প্রাণোদাহ পর্ব-১৯ এবং শেষ পর্ব

0
190

#প্রাণোদাহ
|১৯|
– নবনীতা শেখ

নীহম বাবা-মাকে জানিয়েছে। মা আসেনি, আসবে না। তবে বাবা এসেছে। নীহমের হুটহাট অনেক ধরনের পাগলামোর মধ্যে এই অকস্মাৎ বিয়েটা সবচেয়ে বড়ো ছিল। যদি আগে ভালো থাকত, আর এখন এমন হুট করে বিয়ে বসার মতো কাজ করত—তবে চমকানোর সুযোগ থাকত। অথচ নীহম নিয়মিত অল্প অল্প করে বিষ খাইয়ে তাদের অভ্যস্ত করিয়ে রেখেছে, যার ফলাফল স্বরূপ এক গামলা বিষ দিয়ে আপাদমস্তক পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও শক্ত-পোক্ত শরীরে স্থির দাঁড়িয়ে আলফাজ সাহেব মেয়ের শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে রীতিমতো হাসি ঠাট্টা করে যাচ্ছেন। মোটেও অবাক হননি, মেয়েকে কিছু বলেনওনি। কেবল অতিষ্ঠ ভঙ্গিমায় দুয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন মাঝেমধ্যে, যা প্রায় সবারই দৃষ্টিগোচর।

আলফাজ আন্তরিকতার সাথে হাসলেন, খানিকটা লজ্জিত গলায় বললেন,
-“ছেলে-মেয়েরা যা কাণ্ড করল! আমি হাসব না-কি কাঁদব বুঝতে পারছি না। কী যে করি এখন!”

তৌহিদ সাহেব বললেন,
-“আরেহ বেহাই সাহেব, লজ্জার কী আছে। লজ্জা তো আমার হতচ্ছাড়ার পাওয়া উচিত। মামনি বাচ্চা মানুষ, বয়স কম। কিন্তু এ? বুড়ো বয়সে তিনি রঙ্গ করে বেড়াচ্ছেন!”
-“কাউকে দোষ দিয়ে আর কী হবে, বলেন? এর চেয়ে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা করলে ভালো হয়।”

তৌহিদ সাহেব সহমত পোষণ করলেন। ঠিক করা হলো, সামনের শুক্রবারেই বিয়ের অনুষ্ঠান করে মেয়েকে তুলে দেওয়া হবে৷ এর আগ অবধি নীহমকে তার বাবার বাড়িতে থাকতে হবে। সে চাইলে মায়ের বাড়িতেও থাকতে পারে। সবটা তার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করবে।

নীহমের কাছে জানতে চাইলে সে বলল,
-“এক জায়গায় থাকলেই হলো, বাবা। তুমি বললে এখানেও থাকতে পারি। আফটার অল, শ্বশুরবাড়ি। ঠিক না, শ্বশুরমশাই?”

তৌহিদ সাহেব নীহমের কথা শুনে ভীষণ হাসলেন। অবশেষে নীহম বাবার সাথে ফিরে গেল। আর যাওয়ার আগে স্মরণকে বলে গেল, “যেই লোকটা আমার সকল অসম্ভব ও পাগলাটে ইচ্ছে-অনিচ্ছের গুরুত্ব এভাবে দেয়, তাকে আমি কখনো হারাতে চাই না। থ্যাংকস ফর বিইং মাইন। প্লিজ, স্টে মাইন…”

________
দীর্ঘক্ষণ ধরে বাসর ঘরে বসে রয়েছে প্রীতি। দু’চোখে নিষ্ক্রিয়তা আর তন্দ্রা মিলেমিশে গান গাইছে। তার বয়স আজ আঠারো হলো। জন্মদিনেই বিয়েরদিন। কী সুন্দর কথা না!

এত সুন্দর কথাতে প্রীতির খুশি হওয়া উচিত। অথচ সে খুশি হতে পারছে না। কী চেয়েছিল জীবনে আর কী পেয়েছে, সেসবের হিসেব মেলাতে বসে গেল। আর প্রথমেই মনে পড়ল, স্কুল ইউনিফর্মের রংটা নীল হওয়ায় তার মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে কান্না করাটা। সে কাঁদতে কাঁদতে নাকের পানি চোখের পানি এক করে কেবল এটাই বলেছিল, “বাবা! আমাকে পিংক ইউনিফর্ম বানিয়ে দাও। আমি পিংক পরব।”

বাবা পিংক ইউনিফর্ম এনে দিতে পারেনি, তাই বলেছিল,
-“সোনা মা আমার, সবসময় তুমি যা চাইবে তা পাওয়ার চেষ্টা করবে। সর্বোচ্চ চেষ্টাতেও যখন না পাবে, তখন কম্প্রোমাইজ করবে। ডু ইউ নো, হোয়াট আই মিন টু সে কম্প্রোমাইজ?”
-“আই ডোন্ট নো, বাবা।”
-“বাবা বোঝাচ্ছি, শোনো। কম্প্রোমাইজের বাংলা হচ্ছে আপোষ। আপোষ হচ্ছে যখন আমরা মানিয়ে নিই বা মেনে নিই।”
-“বুঝতে পারছি না, বাবা।”
-“বোঝার জন্য তুমি এখনো ছোট যে।”
-“বাবা, আমি মোটেও ছোট নই। একটু বুঝিয়ে বললেই বুঝি। তোমরা আমাকে স্কুলে ভর্তির সময় তো এ-ই বলেছিলে, আমি বড়ো হয়ে গেছি।”
-“মামনি আমার, বড়ো হওয়া অনেক কঠিন। যেই আপোষটা তুমি এখন বুঝতে পারছ না, তখন সেটা করতে হবে। বার বার, প্রতিবার, একাধিকবার।”
-“কিন্তু কেন?”
-“সেটা এখন বুঝবে না।”
-“উফফো, বাবা! আমি বড়ো হয়েছি, সব বুঝি।”
-“তাহলে আপাতত এই স্কুল ইউনিফর্মকে মেনে নাও ও মানিয়ে নাও।”

প্রীতি সেই যে প্রথমবার আপোষে এলো, আর তারপর আসতেই থাকল। একবার আপোষ করা শিখে গেলে, জীবন কাউকে থামিয়ে রাখতে পারে না। তারপর একদিন বুঝতে পারল, বাবা কেন বলেছিল—বড়ো হওয়া অনেক কঠিন!
আর এই বুঝতে পারার মধ্যে দিয়েই প্রীতিও এগিয়ে গেল সময়ের বহমান জলরাশির সাথে। এর মধ্যে ভেসে পেছনে চলে গেল কত কিছু, কত কী…

স্কুল ইউনিফর্ম, প্রিয় খেলনা, ফার্স্ট বেঞ্চের একটা সিট, রোল এক—এসব থেকে শুরু হলো হারানোর মৌসুম। তারপর আচমকা প্রীতি টের পেল, সে বন্ধু হারানো শুরু করেছে। মানুষ হারানোর মৌসুম বড়ো ভয়াবহভাবে হৃদয় রোপিত গাছগুলোর ক্ষয়সাধন করে। এ মৌসুমে ঝড় হয় না, এ মৌসুমে আগুন জ্বলে না। এ মৌসুমে যা হয়, তা হলো কেবলই সবকিছুর ধ্বংস। কীভাবে কী হচ্ছে টের পাওয়ার আগেই সবকিছু শেষ হয়ে যায়। মানুষ হারিয়ে ফেলার সময়কালে যখন হুট করেই বুকের ভেতরটা অস্থির হতে লাগে, নিঃশ্বাস গলায় আটকে আসে, অবর্ণনীয় সেই কষ্টগুলো মৃত্যু যন্ত্রণা দিয়ে যায় প্রতিনিয়ত।

এরপর জীবনের এই আঠারোটা বছরে সে দেখে ফেলল গোটা দুনিয়া। এই প্রথমবার সে হারানোর বদলে কিছু পেয়েছে। সেই কিছু একটা তার শখের, ভীষণ রকম নিজের। হারানোর এই দুনিয়ায় কিছু পাওয়ার মতো ভাগ্য তারও হয়েছে। তার কি খুশি হওয়া উচিত? নাকি অনিয়মে ভয় ও সময়ের চক্রান্তে আতঙ্কিত হওয়া উচিত? কিছু বুঝতে পারল না। বোঝার চেষ্টাও করল না। দরজা লাগানোর শব্দে স্থির হলো, শান্ত হলো, আড়চোখে আরেকবার দেখে নিল প্রিয় স্বামীকে।

নক্ষত্র প্রীতির সামনে এসে বসল। আর অনেকটা সময় ধরে বসেই রইল। নতমুখী প্রীতি চোখ তুলে তাকাল। একগাল হেসে বলল,
-“চোখ দিয়ে গিলে খাওয়া স্বামী পেয়েছি, কী সৌভাগ্য আমার!”

খানিকটা লজ্জা দিতেই না-কি কী যেন, নক্ষত্র তর্জনী ও মধ্যমার সম্মুখ প্রান্ত দিয়ে প্রীতির চিবুক খানিকটা উঁচুতে তুলল। হাস্কি আওয়াজে জিজ্ঞেস করল,
-“ডু ইউ ওয়ান্ট সামথিং এলস অর সামথিং মোর?”

প্রীতি লজ্জা তো পেলই না, উলটো আবেশিত চোখ দুটো নক্ষত্রের দু’চোখে ফেলে রেখে বিরবির করে বলল,
-“আই ওয়ান্ট এভরি সিঙ্গেল থিং অ্যাবাউট ইউ।”
-“আমার ভীষণ সাহসী প্রীতিলতা!”

প্রীতি অধর এলিয়ে হাসল। টুপ করে চুমু খেলো নক্ষত্রের নাকে। তারপর ঠোঁটে। নক্ষত্রকে অবাক হওয়ার সুযোগ না দিয়েই বলল,
-“চোক্ষে আকুল তৃষ্ণা মোর, গলাতে সুখ আবহ,
তব প্রাণেতে ওদাহ, কী জ্বালা মোর প্রাণোদাহ!”

নক্ষত্র প্রীতির চোখে চুমু খেয়ে বলল,
-“প্রাণোদাহ?”
-“তোমার জন্য পরাণ পোড়ে।”

সে রাতটা বড়ো অদ্ভুতভাবে কাটল। কেবল দেখে আর কিছু শুষ্ক চুমু খেয়েই। নক্ষত্র হাভাতের মতো করে দেখে গেল প্রীতিলতাকে। তার ধারণা, এত কাছ থেকে এত মুগ্ধতা নিয়ে গোটা এক রাত এই শ্যামাকে উৎসর্গ না করলে তার বড়ো পাপ হয়ে যাবে। এমন পাপ সে করতে পারে না। সে করবে না। সারারাত প্রীতিও তাতে বিরক্তবোধ করেনি। সবকিছু স্বাভাবিক, সবভাবেই স্বাভাবিক।

তাদের দিন কাটতে লাগল এমনভাবেই। সুখে, অসুখে, উদ্দীপ্ত প্রাণে, প্রাণের দাহ্যে কীভাবে কীভাবে যেন সময় কেটে যেতে লাগল। দেখা মিলল জটিল সমীকরণের। একপাশে পড়ে রইল একাকী অতসী।

অতসী মেয়েটা এখনো আগের মতোই হাসে, সবকিছু মেনে নেয়, মানিয়ে নেয়। তবে একাকী। ইউকেতে আর ফেরেনি। ঢাকাতেই একটা বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করছে সে। সেখানে পরিচয় হয়েছে রাদিন আহনাফ রউফ নামক এক লোকের সাথে। লোকটাকে ভদ্রলোক বলা উচিত, অথচ অতসী বলতে পারে না। কোনোরকম অভদ্রতা কোনোদিন সে করেওনি। তবু এই যে, সবসময় অতসীকে নজরে নজরে রাখে, কিছু প্রয়োজন হওয়ামাত্র বলার আগেই এনে সামনে রেখে দেয়, আগে-পিছে থাকে—এসব অতসীর কাছে বাড়াবাড়ি লাগে। তবে কিছু বলতে পারে না। চুপ থাকে, এড়িয়ে যায়।

কিছুদিন পর দেখা গেল, তার এই এড়িয়ে যাওয়া ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃতভাবে রউফকে বোঝানো সত্ত্বেও তার খুব একটা পরিবর্তন হচ্ছে না। সে সারাক্ষণ নিজের পাহারাদারিতে ব্যস্ত। একদিন অবশ্য অতসী সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসল,
-“মিস্টার আহনাফ, এগুলো কী হচ্ছে? আপনাকে আমি এনাফ ম্যাচিউর ভেবেছি, তবে এসব ছেলেমানুষী কেন? আমি ডিস্টার্বড হচ্ছি। বুঝতে পারছেন না?”

রউফ দু-ধারে মাথা নেড়ে নেতিবাচকতায় বলেছিল,
-“আমার জানামতে আমি আপনাকে সরাসরি কোনো ইঙ্গিত দিইনি, ম্যাডাম। ধারণা থেকে এতসব অপবাদ দিতে পারেন না।”

অতসী তখন থমকে যায়। রউফের কথাটা শতভাগ শুদ্ধ। সে আসলেই কোনো ইঙ্গিত দেয়নি। ব্যাপারটাকে সম্পূর্ণ মনের ভুল ভেবে অতসী যখনই একপাশে ফেলতে যাবে, রউফ তখন পৃথিবী এলোমেলো করা এক হাসি দিয়ে বলে উঠল,
-“ইউ গ্যেস কারেক্ট, ম্যাডাম। আপনি আমার না হলেও, আ’ম অল ইয়োর্স। সময় নিন। চাপ নেই। বাট রিমেম্বার দ্যাট—আমি আপনার পিছু কখনো ছাড়ছি না, তা আপনি দেশান্তরিই হন না কেন…”

অতসীর মাথা ঘোরাতে থাকে তখন। এই পুরুষের চোখের মধ্যে সেই সকল অনুভূতি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে, যা অন্য একজনের চোখে দেখতে পাওয়ার জন্য কতই না মরিয়া হয়েছিল!

চলতি পথের এক বিস্ময়কর ধাক্কা হচ্ছে—আমাদের মানুষটাকে অন্য কেউ ভালোবাসবে, অন্য কারো মানুষকে আমরা ভালোবাসব, ভালোবাসার মানুষটা অন্য কারো হয়ে যাবে কিংবা এমন কেউ আমাদের হবে, যাকে ভালোবাসি না। এটাই নিয়ম, অলিখিত চুক্তিতে অনুভূতির গল্প। কোনো দুই প্রাণের গল্পে আমরা তৃতীয় ব্যক্তি, আবার আমাদের নিয়েও কোনো একজনের গল্প সাজানো হবে।
কী অদ্ভুত! না? জীবন আমাদের যতই একপাশে ফেলে রাখুক না কেন, আমরা সবাই কারো না কারো গল্পের মূল চরিত্র। কারো সামান্য চাহনিতেও বুকটা এফোড়-ওফোড় হয়, দু-টুকরো কথায় শুরু হয়ে যায় প্রাণেতে দহন…

সমাপ্ত