পরিণয়ে নোলককন্যা পর্ব-৬৪ এবং শেষ পর্ব

0
535

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

শেষ পর্বের প্রথমাংশ

|৬৪|

মনতরীর পাড়ে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হচ্ছে। পাড়ের সবুজ ঘাসের উপর বসে নদীর পানিতে পা ডুবিয়েছে আদ্রিকা৷ ঘাসের সবুজ পাতা নদীর জলে স্নান করছে৷ সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আদ্রিকার ঘাড় ব্যথা হয়ে গেছে৷ সে অপরপাশে ফিরে পরখের দিকে তাকালো৷

আদ্রিকার মতোই নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে পরখ৷ পরখের দৃষ্টি নদীর পানির উপর সৃষ্ট প্রতিবিম্বের দিকে।
যদি নিজের চেহারার দিকে এতো মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকবে তবে আদ্রিকাকে এখানে নিয়ে এসেছে কেনো? ভেবে পেল না আদ্রিকা৷

আদ্রিকা বিরক্ত হয়ে পশ্চিমাকাশের প্রায় ডুবি ডুবি সূর্যটার দিকে তাকালো। পরখের আচরণ কেমন অপরিচিত লাগছে৷ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলেছিলেন পর্তুলিকা। অথচ পরখ ওকে মনতরীর চরে নিয়ে এসে এভাবে নদীর পাড়ে বসিয়ে রেখেছে৷ এসবের কোনো মানে হয়! কী হচ্ছে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না আদ্রিকা।

কয়েকদিনের বোঝাপড়ার পর গতকাল রাতে নিজের সুখ, দুঃখ, কষ্ট সবকিছু উজার করে দিয়েছে আদ্রিকা৷ এখন আর ভালোমন্দ কোনোকিছু বোধ হচ্ছে না। নির্ভার লাগছে৷ গতরাতে একদফা কান্নাকাটির পর আদ্রিকা-পরখ ছাদের শীতলপাটিতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল।

সকালে উঠে আদ্রিকা খেয়াল করলো, মনটা ভীষণ ফুরফুরে লাগছে৷ মনের সব কথা বলে ফেলার পর জাগতিক কোনো চাপ বোধ করছে না৷
কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই, কারো জন্য কোনো চিন্তা নেই, কোনো আকাংঙ্ক্ষা নেই। আদ্রিকার জন্য শুধু আদ্রিকা-ই আছে৷ নিজের পাশে নিজে থাকার চেয়ে উপযুক্ত সঙ্গ আর কিছু হয় না৷ এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে টিকে থাকতে চাইলে, সুখে থাকতে চাইলে নিজের সাথে নিজের সম্পর্ক সবচেয়ে মজবুত রাখতে হয়। যা আদ্রিকা শিখে গেছে৷

সকালে ঘুম থেকে উঠে আদ্রিকা ফুরফুরে মেজাজে নাস্তা তৈরি করেছে, ঘরদোর পরিষ্কার করেছে৷ জিনিসপত্র গোছগাছ করবে কিনা জিজ্ঞাসা করতে গিয়েছিল পরখের কক্ষে৷ পরখ সকাল থেকে নিজের কক্ষে দোর দিয়ে বসে ছিল। কী প্যাকিং করছিল কে জানে! আদ্রিকা ওকে বিরক্ত করেনি৷ যা ইচ্ছে করুক।

পরখ চলে গেলে আদ্রিকা থাকবে শ্বশুরবাড়িতে৷ তাই এই মাসে ভাড়া বাড়িটা ছাড়তে হবে৷ এখানের জিনিসপত্র আজকেই গুছিয়ে ফেলবে কিনা জিজ্ঞাসা করায় পরখ গম্ভীরমুখে জবাব দিয়েছিল,

‘মাসের এখনো অর্ধেক বাকি। প্যাকিং করার এতো তাড়া কীসের?’

মাসের অর্ধেক বাকি হলেও, পরে আদ্রিকা একাই এতো সবকিছু কীভাবে গুছাবে? পরখ কালকে চলে গেলে এই বাড়িটার তো আর প্রয়োজন নেই৷ মাস শেষ হওয়ার অপেক্ষা না করে আজকেই সব গুছিয়ে নিয়ে চলে ফেলে কী এমন ক্ষতি হবে?

তর্ক করতে ইচ্ছে করলো না আদ্রিকার। যার বাড়ি সে ভালো বুঝবে৷ আদ্রিকার কি?

লাঞ্চের আগে পর্তুলিকা কল দিয়ে বললেন, সব প্যাকিং করে তাড়াতাড়ি ও বাড়ি চলে যেতে৷ লাঞ্চটা সবাই মিলে একসাথে করবেন৷

কিন্তু বাধ সাধলো পরখ। তার নাকি এখনো প্যাকিং বাকি। সাথে নিয়ে যাবে একটা মাত্র লাগেজ৷ সকাল থেকে সেটাতে কী এমন ভরছে যে প্যাকিং-ই শেষ হচ্ছে না! আদ্রিকা চাইলে সাহায্য করতে পারত, কিন্তু পরখ বরাবর নিজের গোছগাছ নিজেই করে। তাই আদ্রিকা ওকে একা ছেড়ে দিয়ে দুপুরের জন্য রান্নাবান্না সম্পন্ন করে ফেলল৷

খাওয়াদাওয়া শেষ করে রান্নাঘরের জিনিসপত্র ভালোভাবে তুলে রেখে তারপর গেলো গোসলে। একখানা নতুন শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছছিল আদ্রিকা, তখনি পরখ এলো। দরজার সামনে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আদ্রিকার দিকে চেয়ে রইলো। অমনোযোগী আদ্রিকার চোখ বেখেয়ালে আয়নায় পড়তেই পরখকে দেখে চমকে উঠল। আদ্রিকার মনে হলো, পরখ ওর নগ্ন কোমরের দিকে চেয়ে আছে৷ আদ্রিকা খেয়াল করলো, আশ্চর্যজনকভাবে পরখের এমন দৃষ্টিতে আজ প্রথমবার আদ্রিকার অস্বস্তি হলো৷ তবে কি আদ্রিকার মন থেকে একেবারে মুছে গেল পরখ?

দ্রুত ফিরে তাকালো আদ্রিকা৷ পরখের দৃষ্টি কোমরের দিকে নয়, বরং আদ্রিকার মুখে নিবদ্ধ হলো৷ আদ্রিকার মনে হলো, সে ভুল দেখেছে৷ পরখ কখনোই ওর দিকে কামুক দৃষ্টিতে তাকায়নি৷ আজ হঠাৎ তাকাবে কেনো?

আদ্রিকা স্বাভাবিকভাবেই জানতে চেয়েছিল,

‘কিছু বলবেন?’

ধ্যানভঙ্গের মতো হকচকিয়ে উঠেছিল পরখ৷ থমথমে খেয়ে বলেছিল,

‘একটা ড্রেস এনেছিলাম তোমার জন্য৷ পরে দেখতে পারো৷’

তখনি আদ্রিকা খেয়াল করেছিল পরখের হাতে ধরে থাকা শপিংব্যাগটি৷ আদ্রিকা অবাক হয়ে বলেছিল,

‘এটা আমার ফেয়ারওয়েল গিফট?’

‘কাইন্ড অফ।’

কেমন শুকনো মুখে জবাব দিয়েছিল পরখ। আদ্রিকা ভেবেছিল পরখ বোধহয় নিজের পছন্দের একটা শাড়ি দিয়েছে। যেহেতু আদ্রিকা শাড়ি পরতে ভালোবাসে। কিন্তু শপিংব্যাগে খুলে আদ্রিকাকে হতাশ হতে হলো। শাড়ির জায়গায় পেলো একটা সাদা সালোয়ার কামিজ। তবে ওড়নাটা বেশ সুন্দর৷ বিভিন্ন রঙের মিশেলে ব্লকের কাজ৷ জমিনে জ্যামিতিক আকারের নকশা, প্রান্তে তান্তির কাজ। আদ্রিকা একটু ভালোভাবে খেয়াল করে দেখল, সাদা কামিজেও সাদা চিকনকারির কাজ রয়েছে। প্রথম দেখায় খুব সাধারণ মনে হলেও, ধীরে ধীরে আদ্রিকা বুঝল পোশাকটি বেশ সুন্দর৷

অবশ্য পরখের পছন্দ কখনোই সাধারণ ছিল না। সাধারণের মাঝে অসাধারণ কিছুতেই পরখের দৃষ্টি আটকায়। এজন্যই হয়তো আদ্রিকার মতো সাধারণ কেউ পরখকে বাঁধতে পারেনি।

বেশিকিছু না ভেবে শাড়ি পাল্টে পোশাকটি পরে নিল আদ্রিকা।

ও বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার এলো কিছুক্ষণ পরেই। আদ্রিকাও নিজের জন্য দুটো ব্যাগ প্যাক করে রেখেছিল। পরখের থেকেও আদ্রিকার জিনিসপত্রই বেশি। ব্যাগ, লাগেজ গাড়িতে তুলে দিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে বলল পরখ৷

আদ্রিকা অবাক হয়ে বলেছিল,

‘আমরা যাবো কীভাবে?’

‘বাইকে।’

পরখের উত্তরে যারপরনাই অবাক হয়েছিল আদ্রিকা। গাড়ি রেখে বাইকে ইচ্ছে করলো কোন খুশিতে? যে ব্যক্তি আদ্রিকাকে বাইকে বসাতেই চাইত না, আজ সে নিজেই সেধে বাইকে নিয়ে যাচ্ছে!
সরু চোখে চেয়ে পরখের বাইকে বসেছিল আদ্রিকা৷

****

পরখের বাইক বাড়ির পথে না গিয়ে যখন অন্য পথে যেতে শুরু করল তখন আদ্রিকার হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে গিয়েছিল। শক্ত করে চেপে ধরে ছিল ওড়নার শেষ প্রান্ত৷ পরখ কি ওর সাথে একান্তে সময় কাটাতে চাইছে? কিন্তু কেনো? এলোমেলো কতো চিন্তাই না জেগে উঠেছিল আদ্রিকার মনে! অথচ মনতরীর চড়ে এসেছে থেকে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে পরখ৷

এদিকে বসে থাকতে থাকতে বেচারি আদ্রিকার কোমরে খিল ধরে গেল।

একসময় বিরক্ত হয়ে চোখ মুখ কুচকে আদ্রিকা বলেই বসল,

‘এভাবে আর কতোক্ষণ বসে থাকব?’

