#আমার_ললিতা
#পর্ব:১
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
স্ত্রীর পাশে বসে সে প্রেমিকার উদ্দেশ্যে বলল,
“আমি তোমার কেউ নই রজনীগন্ধ্যা।আমাকে ভুলে যাও।বরং মনে রাখা কষ্টের বিষয়।”
বেলী অধরযুগল চেপে কান্না আঁটকানোর প্রচেষ্টা করলো।কিন্তু হায়!অশ্রুগুলো তো স্বীয় প্রকৃতি অনুসারে নির্লজ্জ।চোখের কার্ণিশ অতিক্রম করে পুরুষটির পা জোড়ার উপর পড়লো।উষ্ণ নগণ্য সিক্ততায়ও কেঁপে উঠলো যুবতীর কোলে থাকা পা জোড়া।রামীম অসুস্থ দৃষ্টিতে দেখছে।বেলীকে সে প্রেমিকা নয় বরং মন সরোবরের জলকন্যা বলে মনে করে।অল্প কয়েক মাসে কতো স্বপ্ন নিয়ে বেঁচেছিল তারা?ভাবতে পারেনা সেসব।ফুসফুস কাঁপিয়ে কাঁশি উঠে।তটিনী তড়িঘড়ি করে রামীমের পিঠে হাত দিয়ে বলল,
“শান্ত হও।এতো কথার দরকার নেই।বেলী বুঝবে।”
“আমি কিছু বুঝবো না তটিনী আপু।কিছু নয়।ফাঁকি নিয়ে নিজ বন্ধুকে তো বিয়ে করে নিলেন।”
রামীম তাকে বাঁধা দিয়ে বলল,
“অল্প সময়ের জন্য।আমি বোধহয় আজ চলে যাবো বেলী।এই মেয়েটার জেদের কাছে…।”
“কিন্তু একদিনের জন্য হলেও সেই অধিকার তো আমার ছিল রামীম।যাক আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন।এরপর সুন্দর সংসার হোক আপনার।”
শেষের বাক্যটি বলতে গিয়ে বেলীর নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠলো।ভালোবাসায় এতো দুঃখ?বোধহয় ভালোবাসায় দুঃখ নেই।আছে অকালে কোনো মরণব্যধি হওয়ায়।একপাশে তাঁকিয়ে বেলী সদ্য বিবাহিত জোড়াটিকে দেখলো।যারা গত পরশু বিয়ে করেছে।দুজনের মুখে উজ্জ্বলতা। না হোক সুখের।একে অপরের প্রতি অধিকারবোধটা দুজনের দৃষ্টিতে জানান দিচ্ছে।বেলী হাতে করে আনা নেতানো শিউলিগুলো প্রিয় পুরুষের পায়ের উপর দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আপনাকে কখনো ভুলবো না প্রিয় পুরুষ।”
অসুস্থতার ফলে নিভু নিভু কণ্ঠে রামীম জবাব দিলো,
“আমাকে মনে রেখো না রজনীগন্ধ্যা।আমি আজ চলে যাবো।যেখান থেকে কেউ ফিরে আসেনা।”
অতি সন্তপর্ণে রামীমের পা দুটো রেখে বিছানাতে রেখে দিলো বেলী।তটিনী নিজ স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।অকস্মাৎ বেলী নিজের ভেতর উষ্ণতা টের পেলো।এ অধিকার তো তার ছিল!অথবা নয়।সে দ্রুত বের হয়ে যাচ্ছে দোতলা এই বাড়ীটির থেকে।কখনো সে এখানে আসবেনা।আঠার বছর বয়সী যুবতী বেলী নিজ পণে অটল ছিল সেদিন অবধি যেদিন রামীমের জন্য আগরবাতি জ্বালানো হলো।প্রতিবেশী ছিল তার পুরুষটি।সেখান থেকে প্রণয়।অথচ হুট করে জানা গেলো কঠিন অসুখ হয়েছে তার।সেখান থেকে বেঁচে ফেরার উপায় বোধহয় নেই।বেলী তো প্রেমে পরা বন্ধ করেনি।তবে কোনো প্রিয় বান্ধুবীর এতো ক্ষমতা যে সে নিজ ম’র’ণাপন্ন বন্ধুকে বিয়ে করতে পারে জেদের বশে?কে জানে তা?বেলী কিন্তু জানেনা।
সে নিজ রুমের জানালায় সেদিন সারাটা দিন দাঁড়িয়ে ছিল।এমনকি কী কাঁদেনি অবধি।যখন শুভ্রতায় মোড়ানো রামীমের নির্জীব দেহখানি ট্রাকে ওঠানো হলো তখন সে ফিসফিস করে বলল,
“আপনি ভুল ছিলেন প্রিয় পুরুষ।সেদিন নয় বরং এই ছয় মাস পর আজ যাওয়ার দিন ছিল আপনার।তাহলে কেন আমার জায়গায় অন্য কেউ এ সময়গুলো পেলো?”
দুঃখবোধের শীতলতায় সে শিওরে ওঠে পুনরায় বলল,
“আমি কখনো আর প্রেমে পরবো না।কখনো নয়।”
বেলীর কাছে আজও সেদিনের পর থেকে সময়গুলো খুব দ্রুত কেঁটেছে মনে হয়।রামীমের অনাগত সন্তান নিয়ে তটিনী ও তার শ্বশুর -শ্বাশুড়ী বাড়ীটা বিক্রি করে দিলো।সেই সুন্দর নির্জীব শান্ত দোতালা বাড়ীটা ভেঙে সেখানে বিলাসবহুল এক রাজপ্রাসাদ গড়ে উঠলো।একটি রাজা তার সুন্দরী রাণী নিয়ে বসবাস করে সেখানে।শুনেছে ওই প্রাসাদে দুজন রাজকুমারী ও একজন রাজকুমার আছে।বিশ বছরের যুবতী বেলীর অবশ্য সেদিকে খেয়াল নেই।সে নিজ খেয়ালমতো চলে।বায়রনের কবিতা পড়ে উদাসীন হয়ে উঠে।আবার সমরেশের উপন্যাস পড়ে শক্তিশালী হয় মন।এক অন্য জগতের বাসিন্দা বেলী।সেখানে কোথা থেকে আগত কামদূত হঠাৎ একদিন কামবাণ ছুঁড়ে দিলো…
স্নিগ্ধ, শান্ত সকাল।চারিধারে নতুন দিনের আভাস।রেবেকা দ্রুত হাতে টেবিলে খাবার গুলো সাজিয়ে রাখলো।তার স্বামী বড় সৌখিন মানুষ।সকালের নাস্তা একদম গুছানো না হলে ভালো লাগেনা।তখন বিড়বিড় করে Moron বুলি আওড়ে দেয়।তার প্রথম সন্তান সিয়াম বলে এই শব্দটা উচ্চারণ করা তার বাবার ভীষণ বা’জে অভ্যেস।যা সে ছাড়তে পারেনা।অবশ্য রেবেকা জানে তার স্বামী একটু আধ-পাগলা অহংকারী লোক।যাকে সহজে বশ করা যায়না।সে মনে প্রাণে চায় একদিন কেউ আসুক ও তার স্বামীর অহংকারকে চূর্ণ,বিচূর্ণ করে দেক।
শশী দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো।তার অফিস ক্ষণবাদে শুরু হবে।টেবিলে বসে বলল,
“বাবা কোথায়?সবসময় তো তাকে টেবিলে আগে পাওয়া যায়।”
“বাহিরে ফুলগাছে পানি দিচ্ছে।বেলী,সিয়াম ওরা কোথায়?”
“ডাক দাও।দেখো কোথায়।”
রেবেকা কখনো তার সন্তানকে তুই সম্বোধনে ডাকেনা।এ প্রচলন সে নিজ পিতার থেকে পেয়েছিলো।শশী চিল্লিয়ে বেলীর নাম ধরে ডাকলো।কিন্তু তার কণ্ঠকে ছাঁপিয়ে তার বাবা উচ্চসুরে বলে উঠলো,
“রাস্কেল ছেলে।আর একটি কথা বললে আমি তোমার নামে থানায় মামলা দেবো।ভেবেছো আঠার বছর হয়নি দেখে পার পেয়ে যাবে?শিশু আইনে আঁটকে রাখবো।”
“বাবা কার সাথে এভাবে বলছে মা?”
“জানিনা তো।”
রেবেকা ও শশী দৌড়ে বাহিরে এলো।তোফায়েল চিল্লিয়ে একজন কিশোর ছেলের সাথে ঝগড়া করছে।
“কী হয়েছে?আপনি চিল্লাচ্ছেন তোফায়েল।”
“দেখো এই ছেলেটা আমার গাড়ীর কী অবস্থা করেছে।”
তোফায়েল গাড়ীর দিকে নির্দেশ করলো।যেটির হেডলাইট ভেঙে গিয়েছে।অবশ্য যাকে দোষী সাব্যস্ত করলো সে নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।আস্তে করে বলল,
“আপনাকে কতোবার বলবো বিড়ালটা রাস্তার মাঝে ছিল।আমি দেখিনি।হঠাৎ দেখে বাইকের ব্রেক করার সময় হয়ে গিয়েছে।সরি আঙকেল।আমি রিপেয়ার করে দিবো।”
“শাট আপ।তোমাকে আমার ছোটলোক মনে হয়?”
“বোধহয়।”
তোফায়েল গর্জন করে উঠলো।এতোক্ষণে তার দুই সন্তান বেলী ও সিয়াম বের হয়ে এসেছে।পুরো ঘটনা শুনলো তারা।এমন সময় হুট করে বহুল তর্ক লেগে গেলো দুজনের।তোফায়েল রাগারাগি তে আশেপাশে লোক বের হয়ে এলো।কিশোর ছেলেটিকে সকলে পাকড়াও করলো।ছেলেটা বারবার বলছে সে নির্দোষ।
“এই পুলিশ ডাকো তো কেউ।”
কিশোর ছেলেটা না পেরে কাওকে ফোন করলো।মিনিট খানেক বাদে কান্তিমান ফর্সা চেহারার একজন পুরুষ বেলীর ভাষার সেই রাজপ্রাসাদ থেকে বের হয়ে এলো।
“কী হয়েছে অনিম?তুই তো দেখা যাচ্ছে আমার রেকর্ড ভেঙে দিবি ঝগড়া করা নিয়ে।”
“অনল ভাই, দেখো আমি নির্দোষ।কিন্তু সামান্য গাড়ীর হেডলাইট ভাঙার জন্য পুলিশে দিবে।”
অনল সবটা দেখলো।লোকটার মুখবিবর এখনও কেউ দেখতে পারেনি।মাস্ক লাগানো।কিন্তু কোলনের সুগন্ধে একবার হলেও সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।রাগান্বিত তোফায়েলের কম্পমান কণ্ঠে বলল,
“তুমি কে? এ ছেলের ভাই?”
“একদম।সব দোষ আমার ভাইয়ের।আপনি বিচক্ষণ।”
“দেখো এসব কথায় চলবেনা।দুম করে বলে দিলেই হলো না।”
“ঠিক।এখন তাহলে কী বলবো বলেন আঙকেল?”
“ভালো শিক্ষা দাও ভাইকে।তোমাকে দেখে ভদ্র ছেলে মনে হচ্ছে।”
অনলের চোখ দুটো যেন হেসে উঠলো।সে আস্তে ধীরে বলল,
“আমার ভাইকে পুলিশে দেওয়ার থেকে আপনার কাছে দিয়ে দেই আঙকেল।ওকে সুন্দর শিক্ষা দিবেন না হয়।আপনার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে আপনি দারুণ নৈতিকবান।”
তোফায়েলের চেহারাতে দারুণ আত্মগরিমা ফুঁটে উঠলো।শান্ত সুরে বলল,
“তোমরা তাহলে সিকেন্দার সাহেবের ছেলে?”
“জি আঙকেল।”
“আচ্ছা যাও।আমি রাগ করলাম না।কিন্তু এই ছেলেকে তর্ক করতে না করবে এরপর থেকে।”
“আপনি শিখিয়ে দিবেন ওকে কথাগুলো।আমি রোজ একবার পাঠাবো।”
অনিম ভাইয়া বলে অস্পষ্ট সুরে ডাকলো।অনল সেদিকে খেয়াল না করে বলল,
“কবে পাঠাবো আঙকেল তাহলে?”
“ভেবে দেখবো।”
তোফায়েল মাথা উঁচু করে বাড়ীর ভেতরে ঢুকে গেলো।আশেপাশের মানুষও নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো।অনল ভাইয়ের মাথার চুল এলেমেলো করে বলল,
“আর কতোবার বাঁচাবো তোকে?”
“আজ দোষ আমার ছিলনা ভাইয়া।”
“এখন চল ভেতরে।বাইক চাচা এসে নিয়ে যাবে।”
“তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো ভাইয়া।এইযে…।”
শার্টের ভেতর থেকে ছোট বিড়াল ছানাকে বের করলো।
“একে নিয়ে যতো ঝামেলা।”
অনল ছানাকে কোলে নিয়ে নিজ বাড়ীর দিকে যেতে লাগলো।এখনও তার চেহারার মধ্যে আস্তরণ রয়ে গেছে।শশী হেসে বলল,
“কতোটা গুড বয় দেখলি?বাবাকে শান্ত করে দিলো।ভীষণ চালাকও।আলাপ করতে হবে একদিন।”
“ভুল আপু।তোমরা কেউ দেখতে পারলে না লোকটা আসলে খুব চতুর।”
“হুহ তুই এক বিচক্ষণ।”
শশীর কথায় বেলী কিছু বলল না।অনলের গমন পথের পানে তাঁকিয়ে বলল,
“ব্যাড বয়।”
চলবে।