অস্তরাগের কলি পর্ব-২৯+৩০

0
120

#অস্তরাগের_কলি
পর্ব_ঊনত্রিশ

#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী

আসুন..
অতিথি নারায়ণ। এই বাণী মাথায় রেখে ঘরে আগত অতিথিকে আমন্ত্রণ জানাল হৈমপ্রভা। সেই সাথে দিপালীর অভিমুখে চোখ গোল করল। আবার বুবলাইকে জোর করতে থাকল দিপালী। কিছুতেই গাড়ি ছেড়ে উঠবে না বুবলাই।
-বুবলু দাদুভাই…তুমি কেমন আছো?
সুর করে ডাকাল তীর্থঙ্কর।
চেনা স্বর শুনে গাড়ি থেকে উঁকি মারল বুবলাই।
-কই..বুবলু দাদুভাই কই?
নাম ধরে ডাকা ব‍্যক্তিকে চেনা মনে হল বুবলাইয়ের। গাড়ি থেকে উঠে তীর্থঙ্করের দিকে এগিয়ে গেল। পায়ে পায়ে পৌঁছে গেল। তীর্থঙ্কর কোলে নিল বুবলাইকে..ভ্রু কোঁচকালো হৈমপ্রভা।
-আমি কে বলো তো..
-ডাডু..
একগাল হাসল বুবলাই।
-হ‍্যাঁ আমি দাদুই..
তীর্থঙ্কর বুবলাইয়ের গালে চুম্বন করল। হৈমপ্রভা স্বভাবত বিরক্ত হল। হৈমপ্রভার ভয়ে তীর্থঙ্করের কোল থেকে ছোট্ট শিশুকে ছিনিয়ে নিতে উদ‍্যত হল দিপালী।
-দাবো না..
তীর্থঙ্করকে আঁকড়ে ধরল বুবলাই। বহুদিন পর চেনা মানুষ পেয়েছে।
অমাবস‍্যার আকাশের ন‍্যায় হৈমপ্রভার মুখাবয়ব দেখে প্রমাদ গুনলো তীর্থঙ্কর।
-বুবলু সোনা..তুমি গাড়ি নিয়ে খেল আমি একটু তোমার দিদার সাথে কথা বলি।
কোল থেকে নামিয়ে দিল বুবলাইকে..সুযোগ পেয়েই কোলে নিয়ে সেই স্থান ত‍্যাগ করল দিপালী।
-অনেকদিন পর দেখল..তাই ছাড়ছে না।
তীর্থঙ্করের কথায় বিষাদের সুর।
প্রত‍্যুত্তরে মৌন থাকল হৈমপ্রভা।
-বুবলাইকে নিয়ে কোনো সমস‍্যা হচ্ছে না তো? তেমন হলে ওকে আমি এডপ্ট করতে পারি…
স্তব্দ হল হৈমপ্রভা। প্রতিপক্ষের সাহস দেখে হতবাকও হল।কী ভাবে একথা মুখে আনতে পারে?
-ওর দিদা এখনো বেঁচে আছে..লোকের হাতে মানুষ হতে যাবে কেন?
দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করল হৈমপ্রভা।
কৃত্রিম চওড়া হাসি হাসল তীর্থঙ্কর। সেই হাসিতে সব ব‍্যক্ত করল তীর্থঙ্কর। মনে করিয়ে দিল হৈমপ্রভার অক্ষমতা।
-কামনা করি একশো বছর বাঁচুক ওর দিদা। ভালো ভাবে মানুষ হোক।
কোর্টের বুক পকেট থেকে একটা খয়েরি খাম বের হৈমপ্রভার দিকে ধরল।
-কী এটা?
গম্ভীর স্বর হৈমপ্রভার।
-খুলে দেখো..
একটা স্ট‍্যাম্প পেপার বাংলা হরফে ছাপা। তাতে লেখা আছে তীর্থঙ্কর গোধূলি শোরুম বুবলাইয়ের নামে করে দিচ্ছে। বুবলাই প্রাপ্তবয়স্ক হলে পূর্ণ অধিকার পাবে।
-এসব..
বাধা দিয়ে নিজেই বলতে শুরু করল তীর্থঙ্কর।
-দরকার ছিল। নির্ঝর আমার একনিষ্ঠ কর্মী ছিল। সে থাকলে ছেলের জন‍্য সাম্রাজ্য সাজিয়ে দিত। আমি না হয় এই টুকু করলাম। চলি..
পিছন ঘুরল তীর্থঙ্কর। আবার ঘুরে হৈমপ্রভার উদ্দেশ্যে বলল,
