অস্তরাগের কলি পর্ব-৩২ এবং শেষ পর্ব

0
409

#অস্তরাগের_কলি
#অন্তিম_পর্ব
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী

কবে বিয়ে?
-দু দিন পর..আমাকে বারবার করে ওখানে থাকতে বলছে। বাক্স প‍্যাটরা নিয়ে আমাকে কাল চলে যেতে হবে।
পা টলে গেল হৈমপ্রভার। পাশের চেয়ারটাকে ধরে ধাতস্থ হল।
-কী হল বৌদি?
-কিছু না..আচ্ছা তুই চলে যাস। তোকে তো আমি আটকাতে পারিনা। বুবলাইকে নিয়ে সমস্যা।
-তুমি কাউকে খুঁজে নাও। আমার মতন কাউকে পাবে। কী করব? হঠাৎ বিয়া ঠিক হল..
-কেউ চলে গেলে তার মতন হয়ে উঠতে কেউ পারেনা। যাকগে..দেখছি কী করা যায়। পায়ে পায়ে শোওয়ার ঘরে গেল হৈমপ্রভা।
বারবার হৈমপ্রভার খোলস থেকে রুকু বেড়িয়ে পড়ছে। তীর্থঙ্কর ওর প্রতিপক্ষ। তবুও এত বছর পর চোখে জল আসছে। ওর তিনুদাকে মনে পড়ছে। অথচ রুকু থেকে হৈমপ্রভার হওয়ার যাত্রাপথে তীর্থঙ্কর ছিল মূল কারণ। আবেগকে দমিয়ে রুকু হৈমপ্রভা হয়েছিল শুধুমাত্র নিজেকে শাস্তি দিতে..
অস্থির হচ্ছে হৈমপ্রভা। বিছানায় শুতে পারছে না। বিছানায় ঘুমন্ত বুবলাইকে দেখেও আদর করতে ইচ্ছে করছে না। ফোন হাতে নিল হৈমপ্রভা। একবার কি তীর্থঙ্করকে ফোন করবে? ফোন করে কী বলবে? নিজেকে সংযত করল হৈমপ্রভা।
-এমন হ‍্যাংলামো করা আমার সাজে না। কারুর যদি বিয়ে করার ইচ্ছে থাকে করুক..আমার কী?
অন্তরাত্মাকে শাসন করতে জোর গলায় বলল হৈমপ্রভা।
-বৌদিমণি আপনি আজ জোয়ান খাননি। তাই নিয়ে এলাম..
জোয়ান হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে দিপালী।
-বেশ করেছো। এখানে রাখো।
-আপনি শোবেন না?
-পরে শোবো..
-ও..
চলে গেল দিপালী।
ঘরে পায়চারি করতে থাকল হৈমপ্রভা। এখুনি
ব্লসম যাবে স্থির করল। আবার দিপালীকে ডাকল..
-দিপালী আমি ব্লসম যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হবে। তুমি বুবলাইকে দেখো।
-দেরি হলে ও কাঁদবে তো..
-ছেলে ভোলাতে পারবে না? আজকের দিনটা অন্তত করো..
কোনোরকমে শাড়ি পরে আলুথালু বেশে ব্লসম গেল হৈমপ্রভা। ডিজাইন ও হিসাব দেখে সময় কাটাবে মনোস্থির করল। কিন্তু কোথায় কী! কোনো কাজে মন বসছে না। না চাইলেও কিশোরী বেলায় ফিরে যাচ্ছে।
দেড় ঘন্টা পর হৈমপ্রভার ফোন বেজে উঠল..ফোন তুলতেই অপর প্রান্তের ভয়ার্ত কন্ঠ..
-বৌদিমণি..
-কী হল?
-বুবলাইকে খুঁজে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে ছাদে..
আঁতকে উঠল হৈমপ্রভা।
-ছাদে? ছাদে গেল কী করে? চাবি দেওয়া তো..

দিপালী যা বলল তার মর্মার্থ হল..
ঘুম থেকে উঠে বুবলাই খুব কান্নাকাটি করছিল। দিপালীও শেষবার ঘোরার জন‍্য বুবলাইকে নিয়ে ব্লসম নিয়ে এসেছিল। লিফ্টে চেপে ভুল করে তিনতলায় চলে গিয়েছিল। এক পরিচিতের সাথে কথা বলার সময় বুবলাই কোল থেকে নেমে চোখের আড়াল হয়েছে। এখন কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।
বুকের রক্ত শুকিয়ে গেল হৈমপ্রভার। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনের কিছু হলে সত‍্যিই মারা যাবে হৈমপ্রভা। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে এ সকল প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছাদে গেল হৈমপ্রভা। ছাদে কোথাও খুঁজে পেলনা হৈমপ্রভা। পায়ে পায়ে কার্নিশের দিকে এগিয়ে গেল।
-রুকু…
পরিচিত অথচ অনিয়মিত কন্ঠস্বরে ঘুরে তাকাল। তীর্থঙ্করকে পিছনে দেখে ভূত দেখার জন‍্য চমকে উঠল।
-বুবলাই..বুবলাই..
গলা থেকে আওয়াজ বের হচ্ছে না হৈমপ্রভার।
-দিপালী পেয়েছে…
বড় নিশ্বাস নিল হৈমপ্রভা। সমস্ত কিছু মনে পড়ে গেল..
-আপনি এখানে? কাল আপনার বিয়ে..
-এজন্মে আমার আর বিয়ে হবেনা। পাত্রী সম্মতি দিচ্ছে না।
হৈমপ্রভা ভেবে পায়না কী উত্তর দেবে।
খুশি হবে না দুঃখ পাবে বুঝতে পারেনা হৈমপ্রভা।
-কী তিনুদা বৌদিমণিকে ছাদে আনতে পারলাম তো?
দিপালী কথা মাথায় ঢোকে না হৈমপ্রভার। ফ‍্যালফ‍্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
-বৌদিমণিকে প্রথম থেকে খুলে বলি..তিনুদা আমাকে তোমার ঘরে কাজে বহাল করেছিল। আমার উপর দায়িত্ব ছিল তোমাকে সামলানোর। তারপর তোমাদের ঝামেলা হল। মুখ দেখাদেখি বন্ধ হল। তিনুদা তবুও থেকে যেতে বলল..তুমি ভালো মানুষ তাই থেকে গেলাম। মাঝেমধ্যে ফোন করে তোমার খবরাখবর নিত। ব‍্যাস এই টুকুই..
সুজি দিদির মারা যাওয়ার পর তুমি পুরো ভেঙে পড়লে। তিনুদা গেরামে চলে গেল। আমি তোমাদের মাঝে ঢুকিনি। তুমি বারবার বুবলাইয়ের বাবার কথা বলতে। আমার মাথায় বুদ্ধি এল। আমার মনে হত তোমার মনে তিনুদা এখনো লুকানো আছে। তাই সত‍্য বের করার জন‍্য এই নাটক..
দিপালীর কোল থেকে নেমে ইতিমধ্যেই বুবলাই ওর মায়ের কাছে চলে গেছে। তীর্থঙ্করের সাথে খুনসুটি শুরু করেছে।
-বুবলাই চলে এসো। তোমাকে বেলুন দেব।
-লুন?
বেলুন নামক জিনিসটাকে মনে করেই আনন্দ পেল বুবলাই। হৈমপ্রভার কোল থেকে নেমে দিপালীর কাছে গেল। সেই স্থান থেকে সরে গেল দিপালী।
-এমনটা না করতেই পারতে? সকলের সামনে আমার ইমেজ খারাপ করে তুমি কী পেলে?
-এখনো তুমি এ কথা বলবে? চল্লিশ বছর আগে না হয় তোমার স্বামীর ধারেকাছে ছিলাম না। দশবছর আগে নাহয় তোমার থেকে কমা ছিলাম। কিন্ত আজ তো একেবারে সমকক্ষ। তাই ইমেজ খারাপ হলে আমারো হবে।
আজকের তিনু জানে রুকুকে কোন অস্ত্রে জব্দ করা যেতে পারে..
-ভুল করছো তুমি..সেদিনও ভুল করেছিলে..আমাকে লোভী, স্বার্থপর আখ‍্যা দিয়েছিলে। আমি তোমাকে বাবার সাথে দেখা করে বলেছিলাম। সেই সৎ সাহস তোমার হয় নি..চির জীবন আমাকে ভুল বুঝে গেলে। সহজ সরল রুকুকে লুকিয়ে হৈমপ্রভা সান‍্যাল হতে নিজেকে কতটা পরিবর্তন করতে হয়েছে তা তুমি জানো না..
-রুকু আবার কি এক হওয়া যায় না? এই বয়েসে শরীর লাগে না। শয্যাসঙ্গীর না, সঙ্গীর প্রয়োজন হয়।শুধুমাত্র পাশে থাকলেই হবে।
তীর্থঙ্করের প্রস্তাবে মৌন থাকল হৈমপ্রভা।
-রুকু জীবন তোমাকে তিন বার সুযোগ দিচ্ছে। এটাই আমার তোমাকে দেওয়া শেষ প্রস্তাব। তোমার উত্তর না হলে আর আমি এ মুখ দেখাব না। আমার মৃতদেহ দেখতেও তুমি যাবে না।সরাসরি হ‍্যাঁ বা না জানাও..
শিউরে উঠল হৈমপ্রভা।
উত্তর না দিয়ে কার্নিশের দিকে এগিয়ে গেল । দুই হাত কার্নিশের প্রসারিত করল।
সূর্য অস্ত গেছে ক্ষানিক আগেই। তবের আবীর রাঙা অস্তরাগ আকাশে এখনো আঁকা। চোখ বন্ধ করল হৈমপ্রভা। স্মৃতির সোপানে অনেক ছবি ভাসছে..চায়ের ভাড় হাতে দুজন তরুণ -তরুণী একে অন‍্যের দিকে তাকিয়ে আছে।
জিজ্ঞাসু চোখে অনেক আশা নিয়ে পাশে এসে দাঁড়াল তীর্থঙ্কর।
-এক ভাড় দুধ চা পেলে মন্দ হত না..
-কী বলছো রুকু! তারমানে তুমি আমাকে বুবলাইয়ের বাবা হওয়ার অধিকার দিলে
?
অস্তরাগের মতন হৈমপ্রভা দুই গাল লালচে হয়ে উঠল। মুখে বলল,
-দিলাম..
সমাপ্ত: