।#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৬০|
বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছে পরখ৷ কিছু কার্যক্রম বাকি ছিল। তা সম্পন্ন করতে বিভাগীয় প্রধান ডেকে পাঠিয়েছেন।
আদ্রিকাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে একাডেমিতে চলে গিয়েছিল পরখ৷ বাড়ি ফিরে দেখল সবার গোছগাছ শেষ৷ জামাকাপড় পরে তৈরি হয়ে নিচ্ছে৷
আদ্রিকা ও পর্তুলিকার উত্তেজনা দেখে মনে হচ্ছে বাড়িতে বিয়ে লেগেছে কিংবা আজ বোধহয় ঈদের দিন। কোন শাড়ি পরবে, কোন গয়না মানাবে, কোন জুতো পরে সাচ্ছন্দ্য হাঁটাচলা করা যাবে। এতো এতো ব্যস্ততার মাঝে পরখের নিজেকে সমাজ বহির্ভূত একজন মনে হচ্ছে।
পাঞ্জাবি পায়জামা পরে হলরুমের সোফায় আরাম করে বসে আছেন ইবনূল ইবতেহাজ। পরখকে অস্থির পায়েচারি করতে দেখে হালকা হেসে বললেন,
‘এখানে আরাম করে বসো। ওদের তৈরি হতে আরও সময় লাগবে। একটা ঝুমকা পরবে৷ ভালো লাগছে না বলে, খুলে আরেকটা পরবে। সাজগোছ মনমতো হতে এখনও ঘন্টাখানেক বাকি।’
বেশ অস্বস্তি নিয়ে পরখ বাবার পাশে বসল। আজ ঠিক কতোদিন পর বাবা ছেলে এমন পাশাপাশি বসে আছে, সে হিসেব পরখের অজানা। তবে বাবার পাশে বসার পর ধীরে ধীরে অস্বস্তিবোধ কমতে শুরু করল। একটা সময় পরখ খেয়াল করল, বাবার পাশে বসে তার ভীষণ ভালো লাগছে৷ অস্থির মনের চঞ্চলতা ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে।
ইবনূল ইবতেহাজ পায়ের উপর পা তুলে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে মনের সুখে পা নাচাচ্ছেন। পরখ সেদিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোমার গোছগাছ শেষ?’
‘আমি বুড়ো মানুষ, আমার আর কীসের গোছগাছ। ওই দু চারটে ফতুয়া, প্যান্ট গুছিয়ে নিয়েছি।’
‘ঔষধ পত্র?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওগুলোও নিয়েছি৷ পুরো বক্সটাই ব্যাগে ভরে নিয়েছি।’
পরখ মাথা দুলিয়ে চুপ করে গেল। কিছু সময় পর পরখকে হুট করে উঠে দাঁড়ালো। ইবনূল ইবতেহাজ ভ্রুকুটি করে বললেন,
‘কোথায় চললে? ওদের এখনো তৈরি হওয়া শেষ হয়নি।’
পরখ জবাব না দিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল। পরখকের কক্ষে পর্তুলিকা, আদ্রিকা একই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছে। পরখ উঁকি দিয়ে দৃশ্য দেখে বাবা মায়ের কক্ষে ঢুকল।
আয়নার এককোণে পরখের প্রতিফলন চোখে পড়েছে আদ্রিকার। সে ঘাড় ফিরিয়ে দেখার আগেই পরখ দ্রুত চলে গিয়েছে। আদ্রিকা তার লম্বা চুলে বেণী গেঁথে আলতো পায়ে কক্ষ ত্যাগ করল।
পর্তুলিকার কক্ষের দরজায় উঁকি দিয়ে দেখল, ইবনূল ইবতেহাজ এর লাগেজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে পরখ৷ হাতে ঔষধের বক্স। আদ্রিকা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,
‘কী খুঁজছেন?’
পরখ চমকে পেছনে তাকাল। ঔষধের বক্সটি দ্রুত লাগেজে রেখে বাইরে বেরিয়ে এসে বলল,
‘কিছু না।’
আদ্রিকাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পরখ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে উচ্চস্বরে বলল,
‘তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেও। আমি একটু বাইরে থেকে আসছি।’
চুড়োখোঁপায় চুলকাটা আটকাতে আটকাতে কক্ষ থেকে বাইরে এসে পর্তুলিকা বলল,
‘আমাদের রেডি হওয়া শেষ। এইবেলায় তুই কোথায় চললি?’
‘এই তো সামনে।’
‘আমরা এখনি বের হবো।’
‘এক্ষুনি আসতেছি।’
উপরতলায় আদ্রিকা, নিচতলায় ইবনূল ইবতেহাজ অবুঝ দর্শকের মতো চেয়ে রইল।
পরখ ফিরে এসে দেখল ড্রাইভার বাড়ির ভেতর থেকে একটি একটি লাগেজ গাড়িতে তুলে দিচ্ছে। এই ফাঁকে সে ইবনূল ইবতেহাজের লাগেজ খুলে ঔষধের পাতাটি রেখে দিল৷
গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল আদ্রিকা। আড়াল থেকে উঁকি বলল,
‘বাবার প্রেশারের ঔষধ নাকি?’
পরখ তড়াক করে চমকে এক পা পিছিয়ে গেল। আদ্রিকাকে সে দেখতে পায়নি। লুকিয়ে ঔষধ রাখতে গিয়ে আদ্রিকা দেখে ফেলায় থমথমে মুখে ছোট্ট করে জবাব দিল,
‘হুম।’
ইবনূল ইবতেহাজের প্রেশারের ঔষধ শেষ হয়েছে, সেটা কেউ খেয়াল করেনি। ইবনূল ইবতেহাজ নিজেও তেমন একটা গায়ে মাখেননি। হেয়ালি করে ঔষধ ছাড়াই ঘুরতে যাচ্ছিলেন। বিষয়টি পরখ খেয়াল করেছে দেখে আদ্রিকার ভীষণ ভালো লাগলো।
গাড়ির সামনের আসন দুটোতে বসেছে ইবনূল ইবতেহাজ এবং পরখ। গ্রামের আঁকাবাকা মেঠো পথ ধরে পরখ ড্রাইভ করছে। মিউজিক সিস্টেমে ইবনূল ইবতেহাজের পছন্দের রবীন্দ্র সংগীত বাজছে। শিল্পীর সুরের সাথে গলা মিলিয়ে তিনি নিজেও উচ্চস্বরে গাইছেন।
পেছনে বসেছে আদ্রিকা ও পর্তুলিকা। আদ্রিকা এর আগে কখনো গ্রামের দিকে আসেনি। জানালার ধারে বসে মুগ্ধ চোখে গ্রামের সবুজ প্রকৃতি দেখছে।
পর্তুলিকাও অতিউৎসাহে গ্রামীণ পরিবেশের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে আদ্রিকাকে।
সবার প্রফুল্লচিত্তের মাঝে পরখ একমাত্র ব্যক্তি যে মুখ গোমড়া করে বসে আছে। এতো আহ্লাদ তার বিরক্ত ঠেকছে।
সেই একই নীল আকাশ, সবুজ গাছপালা, আঁকাবাকা নদী – এসব দেখে এতো হৈ-হুল্লোড় করার কী আছে? এগুলো আদিখ্যেতা নয়তো কি?
*****
আদিযুগের জমিদার বাড়ির মতোন দোতলা একটি ভবন। লালচে ইটগুলো এখনো ফোকলা দাতের হাসি হাসছে। ঝি চাকরদের নিরলস পরিশ্রমের ফলে আজও বাড়িটির যৌবনে ভাটা পড়েনি।
বাড়ির সদর দরজার সামনে লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন বৃদ্ধা। উনার নাম জয়নব। একদা সুবিশাল এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী জয়নবের কোমর কিছুটা হেলে পড়েছে৷ শরীরের চামড়া কুচকে শৈল্পিক এক সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে শরীরজুড়ে। সামনের চারটে দাঁত উঠে যাওয়ায় জয়নবের হাসিটাও এখন অদ্ভুত মায়াবী দেখায়৷ ফোকলা মুখের জয়নব আজকাল খুব কম হাসেন। সারাক্ষণ গম্ভীরমুখে বসে থাকেন বসার ঘরের চৌকিতে।
আজ নাতির আগমনের খুশিতে লাঠিতে ভর দিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন দুয়ারে।
পরখের গাড়িটা যখন বাড়ির কাছাকাছি আসলো, জয়নবের জহুরি চোখ তা দূর থেকেই দেখে ফেলেছিল। তিনি লাঠিতে আরেকটু ভর দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে ডাকলেন,
‘ওরা চলে এসেছে। কোথায় গেলি তোরা? শিগ্গির আয়। ও অধরা? কোথায় গেলি রে?’
দোতলার মস্ত বড় কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত পায়ে এক প্রকার ছুটে নেমে এলো অধরা। গায়ের লাল খয়েরি শাড়িটার আঁচল উড়িয়ে পাখির মতোন হাজির হলো জয়নবের সামনে। কানের দুলটা এক হাতে পরতে পরতে জিজ্ঞাসা করলো,
‘কোথায়? আমি তো দেখতে পাচ্ছি না।’
সামনের কয়েকগাছি চুল পেছনে টেনে ক্লিপ গুজে দিয়েছে অধরা। রেশমি চুলগুলো তখনো হাওয়ায় উড়ছে। চুলের নিচের অংশে আলতো ভাবে টান দিয়ে জয়নব বললেম,
‘এই বয়সে চোখের মাথা খেয়ে বসে আছিস, ছেমড়ি। আমার মতো বুড়ি হলে চোখে কিছুই দেখবি। ভালো করে তাকয়ে দেখ, ওইতো গাড়ি আসছে। মাইক্রোর হর্ণ শুনতে পাচ্ছিস না?’
আহ শব্দে আর্তনাদ করে জয়নবের হাত থেকে চুল ছাড়িয়ে নিল অধরা। মুখ গোমড়া করে বলল,
‘আমার চুলের সাথে তোমার কীসের শত্রুতা, বুড়ি? চুল ধরে টানো কেন? আমার লম্বা চুল দেখে হিংসা লাগে?’
‘তোর বয়সে এর থেকে দ্বিগুণ চুল ছিল আমার। তোর দাদাকে এই চুলেই বেঁধে রেখেছিলাম। আর তুই এখনো একটা ছেলে জুটাতে পারলি না। এমন সুন্দর চুল কোন কাজের! কলসিতে বেঁধে পুকুরে ডুবে মর।’
চুলে থু থু দিয়ে ভেংচি কাটল অধরা। মুখ মুচড়ে বলল,
‘আমার চুলে নজর দিবা না, বুড়ি। ছেলে জুটাতে পারিনি কে বলল? আমি অধরা চাইলে ঠিকই জুটে যেত। কিন্তু তুমি আমাকে তোমার নাতির লোভ দেখায় এতোদিন ঝুলায় রাখছ। এখন তোমার নাতি বিয়ে করে নিয়েছে দেখে আমি অধরা ফেলনা হয়ে গেলাম, নাহ?’
অধরার কথায় জয়নব আদ্র চোখে তাকালেন। চামড়া কুচকানো শীর্ণ হাতটি বাড়িয়ে অধরার মলিন গাল ছুঁয়ে বললেন,
‘তুই ফেলনা হবি কেন? তুই তো আমার রাজকন্যা। আমার দাদু ভাইয়ের কপাল খারাপ বলে তোর মতো রাজকন্যাকে ঘরে তুলতে পারল না। তুই মন খারাপ করিস নাই বইন। তোরে আমি অনেক ভালো ঘরে বিয়ে দিব। রাজকন্যার জন্য রাজপুত্র এনে দিব।’
‘রাজপুত্র আমার চাই না, বুড়ি। আমি তোমার নাতির স্বপ্ন দেখেছিলাম। এখন সেই চোখে অন্য কাউকে নিয়ে কী করে ঘর বাঁধি?’
জয়নব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘পারবি, পারবি। তোর মনের মতো কাউকে খুঁজে দিব।’
‘সে একজনই ছিল, যাকে আমি বাঁধতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অন্য কেউ বেঁধে নিল।’
‘আসতে দে তাকে। দেখি কোন রূপের জোরে বাঁধলো আমার দাদু ভাইকে।’
‘অতিথি আসা মাত্র ঝগড়া ঁবাধিয়ে দিও না যেনো। কতোদিন পর ওরা আসছে!’
জয়নব কিছু বলার আগেই শুষ্ক ভূমির ধুলো উড়িয়ে গাড়িটা এসে থামল উঠোনে। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন ইবনূল ইবতেহাজ। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে জয়নবের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে, মাকে বুকে জড়ালেন।
পর্তুলিকাকে দেখে অধরা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘কাকিমা, আমাকে চিনতে পেরেছো?’
পর্তুলিকা মিষ্টি হেসে অধরার সারা মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
‘চিনবো না আবার! মাশাআল্লাহ। আমাদের ছোট অধরা কতো বড় হয়ে গিয়েছে!’
উষ্ণ অভ্যর্থনার বিপরীতে অপ্রস্তুত আদ্রিকা গাড়ির একপাশে দাঁড়িয়ে পূর্ণ মিলনী দেখছে। ওরা সবাই নিজেদের মাঝে এতোটাই ব্যস্ত যে কেউ আদ্রিকার দিকে খেয়াল করছে না। নতুন পরিবেশ, অচেনা মুখগুলোর সামনে আদ্রিকা নিজেও বেশ বিব্রত।
গাড়ি একপাশে পার্ক করে রেখে পরখ ছুটে গেল জয়নবের কাছে। দাদীর কপালে চুমু খেয়ে বলল,
‘আমার ডার্লিং কেমন আছে?’
হাতের লাঠি তুলে পরখের পায়ে আলতো হাতে আঘাত করে জয়নব ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলল,
‘রাগ তোর ডার্লিং। এতোদিনে ডার্লিংয়ের খোঁজ নেওয়ার সময় হলো?’
‘তোমাকে কতো করে বললাম, আমাদের বাড়িতে চলে এসো। তুমিই তো যাও না।’
‘তোদের ওই শহুরে পরিবেশে আমার মন টিকে না। আমি মাটির মানুষ। মাটির কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করি।’
‘একেবারে না গেলে, কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে তো যেতে পারো।’
‘আমি বুড়ো মানুষ। এই বয়সে গাড়িতে চড়ে হাড়গোড় ভাঙ্গার ইচ্ছে নাই। তোরা জোয়ান ছেলেপুলে, তোরা আসতে পারিস না বুড়িটাকে দেখতে?’
‘আসতে তো চাই। কিন্তু এতো ব্যস্ত থাকি যে সময় মিলে না।’
‘সবই তোদের বাহানা। তোর মা আগে তবুও প্রতিদিন কল দিয়ে খোঁজ খবর নিতো। এখন সপ্তাহে একদিনও খোঁজ নেওয়ার সময় পায় না। বুড়ির প্রতি সবাই বিরক্ত। বেঁচে থাকার বেশিদিন হয়ে গেছে বুঝলি দাদু ভাই। সবাই এখন বিদায় দিতে পারলে বেঁচে যায়।’
পর্তুলিকা এগিয়ে এসে জয়নবের হাত ধরে বললেন,
‘আমি দু তিন পর পর উর্মিকে কল দেই, আম্মা। আপনি বেশিভাগ সময় ঘুমিয়ে থাকেন বলে, আপনার সাথে কথা হয় না।’
জয়নব হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মুখখানা আরও গোমড়া করে বললেন,
‘বেছেবেছে আমার ঘুমের সময় কল দেও। তোমার বাহানা আমি ভালোই বুঝি, বড় বউ। বিয়ের পর আমার ছেলেটারে তুমি টান দিয়া শহরে নিয়া গেলা। নাতিটারে আমার কাছে রাখতে চাইছিলাম৷ সেটাও তুমি রাখতে দিলা না। অধরার সাথে আমি পরখের বিয়ে ঠিক করে রাখছিলাম, তুমি জানতা না? অথচ তুমি সবার থেকে লুকায় পরখের বিয়ে দিয়ে দিলা। তোমার পেটে পেটে শয়তানি৷’
ইবনূল ইবতেহাজ বিরস মুখে এগিয়ে এসে মাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব কী কথা শুরু করলা, আম্মা! পরখের বিয়ে আমি দিছি। তখন ঘটা করে আয়োজনের সময় ছিল না। মসজিদে গিয়ে ছোট করে বিয়ে পড়ানো হইছে৷ বিয়ের পরে আমি নিজে তোমাকে কল দিয়ে জানাইলাম।’
হাতের লাঠি দিয়ে ইবনূল ইবতেহাজের হাতে কড়াঘাত করে জয়নব ধমকে উঠলেন।
‘তুই চুপ থাক নালায়েক। বিয়ে করে সেই যে বউয়ের আঁচল ধরে ঘুরা শুরু করছিস। তোর থেকে আমি কিছু আশা করি না। আমার ইসহাকটাকে দেখ। কী সুন্দর বউকে নিজের হাতের মুঠোয় রাখছে৷ আর তুই! সারাক্ষণ বউয়ের আগে পিছে ছাগলের মতো ম্যা ম্যা করতে থাকিস।’
পরখ দাদীকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ডার্লিং, তুমি এতো হাইপার হচ্ছো কেনো? এতোটা উত্তেজিত হওয়া তোমার জন্য ভালো না।’
‘এরা আমাকে না জানায় তোর বিয়ে দিয়ে দিল! আমি রাগ করবো না?’
‘এই কথা! আমি বিয়ে করেছি বলে তোমার মন খারাপ হয়েছে? কোনো ব্যাপার না। তুমি বললে আমি এখনি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি আছি। তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা। তোমাকে কী করে হেলাফেলা করি! তুমি একদম রাগ করবে না। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।’
‘তবে রে বাদর ছেলে, আমাকে লাইন মারা হচ্ছে! এই বুড়ির আর বয়স নেই বলে ঠাট্টা মারছিস। সবই আমি বুঝি। আমার এতো সুন্দর নাতনিকে রেখে কোন বাদরমুখীকে বিয়ে করেছিস দেখি।’
অস্বস্তি ও লজ্জায় আরক্ত হলো পরখের মুখ৷ জয়নবের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অধরার দিকে তাকিয়ে লজ্জিত মুখে বলল,
‘কী যে বলো না তুমি! অধরা আমার ছোট বোন। ওর সাথে আমার বিয়ে কী করে হয়!’
অধরার ভঙ্গুর হৃদয় পরখের সহজ সরল স্বীকারোক্তিতে আরও ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। অন্তরের ব্যথা অন্তরে লুকিয়ে রেখে মুখে সতেজ হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘দাদীর কাজ নাই, সারাদিন উল্টোপাল্টা কথা বলতে থাকে। তুমি ওসবে কান দিয়ো না, ভাইয়া।’
জয়নব কনুই দিয়ে অধরার পেটে গুতো দিয়ে বলল,
‘কীসের উল্টাপাল্টা কথা! তোর জন্মের সময় আমি কইয়া দিছিলাম, এই লাল টুকটুকে পরীটা হইব আমার দাদু ভাইয়ের বউ। এই বাড়ির সক্কলে সেই কথা জানে। তার পরেও ইবনূলের বউ চক্রান্ত কইরা এই কাজ করছে। আমার স্বপ্ন ভাঙছে সে।’
‘তুমি থামো তো বুড়ি। ওরা কতোটা পথ জার্নি করে এসেছে! ভেতরে এসে একটু জিরিয়ে নিতে নেও।’
জয়নব কিছু বলার আগেই পর্তুলিকার দিকে তাকিয়ে অধরা বলল,
‘ভেতরে এসো না কাকীমা। তুমি আবার মেহমানের মতো বাইরে দাঁড়িয়ে রইলে কেনো?’
অধরার হাত ধরে ভেতরে পা রাখল পর্তুলিকা। মায়ের সাথে পরখ বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। সবাই যেনো একঝটকায় আদ্রিকাকে দৃশ্যপট থেকে বের করে দিয়েছে।
আদ্রিকা কী করবে বুঝতে পারছে না। সেও কি ভেতরে প্রবেশ করবে? এভাবে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? কেউ তো ওকে ডাকলো না। ভেতরে যেতেও বলল না।
পরখের কথা তো আগেই বাদ। এতো গোলযোগের মধ্যে বেচারি পর্তুলিকাও বোধহয় খেই হারিয়ে ফেলেছে। শাশুড়ীর রোষানলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে মাথা এলোমেলো হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক।
বাড়ির ভেতরে চাকরদের ডাকতে গিয়েছিলেন ইবনূল। গাড়ির লাগেজগুলো নামাতে হবে। একজন চাকরকে লাগেজ দেখিয়ে দিতে এসে আদ্রিকাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে বললেন,
‘একি! তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ওরা সবাই ভেতরে চলে গিয়েছে। তুমিও যাও।’
বুকভরা শূন্যতা, দু চোখভরা অশ্রু আড়াল করে আদ্রিকা খানিকটা হাসার চেষ্টা করল। বলল,
‘আপনার সাথে যাই।’
অচেনা বাড়ির উঠোনে যতোটা উৎসাহ, উত্তেজনা নিয়ে পা রেখেছিল আদ্রিকা, তার সিকিভাগও অবশিষ্ট নেই। পরিবারের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের থেকেও বেশি পীড়া দিচ্ছে চাঁদের মতো স্নিগ্ধ, সুন্দর একটি মেয়ের মুখশ্রী৷ তার কাজলকালো চোখের আড়ালে আদ্রিকা দুঃখের সাগর দেখেছে। এক আকাশ হতাশা দেখেছে। সীমাহীন ভালোবাসা দেখেছে।
সেসব কোনো চিন্তার বিষয় নয়। যুবতী নারীর সারা অঙ্গ অনুভূতির জোয়ার থাকে। অধরাও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়।
আদ্রিকার ভয় অন্য জায়গায়। অধরার সমস্ত অনুভূতি যাকে ঘিরে সেই ব্যক্তিটি আদ্রিকার দূর্বলতার একমাত্র কারণ।
দুরুদুরু বুকে অস্বস্তি, ভয়, হতাশা, অভিমানের সংমিলিত অনুভূতি নিয়ে পরখের দাদু বাড়িতে প্রবেশ করলো আদ্রিকা।
চলবে..
#অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৬১|
সদর দরজা পেরিয়ে মস্ত বড় উঠোন। উঠোন পেরিয়ে টানা বারান্দা। সেখানেই খাট পেতে রাখা আছে। ওখানে বসে বাড়ির চারদিকে নজর রাখেন জয়নব। কে কী করছে, আশেপাশে কী ঘটছে সবকিছু থাকে উনার নখদর্পণে।
সবাই মিলে গুটিগুটি পায়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। জয়নবের একহাত ধরে উঠোন পেরোনোর সময় আশেপাশে তাকিয়ে আদ্রিকাকে খুঁজে পেল না পরখ। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়েও যখন আদ্রিকাকে দেখতে পেল না, তখন কপালে ভেসে উঠল সমান্তরাল ভাঁজ। জয়নবকে বারান্দার খাটে বসিয়ে পরখ দ্রুত পায়ে উঠোন পেরিয়ে বাইরে যেতেই আদ্রিকার সাথে দেখা হলো। ধমকে উঠল পরখ,
“কোথায় গিয়েছিলে?”
আদ্রিকা কিছু বলার আগেই পেছন থেকে ইবনূল ইবতেহাজ বললেন,
“বাইরে দাঁড়িয়েছিল। তোমরা বিবেকহীনের মতো ওকে একা রেখে সবাই বাড়ির ভেতর চলে গেলে কীভাবে?”
ইবনূল ইবতেহাজের কথা শুনে আদ্রিকার শুকনো মুখ নজরে এলো পরখের। নতমুখে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করল,
“দাদী হঠাৎ এমন ছেলেমানুষি শুরু করল! উনাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।”
“তাই বলে মেয়েটাকে ওভাবে একা ছেড়ে দিবে! ও এখানে কিছু চিনে? পিউটাও ওর কথা ভুলে বসে আছে! ওকে নিয়ে ভেতরে যাও।”
লাগেজসহ ইবনূল ইবহেতাজ ভেতরে চলে গেলে পরখ আদ্রিকার বাম হাতটি আলতো করে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করলো,
“ভয় পেয়েছো?”
আদ্রিকা বুক ভরে দীর্ঘশ্বাস টেনে ম্লান হেসে দুপাশে মাথা নাড়ল। পরখ বলল,
“দাদী বৃদ্ধ মানুষ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে একটু খিটমিটে হয়ে গেছেন। এমনিতে অনেক মজার মানুষ। কথা বললে বুঝতে পারবে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এসো।”
পরখের হাত ধরে উঠোনে পা রাখল আদ্রিকা। বারান্দার কাছাকাছি যেতেই লক্ষ্য করলো কতোগুলো উৎসুক দৃষ্টি তারদিকে চেয়ে আছে। পর্তুলিকা হাত বাড়িয়ে আদ্রিকাকে কাছে টেনে বলল,
“আদ্রিকা, উনি তোমার দাদী শাশুড়ি। সালাম দেও।”
সালাম কীভাবে দিবে আদ্রিকা? ভয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। জয়নবের কুঁচকানো চামড়ার আড়ালে এখনো ফর্সা ত্বকের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। শুষ্ক চোখজোড়ার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আদ্রিকার দিকে। পর্তুলিকার হাত চেপে ধরে আদ্রিকা মাথা তুলে জয়নবের দিকে একনজর চেয়ে আবারও মাথা নিচু করে ফেলল।
এমন থমথমে পরিস্থিতি দেখে অধরা ধপ করে জয়নবের পাশে বসে অসন্তুষ্ট স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল,
“এই বুড়ি, তুমি ওর দিকে এভাবে তাকাচ্ছো কেনো? মেয়েটা ভয় পাচ্ছে।”
জয়নব চোখ রাঙিয়ে বলল,
“ভয় পাওয়াই উচিত। শাশুড়িকে ভয় পাবে না তো কি মাথায় চড়ে বসে থাকবে?”
“ইশ! তুমি ওর শাশুড়ি নাকি! তুমি হলে দাদী শাশুড়ি। নাত বউয়ের সাথে তোমার গলায় গলায় ভাব থাকবে।”
“নাত বউ আগে পছন্দ হোক। আমার পছন্দকে পায়ে মাড়িয়ে দেখি কেমন বউ বসিয়ে বড় বউ! আদব কায়দার বালাই নাই। মাথায় ঘোমটা নাই, বড়দের সালাম দেওয়ার শিক্ষাদীক্ষা নাই।”
কথাগুলো একটু জোরেই বললেন জয়নব। পর্তুলিকা আদ্রিকার হাতে একটু চাপ দিয়ে সালাম দেওয়ার তাড়া দিলেন। কিন্তু একের পর এক আক্রমণে ভড়কে গেছে আদ্রিকা। সে মুখ তুলে দিশাহীন চেয়ে রইলো পর্তুলিকার মুখপানে।
অধরা উঠে এসে আদ্রিকার অপরপাশে দাঁড়িয়ে আদ্রিকার কাঁধে জড়িয়ে ধরে বলল,
“এই বুড়িকে লম্বা করে একটা সালাম দিয়ে দেও তো আদ্রিকা। সালামের জন্য একেবারে আধমরা হয়ে যাচ্ছে।”
পর্তুলিকার হাতটি শক্ত করে চেপে ধরে আদ্রিকা কাঁপাকাঁপা গলায় সালাম দিল। জয়নবের মনঃপুত হলো কিনা বুঝা গেল না। তিনি গলার স্বর আরও গম্ভীর করে আদেশ করলেন,
“নাত বউয়ের মুখটা তুলো দেখি বড় বউ।”
পর্তুলিকা আড়ালে হেসে আদ্রিকার থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটি উঁচু করে ধরলেন। এমন হেনস্থার স্বীকার হয়ে আদ্রিকা ঠোঁট উল্টে পর্তুলিকার দিকে তাকাল। পর্তুলিকা আর হাসি আটকাতে না পেরে হেসে ফেললেন। জয়নবকে বললেন,
“আর ভয় দেখাবেন না আম্মা। এবার তো কেঁদেই ফেলবে।”
জয়নব সে কথা শুনলেন না। নিজের পাশের স্থানটি দেখিয়ে বললেন,
“মুখের গড়ন তো ঠিকঠাকই লাগে। এখানে এসে বসো, নাত বউ। কাছ থেকে দেখি।”
আদ্রিকা ভয়ে আরেকটু গুটিয়ে গিয়ে পর্তুলিকার গা ঘেঁষে দাঁড়াল। যে মানুষ পর্তুলিকার মতো মিষ্টি মানুষকে ধমকি-ধামকির উপর রাখে তার কাছে আদ্রিকা নস্যি মাত্র। না জানি কখন আদ্রিকাকেও ধমক দিয়ে বসে!
অধরা আদ্রিকার হাত ধরে টেনে নিয়ে জোর করে জয়নবের পাশে বসিয়ে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার যতো ঢং, বুড়ি। চোখে কি ছানি পড়েছে? কাছ থেকে দেখতে হবে। নেও, ভালো করে দেখো।”
জয়নব তার চামড়া কুঁচকানো হাতটি উঠিয়ে আদ্রিকার গালে রাখলেন। জহুরী চোখে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে একসময় স্বাভাবিক হয়ে এলো দৃষ্টি। আদ্রিকার নাকের নোলক ছুঁয়ে বললেন,
“নোলক পরে দেখছি! কে গড়িয়ে দিয়েছে?”
বৃদ্ধার উষ্ণ হাতের ছোয়ায় ততক্ষণে কমে এসেছে আদ্রিকার অস্বস্তি। নিচু স্বরে উত্তর দিল,
“আমার দাদীর।”
জয়নব খুশি হলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“সম্মানবোধ আছে দেখছি। ভালো, ভালো। বুড়া মানুষ শখ করে দিয়ে গেছে ফেলায় না রেখে গায়ে পরা ভালো। সবসময় দোয়া সাথে থাকে। আমি এই ছেমড়িরে একজোড়া নুপুর দিছিলাম। কোন বাক্সে ফালায় রাখছে কে জানে!”
অধরা মুখ ফুলিয়ে জয়নবের দিকে তাকিয়ে নিজের পা জোড়া এগিয়ে দিয়ে বলল,
“মিছা কথা কও ক্যান? এই দেখো এখনো পরে আছি।”
অধরার ফর্সা পায়ে নুপুর জোড়া দেখে জয়নবের চোখ দুটো খুশিতে চিকচিক করে উঠল। সামান্য হাসিও ফুটে উঠল মুখে।
সে হাসি দেখে আদ্রিকার মনে হলো, দাদী বেঁচে থাকলে তার নাকে নোলক দেখে নিশ্চয়ই এমনি খুশি হতেন।
“যা, ঘর থেকে আমার গয়নার বাক্সটা দৌড় মেরে নিয়ে আয় তো।”
জয়নবের আদেশে শাড়ির কুচি তুলে ছুট লাগালো অধরা। বারান্দার শেষের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গিয়ে কিছুক্ষণ পরেই কাঠের বাক্স নিয়ে ফিরে এলো। সেখান থেকে একজোড়া নুপুর বের করে আদ্রিকার হাতে তুলে দিয়ে জয়নব বললেন,
“নুপুরের অনেক শখ ছিল আমার। তোমার দাদা শ্বশুরও দিলখোলা মানুষ ছিলেন। প্রতি বছর ফসল তুলে আমার জন্য একজোড়া করে নুপুর বানিয়ে আনতেন। এখন আর এগুলা পরার বয়স নাই। তোমরা ছেলেমানুষ, পরে বেড়াও। দেখতেও ভালো লাগে।”
আদ্রিকা মাথা তুলে পর্তুলিকার দিকে তাকালে পর্তুলিকা চোখের ইশারায় নিতে বললেন। আদ্রিকা হাত পেতে নুপুর জোড়া নিলো। পুরনো নকশায় তৈরি রূপার গয়নায় হাত বুলিয়ে মুগ্ধ সুরে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল,
“নুপুর জোড়া অনেক সুন্দর।”
জয়নব হেসে হাঁক ছাড়লেন,
“পরখ কই গেলি রে?”
সাথে নিয়ে আসা খাবারের বক্স পৌঁছে দিতে পরখ গিয়েছিল রান্নাঘরে। জয়নবের ডাকে পরখের সাথে উর্মিও ছুটে এসে দাঁড়াল বারান্দায়। পরখ বলল,
“কী হয়েছে?”
জয়নব নূপুর জোড়া পরখের হাতে দিয়ে বললেন,
“নাত বউরে পরায় দে।”
এমন আদেশে পরখ চোখ বড় করে তাকিয়ে রইল। আদ্রিকাও বেশ হকচকিয়ে গেছে। ওদের এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে জয়নব ধমকে উঠল।
“ওমন করে তাকায় আছিস? গয়না পছন্দ হয় নাই? তোর বউরে পুরাতন গয়না দিছি বলে রাগ করছিস? বউকে পুরাতন গয়না পরানো যাবে না? মান সম্মানে লাগবে?”
“কী যে বলো না তুমি! যত বয়স বাড়ছে ,ততই তোমার নাটুকেপনা বাড়ছে। ”
পরখ বারান্দায় হাঁটু মুড়ে বসে আদ্রিকা পা টেনে হাঁটুর উপর রেখে নূপুর পরিয়ে দিয়ে চটপট উঠে দাঁড়াল। ঘটনাটি এতো দ্রুত ঘটল যে আদ্রিকা প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ পেল না। শুধু নিজের পায়ে পরখের হাতের ছোঁয়ায় সারা গাঁ কেঁপে উঠেছিল এতোটুকুই মনে আছে। ঘোর কেটে উঠতে না উঠতেই শুনল, জয়নব পরখের চাচীকে আদেশ করছে,
“ওদের ঘর দেখায় দেও, ছোট বউ। অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আসছে। হাত মুখ ধুয়ে খানিকটা আরাম করে নিক।”
গ্রাম বাংলার খুব সাধারণ রমণী উর্মি। শাশুড়ির আদেশে মাথা দুলিয়ে সায় জানিয়ে মাথার ঘোমটা আরেকটু টেনে নিচু স্বরে বললেন,
“আসোন ভাবি। আপনাদের ঘর উপরতলায়।”
আদ্রিকাকে নিয়ে পর্তুলিকা উপরতলায় চলে গেলে অধরা বাহু দিয়ে জয়নবের বাহুতে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,
“এসব কী ছিল, বুড়ি? হঠাৎ এমন রিনা খানের মতো আচরণ শুরু করলা কেন?”
জয়নব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
“রিনা খান আবার কেডা?”
“ওই যে ডাইনীটা। বাংলা সিনেমা কূটনি শাশুড়ির অভিনয় করে।”
জয়নব চোখ রাঙিয়ে হাত উঁচু করে বলল,
“থাপ্পড় খাবি, ছেমড়ি। আমারে তোর কূটনি শাশুড়ী মনে হয়?”
“মনে হওয়ার কী আছে? তুমি তো কূটনি বুড়ি-ই। কাকিমাকে কতোগুলা কথা শুনায় দিলা!”
“কথা শুনাবো না? আমারে না জানায় আমার নাতির বিয়া দিয়া দিছে। আমার পোলাটারেও বাঁইধা রাখছে। আমার কাছে আইতে দেয় না।”
“বাজে বকবা না তো। কাকা কতো ব্যস্ত থাকেন। উনার সময় আছে? তবুও প্রতিমাসে একবার এসে তোমার খোঁজ খবর নিয়ে যায় না? পরখ ভাইয়ার বিয়ের পরের দিনও তো কল দিয়ে বলল। তবুও তুমি ইচ্ছে করে আজকে এই নাটকটা করলা। নতুন বউটারে পর্যন্ত ভয় পাওয়ায় দিছো।”
জয়নব অধরার গালে হাতে রেখে মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বললেন,
“সত্যি কইরা ক দেহি ছেমড়ি, পরখের বিয়ার কথা শুইনা তুই কষ্ট পাস নাই? ওর বউ দেখে তোর বুক পুড়তাছে না?”
অধরা থমথমে মুখে জয়নবের দিকে তাকিয়ে রইল। ধীরে ধীরে জল ভরে আসতে লাগল চোখের কোলে। গড়িয়ে পরার আগে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল অধরা। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল,
“যা কপালে নাই, তা নিয়ে আফসোস করে কী লাভ? ভাইয়া ভালো আছে, সুখে আছে। এটাই মূলকথা।”
“আর তোর কষ্ট?”
“আমার কীসের কষ্ট? তুমি আছো না? রাজকুমার আইনা দিবা। বিয়েশাদী কইরা আমিও সুখে সংসার করমু।”
জয়নবের দিকে তাকিয়ে বিস্তৃত হাসলো অধরা। এই চমৎকার মনের মেয়েটি এতো দ্রুত নিজের দুঃখ, কষ্ট লুকিয়ে ফেলে রোদের মতো হাসতে পারে দেখে জয়নব অবাক হন। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে জয়নব দোয়া করেন, মেয়েটি যেনো সুখে থাকে। জগতের সমস্ত সুখ যেন তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে।
*****
দক্ষিণের খোলা জানালা দিয়ে ফুরফুর করে হাওয়া বইছে। তাল মিলিয়ে নৃত্য করছে জানালার সাদা পর্দা। জানালা দিয়ে অনতিদূরের বিশাল পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছে আদ্রিকা। দরজায় ঠকঠক শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখল, অধরা দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। এই মেয়েটির সাথে পরখের বিয়ের আলোচনার কিছু কথা আদ্রিকার কানে এসেছে। নিচতলায় ভরা মজলিশে জয়নব নিজেই জাহির করেছেন সেই সংবাদ। আদ্রিকা ভালোভাবে তাকিয়ে দেখতে থাকল মেয়েটিকে।
অধরার পরণে সবুজ রঙা একটি তাঁতের শাড়ি। চুলগুলো হাত খোঁপা করা। কানে একজোড়া ছোট ঝুমকা। এইটুকু সাজে তাকে প্রতিমার মতোন সুন্দর, স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই আদ্রিকার বড্ড হিংসে হলো। পুড়তে লাগল বুকের ভেতরটা। মেয়েটি শাড়ি পরে এভাবে সেজেগুজে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেনো? পরখ আসবে বলেই কি এমন সাজসজ্জা? শক্ত হয়ে এলো আদ্রিকার চোয়াল। গম্ভীর মুখে সে অধরার দিকে নিশ্চুপ চেয়ে রইল। দরজায় দন্ডায়মান ব্যক্তিটিকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি প্রদানের ভদ্রতাবোধটুকুও সে ভুলে গেল।
দু হাতে দুটো লাগেজ নিয়ে বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসছিল পরখ। দরজার সামনে অধরা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পরখ বলল,
“এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন, অধরা?”
অধরা ঘাড় ফিরিয়ে পরখকে দেখে দরজা ছেড়ে একপাশে দাঁড়াল। লাগেজ দুটো নিয়ে কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে আদ্রিকাকে দেখতে পেল পরখ। এখানে কী ঘটছে আন্দাজ করতে না পেরে ফের অধরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দাঁড়িয়ে রইলে কেনো? ভেতরে এসো।”
আদ্রিকার থমথমে মুখ লক্ষ্য করেছিল অধরা। পরখ এসে না পড়লে অধরা হয়তো দরজা থেকেই ফিরে যেত। কিন্তু এই মুহূর্তে পরখের ডাক অবহেলা করা সম্ভব হলো না। তীব্র অস্বস্তি নিয়ে অধরা কক্ষে পা রাখল। সামান্য হাসার চেষ্টা করে বলল,
“তোমরা ফ্রেশ হয়েছো কিনা দেখতে এলাম। মা খেতে ডাকছে।”
“লাগেজ আনপ্যাক করে তারপর ফ্রেশ হবো। তুমি আদ্রিকাকে নিয়ে যাও। ওখানের কিছু চিনে না।ওয়াশরুম দেখিয়ে দিও।”
পরখের কথা শুনে অধরা-আদ্রিকা দুজন দুজনার দিকে তাকালো। একে অপরকে এড়িয়ে চলতে পারলে বোধহয় ভালো হতো। আদ্রিকার মনের অবস্থা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে অধরা। অন্যদিকে নিজের মনের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই আদ্রিকার। অকারণ এই মেয়েটিকে আদ্রিকার অসহ্য লাগছে। ওর মিষ্টি হাসিতেও বিদ্রুপের ছায়া দেখতে পাচ্ছে আদ্রিকা।
“কী হলো যাও।”
পরখের ডাকে আদ্রিকার ধ্যান ভাঙ্গল। মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে কক্ষ ত্যাগ করলো আদ্রিকা।
পথ না চিনলেও দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করল। নীরবে পেছনে হাঁটছে অধরা। আদ্রিকা সিঁড়ির শেষধাপে পৌঁছে দিশেহারা বোধ করলো। নিচে তো চলে এলো। এরপর কোনদিকে যাবে?
পেছন থেকে ভেসে এলো অধরার কণ্ঠস্বর।
“বামদিকে।”
অপেক্ষা করলো না আদ্রিকা। দিকনির্দেশনা অনুযায়ী বামদিকে এগিয়ে গেলে টিনের তৈরি দরজা দেখতে পেল। দরজায় ধাক্কা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দেখল ওয়াশরুম ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা থাকলেও সেখানে শাওয়ার কিংবা ট্যাপের ব্যবস্থা নেই। বরং শ্যাওলা পরা একটি টিউবওয়েল দেখা যাচ্ছে। অধরা ভেতরে প্রবেশ করে দেখল আদ্রিকা একপাশে দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত চোখে টিউবওয়েলের দিকে তাকিয়ে আছে। সে এগিয়ে এসে মিষ্টি হেসে বলল,
“তুমি ওপাশে গিয়ে দাঁড়াও। আমি পানি তুলে দিচ্ছি।”
আদ্রিকা অবাক চোখে কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে অপরপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। হাতলে চাপ দিতেই কলকল করে জল বের হতে লাগল। টিউবওয়েলের শীতল জল দুহাতের আঁজলায় ভরে মুখে ছুড়ে দিতেই শীতল অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো সারা দেহে।
অধরা টিউবওয়েলের হাতলে দু হাতে সজোরে চাপ দিতে দিতে বলল,
“দাদীর কথায় তুমি কিছু মনে করো না। উনি আগের যুগের মানুষ। মনে যা আসে বলে দেয়। আগেপিছে কিছু ভাবেনা।”
আঙ্গুল দিয়ে মুখের জল মুছে ফেলে আদ্রিকা মিনমিন করে বলল,
“আমি কিছু মনে করিনি।”
“ভয় পেয়েছো নিশ্চয়ই।”
আদ্রিকা মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল অধরা হাসছে। সায় জাগানো সে হাসি দেখে আদ্রিকা মনের কথা বলেই ফেলল।
“খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।”
“দাদী এমনিতেই তেমন রাগী নয়। আজকে তোমাকে ভড়কে দিতে এমন রাগ দেখিয়েছেন।”
“ভড়কে দিতে?”
“তুমি নতুন বউ। তোমার খানিকটা বাজিয়ে নিল। দাদীর কথা অনুযায়ী, নতুন বউকে শুরুতে একটু টাইট দিয়ে রাখতে হয়। টাইট দেওয়া বুঝো তো?”
আদ্রিকা সরলমনে দু দিকে মাথা দুলালো। অধরা বলল,
“একটু শাসনের মধ্যে রাখা। ধমকিধামকি দেওয়া আরকি। যাতে মনে একটা ভীতির সৃষ্টি হয়।”
“আরও ভয় দেখাবে?”
“নাহ। তোমাকে দাদীর পছন্দ হয়ে গিয়েছে। এখন অনেক আদর করবে।”
“তোমাকে যেমন করে?”
অধরা হো হো করে মনপ্রাণ খুলে হাসল। বলল,
“ছোটবেলা থেকে দাদীর সাথে বড় হয়েছি বলে উনি আমাকে অনেক স্নেহ করেন। আমরা দাদী নাতনি কম, সই বেশি। একে অপরের সুখ দুঃখের সাথী। তুমি কয়েকদিন থাকো, তোমার সাথেও ভাব হয়ে যাবে।”
“আমি বেশিদিন থাকতে পারবো না। আমার পরীক্ষা আছে।”
“কীসের পরীক্ষা?”
“এইচএসসি।”
“আরেহ! তুমি তো অনেক ছোট।”
“আপনি কীসে পড়েন?”
“থার্ড ইয়ারে পড়ি।”
“ওহ। অনেক বড়।”
“ওতোটাও বড় না। একেবারে বুড়ি বানিয়ে দিচ্ছো যে।”
অধরার দুষ্টুমাখা হাসি দেখে আদ্রিকাও লজ্জামিশ্রিত হাসি হাসল।
আরও কিছুক্ষণ হাত, পায়ে জমে থাকা ধুলো টিউবওয়েলের স্বচ্ছ, পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে ফেলার সাথে সাথে আদ্রিকা ধুয়ে ফেলল নিজের মনের সমস্ত কালিমা।
রান্নাঘরের মেঝেতে শীতলপাটি বিছিয়ে খেতে বসার সময় অধরা আদ্রিকার পাশেই বসল। ওরা অনেক অনেক কথা বলল, অহেতুক বিষয়বস্তু নিয়ে গল্প করল।
সারা বিকেল আড্ডা দেওয়ার পর আদ্রিকার মনে হলো টিউবওয়েল পাড়ে অধরার সাথে কাটানো একান্ত সময়টুকু ভীষণ দরকার ছিল। আদ্রিকা যদি নিজের মনের তিক্ততা পুষে রেখে অধরাকে এড়িয়ে চলত তবে মনের ভ্রম কখনোই ভাঙ্গত না। অধরা নামে চমৎকার মেয়েটির সাথে তার কখনো ভাব হতো না। সম্পূর্ণ না জেনে কারো ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করা উচিত নয়। কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে ব্যক্তিটিকে পুরোটা জেনে নিতে হয়, পড়ে নিতে হয়।
রাতে ঘুমাতে গিয়ে বাঁধল আরেক বিড়ম্বনা। বিষয়টি পরখের জন্য বিড়ম্বনার হলেও আদ্রিকার জন্য বেশ উল্লাসের।
দক্ষিণের সেই বড় কক্ষটিতে আদ্রিকা ও পরখকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। অতিথিশালায় নিশ্চয়ই বলা যায় না, আমরা স্বামী-স্ত্রী হলেও আমাদের শয়নকক্ষ আলাদা। আমাদের দুটো কক্ষ প্রদান করা হোক।এমন পরিস্থিতিতে পরখ এবার কী করবে?
রাতে খাসির গোশত দিয়ে ভাত খাওয়ার পর অধরার বুদ্ধি শুনে জয়নবের পানের বাটি থেকে পান-সুপারি খেয়েছে আদ্রিকা। চুন সমেত পান খেয়ে পুরো মুখ টুকটুকে লাল করে ফেলেছে। কক্ষে প্রবেশ করে বিছানায় শায়িত পরখের চুপসানো মুখটি দেখে আদ্রিকা মুখ চিপে হাসল।
একপাশের ফাঁকা স্থানে আরাম করে বসে চুলে বেনুনি গাঁথতে গাঁথতে আদ্রিকা বলল,
“আজকে আপনি আমার সাথে শুবেন নাকি?”
কথায় আছে হাতি গর্তে পড়লে মশাও লাথি মারে। সেই দশা হয়েছে পরখের। আদ্রিকা যে তার শোচনীয় অবস্থা দেখে তিরষ্কার করছে তা বুঝতে পেরে চোখ রাঙিয়ে আদ্রিকার দিকে তাকাল। তা দেখে ফিক করে হেসে ফেলল আদ্রিকা।
ওর লাল টুকটুকে ঠোঁট জোড়া দেখে পরখ ভ্রু কুঁচকে সরু চোখে চেয়ে বলল,
“পান খেয়েছো তুমি?”
দু হাতে ঠোঁট ঢেকে আদ্রিকা উপর নিচ মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। পরখ কটমট করে তাকিয়ে বলল,
“দাঁত ব্রাশ করে এসো। যাও।”
আদ্রিকা ঠোঁট উল্টে বলল,
“একটু পান-ই তো খেয়েছি। দাঁত ব্রাশ করতে হবে কেনো? দাদী যে মুখে পান নিয়ে ঘুমিয়ে গেলেন।”
“তুমি যাবে নাকি রুম থেকে বের করে দিব?”
আদ্রিকা মুখ ফুলিয়ে বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে যেতে গিয়েও থেমে গিয়ে পরখের দিকে ফিরে বলল,
“একা ওয়াশরুমে যেতে আমার ভয় করে। টিউবওয়েলও চাপতে পারি না।”
পরখ কিছু বলল না। নীরবে বিছানা থেকে নেমে ধুপধাপ পায়ে টিউবওয়েল পাড়ের দিকে চলে গেল।
আদ্রিকা ফ্রেশ হয়ে কক্ষে এসে দেখল কক্ষের মাঝখানে অধরা দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রিকা ও পরখকে দেখে অধরা বলল,
“কোলবালিশ দিতে এসেছিলাম। তুমি যে কোলবালিশ ছাড়া ঘুমাতে পারো না, মা ভুলেই গিয়েছিল।”
আদ্রিকা বিছানার মাঝখানে শায়িত কোলবালিশটির দিকে একনজর তাকিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে অধরার দিকে তাকালো। যে ইতিমধ্যে কক্ষ ত্যাগ করেছে। পরখ কোলবালিশ ছাড়া ঘুমাতে পারে না, সেটা স্ত্রী হয়েও সে জানে না। তবে অধরা কেনো জানবে? আদ্রিকার মন ভার হয়ে এলো। কিছু না বলে সে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়লো।
ঘড়িতে সবেমাত্র সাড়ে নয়টা বেজেছে। গ্রামে নেমেছে সুনশান নীরবতা। সকলে নিজ নিজ কক্ষে নিদ্রাদেশে পাড়ি জমিয়েছে। এতো দ্রুত ঘুমানোর অভ্যাস নেই পরখের। এজন্যই সে গ্রামে আসতে চায় না। দিনের সময়টুকু হৈ হুল্লোড়ে কেটে গেলেও রাত নেমে আসে ঝুপ করে। দীর্ঘ রজনী যুগ যুগ দূরত্বের মনে হয় পরখের নিকট।
বালিশে মাথা রেখে কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে চুপটি করে শুয়ে আছে পরখ। শত চেষ্টা করেও এই মুহূর্তে ঘুম আসবে না। সাথে একটি বই নিয়ে এসেছে অবশ্য। চাইলে বই পড়া যায়। কিন্তু পাশেই আদ্রিকা ঘুমাচ্ছে। এখন বাতি জ্বালালে ওর ঘুমের সমস্যা হবে বিধায় পরখ চুপ করে শুয়ে রইল।
বাড়ির সদর দরজায় পোষা কুকুরটা থেকে থেকে ডেকে উঠছে। জানালার পাশেই কোথাও একটা দলবেধে ডাকছে ঝিঁ ঝিঁ পোকা। দূর হতে থেকে থেকে ভেসে আসছে শেয়ালের হাঁক। পুকুরপাড়ের আগাছাগুলো বড় হয়ে জঙ্গলের মতোন দেখায়। শেয়ালগুলো বোধহয় ওখানেই এসে আস্থানা গেড়েছে। ওরা যেনো বাড়ির আশেপাশে আসতে না পারে তারই নিষেধাজ্ঞা জানাচ্ছে পোষা কুকুরটি।
পরখ কান পেতে তাদের ডাক শুনছে।
হঠাৎ খুব কাছেই একটা শেয়াল ডেকে উঠল। তখনি আদ্রিকা এক লাফে পরখের কাছে চলে এলো।
বুকের উপর আদ্রিকার মাথাটি আশ্রয় নেওয়া মাত্র চমকে উঠল পরখ। কপাল হতে হাত সরিয়ে চোখ মেলে অন্ধকার হাতড়ে তাকিয়ে দেখল বুকে মুখ গুঁজে আছে আদ্রিকা। পরখের নড়াচড়া বুঝতে পেরে আদ্রিকা বলল,
“ওগুলো কি ডাকছে? আমার ভয় করছে।”
এজন্য এক বিছানায় ঘুমাতে পরখের আপত্তি। রাত বিরাতে এমন ঝামেলা কার ভালো লাগে? হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরখ বলল,
“শেয়াল ডাকছে। বাড়ির কাছে আসবে না।”
পরখের গায়ের শার্টটি শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আদ্রিকা ফিসফিসিয়ে বলল,
“নিশ্চয়ই জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কী ভয়ংকর সুরে ডাকছে! ভয়ে আমার ঘুম ভেঙে গেছে। কিছুক্ষণ আপনাকে জড়িয়ে ধরে থাকি। আমি ঘুমিয়ে গেলে সরিয়ে দিয়েন।”
কিছুক্ষণের মধ্যে আদ্রিকা ঘুমিয়ে গেল। পরখ ওকে সরিয়ে দিল না। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, কুকুরের আর্তনাদ, শেয়ালের হাঁক – সব শোরগোল এড়িয়ে পরখের কানে বাজতে লাগল আদ্রিকার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ।
রাত কতো গভীর হলো কে জানে! পরখের ঘুম আসছে না। আদ্রিকা আশেপাশে থাকলে এমনিতেই পরখের ঘুম উড়ে যায়। আজ আবার বুকের বামপাশটায় জায়গা দখল করে আছে। এভাবে কী ঘুম হয়? পরখের বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দটা আরও তীক্ষ্ণ হতে থাকল। হাত দুটোও বারবার ছুটে যেতে চাইছে আদ্রিকার দিকে। পরখ খুব কষ্টে তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
চলবে…
#অক্ষরময়ী