আলোছায়াতে প্রণয়াসক্তি পর্ব-০৬

0
1633

#copyrightalert❌🚫
#আলোছায়াতে_প্রণয়াসক্তি
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৬
আলফির দৃষ্টি সম্মুখে স্থির ও কঠোর। নিঝুম ভড়কানো স্বরে বলে,
“কী হলো? গাড়ি এভাবে ব্রেক করলে কেন?”

তখনি গাড়ির গ্লাসে টোকা পড়লো। নিঝুম সচকিতে নিজের পাশের গ্লাস খুলল। এক বৃদ্ধা এক ৪-৫ বছরের বাচ্চাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে আলফিকে ধন্যবাদ দিলো। এও বলল, তার নাতি তারই অসাবধানতার কারণে রাস্তার মাঝে চলে এসেছিল। নিঝুম ও আলফি বৃদ্ধা মহিলাটির সাথে সৌজন্যে কথোপকথন শেষ করে। আলফি গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলে,
“কারও সম্পর্কে লোকমুখে রিউমার শুনে জাজ না করে নিজে যাচাই করো।”

নিঝুম সন্দিহান হয়ে চায়। অতঃপর তার মুখে বিরক্তি ফুটে উঠে। বলে,
“লোকে কি আর মিথ্যে বলে? আর একটা মেয়ে নিজের সম্মান নিয়ে মিথ্যে বলবেই বা কেন?”

আলফি আর জবাব দিলো না। সে গাড়ি চালানোতে মনোযোগ দিলো। নিঝুমও গাড়ির জানালা দিয়ে সদ্য নামা সায়াহ্ন দেখতে মগ্ন। একটু একটু করে আঁধার নেমে এলো ধরণীর বুকে। রাস্তার ধারের স্ট্রিট লাইটগুলো জ্বলে উঠলো। আস্তে আস্তে ওরা আলফির বাড়ির রাস্তা ধরলো। জায়গাটা কিছুটা নিরিবিলি। আলফির বাড়িটা ঘনবসতি থেকে একটু দূরে। প্রকৃতির কাছাকাছিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি এসে থামলো। আলফি রিমোট দিয়ে বাড়ির গেইট খুলল। এখন আর কোনো গার্ড নেই। গাড়ি ভেতরে ঢুকতেই আবার গেইট অটোমেটিক বন্ধ হয়ে গেছে। গাড়ি থেকে নামতে নামতে আলফি বলল,

“বার্বিকিউ চলবে?”

“চলবে। কোথায় করবে। আর বার্বিকিউ করার জিনিসপত্র?”

“সব আছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। তোমার রুমের সাইডের ইয়ার্ডেই আমি সব ব্যবস্থা করছি।”

নিঝুম খুশি মনে নিজের রুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো আলফি সব ব্যবস্থা করছে। এখন বার্বিকিউ করার চু*ল্লীতে ক*য়লা জ্বা*লিয়ে ঠিকঠাক করছে। দুটো কাঠের বসার টুল রাখা। ক*য়লা জ্বা*লিয়ে আলফি এবার স্টেক পিস ও লবস্টারের বার্বিকিউ করার জন্য মশলাপাতি আনলো। সব সুন্দর করে মেরিনেট করছে। নিঝুম বসে বসে দেখছো। অক্টোবরের হালকা শীতল হাওয়ায় আলফির কপালের ছোটো চুলগুলোও উড়ছে। বাড়ির ভেতর থেকেও মৃদু আলো আসছে সাথে ক*য়লা জ্ব*লার আলো। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। চাঁদ এখনও গোলাকার। চাঁদের আলোয় ইয়ার্ডের অন্ধকার সয়ে গেছে। আলফির ফর্সা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। নিঝুম চাদর জড়িয়ে বিবশ হয়ে আলফিকেই দেখছে। হঠাৎ তার মনের মাঝে একটা ধা*ক্কা এলো, এটা অন্যায়। তুমি বিবাহিতা। স্বামী ব্যাতিত অন্য পুরুষের দিকে এভাবে চেয়ে থাকাটা ভীষণ অন্যায়। পরন্তু তার আরেক মন বলছে, তুমি তো জায়ানকে স্বামী হিসেবে মানো না। তার থেকে মুক্তি চাও। ভালোবাসো না তাকে। তাহলে অন্যায় কীসের? সামনের ছেলেটাকেই তো তুমি মনে মনে চেয়ে এসেছিলে। তার মনে দুই ধরণের চিন্তাই এলো। নিজ মনের এই যু*দ্ধে সে তৎপর হয়ে উঠে দাঁড়ালো। আলফিও সচকিতে তাকালো। বার্বিকিউ করার জন্য মেরিনেটের পর্ব শেষ। সে শুধালো,

“হোয়াট হ্যাপেন্ড? দাঁড়িয়ে গেলে কেন?”

নিঝুম আমতা আমতা করে এদিকওদিক চেয়ে বলল,
“আশেপাশে দেখছিলাম। এখানে গাছও আছে। দুপুরে দেখেছিলাম।”

“হ্যাঁ। এগুলো আমার গ্র্যান্ডপা মানে নানাভাইয়ের লাগানো। ম্যাপল ট্রি, লার্চ ট্রি, পাইন ট্রি, সিডার ট্রি, আপেল ট্রি, জিঙ্কো ট্রি। জিঙ্কো ট্রি ও আপেল ট্রি বাড়ির পেছনের দিকে। জিঙ্কো গাছটা অনেক বড়ো ও পুরাতন।”

নিঝুম দেখতে চাইলো। আলফি ও-কে মিনিট খানেক দাঁড়াতে বলে স্টেক বার্বিকিউ হতে দেয়। লবস্টার পরে দিবে। তারপর দুজনে বাড়ির পেছনের সাইডে যায়। পেছন সাইডে হলুদ, কমলা, লাল বর্ণের দুই ধরনের পাতায় পরিপূর্ণ। চাঁদের আলোয় খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। নিঝুম আগে আগে হেঁটে এই ঐশ্বরিক সৌন্দর্য উপভোগ করছে। হলুদ পাতার জিঙ্কো গাছটাকে প্রথমবারের মতো দেখছে নিঝুম। এর আগে মুভিতে দেখেছে। কানাডার রাস্তাঘাটে ম্যাপল গাছটাই বেশি দেখা যায়। জিঙ্কো গাছটার পাশেই একটা-দুটো ম্যাপল গাছ ও একটি আপেল গাছ। গাছের ফাঁকে আকাশের ওই রূপালী চাঁদখানা। গাছের নিচে এক হাঁটু গেড়ে বসলো নিঝুম। কয়েকটা ঝড়ে যাওয়া পাতা কুড়িয়ে নিলো। এদিকে আলফি মুগ্ধ হয়ে নিঝুমকেই দেখছে। মৃদুমন্দ শীতল বাতাস বইছে। গাছগুলো থেকে পাতা ঝড়ে পড়ছে। পকেট থেকে ফোন বের করে একটু পিছিয়ে গিয়ে নাইট মুডে গাছগুলো সহ নিঝুমের পাতা কুড়ানোর দৃশ্যটা ক্যাপচার করে নিলো। সে বিড়বিড় করে বলে,

“In the rhythm of the waves and the whisper of the leaves, I feel the vibration of your love, My love.”

নিঝুম আলফির কাছে এসে বলল,
“জায়গাটা খুব সুন্দর। তোমার নানুভাই নিরিবিলি পছন্দ করতেন?”

“হু। গ্র্যান্ডমায়ের মৃত্যুর পর তিনি টরন্টোর বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে এখানেই থাকতেন। জায়গাটা গ্র্যান্ডমায়ের খুব পছন্দের ছিল। উইকেন্ডে এখানে আসতেন। তারপর গ্যান্ডপায়ের মৃত্যুর আগে আমাকে লিখে দেন। উনার একমাত্র মেয়ের ঘরে একমাত্র নাতি আমি। তারপর আমি বাড়িটা আরেকটু বড়ো করে মেরামত করে নেই।”

নিঝুম আরেকটু ঘুরে দেখলো। আপেল গাছে আপেল ঝুলে আছে। আপেলের গায়ে রঙ হতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ এখানে থেকে ওরা বার্বিকিউর ওখানে যায়। স্টেক পিসগুলো উলটে দেয়। তারপর লবস্টারও দিয়ে দেয়। সব তৈরি হয়ে গেলে ওরা খোলা আসমানের নিচেই খেতে বসে। আলফি বলে,
“তোমাকে আমি সকালে ইউনিভার্সিটি ড্রপ করে দিয়ে আসব। আর মোনা নামে এক মেয়ে তোমাকে নোটস দিবে। সেগুলো নিয়ে নিবে।”

“আচ্ছা। কিন্তু তোমার ক্লাস নেই?”

“আমার ক্লাস ইভেনিংয়ে। এভরিডে ক্লাস থাকে না। যেসব দিন আমার ক্লাস থাকবে তুমি ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে আমার জন্য ওয়েট করবে। তারপর আমরা একসাথে আসব।”

“ওকে। তুমি কি পার্টটাইম জব করো? পার্টটাইম জবে স্যালারি কতো দেয়? আমিও করব ভাবছি।”

কথাগুলো নিঝুম এতো দ্রুত বলল যে বিষম খেলো আলফি। নিঝুম জলদি করে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। আলফি পানি পান করে একটু চিন্তা করে বলে,
“পার্টটাইম জব….. হ্যাঁ হ্যাঁ করি। একচুয়েলি ওটা পাওয়া একটু টাফ। আর তোমার এখন সময় কম। এমনিতেই ওয়ান মান্থ পিছিয়ে গেছো। স্টাডিতে কনসানট্রেট করো। নেক্সট সেমিস্টারে ভাবা যাবে। স্কলারশিপ ধরে রাখতে হবে তো।”

নিঝুমও বুঝলো। সে মাথা নেড়ে খেতে লাগলো। আলফি ফুঁশ করে নিঃশ্বাস ছাড়ে।

—–
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন নিঝুম। ঘড়িতে এখন রাত একটার বেশি। বারান্দার গ্লাসের পর্দা খানিকটা সড়ানো। যা দিয়ে চাঁদের আলো রুমে এসে প্রবেশ করছে। তখন বারান্দার থাই গ্লাসটা নিঃশব্দে খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো একজন। থাই লক করা ছিল না। নিঝুম ভুলে গেছে। মৃদু পায়ে এসে বসলো নিঝুমের শিয়রে। মুগ্ধ নয়নে চাঁদের আলোয় দেখলে নিজের প্রিয়তমাকে দেখলো। বাতাসের সাথে ফিসফিস করে বলল,

“তুমি আমার থেকে পালাতে পারবে না, সুইটহার্ট। যেদিকেই যাও আমাকেই পাবে। তুমিও ভালোবাসবে আমাকে। এই আলোছায়াতে আমি তোমাতে আরও আসক্ত হয়ে পড়ছি। একেই বুঝি প্রণয়াসক্তি বলে?”

তারপর আকাশের চন্দ্রমাকে দেখে। ধূসর তুলোর মতো মেঘ চাঁদকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ব্যাক্তিটি ফের বলে,
“You are unaware how precious and beautiful you are in my heart. And the moon also envies your beauty.”

নড়েচড়ে উঠে নিঝুম। ব্যাক্তিটি সযত্নে কম্ফর্টারটা নিঝুমের গলা পর্যন্ত টেনে দিয়ে মাথায় আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে বেরিয়ে যায়। থাই গ্লাসটাও টেনে দেয়। হঠাৎ ঘুম ছুটে যায় নিঝুমের। পর্দাটা মৃদু নড়ছে। নিঝুম চট করে উঠে বসে। সে ঘুমের মধ্যে কারও স্পর্শ অনুভব করছিল। আধো কিছু বুলি শুনছিল। কিয়ৎ ভয় ঝেঁকে ধরলো তাকে। রুমে কি কেউ এসেছিল? উঠে পর্দা সরিয়ে বাহিরে চেক করলো। না কোনো মানব ছায়া পর্যন্ত নজরে এলো না। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে ওগুলো স্বপ্ন ভাবলো সে। অতঃপর পানি পান করে ফের ঘুমিয়ে পড়লো।

চলবে ইন শা আল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।