আসার পর এই প্রথমবার আদ্রিকার দিকে তাকাল পরখ৷ কিছু বলল না শুধু চেয়ে রইল৷ আদ্রিকা মুখটা স্বাভাবিক করে বলল,

‘সন্ধ্যা নামতে শুরু করলে মশার প্রকোপ বাড়বে। এই দেখুন এখনি কামড়ানো শুরু করেছে।’

আদ্রিকা ভেবেছিল এই কথা শুনে পরখ চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বিরক্তিমাখা স্বরে বলবে, চলো ফেরা যাক। অথচ এমন কিছু ঘটল না। আজকের দিনে কোনো ঘটনাই স্বাভাবিকভাবে ঘটছে না। আদ্রিকা ধরেই নিল, আজকে শুধুই অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটার দিন৷

চারদিক মুখরিত করে মাগরিবের আযানের ধ্বনি ছুটল। চঞ্চল হলো আদ্রিকা। তড়িঘড়ি করে ওড়না টেনে মাথায় ঘোমটা দিল৷ চেহারায় ফুটে উঠল দুশ্চিন্তা। পর্তুলিকা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছেন।

বিরক্তি, দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা ভরা আদ্রিকার মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আবারও জলের দিকে তাকাল পরখ। জলে ডুবন্ত ঘাসের উপর পা বুলিয়ে পরখ বলল,

‘তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। গোলাপি রঙটা তোমাকে বেশ মানায়।’

চকিতে পরখের দিকে ফিরে চোখ বড় বড় করে তাকালো আদ্রিকা। সে কি ঠিক শুনল? এতোদিন যার মুখে একটু প্রশংসা শোনার জন্য সেজেগুজে পটেরবিবি হয়ে আগেপিছে ঘুরতো আজ সে নিজে থেকে আদ্রিকার প্রশংসা করছে! অথচ আদ্রিকার হৃদয় পুলকিত হলো না। অবাক লাগছে ঠিকই কিন্তু আনন্দ বোধ হচ্ছে না।

পরখ ভুল করেও আদ্রিকার চোখে চোখ রাখল না। সেই যে মাথা নিচু করে জলের দিকে তাকিয়ে আছে তো আছেই। আদ্রিকাও উপায়ান্তর না দেখে জলে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকালো।

সত্যিই ওকে সুন্দর লাগছে। সন্ধ্যার কনে দেখা আলো পড়েছে আদ্রিকার চোখে মুখে এজন্যই বোধহয় রুপের ছটা লেগেছে পরখের চোখে৷

নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আদ্রিকার মনে হঠাৎ করেই একজন ব্যক্তি উঁকি দিল৷ যাকে নিয়ে কথা বলা এতোদিন বারণ ছিল। আদ্রিকাও ভুলে থাকতে চেয়েছিল তাকে। পরখের ভয়ে নয়, বরং নিজেকে কষ্ট থেকে বাঁচাতে এড়িয়ে চলা।

তবে আজ আর সেসবের ভয় নেই। তাই জলের দিকে তাকিয়েই আদ্রিকা বলল,

‘শুদ্ধতার থেকেও সুন্দর লাগছে?’

আকস্মিক এমন প্রশ্নে পরখ ভড়কালো। সচকিত দৃষ্টিতে তাকাল আদ্রিকার দিকে। এবার আদ্রিকা ফিরে তাকিয়ে পরখের চোখে চোখ রেখে কণ্ঠে রোষ নিয়ে শুধালো,

‘আপনার শুদ্ধতাকেও তো গোলাপি রঙে বেশ সুন্দর দেখাতো। ডায়েরিতে এমনটাই লিখেছিলেন আপনি।’

আদ্রিকা ভেবেছিল, পরখ ক্ষেপে যাবে। কিন্তু ওই যে আজ সব অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটার দিন। পরখ ঠোঁট চেপে সামান্য হাসল। বলল,

‘ডায়েরির সব লেখা তোমার মনে আছে!’

আদ্রিকা কঠিন মুখে জবাব দিল,

‘সেগুলো ভুলে যাওয়ার মতো কিছু নয়।’

‘সব পড়েছো?’

‘বোধহয়। কিছু বাকি রয়ে গেলেও পড়ার উপায় ছিল না। আপনি কেড়ে নিয়েছিলেন।’

পরখ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশ পানে চেয়ে বলল,

‘তুমি শুদ্ধতা সম্পর্কে জানতে চাও?’

আদ্রিকা কোনো উত্তর দিল না। সে কি ওই মেয়েটি সম্পর্কে সত্যিই জানতে চায়, পরখের হৃদয়ের সবটুকু জুড়ে রাজত্ব যার? যার কারণে এতোদিনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আদ্রিকা পরখের হৃদয়ে একটুও স্থান দখল করতে পারেনি। যে মেয়েটি পরখের সবটুকু কেড়ে নিয়ে পলায়ন করেছে, স্ত্রীর জন্য তিল পরিমাণ স্থানও ফাঁকা রাখেনি।

হ্যাঁ, আদ্রিকা জানতে চায়। আজ আর ভেঙে পড়ার কোনো ভয় নেই। আদ্রিকা ঠিক সয়ে নিতে পারবে। এতোটুকু শক্ত হতে পেরেছে আদ্রিকা। এতোটুকু কঠিন হয়েছে তার মেরুদণ্ড।

গলার স্বরে পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে আদ্রিকা জবাব দিল,

‘আপনার সমস্যা না থাকলে বলুন। আমি শুনছি।’

পশ্চিম আকাশের রঙের ভেলা ভেসে গেছে। লাল, কমলা, বেগুনি, ধূসর কতো রঙ এর মেলা সেখানে! রঙিন আকাশের পাণে চেয়ে পরখ আপনমনে হাসল। বলল,

‘আমি যখন প্রথমবার ওকে দেখলাম, ও তখন অনেক ছোট। হাইস্কুলে পড়ে বোধহয়। একদিন আমি টিউশন শেষ করে বাড়ি ফিরছিলাম। একটি ট্রাক মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে রাস্তা ব্লক করে রেখেছে৷ ফলস্বরূপ মুহূর্তেই জ্যাম লেগে গিয়েছিল রাস্তায়। বাইক থামিয়ে জ্যাম ছাড়ার অপেক্ষা করছিলাম। তখনি দেখলাম ওকে। ছাদের রেলিং এর উপর পা রেখে হাঁটছিল। আশেপাশে ফুটে আছে সাদা, বেগুনি রঙের কসমস ফুল৷ ফুলের রাজ্যে সে যেনো এক রাজকন্যা।
ইটের সরু রেলিং এর পায়ের ছাপ ফেলে বাতাসে দু হাত মেলে প্রজাপতির মতো উড়ছিল। মুখে স্নিগ্ধ হাসি। একটুও ভয়ডর ছিল না ওর মধ্যে৷ অথচ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল, এক্ষুনি পা ফসকে পড়ে যাবে। জ্যাম না ছাড়া পর্যন্ত ওখানে দাঁড়িয়ে আমি ওকে দেখতে থাকলাম।

আমি ভেবেছিলাম, ওটা এক মুহূর্তের মোহ ছিল মাত্র৷ কিন্তু পরেরদিন আমি আবারও কী ভেবে যেন সেই বাড়িটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেদিন কিন্তু রাস্তায় জ্যাম ছিল না। তবুও আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।
এরপর প্রায়শই ওর বাড়ির সামনে আমি দাঁড়িয়ে পড়তাম।

যা ছিল আমার স্বভাবের বিপরীত। মাসের পর মাস কেটে গেল। একদিন আমার বোধোদয় হলো। নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলাম৷ কেনো আমি এমন স্বভাববিরুদ্ধ কর্মকাণ্ড করছি? এর কারণ কী? জবাবটা আমার চাই।

সেদিন আমি ওর দুয়ারে দাঁড়িয়ে ছিলাম প্রশ্ন উত্তরের আকাংঙ্ক্ষায়। গোধূলিবেলায় কনে দেখা আলোয় গোলাপি ওড়নায় ঘোমটা টেনে গাছে পানি দিচ্ছিলো৷ ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি আবিষ্কার করলাম, এই মেয়েটির কাছে ছুটে গেলে আমি ভীষণ শান্তি পাই৷ ওর মাঝে আমি স্বস্তি খুঁজে পাই। পবিত্রতার প্রতীক মায়াবী মুখটি আমার সমস্ত অস্থিরতা দূর করার ক্ষমতা রাখে৷ ওর আশেপাশে থাকলে আমি সমস্ত দুঃখ, কষ্ট ভুলে সুস্থির হই।
সেদিন আমি ওর একটা নাম দেই৷ শুদ্ধতা৷ আমার অন্তরের কালিমা ধুয়েমুছে শুদ্ধ করে যে৷’

আদ্রিকা যতোবার শুদ্ধতা নামটি শুনেছে, নিষিদ্ধ একটি যন্ত্রণা ধক জ্বলে উঠেছিল বুকে৷ হিংসায়, যন্ত্রণায় পু/ড়েছে আদ্রিকা৷ কিন্তু আজকে শুদ্ধতা সম্পর্কে এতোকিছু শোনার পরেও আদ্রিকার কষ্ট হলো না। অন্যান্য প্রণয়গাঁথার মতোই আদ্রিকা মনোযোগ দিয়ে শুনল পরখের শুদ্ধতার গল্প। দেখল পরখের চোখে মুখে উপচে পড়া ভালোবাসা, স্বস্তি, শান্তি৷ যার কোনোকিছুই আদ্রিকাকে আঘাত করলো না৷

*****

সূর্য ডুবে গেলে অন্ধকার নামতে খুব একটা সময় লাগে না৷ অন্ধকারে মনতরীর চরে অবস্থান বড্ড বিপদজনক তা আদ্রিকার মনে আছে। এই অন্তিমকালে নতুন কোনো বিপদের সম্মুখীন হতে চায় না আদ্রিকা৷ গায়ের ওড়নায় হাত মুছে উঠার বন্দোবস্ত করল সে।

মাথার ঘোমটা নামাতে গিয়ে আবারও চোখ পড়লো জলের বুকে নিজের প্রতিবিম্বে৷ হাত থেমে গেল আদ্রিকার। বুক ধক করে উঠল। একটু আগে পরখ সেই গোধূলিলগ্নের কথা বলল না? যেটা সেই ডায়েরিতে লেখা ছিল। হ্যাঁ, সেটার কথাই তো বলল।

গোলাপি ওড়নায় ঘোমটা পরা শুদ্ধতাকে পরখ তুলনা করেছিল পদ্মফুলের সাথে।
শুদ্ধতার উদ্দেশ্যে লেখা সেই চিঠিটি আদ্রিকা পড়েছিল। কী যেনো লেখা ছিল চিঠিতে? দ্রুত ভাবতে লাগল আদ্রিকা।

শুদ্ধতা,
পদ্মফুল চিনো নিশ্চয়ই?…..

