আমার ললিতা পর্ব-১৫+১৬+১৭

0
541

#আমার_ললিতা
#পর্ব:১৫
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“বেলীর নরম অধরযুগলে অনল ব্যতীত অন্য কারো নাম?দ্যাটস নট গুড মাই ললিতা।এখন যেহেতু সীলমোহর লাগানো হয়নি সেক্ষেত্রে যাও ছেড়ে দিলাম।হেঁটে, দৌড়িয়ে ইনফ্যাক্ট ধরে নিলাম উড়ে যতো আমার থেকে দূরে যেতে চাও। যাও।কিন্তু দিনশেষে পাখির পায়ে কীভাবে বাঁধন দিতে হয় আমার জানা আছে।”

অনল ছেড়ে দিলো বেলীকে।চোখ মুখের অবস্থা কঠিন।সামান্য একটি কল্পনার চরিত্রকে মেনে নিতে পারছেনা?তবে কী সেই যে বেলীকে চিঠি পাঠাতো?আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে।বেলী হাতে থাকা বইটিতে আঙুল বুলিয়ে বলল,

“শেখর দা কে দেখেছেন তিনি কেমন বলিষ্ঠ, মিষ্টিভাষী।এমন পুরুষ…।”

“যে একটা পুতুল খেলাকে বিয়ের নাম দিয়ে মেয়েটির ঠোঁটে চুমো খেতে পারে।কিন্তু পরে বাবার ভয়ে কিছু জানাতে পারেনা।সে কেমন পুরুষ জানা আছে।আরে ভাই ওটা তোমার জন্য বরাদ্দ নারী।সে যদি গিরীন বাবুর পিছনেও যায় ধরে বেঁধে মনে করাও তুমি আমার! শুধু আমার।বিয়ে হলে বাবা এমনিতেও মানতেন। তাছাড়া বাবা বেঁচেছিল বা কয়দিন?”

“ইশ!আপনার সব খোঁড়াযুক্তি।তখন সমাজ ব্যবস্থা ঠিক ওমন ছিল।কেউ ভেগে গেলে তাকে বলতো কুলটা।”

“নট রিয়েলি ললিতা।আমার কথার মর্মাথ সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারো নি।মেয়েটাকে আশা দেওয়া উচিত ছিলনা।এর উপর ধরে নাও আজ থেকে একশ বছর আগে একটা মেয়েকে চুমো খাওয়া অনেক বড় ব্যাপার ছিল।আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হয়ে কোনো মেয়ের উপর অনুভূতি বুঝতে পারবো না?এক্ষেত্রে নির্বোধ ব্যতীত কিছু নই।শেখর ওমন নির্বোধ।শিট!তোমাকে বোঝাতে গিয়ে আমার গরম লেগে গিয়েছে।ললিতা ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করে দাও তো।”

“দেখুন ওটা আমার প্রিয় উপন্যাস।কিছু বললে খবর আছে।”

“আমি শুধু ফ্যাক্ট বললাম।”

“রাখুন আপনার বই।”

“আমি কখন বললাম তোমাকে দিবো বই?এসবের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই।এক বই পড়ুয়ার কাছে আরেক বই পড়ুয়া ডাকাতের মতোন।কখন শখের বই ধারের নামে লুট হবে বলা যায় নাকী?”

“আপনার আমাকে ডাকাত মনে হয়?”

“অবশ্যই তুমি ডাকাত।তবে সুন্দরী।”

বেলীর রাগ উঠছে অনেক।কিন্তু সে রাগবেনা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।অনল ছেলেটা তো এমনই।হাতের কাজটা শেষ করে দ্রুত চলে যেতে নিবে তখন অনল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

“অফিসে কাল কাজ করতে হবে তোমার।জলদি এসো।অপেক্ষাতে থাকবো।আবার সিটি আছে বলে পার্কে ঘুরো না।আমি সব খবর রাখি।”

“দেখা যাবে।”

বেলী তড়িঘড়ি করে সরে গেলো।সে যে সিটির নাম করে পার্কে বসে থাকার প্ল্যান করেছিল সেটা অনল কীভাবে জানলো?লোকটা কী তার মস্তিস্ক পড়তে পারে?যদি এমন হয় তবে মনে মনেও চিন্তা করা যাবেনা কিছু।এহেন নানাবিধ ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি থেকে প্রায় ফস্কে যাচ্ছিলো পা।সিকান্দার দ্রুত হাতটা ধরে নিলো।

“ঠিক আছো তুমি মা?এভাবে তো পড়ে যেতে এখন।”

“ধন্যবাদ আঙকেল।”

ঘটনার প্রভাবে নাকী সিকান্দারের মুখে মা ডাক শোনাতে কীনা বেলী হতবিহ্বল হয়ে গেলো।মুখে বিভ্রান্তময় হাসি ফুঁটিয়ে বলল,

“বাসায় ফিরছিলাম।খেয়াল হয়নি।”

“সমস্যা নেই।ব্যাথা পাওনি তো?”

“না।ঠিক আছি।”

“যদি কিছু মনে না করো তাহলে কথা বলা যাবে তোমার সাথে কিছুক্ষণ।ধরে নাও কফির আমন্ত্রণ দিচ্ছি মা।”

“আমাকে?”

“এখানে অন্য কেউ আছে?”

বেলী মাথা এপাশ-ওপাশ দুলালো।সিকান্দার লোকটা গম্ভীর প্রজাতির।হঠাৎ তার সাথে কী বলতে চাচ্ছে?মিনিট পাঁচেক বাদে বেলী নিজেকে বাগানে আবিষ্কার করলো।এখানে সুন্দর করে কয়েকটা বেতের চেয়ার সাজিয়ে রাখা।মাঝখানে ছোট একটা টেবিল।বেলীদের বাড়ী এখান থেকে দেখা যাচ্ছে।ওইতো শশী ছাদে কারো সঙ্গে কলে কথা বলছে।শব্দহীন ধূমায়িত কফির পেয়ালাতে চুমুক দিচ্ছে সিকান্দার।নিজের গলাটা একটু পরিষ্কার করে বলল,

“শয়তান যদি মানুষের রুপ নিতো তাহলে তাকে কেমন লাগতো দেখতে মনে হয় তোমার বেলী?”

“কখনো বিষয়টি ভেবে দেখিনি আঙকেল।”

“আমি বলি।আমার ছেলের মতোন লাগতো।”

“আপনার ছেলে?”

“আমার ছোট ছেলে মন্দ নয়।কিন্তু বড়টা অনল।সে হচ্ছে শয়তানের মানুষ ভার্সন।বুঝতে পারিনা আমার ছেলে কীভাবে এতো দুষ্ট হলো।মা ভক্ত অনেক।সেটাতে সন্দেহ নেই।কিন্তু একটু বাবা ভক্তও তো হতে পারতো।জানো আড়ালে আমাকে বলে সিকান্দার দোস্ত।বেয়াদব!আমি নাকী ওর বন্ধু।”

“আপনি ওনার উপর অনেক ভাবে রেগে আছেন।”

“হ্যাঁ।এজন্য তোমাকে ডাকা।ওকে একটু শায়েস্তা করতে পারবে?”

বেলী শংকা নিয়ে শুধালো,

“কীভাবে?”

“সেটা তুমি জানো।আমি তোমাকে এর বিনিময়ে ওর লাইব্রেরির একশ বই দিবো।”

বেলী হেসে বলল,

“এতেই উনি ক্ষেপে যাবেন।আঙকেল একটা গোপন কথা বলি?”

“জি বলো।”

বেলী সিকান্দারের কাছাকাছি গিয়ে নিচু স্তরে বলল,

“আমি ওনার দুটো বই মে”” রে দেওয়ার চিন্তা তে আছি।একদম রেয়ার এডিশন সেগুলো।ইতিমধ্যে একটা আমার বাসাতে।”

“অবিশ্বাস্য!দারুণ কাজ করেছে তো।ভয় লাগছেনা?”

“উনি প্রমাণ দেখাক।অলরেডি সেটা পাচার করে দিবো নানুবাড়ী তে।দশ বছর পর আনবো।ক্রাইমের কোনো প্রমাণ থাকবেনা।”

সিকান্দার ছোট্ট বাচ্চাদের মতোন উচ্ছাসিত হয়ে উঠলো।ছেলেকে শায়েস্তা করতে পারলে সে অনেক খুশি হবে।আগ্রহভরে বলতে লাগলো,

“গুপ্তধন যখন পেয়েছো আরো লুট করা উচিত।শুনো লাইব্রেরির উপরে একটা গোপন রুম আছে।সেখানে কিছু দারুণ বই আছে।বিশেষ করে রোমিও জুলিয়েটের রেয়ার এডিশন একটা আছে।ওগুলোর ছয় সাতটা সরিয়ে ফেলতে পারলে নির্ঘাত অনল এক বছর পাগল থাকবে।আমি ভেবে শান্তি পাচ্ছি।”

“ছেলের সাথে এটা কেন করবেন আপনি?”

“কারণ অনেক বিস্তর।তুমি জানো আমার খুব প্রিয় একটা জিনিস লুকিয়ে রেখে ও ইদানীং কিছু একটা আবদার করছে।এমন ঘটনা বহু আছে।”

“আপনাদের মধ্যে কোনো ঝামেলা আছে?”

“আছে।কিন্তু ওর বুঝতে হবে আমি দোষী নই।”

“আচ্ছা।আমি আপনাকে সাহায্য করবো।কারণ ওনার সাথে আমারও শত্রুতা আছে।”

“তবে বেলী ডিল হলো আমাদের?”

সিকান্দার হাত বাড়িয়ে দিলো করমর্দন করার জন্য।বেলী হেসে হাত মিলিয়ে বলল,

“ডিল আঙকেল।ব্যাড বয়কে একটু শাস্তি দেওয়া যায়।”

দূরে মায়ের রুমের বারান্দা থেকে সিকান্দার ও বেলীর কর্মকান্ড দেখছে অনল।হাতে তার একটি ময়ূরের পাখ।সেটাতে সমীরণে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিচ্ছে।ফিসফিস করে বলল,

“মাই ললিতা।তোমার ঠোঁট আমি পড়তে পারি।যেই বুদ্ধি করো না কেন নাকানিচুবানি খাবে আমার থেকে তা সিওর। সিকান্দার সাহেবকে তো ছাড়া যাবে না দেখছি।”

চলবে।

#আমার_ললিতা
#পর্ব:১৬
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“আপনি দেখতে সুন্দর অনল।কিন্তু স্বভাব চরিত্র ভীষণ খারাপ। ভীষণ খারাপ।”

বেলী অভিমান নিয়ে কথা গুলো বলছে।যুবতীর চোখ দুটো অশ্রুতে টইটম্বুর হয়ে উঠেছে।ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ছোট্ট করে গালে থাকা জলকণা মুছে নিলো।অনলের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর থেকে সে কখনো গম্ভীর হতে দেখেনি তাকে।আজকে কেমন চুপচাপ বসে আছে।শুভ্র মুখটা পুরোদস্তুর রক্তিম।

“ললিতা, চুপ থাকো।এমনিতে মেজাজ খারাপ এখন আমার।ছেলেটা তোমাকে প্রপোজ করেছে।”

“আমার জীবন।তাতে আপনার কী অনল?অসভ্য একটা ছেলে।”

বিস্মিত হয়ে অনল বেলীর দিকে তাঁকালো।আজকে সে বেলীর ভার্সিটিতে গিয়েছিল কোনো একটা কাজে।তখন জানতে পারে দুদিন পূর্বে একটা ছেলে বেলীকে সবার সামনে গান গেয়ে প্রপোজ করেছে।যদিও মেয়েটির জবাব ঋণাত্বক ছিল।কিন্তু তাও অনল তা মেনে নিতে পারছেনা।এজন্য বেলীকে কয়েকটা অদ্ভূত কথা বলেছে সে।ধরতে গেলে তা কটূ নয়।তবে বেলী ওটা শুনেই কেঁদে দিলো।অনলের রাগে অন্তরটা বিতৃষ্ণাতে ভরে গেলো।লজিক্যালি একজনকে বকলে সে কাঁদবে কেন?কান্না কে কেন নারী জাতি দূর্বল করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে?

“ললিতা কান্না না থামালে ছাদে নিয়ে আঁটকে রাখবো।বাকী দুদিন পর জানতে পারবে আমি কেন এতো রিয়াক্ট করলাম।এখন চোখের সামনে থেকে সরে যাও।”

“আশ্চর্য!আমি আপনার চোখের সামনে?”

“জি।অফিসের স্টাফ কখনো বসের কেবিনে বসে থাকেনা।নিজের কাজ শুরু করো।ম্যানেজার সব দেখিয়ে দিবে।”

“আমি কখনো এখানে কাজ করতে আসিনা।বরং বাবার জন্য বাধ্য হয়ে আসতে হয়।”

“বাধ্য বলো অথবা নিজ তাগিদে বলো।নিজের দায়িত্ব গুলো এখন তোমারই পালন করতে হবে।আমার মেজাজ খারাপ করো না যাও এখান থেকে।অফিস আমার। বাধ্যও আমার হতে হবে।”

বেলী নিশ্চুপ ভাবে বসে রইলো।একবার ভাবলো সিকান্দারকে সব কিছু জানাবে।অনলের কটূ কথাগুলো সে মেনে নিতে পারছেনা।এটা কেন সবাই বলে যে প্রপোজ পাওয়ার বিষয়টি নারীরা ভীষণ এঞ্জয় করে।বেলী ওমন মেয়ে নয়।আস্তে করে উঠে চলে যেতে নিবে তখন পিছন থেকে অনল বলে উঠলো,

“এখন আবার সিকান্দার সাহেবের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করো না।লাভ হবেনা।”

“আমি এতোটাও দূর্বল নই।”

“আসলেও!চোখের পানি সব পরিষ্কার করে দিচ্ছে।”

বেলী ওড়না দিয়ে পুরো মুখটা একবার মুছে নিলো।এতে ঠোঁটের লিপস্টিক হালকা বিনষ্ট হলো বটে।অনল সেদিকে তাকিয়ে বলল,

“তোমার ঠোঁটেট রঙ যুবকের দুঃস্বপ্নের কারণ না হয় ললিতা।”

“মানে?”

“লিপস্টিক মুছো।”

“একথাটা স্বাভাবিক ভাবে বললে কী হতো?”

“তেমন কিছু না।সিকান্দার সাহেবের দুই বিঘা জমি কমে যেতে।”

“নিজের বাবাকে সম্মান করা উচিত আপনার অনল।”

“অবশ্যই।এবং বেলীর উচিত অনলকে ভালোবাসা।দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যেও।”

শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিলো বেলী।রাগ দমন করার জন্য স্বীয় দাঁতে দাঁত ঘর্ষণ করলো।একটা ছেলে এতোটা শয়তান কীভাবে হয়?প্রশ্নটা বৃথা।

(***)

মৃদুমন্দ সমীরণ বইছে।এর সঙ্গে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি।পরিবেশটা প্রেমিকযুগলের উপভোগ করার জন্য একদম উপযোগী।কিন্তু অনলের এহেন পরিবেশ একটুও পছন্দ হচ্ছে না আজ।মেজাজ সেই যে উঠেছে আর নামার নামগন্ধ নেই।গাড়ীটাতে অফিসে রেখে বৃষ্টিতে হাঁটা আরম্ভ করলো সে।এর পূর্বে ফোন এবং মানি ব্যাগটাকে পলিথিনে মুড়িয়ে পকেটে রাখলো।জুতোসহ পা পানির উপর পড়তে মনোমুগ্ধকর একটি শব্দ হলো।গায়ে থাকা হালকা আকাশী রঙের শার্টটি জলকণার ফলে ধীরে ধীরে পুরুষটির গায়ে লেপ্টে যাচ্ছে।অনলের যখন খুব রাগ উঠে তখন এমন সবকিছু ছেড়ে বাহিরে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ায়।অচেনা লোকদের সঙ্গে কথা বলে।এই বুদ্ধিটা সে পেয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের হিমু চরিত্র থেকে।যদিও হিমু জুতো পরেনা।পকেট রাখেনা পাঞ্জাবীতে।তবে একটি ফিকশনাল ক্যারেক্টারের এহেন কর্মকান্ড বাস্তবের ক্ষেত্রে ঠিক যায়না।ঢাকা শহরে টাকা ফোন ব্যতীত অর্থহীন ঘুরে বেড়ানো আখেরে ঝামেলা নিয়ে আসবে।অনলের মনে হচ্ছে পিছন থেকে নাম ধরে কেউ তাকে ডেকে চলেছে।সে চিনে কণ্ঠটা।অন্যসময় হলে ললিতার আহবানে এক মুহুর্তে ছুঁটে যেতো সে।কিন্তু আজ কেন পিছনে তাঁকালো না?অভিমান।বড্ড অভিমান।তাও এমন বিষয়ে যেখানে বেলীর দোষ নগণ্য।অথচ প্রেমিক পুরুষ খুব বেশী সময় অগ্রাহ্য করতে পারেনি বেলীকে।আস্তে করে পিছনে তাঁকালো।সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ভালোবাসাতে অন্ত:করণ বলে উঠলো, “আসছে তার কল্পনার রাণী।জয় করে নিবে শত্রু পক্ষের সমস্ত এলাকা।”
অথচ হায়!এখানে শত্রু কে?অনলের মন?বৃষ্টির মধ্যে বেলীকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে।শুভ্র রঙের পোশাকে কবুতরের মতোন লাগছে দেখতে।বেলী এতোখানি পথ দৌড়ে এসে নিশ্বাসের সাথে যুদ্ধ করছে।

“অনল!আপনাকে কতোক্ষণ ধরে ডাকছি।”

“কেন?”

“আপনার ফোন ধরছেন না কেন?”

“ইচ্ছা হয়নি।”

“আচ্ছা।”

বেলী এখনও পুরোপুরি নিজের নিশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।সে ফিসফিস করে বলল,

“আমাকে একটু বাড়ী পৌঁছে দিবেন?অনেক খারাপ লাগছে।তাদের দেখেছি আমি।ছোট্ট বাচ্চাটা অবিকল তার বাবার মতোন।ইশ কী যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের ভেতর।আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি অনল।”

বাক্যগুলো বলার সময় বেলীর শরীরটা মৃদু কম্পিত হচ্ছে।বারংবার পিছনে তাঁকাচ্ছে।অনল পুরো বিষয়টি বুঝতে পেরে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।সে ভুলে গিয়েছিল কোম্পানির অন্য ব্রাঞ্চ থেকে স্টাফদের আসার কথা আজ।সেখানে রামীমের স্ত্রী ও আছে।অনল কী বলে আসলে বেলীকে এখন শান্ত করবে?পাছে যদি মেয়েটা তাকে শুধায় অনল কেন এমন একজনের সাথে পরিচয় রেখেছে যে মূলত বেলীকে পুরোপুরি শেষ করে দিয়েছে।চিন্তায় পড়ে গেলো অনল।তবে সবকিছু এক পাশে রেখে টেনে বেলীকে বুকের মাঝে নিলো।রাস্তায় চলা পথিকগুলো তাদের পানে তাঁকায়।বৃদ্ধ রিক্সার বেল্টে টুংটাং শব্দ তুলতে তুলতে তাদের দেখে মুচকি হাসে।অন্যদিকে পৃথিবী ভুলে যাওয়া অনল স্বীয় বায়রনের কবিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“এতো শব্দের ভীরে ভীষণ ব্যথিত হয়ে ওঠেছো তুমি।জানো পাহাড়ের চূড়ায় সর্বদা নীরবতা বিরাজমান।পাখিরাও বিরক্ত করেনা।এমন পরিবেশে তোমার যাওয়া উচিত।ললিতা কখনো পাহাড়ের চূড়ায় যাবে আমার সাথে?আমার ললিতা যেখানে চাঁদও তোমার দুঃখের সাথে মিশে সূর্য হয়ে উঠবে।”

চলবে।

#আমার_ললিতা
#পর্ব:১৭
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“অনলের সাথে তোর কেমন সম্পর্ক বেলী?”

“আমার সাথে?ওমন বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই।বাকীটা তো তোমরা জানো।”

চুল থেকে টাওয়াল খুলতে খুলতে জবাব দেয় বেলী।বাহির থেকে যতো দেরী হোক ফিরে সে গোসল করবে।এছাড়া যখন খুব কান্না করার হয় তখন সে ওয়াশরুমের নির্জনতা বেছে নেয়।আজকে অকস্মাৎ রামীমের স্ত্রীকে দেখে পুনরায় ব্যাথা গুলো ফিরে এসেছে তার মধ্যে।থেমে থেমে বুকের বা পাশে আড়ালে থাকা হৃদপিন্ডটি চিৎকার করছে।বিচ্ছেদের ব্যাথা কিংবা ঠকে যাওয়ার যন্ত্রণা গুলো সেই একমাত্র বুঝতে সক্ষম যে এগুলো সহ্য করেছে।শশী পুনরায় শুধালো,

“ছেলেটা কেমন রে?সত্যি করে বল তো।”

বেলী বিরক্ত হলো।এর একমাত্র কারণ হতে পারে এখন তার মানসিক অবস্থা খারাপ।তবুও অধরযুগল চেপে বলল,

“ভালো। বাকী একেক সময় একেক মেয়ের সাথে দেখা যায় সেই কথা ভিন্ন।”

“মানে প্লে-বয়?”

“হুম।পানির গ্লাসটা দাও তো।”

শশী গোমড়া মুখে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো।তার মুখবিবর দেখে বোধ হচ্ছে কিছু একটা চলছে মনের মধ্যে।কিন্ত সেটি মুখে বলতে পারছেনা।পিপাসিত বিধায় পুরো গ্লাস ঢকঢক করে গিলে ফেললো বেলী।

“তোমার হঠাৎ অনলের ব্যাপারে জানার এতো কৌতুহল কেন?ফাহিম ভাইয়ার সাথো সবকিছু কেমন চলে?”

“ও যোগাযোগ করেনা এখন আর।”

“মানে?সব শেষ তাহলে?”

“হ্যাঁ।অনলের ব্যাপারে এজন্য জিজ্ঞেস করা।সে ছেলে হিসেবে কেমন?মানে হাজবেন্ড ম্যাটেরিয়াল কীনা।”

“আমি জানিনা।আর হাজবেন্ড ম্যাটেরিয়াল হলে বা কী?তুমি নিশ্চয় বিয়ে করার চিন্তা ভাবনাতে নেই।”

“আছি।”

বেলী অবাক হয়ে নিজের বোনের দিকে তাঁকালো।শশীর চেহারাতে লাজুক লাজুক ভাব।নাকী এমনিতে চেহারা তে গোলাপি প্রভা তৈরী হয়েছে?হঠাৎ বেলীর শরীর জ্বলতে লাগলো।সব রাগ গিয়ে পড়লো অনলের উপর।শেষে ছেলেটা তার বোনকেও ছাড়লো না?নিজেকে যথেষ্ট সংবরণ করে বেলী শুধালো,

“অনল ব্যতীত পৃথিবীতে অনেক ছেলে আছে নিশ্চয়?তুমি তাদের সাথে কথা হলো।অবশ্য ফাহিম ভাইয়ার থেকে বেস্ট কাওকে চুজ করবে।নিজের দাম নিজে দিতে শিখো।”

“বাহ!এতো সুন্দর কথা হঠাৎ তোর মুখ থেকে?এক মিনিট আমার কথাতে বিরক্ত হয়েছিস?বোন দেখে শেয়ার করতে এলাম।অনলকে পছন্দ হয়েছে আমার।যদি পারিবারিক ভাবে কিছু হয় তাহলে মন্দ হয়না।”

“ইশ আপু তুমি নির্লজ্জ।”

“একদম না বেলী।নিজের মনের কথা গুলো শেয়ার করলাম।আসলে অনেক দিন আশায় রেখেছিল ফাহিম।বয়স হচ্ছে সকলে বিয়ের কথা বলে।নিজের জীবন গুছিয়ে নিতে চাচ্ছি আমি।”

“গুড ডিসিশন।এখন একটু আম্মুকে চা করে দিতে বলবে?মাথা ধরেছে অনেক।”

“কথা গুলো শুনলি না তো।আসলে আমার কথা কেউ শুনেনা।ভেতরে যে কেমন কষ্ট লাগে।বিশেষ করে ও যদি কারো সাথে সম্পর্কে গিয়ে থাকে?আমি নিজেকে যতো স্ট্রং বলি না কেন?কীভাবে তা সহ্য করবো?”

বোনকে জড়িয়ে ধরলো বেলী।শান্তসুরে বলল,

“কষ্ট পেও না।তুমি অনেক ভালো কিছু জীবনে ডিজার্ভ করো।সময়কে সময় দাও।সব ঠিক হয়ে যাবে।আসলে আজকে আমার শরীর ভালো লাগছেনা।বৃষ্টিতে ভিজেছি তো জ্বর হবে বোধহয়।”

“তোর চোখটা লাল লাগছে।দাঁড়া মা কে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

বোন চলে যাওয়ায় পর বেলী বিছানা হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো।সঙ্গে সঙ্গে রামীমের চেহারাটা ভেসে উঠলো।আচ্ছা এই মুখটা যখন কবরে বিনষ্ট হয়েছিল তখন কেমন দেখতে হয়েছিল?ভাবতে শরীরে কাঁটা দিলো তার।রেবেকা এক কাপ চা দিয়ে গেলো তাকে।তাতে চুমুক দিতে পুনরায় গা গুলিয়ে এলো।

(***)

অনল অনেকক্ষণ ধরে কিছু নিয়ে চিন্তা করছে।তার হাতে কতোগুলো ডকুমেন্টস এসে লেগেছে।যাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তার বন্ধু প্লেনে করে গত ছয় মাসেও কোথাও যায়নি।তাহলে সন্দেহটা ঠিক জায়গায় এসে লাগছেনা।অনল নিজেকে চিরকাল বুদ্ধিমান হিসেবে জানে।শেষে কীনা এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নাস্তানাবুদ হবে?নিজেকে স্থির রাখার জন্য সিগার ধরালো।নিকোটিনের নেশা তার বিশেষ নেই।কিন্তু আজ হঠাৎ মনে হলো সব চিন্তা ভাবনা ধোঁয়ার সঙ্গে উড়িয়ে দেওয়া যায়।অনল দৃষ্টি বন্ধ করতে পারছেনা।যতোবার দেখতে পাচ্ছে বেলীর চোখে রামীমের জন্য মায়াকে।অকস্মাৎ ফোনের রিংটোনে ঘোর ভাঙলো তার।বেলী কল করছে।রিসিভ করতে ওপাশ থেকে বলল,

“আমি বাসা থেকে একটু দূরে গলির মাথায় দাঁড়িয়ে আছি ব্যাড বয়।দ্রুত আসুন।”

“এতো রাতে কেন?”

ঘড়ির কাঁটার দিকে তাঁকালো অনল।এখন বেশ রাত হয়েছে।বাহিরে বৃষ্টিও পড়ছে।অথচ মেয়েটা কীনা একা একা বাহিরে ঘুরছে?কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো অনল।উচ্চতায় বৃহদাকার হওয়ায় লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত সিঁড়ি অতিক্রম করে সদর দরজাতে পৌঁছে গেলো।ওদিকে বেলী এখনও ফোনটা ধরে আছে।

“এতো রাতে বাহিরে কী করো ললিতা?জবাব দাও।”

“ঔষধ কিনতে এসেছি।আমার খুব জ্বর।”

বেলীর জড়ানো কথাতে পূর্বেই টের পেয়েছিল অনল।মেজাজ এবার চওড়া হলো তার।

“জ্বর যেহেতু বাড়ীতে তোমার বাবা আছে, ভাই আছে তাদের না পাঠিয়ে নিজে কেন এসেছো?দাঁড়াও আসছি আমি।”

কলটা কেঁটে পকেটে ফোনটা ভরে নিলো অনল।রাত ভালো হয়েছে।গলিটা এতো বেশী দূরে না হওয়ায় পৌঁছাতে সময় লাগেনি।একটি রিক্সা টুংটাং বেল বাজিয়ে তাকে অতিক্রম করে গেলো।বেলী মুখটা মলিন করে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়।

“ললিতা!ঠিক আছো তুমি?”

বেলীর মুখের দিকে তাঁকিয়ে অনলের মনে ঝড় উঠলো।রাস্তার ঘোলাটে আলোতেও চোখের জল স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।অশ্রুকণা যেকোনো সময় গালের পথ অতিক্রম করে নিচে পড়বে।হঠাৎ মেয়েটা আগ্রাসী হয়ে শুধালো,

“আপনি আমার বোনকেও শেষ অবধি ছাড়লেন না?চরিত্রহীন কোধাকার।”

“কী বলতে চাও তুমি?”

শশীর কথাগুলো অনলকে খুলে বলল বেলী।এতো তাড়াতাড়ি সে বিষয়টি খোলাসা করতে চায়নি।কিন্তু কী হলো কে জানে?বিষয়টা ভেতরে চেপে রাখতে পারছেনা।অনল সব শুনে হেসে শুধালো,

“যদি শশী পছন্দ করে এতো তোমার কেন এতো খারাপ লাগছ?”

“কারণ আপনি চরিত্রহীন।সব মেয়েকে বুকে জায়গা দিয়েছেন।মিষ্টভাষী অন্যায় কথাও ভালোভাবে হজম করিয়ে ফেলেন।”

“ললিতা তুমি কী জানো তোমার এই ঠোঁট দুটো খুবই বাজে শব্দ তৈরী হতে সাহায্য করে।এখন জ্বরে আছো দেখে উল্টো বকছো।সুস্থ হও।বুঝতে পারবে আমি শশীকে তেমন কিছু বলিনি।”

“আমাকে নিজের ধোঁকাতে আনতে পারবেন না শয়তান।একটা লম্পট লোক।”

অনলের মুখবিবরের পেশি কঠিন হতে দেখা গেলো।সে বেলীর সঙ্গে দূরত্ব মিটিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালো।কঠিন সুরে বলল,

“তোমার এই ঠোঁটজোড়ার বহু অহংকার আছে ললিতা।এজন্য শব্দ দেখে বলেনা।বিশ্বাস করো কবে আমি এই অঙ্গের অহংকার দুমড়েমুচড়ে শেষ করে দেই।”

বাক্যের সমাপ্তিতে অনল একটা অদ্ভূত কাজ করলো।ঠোঁট শুষ্ক হওয়ায় বেলী ভ্যাজলিন দিয়েছিল ঠোঁটে।তা বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে ঘষে নিজের জিহবাতে লাগালো।

“Your lips are as bitter as your harsh word.চুপ কেন বলো যা বলছিলে।”

অন্যদিকে বেলী?সে তো এই মাত্র ঘটে যাওয়ায় ঘটনায় অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছে।দুটো কটূ কথা বলাতে যে পুরুষ এমন করতে পারে বেলী মনে মনে যা ভাবছে সেগুলো বললে ঠিক আর কী কী হবে?

চলবে।