প্রাণোদাহ পর্ব-১৮

0
76

#প্রাণোদাহ
|১৮|
– নবনীতা শেখ

-“তবে তাকে বোলো, তোমার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে ফ্যামিলি থেকে। এরপর তার প্রতিক্রিয়া আমাকে জানিয়ো। সে তোমার প্রেমিক হিসেবে তখনই পার্ফেক্ট, যখন তোমার দায়িত্ব নেওয়ার প্রসঙ্গে দু’বার তার ভাবা লাগবে না।”

নীহম ক্লান্ত গলায় বলল,
-“ঠিক আছে, আম্মু। তবে কিছুদিন পর জানাই। অন্তত এক সপ্তাহ লাগবে আমার নিজেকে রেডি করতে। নয়তো এখন যদি সে রাজি হয়ে যায়, তখন মুসিবতে পড়া লাগবে।”

স্মরণ কোনো হাই হ্যালো করল না। সোজা বলে উঠল,
-“নীহম? লেটস গেট ম্যারিড..”

নীহম শেফার দিকে তাকাল। ফোনটা মিউট করে বলল,
-“আম্মু, প্রপোজাল দিচ্ছে! কী করব?”
-“কথা বলো। তোমার যা ইচ্ছে হয়, তাই বলো।”
-“আমি বুঝতে পারছি না।”
-“তুমি কি ওকে চাও না?”
-“চাই।”
-“বিয়ে করতে চাও না?”
-“চাই।”
-“নিশ্চিত?”

নীহম চাপা শ্বাস ফেলে বলল,
-“ওকে ছাড়া কাউকেই বিয়ে করব না। আর ও আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে গেলে, ওকে আস্ত রাখব না।”

শেফা হাসলেন,
-“তবে দ্বিধা কীসের? যাও।”

নীহম শেফা আর মোহর থেকে খানিকটা দূরত্ব বাড়িয়ে ছাদের অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়াল। চাপাস্বরে স্মরণকে শুধাল,
-“আর ইউ শিওর?”

স্মরণ ভাবার জন্য এক মিলিসেকেন্ডেরও সময় নিল না। পালটা প্রশ্নে বলল,
-“কেন? তোমার বিয়ের বয়স হয়নি?”
-“হয়েছে।”
-“তোমার বিয়ের বয়স হয়েছে, এদিকে আমার প্রেমের বয়স নেই। বেটার টু গেট ম্যারিড।”

নীহম সময় নিল। ভাবল। এ ধারের মিনিট তিনেকের নীরবতায় স্মরণ থমকাল। দ্বিধান্বিত গলায় শুধাল,
-“তুমি কি বিয়ের জন্য এনাফ প্রিপেয়ার্ড নও?”
-“এটা আমার জন্য কোনো কারণই না।”
-“তবে?”
-“আমি ভাবছিলাম, বিয়েতে লেহেঙ্গা পরব নাকি শাড়ি!”

নীহম এ কথা বলে হেসে ফেলল। পরপরই আবার বলল,
-“এই ফ্রাইডেতেই বিয়ে করব। সব ম্যানেজ করো, স্মরণ।”
-“সব ম্যানেজ হয়ে যাবে।”

_______
অতসীর ওখান থেকে নক্ষত্র প্রীতির হাত শক্ত করে চেপে ধরল, নিয়ে গেল নিজের রুমে। প্রীতি আঁতকে উঠল,
-“কেউ দেখে ফেলতে পারে!”
-“দেখুক।”

নক্ষত্রের যা হচ্ছে হতে থাকুক মনোভাবটা প্রীতির সবসময় ভালো লাগলেও, আজ ভীষণ লজ্জা লাগছে। তার ধারণা, লজ্জাটা মুখের মধ্যে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নক্ষত্র রুমের ভেতরে এসেও প্রীতির হাত ছাড়ল না। একহাতে প্রীতিকে ধরে হেলান দিয়ে দাঁড়াল দরজায়৷ খট করে শব্দ হয়ে দরজা আটকে গেল৷ আরও একদফায় আঁতকে উঠল প্রীতি। নক্ষত্রের মুখাবয়ব বেশ গম্ভীর। প্রীতি জিজ্ঞেস করল,
-“কী হচ্ছে?”
-“সেটা তো আমি জিজ্ঞেস করব, প্রীতিলতা।”
-“কী জিজ্ঞেস করবেন?”
-“কী কথা হচ্ছিল ওর সাথে?”
-“তা আপনার জেনে কাজ নেই।”
-“সেটা না-হয় জানার পর আমি নিজে বুঝে নেব।”

প্রীতি চাপা শ্বাস ফেলল। নতমুখী হয়ে থেকে হাসল। কিঞ্চিৎ দুঃখবোধের সাথে বলে উঠল,
-“আপনি আমাকে কেন সবটা বলেননি?”
-“ভেবেছিলাম, তোমার জানার প্রয়োজন নেই ওসব।”
-“অথচ প্রয়োজন পড়ল তো!”
-“কেমন প্রয়োজন?”