এরপর?

চিঠির বাকিটুকু যতই মনে মনে আওড়ালো, ততই ঘামতে থাকল আদ্রিকার হাতের তালু। শেষের লাইনগুলো সেদিন ভালোভাবে পড়তে পারেনি৷ প্রচন্ড মন খারাপ লাগছিল। এতোকিছু ভাবার সময় ছিল না আদ্রিকার নিকট। কিন্তু আজ অঢেল সময় আদ্রিকার হাতে।

তবুও আদ্রিকার মস্তিষ্ক দ্রুত গতিতে ছুটতে লাগল। ভাবতে গিয়ে আদ্রিকার হৃৎস্পন্দন ক্রমশ জোড়ালো হলো।

*****

“বালকটির হাতে ধরে রাখা পদ্মফুলগুলো বোধহয় আশেপাশের কোনো ডোবা থেকে তোলা। বালকটির দেহের মতোই পদ্মফুলের গোলাপী অঙ্গে তখনও জড়িয়ে আছে জলের ধারা। ভোরের মিষ্টি আলোয় মুক্তোর মতো চিকচিক করছিল সুক্ষ্ম জলের ফোঁটা। যেমনটি করেছিলো তোমার অদ্ভুত নাকফুলটি। ডুবন্ত সূর্যের শেষ অহংটুকু নাকের অলংকারে প্রতিফলিত হয়ে ঝলমল করছিল তোমার ঠোঁটের ডগায়। যেমন করে ঝলমল করে উঠে ধানের পাতায় শিশির বিন্দু।

কবিগুরুর সেই বিখ্যাত কবিতার লাইনটির কথা মহত্ব বুঝতে বুঝতে দীর্ঘ রাত শেষে দিনের সেই শুভক্ষণে খুঁজে পেলাম আমি তোমার সৌন্দর্যের উপমা।

প্রিয় শুদ্ধতা, সেদিনের গোলাপী ওড়নায় ঘোমটা দেওয়া কিশোরীকে জলে স্নানরত পদ্মফুলের সাথে তুলনা করার ধৃষ্টতা আমি করছি৷ তুমি সেই পদ্ম-কমল-শতদল। যা কারো আরাধনার কর্মে নিয়োজিত নয়। সে যে নিজেই আমার আরাধ্য৷”

আদ্রিকা কাঁপা কাঁপা নিজের নাকের নোলকটি স্পর্শ করলো।
অদ্ভুত নাকফুল! লোকে তার নাকফুলকেই তো অদ্ভুত বলে।

ভেতরে ভেতরে আদ্রিকা ভীষণ ভাবে কাঁপতে লাগল। সন্দেহের স্রোত হুড়মুড় করে ভেঙে দিল আদ্রিকার সমস্ত ধীর-স্থিরতা।

আশেপাশের সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলো আদ্রিকা। নাকের নাকফুল থেকে শুরু করে পরখের উপহার দেওয়া এই পোশাকটি, মাথায় ঘোমটা দেওয়া চুড়নি ওড়নাটি। যার অনেক রঙ এর মধ্যে গোলাপির পরিমাণটাই বেশি৷

এমনি একটি চুড়নি ছিল আদ্রতার। সেটি পরে আদ্রিকা একদিন ছাদে গিয়েছিল। সন্ধ্যাবেলা পর্যন্ত মাথায় ঘোমটা দিয়ে গাছে পানি দিয়েছিল। সেদিনই তো আদ্রিকা অনুভব করেছিল সেই আগন্তুকের অদ্ভুত দৃষ্টি।

আর কিছু ভাবতে হলো না আদ্রিকার। এক ফোটা জল টুপ করে পড়লো নদীর জলে৷ চমকে উঠল আদ্রিকা। খেয়াল করে দেখল ওর চোখে চেয়ে জলের ধারা নেমেছে।

ভূমিতে হাত রেখে সতেজ ঘাসগুলো দু হাতে আঁকড়ে ধরলো আদ্রিকা। দাঁতের কোণে ওষ্ঠ চেপে ধরে কান্নারোধ করে ভীত দৃষ্টি মেলে তাকালো পরখের দিকে।

পরখ এখনো আকাশপাণে নির্বিকার চেয়ে রয়েছে। যেনো কিছুই ঘটেনি। যেনো এই মুহুর্তে সে আদ্রিকার কাঁধে আফসোসের ভারী পাথরটি চাপিয়ে দেয়নি।

আদ্রিকা ঘাড় ফিরিয়ে খানিকদূরে অবস্থানরত পরখের বাইকটির দিকে তাকালো। নাহ, এটা মিলছে না। বাইকটি সম্পূর্ণ কালো নয়। সেই আগন্তুকের বাইক মিশমিশে কালো ছিল।

আদ্রিকার মাথার ভেতর সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এলোমেলো আদ্রিকা, দিশেহারা আদ্রিকা ফুপিয়ে কেঁদে ফেলল হঠাৎ। পরখের বাহুর কাছে শার্টটি মুঠোভরে চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘আপনার বাইক সম্পূর্ণ কালো ছিল। ওটা কোথায়? কোথায় রেখেছেন ওটাকে?’

চকিতে ঘাড় ফিরে চাইল পরখ। আদ্রিকার লালচে মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো ভীষণ। কান্নার দমকে আদ্রিকার গা কাঁপছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে৷ পরখ ঘাবড়ে গিয়ে আদ্রিকার কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘হেই রিলেক্স। আস্তে আস্তে শ্বাস নেও। কাম অন। ব্রিথ ইন, ব্রিথ আউট।’

আদ্রিকার মনে হচ্ছে সে শ্বাস আটকে ম/রে যাবে। কিছুতেই শ্বাস নিতে পারছে না। বুকে যেটুকু অক্সিজেন আটকে আছে, তা বের হতে পারছে না। বুকের ভেতর একটা তীক্ষ্ণ ব্যথা ঘুরে বেড়াচ্ছে। পরখ দ্রুত হাত বাড়িয়ে আদ্রিকার গায়ের ওড়না সরিয়ে দিয়ে বুকের বামপাশে আস্তে আস্তে মালিশ করতে লাগল। সেই সাথে আদ্রিকাকে ধীরে ধীরে শ্বাস নেওয়ার অনুপ্রেরণা দিচ্ছে৷ কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হলো আদ্রিকা।

এক ঝটকায় বুকের উপর থেকে পরখের হাতটি সরিয়ে দিয়ে বলল,

‘আপনার বাইক কালো ছিল। সব কালো ছিল। আমি স্পষ্ট দেখেছি৷’

পরখ নিজের হাত গুটিয়ে নিয়ে পেছন ফিরে বাইকের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘এটাই সেই বাইক। লাল ডিকাল লাগিয়েছি।’

আদ্রিকা বিস্ফোরক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পরখের দিকে। এতোক্ষণ মনের মধ্যে স্বল্প প্রত্যাশা বাকি ছিল, পরখ সেই আগন্তুক নয়। সে অন্য কেউ৷ কিন্তু এরপর আর কোনো আশা বাকি রইলো না।

আদ্রিকার সেই দৃষ্টির সামনে পরখ একটু হাসার চেষ্টা করলো। মলিন সে হাসি আরও অবাক করে দিল আদ্রিকাকে৷ সে বিস্মিত কণ্ঠে বলল,

‘কবে লাগিয়েছেন? কেনো লাগিয়েছেন?’

কোলের উপর রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে পরখ বলল,

‘যেদিন তুমি প্রথমবার বিস্ময়ের সাথে আমাদের বাসাতে এসেছিলে।’

ডিকাল লাগানোর কারণ আলাদা করে বলতে হলো না পরখকে। বাকিটা আদ্রিকা বুঝে নিল। নিস্তেজ কণ্ঠে শুধালো,

‘আর হেলমেট?’

‘ওটা! ওটা তো স্টোররুমে ছিল।’

আদ্রিকার মনে পড়লো, স্টোররুম পরিষ্কারের সময় সে একটি হেলমেট দেখেছিল। তখন এতো কিছু ভাবেনি। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে সবকিছু ভেবে নিজেকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগী মনে হলো।

গলা ছেড়ে ডুকরে কেঁদে কেঁদে আদ্রিকা বলল,

‘আপনি আমার এতো কাছে ছিলেন! আমি আপনার এতো কাছে ছিলাম! অথচ আপনি একবারও আমাকে জানালেন না। কেনো পরখ? কেনো করলেন এমনটা?’

আদ্রিকার কান্না বোধহয় পরখকে স্পর্শ করতে পারল না। ভাবান্তরহীন পরখ বলল,

‘কী বলতাম?’

কী বলতো আদ্রিকা জানে না। কিন্তু এইটুকু জানে, পরখ কিছু একটা বলতে পারতো। বিস্ময়ের সাথে আদ্রিকার সম্পর্ক চলাকালীন সময় চুপ থাকলেও, পরখের সাথে বিয়ের পর অনেককিছুই বলতে পারত। কিন্তু বলেনি। কেনো বলেনি?

নিজের ভাগ্যের প্রহসনে ভঙ্গুর আদ্রিকা নিস্তেজ কণ্ঠে অমলিন হাসল।

‘শুদ্ধতা! আপনার ভালোবাসা! হা হা হা।’

সন্ধ্যানগরীর নিস্তব্ধ আবহে কেমন গা ছমছমে শুনালো সেই হাসি। পরখ অবাক চোখে দেখল আদ্রিকাকে। আদ্রিকা কেমন উন্মাদের মতো পরখের গায়ের উপর ঝুকে বলল,

‘এই মেয়েটাকে ভালোবেসে প্রতিনিয়ত কতোটা কষ্ট পেতেন, তা আমি নিজ চোখ দেখেছি৷ খুব কাছ থেকে অনুভব করেছি৷
আবার এই মেয়েটাকে কতোটা ঘৃণা করতেন, তাও আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, অনুভব করেছি।
আপনার ভালোবাসা সত্যি নাকি ঘৃণা? কোনটা আপনার প্রকৃত অনুভূতি?’

ঘাসের উপর হাত পরখ পেছনের দিকে হেলে পরেছে পরখ। আদ্রিকার রক্তিম চোখে চোখ রেখে নিচু স্বরে পরখ বলল,

‘আমি তোমাকে কখনোই ঘৃণা করিনি।’

পরখকে আরেকদফা চমকে দিয়ে চট করে এক হাতে পরখের শার্টের কলার চেপে ধরল আদ্রিকা। মুখের কাছে মুখ নামিয়ে ধমকে উঠল।

‘এই পরখ, আপনার নাটক বন্ধ করুন৷ আমাকে পাগল পেয়েছেন আপনি? ইতিমধ্যে পাগল না হলেও
আপনার কারণে আমি সত্যিই পাগল হয়ে যাবো। আমাকে নিয়ে খেলা বন্ধ করুন। আপনি আমাকে কতোটা ভালোবেসে ছিলেন, আমি জানি না৷ কিন্তু কতোটা ঘৃণা করেছেন সেটা আমি জানি। এই প্রসঙ্গে কোনো কিন্তু নেই। এ নিয়ে আমার অভিযোগও নেই। এঁটো খাবারের প্রতি মানুষের ঘৃণা জন্মাবে এটাই স্বাভাবিক। আমি তো আগেই নোংরা হয়ে গেছি৷’

‘তুমি আমার নিকট সদা শুদ্ধ, পবিত্র।’

পরখের কণ্ঠে কিছু একটা ছিল। আদ্রিকার পাথুরে হৃদয় পর্যন্ত ধক করে উঠল। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো।

শার্টের কলার ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে দু হাতে মাথার চুলগুলো চেপে ধরে হতাশা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,

‘আমার জীবনে কী থেকে কী হয়ে গেলো! আপনি আমার এত থেকেও কতোদূরে, পরখ! ভালোবেসেও কতোটা ঘৃণার পাত্র আমি! আপনার ভালোবাসাকে সন্দেহ করবো সেই দুঃসাহস আমার নেই। আমি যে নিজে আপনার বিরহের সাক্ষী। নির্ঘুম রাতের সঙ্গী।
আমার প্রতি ঘৃণাকেও অস্বীকার করার সাধ্য আমার নেই৷ আপনার ঘৃণিত দৃষ্টি, শাণিত বাক্য আমাকে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে৷ আমি আর আমি নেই।’

পরখ হাত বাড়িয়ে আদ্রিকার মাথায় হাত রাখতে চাইলে আদ্রিকা এক ঝটকায় সরে গেল। ধক করে জ্বলে উঠে মুহূর্তে আবারও ধপ করে নিভে গেল। চোখে মুখে নিদারুণ অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। ভঙ্গুর কণ্ঠে বলল,

‘কোনটা বিশ্বাস করবো, কোনটা করবো না – কিছুই বুঝতে পারছি না, পরখ। আমি আপনাকে বুঝতে পারছি না। যখনি মনে হয়, আপনাকে বুঝে ফেলেছি তখনি নতুন গোলকধাঁধায় ফেলে দেন।’

বাড়ন্ত হাতটি গুটিয়ে নিল পরখ৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘আমি নিজেই নিজেকে বুঝে উঠতে পারি না৷’

চলবে..
#অক্ষরময়ী

#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)

শেষ পর্বের শেষাংশ

|৬৫|

পাশে বসে থাকা ক্রন্দনরত মেয়েটি খুব করে ছুঁতে ইচ্ছে করছে। বুকের মাঝে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। এমন ইচ্ছে সবসময় জাগে পরখের মনে। মেয়েটি যখনি পরখের আশেপাশে থাকে তখনি মনে হয় বুকের মাঝে লুকিয়ে ফেলি। ভয়ংকর সমাজের সমস্ত বিপদ আপদ থেকে লুকিয়ে বাঁচিয়ে বুক পকেটে ভরে রেখে দেই ওকে।

কিন্তু আদতে তা সম্ভব হয় না। পরখ কি চাইলেই ওকে সারাক্ষণ বুক পকেটে ভরে রাখতে পারবে? পারবে না তো৷ তবুও অসম্ভব সব আকাংঙ্ক্ষা জাগে মনে। পরখ নিজেকে আটকায়। একদম শেকল জড়িয়ে রাখে মনে। এখনো তাই রাখল।

আদ্রিকা আরও কিছুক্ষণ কাঁদলো। কেঁদেকেটে একাকার করে নাক টেনে শান্ত করলো নিজেকে। তারপর পরখের দিকে তাকাল। ওমন ভাবলেশহীন বসে থাকতে দেখে জোরসে এক ধমক দিল।

‘আপনি কিছু বলছেন না কেনো? আপনি কি ভেবেই রেখেছেন, আমাকে পাগল বানিয়েই ছাড়বেন? এতোটাই ঘৃণা করেন আমাকে?’

মেয়েটি এই দুঃখ পাচ্ছে, এই রেগে যাচ্ছে। কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না। কোনো ব্যাপার নয়। পরখ নিজেকে শান্ত করে আদ্রিকার দিকে ফিরে বসল।

‘কী জানতে চাও বলো?’

কী কী প্রশ্ন করবে আদ্রিকা ভাবতে লাগল। অনেকগুলো প্রশ্ন একখানে হয়ে জমাট বেঁধে গেছে৷ কোনটাই খুঁজে পেল না আদ্রিকা। পরখ চেয়ে আছে প্রশ্নের অপেক্ষায়। আদ্রিকা দিশেহারা বোধ করলো। বলল,

‘আমার অনেক প্রশ্ন আছে। কী কী প্রশ্ন আমি জানি না। শুধু জানি, আমার অনেককিছু জানার আছে। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।’

আদ্রিকার মনে অবস্থাটা পরখ বুঝল। ওকে শতভাগ বুঝতে না পারলেও নব্বই শতাংশ বুঝতে পারে পরখ। মন খারাপ বুঝে, হাসি-আনন্দ বুঝে, মান-অভিমানও বুঝে। কিন্তু খুব একটা পাত্তা দেয় না। একবার পাত্তা দিলেই ঘাড়ে চেপে বসবে আদ্রিকা। যা পরখ চায়নি।

তবে আজকের দিনটি ভিন্ন। আদ্রিকাকে সব জানাতেই পরখ এখানে নিয়ে এসেছে। সন্ধ্যা নামার আগেই সব জানিয়ে, বুঝিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে।

পরখ দীর্ঘ আলাপের প্রস্তুতি নিয়ে বলল,

‘আমি দূর থেকেই তোমাকে দেখে গিয়েছি। কখনো কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। হয়তো আমিই বিশেষ চেষ্টা করিনি। বিস্ময়ের সাথে যখন বাসায় এলে তখন প্রথমবারের মতো সামনাসামনি দাঁড়ানোর সুযোগ হলো। সেদিন আমি জানলাম, তুমি আমার হাত ফসকে বেড়িয়ে গিয়েছো৷ কষ্ট পেয়েছিলাম তবে সামলেও নিয়েছিলাম নিজেকে।

বিব্রতকর পরিস্থিতি মুখোমুখি যাতে না হতে হয় তাই হেলমেট পাল্টে ফেললাম। বাইক বদলানোর সামর্থ্য না থাকায় ডিকাল লাগিয়ে বাইকের চেহারা বদলে ফেললাম।

কিন্তু তোমার ভাবনা আমাকে ক্ষণে আক্রান্ত করতে থাকল। বিস্ময়ের সুবাদে তোমার সম্পর্কে অনেক তথ্যই আমি জেনেছিলাম৷ আমি যেমনটা ভেবেছিলাম তেমনি কাঁদামাটি ছিলে তুমি। কিন্তু যে ছাঁচে পড়েছিলে তা ভালো ছিল না৷ যদিও বিস্ময় আমাকে বলেছিলে, ও তোমার ব্যাপারে সিরিয়াস। তা আমি মেনে নিয়ে নিজের পথে হাঁটতে থাকলাম।
বিস্ময়ের মতিভ্রমের ভয়টা মাঝেমধ্যে আমাকে ভাবাতো। তখন নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম এই বলে, তোমার জীবন তুমি বুঝবে। এখানে আমার কী দায়?
সবটাই তোমার মূর্খতার ফল।

পালিয়ে পালিয়েও আমি বারবার ফিরে আসতাম তোমার ভাবনায়। তুমিও পিছু ছাড়ছিলে না। বারংবার সামনে পড়ে যাচ্ছিলে। নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমার বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো বলে রাগ জন্মাচ্ছিলো তোমার প্রতি। কেন তুমি বারবার আমার সামনে আসছ!’

আদ্রিকা তীক্ষ্ণ চোখে পরখের দিকে তাকিয়ে রূঢ়ভাবে বলল,

‘বন্ধুর আদ্যোপান্ত জানার পরেও আপনার কখনো মনে হয়নি, আমাকে সতর্ক করা উচিত? বন্ধুর প্রতি অগাধ বিশ্বাস আপনার।’

পরখ ঠোঁট বাঁকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল,

‘আমি সতর্ক করলে তুমি শুনতে বুঝি?’

উত্তরটা আদ্রিকাও জানে। তখন সে বিস্ময়ের প্রেমে অন্ধ। বাঁধা হিসেবে সামনে যেই আসতো তাকে উপড়ে ফেলতে দু’বার ভাবত না।

পরখ আবার বলল,

‘এমনিতেও আমি জানতাম না, বিস্ময়ের সেই প্রেমিকা তুমি। আমাদের যেদিন দেখা হলো তখন তুমি কোনো স্টেজে দাঁড়িয়ে ছিলে, ভুলোনি নিশ্চয়ই?’

আদ্রিকা দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকালো। বিয়ে নামক সেই ছেলেখেলা স্মরণ করে চোখজোড়া সিক্ত হয়ে উঠল। কোনোভাবে যদি সেইদিনটি ফিরে পাওয়া যেতো! তবে আদ্রিকা কখনোই ওমন ভুল করতো না।

“বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর বাবার কথা অনুযায়ী আমি কখনোই জীবন পরিচালনা করিনি। উল্টো বাবা যা বলেছে জেদ করে তার বিপরীত কাজটি করেছি। এতে আমার ক্ষতি হলেও পরোয়া করিনি।

কিন্তু সেদিন বাবা যখন তোমাকে বিয়ের প্রস্তাবটি দিল, তখন আমি কোনো উচ্চবাচ্য করিনি৷ চুপচাপ মেনে নিয়েছি। নিয়তি যদি তোমাকে আমার করে দিতে চায়, তবে আমি কেনো সেই সুযোগটি লুফিয়ে নিব না?”

পরখের কথায় আদ্রিকা চমকে তাকাল। এই বিয়েতে পরখের সায় ছিল, তবে? বিশ্বাস হতে চাইল না আদ্রিকার।

এমন সন্দিহার দৃষ্টির সামনে বসে পরখ বলল,

‘আমি চাইলে আমার স্বপক্ষে অনেক প্রমাণ দর্শাতে পারতাম। মাকে কনভিন্স করাও আমার কাছে কোনো ব্যাপার ছিল না। কিন্তু নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে গিয়ে তোমার অতীতের বন্ধ অধ্যায় আরেকবার উন্মোচিত হতো।’

‘সে জন্য চুপচাপ বিয়ে করে নিলেন। আমার উপর দয়া করলেন।’

‘বিয়েটা কোনো দয়া ছিল না। আমি চেয়েছি, তাই করেছি।’

‘তবে বিয়ের পর এতো অপমান, অবহেলা কেনো? সেটাও কি আপনার অদ্ভুত ভালোবাসার অংশ?’

সীমাহীন ক্রোধ নিয়ে শুধালো আদ্রিকা। পরখ বিস্মিত হলো না। পরখ জানে, সে যার সামনে বসে আছে, সে পূর্বের আদ্রিকা নয়। সেই সহজ, সরল আদ্রিকা পরখের ভারিক্কি পদতলে পিষ্ট হয়ে গেছে।

পরখ হেয়ালি করে বলল,

‘ধরে নেও তাই।’

‘আমি ধরে নেওয়ার অবস্থায় নেই। আমি সত্য জানতে যাই। আমার সাথে যা ঘটেছে তার যথাযথ কারণ জানতে চাই।’

‘তোমার সাথে ঘটা প্রতিটি ঘটনার কারণ তুমি নিজেই আদ্রিকা।’

‘সেটা কীভাবে?’

‘তোমার কী মনে হয়, সেই সবসময় তুমি যেমন ছিলে তেমন কেউ এই নির্দয়া পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারতো?’

‘কেমন ছিলাম? বোকা, নির্বোধ, মূর্খ?’

‘অতিরিক্ত সহজ, সরল। যাকে যে-কোনো সময় বিপদে ফেলা যায়।’

‘সরলমনা হওয়াটা দোষের বলে গণ্য হয়, জানতাম না তো।’

‘দোষের নয়। তবে টিকে থাকতে হলে চতুর হওয়া জরুরি। ন্যায়, অন্যায় সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি। তুমি ছিলে মায়ের গর্ভে থাকা শিশুর মতোই নিষ্পাপ, নির্বোধ। সেটাও অপরাধের কিছু নয়। তবে অতিরিক্ত ভালো মানসিকতাএ পাশাপাশি, খারাপ সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান না থাকাটা দোষের। তোমার পৃথিবীটা ছিল সাদা ক্যানভাসের মতোন স্বচ্ছ। যাকে তাকে তুমি সরলমনে বিশ্বাস করে ফেলতে।

এই পৃথিবী কতো নিষ্ঠুরভাবে তোমার সেই সরলতার সুযোগ নিতে পারে, এই সম্পর্কে ধারণা না থাকাটা দোষের। তোমার যেমন ধারণা ছিল না, তেমনি তুমি সতর্কও ছিলে না। এজন্য বারবার বিপদে পড়েছিলে।’

‘হৃদয়ে পঙ্কিলতা না থাকলে এতোটা ঠোকর খেতে হয়, আমি জানতাম না। আমার পরিবার আমাকে এই শিক্ষা দেয়নি। নীতি নৈতিকতার মধ্যে আমি বড় হয়েছি।’

‘হৃদয়ে পঙ্কিলতা থাকাটা জরুরি নয়, আদ্রিকা। জগতের প্রতি পদে পদে পঙ্কিলতা রয়েছে এই বোধটি থাকা জরুরি। সন্তানকে শুধু ভালোটা দেখালাম, শেখালাম। একই মুদ্রার অপরপাশের মন্দ অধ্যায় সম্পর্কে শিশুকে সামান্যতম ধারণাও দিলাম না, এটা উচিত নয়। শিশুকে রক্ষা করার জন্য বাবা-মা কিংবা অভিভাবক সবসময় পাশে থাকে না। একটা বয়সের পর সন্তানের উপর অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণও থাকে না। যেমনটা তোমার উপর আদ্রতার নিয়ন্ত্রণ ছুটে গিয়েছিল।

সন্তানকে ভালোমন্দ উভয়কেই চেনাতে হবে। আলো-অন্ধকার উভয়েরই জ্ঞান থাকতে হবে৷ এরপর তাকে জানাতে হবে, কোনটা গ্রহণ করতে হবে আর কোনটা এড়িয়ে চলতে হবে৷

প্রেমের একপাশের সুখটা তুমি চিনেছো কিন্তু অপরপাশের দুঃখ সম্পর্কে তোমাকে ধারণা ছিল না। যদি ধারণা থাকত তবে এমন একটা পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তুমি দ্বিতীয়বার ভাবতে। ভাবোনি কারণ এটার অন্ধকার অধ্যায় থাকতে পারে এই বোধটাই তোমার ছিল না।

তবে আফসোসের বিষয় হচ্ছে, জীবন তোমাকে এতো বড় একটা শিক্ষা প্রদানের পরেও তুমি কিছু শিখতে পারোনি।

বিস্ময় তোমাকে ছুঁড়ে ফেলার পর তুমি আমাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলে। যা আমি মেনে নিতে পারিনি। কেন তুমি আগাছার মতো বাঁচবে? তুমি বাঁচবে তোমার মতো। তোমার বেঁচে থাকতে অন্যকে কেন অবলম্বন করতে হবে?’

আদ্রিকার দু ভ্রুর মাঝে ভাঁজ পড়লো। সরু চোখে পরখের দিকে চেয়ে পরখের কথাগুলো বুঝার চেষ্টা করল।

‘এজন্য আপনি আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন? আগাছার মতো আপনাকে জড়িয়ে ধরে উপরে উঠতে চাইলাম, আপনি আমাকে ছুড়ে ফেলে দিলেন!’

‘আমি চেয়েছিলাম তুমি নিজের মতো করে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াও। নিজের যোগ্যতায়, নিজের শক্তিতে।’

‘একটা মেয়ে, যে দুনিয়াদারি সম্পর্কে কিছু জানে না, পথঘাট চিনে না তাকে এভাবে হঠাৎ মাঝপথে একা ছেড়ে দিলেন। একদম হুট করে ছেড়ে দিলে মেয়েটা কীভাবে সার্ভাইব করবে সেটা ভাবলেন না। তাকে শিখেপড়ে নেওয়ার সময়টাও দিলেন না। বাহ! চমৎকার।’

‘আমি চাইলে তোমাকে একেবারে উপড়ে ফেলতে পারতাম। তা কিন্তু করিনি। কখনো একা ছাড়িনি। যখন যা সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছে, আমি করেছি।’

‘সামনে দাঁড়িয়ে আঘাত করেছেন আবার পেছনে দাঁড়িয়ে সাহায্য করেছেন কাপুরুষের মতো। সেটা আবার গর্বের সাথে বলছেন!’

আদ্রিকার জ্বলন্ত দৃষ্টির সামনে পরখ মলিন চোখে চেয়ে বলল,

‘আমি যদি সামনে থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতাম তবে তুমি কখনো একা চলতে পারতে না, আদ্রিকা৷ সবসময় পরনির্ভরশীল থেকে যেতে৷ তোমার সাথে আমি আছি এই বিশ্বাস তোমাকে এমনভাবে জড়িয়ে রাখত যে তুমি আত্মবিশ্বাসী হতে পারতে না। পরনির্ভরশীলতা নিষিদ্ধ নেশার মতো তোমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছিল। কোনো সহজ উপায়ে যার নিষ্পত্তি সম্ভব ছিল না।’

পরখের বুকের দু হাতে জোরসে ধাক্কা দিয়ে আদ্রিকা চিৎকার করে বলল,

‘এজন্য নিজেকে ভেঙে আমাকে গড়লেন। আমার সামনে নিজেকে টক্সিক উপস্থাপন করে আমাকে আত্মনির্ভরশীল বানালেন। এতে কী লাভ হলো আপনার?’

‘আমার লাভ লসের হিসাব তো এখানে হচ্ছে না। তুমি কতোদূর এগিয়ে এসেছো সেটা দেখো।’

‘আমি তো এমনটা চাইনি। কেউ আমার পেছনে দাঁড়িয়ে, আড়াল থেকে আমাকে সাহায্য করুক, আমি চাইনি। আমি জীবনসঙ্গী চেয়েছিলাম। যে আমার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলবে। আমি আপনাকে আমার পাশে চেয়েছিলাম, পরখ।’

‘তুমি সরলমনার পাশাপাশি খুবই অবুঝ, অপরিপক্ক ছিলে, আদ্রিকা। আমি তোমার পাশে দাঁড়ালে তুমি চলা থামিয়ে দিতে। সংগ্রাম করতে না। আমি এগিয়ে যেতাম, তুমি পেছনে পড়ে যেতে৷ সারাজীবন আমার ছায়াতলে জীবন কাটিয়ে দিতে। এমনটা আমি চাইনি। তোমাকে নিয়ে আমি এমন স্বপ্ন বুনিনি।’

‘আপনার স্বপ্ন দিয়ে আমি কী করব, পরখ? আপনিই বা এমন স্বপ্ন দিয়ে কী করবেন? এই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে আপনি সব হারিয়ে ফেলেছেন। আমাকে হারিয়ে ফেলেছেন। আমি এখন আর আপনাকে অনুভব করতে পারছি না। আপনার কোনোকিছুই আমাকে ছুঁতে পারছে না। আমি আপনাকে ছেড়ে অনেকদূরে চলে গিয়েছি। আমাদের পথ আলাদা হয়ে গিয়েছে।’

সেই বোধ পরখের আছে। জেনে-বুঝেই সে এই পথ বেছে নিয়েছে। জীবন পথে এগিয়ে যেতে অলস আদ্রিকার কণ্টকের প্রয়োজন ছিল, পরখ নিজেই পরিণত হয়েছে সেই কণ্টকে। পরখ জানত, আদ্রিকা একদিন সামলম্বী হবে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। সেদিন এক ঝটকায় ছুঁড়ে ফেলবে পথের সমস্ত কণ্টক। যাদের মধ্যে পরখ নিজেকেও খুঁজে পাবে।

