পরিণয়ে নোলককন্যা পর্ব-৫৫

0
94

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

|৫৫|

জীবনের প্রতিটি মোড়ে জিততে জিততে, তা এক সময় মানুষের বদ অভ্যাসে পরিণত হয়। মানুষ ভুলে যায় ব্যর্থতার স্বাদ। সর্বদা বিজয়ী বিস্ময় আজ কী করে মেনে নিবে হেরে যাওয়ার অপমান? নাহ, কিছুতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না৷ বারবার মনে হচ্ছে একরত্তি একটা মেয়ে তাকে হারিয়ে দিয়েছে৷ নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি ধোঁকা দিয়েছে। অথচ বিস্ময় কিচ্ছুটি জানতে পারেনি, বুঝতে পারেনি।

আজ আদ্রিকার সাথে দেখা না হলে বিস্ময় অন্তত একটা ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে সুখে থাকত। একটা সুন্দর, সুশ্রী মেয়ে। মায়াবী মুখে বেদনার গাঢ় নীল ছাপ। উদাস চোখ দুটো পথের পানে চেয়ে আছে বিস্ময়ের অপেক্ষায়। জগতের কোনো সুখ, আনন্দ তাকে ছুঁতে পারছে না। সুখী হতে সে ভুলেই গিয়েছে। তার সমস্ত অনুভূতি বিস্ময়ের মাঝে বিলীন হয়ে গিয়েছে৷ চিত্রটি এমনি হওয়ার কথা ছিল, তাই না?

অথচ দৃষ্টির সম্মুখে আদ্রিকার হাস্যোজ্জ্বল মুখ৷ উজ্জ্বল দৃষ্টি, দীপ্ত চেহারা৷ সুডৌল দেহের বাঁকে বাঁকে প্রশান্তির ঢেউ৷ শাড়ির আবরণে লুকিয়ে রয়েছে পূর্ণ যৌবনের সুখময় ছন্দ।

বিস্ময়ের সারা দেহ রি রি করে উঠল। হিংসার অনলে ছেয়ে গেল বুকের ভেতরটা। মাথার ভেতর অসহ্য এক যন্ত্রণা নিয়ে সে বসে রইল।

পরখ এলো এক কাপ চা হাতে নিয়ে। অথচ বিস্ময় বসে ছিল আদ্রিকার অপেক্ষায়। পরখকে দেখে বিস্ময়ের মুখে অসন্তুষ্টির ছাপ প্রগাঢ় হয়ে উঠল।

চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বিস্ময়ের পাশে বসল পরখ। গম্ভীর মুখটি আরও গম্ভীর করে বলল,

‘দেশে ফিরেই ঠান্ডা লাগিয়েছিস। মশলা দিয়ে বানানো চা। ঠান্ডায় অনেক উপকারী।’

পরখের এমন খাতির যত্নে বিস্ময়ের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেলো৷ চায়ের কাপ তুলে নিয়ে পরখের দিকে শীতল চোখে চেয়ে বলল,

‘ভালো ভদ্র মানুষের এই মুখোশ এখন আর তোকে মানাচ্ছে না৷ এখন থেকে এসব আদিখ্যেতা অন্তত আমার সামনে করিস না।’

পরখ তেমনি চেয়ে থেকে শান্ত স্বরে জানতে চাইল,

‘কীসের আদিখ্যেতা?’

রয়েসয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিল বিস্ময়। চা গিলে মুখ কুচকে গেল। চায়ে কেমন তেতো একটা স্বাদ৷ নাকে ঝাঝালো একটা গন্ধ ঠেকছে৷ সর্দির কারণে ঘ্রাণটা ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। তিতকুটে স্বাদের দরুন মুখের আকৃতি বিগড়ে জিজ্ঞাসা করল,

‘চায়ের মধ্যে কি দিয়েছিস? এতো বাজে স্বাদ!’

‘মশলা চা। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, ভালো কিছু তো তোর মুখে রুচে না।’

পরখের ইঙ্গিত বেশ বুঝল বিস্ময়। এতোদিন একসাথে বসবাসের সুবাদে বন্ধুকে ভালোমতোই চেনা আছে বিস্ময়ের। অতি ন্যায়নীতিমূলক বাক্য কর্ণগোচরের ইচ্ছা, ধৈর্য কোনোটাই নেই বিস্ময়ের।
দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল,

‘আর আমি জানতামই না, অন্যের এঁটো খেতে তোর এতো ভালো লাগে। এতো দ্রুত রুচি বদলে গেলো তোর!’

অপমানে ধূসর বর্ণ ধারণ করলো পরখের মুখমন্ডল। কিছুমুহূর্ত নীরবে চেয়ে রইল বিস্ময়ের পাণে। পরখের তীরের ফলার মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে নির্বিকার বিস্ময় আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চা শেষ করে বলল,

‘আদ্রিকা আর আমার ব্যাপারটা তুই জানতি না? তবুও কী করে এই কাজটা করতে পারলি? বন্ধুর পিঠে ছু/রি চালাতে তোর বিবেকে বাঁধলো না? দুনিয়াতে এতো মেয়ে থাকতে আমার গার্লফ্রেন্ডের দিকেই তোর নজর গেলো! ধোঁকাবাজ, মীরজাফর।’

‘সবটা আমার জানা। অ্যাফেয়ার থেকে ব্রেকআপ, তোর চোরের মতো পালিয়ে যাওয়া, বিয়ের নামে সাজানো নাটক থেকে শুরু করে নাটকীয় ডির্ভোসটুকুও। এরপরে তোর আর এখানে কিছু বলার থাকে না। অথচ তুই এখন এমন ভাব করছিস যেনো, তুই প্রতারিত হয়েছিস।’

‘চোর! আমি চোরের মতো পালিয়ে গিয়েছি? হাউ ফানি! বিস্ময় কখনো পিঠ দেখিয়ে ভেগে যায় না। আর না পেছন থেকে আঘাত করে৷ এসব তোর স্বভাব হতে পারে, আমার নয়। তোর জ্ঞাতর্থে জানিয়ে রাখি, আমাকে জরুরি ভিত্তিতে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। কাজের জন্য, ক্যারিয়ারের জন্য। সেই সুযোগে আমার বন্ধু আমার গার্লফ্রেন্ডকে বিয়ে করে নিয়েছে। সাব্বাশ! এই না হলো বন্ধুত্বের নমুনা! এই না হলো প্রকৃত প্রেম!’

পরখ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফায় হেলান দিয়ে বলল,

‘সবই জানি, সবই বুঝি কিন্তু আমি যা বুঝতে চাই সেটাই আমি বুঝবো। তোর অবস্থা হয়েছে সেরকম।
তোকে কিছু বলা আর দেয়ালে মাথা ঠুকানো একই জিনিস। তাই আমি বৃথা চেষ্টা করতে চাচ্ছি না। আগে আমি ভাবতাম, অন্যায় করে অন্যায়কারী কী করে এতো শান্তিতে থাকে? তাদের বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হয় না! রাতে তাদের ঠিকঠাক ঘুম হয়? এখন তোকে দেখে বুঝলাম তারা কী করে এতো স্বাভাবিক থাকে। নিজের দোষ অস্বীকার করে অন্যকে দোষারোপ করার থেকে স্বস্তিদায়ক ব্যাপার এই পৃথিবীতে আর দুটি নেই। ব্লেমিং গেমের কারণেই তোর মতো মানুষেরা সুখে থাকে। অন্যায়কারীদের প্রশান্তির ঘুম ঘুমায়। না হলে অন্যায়কারীকে রোজ অনুশোচনায় দ/গ্ধ হতে হতো।’

‘ব্লেমিং গেম! হা হা হা।’

উন্মাদের মতো আপনমনে হাসল বিস্ময়। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,

‘যেটা তোরা এই মূহূর্তে আমার সাথে খেলছিস, সেটাই তো?’

‘সত্যিই কি তাই?’

‘সত্য-মিথ্যা নিয়ে এখনো তোর সন্দেহ হচ্ছে? সবটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। যে কেউ শুনলে এক বাক্যে আমাকে সমর্থন করবে। প্রেমিক চোখের আড়াল হতেই প্রেমিকা অন্য ছেলেকে বিয়ে করে নিল। কেনো নিলো? কীভাবে নিলো? অবশ্যই তার মনে শয়তানি ছিল। না হলে সে অপেক্ষা করত। সপ্তাহ, মাস, বছরের হিসাব গুনত। কিন্তু নাহ, সে করেনি। প্রেমিকেরই বন্ধুকে বিয়ে করে সুখে সংসার করছে। আর আমি বোকার মতো সেই বন্ধুর কাছেই ছুটে এসেছি! কী ভীষণ অপমানজনক ব্যাপার! তোর থেকে অন্তত আমি এটা আশা করিনি পরখ।’

‘আমার থেকে কি আশা করিস নি?’

‘বড্ড সাধু সাজছিস যে! আমার গার্লফ্রেন্ডকে জালে আটকিয়ে এখন নাটক হচ্ছে?’

‘আমি কাউকে জালে আটকাতে যাইনি। এতোটা খারাপ দিন এখনো আসেনি আমার। আমাদের এরেঞ্জ ম্যারেজ ছিল।’

‘আর তুইও তাতে নাচতে নাচতে মত দিয়ে দিলি। আমার গার্লফ্রেন্ডকে বিয়ে করে নিলি। এখন জুটিয়ে সংসার করছিস। একবারও মনে হলো না, আমার কথা? জোর গলায় না করতে পারলি না, প্রতিবাদ করতে পারলি না। কেনো? তোর বিবেক তোকে একবারও জানালো না, এটা বিস্ময়ের গার্লফ্রেন্ড?’

পরখ এক হাতে সোফার হাতল চেপে ধরে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার বৃথা চেষ্টা করল। কটমট করে বিস্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘এক্স গার্লফ্রেন্ড।’

বিস্ময় তার সমস্ত আদব-কায়দা, ন্যায়-অন্যায়বোধ দূরে সরিয়ে সোফার টেবিলে হাত দ্বারা সজোরে আঘাত করে চিৎকার করে উঠল।

‘শি ইজ মাই গার্লফ্রেন্ড। অনলি মাইন। শুধু প্রেম ভালোবাসায় আমাদের সম্পর্কটা সীমাবদ্ধ ছিল না, সেটা তুই ভালো করে জানিস।’

পরখ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের পোশাক টেনেটুনে সোজা করে নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বলল,

‘চা খাওয়া হয়ে গেছে। তোর এখন যাওয়া উচিত।’

বিস্ময় উঠে দাঁড়ালো। পরখের সম্মুখে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে কঠোরভাবে জানালো নিজের বক্তব্য।

‘কেনো? সত্যি বলছি বলে শুনতে খারাপ লাগছে? তুই আগে থেকে জানতি না? নিজের চোখে দেখেছিস ও আমাদের ফ্ল্যাটে এসেছিল। ওই রুমে, ওই খাটে আমার সাথে সময় কাটিয়েছে৷ আমাদের মাঝে কি কি হয়েছে, সেসব নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না? আন্দাজ করতেই পারছিস বোধহয়। নাকি ইচ এন্ড এভরি ডিটেইলস বলব?’

মুহূর্তে রুদ্ররূপ ধারণ করল পরখ। শান্ত, নির্মল চেহারাটি লালচে হয়ে উঠল। তীক্ষ্ণ নাকের ডগা আরও তীক্ষ্ণ হলো। শাণিত দৃষ্টি দ্বারা বিস্ময়কে সাবধান করে দিয়ে বলল,

‘স্টপ ইট বিস্ময়।’

‘থামব কেন? তোরা জানা উচিত। আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে শুচ্ছিস যেহেতু, তোর জানা উচিত তার সাথে আমার ফাস্ট এক্সপেরিয়েন্স কেমন ছিল। আমার এখনো সবটা স্পষ্ট মনে আছে। কোথায়, কোথায় ছুয়েছিলাম, আমার স্পর্শে ও কীভাবে রিয়েক্ট করেছিল, কোথায় আদর করলে ও বেশি মজা পেতো…’

পরখ রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মুষ্টিবদ্ধ হাতটি তুলে সজোরে ঘু ষি মা র ল বিস্ময়ের বাম গালে। গালের আঘাতের থেকেও বিস্ময়কে বেশি আঘাত করলো বন্ধুর ঘৃণিত, খুনে দৃষ্টি।

একটা মেয়ের জন্য এতোদিনের বন্ধুত্ব পরখ এভাবে ভুলে যেতে পারল? হাত তুলতে পারল বিস্ময়ের উপর? বিয়ে করলে মানুষ এভাবে বদলে যায়! হতবাক, হতবুদ্ধি বিস্ময় গালে হাত চেপে কিছুক্ষণ হতবিহ্বল তাকিয়ে রইল পরখের দিকে।

অত:পর ঘোর কাটতেই হিংস্র হয়ে উঠল সেও। পরখের শার্টের কলার চিপে ধরে মুখের সামনে মুখ নিয়ে বলল,

‘হাউ ডেয়ার ইউ! একটা লোভী, দুশ্চরিত্র, নষ্টা মেয়ের জন্য তুই আমার গায়ে হাত তুলতে পারলি?’

পরখও কম যায় না। বিস্ময়ের মতো সেও বিস্ময়ের শার্টের কলার চেপে ধরে সমান উষ্মা নিয়ে বলল,

‘আদ্রিকার নামে আর একটাও বাজে কথা নয়।’

‘বললে কী করবি তুই, হ্যা? এই কয়েকদিনে এতো প্রেম তৈরি হয়ে গেছে? কী করে! কী পেয়েছিস তুই ওর মধ্যে? বিছানায় খুব সুখ দেয় নাকি? আমার তো তেমন মনে হচ্ছে না। অবশ্য আমার বেলা আনকোরা ছিল তো। শিখিয়ে পড়িয়ে দিলাম আমি, আর মজা লুটছিস তুই! বাহ রে বাহ!’

‘তুই একটা জঘন্য মানসিকতার ছেলে। আদ্রিকার জন্য এখন আমার আফসোস হচ্ছে। ও কী করে তোর মতো একটা অমানুষকে ভালোবেসে ছিল! ওকে দুষে কী লাভ! অবশ্য আমি নিজেও কী তোকে চিনতে পেরেছিলাম নাকি!’

‘ভালোবেসে ছিল? বল যে, এখনো ভালোবাসে। আমি ডাকলে ও এখনি সব ছেড়ে ছুড়ে আমার কাছে চলে আসবে। দেখতে চাস তুই?’

‘আমি জেনেশুনে তোর মতো একটা অমানুষকে আবারও ওর ক্ষতি করতে দিব, এটা ভাবলি কী করে? ভুলে যাস না, তুই কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিস। আমি ওর হাসবেন্ড। আমি থাকতে ওর ছায়াও মাড়াতে পারবি না তুই।’

ঝটকা দিয়ে পরখের শার্টের কলার ছেড়ে দিল বিস্ময়। বিদ্রুপের হাসি হেসে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলল,

‘হাসবেন্ড! আদ্রিকার হাসবেন্ড। ধরে রাখতে পারবি ওকে? আমি আদ্রিকার প্রথম ভালোবাসা। প্রথম ভালোবাসার জোর জানিস তো? কিশোরীর প্রথম প্রণয় সর্বনাশী, ধ্বংসাত্মক। সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আমি ডাকলে ও সব ছেড়ে চলে আসবে।’

‘আর আমিও যেতে দিব? এতো সহজ! তোর এই নোংরা চেহারাটা দেখার পর আদ্রিকাকে তোর থেকে দূরে রাখতে যা করা দরকার আমি করবো। জোর খাটাতে হলে খাটাবো। খারাপ হতে হলে তাই হবো। অন্যায় করতে হলে করব। তবুও আদ্রিকা যাতে তোর কাছে ফিরতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করবো।’

‘বড্ড ফিল্মি ডায়ালগ দিয়ে ফেললি, পরখ। তোর দৌড় আমার জানা আছে। আমি তোর এতোদিনের বন্ধু বলে কথা। তোকে পথ থেকে সরাতে আমাকে বেশি কষ্ট করতেও হবে না।’

বিস্ময়ের কথাটি কতোখানি সঠিক, তা পরখ নিজেও জানে। বিস্ময় বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ। মানুষের দূর্বলতা-সবলতা কীভাবে ব্যবহার করতে হয় ভালোই জানে। পরখের সাথে দীর্ঘসময় একই ফ্ল্যাটে অবস্থানের কারণে পরখের নাড়ীনক্ষত্র সবকিছু ওর নখদর্পনে।

মনের মাঝে ভয়ের সৃষ্টি হলেও চেহারায় নির্বিকার একটা ভাব ফুটিয়ে পরখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল। বিস্ময় রহস্যময় হাসি হেসে পরখের নিকটে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বলল,

‘এরেঞ্জ ম্যারেজ না তোদের? তোদের বাড়ির লোকজন চেনে আমাকে? জানে আমার ব্যাপারে? নিশ্চয়ই জানে না। তোর নাকউঁচু, খুতখুতে স্বভাবের বাবা কি জানে, ছেলের বউয়ের রঙিন অতীত সম্পর্কে? আমি শিওর উনি কিছু জানেন না। জানলে একমাত্র ছেলের বউ হিসেবে একজন ব্যভিচারিণীকে ঘরে জায়গা দিতেন না।’

মুহূর্তেই পরখের পায়ের নিচের জমিন সরে গেল৷ মহাশূন্যে পতিত হতে হতে হাওয়ায় ভাসছে সে৷ পায়ের নিচটা ফাঁকা, মাথায় জোর একটা চাপ৷ সম্মুখে বিদঘুটে হাসির একটা চেহারা দেখে গা গুলিয়ে উঠল পরখের।

শীঘ্রই ভাবনার রেশ টেনে ধরে প্রমোদ গুনতে শুরু করল সে। উন্মাদের সাথে উন্মাদনা তাকে মানায় না। শান্ত শীতল স্বরে শুধু একটা কথাই বলল পরখ,

‘স্টে অন ইউর লিমিট বিস্ময়।’

‘ইউ স্টার্ট দ্যা ওয়ার। আই হ্যাভ টু ফিনিশড।’

‘তোর সাথে আমার কোনো যুদ্ধ নেই। তুই নিজে চলে গিয়ে আলাদা জগত বেছে নিয়েছিস। এখন ফিরে এসে সবাইকে নিজ নিজ জীবনে সুখী হতে দেখে তোর হিংসা হচ্ছে। তুই একটা স্বার্থপর মানুষ, বিস্ময়। তুই ভাবছিস, তোকে আমরা ধোঁকা দিয়েছি। অথচ তুই জানিস-ই না, আমরা কেউ তোকে নিয়ে ভাবছিও না। আমরা সবাই নিজের জীবনে খুব ব্যস্ত। তোর মতো একজন বহিরাগতকে নিয়ে ভাবার সময় কোথায়! হিংসার সম্পর্ক বয়ে বেড়ানো তো দূরের কথা। এটেনশন না পেয়ে তোর আর ভালো লাগছে না। তাই যেচে ঝামেলা করতে চাইছিস৷’

‘নাহ বন্ধু। তুই ভুল জানিস। তুই আমার খেলার পাখিটা ছিনিয়ে নিয়ে নিজের অজান্তেই যুদ্ধ বাঁধিয়েছিস। আমার পাখিটা এখন আমার ফেরত চাই। সে যে করেই হোক। আই উইল টেক হার।’

‘মনোরঞ্জনের কোনো বস্তু নয় সে।’

‘আমার কাছে, আদ্রিকা তাই। আমার পোষা পাখি আমি ফেরত নিবোই।’

‘আমি থাকতে সেটা কখনোই সম্ভব না। ট্রাই করে দেখতে পারিস।’

‘নিশ্চয়ই বন্ধু। খুব শীঘ্রই আবার দেখা হবো। ততোদিন আমার পাখিটার খেয়াল রাখিস৷ অবশ্য দেখে মনে হচ্ছে, বেশ আদর যত্নেই আছে।’

বিস্ময় ঠোঁট বাকিয়ে হেসে চলে গেল। এতোক্ষণের দমে রাখা রাগটা আর দমিয়ে রাখা সম্ভব হলো না পরখের। বিস্ময় বেরিয়ে যেতেই সজোরে আঘাত করলো সোফার টেবিলে। লম্বা পায়ের বিশাল লাথি খেয়ে একপাশে মুখ থুবড়ে পড়লো টেবিলটি৷ বিকট শব্দে কক্ষের দরজা খুলে উঁকি দিল আদ্রিকা৷

সবেমাত্র মাথাটি দরজা ভেদ করে খানিকটা বাইরে পরিলক্ষিত হয়েছে, খেকিয়ে উঠল পরখ। সোফায় আরেকটা লাথি বসিয়ে আদ্রিকাকে জোরালো ধমক দিল।

‘ঘরের বাইরে যদি এক পা রেখেছো, তবে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।’

সৌম্যকান্তি চেহারার এমন ক্ষুদ্ধ, ক্রুদ্ধ রূপ দেখে কেঁপে উঠল আদ্রিকার সারাদেহ। হাজার বিরক্তিকর ঘটনার সম্মুখে দাঁড়িয়ে যার অভিব্যক্তি থাকে পাহাড়ের ন্যায় নিশ্চল, তার এমন রণচণ্ডী, উগ্র, অসহিষ্ণু রূপ দেখে দ্রুত দরজা বন্ধ করে কক্ষের ভেতর আশ্রয় নিল আদ্রিকা।

খানিক বাদেই দরজার খট শব্দে আদ্রিকা নিশ্চিত হলো, পরখ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছে। রাতের প্রথম প্রহরে এভাবে বাড়ি ত্যাগ করায় খানিকটা দুশ্চিন্তা হলেও অনেকখানি হালকা অনুভব করলো আদ্রিকা।

গুটি গুটি পায়ে কক্ষ ত্যাগ করে বাইরে এলো। মেঝেতে টুকরো হয়ে পড়ে আছে চায়ের কাপ। সেগুলোর খন্ডিত অংশ সযত্নে তুলে ময়লার ঝুড়িতে ফেলল। উলটে পড়ে থাকা সোফার টেবিল, এককোণে লুটিয়ে থাকা সোফার কুশন তুলে দ্রুত হলরুম গুছিয়ে ফেলল।

রাত বাড়লেও ফিরে এলো না পরখ৷ ক্ষুধা লেগেছে আদ্রিকার। কিন্তু সে সামান্যতম নড়াচড়া না করে হলরুমের সোফায় বসে দৃষ্টি রাখল দরজার দিকে।

যে বিস্ময়ের নাম মাত্র দুজনের মধ্যে কলহ বাঁধে, তার আগমণে বাড়ি একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে তা জানত আদ্রিকা। তাই খুব একটা অবাক সে হয়নি৷ শুধু পরখের রাগান্বিত সত্তার দর্শনে একটু ঘাবড়ে গিয়েছে মাত্র।

ঘড়িতে সময় রাত এগারোটা। লম্বা হাই তুলে সোফায় পা তুলিয়ে বসল। ঘুমে টুপছিল মেয়েটা। তখনি রাতের নিরবতা চিরে চাপা শব্দে ভোঁ ভোঁ করে উঠল মোবাইল। আদ্রিকা চমকে উঠে আশপাশে হাতড়ে নিজের মোবাইলটি উদ্ধার করে হাতে নিল। ততোক্ষণে শব্দ থেমে গেছে। মোবাইলে কারো মিসড কল না দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হলো আদ্রিকার৷ তবে কার মোবাইল বাজল? পরখের? উনি কি মোবাইল রেখে বাইরে গিয়েছেন?
আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজতে থাকল আদ্রিকা। খানিকবাদে আবারও ভোঁ ভোঁ শব্দ শুরু হলো।

এবার বেশিক্ষণ খুঁজতে হলো না আদ্রিকাকে।সোফার কুশনের পেছনে খুঁজে পেল পরখের মোবাইলটি। কল রিসিভ করার ইচ্ছে ছিল না আদ্রিকার। কিন্তু স্ক্রীনে রুমির নামটি দেখে রিসিভ করল। হ্যালো বলার আগেই শোনা গেল রুমির উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর।

‘কী রে, তুই কল রিসিভ করিস না কেন? জরুরি প্রয়োজনে কাউকে পাওয়া যায় না, বাল। খবর শুনছিস কিছু? বিস্ময় নাকি এক্সিডেন্ট করছে দোস্ত। অবস্থা খুব একটা ভালো না৷’

আদ্রিকার স্বাভাবিক শ্বাস প্রঃশ্বাস হুট করে আটকে গেল। ধপ করে বসে পড়ল নিচে। সোফার পাশে মেঝেতে বসে রুমির কথাগুলো ভাবতে থাকল সে। বিস্ময় এক্সিডেন্ট করেছে! কীভাবে সম্ভব!

চলবে..
#অক্ষরময়ী