প্রীতি তাকাল নক্ষত্রের দিকে, নিজ থেকে এগিয়ে এলো আরও এক কদম,
-“আপনার কি মনে হয় না, অজানা পথে হাঁটার চেয়ে চেনা পথে এগোলে লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজ বেশি হয়?”
-“কী কথা হয়েছে?”
-“ছাড়ুন! বিশেষ কিছু নয়। আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না, নয়তো সব বলার মতো গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না। এখনো আমি আপনার কম্ফোর্টজোনে নেই।”
-“প্রীতিল..”
-“না জেনে, না বুঝে আমি ঠিক কতটা পারব? কতক্ষণ পারব আপনার পক্ষপাতিত্ব করতে?”

নক্ষত্র অধৈর্য হতে লাগল,
-“আজ কী কী হয়েছে?”

প্রীতি প্রলম্বিত শ্বাস টেনে নক্ষত্রের গালে হাত রাখল। স্মিত হেসে বলল,
-“দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে ভুল বুঝিনি। আপনি আমাকে সেদিন বলেছিলেন না যে, ইউ আর মাইন। এই কথাটার খেলাফ করার আগ অবধি আপনাকে আমি নিজের কাছে ভীষণ যত্নে রাখব। বোঝা গেল?”

নক্ষত্রের চাহনি শীতল হয়ে এলো। সে উপর-নীচ মাথা নাড়ল। প্রীতি গালে রাখা হাতটার দিকে একবার তাকাল, তারপর নক্ষত্রের চোখের দিকে,
-“আপনার প্রাক্তন সে। আমি তাকে নিয়ে কিছু জানতে চাই না, কখনো চাইবও না। আপনাদের মধ্যে একসময় প্রেমের সম্পর্ক ছিল, আপনারা অনেক ক্লোজ ছিলেন। কাজেই অনেক কিছু হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আমি সেসব শুনে মন খারাপ করতে চাই না। যা চাই, তা হলো..”
-“কী চাও?”
-“সত্যি জানতে চাই। আপনি আমায় ভালোবাসেন?”
-“এখনই বলা লাগবে?”
-“পরে বললে উত্তর পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা আছে?”
-“হয়তো।”
-“তাহলে সময় নিন।”

প্রীতি হাত সরিয়ে নিল নিজের। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল নক্ষত্রের রুমের সবকিছু। নক্ষত্র একই ভঙ্গিমায় দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকিয়ে রয়েছে প্রীতির দিকে। তার চাহনি একজনেতে স্থির। তার দেখা শেষ হয় না। একপর্যায়ে তার চোখ ছোট হয়ে আসে, কার্ণিশে হাসির ভাঁজ পড়ে। সে বিরবির করে বলে,
-“এখন জানতে চাইলে, ভালোবাসার বিপরীতে এখন কেবল ভালোবাসিটুকুই বলতে পারতাম। সঠিক সময় আসুক, শব্দে উচ্চারণ করার প্রয়োজন পড়বে না—তোমায় আমি এতটা ভালোবাসব..”

_____________
ধীরে ধীরে গড়িয়ে এলো নক্ষত্রের আকদের দিন। ঘরোয়া আয়োজনে বিয়ে হবে বিধায় যাদেরকে না এলেই নয়, কেবল তাদেরই আসার কথা হলো। ও বাড়ি থেকে, নক্ষত্রের বাবা-মা, স্মরণ আর নক্ষত্র আসবে। এ বাড়ি থেকে প্রীতির পরিবার। দেখা গেল প্রীতির পরিবারের মানুষই সতেরোজন। পৌলি পেটে কথা চেপে রাখতে পারেন না। আবার বিয়ে হবে, দাওয়াত দেবে না এমন কথাও বাপের বাড়িতে বলতে পারেননি। তাই বলেছেন যে, দেখতে আসবে কেবল।

ব্যস! সবার এত আদরের মেয়েকে দেখতে আসবে কারা, এটাও তো দেখার মতো বিষয়। কাজেই অবিবাহিত বাদে, মোটামুটি বাড়ির সবাই এসে হাজির। ওদিকে বরের বাড়ি থেকে চার/পাঁচজন আসার কথা থাকলেও এসেছে বরসহ মাত্র তিনজন। এ কেমন বিয়ে! এ কেমন কী!

বিয়ের পর বর-কনে নিজেদের বাড়িতে থাকবে। এরপর অনুষ্ঠান করে কনেকে বরের হাতে তুলে দেওয়া হবে। এমন ভাবনা নিয়ে বিয়ে পড়ানো হলেও বিয়ের পর প্রীতি ভরা আসরে বলে ফেলল,
-“আমি শ্বশুরবাড়ির ভাত খেতে চাই। তাই তোমরা আমাকে আজই বিদায় করো।”

প্রীতির মা পৌলি মেয়ের এমন নির্লজ্জতায় কথা বলতে ভুলে যান। তার ইচ্ছে করল কী যে, একবার গিয়ে মেয়েটাকে ঠাটিয়ে ক’টা চড়-থাপ্পড় মারা যাক। কিন্তু এত এত লোকের সামনে তা করতে সংকোচ করল বিধায় তিনি নিজেকে সামলালেন। দাঁতে দাঁত পিষে বলার চেষ্টা করলেন, নক্ষত্রকে আজ এ বাড়িতে রেখে দেবো, এটাই নিয়ম।

নাহ! প্রীতি সে কথাকে পাত্তাই দিলো না। শক্ত গলায় বলল,
-“আমার শ্বশুরবাড়িতে ঘুমানোর শখ জেগেছে। শখ জাগ্রত হলে, শখকে ঘুমাতে বলতে নেই। শ্বশুরবাড়িতে ঘুমানোর মাধ্যমে শখকে খুশি করা লাগে।”

ওর আবল-তাবল লজিকে নক্ষত্রের মতো গম্ভীর ভদ্রলোকও এত এত মানুষের সামনে শব্দ করে হেসে ওঠে। অবশেষে তার বিদায় হয়। সারাক্ষণ ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না করতে থাকা প্রীতি, বিদায়কালে একটুও কান্না করেনি। বরঞ্চ শক্ত করে চেপে ধরে তার পারিবারিকভাবে ঠিক করে দেওয়া স্বল্পপরিচিত বরের হাত।

নক্ষত্র তা নিয়ে মোটেও রসিকতা করে না। যে হাত প্রীতি একবার ধরতে পেরেছে, সেই হাতটা সে কখনো ছাড়বে না বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, সে কথা প্রীতি অল্প অল্প করে জানবে।

এ বাড়িতে যা হলো, তাকে গণ্ডগোল বলা যায় কি? যায় না বোধহয়। তবে অস্বাভাবিক ও অদ্ভুত পরিবেশ যে তৈরি হয়েছিল, তা অনস্বীকার্য। গণ্ডগোল ঘটল বাড়িতে ফিরে। প্রীতির গৃহপ্রবেশের সময়ই স্মরণ ও নীহমের আগমন ঘটে।

নিজেদের যেই ছেলের পাশে শৈশবে কোনো মেয়ে বন্ধু অবধি দেখেনি তারা, কৈশোর-যৌবন কেটেছে সম্পূর্ণ নারীসঙ্গহীনতায়—তাদের সেই ছেলেটা আজ একজন সুন্দর মেয়ের হাত ধরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। নুরনাহার ও তৌহিদ সাহেব ইতোমধ্যে ধারণা করেছেন, মেয়েটা স্মরণের সেই একতরফা প্রেম। বোধহয় প্রপোজ-ট্রপোজ হয়ে গেছে। এখন সম্ভবত সম্পর্কে আছে। আজ এটা জানাবে। অথচ মেয়েটা পরে আছে ঘিয়ে রঙের জামদানি। এত ফর্মাল হতে কে বলেছে!

তাদের ধারণাকে ১৮০° এঙ্গেলে উলটে দিয়ে স্মরণ জানাল,
-“বিয়ে করে ফেলেছি।”

একের পর এক যা ঘটে যাচ্ছে, তাতে করে বোধহয় না এখনো পরিবেশকে স্বাভাবিক বলা যায়। প্রীতিলতা অবাক হলো না। এই মেয়েকে সে একটু একটু চেনে। আর নক্ষত্র? সে স্মরণের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
-“সাব্বাশ, ব্রো! অনেক কাজের কাজ করেছ।”

তৌহিদ সাহেব বুকে হাত রেখে ডলতে লাগল, ক্লান্ত গলায় বলল,
-“হারামজাদাকে কেউ দুটো থাপ্পড় লাগাও তো।”

স্মরণ জবাবে ক্রুর হাসল,
-“হিংসুটে বাবা আমার, বহুত জ্বালিয়েছ তুমি আর তোমার বউ মিলে। এবার আমারও সুন্দরী বউ হয়েছে।”
-“তা বিয়ে করতে চাস আগে বললেই হতো। সব ব্যবস্থা করতাম।”
-“কাইন্ড অভ ফ্যান্টাসি বলতে পারো। পালিয়ে বিয়ে করলে কেমন লাগে, দেখতে চাইছিলাম।”
-“ওর পরিবারের কেউ জানে?”
-“এখনো না।”
-“যা করেছ দু’জনে মিলে। বহুত পেরেশানি যাবে আমার, সব সামলাতে।”

এ কথায় স্মরণ কেবল হাসল। নুরনাহার এগিয়ে এলেন নীহমের মুখোমুখি। নীহম হাসল,
-“আসসালামু আলাইকুম। আমি নীহম।”

নুরনাহার সালামের জবাব নিল। তারপর জড়িয়ে ধরল একহাতে। মিষ্টি করে হেসে বলল,
-“কী একটা অবস্থা! এক চাঁদ আনতে না আনতে আমার বাড়িতে আরও এক চন্দ্রের পা পড়ল৷ পরম সৌভাগ্য আমার!”

তিনি দুইবৌকে একসাথে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। আজ যা কিছু হচ্ছে, সবই অদ্ভুত। অদ্ভুত প্রশান্তিদায়ক। তবে সামনে যা হতে যাচ্ছে, সেটুকু কেমন হবে? সবকিছু সবসময় সমপরিমাণে শান্তিময়ভাবে এগোয় না যে..

চলবে…