#আমার_ললিতা
#পর্ব:৪১
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“এতো জঘন্য ব্যবহার পাওয়ার পরেও ওই মেয়েটাকে তোর ভালোবাসতে হবে অনল?যেখানে সম্মান অবধি পাচ্ছিস না।মাথা কী নষ্ট হয়েছে?”
অনল স্থির দৃষ্টিতে টেবিলে বসে থাকা সিকান্দারের পানে তাঁকালো।যে প্রতিক্রিয়াহীন পাটিসাপটা চিবাতে ব্যস্ত।অরুণা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল,
“আমার দিকে তাঁকা অনল।তোর বাবা বিষয়টা বহু আগে বলেছিল আমাকে।”
“এটাই তো দুঃখজনক ছোট আম্মু।সিকান্দার স্যার অরুণা ম্যামের থেকে করুণা ম্যামের সাথে একটু বেশী সহজ হলে জীবনটা তার সুন্দর হতো।”
“শয়তান ছেলে বাবা-মা কে স্যার ম্যাম বলছে।”
“খালাকেও বলেছি।আমার কাছে বৈষম্য নেই।তবে মাথা যায়নি আমি সত্যি মেয়েটাকে ভালোবাসি ছোট আম্মু।কিন্তু ওর মতোন মাথামোটা মেয়ে আমি পুরো বিশ্বে দুটো খুঁজে পাবো কীনা সন্দেহ।আমি এতো মেয়েদের সাথে কথা বলেছি তাদের থেকে সবথেকে আইকিউ লেভেল আই থিংক ললিতার কম হবে।”
সিকান্দার ট্যাবের উপর দৃষ্টি রেখে বলল,
“আর তাকে যে পছন্দ করে নিশ্চিত তার আইকিউ লেভেল আরো কম হবে।কী বলো অরুণা?”
অনল অগ্নি দৃষ্টি ফেললো সিকান্দারের উপর।সবার মধ্যে সবথেকে নিরব করুণা।সে একটু পর পর এটা ওটা টেবিলে দিয়ে যাচ্ছে।দুটো বোনের মধ্যে চেহারার পার্থক্য খুব কম।চট করে কেউ ধরে ফেলতে পারবেনা।অনল কণ্ঠ নিচে নামিয়ে বলল,
“বেলীকে দেখেছো তুমি? অনেক সুন্দর।”
“দেখেছি।এর থেকেও সুন্দর দেখতে আমার ননদের মেয়েটা।লন্ডনে পড়াশোনা করছে।”
“ড্যাম ছোট আম্মু।তুমি বাংলা সিনেমার টিপিক্যাল খালা শ্বাশুড়ীর মতোন কথা বলছো।”
অরুণা ছোট করে অনলের মাথায় চাটি মা”র”লো।ছেলেটা হাসতে হাসতে খালার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।
“জানো আজ সকালে আমার উপর দিয়ে কতোকিছু গিয়েছে।এরপর অফিসের কাজ।আমি ভীষণ ক্লান্ত।”
“ক্লান্ত কাজের জন্য নাকী বেলীর জন্য?”
অনল দীর্ঘশ্বাস ফেললো।পুরুষটির কপালে থাকা সরু ভাঁজ গুলো স্পষ্টত ব্যাখা করছে যে সে বেলীর ব্যাপারটা নিয়ে ভেতরে ভেতরে বেশ পু”ড়ে যাচ্ছে।অরুণা মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“বেলীকে তুই প্রথমবার কবে দেখেছিলি?এতো কেন মেয়েটাকে পছন্দ করিস?”
“একটা গোপন কথা শুনবে?”
“বল।”
“বেলীকে আমি রামীমের সাথে প্রথমবার দেখেছিলাম।রমনা তে।কপোত-কপোতীর জন্য যেহেতু প্রেম করার বেস্ট জায়গা সেটা।মেয়েটার চেহারা চট করে দেখে আকর্ষিত হওয়ার কিছু নেই।সেদিন নেহাৎ আমি সাধারণ মেয়ে ভেবে আমি ইগ্নোর করে গিয়েছিলাম।তবে এরপর বহুবার স্বপ্নে দেখেছি।ধীরে ধীরে আকর্ষণ বেড়েছে।”
“যখন জানলে অন্য কারো প্রেমিকা তখন পিছনে কেন সরে গেলি না?”
“এই প্রশ্নের জবাব নেই।উল্টো তখনও আমি যা করেছি তা অন্যায়।অন্যের জিএফকে চিঠি দেওয়াটা নিশ্চয় খারাপ বিষয়।”
“সেটা যাই হোক।কিন্তু মেয়েটা তোকে পছন্দ করেনা।”
“না।ও আমাকে অনেকটা ভালোবাসে।”
“এতো কনফিডেন্স?”
“প্রচুর ছোট আম্মু।”
সিকান্দারের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে সে উঠে দাঁড়ালো।গলা পরিষ্কার করে অরুণাকে বলল,
“তোমার ভাগ্নেকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিও।আজ যা হয়েছে তা ভীষণ বাজে ঘটনা।নেহাৎ নিজের ছেলে হিসেবে ভালোবাসি আমি দেখে সব জেদ মেনে নিচ্ছি।”
সিকান্দার চলে গেলে অনল একদম নিশ্চুপ হয়ে সিলিং এর দিকে দৃষ্টি রেখে তাঁকিয়ে রইলো।হঠাৎ সে বলে উঠলো,
“রামীম বেলীকে ভালোবাসতো ছোট আম্মু।অনেক বেশী ভালোবাসা ছিল তাদের মধ্যে। এটা আমার জীবনের এমন এক সত্য যেটাকে আমি ঘৃ” ণা করি।”
“এতো ভালোবাসার পরেও তটিনীকে কেন বিয়ে করেছিলো?”
“কিছু বিষয় রহস্য থাকা জরুরি।”
“আমি জানি অনল তুই অনেকটা কষ্টে রয়েছিস।কিন্তু আমার এই ছেলেটা যে পাহাড়ের মতোন দৃঢ় ও শক্তিশালী এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ আছে?নেই কিন্তু।ছোট বয়স থেকে শক্ত থেকে নিজের বাবা মায়ের সম্পর্কটা টিকিয়ে রেখেছিস।তাই যদি কখনো মনে হয় বেলীকে ছাড়া থাকতে পারবি তাহলে পিছনে চলে আসিস।”
“আমি এমন জায়গায় চলে এসেছি যেখানে ওই মেয়েটাকে ছাড়া ভবিষ্যত কল্পণা করা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।আমি ভীষণ ভালোবাসি ললিতাকে।”
অনল ঘুরে অরুণার কোলে ভালোভাবে মাথা রাখলো।এখন সে ঘুমাবে।যেখানে স্বপ্নতে সে বেলীকে দেখবে।
(***)
ইদানীং বেলী এক অদ্ভূত রোগে ভুগছে।সে সব জায়গায় অনলের সুগন্ধ পাচ্ছে।পুরুষটি বিশেষ এক ধরণের কোলন ব্যবহার করে।যার সুগন্ধ ইউনিক।ভেতরে আস্বাদন করলে বেশ শান্তি অনুভূতি হয়।কিন্তু এখন সেটা সব জায়গায় পায় মেয়েটি।ঘুমানোর আগে,ঘুমের সময় স্বপ্নের মধ্যে।কলেজে গেলে ক্লাসরুমে।সবথেকে অদ্ভূত বিষয় মায়ের হাতের রান্না করা কড়া বিরিয়ানির মধ্যেও সে অনলের গায়ের সুগন্ধ পাচ্ছে।এ কেমন অসহ্য অনুভূতি হচ্ছে তার?এজন্য বেলী সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে আজ সে শাহবাগে ফুলের দোকান গুলোতে যাবে।সেখান থেকে রঙ বেরঙের ফুল কিনবে।সবগুলোর সুগন্ধতে নিশ্চিত আর অনলকে পাবেনা।অনেকদিন পর সুন্দর করে সাজলো বেলী আজ।এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দেরী করেনি।মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রিক্সায় করে চলল গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
সিগন্যালে আঁটকে পড়ার পর বেলীর মধ্যে যতোটা উচ্ছাস কাজ করছিলো তা অনেকটা কমে এলো।ইদানীং সে একা থাকতে চায়না।বরং জীবনের এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে বের হতে চায়।সুস্থ সুন্দরভাবে বাঁচতে চায়।হঠাৎ পাশ ফিরে তাঁকিয়ে সে ভূত দেখার মতোন চমকে উঠলো।অনল বাইক নিয়ে তার রিক্সার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।কী যে সুন্দর লাগছে পুরুষটাকে।বেলী কে কী সে খেয়াল করেছে?নিজেকে সংযত করে সে রিক্সাতে বসে রইলো।সিগন্যাল ছেড়ে দিলে মুহুর্তে অনল বাইক নিয়ে ছুঁটে গেলো।বেলীর হঠাৎ কী খেয়াল হলো।রিক্সাওয়ালাকে বলল,
“মামা দ্রুত রিক্সা চালিয়ে ওই বাইকটার পিছু নেন।”
চালক পিছন ফিরে তাঁকালো।বিদ্রুপ কণ্ঠে বলল,
“আপনে আপা রিক্সায় বইসা আছেন।হেলিকপ্টারে না।মোটরসাইকেলের সাথে আমি পারুম না।”
নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য লজ্জা পেলো বেলী।সত্যি তো ছেলেটা যে স্পিডে বাইক চালিয়ে গেলো তাতে ধরা মুশকিল।অগত্যা রিক্সা তে বসে রইলো।গন্তব্যতে পৌছাতে এখনও বিশ মিনিট সময় লাগবে।কিন্তু ক্ষণবাদে পুনরায় বাইকটা দেখতে পেলো সে।কিন্তু এবার ভিন্নভাবে।রাস্তার এক ধারে কালো রঙের বাইকটা পড়ে আছে।অপরপাশে র””ক্তের বন্যা বয়ে গেছে যেন।বেলী দ্রুত রিক্সা থামাতে বলল।সেখানে উপস্থিত জনগণকে পুলিশ সাইডে সরে যেতে বলছে।বেলী দ্রুত তাদের জিজ্ঞেস করলো,
“কী হয়েছে?”
“বাইক এক্সিডেন্ট করছে।চালক একেবারে শেষ।অর্ধেক খু” লি উড়ে গেছে।”
বেলীর হঠাৎ মস্তিস্ক ফাঁকা হয়ে গেলো।অনল?এই বাইকে তো একট আগে অনল ছিল।সে কী শেষ হয়ে গেলো মুহুর্তে।কাঁপতে কাঁপতে সে রাস্তায় বসে পড়লো।চিৎকার দিয়ে কাঁদছে সে।সেখানকার মানুষেরা তাকে স্বান্তনা দিতে লাগলো।বেলীর মন তবুও মানছেনা।হঠাৎ পরিচিত এক সুগন্ধ নাকে এসে ঠেকলো তার।এক জোড়া শক্ত হাত তার কাঁধ চেপে ধরলো।
“কী হয়েছে ললিতা?তুমি কাঁদছো কেন?আশ্চর্য তোমার হয়েছে কী?”
“অনল!”
বেলী অবাক হয়ে অনলকে দেখছে।পুরুষটা ভুরু জোড়া কুঁচকে তাঁকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে।হঠাৎ বেলী জড়িয়ে ধরলো তাকে।শক্ত করে।যতোটা বল প্রয়োগে তাদের মধ্যে কোনো সমীরণও প্রবেশ করতে পারেনা।বিভ্রান্ত হয়ে মেয়েটা কয়েকটি চুমোও খেলো অনলকে।
“আমি ভেবেছিলাম আপনাকেও হারিয়ে ফেলেছি।কতো অসহ্য যন্ত্রণা সেই অনুভূতি।”
সামনে থাকা কালো রঙের বাইক দেখে সব পরিষ্কার হলো অনলের নিকট।সে অবাক হয়ে গেলো বেলীর কান্নাকাটি স্মরণ করে।এই মেয়ে এখনও কীভাবে অস্বীকার করে যে সে অনল কাশফকে ভালোবাসে না।অনলের হৃদয়টা আনন্দে ভরে গেলো।সে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“মাই ললিতা।আমি ঠিক আছি তো।শান্ত হও।তুমি এতো বোকা সঙ্গে গর্দভ কেন বলো তো?”
চলবে।
#আমার_ললিতা
#পর্ব:৪২
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“আপনার কী মনে হয় আমি গাঁধা?আমার কপালে বড় বড় করে কী লেখা আছে তা?”
“আমার ভাবতে হবেনা ললিতা।তুমি সেটাই।আই মিন সিরিয়াসলি? পৃথিবীতে আমার বাইকের মতোন দেখতে অহরহ রয়েছে।সেটার জন্য এমন কান্নাকাটি করতে হয়?”
বেলী লজ্জা পেলো।গালের মেদুর ত্বকটাতে গোলাপি আভা ফুঁটে উঠলো।গায়ের রঙ ঈষৎ অনুজ্জ্বল হওয়ায় এসময় দেখতে অনেকটা রক্তিম অর্ধচন্দ্রের মতোন দেখায়।অনল ভেতর থেকে শিহরিত হয়।বারংবার ঢোক গিলে।এই মেয়েটার মধ্যে কোন ধরণের নেশা পায় সে?অজান্তে বেলীর হাত ধরলো।নাকের কাছটায় টেনে লম্বা শ্বাস বিলো।বেলী উশখুশ করে বলল,
“পাগল হলেন নাকী?ছাড়ুন আমাকে।”
“তোমার শরীর থেকে সত্যি কিন্তু বেলীর সুবাস আসে।বলতে হয় মি.তোফাজ্জল ঠিক নাম রেখেছিলো তোমার।”
“আমার নাম বাবা নয় আপু রেখেছিলো।যাই হোক আপনি কথা ঘুরিয়ে দিচ্ছেন।”
হাতটা নিজের কাছে টেনে নিলো বেলী।দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,
“আমি আপনাকে একটু আগেই রাস্তাতে খেয়াল করেছিলাম।সেইম পথে সেইম বাইক দশ মিনিটের ব্যবধানে দেখলে যেকোনো সুস্থ মানুষের মাথায় এটা আসবে।স্বাভাবিক।”
“আমাকে তুমি ঘৃণা করো তবে কাঁদলে কেন?”
বেঞ্চের এপাশে বসে থাকা অনল উত্তরের আশায় এক দৃষ্টিতে নিজের ললিতাকে দেখছে।মেয়েটার চোখে মুখে প্রহেলিকার ছাঁপ স্পষ্টত।জবাবটা কী সে জানাতে চায়না?নাকী তার জানা নেই?
“অনল।”
“ইয়েস।”
বেলী সরাসরি অনলের চোখের দিকে তাঁকালো।সেই দৃষ্টিতে শূন্যভাব।অনল বেলীর দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন সে বেলীর চোখের ভেতর থেকে উত্তর খুঁজছে। কিন্তু সেই শূন্য দৃষ্টিতে কিছুই নেই শুধু একটি অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। বেলীর নির্লিপ্ততা অনলকে আরো দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলে।কিছু একটা বলতে চায় মেয়েটা।পুরুষটি আরো সন্নিকটে চলে এলো।
“তুমি কাঁদলে কেন?” অনলের কণ্ঠের ভেতর থেকে পুনরায় প্রশ্নটা এলো।
“আমি জানিনা কী হয়েছিলো।শুধু খেয়াল হলো আরো একটা ক” ব”রে”র ভার বইতে হবে।সেটা কী অসহ্য যন্ত্রণা।”
“তুমি কী অজান্তে আমাকে রামীমের সাথে তুলনা করলে?”
“আমি সজ্ঞানেই করেছি।মানুষের মন অদ্ভূত গড়নের।আপনার সাথে পরিচয়ের পর থেকে আমি না চাইতেও জুড়ে গিয়েছি।কাল আপু বলছিলো আমার চোখ দেখে বোঝা যায় যে আমি আপনাকে ভালোবাসি।”
“জবাবে তুমি কী বললে?”
“দেইনি জবাব।আমাকে একটা কথা বলেন অনল।আপনি কী কোনো খারাপ কাজ করেন?”
“কেন বলো তো?”
“একজন পুলিশ অফিসার বেশ অনেকদিন পূর্বে আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলো।সে বলেছে আপনি ভালো নয়।”
“তুমি বিশ্বাস করে নিলে?”
“না।”
“আর যদি সেসব সত্য হয়?”
“সম্ভাবনা কম।”
“হতেও পারে সে যা যা বলেছে সত্য।যদিও আমি জানিনা কী কথা ছিল সেখানে। কিন্তু তা সত্য হয় তাহলে আমাকে ঘৃণা করবে?আমাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিবে ললিতা?”
বেলী ধীরে ধীরে বলল, “ঘৃণা? আমি আপনাকে ঘৃণা করি না, অনল। কিন্তু সবকিছুর একটা সীমা আছে। আপনি তা বোঝেন তো?যে মেয়েকে বাবা তাকে পছন্দ করেনা।প্রথম ভালোবাসা তাকে ছেড়ে দিয়েছে।তার জীবনে আসলে সীমা থাকা উচিত কষ্টের।”তার গলার সুর নরম, কিন্তু শব্দের ধার যেন ধারালো ছু”রির” মত।পুনরায় বলল,
“সত্য হলো রামীমের কাজ আমাকে প্রচন্ড কষ্ট দিয়েছিলো।আচ্ছা ওয়াদা যখন ভাঙার জন্য দেওয়ার হয় তাহলে মানুষ দেয় কেন?”
অনল কিছু বলতে চেয়েও আটকে গেল। একটা ভারী নিস্তব্ধতা আবার ঘিরে ধরল তাদের।সে নিঃশব্দে বেলীর কথাগুলো শুনছিল।তার ভেতরে থাকা প্রেমিক পুরুষটি নিজের কাছে নিজে প্রশ্ন করলো।’এতো অভিমান বেলীর কণ্ঠে?’তবে আজ মেয়েটি নিজের মনের কষ্টগুলো এতো সহজে বলে দিতে পারছে কারণ তার কাছে লুকানোর কিছু নেই আর।আচ্ছা সে কি কখনো তার সত্যিটা বলবে?মাটিতে জুতো দ্বারা কয়েকটি রেখা এঁকে অনল বলল,
“ওয়াদা ভাঙার জন্য মানুষ দেয় না। আমরা হয়তো ভাঙতে চাই না।কিন্তু পরিস্থিতি চরিত্র অনেক কিছুই বদলে যায় ঘটনার ফলে। আমি হয়তো জানি কীভাবে রামীম তোমাকে আ”ঘা”ত করেছে।কিন্তু আমি জানি আমি চাই না তোমাকে এমন কষ্ট আর দিতে।”
বেলী ঈষৎ হেসে বলল, আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে চাই। কিন্তু আপনার আশেপাশে একটা অদ্ভুত অন্ধকার আছে। সেটাই আমার ভয়।”
অনল একটু হেসে বলল, “অন্ধকার?কিন্তু আমি তো আগুন।আগুনের আশেপাশে অন্ধকারের ঠাঁই নেই।আমাকে বিশ্বাস করো বেলী।আমি তোমাকে হারাতে দিবো না।তবে যে পুলিশ অফিসার তোমাকে উদ্ভট নিউজ দিয়েছে তার খোঁজ নেওয়া আবশ্যক।কিছু একটা ঝামেলা চলছে।”
অনলের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো।এমনটা কিছু কেন বেলীর কাছেই এসে বলল?বিস্তারিত সে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছে না।কিছু রহস্য নিজ থেকে সমাধান করা দরকার।
“কোথায় যাচ্ছিলে?এমন সেজেগুজে আছো।”
“নিজেকে নিয়ে ডেটে এসেছি।মাঝখানে এক শয়তান এসে সব নষ্ট করে দিলো।”
“এর ক্ষতিপূরণ দিতে পারি আমি।”
“কীভাবে?”
“আমার সাথে বাইকে ঘুরবে?”
বেলী কিছু ভাবলো।এক মন বলছে না যেতে।কিন্তু পুরুষটি এমন এক আগুন যা চিন্তা শক্তিকে নিস্ক্রিয় করে দেয়।সে ফিসফিস করে বলল,
“আমি আপনার সাথে গেলে সেটা কাওকে বলতে পারবেন না।ওয়াদা করেন।”
“আমি এমনিও কাওকে বলার ক্ষেত্রে মত দিবো না।প্রেম লুকিয়ে করা ভালো।”
“আমি আপনার সাথে প্রেম করছিনা।”
“আই নো আমার বাইরনের কবিতা।”
অনল তর্জনী দ্বারা বেলীর নাকে স্পর্শ করলো।তারা উঠে বাইকের কাছটায় এলো।হঠাৎ মেয়েটা শুধালো,
“আমার জন্য এতো অপমান সহ্য করলেন সেদিন।তাহলে আজ এতো ভালো বিহেভ কেন করছেন?”
“প্রশ্নটার জবাব সহজ।আমার হবু বউ তুমি।তার সাথে খারাপ ব্যবহার করা যাবে?”
“বড্ড দিবা স্বপ্ন দেখেন।”
“আপনার স্বপ্নই তো তুমি।এখন এসে বসো।”
বাইকের পিছনটাতে এসে বসলো বেলী।অনল চালু করতেই তারা পিচঢালা রাস্তায় নেমে এলো।এখন দিনের শেষ সময়।ঈষৎ ঠান্ডা পরিবেশ।বেলীর বহুদিন পর নিজেকে স্বাধীন মনে হচ্ছে।সে অনলের সাথে কেন এলো?এই প্রশ্নে বিভোর থাকতে চায়না।বরং জীবনের সব অন্ধকার কাঁটিয়ে একটা সুন্দর সময় চাচ্ছে।হঠাৎ কী মনে হলো তার।ধীরে ধীরে ব্যাড বয়ের পিঠে মাথা রাখলো ললিতা।এ সময় অনন্ত কাল চলুক।কখনো না শেষ হোক।
চলবে।
#আমার_ললিতা
#পর্ব:৪৩
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
” ললিতা বসে একা, চোখে বিষাদের দা”হ
অনল পু”ড়ে যায় দূরে, বিরহের সর্বনাশে”
“দুটো লাইন পড়ে কী মনে হলো তোমার বেলী?প্রচন্ড বিরহে নি:শেষ হয়ে যাওয়া অনল নামক প্রেমিকের দুর্দশার কথা তাইনা?বোধহয় তাই।এর সাথে একটা প্রশ্ন ছিল যে আমি তাকে তার ললিতাকে দিবো কীনা?
সেদিন সকালে আমার কাছে যখন একটা চিঠি এলো তখন আমি অবাক হয়েছিলাম।আটামাখা হাতে মা চিঠি এনে দিয়ে বলল, ‘ রামীম তোকে একজন এটা দিয়ে গেলো।বলেছে পড়ে জবাব জানাতে।তা নয় সে শ্বাস আঁটকে দম হারাবে।’ আমি প্রচন্ড অবাক হয়েছিলাম একথা শুনে।চিঠি খোলার পর খাম থেকে সাদা একটি কাগজ ব্যতীত আর কিছু বের হয়নি।এই দুটো লাইন সেখানে লেখা ছিল।অনল নামক মানুষটাকে আমি চিনি।সেই ছোটবেলাতে আমরা একসাথে স্কুলে পড়তাম।পরবর্তীতে আমার স্কুল বদলে দেয় বাবা।দেখতে সুন্দর ছেলেদের হয়তো একধরণের অহমিকাবোধ থাকে।অনলও এর ব্যতিক্রম নয়।এতো বছর পর যখন তোমার সুবাদে আবার দেখলাম আমি চিনতে পারিনি।কিন্তু অনল ঠিকই চিনেছে।স্মৃতিশক্তি প্রচন্ড মজবুত কীনা তার।তোমার মনে আছে তুমি ড্রয়িং ক্লাস করতে যেতে বেইলি রোডের ওদিকে?অনল তোমাকে সেখানেই দেখেছিলো।এরপর কীভাবে প্রেমে পড়েছে ছেলেটা আমাকে বলেনি।কিন্তু তোমাকে চিঠি দেওয়া, তোমার বন্ধুদের হু” ম”কি বা পি”টা”নো সব কানে আসতো।তোমাকে তো বলেছিলাম এই ব্যাপারে।আমি সব জেনেও কিছু বলিনি।কারণ আমার রজনীগন্ধার মনে শুধু আমার বসবাস ছিল।তো সেখানে কোথাকার কোন অনলকে আমি পাত্তা দিবো কেন?তাছাড়া অনেক বেশী বাজে কথা শুনেছি ওর ব্যাপারে।সেসবও আশংকাজনক।আমি শুধু তখন আমাদের নিয়ে ভাবতে চাচ্ছিলাম।কিন্তু নিয়তি দেখো?আমাকে শেষ করে দিচ্ছে রোগটা।
আমি ভেবেছিলাম যতোদিন বাঁচি একা বাঁচবো।স্বল্প এই জীবনে কাওকে জড়ানোর মতোন বোকামো করার মানে হয়না।আমি শুধু তোমার আশেপাশে থাকতে চাচ্ছিলাম বেলী।কিন্তু চিঠিটা পাওয়ার পর আমার মনে পরিবর্তন হলো।রোগাক্রান্ত শরীর নিয়ে ছুটে গেলাম সিকান্দার আঙ্কেলের নিকট।আমার শুধু একটা কথা জানার ছিল যে অনল সত্যিই খারাপ ছেলে কীনা?কারণ আমি যাওয়ার পর তোমার জীবনটা পুরোপুরি বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে।সেসময় শক্ত খুঁটি দরকার।সিকান্দার আঙকেল আমাকে আশ্বাস দিলো তার ছেলে খারাপ নয়।তবে পাগল।মানে বদ্ধ নয় বরং এটা বলা যায় দুনিয়ার সব পাগলামি তার মধ্যে আছে।
আমি এটা বলছিনা যে তুমি অনলকেই ভালোবাসো।তোমার মনের ইচ্ছে অনুযায়ী সব কাজ করবে।আমার অসুস্থ হওয়ার পূর্ব থেকে অনল তোমাকে চাচ্ছে।কিন্তু এখন সে আমার কাছ থেকে শুধু এতোটুকু আশা করছে যে জীবিত অবস্থাতে আমি তোমার সাথে সব সম্পর্ক শেষ করি।তটিনীকে বিয়ে করার আমার কোনো ইচ্ছা ছিলনা।কিন্তু মেয়েটা আমাকে আগে থেকে ভালোবাসতো।বন্ধুত্বের আড়ালে কখনো বলেনি।সে এমনভাবে আমার মায়ের সঙ্গে মিলে বিয়ের কথা বলল যে আমি না করতে পারিনি।তোমার থেকে দূরে থাকার সঠিক কারণটাও পেয়ে গেলাম।আমি এই যে তোমাকে এসব ডায়ারিতে লিখে যাচ্ছি তা কখনো অনল তোমাকে দেখাবেনা বলেছে।কারণ সে নিজে তোমাকে অর্জন করতে চাচ্ছে।প্রেম কী অদ্ভূত জিনিস তাইনা রজনীগন্ধা?আমি যাকে চাইলাম তাকে পেলাম না বরং যে আমাকে কামনা করলো সে ঠিক পেয়ে গেলো।তোমাকে রোজ মনমরা থাকতে দেখি।বিশ্বাস করো একটুও ভালো লাগেনা।কিন্ত মায়া বাড়িয়ে কী লাভ বলো?একটা গোপন কথা বলি?তটিনীকে স্ত্রীরুপে মেনে নিতে কষ্ট হয় মাঝে যখন কিছুটা সুস্থ হলাম তখন আমাদের মধ্যে সম্পর্ক এগিয়েছে।আমার একটুও ভালো লাগেনি বেলী।”
এরপর আর কোনো লেখা নেই।বেলী কয়েকবার পৃষ্ঠা উল্টে দেখলো।কিন্তু কিছু নেই।অশ্রুসজল চোখে অরুণার পানে তাঁকালো।
“এটা রামীমের দেওয়া শেষ চিঠি নয়।বরং ওর ডায়ারিতে লেখা ক্ষুদ্র অংশ।অনল তোমাকে ভুল বলেছিলো যে চিঠি।সত্য বলতে ও কখনো তোমাকে এসব দেখাতো না।”
“তাহলে আপনি কেন দেখালেন?উল্টো বেলীর মনের কষ্টটা বাড়িয়ে দিলেন।” প্রচন্ড আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলল রেবেকা।বেলীর হাতখানা সে ধরে রেখেছে।সে একটু আগে অরুণাকে দেখে ভেবেছিলো অনলের মা।কিন্তু কয়দিন পূর্বের ঘটনার জন্য অনেক কিছু শুনিয়েও দিতে চেয়েছিলো।পরে যখন শুনলো সে অরুণা তখন নিজেকে সংযত করলো।
“আমি এটা দেখিয়েছি কারণ রামীম নয়।বরং অনল।তুমি ওর জন্য একটা অবসেশন মেয়ে।একটা বিষয় মস্তিস্ক দ্বারা ভেবে দেখো।ও কতোটা অসহায় বোধ করছে যে একজন প্রেমিকের নিকট তার প্রেমিকা চেয়ে বারবার আর্জি জানিয়েছিলো।তোমাকে ও হারাতে চায়না কোনোভাবে।”
বেলী দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে সংযত করলো।হাতের চিঠিটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
“রামীম আমাকে ভালোবাসতো একথা কেন যেন আজ এই মুহুর্ত থেকে বিশ্বাস হচ্ছে না।ও নিজেও বলেছিলো তটিনী তাকে জোর করায় বিয়ে করেছে।এমন বেহুদা লজিক এই পৃথিবীতে আর একটাও থাকতে পারে মা?”
রেবেকা খেয়াল করলো বেলীর চোখেমুখে প্রচন্ড আক্রোশ দেখা দিচ্ছে।হয়তো এতো বছরের দুঃখ মিলে একটা ক্ষোভের জন্ম দিলো মনে।অরুণা তার কথার মধ্যে বলল,
“আমি এখানে অনলের জন্য এসেছিলাম। সত্য বলতে এই জীবনে তোমার মনের সঙ্গে ওর যুদ্ধটা প্রবল।সেখান থেকে রামীমকে সরিয়ে নিজের অবস্থান গড়া সহজ নয়।আমার ছেলের মতোন নয় বরং ছেলেই হচ্ছে অনল।করুণা আর অরুণার মধ্যে তফাৎ আদৌ কিছুর নেই।সেক্ষেত্রে সন্তানদের মধ্যেও নেই।অনল তোমাকে ভালোবাসে এটা সত্যি অনেক বড় বিষয়।ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও।আসছি।”
অরুণা উঠে দাঁড়ালো।বেলী হঠাৎ তার হাতখানা ধরে ফেললো।মেয়েটার মুখে এখনও দুঃখের ছাঁপ।অরুণার হঠাৎ অনেক মায়া হলো।সে থুতনিটা ধরে বলল,
“কিছু বলবে?”
“আমি এসব লেখা পড়েছি তা আপনি অনলকে কখনো জানাবেন না।”
“কেন?তুমি কী নিজের মধ্যে পরিবর্তন করতে চাচ্ছো?”
“হ্যাঁ।অনল যেন না ভাবে কখনো এই চিঠি দ্বারা আমার মনে পরিবর্তন এসেছে।আমি তা চাইনা।”
“বেশ।বলবো না।আমার একটা পরামর্শ থাকবে।যা একজন মানুষ হিসেবে অন্য মানুষকে বলতে চাই।আমি এমন অনেককে দেখি যে একজন মানুষের সাথে বিচ্ছেদের পর এতোটা আত্নহারা হয়ে উঠে যে অন্য সবকিছু তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়।তুমি তাদের মতো হইও না।অনলকে ভালোবাসতেই হবে এমন না।বরং নিজেকে ভালোবাসো।নারীর জীবন কোনো খেলনা নয়।”
অরুণা মৃদু হেসে বেলীর মাথায় স্নেহসুলভ চুমো খেলো।মানুষটার ব্যক্তিত্ব দারুণ মনে হলো রেবেকার।
(***)
অনলের মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে।অবশ্যই এটা স্বপ্নই হবে।তা নয় তার ললিতা কেন এতো সকাল সকাল তার রুমে আসবে?স্বপ্নে ছাড়া আপাতত তা সম্ভব না।সে ঘুমন্ত চোখটা পুনরায় বন্ধ করলো।
“অনল।উঠেন আর কতো ঘুমাবেন?”
চট করে উঠে বসলো অনল।তার একটি অভ্যেস আছে উদাম হয়ে ঘুমানোর।তবে ললিতার সামনে লাজ কম যেন তার।সে ঘুমঘুম কণ্ঠে বলল,
“কী চাই?”
“এতো রুড ভাবে বলছেন কেন?তবে যখন জিজ্ঞেস করছেন তাহলে বলে দেই।এক লাখ টাকা লাগবে।”
অনল খুব কষ্টে নিজের মেজাজ ঠান্ডা রাখলো।সারারাত প্রায় জেগে ছিলো।সকাল সকাল একটু ঘুমিয়েছিল তাও কীনা মেয়েটা এভাবে নষ্ট করলো?
“শুধু তুমি সুন্দর দেখে আজ বেঁচে গেলে ললিতা।তা নয় সকাল সকাল এমন রসিকতার ফল ভালো হতো না।”
বেলী বিরক্ত হলো।এমনিতেও তার বাবা আর ভাইয়ের থেকে লুকিয়ে এসেছে।যদি রাহিমা না সাহায্য করতো তাহলে এই অবধি আসাও সম্ভব ছিলনা।আর মানুষটা কীনা তাকে বিশ্বাস করছেনা।এক ধাপ এগিয়ে এসে সে বলল,
“দেখুন আমার সত্যি টাকা লাগবে।”
“কোন কারণে শুনি?”
বেলী নিশ্চুপ রইলো।তার চোখে বিষন্নতা।যেন কথাটা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে।অনল আগ্রহভরে অপেক্ষা করছে জবাবটার জন্য।
চলবে।