অনেক সময় নিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল পরখ। বড্ড হালকা লাগছে পরখের। আদ্রিকার এখনো চোখের জল ফেলছে। চোখে মুখে রাগ, ঘৃণা, অনুশোচনা মিলেমিশে অদ্ভুত আভা সৃষ্টি করেছে। পরখ মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।

পরখকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদ্রিকা চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলল,

‘আপনার সাথে আমার আরও আগে কেনো দেখো হলো না, পরখ? আপনি আরও আগে কেনো আমার জীবনে এলেন না? সেই কিশোরী মেয়েটির সামনে প্রণয় নিবেদন নিয়ে কেনো দাঁড়ালেন না? আপনি যদি আমার প্রথম প্রণয়প্রার্থী হতেন, তবে প্রথম প্রহরেই আমি আপনাকে লুফে নিতাম৷ খোদার কসম, আর কারো দিকে কখনোই চাইতাম না। আপনি তখনি কেনো এলেন না, পরখ? এখন যে আমার হাতে আর কিছু নেই।’

পরখ আদ্র চোখে আদ্রিকার বন্ধ চোখ জোড়ার দিকে চেয়ে ফাজলামো করে বলল,

‘ধুর বোকা! তখন তুমি কতো ছোট ছিলে! নাইন কি টেনের ল্যাদা বাচ্চা ছিলে।’

আদ্রিকা ওভাবেই বসে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকল। একসময় হুট করে মনে পড়ে যাওয়ায় চোখ খুলে পরখের দিকে চেয়ে থেকে বলল,

‘বিয়ের পর আমাকে এতো ঘৃণা কেনো করতেন? বিস্ময়ের সাথে ঘনিষ্ঠতার জন্য?’

পরখ হঠাৎ মুখ লুকিয়ে অন্য দিকে তাকালো। আদ্রিকা ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড অপমান বোধ করলো। সব পুরুষই একই। বিয়ের আগে রংঢং করার সময় মনে থাকে কিন্তু নিজের বিয়ের সময় সতী সাবিত্রী বউ চাই। পরখেরও নিশ্চয়ই তেমনি আকাংঙ্খা ছিল।বিস্ময়ের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে দেখে পরখের ঠুনকো ভালোবাসা পবিত্রতার দোহাই দিয়ে পালিয়ে গিয়েছে।

কিন্তু আদ্রিকাকে হতাশ করে দিয়ে পরখ নিচু স্বরে বলল,

‘বিয়ের পরেও বিস্ময়ের চলে যাওয়ায় তুমি কষ্ট পেতে৷ প্রতিনিয়ত তোমার কষ্ট, তোমার অনুশোচনা, আফসোস দেখে আমার নিজেকে অপরাধী মন হতো। এখনো অবশ্য আমি নিজেকে অপরাধীই ভাবি। আমি যদি আরেকটু চেষ্টা করতাম, আরেকটু সাহসী হতাম তবে তুমি বিস্ময়ের খপ্পরে পড়তে না৷ কিন্তু আমি তখন সাহসী হতে পারিনি। তোমার দিকে ধাবিত প্রতিটি পদক্ষেপকে আমি রুখে দিয়েছি। আমার মনে হয়েছিল, আমি তোমার যোগ্য হয়ে উঠতে পারিনি। পড়াশোনা শেষ করে তবেই তোমার দুয়ারে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। তবুও একটা আশংকা আমাকে দমিয়ে রাখত আমি কি সঠিক পথে যাচ্ছি? তোমার প্রতি দূর্বল হওয়াটা কি আদোও ঠিক হচ্ছে?
প্রতিটি কাজে এমন দোটানার স্বভাব আমার বহু পুরনো। এর জন্য আমাকে অনেককিছু খোয়াতে হয়েছে৷ সেসব আমি আমলে নেইনি। কিন্তু আমার দোটানা স্বভাবের কারণে তোমাকে সাফার করতে দেখলে আমার নিজের উপর ভীষণ রাগ হতো৷ বারবার নিজেকে দোষারোপ করতে থাকতাম, আমার কারণেই আজ তুমি এতোটা কষ্ট পাচ্ছো, এতোটা হীনমন্যতায় ভুগছ। নিজেকে অনুশোচনার দহন থেকে বাঁচাতে তোমার থেকে দূরে থাকতাম। কিন্তু তুমি কাছে আসার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে থাকলে। রূঢ় আচরণ করা ছাড়া আমার উপায় ছিল না৷’

পরখের এই মানসিক অস্থিরতা,নিজেকে দোষারোপ করার তথ্যটি আদ্রিকাকে বেশ চমকে দিল। ওকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে পরখ তাড়া দিয়ে বলল,

‘চলো উঠো। মা অপেক্ষা করছে। তখন থেকে কতোবার যে কল দিল!’

প্যান্টের গায়ে লেগে থাকা ময়লা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো পরখ। ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকল। আদ্রিকাকে নিয়ে আর চিন্তা নেই৷ সে নিজের ভালো বুঝতে শিখেছে৷ নিজেকে সামলে নিজেই উঠে দাঁড়াবে।

মাত্র কয়েক কদম এগিয়ে পরখ, পেছন থেকে ডেকে উঠল আদ্রিকা৷

‘পরখ?’

কী মায়াবী শোনালো সেই ডাক! পরখের বুক ধক করে উঠল সেই প্রথমদিনগুলোর মতোন৷ অথচ আদ্রিকা বলছে, সে পরখকে অনুভব করতে পারছে না। তবে পরখ কেন এতোদিন পরেও আদ্রিকার প্রতি ভালোবাসা কমাতে পারলো না?

পরখ নিজেকে সামলে শুধু ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাল। আদ্রিকা ছোট্ট শিশুর ন্যায় সরল কণ্ঠে বললো,

‘যদি নতুন করে শুরু করতে পারতাম, তবে আপনার সব ঋণ আমি ভালোবেসে শোধ করে দিতাম।’

পরখ মলিন হেসে বলল,

‘তুমি আর কখনো আমাকে ভালো বাসতে পারবে না৷ তোমার মস্তিষ্কে আমার যে প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি হয়েছে, তাকে ভালোবাসা যায় না। যে তোমাকে প্রতি পদে পদে অপমান করেছে, তোমার আত্মসম্মানে প্রশ্ন তুলেছে তোমাকে ভেঙেচূড়ে দিয়েছে সেই নিষ্ঠুর, জালিম মানুষটির স্মৃতি তুমি কী করে মুছে ফেলবে?’

আদ্রিকা যুক্তি দিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখল, সত্যি সে পরখকে শুদ্ধ প্রেমিকরুপে কল্পনা করতে পারছে না। ভাবতে বসলেই চোখের কোণে ভেসে উঠছে সেই বিরক্তিমাখা দৃষ্টি, ভ্রু কুচকে গম্ভীর মুখে বলা দু চারটে কটু কথা। তবুও আদ্রিকা শেষ চেষ্টা করে অনেক আগ্রহ নিয়ে আবদার করল,

‘আমাকে একবার শুদ্ধতা বলে ডাকবেন?’

পরখের চোখ ভরে এলো জলে। তবে গড়িয়ে পড়তে দিল না। ঢোক গিলে অশান্ত মনটার রেষ টেনে ধরে কেমন মলিন স্বরে বলল,

‘সেই অধিকার আমি হারিয়ে ফেলেছি।’

পরখ দ্রুত সামনের দিকে তাকিয়ে লম্বা লম্বা কদম ফেলে হাঁটতে লাগল৷ তবুও অবাধ্য অশ্রুরা পরখকে বদনাম করতে দু এক ফোঁটা করে গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো।

ভাগ্যিস আদ্রিকার সামনে পড়ার আগেই আড়ালে তাদের নামনিশানা মুছে ফেলল পরখ।

******

পরখ আদ্রিকার বিয়ের ছ মাস পেরিয়েছে মাত্র। এর মাঝেই পরখকে দেশ ছাড়তে হচ্ছে৷ নবদম্পতির বিরহের থেকেও বেশি মন খারাপ হচ্ছে পর্তুলিকার। তাই তিনি এইটুকু সময় আদ্রিকা-পরখকে কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। গতকাল ওরা সন্ধ্যা পেরিয়ে বাড়ি ফিরলেও পর্তুলিকা কিছু বলেননি। পরখ-আদ্রিকার মলিন মুখ দেখে পর্তুলিকারও মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাই আজকে আদ্রিকাকে রান্নাঘরের কাজে হস্তক্ষেপ দিচ্ছেন না। বারবার বলছেন,

‘তুমি ঘরে যাও। দেখো পরখের কিছু লাগবে কিনা।’

পর্তুলিকার জোরাজোরিতে অস্বস্তিতে গাট হয়ে আদ্রিকা ফিরে যাচ্ছে কক্ষে। শেষ সময়ের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। কিছু ছুটে গেল কিনা আবারও চেক করে দেখছে পরখ। দরজায় দাঁড়িয়ে আদ্রিকা জিজ্ঞাসা করল,

‘আপনার কিছু লাগবে?’

কিছুক্ষণ পরপর একই প্রশ্নে পরখও অস্বস্তিতে পড়ে গেল। বলল,

‘নাহ। আ’ম গুড হেয়ার।’

আদ্রিকা মাথা দুলিয়ে ফিরে গেল রান্নাঘরে। সে জানে কিছুক্ষণ পর পর্তুলিকা তাকে আবারও এ কক্ষে পাঠিয়ে দিবেন। কিন্তু পরখের আশেপাশে থাকতে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে আদ্রিকার।
গতকালের বিস্তর আলাপ আলোচনা শেষে পরখের সাথে আদ্রিকার মানসিক দূরত্ব আরও বেড়েছে। মনে হচ্ছে, সব দায় চুকে গেছে। লেনাদেনা সম্পন্ন হওয়ার পরে দুজনেই নির্ভার বোধ করছে। অচেনা অপরিচিত একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে।
গতরাতে একই বিছানায় রাত্রিযাপনের সময় এমনটাই মনে হয়েছে আদ্রিকার।

পরখের কক্ষেই আদ্রিকার জিনিসপত্র রাখা হয়েছে। এটাই এখন আদ্রিকার নিজস্ব নীড়। যেখানে পরখকে অযাচিত কেউ মনে হচ্ছে৷ আজ রাতের ফ্লাইটে পরখ চলে গেলেই যেনো আদ্রিকার স্বস্তি। নিজের কক্ষে হাত পা ছড়িয়ে থাকতে পারবে।

দুপুরের খাবার পর পরখের জন্য কিছু খাবার তৈরি করতে বসলেন পর্তুলিকা। আদ্রিকাও সাহায্য করছিল। পরখ এসে বলল,

‘মা, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।’

পর্তুলিকা অবাক হলেন। বললেন,

‘এই সময় আবার বাইরে কেনো?’

‘একটু কাজ আছে। বেশিক্ষণ লাগবে না। আধাঘন্টা মাত্র। রেস্তোরাঁর সবার থেকে বিদায়ও নিয়ে আসি।’

গুনে গুনে আধাঘন্টা পর ফিরে এলো পরখ। দ্রুত পায়ে কক্ষের দিকে ফিরে যেতে যেতে উঁচু স্বরে ডাকল দিল,

‘আদ্রিকা, ঘরে এসো তো একবার।’

এক ডাকেই আদ্রিকাকে ঠেলেঠুলে কক্ষে পাঠিয়ে দিলেন পর্তুলিকা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কক্ষে এলো আদ্রিকা। শাড়ির আঁচলে ভেজা হাত মুছে দরজা থেকেই জানতে চাইল

‘কী হয়েছে?’

আদ্রিকার বিরক্তি পরখের চোখ এড়ালো না। সে বিছানায় বসে ডাকল,

‘ভেতরে এসো।’

আদ্রিকা দ্বিধান্বিত কদম ফেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। বিছানার উপর কিছু পেপার্স রাখা ছিল। সেগুলো আদ্রিকার হাতে তুলে দিয়ে দিল পরখ। বলল,

‘এগুলো রাখো?’

পেপারের পাতা উলটানো শুরু করে আদ্রিকা বলল,

‘এগুলো কীসের পেপার্স?’

‘প্রোপার্টি পেপার্স।’

আদ্রিকা থমকে গিয়ে পরখের দিকে তাকাল। ওর কুঞ্চিত ভ্রুতে ধৈর্যের স্বল্পতা দেখে পরখ বলল,

‘রসনাবিলাসীতে আমার ফিফটি পার্সেন্ট শেয়ার ছিল। এখন যেহেতু আমি চলে যাচ্ছি, শেয়ারগুলোর আমার প্রয়োজন নেই। ওগুলো আমি তোমার নামে ট্রান্সফার করে দিয়েছি।’

আদ্রিকা থমথমে মুখে বলল,

‘আরেকটা কীসের?’

পরখ মুখ নিচু করে দৃষ্টি লুকিয়ে বলল,

‘আমাদের বাসার।’

আদ্রিকার কপালে সমান্তরাল দুটো ভাঁজ পড়লো৷ বলল,

‘মানে?’

‘ভাড়া বাড়িটা ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে জনার্দন রায়ের সাথে যখন কথা হয়েছিল উনি বাড়িটি বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলছিলেন। কম দামেই দিচ্ছিলেন। তাই কিনে রাখলাম। রেস্টুরেন্ট থেকে বেশ ভালোই প্রফিট এসেছিল। কিনতে তেমন একটা অসুবিধা হয়নি।’

আদ্রিকা অবাক হলেও ভড়কালো না৷ কপালের ভাঁজ অক্ষুণ্ণ রেখে দ্রুত হাতে কাগজের লেখাগুলো পড়ে নিয়ে মুখ তুলে পরখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

‘আমার নামে কিনলেন?’

পরখ কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে বলল,

‘আমি তো আর ফিরব না। বাড়ি কিনে কী করব! ওটা তোমার দরকার হবে। তোমার কতোগুলো গাছ আছে ওখানে! অন্য কেউ কিনে নিলে গাছগুলো কেটে ফেলত। তাই তোমার নামেই নিলাম। তোমার গাছ তোমার কাছেই থাকল।’

আদ্রিকা শীতল চোখে পরখের চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে রূঢ় স্বরে বলল,

‘দাম দিচ্ছেন?’

পরখ সযত্নে আদ্রিকার হাত দুটো ধরে নরম সুরে বলল,

‘তুমি অযথা রাগ করছ, রূঢ় কথাবার্তা বলছ। আমি তেমন কিছু ভেবে এগুলো তোমাকে দেইনি। যাস্ট দিতে ইচ্ছে হলো তাই দিলাম। তুমি প্লিজ রিজেক্ট করো না।’

আদ্রিকা পেপার্সগুলো গুছিয়ে নিতে নিতে বলল,

‘আপনি কখনো ভেবেচিন্তে কাজ করেন না। করতে ইচ্ছে করলে করে ফেলেন।’

কাগজপত্র গুছিয়ে রেখে আদ্রিকা চলে গেল। ওকে কোনো উচ্চবাচ্য করতে না দেখে পরখ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। শীতল আদ্রিকা যে এতোটা ভয়ানক হতে পারে, পরখ কখনোই ভাবেনি।

*****

রাতের আটটায় ফ্লাইট। সন্ধ্যা হতেই সবাই এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। আদ্রিকার বাড়ি থেকেও সবাই এসেছে। একটি বড় মাইক্রোতে সবাই চেপে বসেছে।

পেছকের সীটে বসে ছিল আদ্রতা এবং আদ্রিকা। বোনের মন খারাপ ভেবে আদ্রতা আদ্রিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

‘তুই আমাদের বাড়িতে গিয়ে থাকলেই পারতি। এখানে একা একা মন খারাপ লাগবে। ওখানে আমরা সবাই আছি।’

আদ্রতার কাঁধে মাথা রেখে আদ্রিকা বলল,

‘পরখ চলে গেলে ও বাড়িতে পিউ মা, বাবা একা হয়ে যাবে। আমাদের বাড়িতে আব্বু, আম্মুর জন্য তুমি আছো। উনাদের জন্য কেউ নেই। আমি সাথে থাকলে উনাদের সঙ্গ দিতে পারবো। উনাদের এভাবে একা ফেলে আমি কীভাবে বাবার বাড়িতে যাই বলো?’

‘বড্ড দায়িত্বশীল হয়েছিস তুই!’

জবাবে আদ্রিকা মুচকি হাসে।

গাড়ি থেকে লাগেজ নিয়ে নামল পরখ৷ কালো জিন্স প্যান্ট, কালো হুডি পরিহিত পরখকে এয়ারপোর্টের লোকজন একবার হলেও ঘুরে তাকিয়ে দেখছে৷ সেই সাথে পরখের আশেপাশে এতো লোকজনও মানুষের কৌতূহলের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সারারাস্তা নিজেকে বুঝ দিয়ে এলেও শেষ মূহুর্তে এসে পর্তুলিকার মমতা বাঁধা মানলো না। রাস্তার মাঝখানে পরখকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।

পর্তুলিকার কান্না উপস্থিত সবার চোখে জল এনে দিয়েছে। পরখ নিজেও বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো৷ শুধু আদ্রিকা জ্বলজ্বল চোখে চেয়ে আছে।

এই কান্নাকাটির পর্বের জন্য হাতে অনেকখানি সময় নিয়ে আগেভাগেই বের হতে বলেছিলেন ইবনূল ইবতেহাজ। যিনি বিদায়কালীন সময়েও ছেলে জড়িয়ে ধরেও উপদেশ দেওয়া বন্ধ করলেন না। আজ অবশ্য পরখের বিরক্ত লাগছে না। কিছু মানুষ উপদেশ দিতে পছন্দ করেন। ইবনূল ইবতেহাজ তাদের মধ্যে একজন। পরখ মেনে নিয়েছে, তার বাবা এমনি।

একে একে সবার থেকে বিদায় নেওয়ার পর এবার আদ্রিকার পালা। পর্তুলিকা সবাইকে ইশারায় সরে যেতে বললেন। দম্পতিকে একলা ছেড়ে সবাই গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

পরখের সামনে দাঁড়িয়ে হাতের নখ খুটছিল আদ্রিকা। কেমন অপ্রস্তুত লাগছে নিজেকে! পরখ নিজেই প্রশ্ন করল,

‘তুমি ঠিক আছো?’

আদ্রিকা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘কেমন লাগছে ঠিক বুঝতে পারছি না।’

প্রসঙ্গ বদলালো পরখ। বলল,

‘আমাদের বাড়িতেই থাকবে তুমি?’

সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আদ্রিকা বলল,

‘আমার এখন অনেক বাড়ি হয়ে গেছে। বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি, নিজের বাড়ি। যখন যেখানে মন চাইবে সেখানে চলে যাবো। কখনো শ্বশুরবাড়িতে রান্নাবান্না করবো, কখনো বাবার বাড়িতে গিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে খাবো। কখনো নিজের বাড়িতে গিয়ে গাছের পরিচর্যা করবো, তো কখনো রেস্তোরাঁয় গিয়ে নতুন রেসিপি ট্রাই করবো। বিন্দাস লাইফ।’

আদ্রিকার সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পরখ বলল,

‘হুম। তোমার দেখছি সুখের জীবন।’

‘একদম।’

‘এসবের মাঝে এখনো পড়াশোনাটা ভুলে বসে আছো।’

আদ্রিকা গা দুলিয়ে হেসে ফেলল। বলল,

‘ওটা আমার জন্য কম্পালসারি নয়। আপনার জন্য ঠিক আছে।’

‘পরীক্ষাটা দিচ্ছ তো?’

‘এতো কষ্ট করে পড়াশোনা করলাম। কেনো দিব না! অবশ্যই দিব।’

‘মন দিয়ে পড়াশোনা করো।’

‘সেম গোস টু ইউ।’

পরখ হালকা হেসে আদ্রিকার সামনে দাঁড়িয়ে পাশে লাগেজটি রেখে আলতোভাবে আদ্রিকাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ভালো থেকো, আদ্রিকা।’

এই একটি কথায় আদ্রিকার সমস্ত শরীর ভেতরে ভেতরে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল৷ সে ভেবেছিল পরখের জন্য মনের সমস্ত দুয়ার বন্ধ হয়ে গিয়েছি। হয়তো সত্যিই গিয়েছিল৷ কিন্তু বিরহের দরজাটি বন্ধ করে দিতে বিধাতা বোধহয় ভুলে গিয়েছেন। না হলে যেখানে ভালোবাসা বাকি নেই, সেখানে বিরহ থাকবে কেনো?

আদ্রিকার প্রশ্নের বিপরীতে মনের ভেতর থেকে কেউ একজন ফিসফিসিয়ে জবাব দিল,

‘নিজেকে বোকা বানানো বন্ধ করো নির্বোধ মেয়ে৷ ভালোবাসার কাঙাল তুমি। তোমার মনের ভালোবাসার দরজা যে কখনো বন্ধ হতে পারে না, সেটা বোধহয় আমি জানি না? তোমার চাপা অভিমান আর কেউ না দেখলেও আমি দেখতে পাচ্ছি।’

‘অভিমান নয়। আমার আত্মসম্মান।’

‘ভালোবাসার থেকেও আত্মসম্মান বেশি গুরুত্বপূর্ণ?’

‘ভালোবাসা ছাড়া বেঁচে থাকা যায়। কিন্তু আত্মসম্মান ছাড়া বেঁচে থাকাটা ভয়ানক অপমানের। আরেকবার অপমানিত হওয়ার শক্তি আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই।’

আদ্রিকার বাহুতে হাত রেখে ধ্যান ভাঙালো পরখ। কোন ফাঁকে পরখের গলায় মুখ গুজে দিয়েছিল আদ্রিকা, সে নিজেও জানে না। তবে পরখের ঘ্রাণে বুদ হয়ে থাকার ইচ্ছেটা অপূর্ণ রাখতে ইচ্ছে হলো না। আলিঙ্গন ছড়ানোর বড্ড তাড়া পরখের। আদ্রিকা ছাড়লো না। গলায় মুখ গুজে রেখেই বলল,

‘আর কিছুক্ষণ থাকুন। আপনার ঘ্রাণ আরেকটু বুকে ভরে নেই।’

আদ্রিকার মুখে এমন কথা শুনে পরখ থমকে গেল।
ওকে জড়িয়ে ধরে মূর্তিমান দাঁড়িয়ে রইলো। মেয়েরা চাইলে মনের কথা কতো সহজে বলে দিতে পারে। যখন যা ইচ্ছে বলে দেয়। কিন্তু ছেলেরা পারে না। পরখের কতো কথা অব্যক্ত রয়ে গেলো!

বুক ভরে ঘ্রাণ নিয়ে আদ্রিকা ঝট করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। চোখ মুখ স্বাভাবিক রেখে বলল,

‘এইটুকু ঘ্রাণ সঞ্চয় করে সারাজীবন হেসে খেলে পাড় করে দিতে পারবো৷ এ জীবনে আর কিছুর প্রয়োজন হবে না। সৃষ্টিকর্তা আমাকে যথেষ্ট দিয়েছেন। আরও কিছু চাইনে৷ এবার কোনো ঝড়ঝাপটা এলেও আমি প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত। আজ আমার জীবনে আপনার প্রয়োজনও ফুরিয়ে গেল।
আপনি নিশ্চিন্তে চলে যান। আমার জন্য আপনাকে আর কোনো ঝামেলায় পড়তে হবে না। আমার অজান্তেই এতোদিন অনেক সাহায্য করেছেন। তার জন্য অনেক ধন্যবাদ,পরখ। আপনি ভালো থাকবেন। সুখে থাকবেন প্লিজ। আমাকে ভালোবেসে আপনি অনেক যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। এবার কিন্তু একটু শান্তিতে থাকার চেষ্টা করবেন।’

আদ্রিকার এমন লম্বা চওড়া ভাষণ শুনে পরখের নাকের ডগায় একটা হাসি খেলে গেল। সে দুপাশে পাশে মাথা দুলিয়ে বলল,

‘আসি?’

আদ্রিকাও হৃদয়ের গভীর থেকে সম্মতি জানিয়ে খুশি মনে বিদায় দিল।

সবার উদ্দেশ্যে হাত উঠিয়ে বিদায় জানালো পরখ। তারপর গুটি গুটি পা ফেলে এগিয়ে চলল এয়ারপোর্টের ভেতরে। কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে পরখের বুকের ভেতর একটা করে ভারী পাথর চাপা পড়তে লাগল। অব্যক্ত কিছু কথা, অপ্রকাশিত কিছু অনুভূতির ভারে পরখের প্রতিটি পদক্ষেপ আরও ভারী বোধ হলো।

পরখ নিজেই নিজেকে অনুরোধ করলো,
‘এখন আর নয় প্লিজ। আমি অনেকদূর এগিয়ে এসেছি।’

কিন্তু মন বেচারা সে কথা শুনবে কেনো৷ সে সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে হু হু করে কেঁদে উঠল। পরখ বাধ্য হলো পিছনে ফিরে তাকাতে।

খানিক দূরেই ক্রিম রংয়ের একটি শাড়ি পরে পরিপাটি আদ্রিকা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। কতোটা নির্বিকার, কতোটা নিশ্চিন্ত! এমনটা হওয়ার কথা ছিল পরখের। অথচ এই মুহূর্তে পরখের চিত্ত অস্থির। দামামা বাজছে বক্ষজুড়ে৷

ওখানেই লাগেজ রেখে লম্বা লম্বা পা ফেলে পরখ ছুটে এলো আদ্রিকার কাছে। আদ্রিকার হাত দুটো দু হাতে বন্দী করে সমস্ত দ্বিধা, শঙ্কা ভুলে আবদার করলো,

‘তুমি আমার জন্য কয়েকটা বছর অপেক্ষা করবে? আমি তোমার কাছে ফিরে আসতে চাই।’

আদ্রিকার চোখে বেয়াদব অশ্রুরা বাসা বাধতে চাইল। কিন্তু আদ্রিকা তাদের তাড়িয়ে দিয়ে চোখ মুখ পাথর স্বরূপ কঠিন করে ফেলে জবাব দিল,

‘আমি আর কারো জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে চাই না, পরখ। নিজের মূল্যবান সময় অন্য কারো প্রতীক্ষায় ব্যয় করতে চাই না।’

আদ্রিকার অশ্রুরা বোধহয় পরখের চোখে জায়গা নিল। পরখের আর্দ্র চোখজোড়ায় বিনীত অনুরোধ। যা সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করলো আদ্রিকা৷ বলল,

‘আপনার দেরী হয়ে যাচ্ছে। ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে।’

পরখের ইচ্ছে করলো বলতে, মিস হয়ে গেলে যাক। আমি কোথাও যাব না৷

কিন্তু চাইলে সে কথা বলা যায় না। মন চাইলেই অনেক কিছু করা যায় না। সময়, সুযোগ, পরিস্থিতির উপর অনেককিছু নির্ভর করে। যেমন এই মুহূর্তে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জেদী, একরোখা মেয়েটিকে পরখের একটি ধমক দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে তা দিতে পারলো না। উল্টো আদ্রিকাকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ভারী গলায় বলল,

‘শেষবারের মতো আমার জন্য কয়েকটা বছর অপেক্ষা করো প্লিজ।’

আদ্রিকা নিজ সিদ্ধান্তে অনড় রইলো। জীবনের দেড়টা বছর সে কিছু হৃদয়হীন ব্যক্তির পেছনে ব্যয় করেছে। আর নয়৷ সে শক্তভাবেই জবাব দিল,

‘সম্ভব নয়।’

পরখ আদ্রিকার কানের কাছে মুখ নামিয়ে ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, শুদ্ধতা। তোমাকে সেই ভালোবাসার দোহাই। আমার জন্য অপেক্ষা করো। আমি দ্রুত ফিরবো তোমার কাছে৷ সব মান অভিমানের হিসাব চুকিয়ে দিব।’

আদ্রিকার বরফ শীতল হৃদয়ে উষ্ণতা এসে ছুঁয়ে দিল। মোমের তাপের মতো ধীমে উত্তাপে হৃদয়ের সমস্ত অভিমান গলে যাওয়ার আগেই চোখজোড়া বন্ধ করে আদ্রিকা বলল,

‘কারো ভালোবাসা আমার চাই না। আপনার প্রতি আমার আর কোনো প্রেমপ্রীতি বোধ নেই।’

‘আমার চাই। তোমার ভালোবাসা ফিরে চাই। আমার দীর্ঘ অপেক্ষার সমাপ্তি চাই। আমি ফিরে এসে প্রেম-প্রীতিবোধ জাগ্রত করার অনেক অনেক কারণ দিব। তুমি শুধু একটু অপেক্ষা করো। তোমার তুলনায় আমি কিন্তু অনেক বেশি অপেক্ষা করেছি৷ এবার তুমি আরও কয়েকটি বছর অপেক্ষা করে অপেক্ষার পরিমাণ সমান সমান করে দেও।’

‘আমি পারবো না। অপেক্ষার পথ অনেক যাতনার। সেই পথ পাড়ি দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই।’

পরখ আলিঙ্গন ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মুদিত চক্ষুর আদ্রিকার অভিমানী ঠোঁটে দীর্ঘ চুমু এঁকে বলল,

‘আমি জানি তুমি পারবে।’

যেভাবে এসেছিল সেভাবেই দ্রুত পায়ে ফিরে গেলো পরখ। অভিমানী প্রেয়সীর মুখে ভালোবাসা মিশ্রিত দুটো বাণী শোনার তৃষ্ণা বুকে অমলিন রইলো।

আদ্রিকা চোখ খুলে পরখকে দূর হতে আরও দূরে সরে যেতে দেখল। পরখ দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেলেও আদ্রিকা যেখানে ভাবলেশহীন দাঁড়িয়ে রইলো।

আদ্রতা ছুটে এসে আদ্রিকার কাঁধে হাত রাখতেই পাথরমূর্তি ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়লো। আদ্রতার বুকে মুখ গুজে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল আদ্রিকা। অস্পষ্ট স্বরে বিড়বিড় করতে থাকল,

‘আমি কারো অপেক্ষায় থাকব না। ওই স্বার্থপরের অপেক্ষায় তো একদমই না।’

আদ্রিকাকে কোনোরকমে গাড়ির কাছে নিয়ে গেল আদ্রতা। ওখানে কেউ আদ্রিকাকে কেউ বাঁধা দিল না। সবাই দেখল কয়েকদিন ধরে আদ্রিকার লুকায়িত কষ্টরা আজ বাঁধ ভেঙেছে। তবে ওরা কেউ কান্নার মূল কারণ বুঝতে পারল না।

যে বুঝতে পারত সে একটি মস্ত বড় প্লেনের উইনডো সীটে বসে দু হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। আশেপাশের সকল যাত্রী অবাক হয়ে দেখছে একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক কীভাবে মন উজার করে কাঁদছে! চোখের জলে কীভাবে ধুয়ে যাচ্ছে তার গ্লানি, আফসোস, হতাশা৷ দেশের সাথে বাড়ন্ত দূরত্বের সাথে বাড়ছে তার ভালোবাসার তৃষ্ণা, প্রেয়সীকে বুকে ফিরে পাওয়ার আকাংঙ্ক্ষা।

সমাপ্ত।