আয়ুর প্রহর পর্ব-১৫

0
1577

#আয়ুর_প্রহর
#পর্ব_১৫
#আয়িশা_নুর_তৃষ্ণা
___
আয়ুশের মুখে আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে অনীতা মিইয়ে গেল।কি বলবে সে?নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গিয়েছে।মোক্ষম জবাব দিতে পারছে না অনীতা।কি হবে এখন?তার ভাইয়ার কাছে কী সে খারাপ মেয়ে হয়ে যাবে?

অনীতা জবাব দিল না।চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।

আয়ুশ আবার জিজ্ঞেস করলো,
-“ চুপ করে থাকিস না অনী।বল!”

তখনি অনীতা মুখ গম্ভীর করে ফেললো। গম্ভীর গলায় বললো,
“ আমাকে এই সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করিস না ভাইয়া। কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা থাকলেও তা আমরা কখনোই প্রকাশ করতে পারি না। উত্তর মনেই রয়ে যায়।কখনো প্রকাশ করা হয় না। প্রশ্ন আজীবন উত্তর ছাড়া প্রশ্নই রয়ে যায়। ”

অনীতার সহজ অথচ দুর্বোধ্য কথামালা আয়ুশের কাছে কেমন রহস্যময় ঠেকলো। এতোক্ষণ প্রণয়ের হাতের ছিলে যাওয়া অংশে স্যাভলন লাগিয়ে দিচ্ছিলো আয়ুশ। শেষ করেই সে অনীতার কাছে গেল।বোনের এক গালে হাত রেখে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলো,

-“ কি হয়েছে অনী?এভাবে বলছিস কেন ভাইয়াকে?”
-“ কিছুই না ভাইয়া।এখন তুই যা।বাবা চলে গিয়েছে। এতো রাতে আমার রুমে একটু আওয়াজ পেলে চলে আসতে পারে।তখন আবার সমস্যা হবে।এখনি চলে যা।”
-“ কিন্তু অনি……”
-“ কোনো কিন্তু নয় ভাইয়া।ভাল্লাগছে না আমার ঘুমোবো এখন।এমনিতেই আমার ঘুমের সময় খুব কম।”
-“ কম মানে?”
-“ আর কিছু জিজ্ঞেস করিস না ভাইয়া!প্লিজ!”
আয়ুশ আর কিছু রইলো না।তার ছোট্ট বোনটা এতো বড় কবে হলো।এতো কঠিন কঠিন কথা বলা শিখে গিয়েছে তার ছোট্ট অনীটা!

আয়ুশ আর কথা বাড়ালো না।একটু পরই সকাল হবে।তার আগেই যা করার তা করে বাড়ি যেতে হবে।তাই বের হওয়ার আগে সে বাইরে অপেক্ষারত অফিসারদের মেসেজ করে বাড়ি চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলো।

তারপর প্রণয়ের দিকে ইশারা করে তাকে সাবধানে বের হতে বলে নিজেও খুব সাবধানে জানালা দিয়ে বাইরে বের হলো।আয়ুশের পর প্রণয় ও বের হলো।আয়ুশ জানালার বাইরে যাওয়ার আগে অনীতাকে বললো,
সে বের হওয়ার পর অনীতা যেন ওয়াশরুম থেকে
মগ ভর্তি পানি এনে আয়ুশের হাতে দেয়।

আয়ুশ-রা বের হওয়ার পর অনীতা তাই করলো।সে পানি এনে জানালা দিয়ে আয়ুশের হাতে পানিভর্তি মগ দিল।

আয়ুশ নিজের পা থেকে জুতা খুলে পাঁচিলের সামনে থাকা শক্ত ঘাসের উপর জুতা ছুড়ে মারলো।তারপর প্রণয়কে পাঁচিলের কাছাকাছি যেতে বললো।প্রণয় তাই করলো।

পাঁচিলের যে জায়গা দিয়ে প্রণয় আর আয়ুশ এসেছে সে জায়গায় ওদের দুইজনের জুতার ছাপ ছিল।আয়ুশ এক হাতে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জালিয়ে পানিভর্তি মগ থেকে পানি ফেলে ফেলে পায়ের ছাপগুলোয় ঢালতে লাগলো।

অনীতাকে আরো কয়েকবার ওয়াশরুম থেকে পানি আনতে হলো।আয়ুশ ও খুব সাবধানতা অবলম্বন করে পায়ের ছাপগুলো ধোয়া শেষ করলো।তারপর নিজের পা ধুয়ে জুতা পড়ে নিলো।

ঝোপের এইদিকটায় বেশ ঘাস হওয়ার আর ঝোপটা পাঁচিলের কাছাকাছি থাকায় আয়ুশ ঝোপের আড়ালে মগটা রেখে দিয়ে অনীতাকে পরদিন সকালে মগ নিতে বললো। জানালার কাছাকাছি বেশ নরম মাটি।এখন গিয়ে মগ দিয়ে আসলে যদি আবার পায়ের ছাপ পড়ে।এই খেয়ালে আয়ুশ আর জানালা দিয়ে মগ দিলো না।

অতি সাবধানে প্রণয় আর আয়ুশ পাঁচিল টপকে বের হলো। এতোক্ষণ চুপচাপ থাকলেও প্রণয়ের বুক বেশ ধকপক ধকপক করছে।এই না আয়ুশ তাকে অনীতার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে!

কিন্তু তেমন কিছুই হলো না।আয়ুশ তার গাড়ি নিয়ে বাসায় আসলো।আর প্রণয় তার মোটরসাইকেলে করে। দু’জন পাশাপাশিই আসতে লাগলো।দু’জনের ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে গেল।

বাড়ির একটু কাছে আসতেই আয়ুশ গাড়ি থামিয়ে প্রণয়কে দাঁড়াতে বললো।প্রণয় দাঁড়ালে আয়ুশ গাড়ি থেকে নেমে প্রণয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রণয়কে জিজ্ঞেস করলো,
-“ একটা কথা বলি?”

প্রণয় ভয় পেয়ে গেল। এতোক্ষণ তো সব ঠিকই ছিল।এখন হঠাৎ কি জিজ্ঞেস করবে আয়ুশ।

পরক্ষণেই মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।আয়ুশের থেকে পাওয়া প্রশ্নের উত্তর সে ঘুরিয়ে পেঁচিয়েই দিবে।
তারপর প্রণয় বললো,
-“ হ্যাঁ,বলো।”

আয়ুশ প্রণয়ের কাঁধে হাত রাখলো।মৃদু স্বরে বললো,
-“ তুমি আমার ভাইয়ের মতো।ভাইয়ের প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিও!”
প্রণয় হ্যাঁ বললো।

এর পরপরই আয়ুশের মুখ থেকে শুনতে পেল সেই কাঙ্খিত প্রশ্নটি,
-“ অনীর সাথে তোমার কি সম্পর্ক?”
-“ আসলে…ব্রাদার,অনীতা আর আমি একই ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতাম।ও আমার জুনিয়র।একটা অনুষ্ঠান এটেন্ড করতে গিয়ে ওর সাথে আমার পরিচয়।আস্তে আস্তে কথা বলা।এরপর আমাদের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।আমরা ফ্রেন্ডের মতোই।”
এতটুকু বলে একটা ঢোঁক গিলে বললো “বেশি কিছু না।”

আয়ুশ বললো,
-“ সত্যিই কি বেশি কিছু না?তা না হলে তোমার ফোন নাম্বার অনীর মুখস্থ থাকবে কেন?কাছের মানুষ না হলে তো এমনভাবে মুখস্থ করার কথা না! তাছাড়া ও যেভাবে এই মাঝরাত্তিরে তোমাকে বিশ্বাস করে বাড়িতে ডাকলো,কোনো ছেলে বিশেষ কেউ না হলে তো তাকে এমনভাবে বিশ্বাস করে না কেউ। অত্যন্ত আমার বোন না।তুমি নিশ্চয়ই তার কাছের কেউ?”

আয়ুশের থেকে সোজাসাপ্টা প্রশ্ন শুনে প্রণয় আরেকবার ঢোঁক গিললো।তারপর জোর গলায় বললো,
-“ সত্যিই আমি অনীতার কাছের কেউ না।আমি তার বিশেষ কেউ না।আমরা শুধুই ফ্রেন্ড ছিলাম।”

এই কথাটুকু বলতে প্রণয়ের খুব কষ্ট হলো।সে চাইলেই পারতো,তার আর অনীতার বিয়ের কথা আয়ুশের কাছে বলে দিতে।আয়ুশ হয়তোবা রাগারাগি করতো বা তাদের ভুল বুঝতো। তবুও তো সব জানতো। সত্যটা তাড়াতাড়ি প্রকাশ হওয়াটাই ভালো ছিল।

প্রণয় আজকেই আয়ুশকে তার আর অনীতার ব্যাপারে বলে দিতো। কিন্তু অনীতা প্রণয়কে ইশারা দিয়ে বারবার না করেছে,যেন সে আয়ুশকে তাদের সম্পর্কে কিছু না জানায়।তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রণয় আয়ুশ কে কিছু বলতে পারলো না।

প্রণয়ের কথা বিশ্বাস করতে আয়ুশের খুব কষ্ট হলো।তার মনে হলো,প্রণয় তার কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছে।কিন্তু এটা তো অফিস নয়।প্রণয় ও তো কোনো অপরাধী নয় যে, এই জায়গায় ধরে বেঁধে তার থেকে উত্তর আদায় করবে।

অবশ্য কথার জালে ফেলে প্রণয়ের থেকে উত্তর আদায় করতে পারবে আয়ুশ।তবে সে চায়, প্রণয় নিজ থেকেই তাকে সব সত্য বলুক।কিংবা অনীতাই এসে বলে যাক।

কথা শেষ করে দু’জন যে যার গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় হঠাৎ আয়ুশের কিছু একটা মনে হলো।সে গাড়িতে না উঠে প্রণয়ের বাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,

-“ একটা কথা প্রণয় ব্রো।তুমি কি বাড়ির মেইন দরজা বন্ধ করে এসেছিলে?”
-“ হ্যাঁ।”
-“ থ্যাংকস ব্রো।আমি তাড়াহুড়োয় দরজা লাগাতেই ভুলে গিয়েছিলাম।কি করে যে এতো বড় ভুল হলো!”

-“এখন আর টেনশন নিও না।আমি বের হওয়ার সময় দরজা খোলা দেখছিলাম।তখন ভাবিনি তুমি বের হয়েছো।ভেবেছি হয়তোবা রাতের বেলায়ই মনের ভুলে দরজা লাগাতে ভুলে গিয়েছো।আসার সময় কাউকে সজাগ করতে চাইনি।তাই বাইরে থেকেই দরজা বন্ধ করে চলে এসেছি। কিন্তু একটা কথা আমার মাথায় ঢুকছে না,আমি তো অনীতার ফোন পেয়ে ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি জানলে কি করে?আর কেইবা খু’ন হতে চলেছিলো”?

প্রণয়ের প্রশ্ন শুনে আয়ুশ ঘাবড়ালো না।এমন সময় সে প্রণয়ের সামনে পড়েছে,আজ না হোক কাল তাকে প্রণয়ের মুখ থেকে এমন প্রশ্ন শুনতে হতোই।তাই সে না ঘাবড়ে জবাব দিলো,

-“ আসলে এটা তুমি এখন বুঝতে পারবে না।সময় হলে সব জানতে পারবে।আপাতত আজকে রাতের বিষয়ে কাউকে কিছু বলো না।প্রহর বা প্রেমাকেও না।”

প্রণয় মাথা নাড়িয়ে “আচ্ছা” বললেও তার মনে প্রশ্ন থেকেই গেলো।

এরপর আয়ুশ প্রণয়কে তার বাইকে উঠতে বললো,সাথে এও বললো,তারা একটা মসজিদের সামনে দাঁড়াবে।মসজিদে দু’জন ফজরের নামাজ আদায় করে তারপর বাসায় ফিরবে।
বাসায় ফিরে প্রহরকে বলবে,তারা দুইজন নামাজ পড়তে গিয়েছিল।

__
ফজরের আযান দেওয়ার সাথে সাথেই প্রহরের ঘুম ভেঙে গিয়েছে।প্রহরের প্রতিদিন এমন সময়েই ঘুম ভাঙে।প্রহর নিয়মিত নামাজ পড়ে। কিন্তু লাস্ট কয়েকদিন পিরিয়ড থাকার কারণে নামাজ মিস গিয়েছে।

যথারীতি নিয়ম অনুযায়ী আজ ও প্রহরের ঘুম ভাঙল।রুমের লাইট অন করাই ছিলো।পাশ ফিরতেই সে দেখলো,আয়ুশ পাশে নেই।প্রহর চমকে গেল।কোথায় গেল লোকটা! বাথরুমে নয়তো।

প্রহর দেখলো ওয়াশ রুমের লাইট অফ করা।এখানেও তো নেই।প্রহর শোয়া থেকে উঠে পড়লো। ব্যালকনির দরজা খুলে,কিচেনে গিয়ে আয়ুশকে খুঁজলো। কিন্তু না,আয়ুশ কোথাও নেই।
তারপর প্রহরের চোখ গেল,মেইন ডোরের দিকে।দরজা ভিতর থেকে খোলা।এটা খেয়াল করে প্রহর দরজার দিকে গিয়ে দরজা টান দিতে দেখে দরজা বাইরে থেকে লাগানো।

আয়ুশের খোঁজ না পেয়ে আর মেইন ডোর বাইরে থেকে লাগানো দেখে প্রহর প্রণয়ের রুমের দরজায় আওয়াজ দিতে লাগলো।কয়েকবার কড়া নাড়ার পর দরজা আপনাআপনিই খুলে গেল।প্রহর প্রণয়ের রুম, বাথরুমে প্রণয়কে খুঁজলো।না, এখানেও নেই।

প্রহরের ফোনে আয়ুশ আর প্রণয় দুইজনের ফোন নাম্বারই সেভ করা ছিল।প্রহর দু’জনকেই কল দিল।
আয়ুশের ফোনে রিং হওয়ার পর আপনাআপনিই কেটে গেল।প্রহর আরো ৯ বার কল দিল। প্রতিবারই ফুল রিং হয়ে কেটে গেল।

তারপর প্রহর প্রণয়ের ফোনে কল দিল। কিন্তু প্রণয়ের ফোনে যতবারই ফোন দিল, ততবারই একটা মেয়েলি গলা শুনতে পেল,
“ আপনি যে নাম্বারে কল করছেন,সে নাম্বারে এই মুহূর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না।”

নিরাশ হয়ে প্রহর প্রেমার দরজায় তিনবার নক করতেই দরজা খুলে গেল।তার সামনে প্রেমা ঢুলুঢুলু চোখে দাঁড়িয়ে আছে।

চোখ কচলাতে কচলাতে প্রেমা প্রহরকে জিজ্ঞেস করলো,
-“ কি হয়েছে রে প্রহু?এই রাতদুপুরে এইভাবে বিরক্ত করছিস কেন?”
-“ বাসায় ওরা কেউ নেই।ভাইয়াও নেই।উনিও নেই।”
-“ উনি কে?”
-“ আরে উনি।”
প্রহরের কথা শুনে প্রেমা চোখেমুখে বিরক্তি এনে বললো,
-“ আরে ভাই,উনিটা কে?উনির কি কোনো নাম নেই?”
-“ হ্যাঁ নাম আছে।ওইযে তুই যাকে দুলাব্রো বলে ডাকিস।উনিই উনি।”
প্রহরের কথা শুনে প্রেমা হেসে ফেললো।বললো,
-“ তুই আগের মতোই লজ্জাবতী রয়ে গেলি প্রহর।আমার দুলাব্রো ও তোর লজ্জাকাঁটা হতে পারলো না।”

প্রেমার কথা শুনে প্রহর বললো,

-“ এটা হাসি-মজা করার সময় নয় প্রেমা।ভা…
-“ তাহলে এটা কিসের সময়? নিশ্চয়ই ঘুমানোর।তুই আমাকে ঘুম থেকে তুলেছিস কেন?তোর জামাইকে বলে দিবো কিন্তু।আমার ঘুম নষ্ট করার তুই কে?ভাইয়া কি তোকে….
প্রেমার একনাগাড়ে কথা বলা শুনে প্রহর বুঝলো, এর কথা থামবেই না।তাই প্রহর যতটুকু আওয়াজে পারে,ততটুকু আওয়াজ দিয়ে প্রেমার কথার মাঝেই বেশ জোরেশোরে বললো,

“ভাইয়া আর উনাকে খুঁজে পাচ্ছি না ।উনারা কোথাও নেই।দরজাও বাইরে থেকে লাগানো।”

প্রহরের কথা শুনে প্রেমার দু’চোখ থেকে ঘুম আর মুখ থেকে ফোটা কথার খৈ যেন উধাও হয়ে গেল।অবাক মুখশ্রীতে কয়েকগুণ জিজ্ঞাসার রং ঢেলে জিজ্ঞেস করলো,

-“ কি বলছিস প্রহর।মেইন দরজা বাইরে থেকে বন্ধ মানে?”
-“ হ্যাঁ।এটাই তো দেখলাম।”
-“ তো এতে চিন্তা করার কি আছে?”
-“ তো চিন্তা করবো না।বাসায় পুরুষ মানুষগুলোর একটাও নেই।দরজাও বাইরে থেকে লাগানো। চিন্তা করবো না বলছিস?”
-“ চিন্তা কর। এই চিন্তার মধ্যে আমাকে ফেলছিস কেন?”

প্রেমার কথা শুনে প্রহর অবাক হয়ে বললো,
“ আমি চিন্তা করবো আর তুই করবি না?ওরা কি তোর কাছের কেউ না?”
-“ অবশ্যই কাছের।ওরা দুইজনই আমার ভাই?”
-“ তো এমন বলছিস কেন?”

প্রহরের কথা শুনে প্রেমা একটু সময়ের জন্য চুপ করে রইলো।তারপর বললো,
-“ এখন ফজরের সময় তাই তো প্রহু?”
-“ হ্যাঁ!”
-“ তুই এখন কি জন্য ঘুম থেকে উঠেছিস?”
-“ ফজরের নামাজ পড়ার জন্য।”
-“তুই শুধু একাই ফজরের নামাজ পড়িস?”

প্রেমার এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে প্রহর চকিত নয়নে প্রেমার দিকে তাকাল।তারপর বললো,
-“ এটা কেমন প্রশ্ন?আমি একা পড়বো কেন? যে সকল মুসলিম ভাই-বোন দ্বীন পালন করে,তারা সবাই তো ফজরের নামাজ পড়ে?

প্রহরের কথা শুনে প্রেমা নিজের এক হাতের উপর আরেক হাত দিয়ে মতো হালকা আওয়াজ করে বললো,

-“ কারেক্ট প্রহু।নোট দিস পয়েন্ট।তুই একা পড়িস না।যেইসকল মুসলমান দ্বীন পালন করে,তারা ফজরের নামাজ পড়ে।তো আমার ভাই,তোর হাসবেন্ড ওরাও তো মুসলমান।ওরা কি ফজরের সময় নামাজ পড়ার জন্য বাসার বাইরে অর্থাৎ মসজিদে যেতে পারে না?”

প্রেমার কথা শুনে প্রহর ভাবলো,সত্যিই তো।এমনভাবে তো সে ভেবে দেখেনি। তবুও বললো,
-“ কিন্তু উনি আমাকে সজাগ করেননি কেন?উনি তো দেখেছেন আমি প্রতিদিন উঠে নামাজ পড়ি। তাছাড়া উনিও পাশের ঘরে ফজরের নামাজ আদায় করতেন।আজ বাইরে গেলেন কেন?”

-“ হতে পারে,আজকে দুলাব্রোর বাইরের হাওয়া খাওয়ার শখ হয়েছে।তাই ওরা দুইজন বাইরে গিয়েছে।আর সাথে যদি তুইও যেতে চাস,এইজন্য আগে আগে উঠেও তোকে সজাগ করেনি।ওরা ওদের মতো সময় পার করুক না প্রহর।তুই এতো ভাবিস না”।

-“ তবুও……!”
-“ তবুও কি?”
-“ না রে কিছু না।তোর কথায় একটুখানি নিশ্চিন্ত হলাম।তুই কত সহজভাবে ভেবে বললি।আর আমি কত দুশ্চিন্তা করছিলাম”

প্রহরের কথা শুনে প্রেমা প্রহরের একটু কাছে গিয়ে প্রহরকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,

-“ তেমন কিছুই না প্রহর।সবকিছু আগে পজিটিভলি চিন্তা করতে হয়। কিন্তু কাছের মানুষদের ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই উল্টাপাল্টা চিন্তা করি।যে,তার কোনো বিপদ হলো কি না।কোথায় আছে,এমন করছে কেন?হেন তেন। খুব কাছের মানুষদের জন্য এমন ভাবা অস্বাভাবিক কিছু নয়।ওরা হুটহাট গায়েব হয়ে গেলে পজিটিভ কোনো চিন্তাই মাথাম আসবে না,আসেও না।আমি তোর চিন্তাভাবনাকে সাপোর্ট করি।
তোর কথা শুনে আমার যে চিন্তা হয়নি তা নয়। কিন্তু আমি সহজভাবেই চিন্তা করে ফেলেছি।কারণ আমি প্রণয় ভাইয়াকে বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে ঠিকমতো নামাজ পড়তে দেখেছিলাম।আর এখন যেহেতু নামাজের সময়,তাই সহজভাবে ভেবে সহজভাবে বলেছি।এটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়।বুঝেছিস প্রহু?”

প্রেমার কথা শুনে প্রহর মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বললো।তার চেয়ে ছোট প্রেমা,অথচ কি সুন্দর বুঝাতে পারে সে!

প্রেমা প্রহরের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললো,
“ চল এখন দুইজন মিলে ফজরের নামাজ টা পড়ে ফেলি”
-“ চল।”

প্রহর আর প্রেমা ওযু করতে চলে গেল।
প্রেমা প্রহরকে নিজের মতো করে বলে তার মনটাও যে খুঁতখুঁত করছে না তা নয়। ওরা গেল কোথায়?

প্রেমা আর প্রহরের নামাজ পড়া শেষ হলো।ওরা অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু প্রণয় আর আয়ু্শ এলো না।
প্রেমার কথা অনুযায়ী প্রহর আর প্রেমা দু বোন মিলে রান্না বসিয়ে দিলো।

ঠিক সকাল সাতটা বাজে দরজা খোলার আর বন্ধ আওয়াজ হলো।প্রহররা তখনও রান্নাঘরেই। ততক্ষণে ওদের রান্না-বান্না শেষ।রান্নাবান্না শেষ করার পর ওদের দু বোনের মনোযোগ ছিল মেইন ডোরের দিকে।তাই দরজা খোলার ও দরজা লাগানোর আওয়াজ ওরা বেশ ভালোভাবেই শুনতে পেল।

দুই বোন একসাথে রান্নাঘর থেকে বের হলো‌। ড্রয়িংরুমে এসে দেখলো প্রণয় আর আয়ুশ এসেছে।শেলফে জুতা রেখেই সোফায় বসে পড়েছে দুইজন।

আয়ুশ আর প্রণয়কে দেখে প্রহরের আত্মায় যেন পানি ফিরে এলো।পুরোটা রান্নার সময় ও শুধু ওদের আসার অপেক্ষাই করেছে।
প্রেমা এসেই প্রণয়ের পাশে গিয়ে বসলো।আর প্রহর আয়ুশ আর প্রণয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো।আয়ুশের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-“ কোথায় গিয়েছিলেন আপনারা?”
প্রহরের কথা শুনে আয়ুশ প্রণয়ের দিকে একবার তাকিয়ে হাসোজ্জ্যল মুখে উত্তর দিলো,
-“ কোথায় আর?মসজিদে নামাজ পড়তে!”

আয়ু্শের কথা শুনে প্রেমা বলে উঠলো,
-“ দেখেছিস প্রহু আমি বলেছিলাম না,ভাইয়ারা মসজিদে গিয়েছেন।দেখেছিস আমার কথাই ঠিক হয়েছে।”
বলেই নিজের সামনের চুল ঝাড়া দিয়ে পিছনে রাখলো প্রেমা।

“ তুই তো সবসময় ঠিক কথাই বলিস‌।”বলে প্রেমার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচালো প্রণয়।
প্রণয়ের মুখ ভেংচানো দেখে প্রেমা প্রণয়ের চুলে টান দিয়ে বললো,
-“ আমাকে মুখ না ভেঙচালে তোমার সারাদিন ভালোমতো যায় না?”

প্রণয় মুচকি হেসে বললো,“ সত্যিই দিন ভালো যায় না!”
প্রেমা গাল ফুলিয়ে বললো,“ ভাইয়া!”
“ এখন যা তো,আমি গিয়ে একটু রেস্ট নিই।” বলেই আয়ুশ আর প্রহরের দিকে এক নজর তাকিয়ে নিজের রুমে চলে গেল প্রণয়। চলে যাওয়ার সময় প্রহর বললো,

-“ রান্না করেছি ভাইয়া।খেয়ে রেস্ট নাও।”
-“ না রে বনুই।এখন খিদে পাচ্ছে না।একটু রেস্ট নিই।তারপর না হয় খাবো।”
-“ আচ্ছা ভাইয়া।”

প্রণয় চলে গেল।প্রণয় চলে যাওয়ার পর প্রহর আয়ুশকে বললো,
-“ আপনি খাবেন না?”
-“ না,এখন ইচ্ছে করছে না।”
-“ কেন?”
-“ প্রণয়ের সাথে একসাথে খাবো।এখন ঘরে যাচ্ছি।”বলেই বেডরুমের দিকে যেতে লাগলো আয়ুশ।

প্রহর প্রেমাকে ইশারায় বসতে বলে আয়ুশের পিছুপিছু সেও বেডরুমের দিকে যেতে লাগলো।প্রহর রুমে ঢুকামাত্রই আয়ুশ পিছু ফিরে প্রহরের মুখোমুখি হয়ে প্রহরের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।প্রহর চোখ বন্ধ করে ফেলল..।

চলবে…