-আজ থেকে আমি তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী নই। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। দুই তরুণ প্রাণের বলি আমাকে অনেক কিছু শেখাল। রেষারেষি খেলাটা বন্ধ করলাম হৈমপ্রভা। ভালো থেকো। আর হয়ত দেখা হবে না..
কৌতূহল দমন করতে পারল না হৈমপ্রভা। প্রশ্ন করেই ফেলল,
-কোথায় যাচ্ছেন?
-আমার গ্রামে..রাধারাণী বস্ত্রালয়টাকে নতুন রূপে শুরু করব। ওখানেই থাকব। ফ‍্যাক্টারী আর শোরুম বিশ্বস্ত লোকের হাতে ছেড়ে গেলাম। কালেভদ্রে আসতে পারি। তবে ওরাই দেখবে।
চলি..
চলে গেল তীর্থঙ্কর। খাম হাতে দাঁড়িয়ে থাকল হৈমপ্রভা।
সেই সময় ঘরে প্রবেশ করল সংযুক্তা। দুই দিন পর আবার সান‍্যাল ম‍্যানসনে এল।
-মা কে এসেছিল?
ঘোরে ছিল হৈমপ্রভা
সংযুক্তার কথা কানে ঢুকল না।
-মাআ..
-ও তুই! আয়..বুবাই কই?
-আনিনি। ওর টিউশন আছে।
-ও..
আসল কারণটা হৈমপ্রভা জানে। বুবলাইয়ের সাথে বুবাইয়ের সখ‍্যতায় সংযুক্তার চরম আপত্তি।
-তীর্থঙ্কর দাশগুপ্ত এসেছিল। গোধূলি বুবলাইয়ের নামে করে দিয়েছে।
-কেন?
-নির্ঝরের জন‍্য..
-বাহ..বুবলাই তো বড়লোক।
সহ‍্য হল না হৈমপ্রভার।
-তুই কি ছোট বাচ্চাটাকে হিংসা করছিস?
সত‍্যটা সহ‍্য হল না সংযুক্তার। জ্বলে উঠল ও..
-সেটা আসল নয়। আসল ব‍্যপারটা অন‍্য..আমার সব মনে আছে। আমি সব জানি..
দাপাতে থাকল সংযুক্তা।
-কী জানিস তুই?
হৈমপ্রভার মনে সংশয়।
-বাবা মারা যাওয়ার পর তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল ঐ লোকটা। তুমি রাজি হওনি বলেই তোমার সাথে শত্রুতা। আজ তোমার জন‍্য বুবলাইকে দান করল। পরোক্ষভাবে এই শোরুমটা তোমার হয়ে গেল।
কান গরম হল হৈমপ্রভার। আপন আত্মজা কী বলছে..এ তো আপন মায়ের সাথে হিংসা করছে।
-তোমার প্রতি ওর প্রেম একটুও কমেনি। তাই ফুলের বুকে নিয়ে তোমাকে দেখতে গিয়েছিল। আমার তো মনে হয় তোমার দিক থেকেও সায় আছে নাহলে এই দান নেবে কেন? ইচ্ছা থাকলে সেদিনই ওর প্রস্তাবে সায় দিতে পারতে মা.. লোক দেখানো শত্রুতা তাহলে করতে হত না।
ধপ করে বসে পড়ল হৈমপ্রভা। স্বামীর মৃত‍্যুর পর তীর্থঙ্কর একসঙ্গে দুজনের ব‍্যবসা একত্রিত করতে চেয়েছিল। রাজি হয়নি হৈমপ্রভা। তীর্থঙ্করের কামনায় হৈমপ্রভা ছিল..এটাও সত‍্যি..হৈমপ্রভার দিক থেকে কোনো সবুজ সঙ্কেত পায়নি বলেই এতটা প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়েছিল। সে প্রায় দশ-এগারো বছরের আগেকার কথা..
সেই কারণে আজকে মেয়ের কাছে অপমানিত হতে হবে ভাবেনি হৈমপ্রভা।
কথা না বাড়িয়ে ঘরে নিজেকে বন্দী করল হৈমপ্রভা।
চলবে:

#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_ত্রিশ

রাত সাড়ে দশটা:
বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে হৈমপ্রভা। ঘুম চুরি হয়েছে ওর। সংযুক্তা থাকেনি, দশমিনিট দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেছে। যাওয়া আগে তেজ দেখিয়ে বলে গেছে আর কখনো সান‍্যাল ম‍্যানসনে পা দেবে না। আত্মজার অগ্নিসম কথায় কষ্ট পেয়েছে হৈমপ্রভা। এখনোও পাচ্ছে.. বরাবর বড় মেয়ে একটু স্বার্থপর। বিয়ের পর আত্মকেন্দ্রিকতা অধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্বশুরবাড়ির প্রভাব পড়েছে।
উঠে বসল হৈমপ্রভা। ভিতরে একটা আনচানানি। জগ থেকে জল ঢেলে জল খেল। একটা তীক্ষ্ণ ল‍্যাম্পের আলো ঘরময় আলোকিত করেছে। নিদ্রাদেবীকে আহ্বান করতে সেটাকে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল হৈমপ্রভা। পাশ ঘুরতেই ঘুমন্ত নিস্পাপ শিশুর মুখাবয়বে চোখ আটকে গেল। মায়ের মুখের আদল পেয়েছে বুবলাই।
ঠিক যেন ছোট্ট সুজি..
নাতির মাথায় চুম্বন করল হৈমপ্রভা। লাইট বন্ধ করে নাতিকে ধরে শুয়ে পড়ল। বিক্ষিপ্ত মন একসময় থিতু হল। নিদ্রাদেবী অধিস্থিত হল হৈমপ্রভার দুই চোখে।

কতক্ষণ সময় অতিবাহিত হয়েছে সেই হিসেব নেই। দূর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসতে থাকল। মস্তিষ্ক সজাগ হতেই উপলব্ধি করল সেই শব্দ ওর পাশ থেকে আসছে। ঝড়ফড় করে উঠে বসল হৈমপ্রভা। বিছানার কোণ থেকে বাবাআ বাবাআ স্বরে ক্রন্দন ধ্বনি ভেসে আসছে। নিকষ অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছেনা হৈমপ্রভা।
-বুবলাই কোথায় তুই?
কান্নার স্বর বাড়াল বুবলাই।
হাতড়ে হাতড়ে খাটের কোণে পৌঁছে বুবলাইকে কোলে নিল।
-কী হয়েছে?কী হয়েছে সোনা?
কান্না থামেনা বুবলাইয়ের। দিশা খুঁজে পাচ্ছে না হৈমপ্রভা। কোনরকমে লাইট জ্বালায়। কান্না থামে বুবলাইয়ের..ভালো ভাবে দিদার অভিমুখে তাকায়। কিছু একটা সাদৃশ্য পেয়ে আবার মা মা বলে হৈভপ্রভার কোলে আছড়ে পড়ে। স্তব্দ হয়ে যায় হৈমপ্রভা। নিজের থেকেও একরত্তি ছেলেটাকে বেশী দুঃখী মনে হয়।
-এই তো মা। আমি আছি তো..
***
অস্তরাগকে সাক্ষী রেখে তিনুর প্রস্তাবে সায় দিয়েছিল রুকু। কথা দিয়েছিল, একসাথে সারা জীবন কাটানোর। লুকিয়ে প্রেম পর্ব ভালোই চলতে থাকল। কখনো নদীর ঘাট, কখনো সখনো বা হলে সিনেমা দেখত যেত। ম‍্যাট্রিক পরীক্ষায় ভালো ফল করেছিল রুকু। বাড়ির অমতে জোর করে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। পড়া ছাড়াও কলেজে ভর্তির আরো একটা অন‍্যতম কারণ হল বাড়ি থেকে বেরোনো। সাদামাটা ফলের জন‍্য কোনো সরকারি চাকরি জোটে নি তিনুর। দাদুর তৈরি রাধারাণী বস্ত্রালয়ে যোগ দিল। রমরমিয়ে চলত এই বস্ত্রালয়। ঘরের ছেলেকে ব‍্যবসাতে যোগ দিতে দেখে খুব খুশি।
বড় হচ্ছে রুকু। সেই সাথে সুন্দরীও..অনেক পাত্রের পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় রুকু। তিনুকে চাকরির জন‍্য চাপ দিতে থাকে। রুকুর বাবার পণ,ভালো চাকরিওয়ালা ছেলের সাথে ছাড়া মেয়ের বিয়ে দেবে না। এর মধ‍্যেই সান‍্যাল পরিবার থেকে রুকুর জন‍্য সম্বন্ধ আসে। কাপড়ের ফ‍্যাক্টারী দেখে রাজি হয় রুকুর বাবা।
-তাহলে তোর বাবা ব‍্যবসায়ীর সাথে বিয়া দিবে?
-আমার কিছু করার নেই। বাপ-মার কথা মানতেই হবে।
-সে তো বটেই..পেরেম নিজের ইচ্ছায় হয়। কিন্তু বিয়া ঘরের লোকের..
-তুমি একবার বলো না..তুমি বড় ব‍্যবসা করবে। কিছু দিন সময় দিতে..একবার বাবাকে বলো।
-তোর বড়লোককে বিয়া করার পুরা ইচ্ছা। তোর মত না থাকলে কি বিয়া হয়? যা যা চোখের সামনে থেকে চলে যা..
চোখে জল এল রুকুর।
-তিনুদা তুমি একবার বাবাকে আমাদের আমাদের সম্পর্কের কথা বলো। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে বিয়া করতে চাই..
-যা যা..সব তোর মন গড়া কথা। লোভী মেয়েছেলে একটা..চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা।
নদীর পার উঠে বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরল। একাকি বসে রইলো রুকু।
-আমি লোভী হলে তুমিও একটা কাপুরুষ। আমার বাবা সামনে দাঁড়ানোর সৎ সাহস নেই..
নদীর জলের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলতে থাকল রুকু। ওর মুখাবয়ব অস্তরাগের মতন লালচে..

সারারাত ঘুম হয়নি হৈমপ্রভার। চোখের সামনে চল্লিশ বছরের আগেকার ঘটনা সিনেমার রিলের ন‍্যায় ভেসে উঠছিল। তারপর বিজন সান‍্যালের বিয়ে হয়ে যায়। প্রথমে মানতে কষ্ট হলেও পরে সংসারে মনোনিবেশ করে হৈমপ্রভা। স্বামীকে ভালোও বেসে ফেলেছে ..তবুও মনের কোণে তিনুদা থেকেই যায়। অষ্টমঙ্গলার সময় বাপের বাড়ি গিয়ে জানতে পেরেছিল তিনু বোম্বে চলে গেছে। আর কখনো সাক্ষাৎ হয়নি দুজনের। সময় বইতে থাকে..পঁচিশ বছর আগে বন্ধু হয়ে বিজন সান‍্যালের হাত ধরে সান‍্যাল ম‍্যানসনে আসে তিনু ওরফে তীর্থঙ্কর দাশগুপ্ত। বুক কেঁপে ওঠে হৈমপ্রভার। সাধের সংসারে কোনো আঁচড় না পড়ে। না সে সব কিছুই হয়নি..বৌদি বলেই ডাকত তীর্থঙ্কর। শুধু তীরের মতন কিছু কথাতে মাঝেমাঝে বিদ্ধ হত হৈমপ্রভা। উপলব্ধি করত, ওর জন‍্য তীর্থঙ্করের ভালোবাসা সেদিনও জীবন্ত। তীর্থঙ্করের হেম ফ‍্যাক্টারীর নামকরণ যে হৈম থেকেই নেওয়া তা বুঝেছিল হৈমপ্রভা। তীর্থঙ্করের উপস্থিতি কাঁটার মতন বিঁধত হৈমপ্রভাকে..হঠাৎ বিজন সান‍্যালের মৃত‍্যু হয়। কদিন যেতেই তীর্থঙ্কর হৈমপ্রভাকে এক সাথে পথ চলার প্রস্তাব দেয়। সেই প্রস্তাব প্রত‍্যাখান করে হৈমপ্রভা। শত্রুতার সূত্রপাত সেখান থেকেই..
চলবে: