#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
পর্ব সাতেরো
–এই সুজি রাগ করছ কেন?
-কে বলল রাগ করেছি, আমি ঠিক আছি।
উঠে চলে গেল সৃজিতা।
-আমার দিকটা একটু বোঝো। মালিক আমার পক্ষে থাকেন। আমাকে স্নেহও করেন। তবুও তিনি মালিক। একের পর এক যা চাপ পড়ছে আমি আর পেরে উঠছি না। একদিনের ছুটি নিলে মুখ ভার হয়ে যায় সেখানে ঘুরতে যাওয়ার জন্য ছুটি চাওয়া হল একটা বিলাসিতা।
-আমি আর কিছু শুনতে চাই না। তুমি প্লিজ কিছু বলো না।
-তুমি বোঝার চেষ্টা করছ না। আমি কী করব বলো?
-কেন কথা বাড়চ্ছো বলো তো? চল তোকে পরিষ্কার করিয়ে দিই।
বুবলাইকে কোলে নিয়ে অন্য ঘরে গেল সৃজিতা।
মাকে দেখা আসার পর থেকেই সৃজিতা অল্পতেই আঘাত পাচ্ছে। কী হতে পারত, আর কী হয়েছে..এই সব ভাবনা মনের মধ্যে আসছে। যাদের বিদেশ ভ্রমণ বছরে একবার হতই, সেখানে বছর তিন ঘরের বাইরে রাত কাটায়নি সৃজিতা। সকালে ওঠা, রান্নাবান্না করা ছেলে সামলানো ঘর পরিষ্কার এটাই ওর দৈনন্দিন কর্মসূচি। ঘরের উঠোন থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সৃজিতা। খিটখিটে হয়ে উঠেছে সৃজিতা।
ছেলেকে সাফ করতে করতে চোখে জল ফেলল।
-আমি কী এমন জীবন চেয়েছিলাম!
একটা দীর্ঘনিশ্বাস নির্গত হল সৃজিতার অন্তঃস্থল থেকে..
**
তিনমাস পর:
দুপুরের ভাত ঘুম থেকে উঠে ঘড়ি দেখল হৈমপ্রভা। পাঁচটা বেজে দশ মিনিট। তড়িঘড়ি বিছানা ছাড়ল। বাড়তি দশ মিনিট ঘুমানোর জন্য নিজের উপর বিরক্ত হল। আজ আবার সন্ধ্যায় ব্লসমে যাবে। সকালে হেম ফ্যাক্টারীতে বিনা নোটিশে পরিদর্শন করেছে হৈমপ্রভা। চুরিও ধরা পড়েছে। এমন ছোট চুরি চলতেই থাকে। বয়েস বাড়ছে হৈমপ্রভার। কী ভাবে যে ফ্যাক্টারী আর ব্লসম সামলাবে বুঝতে পারে না।
মাআ মাআআ..
তীক্ষ্ণ চিৎকারে কান ঝালাপালা হল হৈমপ্রভার। মেয়ের বিচ্ছেদের মানসিক অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য টিয়া পাখি কিনে আনে হৈমপ্রভা। স্বাধীনচেতা হৈমপ্রভা ছিল পাখি পোষার ঘোর বিরোধী। খাঁচাতে এইভাবে একটা প্রাণীকে বন্দী করবে! মতাদর্শ পরিবর্তন করে ছোট্ট টিয়াকে খাঁচায় রাখে। ভালোবাসা দিলেও ওকে আর খোলা আকাশে উড়তে দেয় না। পালিয়ে যাওয়ার ভয় ওকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
-যাই যাই..
