বিচ্ছেদের অন্তরালে প্রেম এলো জীবনে পর্ব-০২

0
887

#বিচ্ছেদের অন্তরালে প্রেম এলো জীবনে
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী

অহনার কল্পনাতেও ছিলো না আজকের এমন একটি দিনের মুখোমুখি ওকে হতে হবে। তবে বাবা মারা যাবার পর থেকে বুঝেছে পৃথিবী কতোটা কঠিন। এই কঠিনের রুপ যে এতোটা ভয়ঙ্কর তা ওর জানা ছিলো না। অথচ বাবা মাকে নিয়ে ছিলো ওর সুখের জগত। সেই জগতের মধ্যমনি ছিলো ও। বাবা দুনিয়া থেকে চলে যাবার সাথে সাথে ওর সুখের জগতটা তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ে।
—-কি ব্যাপার অহনা শুধু শুধু কেন ঝামেলা করছেন? আপনার আইডি কার্ডটা দিয়ে রুমটা বুকিং দিতে বললাম না?
অহনা চমকে উঠলো। কি জানি আজ ওর ভাগ্যে কি লেখা রয়েছে কে জানে? ও একটু তেঁতে উঠে বলে,
—স্যার আপনার সাথে কারখানা ভিজিটে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু কোনো রিসোর্টের রুমে থাকার কথা তো ছিলো না।
আয়মান চৌধুরী অহনার একদম কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,
—এখানে কোনো রকম সিনক্রিয়েট করবেন না। কিছু বলার থাকলে রুমে এসে বলবেন। এর অন্যথা হলে আপনার সাথে কতটা খারাপ হতে পারে তা আপনার ধারণার বাইরে।
অহনার বুকের ভিতরটা শিউরে উঠলো। এক সপ্তাহ আগে এই অফিসটাতে জয়েন করেছে।আয়মান সাহেবের সাথে অ্যাসিটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে দুটো সেতু ভিজিটে আজ গাজীপুরে এসেছিলো। ভিজিট শেষ করে ফেরার পথে আয়মান চৌধুরী এই রিসোর্টটাতে গাড়িটা থামায়। উনি নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছিলেন। অহনা তখনও বুঝতে পারেনি এই শয়তানটার মনে এই কুবুদ্ধি ছিলো। ও অফিসে জয়েন করার পর উনার সম্পর্কে কিছু নেগেটিভ কথা শুনেছিলো। উনার নাকি আলুর দোষ আছে। কিন্তু ওর বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়নি। কারণ উনি ভালেবেসে নিগার আপুকে বিয়ে করেছেন। আপু পাঁচমাসের প্রেগটেন্ট। এই আপুটাকে ও কখনও দেখেনি। কারণ নিগার আপু হচ্ছে ওর ভার্সিটির সিনিয়র সুজানা আপুর স্কুল ফ্রেন্ড। অহনার এই মুহুর্তে চাকরীর খুব প্রয়োজন ছিলো। সেটা সুজানা আপু জানতো। তাই অনরিকোয়েস্টে সুজানা আপু ওর জন্য এই চাকরীটার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সুজানার কাছেই অহনা শুনেছে নিগার আপু আর আয়মান চৌধুরীর প্রেম কাহিনী। অথচ আজ আয়মান চৌধুরীর এই চেহারা দেখে নিগার আপুর জন্য ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। হয়তো নিগার আপু জানে না তার স্বামীর দ্বিচারিতার কথা। না জেনেই মন প্রাণ দিয়ে পতিভক্তি করে যাচ্ছে। আর এই শয়তান লোকটা আপুর সাথে অবিরাম প্রতারণা করছে।
—–কি ব্যাপার আপনার কানে কথা যাচ্ছে না? আমার এখন বিশ্রামের খুব প্রয়োজন।
আয়মান চৌধুরীর বডিল্যাঙ্গুয়েজে রিসিপশনের মানুষগুলো অহনার দিকে কিভাবে যেন তাকাচ্ছে। হয়ত ওরা ভাবছে অহনা ওর রেট নিয়ে দর কষাকষি করছে।ভাবতেই অহনার শরীরটা কেমন গুলিয়ে উঠলো। না,আজ এখান থেকে মুক্ত হলে আর চাকরি করার চেষ্টা করবে না। এর থেকে টিউশনি করাই ভালো। এতে ওদের মা মেয়ের ভালোই চলবে। সাথে বাবার পেনশন বাবদ কিছু টাকা প্রতিমাসে ওর মা পায়।
অহনা একরকম বাধ্য হয়ে ওর আইডি কার্ড দিয়ে রুমটা বুকিং করে নেয়। এরপর আয়মান সাহেবের সাথে রুমের ভিতর চলে আসে। অহনার পা দুটো যেন চলতে চাইছে না। তারপরও জোর করেই নিজেকে টেনে নিয়ে আয়মান চৌধুরীর পিছু পিছু রুমের ভিতর প্রবেশ করলো। আয়মান চৌধুরী রুমের দরজা লক করে অহনার খুব কাছে এসে বললো,
—-আপনি কেন এই সহজ বিষয়টকে জটিল করে তুলছেন। কর্পোরেট সেক্টরে এগুলো খুব সাধারণ ব্যাপার। আজ যদি আপনি আমাকে সহযেগিতা করেন তাহলে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না জীবনের উপরে উঠার সিঁড়িতে আপনি কোন জায়গায় পৌঁছে যাবেন। অহনা ওর ঘাড়ের উপর আয়মান চৌধুরীর নিঃশ্বাসের গরম বাতাস উপলব্ধি করলো। ও স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। শয়তানটা অহনার কাছে কোনো রকম প্রশ্রয় না পেয়ে কিছু নোংরা কথা অহনার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে,
—-আপনার ডিভোর্স হয়েছে এক বছর হলো। বায়োলজিক্যাল নিডস থাকে তাই না? সেটাও পূরণ করে নিতে পারেন। আপনি দেখতে কিন্তু ভীষণ সেক্সি। পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা আকর্ষনীয় ফিগার গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। যে কোনো পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো রুপ আছে আপনার। তারপরও কেন যে আপনার স্বামী আপনাকে ডিভোর্স দিলো আমি বুঝে পেলাম না।
অহনার কান দুটো গরম হয়ে গেল। একবার মনে হলো লোকটার মুখ বরাবর একটা ঘুষি মেরে নাক মুখ ফাটিয়ে দিতে। কিন্তু মনে মনে অনেক কিছুই ভাবলো। তবে কিছুই করে উঠতে পারলো না। অহনার নিরবতায় শয়তানটা আবারো বলে,
—-আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। আজকের দিনটার জন্য আপনি যা চার্জ বসাবেন আমি আপনাকে তাই দিবো। প্রথম প্রথম অনেক মেয়ে নিজেকে সতীসাদ্ধী হিসাবে শো করে।কিন্তু পরে যখন অর্থ বিত্ত ক্ষমতা এসবের স্পর্শ পায় তখন নিজেকে হাজার পুরুষের বিছানায় বিকিয়ে দিতে দ্বিধা করে না।
এবার যেন অহনার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। সে আয়মান চৌধুরীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,
—-আমি এই মুহুর্ত থেকে আপনার অফিসের এমপ্লয়ি থেকে ইস্তফা দিলাম। আমার রেজিগনেশন লেটার আপনার মেইলে পাঠিয়ে দিবো।
একথা বলেই ঝড়ের গতিতে রুমের লক খুলে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় রিসিপশনের সমস্ত মানুষের দৃষ্টিগুলো ওর উপর নিবদ্ধ হলো। অহনার নিজের কাছে নিজেকে অনেক ছোটো আর অসম্মানিত মনে হতে লাগলো। ও রিসোর্ট থেকে বের হয়ে একটা উবার কল করলো। আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া জানালো। কতবড় বিপদ থেকে ও আজ রক্ষা পেয়েছে। হায়নার মুখের আহার থেকে নিজেকে ফিরিয়ে আনা এযে আল্লাহপাকের বিশাল রহমত। কিন্তু ওর নারীত্বের অপমানে ওর দুচোখ দিয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আচ্ছা আয়মানের মতো পুরুষরা নারীদেরকে শয্যাসঙ্গীনি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না কেন? ও তো সাস্ট থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে। ওর কাজের কোয়ালিটি আছে। তারপরও কেন ওকে নিয়ে এভাবে চিন্তা করবে? হা ওর আগের অফিসের বস মিতা আপা সম্পর্কে এরকম কথা শুনেছিলো। কেননা অফিসের এমডি যখনি দেশের বাইরে ট্যুরে যেতেন মিতা আপাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। উনারা দু’জন নাকি একই রুমে থাকতেন। অথচ মিতা আপার কি সুন্দর সাজানো গোছানো সুখের সংসার। একটা মাত্র ছেলে সন্তান। হাসব্যান্ডও করপোরেট সেক্টরে জব করে। ছেলেকে দেখাশোনার জন্য দেশ থেকে একজন বয়স্ক মহিলা এনে মিতা আপা নিজের বাসায় রেখেছেন। ফোনটা বেজে উঠলো। অহনা চোখের পানি মুছে মোবাইলের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখে ওর মা ফোন দিয়েছে। গলাটা স্বাভাবিক করে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ওর মা বলে,
—-কিরে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো তোর এখনও কোনো পাত্তা নাই। তুই না বললি আজ দুপুরের পরপর বাড়ি ফিরে আসবি।
কথা বলতে বলতে উবার চলে আসলো। অহনা উবারে উঠে ওর মাকে বললো,
—-আধ ঘন্টার মধ্যেই চলে আসছি।
—-তাড়াতাড়ি আয়। তোকে শায়লা আপার কথা বলেছিলাম না। তোর বড় খালার বান্ধবী। উনি আজ বাসায় এসেছেন। তোর সাথে দেখা করবে বলে অপেক্ষা করছেন।
—আসছি। জ্যাম না থাকলে গাজীপুর থেকে উত্তরায় হাফ এন আওয়ারের মধ্যেই পৌঁছে যাবো।
ফোনটা রেখেই অহনা ভাবছে, শায়লা আন্টির নাম ওর মায়ের মুখে অনেক শুনেছে। কখনও দেখা হয়নি। কিজানি কি মনে করে আজ ওদের বাসায় এসেছে?বড় খালা ওর বিয়ের চেষ্টা করছেন। কিন্তু ওর বিয়ে করার মোটেই ইচ্ছে নেই। ও আর কারো কাছে নতুন করে প্রতারিত হতে চায় না। যার সাথে বিয়ে হয়েছিলো সেও তার অফিসের কলিগের সাথে পরকীয়া করে প্রতারিত করেছে। অথচ ওর বাবা কতো ঘটা করে ওকে সোহানের সাথে বিয়ে দিয়েছিলো। প্রথম প্রথম সোহানের পরিবারের সবাই ওকে বেশ কেয়ার করতো। কিন্তু যখনি ওর বাবা মারা গেল সাথে সাথে ওর শ্বশুরবাড়ির পরিবেশ পাল্টে গেল।

চলবে