মনের পাশে পর্ব-০১

0
506

#ছোট_গল্প
#মনের_পাশে
#নূপুর_ইসলাম

ইশিতা কাঁপা কাঁপা হাতে কপাল মুছলো। নাক, মুখ এমনকি তার পুরো শরীর দিয়েই দরদর করে ঘাম ছুটছে। গায়ে তার নতুন জামদানি শাড়ি। খসখসে মচমচে । সেটা দিয়েই কিছুক্ষণ পরপর মুছে মুখের বারোটা বাজিয়ে ফেলেছে। তার গায়ের রং শ্যামলা ফর্সার মাঝামাঝি। সেই মাঝামাঝি গায়ের রং’ই এখন বলতে গেলে পুরো লাল টকটকে হয়ে আছে। শুধু যে আছে তা না, কিছু কিছু জায়গা বেশ ভালোভাবেই জ্বলছে। অবশ্য সেই জ্বলার চেয়ে তার ভয়’ই করছে বেশি।

আজ পহেলা ফাল্গুন! ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম ছিল। তাই শাড়ি টাড়ি পরে একটু সেজেগুজে’ই বের হয়েছিল। সারাদিন বলতে গেলে ভালোই আনন্দে গেছে। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো বাড়ি ফেরার পথে। চারজন কালো পোশাকধারী লোক তার রিকশা ঘিরে ধরলো। এই লোকদের সাধারণ লোক বলা যায় না। কেননা সবাই একই সাইজের উঁচা লম্বা। গায়ে একই কালো পোশাক। একই রকম সবার হাতের মাসল ফুলে ফেঁপে আছে। সেই ফুলে ফাঁপা হাতের শরীর দেখা না গেলেও সিক্স প্যাক ঠিক অনুমান করা যাচ্ছে। চোখে সবার কালো সানগ্লাস। বাংলাদেশে যে এইরকম উঁচা লম্বা সিক্স প্যাকওয়ালা সালমান, জন, হৃিতিক আছে তার তো জানাই ছিল না। অবশ্য সে কচ্ছপ টাইপ মানুষ। লেখাপড়া, ঘর, ভার্সিটি আর কয়েকটা টিউশনি ছাড়া তার আর কোন দুনিয়া’ই নেই। তবুও আল্লাহ’ই জানে। এই এক লক্ষ, সাত চল্লিশ হাজার, পাঁচশত সত্তর বর্গ কিলোমিটার ছোট্ট বাংলাদেশে তার না দেখা আরো কতো কতো নমুনা আছে।

যাইহোক সেই ফুলে ফেঁপে ওয়ালা সালমান, হৃিতিকদের মাঝ থেকে একজন প্রায় ধমকে বলল, — চুপচাপ গাড়িতে উঠুন ! কোন চিৎকার চেঁচামেচির দরকার নেই। যতো কোঅপারেট করবেন আপনার জন্য ততোই ভালো ।

নিজের ভালো পাগলেও বুঝে। আর ইশিতা তো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। সে ভয়ে কাঠ হয়ে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো। তার হাতে পার্স, কয়েকটা লাল গোলাপ । গোলাপগুলো দিলো তার বন্ধু রাফি। শুধু যে তাকে তা না, সব বন্ধুদেরই দিলো। আহারে! সবাই মিলে কত মজা করলো। ভেবেছিল স্মৃতি হিসেবে ডায়রিতে রাখবে। সেই আশায় ধূলোবালি। জীবন’ই এখন যায় যায়। আবার কোথাকার গোলাপ, কোথাকার ছাইয়ের ডায়েরি।

সে পার্স, ফুল, আর একমণ দুঃখ বুকে চেপেই গাড়িতে উঠে বসলো। না উঠে উপায় কি? কখনো পড়েছে এমন মাইনকার চিপায়। সাধারণ ডাল ভাতের জীবন তার। এই ডাল ভাতের জীবনে এমন ঘূর্ণিঝড় কোথা থেকে এলো তার মাথায়’ই তো আসছে না। আর আসছে না বলেই বুকের ভেতর তার ঘড়ির ঘন্টার মতো ঢং ঢং করতে লাগলো। একতো সাথে এতোগুলো কালো ষাঁড় তার মধ্যে কালো গাড়ি। ভেতরে নিয়ে গলা কেটে ফেললেও কারো বোঝার সাধ্য নেই। আল্লাহ! কোন দুঃখে সে আজ বের হয়েছিল।

ভাইয়া দেখেই নিষেধ করলো। দিনকাল ভালো না। যতো আকাম কুকাম এইসব ফালতু দিনগুলোতেই বেশি হয়। সে শুনলে তো। বন্ধুরাও জোর করলো। আছেই আর বছর দু’এক। কখনো যায় না, ভাবলো এবার যাওয়া যাক। কেন রাজি হয়েছিল, এই কালো ষাঁড়দের হাতে পড়ার জন্য। হুম!

ইশিতা গাড়িতে উঠেই আকুল ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করল। তবে নিঃশব্দে! তার ডানে বামে সামনে পেছনে সব এই কালো ষাঁড়ের দল। কালো সানগ্লাসের নিচে কোন দিকে তাকিয়ে আছে কে জানে? তবে তার আকুল ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে দেখে একজন টিস্যু বক্স এগিয়ে দিয়ে বলল, — আপনি চাইলে চিৎকার করেও কাঁদতে পারেন। সমস্যা নেই। এটা সাউন্ড প্রুফ গাড়ি।

ইশিতা টিস্যু নেয়নি। নেওয়ার মতো অবস্থা অবশ্য তার নেই ও। সে হা করে কিছুক্ষণ সেই ষাঁড়ের দিকে তাকিয়ে রইল। হচ্ছে কি তার সাথে?

গাড়ি কতক্ষণ চললো কে জানে? তার সেই অবস্থার মাঝেই গাড়ি এসে থামলো বিশাল এক হোটেলের সামনে। সে গাড়ির ভেতর থেকেই হা করে তাকিয়ে রইল। হোটেলের নাম দ্যা ব্লু সী । মানে নীল সমুদ্র! হোটেলটা সমুদ্রের মতোই বিশাল আর চোখ ধাঁধানো সুন্দর। সে কখনও এমন হোটেলে আসেনি। আসেনি মানে দেখেও নি। আজকে কি তার না দেখানো সব কিছুই দেখার দিন? কি আজব ব্যাপার!

সেই ব্যাপারের মাঝেই তার কলিজা খাবলে উঠল। তাকে হোটেলে এনেছে কেন? নিউজ খবরে কতোইতো গাল গল্প শোনা যায়। নেতা টেতা রা নাকি মেয়েদের হোটেলে তুলে নিয়ে যায়। শারীরিক কাজ কাম খালাস করে। করে সুন্দর মতো আবার জায়গা মতো রেখে আসে।

এজন্যই বুঝি বলল চুপচাপ কোঅপারেট করতে। করলে তারই ভালো। কাজ কামের পরে জায়গা মতো আবার রেখে আসবে। তা না হলে গলা কেটে একদম খালাস।

ইশিতা শক্ত হয়ে বসে রইল। সে যাবে না। মরে গেলেও না। মেরে ফেললে মেরে ফেলুক! এখানেই ফেলুক। তবে সে ভেতরে যাচ্ছে না।

কালো ষাঁড়ের দলের সেই টিস্যুওয়ালা প্রথমে একটু নরম ভাবে বলল। ইশিতা শুনলে তো। তার পরে দিলো এক ধমক।

ইশিতার ভেতর ফুঁপিয়ে উঠল! উঠতেই ভদ্র মেয়ের মতো চুপচাপ নামলো। নেমে ফুঁপাতে ফুঁপাতেই এগিয়ে গেলো।

ইশিতাকে নিয়ে আসা হলো সেভেন ফ্লোরের একটা অভিজাত রুমে। সে এসেই হা হয়ে আশ পাশ দেখলো। তার সামনে ডানে বামে আয়না আর আয়না। আয়না ভরা রুমের মাঝে সাদা শুভ্র একটা বেড। শুধু বেড না, এই রুমের সব কিছুই সাদা। এরকম একটা রুম তৈরির মানে কি? রুমটাও বিশাল! সাইডে ছোট্ট একটা সুইমিংপুল। আর সবচেয়ে বড় কথা রুমের কর্নারে ছোট্ট একটা বার ।

সে ঢোক গিললো! গিলে তার সামনে ধবধবে সাদা সোফার উপরে বসা ধবধবে ফর্সা রমণীর দিকে তাকালো। যে আপাতত খুবই ভাব নিয়ে পায়ের উপরে পা তুলে আরামছে মোবাইল দেখছে। রমণীর গায়েও সাদা শার্ট, প্যান্ট অবশ্য কালো। এই সাদা শার্ট আর প্যান্ট মনে হয় গায়ে দেওয়ার পরে সেলাই করেছে। তা না হলে এমন আঁটসাঁট ভাবে লেগে থাকার কারণ কি ? সেও একটু ফিটিং ফাটিং জামা কাপড় পরে। সেই জামা গলা দিয়ে নিজ পর্যন্ত নিতেই তার বারোটা বেজে যায়। আর এমন ফিটিং হলেতো তার গলায় ফাঁসের মতো লটকে যাবে।

অবশ্য বলতেই হবে এই মেয়ের কাছে নায়িকা ফেল। যেমন রং, রুপ তেমনি বডি ফিগার। বলেই সে আয়নার দিকে একবার তাকালো। তাকে দেখতে লাগছে ভুল ভুলাইয়া ছবির মঞ্জুলিকার মতো। শাড়ি, এলোমেলো চুল, কাজল, লাল লিপস্টিক ঘেটে পুরো মাখামাখি। আর বডি ফিগার সেটার কথা বাদই থাক। তার মায়ের দুই ছেলে মেয়ের গায়ে উপরওয়ালা সব কিছু দিতে দিতে বড়ই কাঞ্জুসিপনা করে ফেলেছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কম যেটা দিয়েছেন সেটা হলো গোস্ত। উপর নিচ পুরোই ফ্ল্যাট। কোন রকম মেয়ে বাজারে টিকে আছে সে।

ইশিতা আয়না থেকে চোখ ফিরিয়ে আবার এই সুন্দরী রমণীর দিকে তাকালো। না তাকিয়ে উপায় কি? আর করবেই টা কি?

তাকাতেই এই রমণী উঠলো। স্ট্রেইট করা চুল উড়িয়ে হাই হিলের ছন্দ তুলে র্যাম্পে হাঁটার স্টাইলে এগিয়ে এলো। এসে অতি অতি শুদ্ধ ভাষায় নেকুমার্কা কন্ঠে বললো, — স্যার ঘুমোচ্ছে! আপনি একটু বসুন প্লিজ।

ইশিতা হা হয়ে এই নেকুডেকুর কথা শুনলো। সে তো এটাই বুঝতে পারছে না। কে স্যার, কোন স্যার,। তার ঘুমের সাথে ইশিতার সম্পর্ক কি? নাকি ঘুম থেকে উঠে তার মেয়ে লাগে। লাগতেও পারে। তার বান্ধুবী একবার তাকে বলেছিল, — শোন ইশিতা ! কোন ঘুমন্ত ছেলের আশে পাশে থাকবি না। তাদের ঘুম তো ঘুম না। ঘুম মানে ব্যাটারি চার্জ। তাও আবার যেন তেন চার্জ না। একেবারে ফুল চার্জ।

এই স্যার কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তার ব্যাটারি ফুল চার্জ করছে নাকি? আল্লাহ! রক্ষা করো। জীবনে আর এমন কোন দিনে ঘর থেকে বের’ই হবো না। সত্যিই হবো না।

সে মনে মনে হাজার কসম খেতে খেতে এগিয়ে খাটের এক কর্নারে বসলো। ভয়ে শরীর ঝিমিয়ে আসছে তার। মনে মনে এক চোট দোয়া ইউনুস পড়ল। যদি মুশকিল আসান হয়। পড়তে পড়তেই আড়চোখে নিজের হাতে পার্স আর ফুলগুলোর দিকে তাকালো। পার্সে তার মোবাইল, কাউকে জানাতে পারলেও হয়তো বাঁচার সম্ভবনা একটু হতো।

এই নেকুঢেকু জাতে মাতাল তালে ঠিক। সেই তাকাতেই ঠিক বুঝলো। তাই সাথে সাথেই বলল, — পার্সটা সাইডে রাখুন প্লিজ। রেখে চুপচাপ বসুন। কোন ঝামেলা করার চেষ্টা করবেন না। অবশ্য করেও লাভ হবে বলে মনে হয় না। এটা স্যারের নিজের হোটেল। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এখান থেকে না যাওয়া সম্ভব, না কারো আসার।

ইশিতা আজ অবলা নারী। বিপদের সমুদ্রে মাঝ দরিয়ায় বসে সে কোন ঝামেলা পাঁকাবে? তাই সে তার পার্স, গোলাপের ফুল সাইডের বেড টেবিলের উপর চুপচাপ রাখলো। রেখে আবার রুমের এ মাথা থেকে আরেক মাথা দেখতে লাগলো। তার মন বলল এই আয়নার পেছন থেকে কেউ তাকে দেখছে। ক্যামেরাও থাকতে পারে। তা না হলে এই রকম রুম তৈরির মানে কি? এই রুম নিশ্চয়ই ওই ঘুম ওয়ালা স্যারের বুদ্ধিতে তৈরি। সব এঙ্গেল দেখে দেখবে। কি খাটাশের খাটাশ। আর এই খাটাশের ঘুম এতক্ষণে নিশ্চয়ই ভেঙেছে। আর বেটারিও ফুল চার্জ। সে তো এটাই বুঝতে পারছে না, হাতের কাছে এমন নেকুঢেকু লোভনীয় নরম আইসক্রিম থাকতে তার মতো শক্ত পোক্ত চিনির পানির বরফের দলার কাজ কি?

তখনি ফট করে দরজা খুললো! ইশিতা আঁতকে দরজার দিকে তাকালো! তার চেয়েও আঁতকে উঠলো এই নেকুঢেকু। আঁতকে প্রায় স্প্রিং এর মতো লাফিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে গেলো। দেখে মনে হচ্ছে এখনি অ্যাসেম্বলি শুরু হবে। স্যার এসে বলবে, — সোজা হও, আরামে দাঁড়াও। না দাঁড়ালেই স্কেলের ঠাস ঠাস বাড়ি। দেখতো কি অবস্থা? নিজের ভয় দেখবে কি? এই নেকুঢেকুর ঢং দেখেইতো বাঁচে না।

দরজা খুলেছে সেই বাংলার সালমান, হৃতিকদের একজন। দরজা খুলে সাইডে দাঁড়াতেই এক গুচ্ছ ঝাঁকড়া এলোমেলো চুলের এক কালো লোককে এগিয়ে আসতে দেখা গেলো। কালো বলতে খুব কালো। আদর করেও শ্যামলা বলা যাবে না আরকি।

আর সেই লোক চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি নিয়ে এগিয়ে এলো। গায়ে হাতাকাটা গেঞ্জি, থ্রি কোয়াটার প্যান্ট। যেই প্যান্টের নিচে কালো কালো বড় বড় পায়ের পশম বেরিয়ে আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা তার পায়ের স্লিপার । ভয়ংকর এক স্লিপার! দেখে মনে হচ্ছে দুইটা মিনি সাইজের কুমির হা করে এগিয়ে আসছে। কত কিছু যে এই দুনিয়ায় আছে আল্লাহই জানে। এরকম স্লিপার তো সে ফ্রিতে দিলেও পরবে না। কে এই লোক? এর সাথে তার সম্পর্ক কি? ইশিতা তার এই ছোট্ট জীবনের মনের অলিগলি, ব্রেইনের কোণা কাঞ্চি সব তন্নতন্ন করলো। তবে এই লোকের কোন হদিস সে পেলো না।

জাওয়াদ রুমে এসেই ধাক্কার মতো খেলো। লাল শাড়ি পরে এক মেয়ে কেঁদে কেটে চোখ মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। মাথায় ফুলের ক্রাউন। দেখে মনে হচ্ছে অবুঝ, কোমল। ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। তবে যেই তেজ সে দেখেছে, এই মেয়ের সাথে কেন জানি মেলাতে পারলো না।

তার বাবার নাম আজিজুল হক। যে কিনা হক এক্সপোর্ট ইনপোর্ট প্রাডাক্সের নির্মাতা। একটা এক্সিডেন্টে তিনি তার দুটো পা হারিয়েছেন। তারপর থেকেই ছেলে হিসেবে জাওয়াদ সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছেন। জাওয়াদ তার নিজের ছেলে না। তবে তিনি কখনো সেই কথা জাওয়াদকে বুঝতে দেয়নি। অবশ্য জাওয়াদ জানে সেটা তিনিও জানেন না। সেই বাবা একদিন ডেকে তাকে বললেন, — জাওয়াদ তোমার কি কোন পছন্দ আছে?

জাওয়াদ একমাত্র তার মা ছাড়া, বলতে গেলে সব নারীদের থেকেই দূরে থেকেছে। ইচ্ছে করেই থেকেছে। নিজের প্রতি তার অসীম ঘৃণা কাজ করে। কেননা তাকে তার বাবা পেয়েছিল ময়লার এক ডাস্টবিনে। বিশাল এই পৃথিবীর এক কোণায় এক নারী তাকে দশ মাস গর্ভে রেখে ময়লার ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলেছে। গর্ভে যে রেখেছে সে’ই ভালোবাসতে পারেনি, আর কে ভালোবাসবে। যারা আসবে টাকা দেখেই আসবে। তাই সোজা বলল, — না বাবা।

— পছন্দের কোন তালিকা আছে। যেমন মেয়েকে অসম্ভব রুপবতী হতে হবে এমন?

জাওয়াদ হেসে ফেলেছিল। নিজের কাছে নিজেই তুচ্ছ আবার রুপবতী মেয়ের রুপ। সেটা তার কাছে মূল্যহীন। সে হেসেই বলেছিল, — না বাবা তেমন কিছু নেই।

— আমি যদি তোমার জন্য কারো কাছে হাত চাই, তাতে কি তোমার সমস্যা আছে?

জাওয়াদ তখন থমকে গিয়েছিল। উত্তর দিতে পারেনি। তাছাড়া তার পুরো দুনিয়া তার বাবা। বাবা কথা বলছেন হেসে হেসে। বোঝাই যাচ্ছে খুব খুশি তিনি। বাবা হাসলে সে দুনিয়া ভুলে যায়। তবে মেয়েদের নিয়ে তো সমস্যা তার। একটা মেয়ের আশা, স্বপ্ন নিয়ে খেলার অধিকার কি তার আছে?

বাবা তার নীরবতাকে সম্মতি ধরে নিয়েছিলেন। ধরেই এই কোমল রুপী বেয়াদবের কাছে প্রস্তাব রেখেছিলেন। ভেবেছিলেন হ্যাঁ হলে পরিবারের কাছে ঘটা করে প্রস্তাব রাখবেন। তবে এই বেয়াদব সেই প্রস্তাব নাকোচ করেছে খুব স্বাভাবিক ভাবে। অবশ্য কলিজা আছে বটে। তা না হলে আজকাল যুগে এমন সোনার হরিণ পায়ে ঠেলা সহজ কথা না।

এই বেয়াদবের নাকোচে বাবা কিছুটা উদাস হয়েছিলেন। সে সব সহ্য করতে পারে তবে বাবা সামান্য কষ্টও সহ্য করতে পারে না। তাই নিজের সব সমস্যা সাইডে রেখে ভাবলো মেয়েটার সাথে কথা বলা যাক। যদি তার সমস্যা টা বুঝে। বুঝে ডিসিশানটা নিয়ে আরেকবার ভাবে। মাই গড! সমস্যা বুঝবে দূরের কথা। তাকে প্রায় ধমকে বলে, — মেয়েদের খুব একটা ভালো পান না। এতদিন তাদের থেকে নিজেকে রেখেছেন সরিয়ে। এখন বাবার সামান্য উদাসের জন্য চলে এসেছেন নাচতে নাচতে বিয়ে করতে। কেন? মেয়েদের হাতের মোয়া মনে হয়। ইচ্ছে হলো খেলাম না হলে ছুঁড়ে ফেললাম।

— আসলে সেই রকম কিছু না।

— তো কি রকম? একটা মেয়েকে বিয়ে করবে তাও আবার বাবার জন্য। বাবার জন্যই বিয়ে করবেন তা হলে বাবাকেই করান না। নিজে করছেন কেন? আব্বার হাম্বা। এই রকম হাম্বাদের ছেচে দাঁত ফেলে দেওয়া উচিত। বেয়াদবের বেয়াদব। আবার এসেছে ঢং করতে ” আসলে সেই রকম কিছু না। ”

সে কিছুক্ষণের জন্য কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল। তার উনত্রিশ বছর জীবনে এমন ভাষায় কেউ কথা বলেছে বলে মনে পরে না।

সে দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, — এভাবে কথা বলছেন কেন? ভদ্রভাবে কথা বলুন।

— ওরে আমার ভদ্ররলোক রে। এরা আসে নিজের সমস্যা নিয়ে বিয়ে করতে। পরে শুরু করে নানান ফ্যাঁকড়া। খাটে শোবে না, এটা ধরবে না, ঐ টা করবে না। আমাদের ক্লাস মিলছে না। তুমি শুধু বাবার পুত্র বধু, সেভাবেই থাকো আর আমি আমার রাস্তা মেপে মেপে পেটের ভাত জাউ করবো। কেন রে? কোন ঠেকা আমার যে বাপ বেটার মনোরঞ্জনের জন্য বিয়ে করে বসে থাকবো। ওহ! আপনাদের তো আবার টাকার গাছ আছে। ভেবেছেন যাই বলবেন, শুনে কাঠের পতুলের মত টুকটুক করে মাথা হেলাবো। তাই কান খুলে শুনে রাখেন, যেই পালের গোদাই হন, এই ইশিতা বিয়ে করছে না।

কোন কারণে বাবা এই মেয়েকে পছন্দ করেছিল সে জানে না। সেও শর্ট টেম্পার্ট মানুষ। লেগে গেলো ধুমধারাক্কা। এতক্ষণ যে ভদ্র ভাবে কথা বলেছে এই তো কত। এই ধুম ধারাক্কার জন্যই রাগ এতো চড়া চড়লো। বিয়ে করবি না মানে। তোর বাপ এসে করবে। এখন দেখো বলেই জাওয়াদ তার সামনের টিটেবিলের’ই উপর বসলো। বসে সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করলো। সে চেইন স্মোকার! মিনিটে মিনিটে তার সিগারেট লাগে। তবে আজ ঠোঁটে সিগারেট নিয়েও আগুন ধরাতে পারলো না। তার হাত কাঁপছে। আশ্চর্য!

সে সাথে সাথেই আবার সিগারেট মুখ থেকে হাতের মুঠোয় নিলো! গলা শুকিয়ে আসছে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ঢোক গিলে বললো, — ইশিতা রাইট?

ইশিতা উপর নিচে মাথা নাড়ালো।
— আমি জাওয়াদ! দু’দিন আগে ফোন দিয়েছিলাম।

ইশিতা হা হয়ে গেলো। ওরে বাবা, এই নি ব্যাপার। এখন তার কাছে সব ক্লিয়ার। পানির মতো ক্লিয়ার। আজিজুল আঙ্কেল ছিলেন এক সময় তাদের বাড়ি ওয়ালা। অবশ্য তারা এক বাড়িতে থাকতো না। আঙ্কেলদের বেশ কয়েকটা বাড়ির মধ্যে একটাতে তারা থাকতো। বলতে গেলে অনেকটা সময় ছিল। ম্যানেজার ছিল তবুও অনেকদিন থাকার সুবাদে আজিজুল আঙ্কেলের সাথে বাবার কিছুটা সখ্যতা ছিল।

বাবা ব্যবসায় লস করলেন। সেই লস থেকে উঠতে ব্যাংক থেকে লোন নিলেন। সেই ব্যাংকের লোন টানতে টানতে ব্যবসা আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। বলতে গেলে আরো নিচের দিকে ডুবতে থাকলো। এতই ডুবে গেলো যে, বাড়ি ভাড়া পর্যন্ত গেলো কয়েক মাস জমে। পরে গ্রামের জমি টমি যা ছিল বিক্রি করে ব্যাংকের লোন দিয়েছিল। দিয়েছিল বাড়ি ভাড়াও তবে সম্পূর্ণ দিতে পারেনি। কিছু দিয়ে কিছুদিনের সময় নিয়ে সেই বাড়ি বাবা ছেড়ে দিয়েছিল।

একবার যারা ডুবে তারা আর সহজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। তারাও পারে নি। পারবে কি করে। বাবা একা, আর চার চারজন মানুষের মুখ। ঢাকার মতো শহরে নুন দিয়ে ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতেও দুনিয়ার খরচা লাগে। তার মধ্যে তাদের লেখাপড়া। তাই তারা এসে উঠেছিল দু’রুমের ছোট্ট এক বাসায়। তবুও যেন বাবা একা পেরে উঠে না।

উঠতে উঠতে কতোটা সময় গেছে বুঝতেই পারেনি। সে না পারার মাঝে বাবা চলে গেলেন। চলে যাওয়ার আগে তাদের দু’ভাইবোনের হাত ধরে বলেছিল, — এই ঋনটা যেন শোধ করে দেয়। তা না হলে হাশরের ময়দানে গিয়ে সে কি জবাব দেবে।

তাদের অবস্থা বলতে গেলে এখন আগের চেয়ে কিছুটা ভালো। খেয়ে পরে ভালো আছে আর কি। ভাইয়ার চাকরি হয়েছে। না, বড় কোন চাকরি না। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তদের কখনো আকাশ ফুঁড়ানো চাকরি হয় না। পেটে ভাতে চলতে পারে এমন চাকরি’ই হয়। সে নিজে লেখাপড়ার পাশাপাশি বেশ কয়েটা টিউশনি করছে। ব্যস তখন থেকেই তাদের দু’ ভাই বোনেন চেষ্টা ছিল, টাকা জোগাড় করা। চাইলেই তো আর জোগাড় হয় না। পেট ও তো চালাতে হয়। তাই ভাইয়ার বেতন থেকে কিছু, নিজের টিউশন থেকে কিছু। কিছু কিছু জমিয়ে সেই টাকা জোগাড় করেছিল।

ভাইয়ার নতুন চাকরি আর তার ভার্সিটি থেকে খুব একটা দূরে না। তাই টাকা নিয়ে সেই গিয়েছিল দিতে। দিতে গিয়েই হলো জ্বালা। সে টাকা দিতে গিয়ে লজ্জায় শেষ। তাদের হয়তো মনেও নেই। তাদের কাছে এই টাকা হাতের ময়লা। তবে তারা তো জানে না, এই টাকা কথা তারা একদিনের জন্যও ভুলেনি। কত চেষ্টার পরে জোগাড় করেছে।

ইশিতার মনে হয় এই পৃথিবীতে প্রত্যেকটা মানুষের লেখাপড়া শেখা উচিত, নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিত। সেটা ছোট হোক বড়। কেননা তার মা যদি কিছুটা সাবলম্বী হতো। তাহলে তাদের আজ এমন লজ্জায় পড়তে হতো না। কিছুটা হলেও স্বামীর বিপদে পাশে দাঁড়াতে পারতেন। আর পারলে আজ এমন দিন আসতোই না।

সে ভেবেছিল কোনরকম টাকা দিয়েই চলে আসবে। নতুন ম্যানেজার বাবাকে চিনলোই না। তাই আজিজুল আঙ্কেলকে ফোন করলেন। করতেই তিনি চিনলেন। আর সাথে সাথে বললেন বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেতে। বাবার সাথে তার কতোটুকু পরিচয় ছিল ইশিতা জানে না, জানার কথাও না। তখন সে ছোট। কখনো বাড়িওয়ালাকে দেখেওনি। তাই সে গেলো খুব সংকোচ নিয়ে। সংকোচ নিয়ে গেলেও তার খুব খারাপ লাগলো। কেননা যতোই হুইল চেয়ার থাক। একটা মানুষ এভাবে একা একা জীবন পার করছে তার ভাবতেই খারাপ লাগলো। তার মধ্যে সুখ দুঃখ বলার জন্য অর্ধাঙ্গিনীও নেই।

তার সংকোচ, তার খারাপ লাগা এই মানুষটার সুন্দর, আদরমাখা ব্যবহারে কোথায় যে গায়েব হয়ে গেলো ইশিতা বুঝতেই পারলো না। তাই নিজেও খুব আগ্রহ করে অনেক্ষণ আড্ডা দিলো। তিনি কিছুতেই দুপুরে খাবার না খেয়ে আসতে দেবেন না। তাই তারা এক সাথেই লাঞ্চ করলো। সব সময় টাচে থাকার জন্য তাদের বন্ধুদের মজ মাস্তি গ্রুপে এ্যাডও করে ফেললো। তারপরে কতো মজা। তিনি খুব’ই মজাদার মানুষ। সম্পর্কটা হয়ে গেল ঠিক বন্ধুর মতো।

তবে বয়স্ক মানুষদের সমস্যা একটাই। তারা আঁকড়ে ধরতে চায়। ইশিতাকে চাইলো। তবে ইশিতা বাস্তবতা জানে। তাদের সাথে এই সম্পর্ক কখনো যায় না। এগুলো প্রথম প্রথম ভালো গেলেও, এক সময় দেখা যায় কিছুই ম্যাচ হচ্ছে না। কেননা সে চাইলেও তাদের মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি মানসিকতা থেকে বের হতে পারবে না, আর না পারবে তারা তাদের উচ্চ বিত্ত চিন্তাভাবনা থেকে। প্রথম প্রথম সব ভালো লাগলেও পরেই শুরু হয় ভেদাভেদ, অশান্তি। কেননা এই দুনিয়ায় সব হতে হয় সমানে সমান। বেমানান হলেই ভোগান্তি।

ইশিতার এক জীবন গেছে অনেক অনেক ভোগান্তিতে ভরা। বাকি জীবনে তার তেমন কিছু চাওয়ার নেই। তবে সে মায়ের মতো কখনো কারো ঘাড়ে বোঝা হবে না। হয়তো তার মায়ের সময়ে সেই পরিস্থিতি ছিল না। কিন্তু তাদের কাছে তো আছে। তাই যতটুকু পারে ততোটুকু দিয়েই যেন সব সময় পরিবারের পাশে থাকতে পারে। তাই তার বিশাল এক স্বপ্ন আছে । ভালো সিজিপি পাওয়ার স্বপ্ন। পোস্ট গ্রাজুয়েশনের স্বপ্ন। অবশ্য সে জানে এই স্বপ্ন কখনো পূরণ হওয়ার নয়। কেননা তাদের কোন ব্যাংক ব্যালেন্স নেই। তবুও ইশিতা স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখতে তো ব্যাংক ব্যালেন্স লাগে না।

আর এই কোথাকার কোন আব্বার হাম্বা। বাবার একটু মন খারাপে তার শান্তির জীবনে অশান্তি টেনে এনে বসে আছে। তাই এতক্ষণ যে ভয় ডর ছিল সবই উবে গেলো। সে তেড়ে গিয়ে আঙ্গুল নাচিয়ে বললো, — মেয়ে মানুষে সমস্যা। এখন তুলে এনেছেন কেন? যতোই তেল মারেন, লাভ হচ্ছে না। বিয়ে তো আমি আপনাকে করছি না। এখন তো কোন দিনও না। মেরে ফেললে মেরে ফেলুন।

জাওয়াদ খুক খুক করে কাশলো। এই মেয়েকে বাবার পছন্দ হওয়ার কারণ কি এখন সে বুঝতে পারলো। তার মায়া মমতাময়ী মা। যে তাকে গর্ভেধারণ না করলেও বুকে আগলে নিয়েছিল। এই পুরো পৃথিবীতে তাকে বিনা স্বার্থে ভালোবাসার চাদরে আগলে রেখেছিল। এই মেয়েটা কিছুটা দেখতে মায়ের মতো। আর সবচেয়ে বড় কথা তার মাও এমন চঞ্চল প্রকৃতির ছিল।

সে খুকখুক করে কেশে দিসার দিকে তাকিয়ে বললো,– ওকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসো।

ইশিতা তো আরো রেগে ফেটে পড়লো। পড়ে বললো, — ফজলামি নাকি? যখন ইচ্ছা ষাঁড়, গন্ডার দিয়ে তুলে নিয়ে আসবেন, আবার মুখ দেখেই বাসায় পৌঁছে দিবেন? এতো সোজা সব কিছু।

— তাহলে থাকতে চাইছো?

— থাকতে চাইছি মানে। কোথায় থাকবো, কেন থাকবো? কোন দুঃখে থাকবো।

জাওয়াদ আর উত্তর দিলো না। তা না হলে এই মেয়ের সাথে তার হাতাহাতি হয়ে যেতে পারে। অবশ্য তার প্ল্যান ছিল অন্য কিছু। তাই দিসাকে রেখেছিল। তা না হলে জাওয়াদের সাথে বাঁদরামি। সে শান্ত ভাবেই দিসাকে বললো, — এই মেয়ে যদি আরেকবার আঙ্গুল নাচিয়েছে সাথে সাথে মুচড়ে ধরবে। যেন তেন ভাবে না। আঙুল দিয়ে ঘি তোলা যায় ঠিক তেমন।

দিসা অবাক হয়ে বললো, — জ্বি স্যার?

— যা শুনেছো তা’ই স্যার। যদি করতে পারো প্রমোশন পাক্কা। যখন মুচড়ে ধরবে তখনি সাথে সাথে পাক্কা।

নেকুঢেকু ইশিতার দিকে তাকালো। ইশিতা সাথে সাথে আঙুল মুঠো করে, দু’হাত বুকে বেঁধে ফেললো। ইজ্জত বেঁচেছে এখন আঙুল নিয়ে টানাটানি। হচ্ছে কি তার সাথে। সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ঘটা করে তুলে এনে আবার ঘটা করে পৌঁছে দিচ্ছে। কাহিনীটা আসলে কি?

চলবে।