আয়ুর প্রহর পর্ব-২৫+২৬

0
890

#আয়ুর_প্রহর
#পর্ব_২৫
#আয়িশা_নুর_তৃষ্ণা
____
এই গোধূলি লগ্নে ব্রিজে হাঁটছে দুইজন। পাশপাশি তবে কাছাকাছি নয়।দূর থেকে দেখলে মনে হবে,কি সুন্দর এক জোড়া সুখী কপোত-কপোতি পাশাপাশি হাঁটছে। কিন্তু মূল বিষয়টা তারাই জানে,তারা কতোটা সুখী!

পাশাপাশি দুজন হেঁটেই যাচ্ছে। দু’জনের একজনের মুখেও কোনো রা নেই।ব্রিজের ওপারে গিয়ে ওপার থেকে আবার ফিরে এলো দুজন। তবুও একজনের মুখে কোনো শব্দটি নেই।

সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। আশেপাশে অন্ধকার হয়ে আসছে।প্রণয়ের ইচ্ছে করছে অনীতার হাতে হাত রেখে হাঁটতে।অনীতার কোমল হাত ছুঁতে ছুঁতে প্রকৃতির নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে।কিন্তু কি একটা বাঁধা যেন তাকে আকড়ে ধরছে বারবার।

প্রণয়ের সাথে পাশাপাশি এতোক্ষণ হাটতে পেরে অনীতার ভালোই লাগছে।মনে হচ্ছে,এক অন্য জগতে আছে সে। প্রণয়ের পাশাপাশি হাঁটা তাকে এক অদ্ভুত রকমের প্রশান্তি দিচ্ছে।তাই সে প্রণয়কে কিছুই বলছে না।

অপেক্ষা করতে করতে যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে চারিদিকে অন্ধকার নেমে এলো,তখন অনীতা দাঁড়িয়ে পড়লো।অনীতার সাথে সাথে প্রণয় ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অনীতায দিকে তাকালো।এবার অনীতা মুখ খুললো,

-—“ আপনি এখনো কিছু বলছেন না কেন?কি দরকারে ডেকেছিলেন?”

আচমকা অনীতার এমন প্রশ্ন শুনে একটা চুপ থাকে প্রণয়।তারপর বলে,
-—“ দরকার তো অনেকই আছে। কোনটা রেখে কোনটা বলি।”

-—“ একপাশ থেকে শুরু করুন।শুনছি।”

-—“ এখনি?তোমার কি হাঁটতে ভালো লাগছে না?”

-—“ তেমন কোনো বিষয় না। হাঁটতে ভালো লাগলেও শরীরটা….”

-—“ কি হয়েছে অনী? শরীর খারাপ লাগছে?খুব বেশি?তুমি ঠিক আছো?” উত্তেজিত হয়ে বললো প্রণয়।

-—“ না না।শরীর ভালোই লাগছে।আপনি এতো হাইপার হবেন না দয়া করে।ঠিক আছি আমি।আসলে, অনেকক্ষণ হলো এলাম।অনেক তো হাঁটলাম।এইবার মনে হচ্ছে কথা বলতে হবে।আমরা তো কথা বলতেই এসেছি। কথা শেষ হলেই চলে যাবো!যে দরকারে এসেছি,তা তো পুরো করতে হবে।”
নিজের অসুস্থতা লুকালো অনীতা।

অনীতার শরীর ভালো শুনে প্রণয় যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু পরক্ষণেই অনীতার শেষোক্ত কথা শুনে সে খানিকটা কষ্ট পেলো।
সে অনীতাকে শুধালো

-—“ তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো অনী?”

‘না একদমই বিরক্ত হচ্ছি না আমি।আপনার হালকা সংস্পর্শই আমায় স্বর্গের অনুভুতি দেয়। সৃষ্টিকর্তা চাইলে আমি সারাজীবন আপনার সাথে থেকে যেতাম। আপনার সংস্পর্শ আমার জীবনের সুন্দর মুহুর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম।আর আপনি বলছেন আমি বিরক্ত হবো?’
মনে মনে কথাগুলো আওড়ালো অনীতা । কিন্তু মুখে বললো,

“ একদমই বিরক্ত হচ্ছি না,এমনটা বলতে পারছি না।তবে রাত হয়ে গিয়েছে।বাসায় ফিরতে দেরী হলে খালমণি বকা দিবে।ভাইয়াকেও বলে আসিনি আজ।যদি জানে এতোরাত করে ফিরেছি,তাহলে ভাইয়াও রাগ করবে।”

-—“ বলে আসোনি কেন?”

-—“ বাহ রে!বলে আসবো কি করে!আপনি বিকেলে ফোন দেওয়ার সাথে সাথেই তো বেরিয়ে পড়েছি।এমনভাবে বললেন,যেন কি জরুরী কথা বলবেন….!”

তক্ষুণি প্রণয়ের মনে পড়ে গেল বিকেলের কথা।
কদিন ধরেই তার মনটা অনীতার জন্য কেমন কেমন করছিলো। অনীতার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিছু কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো।কিন্তু অনীতাকে কল দিয়ে তার সাথে দেখা করার জন্য বলতে প্রণয়ের নিজেকে প্রস্তুত করতে একটু সময় লেগেছিলো।

অবশেষে আজ নিজের পক্ষ হতেই অনেক বাধা কাটিয়ে অনীতাকে ফোন দিয়ে বললো,তার সাথে দেখা করবে ।কথা আছে।

প্রথমে অনীতা না করলেও পরে প্রণয় এতো জোরাজুরি করলো যে অনীতা আর না বলতে পারলো না। তড়িঘড়ি করে একটা বোরখা আর হিজাব পড়ে চলে এলো।

খালামণির বাসায়ই ছিলো অনীতা‌।বেরোনোর আগে খালামণিকে বলে এলো,তার ফিরতে একটু রাত হবে‌।

খালমণি প্রথমে বারণ করতে চাইলেও পরে ভাবলেন,এমনিতেই মেয়েটা একটু মুষড়ে পড়েছে।রুম থেকে সহজে বের হতে চায় না।কথা বলতে চায় না।খেতে চায় না।বাইরে ঘুরার কথা বললে শুধু একটা কথাই বলে,‘তোমরা যাও।আমার শরীর ভালো লাগছে না।’

আজ যখন নিজ থেকেই বাইরে যাওয়ার কথা বলেছে,তখন অনীহার খালামণি তার বাইরে বেরোনোর ইচ্ছায় সম্মতি জানালেন।তবে সম্মতির পাশে বসালেন এক আবদার।

কি আবদার!
উনার আবদার হচ্ছে,উনিও অনীতার সাথে বাইরে যাবেন।উনার আবদার শুনে অনীতা সাথে সাথে বিনয়ের সাথে না বললো।

অনীতা একদমই চায় না,সে যে এখন প্রণয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে এই কথাটি কেউ জানুক।

তাই সে খালমণিকে একথা ওকথা বুঝিয়ে বললো যে,তার ফ্রেন্ড আসবে।আর ওদের সাথে একটু পার্সোনাল টাইম স্পেন্ড করলে তার মন ফ্রেশ হবে।তাই তাকে একা যেতে দিলেই ভালো হবে।

অনীতার সহজ সরল খালামণি ভাবলেন,তাই তো।উনি গেলে হয়তো ওদের খোলাখুলি কথা বলতে অস্বস্তি লাগবে। এরচেয়ে অনীতার একা যাওয়াটাই ভালো।
তাই উনি অনীতাকে একাই যেতে দিলেন।সাথে বলে দিলেন, তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে।
কি মনে করে অনীতা বললো তার বাসায় ফিরতে দেরী হবে।রাতও হতে পারে।
কারণ হিসেবে জানালো,বহুদিন পর ফ্রেন্ডের সাথে দেখা।একটু সময় নিয়েই দেখা করতে হবে।
অনীতা বেরিয়ে সোজা প্রণয়ের পাঠানো লোকেশনে এসে পড়লো।
__
অনীতার কথা শুনে প্রণয় বললো,

-—“ ও আচ্ছা। তাহলে কথা শুরু করি।”
-—“ হ্যাঁ,বলুন আপনার জরুরী কথা।”
-—“ আমরা কি আমাদের সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক করতে পারি না অনী?তোমার থেকে এতো দূরে থাকা আমার কাছে অনেক কষ্টের মনে হয়।”
-—“ আমাদের সম্পর্ক তো স্বাভাবিকই আছে।”

-—“ একদম স্বাভাবিক নেই অনী।একদম স্বাভাবিক নেই।”

-—“ যেমন?” বুঝেও প্রশ্নটা করলো অনীতা।
-—“ উদাহরণ দিলে কতো কিই বলা যেতে পারে।আমাদের বিয়ে হয়েছে কতো তারিখে বলো তো? আমাদের বিয়ে হয়েছে আজ থেকে পাঁচ মাস আগে।তেইশের সেপ্টেম্বরের চৌদ্দ তারিখ এ।অথচ কেউ এখনো আমাদের বিয়ের বিষয়ে কিছু জানে না।

তোমার কি মনে হয় এসব স্বাভাবিক?আমি এসব আর নিতে পারছি না অনী।আমার মনে হয়, আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক করা উচিত।সবার কাছে প্রকাশ করা উচিত।এইযে তুমি কাছে থেকেও দূরে আছো,এটা আমার কাছে শত শত ধারালো কাঁটার উপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যাওয়ার থেকেও যন্ত্রণাদায়ক মনে হয়।
তুমি কি আমার হবে না অনী?”

বলতে বলতে প্রণয়ের গলা ধরে আসে।তার চোখের কোণে পানি স্পষ্ট।
অনীতা চুপ করে আছে।কোনো উত্তর দিচ্ছে না।কি উত্তর দিবে সে।কিছুই তো বলতে পারবে না প্রণয়কে।তার মনের ভিতর যে হাহাকার চলছে,তার উপশম কি আদৌ আছে নাকি!
সে চুপ রইলো।প্রণয় জিজ্ঞেস করলো,
-—“ চুপ করে থেকো না অনী! কিছু তো বলো।অনেক আশা নিয়ে আজ তোমার কাছে এসেছি।আজ অন্তত ফিরিয়ে দিয়ো না আমায়।”

অনীতা অন্যদিকে ফিরে রইলো।তার চোখের কোণায় ও পানি চিকচিক করছে। কিন্তু প্রণয়ের সামনে তার চোখের জল প্রকাশে সে অনিচ্ছুক।
তাই নিজেকে খানিকটা ধাতস্থ করে প্রণয়কে বললো,
-—“ ব্রিজের ওপাশ থেকে একটু চা নিয়ে আসবেন‌। ঠান্ডা লাগছে।”

প্রেয়সী আর কিছু না বলুক,তার আবদার তো আর উপেক্ষা করা যায় না।তাই আর কিছু না বলে সাথে সাথেই চা নিয়ে আসতে চলে গেল প্রণয়।
অনীতার চোখের বিন্দু বিন্দু পানি তার গালে টুপটাপ করে পড়লো।ভাঙা গলায় সে গাইতে লাগলো,

দেখোনি তো তুমি,
আমার চোখের পানি।
আমার গাওয়া গানে,
তোমাকে কাছে টানি।
আসো আবার কাছে,
হাতটা ধরে……

আর গাইতে পারলো না অনীতা‌। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো তিমিরাচ্ছন্ন আকাশের দিকে।আদৌ কি কখনো প্রণয়ের হাত ধরতে পারবে অনীতা?

প্রণয় যেতে যেতে চোখ মুছে চলছে।এমনভাবে চোখ মুছলো সে,যেনো সৃষ্টিকর্তা ব্যাতীত আর কেউ না দেখতে পায় । ঈষৎ হেসে চায়ের দোকানে গেলো সে।
ছেলেদের কাঁদতে নেই।চোখের পানি প্রকাশ করতে নেই।

চলবে….

#আয়ুর_প্রহর
#পর্ব_২৬
#আয়িশ_নুর_তৃষ্ণা
____
মৃদু বাতাস বইছে চারদিকে।শীতল,মনোমুগ্ধকর হাওয়া।প্রণয় ফিরে এলো দু কাপ চা নিয়ে।
এক কাপ অনীতাকে দিলো।আরেক কাপ নিজের হাতে নিয়ে গরম চায়ে ফুঁ দিয়ে চুমুক দিতে লাগলো প্রণয়।

প্রণয় চা ফুঁ দিয়ে খাচ্ছে ভেবে অনীতা ভেবেছিলো তার চা ও হয়তো খুব গরম।অনীতা গরম চা খেতে পারে না।সে খায় ঠান্ডা চা।একেক মানুষের একেক রুচি।

তাই সে তার উড়না চায়ের কাপের নিচ দিক দিয়ে পেঁচিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ফুঁ দিতে লাগলো।

প্রণয় চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছে মাত্র,তখনই দেখে অনীতা তার চায়ের কাপে অনবরত ফুঁ দিয়েই যাচ্ছে।
এটা দেখে প্রণয় হেসে ফেললো।প্রণয়ের হাসির আওয়াজ শুনে অনীতা বোকা বোকা চোখে প্রণয়ের দিকে তাকালো।অনীতার চাহনি দেখে প্রণয় তাকে বললো,
-—“ চা-য়ে অতোবার ফুঁ দিতে হবে না অনী।তোমার চা ঠান্ডাই আছে।”

প্রণয়ের কথা শুনে অনীতা চায়ের কাপে পেঁচিয়ে রাখা উড়না সরিয়ে আলগোছে কাপের নিচের দিকটায় হাত রাখলো।তাই তো,চা গরম থাকলে চায়ের কাপ ও তো গরমই থাকবে। কিন্তু এটা তো ঠান্ডা!

আরেকটু ভালো করে পরখ করার জন্য অনীতা তাড়াহুড়ো করে চায়ের কাপে চুমুক দিলো।আরে!চা তো সত্যিই ঠান্ডা!মনে মনে একবার প্রণয়কে শুকরিয়া জানালো অনীতা।

দু চুমুক দিয়ে প্রণয়কে জিজ্ঞেস করলো,
-—“ আপনি কি করে জানলেন,আমি ঠান্ডা চা খাই?”

-—“ ম্যাজিক।” এক হাতে চায়ের কাপ মুখের কাছে এনে ,আরেক হাত প্যান্টের পকেটে রেখে বললো প্রণয়।

-—“ আরে,সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করেছি। কোত্থেকে জানলেন?কেউ তো জানে না আমি ঠান্ডা চা খাই!”

-—“ জেনেছি একদিন।”

-—“ ভনিতা না করে বলবেন?”

-—“ বললে কি দেবেন?”

-—“ কি চান?”

-—“ দিলে বলবো!দিবেন কিনা বলুন?”

-—“ অবশ্যই দিবো।আগে বলুন কিভাবে জানলেন”

-—“ আচ্ছা,যা আপনার আদেশ।তাহলে আগে বলছি।তারপর চাইবো।ওকে?”

-—“ ওকে।”

-—“ আমাদের পরিচয়ের পর আমরা কতোবার একসাথে চা পান করেছি মনে আছে?”

-—“ এটা মনে রাখার বিষয় হলো নাকি?ভার্সিটির প্রোগ্রামের জন্য হওয়া আড্ডায় অনেকবারই তো চা পান করা হয়েছে।”

-—“ তো?ওই সময়গুলোতেই..যতোবার আমরা চা-পান করেছি,প্রতিবার আমি খেয়াল করেছি।তোমার চা-পান করা হয় সবার শেষে।আমরা ফুঁ দিতে দিতে চা খেতাম।আর তুমি সব ফুঁ একসাথে দিয়ে চা ঠান্ডা করে খেতে।অনেকদিন নোটিশ করেছি।তাই খেয়াল আছে।”

-—“ আসলে চা আমার অতোটাও পছন্দ নয়।গরম চা তো নয়ই।কিন্তু সবার সাথে চা পান করাটা মিস করতে চাইতাম না।তাই ঠান্ডা করে খেতাম।চা ঠান্ডা হলে খেতে তাও ভালো লাগে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”

কৃতজ্ঞ নয়নে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞভরা হাসি দিলো অনীতা। এতোক্ষণে প্রেয়সীর হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখে নিমেষেই মন ভালো হয়ে গেলো প্রণয়ের।বিনিময়ে নিজেও একটা হাসি দিলো প্রণয়। চোখাচোখি হলো দু’জনের।

লজ্জায় অনীতা চোখ নামিয়ে চা খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। কিন্তু তখনি প্রণয়ের চোখ গেল অনীতার চোখের দিকে।চোখ কেমন ফুলে আছে।তাই সে অনীতাকে জিজ্ঞেস করলো,

-—“ অনী?”
অনীতা চোখ তুলে জবাব দিলো।
-—“ হুম।”
-—“ কিছু হয়েছে?”
-—“ না তো!”
-—“কোনো কারণে আপসেট তুমি?”
-—“ একদমই না।”
-—“ চাইলে বন্ধ শেয়ার ভেবে শেয়ার করতে পারো।”
-—“ না তো কিছুই হয়নি আমার।কিন্তু হঠাৎ এমন প্রশ্ন?”

ততক্ষণে প্রণয়ের চা পান করা শেষ। চায়ের কাপটা পাশে একটা উঁচু জায়গায় রেখে দু হাত বুকে গুজে সে অনীতাকে জিজ্ঞেস করে,
-—“তাহলে আমি এখান থেকে চলে যাওয়ার পর কেঁদেছিলে কেন?”
আকস্মিক এমন প্রশ্নে অনীতা চুপ হয়ে যায়।সে কিছুই বলতে পারে না।
প্রণয় ফের জিজ্ঞেস করে,
-—“ কেঁদেছিলে কেন? বলো।”
এবার অনীতা স্বাভাবিক হয়।বলে
-—“ আমি কেঁদেছি, আপনি দেখছেন?আমাকে কাঁদতে দেখেছেন?”
-—“ তোমার চোখগুলো ফোলা ফোলা অনী।”
-—“ এটা এমনিই।তেমন কিছু না।”
বলেই অনীতা নিজের খালি চায়ের কাপটা প্রণয়ের রেখে দেওয়া চায়ের কাপের পাশে রাখে।

দু জোড়া চোখ তাদের সম্মুখ পানে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই প্রণয় কি মনে করে অনীতার দিকে তাকালো।অনীতার কপাল,নাক,চোখ পরখ করলো।এই ক’দিনেই অনেকখানি শুকিয়ে গিয়েছে মেয়েটা।দেখলেই মনে হয় অসুস্থ অসুস্থ। কিন্তু নিজেকে অসুস্থ তকমা দিতে অনীতা নারাজ।

প্রণয় চকিত নয়নে অনীতার দিকে তাকিয়ে আছে।হুট করেই বললো,
-—“ এতো শুকিয়ে যাচ্ছো যে?কেমন লাগছে!”
-—“ কেমন লাগছে?”

-—“ বললে তো মানবে না।মুখটা গম্ভীর করে বলবে ‘ না,আমি ঠিক আছি’।”

শেষোক্ত কথায় অনীতাকে একটু নকল করলো প্রণয়।
প্রণয়ের কথার ভঙ্গি দেখে অনীতা একটু জোরে হেসে ফেললো।
প্রেয়সীর মনকাড়া হাসির ঝংকার লক্ষ্য করে তার দিকে তাকিয়ে রইলো প্রণয়।খানিক বাদে সব নিরব।নিরবতার মাঝেই ফট করে বলে উঠলো প্রণয়,

-—“ তোমার হাসিটা খুব সুন্দর অনী!”

আকস্মিক প্রণয়ের এমন কথাতে অনীতা খানিকটা লজ্জা পায়।পরক্ষণেই লজ্জা কাটিয়ে শান্ত ভাব বইয়ে নিয়ে আসে নিজের মাঝে।প্রণয়ের কথার প্রত্যুত্তরে বলে,
-—“ যদি এ হাসিটা অকালে হারিয়ে যায়,তবে কেমন হবে বলুন তো?”

-—“ এসব কি কথা অনী? এমন বাজে বকো না।”

-—“ সত্যি বলছি।বলুন না কেমন হবে এই হাসি হারালে?”

-—“ আমার ঠোঁটের কোণের হাসি চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে।”

কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা।অনীতার চোখের কোণে জমা হয় খানিকটা অশ্রু।সে অন্যদিকে ফিরে চোখের পানি মুছে নেয়।আর প্রণয় বুকে হাত গুঁজে সামনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকে।

খানিক বাদে প্রণয় সোজা হয়ে ব্রিজের রেলিংয়ের উপর দুই হাত রেখে ব্রিজের সামনে বয়ে চলা নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে।পাশে ঠিক একইভাবে রেলিংয়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ও তাকিয়ে থাকে অনীতাও।

কিছু সময় পেরোয়। সবকিছু নীরব,চারদিক নিস্তব্ধ। হঠাৎ প্রণয় বলে উঠে,

-—“ একটা জিনিস চাইবো বলেছিলাম।দিবে?”

-—“ বলুন কি চান।”

-—“ তোমাকে একবার ছুঁতে চাই অনী।তোমার হাতটা একটিবার স্পর্শ করতে চাই।হালাল ছোঁয়া কেমন হয় তা অনুভব করতে চাই।”

প্রণয়ের এমন আবদারে অনীতা কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকে।তারপর নিজের ব্যাগ কাঁধে ঝোলাতে ঝোলাতে বলে,
“ দেরী হয়ে গিয়েছে।বাসায় যেতে হবে।”

-—“ আমি এগিয়ে দিয়ে আসি।”

-—“ তার দরকার নেই।” কঠোর হয় অনীতা।

-—“ আর আমার কথা রাখবে না?”

অনীতা এবার প্রণয়ের একটু সামনে এগিয়ে দাঁড়ায়।প্রণয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,

-—“ আপনি আমার নিকট এমন অধিকার অবশ্যই পাওনা।এ অধিকার থেকে আপনাকে বঞ্চিত আমি করবো না।তবে এখন নয়।সময় আসুক।
এখন…আমি অনীতা,আজ এই ব্রিজকে,নদীর পানিকে সাক্ষী রেখে বললাম,আপনি আমাকে নিশ্চয়ই ছুঁতে পারবেন।একবার হলেও।আমি সে অঙ্গীকার আজ করলাম।এ কথার খেলাফ কখনোই হবে না ইন শা আল্লাহ।”

-—“ অনী!”

অনীতা মুচকি হাসির ভান করে।মুখে বলে,

-—“ আল্লাহ আপনাকে সবসময় ভালো রাখুক।আপনার মঙ্গল কামনা করি।”

-—“ সত্যিই আমার মঙ্গল কামনা করো?”

-—“ মিথ্যে বলিনি।”

-—“ তাহলে সারাজীবন আমার কাছে থেকে,পাশে থেকে যাও না অনী!আমার মঙ্গল এতেই!”

-—“ বান্দার মঙ্গল কিসে নিহিত আছে তা একমাত্র আমাদের স্রষ্টাই ভালো জানেন!”

-—“ হ্যাঁ! কিন্তু আমি আমার জীবনের মঙ্গল হিসেবে তোমাকে চাই।”

-—“ চলি।”

-—“ এতোটা কঠোর কেন হচ্ছো অনী?আমাদের পরিণয় কি এভাবেই মাঝরাস্তায় আটকে থাকবে?এমন কেন করছো?”

-—“ আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না গেলাম। আসসালামু য়ালাইকুম।”
-—“ কমপক্ষে এগিয়ে দিয়ে আসতে দাও।চারপাশ হায়েনায় ভর্তি।”

প্রণয়ের কথা শুনে আড়ালে মুচকি হাসে অনীতা।মানুষটা এতো যত্নবান। কিন্তু তাও সে প্রণয়ের কাছে থাকতে পারছে না।
সৃষ্টিকর্তা যদি এই ভালো মানুষটার সাথে তাকে এক জনম কাটানোর সুযোগ দিতো! নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনীতা!
মুখে বলে,
-—“ তবে চলুন। কিন্তু শর্ত হলো..

-—“ কি শর্ত?”

-—“ রাস্তায় আর একটা কথাও নয়।”

মাথা কাত করে সম্মতি জানায় প্রণয়।কথা না হোক,তবুও তো প্রেয়সীর সাথে আরো কিছুক্ষণ সময় কাটাতে পারবে সে।এতেই ভালোলাগা!
___

তারপর কেটে গেল কিছু মাস। আয়ুশ আর প্রণয়ের অনীতার সাথে যোগাযোগ না হওয়ার ২ মাস ২৯ দিন হলো আজ।

ওইদিন প্রণয়ের সাথে দেখা করার পরদিনই অনীতা চলে যায় লন্ডনে,তার মামার কাছে।

অনীতা যেহেতু এর আগেও মা-বাবার সাথে লন্ডন গিয়েছে।তাই তার যাওয়ার সময় কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি।

আগে থেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে ভিসার সব কাগজ ঠিক করে রেখেছিলো অনীতা।তার চলে যাওয়ার বিষয়টা আয়ু্শের কাছেও গোপন রেখেছিলো অনীতা।নিজের খালামণিকেও যাওয়ার আগ পর্যন্ত জানায়নি। শুধু নিজের মামাকে বলে রেখেছিলো,সব ব্যাবস্থা করতে।কয়েকদিনের মধ্যে সে লন্ডন যাবে।

অনীতার কথানুযায়ী অনীতার মামা সবকিছু ঠিক করেন।এবং চলে যাওয়ার দিন ফ্লাইটের ৩ ঘন্টা আগে অনীতা আয়ুশের কাছে যায় এটা জানাতে যে সে ,লন্ডন চলে যাচ্ছে।

আয়ুশ অনীতার লন্ডনে যাওয়ার ব্যাপারটায় সম্পুর্ণ নাখোশ ছিল।প্রথমে আয়ুশ অনীতাকে লন্ডনে না যাওয়ার জন্য অনেক বুঝায় । কিন্তু অনীতা জেদ ধরে।সে যাবেই।

হঠাৎ কেন দেশের বাইরে বেড়াতে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে আয়ুশ অনীতাকে জিজ্ঞেস করলে কারণ হিসেবে অনীতা বাবা-মায়ের ব্যাপারটা দেখায়। কিন্তু আয়ু্শ বুঝে,কিছু একটা খটকা আছে। কিন্তু কি!তা ঠাহর করতে পারে না।

তারপর যখন সে জানতে পারে,অনীতা আরো আগে থেকেই তার মামার কাছে চলে যাওয়ার প্ল্যান করছে,তখন আয়ুশ খুব কষ্ট পায়।

তবুও সে অনীতাকে দেশে থেকে যেতে বললে অনীতা চোখে পানি নিয়ে ভাইকে বলে,
“ ওখানে আমি ভালো থাকবো ভাইয়া।”

প্রত্যুত্তরে আর কিছু বলতে পারে না আয়ুশ।তার বোনের ভালো থাকাই তার ভালো থাকা।বাধ্য হয়ে অনীতাকে যেতে দেয় সে।

লন্ডনে যাওয়ার পরপরই অনীতা আয়ুশ ব্যাতীত সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। আয়ুশের সাথেও খুব বেশি নয়,কথা হয়েছে মাত্র দুই বার।

এতোদিন প্রণয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার সকল পথ বন্ধ রেখেছিলো অনীতা।আজ হঠাৎই প্রণয়ের ফোনে অনীতার কল আসে।

প্রণয় ঘুমিয়ে ছিল।ফোনের রিংটোনে জেগে যায় সে।
বাইরের দেশের নাম্বার দেখে প্রণয়ের মনের মধ্যে শিহরণ হয়ে যায় । একটা ছেলে হয়েও সে প্রচন্ড আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে।এটা কি তার অনী?

কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন ধরে প্রণয়।ওপাশ থেকে ভেসে আসে অনীতার গলা,

“ আসসালামু য়ালাইকুম।আছেন?”
বহুদিন বাদে প্রেয়সীর কন্ঠস্বর শুনে শান্ত হয়ে যায় প্রণয়ের হৃদয়মনন।জবাব দিতে ভুলে যায় সে।ওপাশ থেকে আবার ভেসে আসে,
“ শুনছেন?আছেন আপনি?”

সম্বিত ফিরে আসে প্রণয়ের।জবাব দেয় সে,
“ ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ।কেমন আছো অনী?এতোদিন যোগাযোগ বন্ধ রেখেছিলে কেন?কতো চিন্তা করেছি জানো?”

অনীতাও যেন তার প্রিয় মানুষের কন্ঠ শোনার অপেক্ষায় ছিল।প্রিয় মানুষের মুখ থেকে একনাগাড়ে এমন প্রশ্ন শুনে বিমুর্ষ মুখে এক চিলতে হাসি ফুটায় মুখে।বলে,

-—“ আস্তে,আস্তে।একসাথে এতো প্রশ্ন করলে উত্তর দিবো কিভাবে?আমি ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন বলুন।”

-—“ এতো দিন কেমন ছিলাম জানি না।তবে ভীষণ ভালো আছি আজ।এই মুহূর্তে…!”

-—“ আচ্ছা।”

-—“ এতো দিন যোগাযোগ বন্ধ রেখেছিলে কেন অনী?”

-—“ মন চাইলো।”

-—“ মন চাইলো আর যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে।এটা কেমন ব্যাপার হয়ে যায় না অনী!” অভিমান ঝরে পড়ে প্রণয়ের কন্ঠে।

-—“ অবশ্যই।এটা খুব বিশ্রী একটা ব্যাপার।এবং তা আমি জানি!”

-—“ জানো তাহলে যোগাযোগ করলে না কেন!কতো চিন্তা হচ্ছিল জানো?”

-—“ আমি যোগাযোগ করলে চিন্তা করতেন বুঝি!? অবশ্যই করতেন না।তাই যোগাযোগ করিনি।আপনার মনে সারাক্ষণ যেন আমি থাকি,আপনার মস্তিষ্কে যেন সারাক্ষণ আমার চিন্তা থাকে,তাই যোগাযোগ করিনি।”

অনীতার কথা শুনে প্রণয় মৃদু হাসলো।
তারপর কিছুক্ষণ দুইজন চুপ।হুট করেই অনীতা বলে উঠলো,
-—“ একটা কথা বলার জন্য কল দিয়েছিলাম।”

-—“ শুধু একটা কথাই?”

-—“ আরে,জরুরী কথা।”

-—“ বলো।”

-—“ আগে বলুন রাখবেন।”

-—“ আগে বলো তো।”

-—“ রাখবেন?”

-—“ আচ্ছা।”

-—“ আমায় ক্ষমা করে দিতে হবে।”

-—“ ক্ষমা!কেন?” অবাক হয়ে বললো প্রণয়।

-—“ কারণ আমি অনেক অন্যায় করেছি আপনার সাথে।”

-—“ কি অন্যায় করেছো?আমি কিছু বুঝতে পারছি না অনী।”

-—“ আপনি আমার স্বামী হওয়ার পরেও,আপনার জন্য আমাকে স্পর্শ করা বৈধ হওয়ার পরও আমি আপনাকে স্বামীর মর্যাদা দেইনি।সবসময় আপনার থেকে দূরেই থেকে গিয়েছি।এটা অনুচিত ছিল। এইজন্য আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।ক্ষমা করবেন তো আমায়?”

-—“ আরে বোকা।এতে….” প্রণয় কিছু বলার আগেই তার মুখ থেকে কথা টেনে নেয় অনীতা।বলে,

-—“ আমি জানি,আপনার কাছে এসব কোনো অন্যায় বলে গণ্য হবে না। কিন্তু আমি অনুতাপী।আমি বুঝতে পেরেছি আমার অন্যায়।আমাকে ক্ষমা করে দিন প্লিজ।আমি জানি,আপনি বলবেন কিছু না।এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আপনার মুখ থেকে এসব শোনার চেয়ে আপনি আমাকে মন থেকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এটা জানলে আমি বেশি খুশি হবো।”

অনীতার কথা শুনে প্রণয় চুপ হয়ে যায়।অনীতা আবার বলে,“ ক্ষমা করবেন তো আমায়?”

প্রণয় চুপ করে থাকে।
“ কথা বলুন প্লিজ।আমায় ক্ষমা করেছেন?” অনীতা যেন ছটফট করতে থাকে।

এবার প্রণয় মুখ খুলে,বলে,“ ক্ষমা করলাম।”

হাঁফ ছাড়ে অনীতা।বলে “ নিশ্চিন্ত হলাম।”
ফোন কেটে যায়।দু দেশে দু’জন মানুষ একে অপরকে ভাবতে ভাবতে বুকে ফোন চেপে ঘুমিয়ে যায়।
____

সেইরাতের পর পরদিন সকালবেলায় প্রণয়ের ফোনে অনীতার ফোন নাম্বার থেকে কল আসে।ফোন রিসিভ করার পরপরই একজন পুরুষালী কন্ঠ শুনতে পায় প্রণয়।পুরুষটি স্পষ্ট বাংলা ভাষায় বলে,

-—“ তুমি প্রণয়?”

-—“ জি।আপনি কে?” অনীতার ফোন থেকে পুরুষালী কন্ঠস্বর শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে প্রণয়।

-—“ আমি অনীতার মামা।”

-—“ ও… আসসালামু য়ালাইকু মামা।ভালো আছেন?”

-—“ হ্যাঁ ভালো তুমি?”

-—“ আলহামদুলিল্লাহ।অনী কোথায় মামা?”

ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ আসে না। কিছুক্ষণ বাদে অনীতার মামা বলে উঠেন,

-—“ অনীতা ভীষণ অসুস্থ প্রণয়।ও এখন হাসপাতালে আছে। মৃত্যুশয্যায়।তোমাকে দেখতে চাইছে ও।”

-—“ কি হয়েছে অনীর?ও হাসপাতালে কেন?” হন্তদন্ত হয়ে উঠে প্রণয়।

-—“ অনীতা ক্যান্সার লাস্ট স্টেজে আছে।তার হাতে বেশি সময় নেই।এতোদিন সবার থেকে লুকিয়ে গেলেও কিছুদিন আগে আমি ধরে ফেলি।ও আর আমার থেকে লুকাতে পারেনি। কিন্তু আমি যখন জানতে পারলাম,তখন শুনলাম আর সময় নেই।”
কান্নাভেজা গলায় বলে অনীতার মামা।
প্রণয় স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে।তার কানে আর কোনো কথা ঢুকছে না।

অনীতার মামা আবার বলতে থাকেন,

-—“ ও আমাকে কিছুদিন আগে তোমার ব্যাপারে জানায়।আমি বলি গোটা বিষয়টা তোমাকে আর আয়ুশকে জানাতে । কিন্তু ও নিষেধ করার কারণে তোমাদের কিছু বলতে পারিনি, জানাতে পারিনি।
এখন অনীতা তোমাকে দেখতে চাইছে।অনীতা বলেছে, তোমার পাসপোর্ট সব ঠিক আছে।দূতাবাসে আমার পরিচিত লোক আছে।তাই আমি তোমার ভিসার ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি। তোমাকে যত দ্রুত আগামী কয়েকদিনের দিনের মধ্যেই ইমার্জেন্সি লন্ডনে আসতে হবে।কি হয় বলা যাচ্ছে না।”

প্রণয় এবারও কিছু বলে না।এবার অনীতার মামা বলেন,

-—“ রাখি।টেক কেয়ার প্রণয়। আল্লাহ হাফিজ।”
___

৫ দিন পর,

প্রণয় লন্ডনের বিমানবন্দরে পা রেখেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে আছে সে।দেখছে,তাকে নেওয়ার জন্য কেউ এলো কি না!

কিছুক্ষণ পর অনীতার মামার একজন লোক তাকে রিসিভ করতে এলেন।প্রণয় আগেই বলে রেখেছিলো, লন্ডন পৌঁছে আগে সে অনীতার সাথে দেখা করতে যাবে।কথানুযায়ী প্রণয় ওই লোকের সাথে সরাসরি হাসপাতালে গেলো।

হাসপাতালে গিয়ে সে দেখলো অনীতার কেবিনের সামনে অনীতার মামা বসে আছেন।যেহেতু লন্ডনে যাওয়ার আগে অনীতার মামার সাথে প্রণয়ের কথা হয়েছিলো।উনি নিজের আইডি দিয়ে প্রণয়ের সাথে কথা বলেছিলেন।প্রোফাইলে উনার নিজের ছবি থাকার কারণে প্রণয় সহজেই মিলিয়ে নেয়,এটাই অনীতার মামা।

অনীতার মামা একদৃষ্টে সামনে তাকিয়ে আছেন।প্রণয় উনাকে দেখামাত্রই প্রায় দৌড়ে যায় উনার কাছে।গিয়ে উনার পাশে বসে সালাম দিয়ে অনীতার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি নিশ্চুপ হয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ পরে অস্ফুট গলায় বলেন,
“ অনীতা আর নেই।”

তিনটি শব্দ দিয়ে গঠিত সোজাসাপ্টা একটা বাক্য ।অথচ প্রণয়ের তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।সে বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়।অনীতার মামা হাত দিয়ে অনীতার কেবিনের দিকে ইশারা করে দেখান।প্রণয় সাথে সাথে দৌড়ে অনীতার কাছে যায়।

অনীতার নিথর দেহ বেডে পড়ে আছে।মুখটা উজ্জল হয়ে আছে।কি যেন প্রশান্তি চোখেমুখে। কিন্তু চোখদুটো এখনো ফোলা।যেন একটু আগেও কেঁদেছে সে।কি জন্য কেঁদেছে?প্রণয়ের জন্য?

অনীতার নিথর হাতদুটো বেডের দু’পাশে পড়ে আছে।প্রণয় অতি যত্নে অনীতার নরম হাত দুটো উঠিয়ে নেয় নিজের হাতের মুঠোয়।আদুরে বাচ্চার মতো অনীতার হাতদুটো নিজের হাতে পুরে রাখে প্রণয়।চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নেয় সে।এরপর অনীতার হাত অনীতার পেটের উপর রেখে দেয়।তারপর একটা চাদর উঠিয়ে অনীতার গলা পর্যন্ত ঢেকে দেয়।

অনীতার আত্মা ছাড়া শরীরের সাথে সংযুক্ত মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে চায় প্রণয়। কিন্তু কি ভেবে থেমে যায়।গলা পর্যন্ত উঠিয়ে রাখা চাদরে টেনে মাথা পর্যন্ত ঢেকে দেয় সে। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সাদা চাদরে মোড়ানো মানুষটার দিকে।একপলক ও ফালায় না সে।

ওইদিনই অনীতার ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়।প্রণয় তাকে দেশে নিয়ে আসতে চাইলে অনীতার মামা বলেন,

“ মৃত্যুর আগে অনীতা আমায় অনেক কিছুই বলে গিয়েছিলো।অনীতা আর ওইদেশে ফিরতে চায়নি।ওখানে তার সমাধি হলে তার বাবা-মা কোনো একসময়ের জন্য তাকে দেখতে আসবে,তার কবর জিয়ারত করতে আসবে। কিন্তু সে ওটা চায় না।তার ভাই আয়ুশ প্রতিদিন তার কবরের পাশে গিয়ে চোখের পানি ফেলে কাঁদবে,সেটা সে চায় না।দেশে তার কবর দেওয়া হলে তার পুরুষ তার কবরের পাশে নিজের বসতি গড়বে এটা সে বিশ্বাস করতো।তাই সে ওদেশে সমাধিস্থ হতে চায়নি।সে এখানেই থাকতে চায়।সে এখানেই থাকবে। তাছাড়া ও এটাও বলে গিয়েছে,ওকে যেন বেশিক্ষণ বাইরে রাখা না হয়। তাড়াতাড়ি কবরস্থ করে ফেলা হয়!”

অনীতার মামার মুখে এমন কথা শোনার পরও প্রণয় অনীতাকে নিয়ে দেশে ফেরার জন্য আকুতি জানায়। কিন্তু অনীতার মামা স্পষ্ট বলে দেন,উনি অনীতাকে এখানেই তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করবেন।ওকে নিয়ে যেতে দিবেন না তিনি।

আয়ুশ একটা মিশনে থাকার কারণে তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি অনীতার মামা।আর প্রণয়ের যেহেতু লন্ডনের সিমকার্ড নেই তাই সেও প্রহরকে কল করে অনীহার বিষয়টি জানাতে পারেনি।

অনীতার মামার সঙ্গে আর বাক্যালাপ না করে অনীতাকে সেখানেই দাফন করতে সম্মত হয় প্রণয়।
জানাযাটা পড়ায় প্রণয় নিজেই।
___

১ মাস পর,
কেটে গিয়েছে ত্রিশ দিন।প্রণয় দেশে ফিরেছে সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে।দেশে ফিরেই সে বাসায় গেল না।সে গেল তার আর তার প্রেয়সীর স্মৃতিবিজড়িত একটা জায়গায়।ওই ব্রিজটায়…

ওইদিনের মতো আজও ধরণীতে সন্ধ্যা নেমেছে।প্রণয় কতোক্ষণ ব্রিজে একা একা হাঁটল,ঘুরোঘুরি করলো।

চারদিকে আঁধার নেমে আসার পর প্রণয় গিয়ে দাঁড়ালো ব্রিজের ওই জায়গায় যেখানে সে আর অনীতা ওইদিন দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলো।সে ওখানে গিয়ে দাঁড়াতেই তার কানে আসে কিছু শব্দ। আশেপাশে এক জায়গায় কনসার্ট হচ্ছে।সেখানে খালি গলায় কেউ গাইছে,

“কখনো ভাবিনি চলে যাবে তুমি,আমাকে এভাবে কাঁদিয়ে!

কখনো ভাবিনি ফিরে আসবে না আমার পৃথিবী রাঙিয়ে!

অনেক পথের পথিক আমি ক্লান্ত সর্বশেষ!
তোমার পথের ঠিকানা খুঁজে আমি আজ অবশেষ!
তুমি আমার প্রথম ও শেষ জীবনের ভালোবাসা!
তোমার মাঝে তাইতো আমার জীবনের যত আশা!”

প্রণয় আর শুনতে পারে না।কানে হাত চেপে ধরে সে। লাইনগুলো যে তার সাথে পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে,যা তার হৃদয়ের যন্ত্রণা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।সে কানে হাত চেপে অনীতার উদ্দেশ্য জোড়ে জোড়ে বলতে থাকে,

“ তুমি আমার হয়েও হয়নি!
আমি তোমায় খুঁজে পেয়েও পাইনি!
তুমি নেই তাই আজ বৃষ্টি নামেনি!
আমি তোমায় পেয়েও পাইনি!
”প্রণীতা” হতে পারতো নাম এক জোড়া!
কিন্তু তোমায় ধরতে গিয়েও তুমি থেকে গেলে অধরা!আমি তোমায় পেয়েও তোমায় পাইনি!
তুমি আমার হয়েও আমার হওনি!”

এতটুকু কথা বলে প্রণয় জোড়ে নিঃশ্বাস নেয়।এক দমকা নিঃশ্বাস মুখ দিয়ে বের করে।তারপর ওইদিন অনীতা রেলিংয়ের যে জায়গায় হাত রেখেছিলো,প্রণয় আজ ঠিক সে জায়গায় হাত রাখে। মনে মনে অনীতার অস্তিত্ব অনুভব করে অস্ফুট স্বরে একা একা কিছু কথা বলে প্রণয়,

“ তাকে আমি প্রথম যখন ছুঁয়েছিলাম,তখন সে ছিল নিষ্প্রাণ,জড় পদার্থের ন্যায় অসাড়।এবং সেটাই তাকে করা শেষ স্পর্শ!অথচ তাকে আমি মাত্র একবারই ছুঁয়েছিলাম।”

বলেই ঢুকরে কেঁদে উঠে প্রণয়।
একা একা কাঁদতে থাকে অনীতাকে মনে করে….!চিৎকার করে ধেয়ে আসা নোনাজলকে ধেয়ে আসতে দেয় নিরব সম্মতিতে…!

গল্প সম্পর্কিত আলোচনা করতে জয়েন হয়ে যান আমার ছোট্ট গ্রুপ তৃষ্ণা’র গল্প-প্রহর— এ ❤️

চলবে…