প্রিয়তমা
(A Third Gender’s story)
পর্ব—-০৩(শেষ পর্ব)
প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
সৌভিকের সিমরানকে নিয়ে অনেক বড়ো পরিকল্পনা।সে তিলে তিলে শেষ করে দিতে চায় সিমরানকে।আর সেই পথটা এতোটা আরো জটিল।সিমরানকে প্রথমে বিয়ের টোপ দিলো সৌভিক।সরল সহজ সিমরান ওর কথায় সহজেই ভুলে গেলো।এবার মোক্ষম অস্ত্রটা প্রয়োগ করার সময় এসে গেছে।সৌভিক সিমরানকে আবারো ডেকে পাঠালো।এরপর দুজনের ভেতরে কথা হয়।
—-দেখো সিমরান,আমার তোমাকে আরো কিছু বলার আছে।
—হ্যাঁ,বলো।তো এতো আমতা আমতা করছো কেন?
—না,আসলে একটু ভয় হচ্ছে আমার।যদি তুমি বিষয়টা অন্যভাবে নাও।
—-আরে বাবা,কিভাবে নেবো আর।তুমি বলো না।
—আমাকে ভুল বুঝবে না তো!
—না বুঝবো না বলো,
—দেখো আমাদের বিয়েটা তো ঘনিয়ে এসেছে খুব তাড়াতাড়ি।
—হ্যাঁ,তো।
—বিয়ের আগে আমাদের আরো একটা ছোট কাজ করার বাকি আছে।আমাদের মানে তোমার….
—আমার কি কাজ বাকি এখন,দেখো আমি কিন্তু তোমার কোনো কথা বুঝতে পারছি না।
—সিমরান আমি তোমাকে এইভাবে বিয়ে করতে পারবো না।সেটা সম্ভব নয় কিছুতেই।আমি চাই তুমি এই অবস্থা থেকে একজন মেয়ে হয়ে যাও…..
—-হোয়াট!!!কি বলছো কি তুমি এগুলো?মাথা ঠিক আছে তো তোমার?
—কেন ভুল কি বললাম।তোমাকে আমাদের বিয়ের আগে একটা অপারেশন করতে হবে।আমি বলতে চাইছি তুমি ট্রান্সজেন্ডার হয়ে যাও।একজন হিজড়া হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে ট্রান্সজেন্ডার হয়ে বেঁচে থাকা অনেক সম্মানের।তুমি নিজেও জানো না সমাজের মানুষ ঠিক কোন চোখে দেখে তোমাদের।একবার মেয়ে হয়ে দেখোই না সবার দৃষ্টিভঙ্গি কিভাবে বদলে যায়।
—তার মানে তুমি আমাকে অপারেশন করে নিজের জেন্ডার পরিবর্তন করতে বলছো?কিন্তু আমরা দুজন তো এভাবেও লাইফ লিড করতে পারি।তুমি ভালোবাসো না আমায়?
—আমি এতো কিছু জানি না।আমাকে বিয়ে করতে হলে এটা করতেই হবে তোমায় ব্যস।আর আমি যা বলছি আমাদের ভালোর জন্যই বলছি। এখানে আমার নিজের কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই।
সিমরান কিছুক্ষণ ভেবে যথেষ্ট দ্বিধাদ্বন্দের ভেতরে উত্তর দিলো-
—আচ্ছা,ঠিক আছে।আমি রাজি।তুমি যেমনটা চাইবে তাই হবে।কোনো আপত্তি নেই আমার।
—রিয়েলি……!!আমি জানতাম তুমি আমার কথা ফেলতে পারবে না।তাহলে আমরা দ্রুত অপারেশনের কাজটা সেরে ফেলি।কেমন।
—নিশ্চয়ই।
—Thank you so much সিমরান।তুমি বাঁচালে আমায়।
নিজের সিধান্ত মেনে নেয়ায় ভীষণ খুশি সৌভিক।অবশেষে সিমরানের অপারেশন হলো। সে একজন থার্ড জেন্ডার থেকে ট্রান্সজেন্ডারে রুপান্তরিত হলো।সৌভিকও নিজের কথা রাখলো।ডিসেম্বরের একুশ তারিখে ওদের দুজনের বিয়ে।অর্থাৎ আজ।
বিয়ের জন্য একটা কমিউনিটি সেন্টার রেন্ট নিয়েছে সৌভিক।সেখানেই বিয়ে হবে ওদের।সকল গেস্টরাও ইতিমধ্যে চলে এসেছে।বরবেশে হাজির হলো সৌভিক।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কনের দেখা নেই এখনো।সবাই এই নিয়ে
বেশ চিন্তিত।সৌভিক বার বার সিমরানকে ফোনে ট্রাই করছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না।এভাবে অনেকটা সময় কেটে যায়।একটু পরে বিয়ের আসলে একটা অপরিচিত ছেলে এসে ঢুকলো।তার হাতে একটা অডিও প্লেয়ার।ছেলেটা নিজেকে সিমরানের লোক হিসেবেই পরিচয় দিলো।
—কি ব্যপার,সিমরান তোমাকে পাঠিয়েছে শুধু। সে কোথায়।তার দেখা নেই কেন।
—সেই প্রশ্নের উত্তর আমি কিকরে দেবো।ম্যাম আপনাদের জন্য এই অডিও প্লেয়ার টা পাঠিয়েছেন।আমি এটা শুনিয়েই চলে যাবো।
—কিসের অডিও প্লেয়ার এটা।আর এখন এটা দিয়ে কি করবো আমরা?
—শুনলেই বুঝতে পারবেন।
—আচ্ছা প্লে করো।
ছেলেটা সৌভিকের নির্দেশ অনুসারে অডিও প্লেয়ার টা অন করলো।মূহুর্তেই তার ভেতর থেকে সিমরানের কন্ঠস্বর ভেসে আসলো।সৌভিক এবং সমস্ত গেস্ট মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো।
“আমি জানি এই মুহুর্তে তুমি আমার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছো।কখন আমি কনে সেজে আসবো।তোমার সাথে বিয়ে হবে আমার।কিন্তু আমি দুঃখিত সৌভিক।তোমায় বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।কি ভেবেছিলে, আত্মসম্মানবোধ শুধু তোমার একারই আছে, আমি হিজড়ে বলে আমার কোনো আত্মসম্মান বোধ নেই।যদি তাই ভেবে থাকো তবে বলবো ভুলের স্বর্গে বাস করছো তুমি।তুমি আমাকে কখনোই বিয়ে করে যোগ্য সম্মানটা দিতে পারবে না আমি জানি।তোমায় বিয়ে করতে পারি নি বলে আজ কোনো আক্ষেপও হচ্ছে না আমার।কারণ আমি জানি তুমি আমাকে কখনো ভালোই বাসোনি।যদি বাসতে আমায় ট্রান্সজেন্ডার হতে ইনসিস্ট করতে পারতে না।আসলে তুমি সিমরানকে ভালো বাসোনি কোনোদিন,তার চেহারাকে ভালোবেসেছো।তার শরীরকে নিজের চাহিদা পূরণের উৎস নির্বাচন করে রেখেছো এতোদিন।আর হ্যাঁ,তুমি এটা জেনে আরো অবাক হবে যে আমি কোনো অপারেশন করি নি।অপারেশন করে মেয়ে হয়নি।মিথ্যে বলেছিলাম তোমায়।তুমি আমার সত্ত্বাকে যেভাবে চূড়ান্ত অপমান করেছো,তাই আমিও ভাবলাম অপমানবোধ কেমন হয় তার কিছুটা হলেও তোমায় বুঝিয়ে দিতে।সেইকারণে এই বিয়ের মিথ্যে নাটক।যদি তাতে তোমার কোনো শিক্ষা হয়।কিন্তু সেই ব্যপারেও আমি যথেষ্ট সন্দিহান।
তোমায় আরো কিছু কিছু কথা বলে রাখি,যদি সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস থেকে থাকে।তিনি তার ইচ্ছে অনুসারে মানুষ সৃষ্টি করেছেন।আজকে আমি একজন থার্ড জেন্ডার আর তোমাদের ভাষায় হিজড়া।আমি কখনো নিজের সত্ত্বা নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগি না।আমার কাছে আমিই শ্রেষ্ঠ। সৃষ্টিকর্তা আমাকে যেভাবে সৃষ্টি করেছেন তাতেই আমার তৃপ্তি।আমি কিছুতেই তার নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারবো না।এটা পাপ,শুধু পাপই নয় মহাপাপ।
বলেছিলে না,লিঙ্গ পরিবর্তন না করলে তুমি বিয়ে করবে না আমায়।আরে তুমি কি বিয়ে করবে না আমায়,আমি নিজেই রিজেক্ট করছি তোমায়।এবার থেকে গোটা পৃথিবী জানবে সিমরান একজন থার্ড জেন্ডার।সে একজন হিজড়া।আর লুকিয়ে বাঁচা নয়।নিজের পরিচয় নিয়ে সগৌরবে মাথা উঁচু করে বাঁচবো আমি।আর বাকি জীবনটা সমাজে আমার মতো যারা আছে,যারা বেড়ে ওঠার আগেই তোমাদের তথাকথিত সমাজ থেকে বিতাড়িত করে দাও তাদের জন্য কাজ করবো।তোমার মতো একটা অমানুষের সাথে সংসার করার থেকে এটাই উত্তম আমার জন্য।ভালো থেকো।আগামী জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইলো “।
এরপর অডিও প্লেয়ার অফ হয়ে গেলো।বিয়ের আসরে উপস্থিত সবাই বাকরুদ্ধ।সৌভিককে চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।হয়তো এই জল অনুশোচনার,আত্ম উপলব্ধির।কিন্তু দূর্ভাগ্য এই দৃশ্য দেখার জন্য আজ সিমরান নেই।সৌভিককে ছেড়ে বহুদূরে আজ সে।
(সমাপ্ত)