দ্রুততার সাথে দোতলার বারান্দায় এসে খাঁচার সামনে দাঁড়ায় হৈমপ্রভা। হৈমপ্রভাকে দেখে আরো জোরে চিৎকার করল মিষ্টু নামের টিয়া।
-দিপালী ছোলা সেদ্ধটা আনো। মিষ্টুর খুব খিদে পেয়েছে।
যতটা চোখ বড় করা যায় ঠিক ততোটাই চোখ বড় করে ছোলার কথা শুনল। শান্তও হল।
মিষ্টুকে খাঁচা থেকে বের করল হৈমপ্রভা। মিষ্টু হাত থেকে সটান ঘাড়ে উঠল। তারপর চলা চলা বলে কাঙ্খিত ছোলা চাইতে শুরু করল। পড়ি কি মরি করে সেদ্ধ ছোলা নিয়ে এল দিপালী।
-থাক মিষ্টুকে ছোলা খেতে হবে না। বাটির ছোলাটা একবার দেখিয়ে আবার নিয়ে চলে যাওয়ার অভিনয় করল।
মুখ ফুলিয়ে চিৎকার করতে থাকল মিষ্টু।
সেই সময় বাড়িতে ধুমকেতুর আগমন হল।
-দিনদিন আমরা এই সামারে বরফে বেড়াতে যাব।
হৈমপ্রভার কাছে এসে বলল সেই ধুমকেতু।
-ওমা তাই..আমাকে নিয়ে যাবে না?
-পাপাকে বলবো তোমারো টিকিট করে দেবে।
বিজ্ঞের মতন বলল পাঁচ বছরের বুবাই।
সংযক্তা বেশিরভাগ সান্যাল ম্যানসনে থাকে। মার্চে বুবাইয়ের নার্সারির পরীক্ষা চলছিল, টানা বারোদিন শ্বশুরবাড়িতে ছিল সংযুক্তা। আজ আবার ফিরেছে।
এবার বুবাইয়ের চঞ্চলতায় বাড়ির প্রতি সদস্য তটস্থ থাকবে। আবার আগের মতন হাসবে হৈমপ্রভা। এই নাতি যে ওর বড় আদরের।
বুবাই কি তাহলে সান্যাল ম্যানসের একমাত্র উত্তরসূরী! কি জানি সময় বলবে সে কথা।
-ব্যাস এসেই বদমাইসি শুরু। জানো ওর দাদু ঠাম্মিকে যা জ্বালিয়েছে,ওরা দিন দশ অন্তত যেতে বলবে না।
-না রে নাতি-নাতনিদের অত্যাচার দাদু ঠাম্মিরা হাসি মুখে সহ্য করে। এই সম্পর্ক গুলো যে খুব মায়ামাখানো।
আদর করল নাতিকে..
-কি জানি! ওদের কথা জানি না। ও মা তুমিও চলো না আমাদের সাথে।
-ধুর! আমার আবার ঘুরতে যাওয়া।
-এক আধদিন তো ছুটি নাও। সেই বাবা থাকতে আমরা চারজন প্যারিস গিয়েছিলাম। তারপর তুমি কোথাও যাওনি। চলো না মা।
-আরে তোরা তিনজন যাচ্ছিস যা না। আমাকে টানছিস কেন?
-আমরা কি হানিমুনে যাচ্ছি? চলো না মা। তুমি তাও বুবাইকে সামলে রাখতে পারবে।
মেয়ের অভিমুখে তাকাল হৈমপ্রভা। সেবার যখন আন্দামান গেল নিজেরাই গেল, উটিতেও তাই। এখন ছেলেকে সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাই মাকে এত সাধাসাধি।
-কিন্তু সত্যি আমার অত দিন ব্যবসা ছেড়ে যাওয়া যাবে না।
-বুবাই বরফ বরফ করছে। তাহলে গ্যাংটক ঠিক করি। ওমা তুমি আর না কোরো না।
-কিন্তু..
-কোনো কিন্তু না। তুমি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছো। আর এটাই ফাইনাল।
-ওয়াও, দিনদিন আমাদের সঙ্গে যাবে। কি মজা..
আনন্দে লাফিয়ে উঠল বুবাই।
-দাঁড়া আমি ভেবে দেখি..
চলবে:
#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_আঠারো
-মা এত ভাবাভাবির কী আছে? তুমি যাচ্ছো ব্যাস..
-এখুনি বলতে পারছি না। সবে দৈনন্দিন কাজকর্ম শুরু করেছি। এখন আবার গেলে সমস্যায় পড়ব।
-ঐ জন্যই বলছি এখুনি চলো। পরে আর যেতে পারবে না।
-দিনদিন চলো না। খুব মজা হবে।
করুণ মুখে সম্মতি চাইছে বুবাই। কথা কাটতে পারল না হৈমপ্রভা।
-আচ্ছা চল..আমি যাব।
-কী মজা কী মজা..আমার সোনা দিনদিন।
দিদাকে জড়িয়ে ধরল বুবাই।
-ভালোই হল আমি শিবমকে টিকিট কাটতে বলে দিচ্ছি। বাকিটা তুমি দেখে নিও। শাশুড়ি ট্যুরে নিয়ে যাচ্ছে শুনলে খুব খুশি হবে।
উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে গেল সংযুক্তা।
অবাকের সাথে বিরক্ত হল হৈমপ্রভা। ওকে জোর করার আসল কারণ বুঝতে পারল। বড় মেয়ে মায়ের টাকা আদায় করতে সদা তৎপর। সৃজিতা ছিল দিদির সম্পূর্ণ উল্টো। প্রয়োজনের বাইরে এক টাকার খরচ করার পাত্রী সে নয়।
-আমার সুজি এমনটা ছিল না।
সংযুক্তার স্বভাবের সাথে সৃজিতার স্বভাবের ফারাক উপলব্ধি করে মনে করে আক্ষেপ করল হৈমপ্রভা।
***
-শুনছো সৃজি বুবলাইকে একেবারে নার্সারিতে ভর্তি করব।
-প্লে তে করবে না?
-শুধু চাপ দিয়ে কী হবে। ভর্তি করলেই তো পরীক্ষা শুরু। তার থেকে আরো একটু খেলুক।
-বলো দুষ্টুমি করুক। এখন কত নতুন কথা শিখছে। উফ! আমি হেসে হেসে মরি..দেখো ঘুমাচ্ছে বলে বাড়িটাও কত শান্ত। দশমিনিট আগে তোলপাড় চলছিল। ঘুমন্ত ছেলেকে নিজের কাছে টেনে চুম্বন করল সৃজিতা।
-সৃজি তোমার পাহাড় খুব বেশি পছন্দ নয় না?
প্রশ্ন শুনেই মেজাজ পরিবর্তন হল সৃজিতার।
-আবার এখন এই সব প্রশ্ন কেন?
-আহা! বলোই না…
প্রত্যুত্তরে মৌন থাকল সৃজিতা।
-এই বলো না..
শুয়ে শুয়েই হাত দিয়ে স্ত্রীকে ঠেলা দিল নির্ঝর।
-পাহাড় বা সমুদ্র। হলেই হল..
গম্ভীর স্বরেই বলল সৃজিতা।
-তাহলে পাহাড়েই যাব।
নির্ঝরের মুখ থেকে নিঃসৃত কথার প্রকৃত অর্থ জানতে সৃজিতারও ইচ্ছে করছে। স্বপ্ন ভঙ্গ হওয়ার আশায় প্রশ্ন করতে মন চাইলো না।
-এই সৃজি কিছু জিজ্ঞাসা করলে না যে?
-কী জিজ্ঞাসা করব?
-ঐ যে হঠাৎ তোমায় কেন এমন প্রশ্ন করলাম।
-প্রশ্নটা যখন তোমার মাথা থেকে এসেছে উত্তরটা তুমিই দাও। আমি শুনি…
-যদি বলি আমরা পাহাড় যাচ্ছি..
“পাহাড় যাচ্ছি” এই শব্দ দুটো শোনামাত্র সৃজিতার মনে উত্তেজনা কাজ করল।
-সত্যি?
কোনরকম রাখঢাক না রেখেই খুশি মুখে উঠে বসে বলল সৃজিতা।
-তিন সত্যি..
নির্ঝরও বিছানায় উঠে বসে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল।
***
গোধূলি শোরুমে ঢুকে তীর্থঙ্করের কেবিনে দিকে পা বাড়াল নির্ঝর। ছুটির দরখাস্ত জমা দিতেই সেখানে যাওয়া। এখন তীর্থঙ্কর থাকবে না। প্রতিদিন আসেও না। পিয়ের কাছে দিয়ে আসবে। অনেক ভেবে
সাতদিনের জন্য ছুটি চেয়েছে নির্ঝর। বিয়ের পর দীঘা, মন্দিরমণি অব্দি যায়নি। তখন ওর মা বেঁচে ছিল। মা মারা যাওয়ার পরেই বুবলাই গর্ভে আসে। ঘুরতে যাওয়াতে দাঁড়ি পড়ে। তারপর কচি বাচ্চা নিয়ে কখনো বাইরে যাওয়ার কথা ভাবেনি। এখনো ভাবত না। সৃজিতার অস্থিরতা দেখে নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিল। তাই এই সিদ্ধান্ত। এবার ভালোই ভালোই ছুটি মঞ্জুর হলেই হল।
দরখাস্তটা জমা দিয়ে নিজের কাজে লেগে পড়ে নির্ঝর। কেরলার এক ধরণের শাড়ির খোঁজ পেয়েছে। গুগলে বিশদে দেখতে থাকে নির্ঝর। কোন কাপড়ে শাড়িটা তৈরি, কোন কোন রঙের শাড়ি গুলো দেখতে সুন্দর..সেইগুলো নিয়েই গবেষণা চলছিল। সাড়ে বারোটায় তীর্থঙ্করের কেবিনে ডাক পড়ে নির্ঝরের।
কাজটা অর্ধেক ছেড়েই কেবিনের দিকে অগ্রসর হয়।
-আসবো স্যার?
-হ্যাঁ এসো। শাড়িটার খোঁজ পেলে?
-হ্যাঁ পেয়েছি। ডিটেলে দেখছি। আজকের মধ্যে আপনাকে জানাচ্ছি। শাড়িগুলো হাল্কা কালারের মধ্যেই সব আসছে।
-আচ্ছা সব ইনফরমেশন আমাকে মেইল করে দিও।
-আচ্ছা স্যার।
-ঠিক আছে এখন যাও।
নির্ঝর দেখল ওর দরখাস্ত টেবিলের সাইডে মোড়ানো আছে। খাম থেকে বের করেছে মানে পড়েছে। নিশ্চিত হল নির্ঝর।
-স্যার আমাকে কী শাড়ির খবর জানার জন্য ডেকেছেন?
জিভ কাটল তীর্থঙ্কর।
-দেখেছো বয়েস হচ্ছে সব ভুলে যাচ্ছি। ছুটি কীসের জন্য? কোথাও ঘুরতে যাচ্ছো?
-হ্যাঁ স্যার। বিয়ের পর কোথাও যাওয়া হয়নি।
-কোথায় যাচ্ছো?
-গ্যাংটক।
লাজুক হাসল নির্ঝর।
-বেশ বেশ..ঘুরে এসো। দাদুভাইকে সামলে রেখো।
-ওটাই একটা চাপের বিষয়।
স্মিত হাসল নির্ঝর।
-তোমার কাজ মাধবকে বুঝিয়ে দিও। প্রথম বার এত দিনের ছুটি নিচ্ছো তো..আমরা অসুবিধাতে পড়ব।
মুখকে অনুচ্চারিত রেখে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে গেল নির্ঝর।
“শালা মালিক মালিকপক্ষ সব এক। যতটা পারবে শুষে নেবে”
মনে মনে বিরক্ত হল নির্ঝর।
***
দশদিন পর
-কী বলছো? খবরটা সত্যি?
-হ্যাঁ স্যার হৈমপ্রভা গ্যাংটকে যাচ্ছে..
-একা?
-না, শুনলাম মেয়ে-জামাইকে নিয়ে..
-কবে যাচ্ছে খবর নাও..
ফোনটা কান থেকে নামিয়ে অস্থির হয়ে পড়ল তীর্থঙ্কর।
আরো দশ মিনিট পর ফোন বেজে উঠল। অপর প্রান্তের বলা ডেটটা নোট প্যাডে লিখল তীর্থঙ্কর। ফোন নামিয়ে নির্ঝরের লেটারটা খুঁজতে শুরু করল। পেল না কোথাও..শেষমেশ নির্ঝরকে ফোন করে যাওয়ার তারিখ জানল তীর্থঙ্কর। চোখ কপালে উঠল। যা দুশ্চিন্তা করেছিল তাই হল..প্রায় একই সময়ে হৈমপ্রভা ও সৃজিতা গ্যাংটক থাকবে।
-আমি থাকতে মা-মেয়ের সম্পর্ক ঠিক হবে না। আমি করতে দেবনা।
উত্তেজনায় কেবিনে হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিল।
টেবিল থেকে ফোন হাতে নিয়ে একটা নম্বর ডায়াল করল।
-আমার ফ্লাইটের টিকিট লাগবে..
চলবে: