাঁকা ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে পরখ খেয়াল করল, অদ্ভুতভাবে আজ প্রথমবার আদ্রিকাকে সে ভয় পাচ্ছে। নিজের মনের এমন পরিবর্তনে পরখ হকচকিয়ে গেল৷

বিক্ষিপ্ত মনের রেশ টেনে পা ফেলল নিজ কক্ষের দিকে। অফিস ফেরত সাজসজ্জা ছেড়ে খানিক পরিপাটি হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল বিছানায়। অবশেষে মনের অস্থিরতার কাছে হেরে গিয়ে পরখ বিছানা ছাড়তে বাধ্য হলো।

পরখ-আদ্রিকার ছোট্ট রান্নাঘরটিতে পিনপতন নীরবতা। পরিষ্কার পরিপাটি রন্ধনশালায় রন্ধন প্রক্রিয়ার কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না৷ ঘর্মাক্ত শার্টের হাত গুটিয়ে নিয়ে পরখ ফ্রিজ খুলল। সেখানেও কোনো খাবার অবশিষ্ট নেই৷

দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঁকি দিলো আদ্রিকার কক্ষে। দেখল জানালার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিকা৷ সাবধানী পায়ে কাছাকাছি পৌঁছে প্রথম কথাটি পরখ নিজেই বলল।

‘লাঞ্চ করোনি তুমি?’

আদ্রিকার পেছনে একহাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে পরখ। ডুবন্ত বিকেলের শান্ত আবহাওয়ায় পরখের কথাগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। নিশ্চিতভাবে পরখের প্রশ্ন কর্ণগোচর হয়েছে আদ্রিকার। অথচ সে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইল।

নিরুপায় পরখ আদ্রিকার সন্নিকটে দাঁড়িয়ে কাঁধের পেছন থেকে উঁকি দিয়ে ওর হাতের ক্ষত দেখার চেষ্টা করে বলল,

‘তোমার হাতের কি অবস্থা এখন?’

এবার আদ্রিকা নিরুত্তর রইলেও কিছুটা সাড়া পাওয়া গেল। পরখকে উপেক্ষা করে জানালার ধার হতে সরে যেতে চাইলে পরখ এক হাতে পেছন থেকে আদ্রিকার হাতসহ উদর জাপটে ধরল।

আদ্রিকার পিঠ ঠেকেছে পরখের বুকে৷ কাঁধের উপর পরখের থুতনি। তুলতুলে গালে শক্ত চোয়ালের রুক্ষ দাঁড়ি খোঁচা দিচ্ছে। আদ্রিকার বেহায়া মনে হঠাৎ করে প্রজাপতি উড়াউড়ি শুরু করে দিল। দেহের দুপাশে দুটো হাত নিথর ফেলে রেখে অশান্ত মনকে শান্ত করতে চোখ জোড়া বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস নিল আদ্রিকা।

একহাতে আদ্রিকাকে বন্দী করে, অন্য হাতে আদ্রিকার ডান হাতের কব্জি ধরে জানালার আলোর সামনে তুলে ধরল পরখ। ম্লান আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে হাতের ক্ষত। ফোস্কা না পড়লেও সাদা ত্বকে লালচে ক্ষত ফুটে উঠেছে৷

পরখের কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ ঠিকমতো ফুটে উঠার আগেই হাত ঝাপ্টা দিয়ে ছাড়িয়ে নিল আদ্রিকা৷ পরখ বিরক্ত হলেও সহানুভূতি নিয়ে বলল,

‘আরেকবার ক্রিম দেওয়া দরকার। এসো লাগিয়ে দেই।’

‘প্রয়োজন নেই।’

অভিমানে ফুলেফেঁপে উঠল আদ্রিকা। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে হুটোপুটি শুরু করে দিল। স্বল্প ধৈর্যের অধিকারী পরখের পক্ষে বিরক্তি লুকানো সম্ভব হলো না৷ আরও শক্ত করে কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিল আদ্রিকাকে। ধমক দিয়ে জানতে চাইল,

‘কী সমস্যা? এমন করছো কেনো?’

ছাড়া পাওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে আদ্রিকা বলল,

‘কী সমস্যা আপনি জানেন না? তখন অপমান করে এখন আদিখ্যেতা দেখাতে এসেছেন?’

এজন্যই পরখের মুখোমুখি হতে চায়নি আদ্রিকা। দু লাইনের দুটো কথা বলতে গিয়ে কণ্ঠরোধ হয়ে আসতে চাইছে। চোখে জল জমে একাকার অবস্থা। অথচ আদ্রিকার আরও অনেকক্ষণ অভিমান ধরে রাখার কথা ছিল। আরও অনেকক্ষণ মন আকাশে কালো মেঘে জমে থাকার কথা ছিল। এখনি বৃষ্টি নামতে শুরু করলে কিছুক্ষণ পরেই মেঘ হারিয়ে পরিষ্কার হয়ে যাবে আকাশ। স্বচ্ছ আকাশে আবারও ঝলমল করে উঠবে প্রত্যাশার নতুন সূর্য৷ এরপর পরখ আবারও অপমান করবে, আবারও মেঘ জমে আঁধার ঘনিয়ে আসবে৷ এভাবে আর কতো! অপ্রিয় এক চক্রে আটকে যাচ্ছে আদ্রিকা।

মনকে চুপিচুপি একখানা কড়া ধমক দিয়ে নিজেকে লুকাতে মাথা নিচু করে ফেলল আদ্রিকা৷ পরখ দু হাতে আদ্রিকার কোমর জড়িয়ে ধরে চুপচাপ দেখতে থাকল আনত দৃষ্টির অভিমানী মেঘমল্লার। বর্ষণ ঠেকাতে তার কতোই না অপরাগ প্রচেষ্টা!

ওই মুখখানির দিকে চেয়ে হঠাৎ কী হলো, পরখ জানে না। নিজের অজান্তেই এই প্রথমবার উন্মাদ মেয়েটির কাছে হার মেনে নিল। আদ্রিকার অবনত শিরে আলতো করে কপাল ঠেকিয়ে ফিসফিস করে পরখ বলল,

‘স্যরি।’

ছোট একটি শব্দ। তবে তার ভার অসীম৷ আদ্রিকার মনে হলো, পরখের এই দুঃখ প্রকাশ আজকের সামান্য অপমানের জন্য নয়। এ দুঃখের ভাষা অন্যরকম। অনেক গভীর, অনেক বিস্তৃত। যা খুব ধীরে কর্ণকুহর ভেদ করে হৃদয়ে পৌঁছে যায়৷ অস্থির মনটিকে জাপটে ধরে শব্দরা চুপি চুপি বলে, তোমার দুঃখে আমি দুঃখিত।

ছলছল চোখজোড়া বন্ধ করে মনের সাহায্যে আদ্রিকা শুনল, সে দুঃখগাথা। শান্ত হলো তার মন।

আদ্রিকা খুব সাবধানে ডান হাত বাড়িয়ে পরখের গালের উপর রাখল। দ্রুত মাথা তুলে গাল থেকে সেই হাত সরিয়ে নিয়ে পরখ বলল,

‘হাতে ব্যথা পাবে।’

পরখের হাত থেকে নিজের হাতটি ছাড়িয়ে নিয়ে দু হাতে পরখের গলা জড়িয়ে ধরে আদ্রিকা বলল,

‘আপনি এর থেকেও বেশি ব্যথা দিয়েছেন৷ সেসব আমার সয়ে গেছে।’

আদ্রিকার অভিযোগে পরখ শান্ত চোখে তাকাল। চোখে চোখ রেখে বলল,

‘আমি মোটেও ব্যথা দেওয়ার মতো কিছু বলিনি। আমার সব কথা তোমার বিদ্রুপ মনে হয়, তাই তেতো লাগে৷ অথচ আমি তোমার ভালোর জন্যই বলেছিলাম। রুমি যথেষ্ট ভালো ছেলে। ওর সাথে তুমি ভালো থাকবে।’

আবার একই কথা শুনে প্রচন্ড বিরক্ত হলো আদ্রিকা। ইচ্ছে হলো দু হাতে এই নিষ্ঠুর লোকটার গলা টিপে ধরতে৷ হাতে আঘাত না পেলে আজ সত্যি গলা টিপে মেরে ফেলত। উহু। পুরোপুরি মেরে ফেলতে পারত না। তবে আধমরা ঠিকই করত। রোজ আদ্রিকার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার মতো কথা বলা মহাশয়ের জানা দরকার, শ্বাসরোধ হয়ে এলে কেমন লাগে।

হৃদয়ের উত্তাপ কণ্ঠে প্রকাশ করে আদ্রিকা বলল,

‘আমি কার সাথে ভালো থাকবো সেটা আপনার কাছে জানতে চেয়েছি? আজ অযথা আমাকে নিয়ে ভাবতে বসেছেন কেনো? আপনি যদি সত্যি আমাকে নিয়ে ভাবতেন, আমার ভালো চাইতেন তবে এমন কথা বলতেন না। আপনি খুব ভালো করে জানেন, আমি কার সাথে ভালো থাকতে চাই। সুখী হতে চাই।’

‘তোমাকে আগেই বলেছি, তা সম্ভব নয়। আই হ্যাভ টু গো।’

বারংবার একই কথা, একই যুক্তি শুনে বিরক্ত আদ্রিকা৷ কণ্ঠে সমস্ত বিরক্তি ঢেলে বলল,

‘তো যান৷ আমি আটকেছি আপনাকে? একবারও বলেছি, আমি আপনাকে যেতে দিব না? আমাকে এতো কীসের ভয় আপনার? আপনি চলে যেতে চাইলে, আমাকে জরিমানা দিতে হবে৷ বাড়ি গাড়ি দিতে হবে। এমন কিছু বলেছি? কিংবা মোটা অঙ্কের কোনো টাকা দাবী করেছি আমি?’

মুখে কিছু না বলে দুদিকে মাথা দুলিয়ে জবাব দিল পরখ। তা দেখে আদ্রিকা দ্বিগুণ জ্বলে উঠে বলল,

‘তবে আমাকে ঘাড় থেকে নামাতে উঠে পড়ে লেগেছেন কেনো? আমার পেছনে আপনার খুব খরচা হচ্ছে? তাও তো হচ্ছে না৷ আমার এখন নিজের উপার্জন আছে৷ টাকার সমস্যা হলে বলুন। খাওয়াদাওয়া, বাড়ি ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি৷ নাকি বিয়ে করে অন্য মেয়েকে নিয়ে আসার প্ল্যান করেছেন? আমি এ বাড়িতে আছি বলে তাকে নিয়ে আসতে পারছেন না? আমার হতে হতেও না হওয়া সতীনটা কি ফিরে আসতে চাইছে?’

আজ প্রথমবার আদ্রিকাকে অবাক করে দিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল পরখ। আদ্রিকা অবাক হয়ে দেখল সূর্যের প্রথম কিরণের মতো স্নিগ্ধ, পবিত্র সে হাসি। প্রাণ ভরে শুনল ঝর্ণার সেই কলকল ধ্বনি।

আদ্রিকাকে থমকাতে দেখে নিজের হাসি সামলে পরখ বলল,

‘এক বিয়ে করে পস্তাচ্ছি। দোদুল্যমান জীবনে আরেকজনকে জড়ানোর দুঃসাহস নেই।’

দোদুল্যমান জীবন বলতে পরখ কি বুঝিয়ে আদ্রিকা ভালো করেই জানে। উচ্চশিক্ষা অর্জনের অপূর্ণ স্বপ্ন আজও পরখকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেয় না। পরখ ভুলতে পারেনি নিজের ব্যর্থতা। পরখের জীবনের সেই নাজুক অধ্যায়ের প্রসঙ্গে যেতে চায় না আদ্রিকা৷ তাই প্রসঙ্গ এড়িয়ে সরু চোখে চাইল। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করল,

‘নিজে এক বিয়ে করে পস্তাচ্ছেন। তবে আমার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন কেনো?’

পরখ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজ অপারগতার আফসোস লুকালো। মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে বড্ড জ্ঞানীভাব নিয়ে বলল,

‘ আমি চলে গেলে তোমার নিজের পাশে কাউকে প্রয়োজন হবে। সে হিসেবে রুমি পারফেক্ট চয়েজ৷ তোমার সাথে ভালো মানাবে। তুমি যেমন কেয়ার, এটেনশন চাও, যতোটা ভালোবাসা চাও ততোটা রুমি তোমাকে দিতে পারবে। ও খুবই ভালো ছেলে। আমি ওকে অনেকদিন ধরে চিনি। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি,ও তোমাকে আগলে রাখবে। তুমি নিজেও এই কয়েকদিন রুমির সাথে মিশে নিশ্চয়ই বুঝে গেছো, ও কতোটা কেয়ারিং।’

‘আমার পাশে কাকে, কখন প্রয়োজন সেটা আমি দেখব। আমার জীবন নিয়ে আপনি এতো ভাবছেন কেনো? স্বার্থপরের মতো নিজের জীবন গুছিয়ে ঠিকই তো চলে যাবেন। সেটাই করুন৷ আমার কাউকে বিয়ে করা প্রয়োজন হলে সেটা আমি বুঝে নিব। নিজেই ছেলে খুঁজে নিতে পারব। আপনার কাছে আমি নিশ্চয়ই সাহায্য চাইনি৷ যেচে সাহায্য করতে আসছেন কেনো? আমি চেয়েছি আপনার সাহায্য?’

পরখ জবাব না দিয়ে চুপচাপ আদ্রিকার দিকে চেয়ে রইল। সত্যিই তো। আদ্রিকা কখনো ওর কাছে সাহায্য চায়নি৷ পরখ চলে গেলে ও কীভাবে দিন কাটাবে তা নিয়ে কখনো উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেনি। তবে পরখ কেনো এতো ভাবছে? আদ্রিকা পরবর্তী জীবন নিয়ে কেন এতো চিন্তা করছে? একি শুধুই দায়িত্ববোধের তাড়না?

নিরুত্তর পরখের শুষ্ক মুখখানি দেখে আদ্রিকার রাগ, অভিমান উড়ুউড়ু করতে করতে একসময় পেছনের খোলা জানালা দিয়ে ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে গেল।

পরখের শক্ত চোয়ালে নাক ঠেকিয়ে অবলম্বনহীন আদ্রিকা পুরো দেহের ভার ছেড়ে দিল। গায়ের সাথে গা লেপ্টে রুক্ষ ত্বকে শীতল নাক ঘষে উত্তাপহীন ম্লান কণ্ঠে বলল,

‘আমি যা চাই, তা দিতে আপনি নারাজ৷ অথচ প্রতিনিয়ত অহেতুক বোঝা আমার মাথার উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আপনি আমাকে কেনো বুঝতে পারেন না? কেনো বুঝার চেষ্টা করেন না? মাত্র কয়েকটা দিন আপনার সাথে শান্তিতে থাকতে চাই৷ খুব বেশি চাইছি কি?’

একটুখানি সরে গিয়ে গভীর চোখে চেয়ে আদ্রিকার চোখে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করল পরখ। আদ্রিকার চোখের অতলে সীমাহীন প্রেম, অতৃপ্ত তৃষ্ণা। মনোযোগ দিয়ে তাকালে মন হারিয়ে যেতে চায়। হারানোর আগেই পরখ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে চাইল। কিন্তু আদ্রিকা তা হতে দিবে কেনো? এক হাত পরখের গালে রেখে ঠোঁট ছুলো অন্য গালে।
পরখ সতর্ক করে দিতে বলল,

‘হাতে লাগবে।’

আবেশে চোখ দুটো বন্ধ করে আদ্রিকা একরোখা গলায় বলল,

‘ লাগলে লাগুক।’

গাল বেয়ে ছোট ছোট চুম্বন এঁকে ক্রমেই নিম্নগামী হতে থাকল আদ্রিকার ওষ্ঠপুট। রুক্ষ চোয়াল বেয়ে গ্রীবাদেশে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলে শুকনো ঢোক গিলল পরখ।

আদ্রিকার কোমর জড়িয়ে থাকা হাত দুটো বন্ধন ছেড়ে দিল। পরখ দ্রুতগতিতে কোলে তুলে নিল আদ্রিকার পলকা দেহখানি৷

বাহিরে তখন নীড়হারা পাখিরা নতুন নীড়ে আশ্রয় নিতে ব্যস্ত। সঙ্গীর উষ্ণ দেহের ওমে জিরিয়ে নিচ্ছে সারাদিনের ক্লান্তি৷ রঙ হারানো সূর্যটা দূর আকাশের শেষপ্রান্তে নিজেকে লুকিয়ে ফেলছে। শহর জুড়ে ধীরে ধীরে নেমে আসছে অন্ধকারের চাদর।

মনতরীর পাড়ের ছোট শহর ভূবনভোলার একপ্রান্তে একখানা দোতলা বাড়ি। নির্জরতার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। তারই ছোট একটি কামরায় অবস্থিত ছোট্ট একটি খাট৷ যেখানে কোনোরকমে একজন মানুষ হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাতে পারে৷ আজ সেখানে ঠাঁই নিয়েছে অস্থির চিত্তের দুটো প্রাণ।

পূর্ণযৌবনা আদ্রিকার হাত দুটো আঁকড়ে ধরে আছে প্রাণপুরুষের বলিষ্ঠ কাঁধ। পরখ খুব সাবধানে হাত দুটো ছাড়িয়ে নিল। দৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য মায়া ঢেলে তাকাল লালচে ত্বকের দিকে। মুখ নামিয়ে আলতো করে চুমু খেলো হাতের তালুতে৷

আদ্রিকার মনে হলো, দিনদুপুরে সে সুখস্বপ্ন দেখছে। এতো মায়া নিয়ে পরখ আগে কখনো তার দিকে তাকায়নি। পূর্বে সঙ্গমকালীন সময়ে পরখ কখনো আদ্রিকাকে অপমান করেনি ঠিকই। বরং যা দিয়েছে, যতোটুকু দিয়েছে সম্মানের শহীদ দিয়েছে৷ পরখের প্রতিটি স্পর্শে ভালোবাসা ছিল, চাহিদা ছিল, কাম ছিল। কিন্তু এতোটা সাবধানতা, এতোটা মায়া, এতোটা প্রীতি কখনো ছিল না।

পরখের আলতো ঠোঁটের ছোঁয়া আদ্রিকার আর্দ্র মুদিত চক্ষু পেলো। পেলো নাকের ডগা, কম্পিত অধরোষ্ঠ, শুষ্ক গ্রীবা।

বহু কাঙ্ক্ষিত মূল্যবান কোনো রত্নের মতো পরখ ছুঁয়ে দিল আদ্রিকার পুরো দেহখানি। আদ্রিকার মনে হচ্ছে সে ভুল করে কোনো ভ্রমের রাজ্যে প্রবেশ করেছে। যেখানে শুধুই সুখের ছড়াছড়ি। অলিতেগলিতে প্রশান্তি৷ নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে স্বস্তি। আবেশে চোখ বুজে আসছিল আদ্রিকার৷ ভ্রমের এই যবনিকা যেনো কখনো বেআবরু না হয় সেই ভয়ে আদ্রিকার দুচোখের পাতা সারাক্ষণ মুদিত রইল।

অনুভূতির জোয়ারে আন্দোলিত পরখ। বিবেকের রাজ্যে আবেগের রাজত্ব। অনুরাগের পরম ক্ষণের পূর্ব মুহূর্তে পরখ চেয়ে দেখল আদ্রিকার পেলব, সুশ্রী
মুখ পানে। আদ্রিকার মুদিত চোখের কোলে এক ফোঁটা জলের উপস্থিতিতে পরখের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। ভঙ্গুর হৃদয়ে প্রশ্ন জাগল, এই প্রণয়যাত্রায় কোথায় তোমার প্রণিধান, সহচারিণী?

পরখের সন্দিহান মস্তিষ্কে তোড়জোড় শুরু হলো। আদ্রিকার টানটান গ্রীবায় হাত রেখে আঙ্গুলগুলো গুটিয়ে সৃষ্টি করল মুষ্টি।

হঠাৎ গলায় চাপ অনুভব করায় চকিতে চোখ মেলে তাকাল আদ্রিকা। ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকল গৃহীত অক্সিজেনের মাত্রা।

পরখের অপর হাত তখন আদ্রিকার দু হাতের কব্জি ধরে মাথার উপরে আটকে রেখেছে৷ অক্সিজেনের চাহিদায় ছটফট করে উঠল আদ্রিকা। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেও বিশেষ লাভ হলো না। পরিশেষে বিনীত চোখে তাকালো পরখের দিকে। পরখ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে আদ্রিকাকে। সে চোখের ভাষা দুর্বোধ্য। ক্ষণকাল পূর্বে পরখের চোখে যে ভাষা আদ্রিকা পড়েছিল, তা এখন সম্পূর্ণ নিরুদ্দেশ। ভয় হতে শুরু করল আদ্রিকার।

ওর ফ্যাকাশে মুখের দিকে চেয়ে পরখের খানিক বোধোদয় হলো। খানিক ঝুঁকে আদ্রিকার চঞ্চুর মতো গোলাকার ঠোঁটের সন্নিকটে তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,

‘তুমি যখন আমার সান্নিধ্যে থাকবে তখন অন্য কারো ভাবনায় বিভোর থাকার দুঃসাহস করবে না।
পুরোটা সময় চোখ মেলে তুমি শুধু আমাকেই দেখবে। তোমার দৃষ্টি, তোমার মনোযোগ সবকিছু থাকবে আমার দিকে।’

অক্সিজেনের অভাবে নাকি পরখের কথার ভাঁজে লুকায়িত মিথ্যে অপবাদে আদ্রিকার চোখ ভরে এলো জলে। তবে পরখ থেমে রইলো না।
আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে মিশে যেতে চাইল আদ্রিকার ললিত তনুতে।

ঠোঁট দুটো ঈষৎ ফাঁকা করে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল আদ্রিকা। স্বল্প পানিতে মাছ যেমন মুখ গোল করে শ্বাস নেয়, ঠিক তেমনি পানি ছাড়া মাছের মতো দেখাচ্ছে আদ্রিকাকে৷ পরখের পুরুষালি ঠোঁটজোড়া নেমে এলো আদ্রিকার ঠোঁটে। নির্দয়ের মতো রুক্ষ দন্ত বসিয়ে দিল নিম্ন ওষ্ঠে।

চিনচিনে ব্যথা এবং অক্সিজেনের স্বল্পতায় চারদিকে আঁধার নেমে আসতে শুরু করলে আদ্রিকা অনুভব করল তার গ্রীবাদেশ চেপে রাখা হাতটি ধীরে ধীরে শিথিল হচ্ছে৷

চলবে..
#অক্ষরময়ী

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

|৪৮|

প্রকৃতির সজীবতা গ্রাস করে নিয়েছে অন্ধকার৷ জেগে উঠতে শুরু করেছে নিশাচর প্রাণীরা। বাড়ির সামনের আমগাছে কয়েকদিন আগেই দুটো ঘু ঘু পাখি বাসা বেঁধেছে। এই অসময়ে তারা থেকে থেকে ডেকে উঠছে৷

পর্যাপ্ত স্থানের অভাবে ছোট খাটে দুজন মানুষের ঠাঁই পাওয়া মুশকিল। মানিয়ে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা আদ্রিকার৷ পরখের প্রশস্ত বুকে মাথা রেখে নিজের প্রয়োজনীয় জায়গাটুকু করে নিয়েছে৷

ঘরের পিনপতন নীরবতা বহাল রেখে পরখ খুব সাবধানে বুকের উপর থেকে আদ্রিকাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। আদ্রিকা মাথা তুলে চাইল পরখের দিকে৷ চোখে চোখ রেখে পরখ কিছু বলতেই যাচ্ছিল। পরখ কী বলতে পারে নিশ্চয়ই অনুমান করা যায়। সচেতন হলো আদ্রিকা৷ প্রতিবার সুখ সমুদ্রে ভাসিয়ে এভাবেই তো গায়ে কালি লেপ্টে দেয়৷ আদ্রিকা কড়া চোখ তাকিয়ে শাসালো।

‘আজকে একটা বাজে কথা বললে, বিছানা থেকে নিচে ফেল দেব৷ ভুলে যাবেন না, এটা কিন্তু আমার বিছানা।’

পরখ বোধহয় ভুলে গিয়েছিল। আদ্রিকার কথা শুনে চারদিকে চোখ বুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ভালোভাবে শোও৷ আমি উঠবো।’

আদ্রিকা ঠোঁট ফুলিয়ে খানিক আহ্লাদ করে বলল,

‘উহু৷ আমি এভাবেই ঘুমাবো৷ আপনাকেও কোথাও যেতে দিব না৷ প্রতিবার আমাকে নিজের রুম থেকে তাড়িয়ে দেন৷ এবার আমি আপনাকে আমার রুমে আটকে রেখে দিব। থাকুন কারাবন্দী৷’

পরখের উত্তরের অপেক্ষা না করে আবারও বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ফেলল আদ্রিকা৷ আঁধারে তলিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে অনুভব করল, পরখ দু হাতে তাকে জড়িয়ে ধরেছে৷ পরখের মুখখানি দেখার
খুব ইচ্ছে হলো। কিন্তু ঘুম জড়ানো চোখ দুটো কিছুতেই সায় দিল না।

******

খোলা জানালায় ঝাপ্টা দিচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটা৷ শনশন শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আদ্রিকার৷ চোখ খুলে দেখল চারপাশে গাঢ় অন্ধকার। কেউ আলো জ্বালায়নি৷ কতোক্ষণ ঘুমিয়েছে সে? রাত কতোটা গভীর হয়েছে?

অন্ধকার হাতড়িয়ে বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটি হাতে নিয়ে দেখল সবেমাত্র আটটা বাজে। আশেপাশে পরখকে দেখা গেল না৷ আশানুরূপ ভাবে আদ্রিকা বিছানায় একা। বিছানা থেকে নেমে সুইচ টিপে আলো জ্বালালো। পরিপাটি হয়ে বাইরে এসে দেখল পুরো বাড়ি ফাঁকা। প্রতিটি কোণে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই সময়ে পরখ আবার কোথায় গেল?

সবগুলো বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে আদ্রিকা গুটিগুটি পায়ে সামনের খোলা ছাদে চলে গেল। অন্ধকারে ডুবে আছে পুরো ছাদ৷ চোখ সয়ে আসা অন্ধকারে আদ্রিকার দেখল, ঝিরিঝিরি বৃষ্টির নিচে ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে পরখ৷

ভেজা মেঝেতে নগ্ন পা ফেলে আদ্রিকাও সেদিকে এগিয়ে গেল।

আদ্রিকা পাশে এসে দাঁড়াতেই পরখ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। অন্ধকারে ম্লান হেসে সম্ভাষণ জানিয়ে প্রশ্ন করল,

‘ঘুম হলো?’

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি এসে ঝাপ্টা দিচ্ছে চোখের পাতায়। ক্ষণে ক্ষণে ঘোলাটে হয়ে আসছে দৃষ্টি। দু চোখের পাতা ঝাপটিয়ে আদ্রিকা বলল

‘হুম।’

তারপর আবার পিনপতন নীরবতা৷ চারদিকে ভেসে বেড়ানো বিষণ্ণতায় আদ্রিকার গা ছমছম করে উঠল৷ এতো নিস্তব্ধতা আদ্রিকার পছন্দ নয়৷ চাঞ্চল্যতায় সদা অস্থির থাকে সে৷

‘আপনি কখন উঠছেন?’

‘আমি ঘুমাইনি৷ অসময়ে ঘুম আসে না।’

অন্ধকারে পরখের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে আদ্রিকার মনে হলো পরখের ভীষণ মন খারাপ। যার কারণ হয়তো আদ্রিকা জানে। তবুও প্রশ্ন করল,

‘আপনার মন খারাপ?’

পরখ খানিক হকচকিয়ে গিয়ে দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলল,

‘নাহ তো।’

‘তবে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?’

‘বোর লাগছিল তাই বাইরে এলাম। খোলা আকাশের নিচে ভালোই লাগছে।’

‘আপনার প্রাক্তনের কথা মনে পড়ছে?’

বউয়ের সাথে সময় কাটানোর পর এমন মনমরা হয়ে থাকার একটি কারণই আদ্রিকার মাথায় এলো৷ তাই কোনো কিছু না ভেবে প্রশ্ন করেই ফেলল। আদ্রিকা ভেবেছিল, পরখ বুঝি রাগ করবে৷ তাই একখানা ধমক খাওয়ার প্রস্তুত নিয়ে রাখল। তবে আদ্রিকাকে অবাক করে দিয়ে পরখের বন্ধ ঠোঁটের আড়ালে খেলে গেল কৌতুকে হাসি।

‘তোমার কি তাকে হিংসে হচ্ছে?’

সে প্রশ্নের জবাবে আদ্রিকা কিছু বলল না৷ শুধু সন্দিহান চোখে পরখকে নিরক্ষণ করতে থাকল। পরখের উদাস চাহনী, মনোযোগহীনতা, স্বভাব বিরুদ্ধ স্বাভাবিক আচরণ পর্যবেক্ষণ করে আদ্রিকা নিশ্চিত হলো পরখের আজ মন খারাপ৷ এমন মন খারাপে আদ্রিকার কষ্ট হওয়া উচিত। খানিকটা হচ্ছেও বটে৷

তবে নিজের কষ্টগুলো আড়াল করে এই মুহুর্তে পরখের জন্য আদ্রিকার মন কেমন করতে শুরু করল। মানুষটা নিশ্চয়ই সেই শুদ্ধতা মেয়েটির কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছে। প্রাক্তনের প্রতি পরখের এমন গাঢ় ভালোবাসায় আদ্রিকার হৃদয়ে কোথাও একটা পুড়ছে।

অদ্ভুতভাবে আদ্রিকার হিংসা হওয়ার পাশাপাশি খারাপও লাগছে। ভালোবাসা হারানোর বেদনা আদ্রিকা জানে। পৃথিবীটা কেমন উলোটপালোট হয়ে যায়, শ্বাস নেওয়াটা কতোটা যন্ত্রণাদায়ক মনে হয় সে জানে। তাই তো পরখের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা অনুভব করতে পেরে আদ্রিকার মনটাও ভার হয়ে এলো।

দু পা এগিয়ে পরখের সামনে দাঁড়িয়ে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। পরখ একটুখানি পিছিয়ে গিয়ে আদ্রিকাকে দাঁড়ানোর জায়গা করে দিল। পরখের বেদনাদায়ক চোখজোড়ায় ডুবে আদ্রিকা বলল,

‘আপনি শুদ্ধতাকে অনেক ভালোবাসেন?’

পরখ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে দূর অন্ধকারে তাকিয়ে জবাব দিল,

‘তার প্রতি আমার ভালোবাসা হয়তো অপরিসীম, কিংবা খুব সামান্য মাত্র।’

এমন স্পষ্ট জবাবে আদ্রিকার নারীসত্তা খানিক বিদ্রোহ করে পালটা জবাব দিল,

‘আপনি শুদ্ধতাকে যতোটা ভালোবাসেন তার থেকে দ্বিগুণ ভালো আমি আপনাকে বাসি।’

পরখ বিদ্রুপের হাসি হেসে আদ্রিকার দিকে তাকাল। বলল,

‘হবে হয়তো। তোমার মতো জোরজবরদস্তি আমি আমার করতে পারি না।’

আদ্রিকা মুখ মুচড়ে ঘাড় ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। খানিকক্ষণ নিস্তব্ধতায় আকাশকুসুম ভেবে পরখ হঠাৎ করে প্রশ্ন করল,

‘কলেজ শেষ করে কি করবে, কিছু ভেবেছো?’

এমন প্রশ্নে আদ্রিকার মুখে অনেকখানি উৎসাহ দেখা দিল। খুব পছন্দের কোনো বিষয়ে আলোচনার সুযোগ পেয়ে চঞ্চল হয়ে উঠল সারা অঙ্গ। আদ্রিকার মুখমণ্ডলে সেই পুরনো শিশুসুলভ হাসি দেখে পরখের মনে হলো সে ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে৷ এক্ষুণি এই উন্মাদিনী উল্টাপাল্টা জবাব দিয়ে পরখের মেজাজ আবার বিগড়ে দিবে। আলোচনার মোড় দ্রুত ঘুরিয়ে ফেলা দরকার। কিন্তু তার আগেই আদ্রিকা বেশ উৎসাহে পরখের দু কাঁধ বেয়ে দু হাতে গলা জড়িয়ে ধরে বলল,

‘আমি ঠিক এইচএসসি পাশ করে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে পুরোদস্তুর সংসারী হয়ে যাব।’

যার সংসার নেই, সে কীভাবে সংসারী হবে ভেবে পেল না পরখ। সন্দিহান কণ্ঠে প্রশ্ন করল,

‘সংসার করবে? তবে আমি যখন আবার বিয়েশাদির কথা বললাম, তখন তেতে উঠলে কেনো?’

‘সংসার করতে আবার বিয়েশাদি করতে হবে কেনো? আমি আর আমার বাচ্চা মিলে আমাদের সংসারে হেসেখেলে দিন পার হয়ে যাবে।’

পরখ চমকে উঠে গলা থেকে আদ্রিকার হাত সরিয়ে দিয়ে শান্ত চোখে চাইল।

‘বাচ্চা?’

পরখের বিভ্রান্তকর দৃষ্টি এড়িয়ে আদ্রিকা স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিল,

‘হ্যাঁ।’

‘কার বাচ্চা?’

‘আমাদের।’

বিস্ময়ে পরখের মুখের ভাষা হারিয়ে গেল। হতবিহ্বল, হতবুদ্ধি হয়ে শুধু তাকিয়ে রইল আদ্রিকার দিকে৷ কবে, কখন এমন ভয়ংকর পরিকল্পনা জন্ম নিয়েছে আদ্রিকার মস্তিষ্কে? তবে কি পরখ ইতিমধ্যে আদ্রিকার ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে?
পরখের কপালের দুপাশের শিরাগুলো দপদপ করতে লাগল। হতভম্ব পরখকে স্থির চেয়ে থাকতে দেখে আদ্রিকা বলল,

‘রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরে আমি অনেকক্ষণ ভাবলাম। আসলেই তো, আপনি চলে গেলে আমার দিন কাটবে কীভাবে? তখনি আইডিয়াটা মাথায় এলো৷ একটা বাচ্চা নিয়ে ফেললে আমার আর একা লাগবে না।
আপনিও বিদেশ যেতে পারবেন, আমারও সংসারের স্বপ্ন পূরণ হলো। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়ে যাবে। আপনি থাকবেন আপনার মতো, আমি থাকবো আমার মতো।’

রাগে, উত্তেজনায় পরখের পুরো শরীর শিরশির করে উঠল। অত্যাধিক ক্রোধে ফর্সা মুখখানি লালচে হয়ে উঠেছে। কিন্তু অন্ধকারে তা আদ্রিকা দেখতে পেল না। শুধু শুনতে পেল পরখের গমগমে আওয়াজ।

‘ তুমি কি পাগল? আসলেই কিছু বুঝো না, নাকি বুঝতে চাও না। আমি ভাবতেও পারছি না, কেউ এতো চাইল্ডিশ কী করে হতে পারে! তোমার কাছে জীবন এতো সহজ মনে হয় কেনো? সব বিষয়ে তোমার খামখেয়ালি।’

আদ্রিকা তখনি কিছু বুঝতে পারল না। জীবনে প্রথমবার অনেক ভেবেচিন্তে সে একটি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করেছে। অথচ পরখ বলছে, এসব তার খামখেয়ালীপনা। হতাশ আদ্রিকা মুখ গোমড়া করে বলল,

‘মোটেও খামখেয়ালি নয়। আমি অনেক সিরিয়াস। আপনি চলে যাবেন লেখাপড়া করতে। আমি এখানে একা কি করবো? একটা বাচ্চা থাকলে, তার সাথে আমার সময় কেটে যাবে।’

‘আমি তোমাকে বলিনি, আমি একেবারে বিদেশ চলে যাব। আর কখনো ফিরব না। বলিনি?’

‘হ্যাঁ, বলেছেন। তাতে কি হয়েছে?’

‘এরপরেও তুমি কীভাবে বাচ্চার কথা ভাবো?’

‘আজব! বাচ্চার সাথে আপনার থাকা, না থাকার সম্পর্ক কোথায়? বাচ্চা থাকবে আমার গর্ভে, জন্ম দিব আমি, লালনপালন করবো আমি। এখানে আপনার কি দরকার? আমাকে একটা বাচ্চা দিয়ে আপনি যেখানে খুশি সেখানে চলে যেতে পারেন। আপনাকে কে আটকাচ্ছে?’

পরিস্থিতির গম্ভীরতা আদ্রিকাকে বুঝাতে না পারার ক্ষোভে পরখ সমস্ত ক্রোধ ঢেলে আদ্রিকাকে ধাক্কা দিল। হতভম্ব আদ্রিকা রেলিং আঁকড়ে নিজের পতন ঠেকিয়ে বিস্ফোরিত চোখে চাইল পরখের দিকে৷ আশ্চর্য! পরখ এমন রেগে যাচ্ছে কেনো? একটা বাচ্চাই তো চেয়েছে আদ্রিকা। বেশি কিছু তো নয়।

রাগে, ক্রোধে অন্ধ পরখ হিসহিসিয়ে বলল,

‘আমার বাচ্চা আমি তোমাকে দিয়ে চলে যাব, এতো সহজ সবকিছু? সত্যিই তুমি এমনটা ভাবো? এতোটা ইমম্যাচিউর তুমি? নাকি বাচ্চার দোহাই দিয়ে আমাকে আটকে রাখতে চাইছ?’

এমন অপবাদে আদ্রিকাও ক্রোধে ফেটে পড়ল। সমানতালে চিল্লিয়ে বলল,

‘বাজে কথা বলবেন না। আপনাকে আটকে রাখতে আমার বয়ে গেছে। আটকাতে চাইলে এমনিতেই আটকাতে পারতাম। একবার যদি আপনার কিংবা আমার বাড়িতে এসব কিছু জানাই, এক্ষুণি আপনার বিদেশ যাওয়া বাতিল হয়ে যাবে।’

‘আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছ তুমি?’

‘আপনার ব্ল্যাকমেইল করতে আমার বয়ে গেছে। বরং আপনি আমাকে মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছেন। বাচ্চা আমি নিজের জন্য চাচ্ছি৷ আপনি কোন জলে ভেসে যাবেন যান৷ সেসব আমি দেখতে যাব না।’

‘আমার বাচ্চা আমি তোমার মতো একটা মেয়ের কাছে রেখে যাব, তুমি ভাবলে কি করে?’

‘আমার মতো মেয়ে মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি?’

‘তুমি খুব ভালো করে জানো, আমি কি বলতে চাইছি। আমার বাচ্চা তোমার মতো একটা থার্ডক্লাশ মেয়ের গর্ভে থাকবে, তা আমি কখনোই মেনে নিব না। আমার বাচ্চার মা হওয়ার মতো যোগ্যতা তোমার নেই। শুধু আমার বাচ্চা কেনো, তুমি পৃথিবীর কোনো বাচ্চার মা হওয়ার যোগ্যতা রাখো না।’

পরখের কথা শুনে থমকে গেল আদ্রিকা৷ আদ্রিকা মা হওয়ার যোগ্যতা রাখে না? এতোটাই অযোগ্য সে? এতোটাই ঘৃণিত সে? একজন মেয়ের মাতৃত্বে প্রশ্নচিহ্নে থেকে বড় অপমান বোধহয় আর কিছু হয় না?

আদ্রিকার বুকের ভেতরটা একটু একটু ভাঙ্গতে শুরু করল। স্তম্ভিত, হতবল আদ্রিকাকে ওখানে রেখে পরখ ক্রোধ মিশ্রিত দীর্ঘ কদম ফেলে ছাদ ত্যাগ করল।

খানিক উচ্চৈঃস্বরে চ্যাঁচামেচি করে হাঁপিয়ে গেছে আদ্রিকা। ওর এসবের অভ্যাস নেই৷ কিন্তু সন্তান নিয়ে অপবাদে কোন মা চুপ থাকতে পারে! অনাগত সন্তানের আগমনে বাধাপ্রদানকারীর প্রতিরোধে অজান্তেই আদ্রিকা তৎপর হয়ে উঠেছে।

পরখের প্রস্থানে আদ্রিকার ক্রোধ অস্তমিত হলো। রেলিং মুঠোভরে ধরে পরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ মস্তিষ্ক শান্ত হয়ে এলে মন জুড়ে নামতে শুরু করল অভিমানের মেঘ। তীব্র মন খারাপ অন্তরে পুষে জেদ করে দাড়িয়ে রইল অন্ধকার ছাদে৷ মাথার উপর ঝিরিঝিরি বৃষ্টির প্রকোপ বেড়ে মুষলধারায় বর্ষণ শুরু হলো।

বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে জানালা দিয়ে সেজ ঝুম বৃষ্টি দেখল পরখ। দু হাতে মাথার চুলগুলো টেনে উঠে দাঁড়াল। গটগট করে হেটে বাইরে এসে স্লাইডিং ডোরের অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আদ্রিকার উদ্দেশ্যে বলল,

‘বৃষ্টি বাড়ছে। ভেতরে এসো৷’

আদ্রিকার ফিরে তাকাল না৷ জেদ ধরে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পরখ আবার বলল,

‘ঠান্ডা লেগে জ্বর বাঁধাবে। অকারণ জেদ করো না৷’

এবারও আদ্রিকার সাড়া না পেয়ে পরখ নিজেই ছাদে পা রাখল। ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আদ্রিকার কাছে পৌঁছাল। বিনাবাক্য ব্যয়ে আদ্রিকার এক হাত ধরে টেনে নিয়ে আসলো ঘরের ভেতর৷
আদ্রিকাকে ড্রয়িংরুমে দাড় করিয়ে রেখে পরখ চলে গেল আদ্রিকার কক্ষে। কাপড়ের ব্যাগ থেকে একটা থ্রি পিস বের করে নিয়ে এসে আদ্রিকার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওকে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিল।

জেদী মেয়ে মানুষ নিয়ে এই হয়েছে আরেক মুশকিল৷ রাগ দেখালে উল্টো জেদ দেখায়৷ আদ্রিকা এতোদিন পরখের সাথে তেমন জেদ করত না। ইদানীং করা শুরু করেছে৷ জেদ করছে, চিল্লাচ্ছে, ঝগড়া করছে, মারামারিও করছে। আর যে কি কি অনাসৃষ্টি কান্ডকারখানা করবে তাই দেখা বাকি।

হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরখ রান্নাঘরের গিয়ে রাতের খাবারের আয়োজন করল। দুপুর থেকে দুজনেই উপোস আছে৷ অযথা ঝগড়াঝাটি বাদ দিয়ে রাতের খাবারটা অন্তত পেটপুরে খাওয়া উচিত৷

******

নিঝুম রাত পরখ ঘুমিয়ে আছে এক পাশে কাঁধ হয়ে৷ দেয়াল ঘড়ি জানান দিচ্ছে ঘড়িতে এখন সময় রাত বারোটা৷
হঠাৎ কক্ষের বন্ধ দরজা ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করল। রাতের গাঢ় অন্ধকার ভেদ করে নিস্তব্ধ কক্ষে প্রবেশ করল নারী ছায়ামূর্তি। পরখ কিচ্ছুটি টের পেল না।

পরখের গায়ের কম্বল সরিয়ে আদুরে বেড়ালের মতো ভেতরে ঢুকে পড়ল আদ্রিকা। এক হাত ভাজ করে মাথার নিচে রেখেছিল পরখ। তাতে মাথা রেখে পরখের উষ্ণ বুকের মাঝে গুটিসুটি হয়ে জায়গা করে নিল আদ্রিকা।

শীতল ত্বকের স্পর্শে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল পরখের। যতোটা না বিরক্ত হলো তার থেকেও বেশি ভড়কালো আদ্রিকাকে নিজের বিছানায় দেখে। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ বন্ধ রেখে বিরক্তিমাখা কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

‘আমার বিছানায় কেনো এসেছো? নিজের ঘরে যাও।’

আদ্রিকা ম্লান স্বরে জবাব দিল,

‘উহু। এখানেই ঘুমাবো।’

‘রাতের বেলা ঝামেলা করো না৷ আমি অনেক ক্লান্ত৷ ঘুমাতে দেও৷’

আদ্রিকা ঠোঁট উল্টে মাথা উঁচু করে পরখের মুখের দিকে তাকালো। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে নির্লিপ্ত পরখ৷ একবার তাকিয়েও দেখলো না আদ্রিকার দিকে৷ মন খারাপ করে আবারোও পরখের বুকে মুখ গুজে আদ্রিকা বায়না ধরল।

‘ঠান্ডা লাগছে৷ আমি আপনার সাথেই ঘুমাবো৷’

এই অবেলায় ঠান্ডা লাগার কথা শুনে পরখের খেয়াল হলো, আদ্রিকার গা অনেক ঠান্ডা। বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা বাঁধিয়ে ক্ষ্রান্ত হলো তবে৷

কথা বাড়িয়ে লাভ নেই বলে চুপ করে আবারও চোখ বন্ধ করে নিল পরখ। কিন্তু আদ্রিকা চুপ করে থাকার মেয়ে নয়। সে পরখের গ্রীবাদেশের নিচে উন্মুক্ত স্থানে নাকে ঘষতে ঘষতে আবদার করলো,

‘এটা খুলুন।’

রাতের পোশাক পরখের গায়ে৷ সিল্ক শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা৷ সেখানে আদ্রিকাকে নাক ঘষতে দেখে চকিতে চোখ খুলল পরখ৷ আদ্রিকার শুষ্ক মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

‘চুপচাপ ঘুমাও।’

আদ্রিকা সেসব কথা শুনলো না। দু হাতে টপাটপ খুলে ফেললো পরখের শার্টের বোতাম৷ তারপর দু হাতে পরখকে জড়িয়ে ধরে উন্মুক্ত বুকে লেপ্টে পাড়ি জমালো ঘুমের দেশে।

এদিকে বাকিটা রাত জেগে কাটালো পরখ। রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে ক্রমেই বাড়তে লাগল আদ্রিকার গায়ের তাপমাত্রা। হাত বাড়িয়ে পাশের টেবিলের ড্রয়ার থেকে জ্বরের ঔষধ বের করে ঘুমের মাঝেই আদ্রিকাকে খাইয়ে দিল।

আদ্রিকার উত্তপ্ত শরীর, গরম নিঃশ্বাস সারারাত পরখকে দু চোখের পাতা এক করতে দিলো না৷ কিছুক্ষণ পরপর আদ্রিকার কপালে হাত দিয়ে জ্বর মেপে দেখলো। কমার বদলে ক্রমাগত বেড়েই চলছে আদ্রিকার শরীরের উত্তাপ। জ্বরের তাপে আদ্রিকা কিছুক্ষণ পরপর যন্ত্রণায় ছটফট করছে৷ পরখ এক হাতে ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে অন্যহাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পুরো রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিল।

রজনির আঁধার কাটিয়ে পূর্ব আকাশে লালচে আভা দেখা মাত্র আদ্রিকাকে নিয়ে পরখ ছুটলো হাসপাতালে। জ্বরের প্রকোপে আদ্রিকা প্রায় অচেতন। শুধু পরখের গায়ের সাথে সারাক্ষণ লেপ্টে থাকে।

সদর হাসপাতালের সিনিয়র ডক্টররা কেউ তখনো আসেননি। কয়েকজন ইন্টার্নকে পাওয়া গেল। মেডিসিন ওয়াডে নিজেদের বরাদ্দকৃত কক্ষে বসে ঝিমাচ্ছে। নার্সের ডাকে তন্দ্রাভাব কাটিয়ে দুজনে গা ঝেড়ে বসল। চোখের মোটা চশমাটি নাকের ডগা হতে চোখে ফিরিয়ে নিয়ে স্থুলকায় দেহের অধিকারী যুবকটি লম্বা হাই তুলে সঙ্গীকে বলল,

‘তুই দেখ। আমি কফি নিয়ে আসছি।’

দীর্ঘকায় সুঠাম দেহের অধিকারী অপর যুবকটি দু হাতে চোখ ঘষে রোগীর উদ্দেশ্যে বলল,

‘আপনারা বসুন।’

আদ্রিকাকে নিয়ে পরখ বসলো টেবিলের এপাশে। জ্বলন্ত চোখের ঘোলা দৃষ্টি মেলে আদ্রিকা দেখলো সাদা শার্ট পরা যুবকটিকে। পরখের সাথে কি যেন কথা বলছে। একজন নার্স এসে আদ্রিকার জ্বর মেপে দেখলো৷ দুটো ঔষধ খুলে আদ্রিকার হাতে দিয়ে খেতে বলায় আদ্রিকা বিনাবাক্যে তা গলাধঃকরণ করে নিলো৷ খসখস করে সাদা কাগজে কয়েকটি ঔষধের নাম লিখল যুবকটি। কাগজটি পরখের হাতে দিলে পরখ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আদ্রিকার হাত ধরে তাকে উঠতে সাহায্য করল।

চলে আসার সময় আদ্রিকা আবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ডাক্তারটিকে। ক্লান্ত চোখ দুটো বুঝে আবারও চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছে সে।

আদ্রিকা ফিসফিসিয়ে পরখকে বলল,

‘হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে এসেছেন আমাকে। এ তো কিচ্ছু জানে না৷ শুধু চেয়ারে বসে ঘুমায়। আপনি ভীষণ কিপ্টে। পয়সা বাঁচাতে আমাকে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন।’

দাতে দাত চিপে পরখ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো। কথাউ বলে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। আদ্রিকার হয়েছে একই দশা৷ জ্বরে মস্তিষ্ক প্রায় চেতনাশূন্য। অথচ কথার ধাচ সেই আগের মতোই রয়েছে।

সজ্ঞানে এই কথা বললে পরখ এতোক্ষণে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতো এই বেয়াদব মেয়েটিকে। নির্ঘুম রাতের ধকলে এমনিতেই মেজাজ বিগড়ে আছে। তার উপর টাকার খোঁচা দেওয়া। বিরক্তিতে পরখের সারা গা রিরি করে উঠল।

লম্বা করিডোর পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আদ্রিকা চারপাশে তাকিয়ে দেখলো ডানদিকে একটি লিফট আছে। অথচ তার মহান স্বামী তাকে তিনতলা থেকে সিঁড়ি ভেঙে নিচতলায় নিয়ে নিয়েছে। কেমন পাষাণ লোক! অসুস্থ মানুষের উপরে একটুও দয়ামায়া দেখালো না।

তখনি লিফটের দরজা খুলে বের হলো এক দম্পতি। নতুন বিয়ে হয়েছে মনে হয়। মেয়েটির কাঁধে হাত রেখে ভদ্র লোক হাঁটছেন৷ দৃষ্টি মেয়েটির মুখের দিকে নিবদ্ধ। মেয়েটির মুখে লাজুক হাসি। তবে মুখটি শুকনো দেখাচ্ছে। অসুস্থ হয়তো। অসুস্থতা ছাড়া হাসপাতালে কে বা আসে? এটা তো কোনো বিনোদন পার্ক না যে ঘুরতে আসবে৷

দম্পতির দিকে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে গিয়েও আদ্রিকার চোখে মিষ্টি একটি দৃশ্য ধরা পড়লো। লোকটি তার স্ত্রীকে কি যেনো বললো তারপর একটু ঝুকে চটাস করে চুমু খেলো মেয়েটির কপালে। মেয়েটি লাজুক হেসে চোখ বন্ধ করে নিলো।

এমন দৃশ্য দেখে আদ্রিকা তৎক্ষনাৎ চমকালেও পরক্ষণে নিজের অজান্তে হেসে ফেললো। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার স্বামী মহাশয় গটগট করে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছে।

হতাশ আদ্রিকা পোশাক সামলে এক ছুটে পরখের কাছাকাছি পৌঁছে এক হাতে পরখের হাত জড়িয়ে ধরলো৷ অতি ভদ্র পরখ জনসম্মুখে এমন সান্নিধ্যে অস্বস্তিতে গাট হয়ে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে নীরবে আদ্রিকার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। পরখকে আরেকদফা অবাক করে দিয়ে আদ্রিকা বললো,

‘আমাকে একটা চুমু দিন।’

এমন আবদারে থমকে দাঁড়ালো পরখ। জ্বরের কারণে এবার কি আদ্রিকার মস্তিষ্ক পুরোপুরি বিগড়ে গেল? চোখ বড় বড় করে কিছুপল আদ্রিকার দিকে চেয়ে থেকে পরখ আবার হাঁটতে শুরু করলো। জ্বরের ঘোরে নিশ্চয়ই উল্টাপাল্টা বকছে। বাইরে না হলে এতোক্ষণে জোরসে একটা ধমক দেওয়া যেতো। কিন্তু এই মুহুর্তে বেচারা পরখ না কিছু বলতে পারছে আর না পারছে সইতে৷

পরখের থেকে কোনো জবাব না পেয়ে আদ্রিকার ভীষণ রাগ হলো। এমন মৌনব্রত পালন করার কারণ কি? বউ একটা চুমু চেয়েছে মাত্র, লাখ টাকা তো চেয়ে বসেনি। এমন কিপ্টামি করার কি আছে?

আদ্রিকা গোঁ ধরে হাঁটা থামিয়ে পরখের হাত ছেড়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থেকে বললো,

‘আমি ওই ডাক্তারটাকে চুমু খাবো।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরখ পেছন ফিরে তাকালো। নিচু স্বরে আদেশ করলো,

‘বাড়ি চলো।’

‘নাহ, আমি চুমু খাবো।’

ফিরে এসে আদ্রিকার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চাইলো পরখ। কিন্তু আদ্রিকার জেদ, সে যাবে না। ইতিমধ্যে রাগে পরখের মুখ মন্ডল লাল হয়ে উঠেছে৷ আদ্রিকা সেসব দেখেও দেখলো না।

হঠাৎ হ্যাচকা টান দিয়ে আদ্রিকাকে পাশের দেয়ালের সাথে চেপে ধরল পরখ। মাথায় চোট পেয়ে আদ্রিকার চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। ব্যথা সামলে চোখ খোলা মাত্র আদ্রিকার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবালো পরখ। বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আদ্রিকার।

অল্প কিছুক্ষণ মাত্র। আদ্রিকার মনে হলো উত্তপ্ত শরীরের শীতল বাতাস বয়ে গেলো। সে চুমু খেতে বলেছে ঠিকই, কিন্তু ঠোঁটে নয়। কপালে ছোট একটা হামি দিলেই তো হয়ে যেতো। ভরা হাসপাতালে এভাবে ঠোঁটে চুমু খাওয়ার কী আছে? পুরুষ মানুষের মনে খালি দুষ্টুমি৷

চুমু দিয়েই পরখ হনহন করে সামনের দিকে হেঁটে চলে গেলো৷ আদ্রিকা মেঝের দিকে চেয়ে লাজুক হেসে আবার পিছু পিছু নিলো পরখের।

বাইকের পেছনে বসে পরখের কোমর জড়িয়ে ধরে আদ্রিকা মাথা ঠেকালো ওর কাঁধে৷ পরখ বললো,

‘ভদ্রভাবে বসো।’

আদ্রিকা পাত্তা দিলো না। ওভাবে বসে রইলো৷ জ্বর ছাড়তে শুরু করেছে বোধহয়। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। বাড়ি ফিরেই লম্বা ঘুম দিবে।

বাইক চালানোর বেশিরভাগ সময় ফ্রন্ট মিররের দিকে চেয়ে থাকতে হচ্ছে পরখকে। ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমে ঢুলে পড়ছে আদ্রিকা। চোখ জোড়া বন্ধ হয়েছে সেই কবে! কোমর জড়িয়ে থাকা হাতের বাধনটি দূর্বল হতে পরখ দরাজ কন্ঠে ডেকে উঠল,

‘আদ্রিকা?’

আবার শক্ত বাধনে কোমর জড়িয়ে ধরে ম্লান কণ্ঠে আদ্রিকা জবাব দিল,

‘হুম।’

‘ঘুমাচ্ছো কেনো?’

‘আমার ঘুম পাচ্ছে।’

‘চলে এসেছি প্রায়। এখনি ঘুমিও না।’

সেসব কথা কে শোনে? দু হাতে আরও শক্ত করে পরখকে জড়িয়ে ধরে ওর গায়ের সাথে লেপ্টে বাকিটা পথ পাড়ি দিলো আদ্রিকা। বাইকের গতি কমাতে বাধ্য হয়েছে পরখ। সামান্য একটু পথ পাড়ি দিতে আধা ঘন্টা লেগেছে শুধু আদ্রিকার এই অসময়ের ঘুমের কারণে।

বাড়ি ফিরে কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের কক্ষে গিয়ে দুম করে বিছানার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে নিমিষেই আদ্রিকা ঘুমিয়ে পড়লো।

আদ্রিকার গায়ের উপর কম্বল চাপিয়ে পরখ চলে গেল বাসি পোশাক ছাড়তে।

আজকে আর ভার্সিটিতে যাওয়া হবে না। ঘর গোছানো, নাস্তা বানানো, আদ্রিকাকে ঔষধ খাওয়ানো – কতো কাজ বাকি!!

চলবে
#অক্ষরময়ী