বিচ্ছেদের অন্তরালে প্রেম এলো জীবনে পর্ব-০৪

0
670

#বিচ্ছেদের অন্তরালে প্রেম এলো জীবনে
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী

অহনা ওয়াশরুমে গিয়ে বিয়ের বেনারশী শাড়ি চেঞ্জ করে একটা পাতলা সুতি শাড়ি পরে নিলো। শায়লা চৌধুরী এরুম থেকে যাবার সময় ক্লসেটের চাবি দিয়েছিলেন। অহনা গয়নাগুলো খুলে ক্লসেটে রেখে দিলো। এরমাঝে শেজাদ এসে ওকে ঘুমিয়ে পড়তে বলে রুম থেকে বের হয়ে যায়। অহনাও বেশ কিছুক্ষণ ওর জন্য অপেক্ষা করে ঘুমিয়ে পড়ে। সারাদিন বিয়ের ধকলে ও ভীষণ ক্লান্ত ছিলো। মাঝরাতে ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘরের ডিম লাইটের আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেলো শেজাদ এ ঘরে কোথাও নেই। তবে ফিসফিস করে কথা বলার আওয়াজ শুনতে পারছে। ও বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় উঁকি মেরে দেখে,
শেজাদ কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। তবে যার সাথে কথা বলছে সে যে শেজাদের খুব কাছের মানুষ তাতে কোনো সন্দেহ নাই। কারন শেজাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ সেটাই বলছে। অহনা বেশীক্ষণ ঐ জায়গায় দাঁড়ালো না। কারণ শেজাদ যদি দেখে ফেলে তাহলে ওকে ভুল বুঝতে পারে। সে কারণে ও এসে আবার আগের মতো বিছানায় শুয়ে পড়লো। দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে রাত দুটো বাজে। তবে অহনা ভীষণ অবাক হলো। শেজাদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে আজ যে ওর বাসর রাত ও যেন ভুলে গিয়েছে। নাকি একবার বাসর হয়েছে বলে ওর দ্বিতীয় বাসর করার আর ইচ্ছে নাই। পায়ের আওয়াজ শুনতে পায়। মনে হয় শেজাদ আসছে। অহনা চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করে বিছানায় পড়ে থাকে। শেজাদ রুমে এসে উঁকি দিয়ে অহনার মুখের দিকে তাকিয়ে নেয়। ঘুমিয়েছে কিনা হয়ত সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়। এরপর পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। শেজাদের এমন লুকোচুরি আচরনে অহনার মনের ভিতরে সন্দেহের উদ্রেক হয়।

খুব ভোরে অহনার ঘুম ভেঙ্গে যায়। পাশে শেজাদকে অঘোরে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে ওর মুখের দিকে অহনা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রয়। শেজাদ একটু নড়ে উঠতেই অহনা চোখ সরিয়ে নেয়। মনে মনে শেজাদের চেহারার প্রশংসা করে। এরপর সাবধানে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে এসে ফজরের নামাজ আদায় করে নেয়। এরমাঝে শেজাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। নামাজরত অবস্থায় অহনাকে দেখে শেজাদের ভীষণ ভালো লাগে। শেজাদও ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে এসে নামাজ আদায় করে নেয়। অহনা রুম থেকে বের হয়ে কিচেনে যায়। অহনাকে কিচেনে আসতে দেখে শাশুড়ী শায়লা চৌধুরী অহনাকে বলে,
—এতো সকালে উঠে এলে কেন? তুমি বরং উপরে তোমার ঘরে যাও। কুলসুম তোমাদের ঘরে সকালের চা,টা দিয়ে আসবে। শেজাদ কি উঠেছে?
—-হুম,
—-তুমিও উপরে চলে যাও।
অহনাও আর কোনো কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে চলে আসে। এ বাড়িতে মানুষ চারজন আর কাজের সহযোগী তিনজন। এখানে আসলেই অহনার কিছু করার নেই। অহনা মধ্যবিত্ত ঘরে বেড়ে উঠা মানুষ। ছোটোবেলা থেকে এ অবদি ওদের ঘরে কখনও ফুলটাইম কাজের অ্যাসিসটেন্ট ছিলো না। সবসময় অস্থায়ী অ্যাসিসটেন্টের সহযোগিতা নিয়েছে। বুঝতে পারছে ওর শ্বশুরবাড়ী অনেক টাকাপয়সাওয়ালা। তাতো বোঝাই গিয়েছে। ওর শাশুড়ী ওর মাকে কোনো খরচ করতে দেয়নি। বিয়ের সব খরচ নিজেই করেছে। অহনা নিজের ঘরে এসে দেখে শেজাদ মোবাইলে কারো সাথে চ্যাট করছে। অহনাকে দেখে মোবাইলটা বন্ধ করে জিজ্ঞাসা করে,
—-রাতে ঘুম ঠিকমত হয়েছে?
অহনা আস্তে করে জবাব দেয়,
—-হুম,
—-আমার আবার বিছানা চেঞ্জ হলে ঘুম আসে না।
অহনা কি বলবে বুঝে পায় না। এমন সময় কে যেন দরজা নক করে। অহনা বিছানা থেকে উঠে দরজাটা খুলে দেয়।কাজের অ্যাসিসটেন্ট কুলসুম রুমে চা বিস্কুট দিয়ে বলে,
—-আধ ঘন্টার পর খালাম্মা আপনাদের নীচে যাইতে কইছে।
একথা বলে ও চলে যায়। কুলসুম চলে যাবার পর অহনা আর শেজাদও চায়ের পর্ব শেষ করে নীচে চলে যায়। শেজাদ নাস্তা করে তড়িঘড়ি করে বাইরে চলে যায়। আশরাফ চৌধুরীও নাস্তা শেষ করে নিজের স্টাডি রুমে চলে যায়। শায়লা চৌধুরী অহনাকে নিজের রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিতে বলে। অহনা নিজের রুমে এসে মায়ের সাথে কথা সেরে নেয়। আসলে মায়ের শরীরটা নিয়ে ওর খুব চিন্তা হয়।
সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর পেরিয়ে সন্ধা হয় শেজাদ বাড়ী ফিরে আসে না। শায়লা চৌধুরী ছেলের মোবাইলে ফোন দেয়। কিন্তু শেজাদ ফোন রিসিভ করে না। অহনাও শায়লা চৌধুরীর কাছে নাম্বার নিয়ে শেজাদকে ফোন দেয়। অপরিচিত নাম্বার দেখে শেজাদ ফোন রিসিভ করে। অহনা নিজের পরিচয় দিতেই শেজাদ গম্ভীর হয়ে বলে,
—-তুমি আমাকে কখনও ফোন দিবে না। প্রয়োজন হলে আমি তোমাকে ফোন দিবো। আর সময় হলে বাড়ী ফিরে আসবো। এটা নিয়ে তোমাকে কোনো প্যারা নিতে হবে না।
ফোনটা রাখার সাথে সাথে অহনার চোখটা আদ্র হয়ে উঠে। কাল ওর বিয়ে হয়েছে অথচ শেজাদ আজ ওর সাথে এতো কঠিনভাবে কথা বলতে কিভাবে পারলো। শেজাদ তো ওর দিকে এখনও ভালো করে তাকিয়ে দেখেনি।
রাত এগারোটার সময় কলিং বেল বাজলো। ঘরের অ্যাসিসট্যান্ট গিয়ে দরজা খুলে দেয়। শেজাদ ঘরে ঢুকতেই শায়লা চৌধুরী জিজ্ঞাসা করে,
—-সারাদিন তুই কোথায় ছিলি?
—-নেহারের বাসায়,
—-ওর সাথে তো সব সম্পর্ক চুকে গেছে।
—-তোমার সাথে গিয়েছে কিন্তু আমি ওকে এখনও ভুলতে পারছি না।
—-সেটাতো বললে হবে না। বিয়ে তো কোনো ছেলেখেলা নয়।
—-আম্মু ও হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। সে কারনে আমাকে যেতে হয়েছে।
—-তুমি তো ডাক্তার নও যে রোগ সারিয়ে তুলবে।
—-তোমার সাথে এবিষয় নিয়ে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
শায়লা চৌধুরী রেগে গিয়ে বললেন,
—-তাহলে তুমি বিয়েতে মত দিলে কেন? শুধু শুধু এই মেয়েটার জীবন নষ্ট করার অধিকার তোমায় কে দিয়েছে?
—ওর জীবন কোথায় নষ্ট হলো? আমি তো ওকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলেছি।
একথা বলে শেজাদ মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
নিজের রুম থেকে অহনা ওদের মা ছেলের সব কথাই শুনতে পেলো। চোখের পানিকে আর আটকে রাখতে পারলো না। শেজাদের পায়ের আওয়াজ পেয়ে ও ওয়াশরুমে চলে যায়। কলটা ছেড়ে দিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো অহনা কেঁদে নেয়। শেজাদ ঘরে ঢুকেই বিছানায় শুয়ে পড়ে। অহনা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে শেজাদকে ডিনার করার কথা বলে। শেজাদ ওকে বলে,
—-আমি খেয়ে এসেছি। লাইটটা অফ করে দাও। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।
অহনা লাইট অফ করে বারান্দায় এসে বসে। নিজের ভাগ্যের উপর ওর খুব রাগ হলো। সোহানও ওর সাথে যে কাজ করলো শেজাদও একই কাজ করছে। সবার তকদিরে সবসুখ ধরা দেয় না কিংবা সবার জীবন একই সরলরেখায় চলে না। আকাশে আজ বড় থালার মত চাঁদ উঠেছে। মনে হলো পূর্ণিমা। কখনও কখনও চাঁদের উজ্জ্বল আলোটা কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে। কুয়াশা সরে গেলে আবার ঝকঝকে চাঁদের আলো উছলে পড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে অহনার মনে হচ্ছে ওর জীবনের কুয়াশা কেটে গিয়ে কবে এভাবে উজ্জ্বল আলো ছড়াবে। এমন সময় শেজাদ এসে বলে,
—-এভাবে শীতের রাত্রিতে বাইরে বসে আছো কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে তো?
শেজাদের কথা শুনে ওর প্রচন্ড রাগ হলো। মনে মনে বললো,আমার ঠান্ডা লাগলে আপনার কি? কিন্তু বলতে পারলো না। কারণ সব কথা সব জায়গায় বলা যায় না। অহনা এসে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়লো। শেজাদ এসে খাটে হেলান দিয়ে বসলো। এরপর ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
—-আমি তো বাইরে থেকে ডিনার করে এসেছি। তুমি খাওনি কেন?
—-আমার খিদে নেই।
—-দেখো, এভাবে না খেয়ে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে নেই। তোমাকে এভাবেই এ বাড়িতে মানিয়ে নিতে হবে।

আসলেই অহনাকে এ বাড়িতে এভাবেই মানিয়ে নিতে হচ্ছে। অহনা ভালোই বুঝতে পারছে শেজাদ নেহারের সাথে এখনও সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। কিন্তু অহনার কিছু বলার নেই। কারণ শেজাদ অহনার মনের খোরাক না মেটালেও জাগতিক সব খোরাক মিটিয়ে দিচ্ছে। তবে ও ভালো আছে কি না আছে সেটা নিয়ে ওর কোনো মাথা ব্যথা নেই। দামী শাড়ি গয়না ঘরে দাস দাসী কোনো কিছুর অভাব রাখেনি। ওর মা এসব দেখে ভীষণ খুশী। মেয়ে তার রাজকপালী।
এরমাঝে ওর মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। চিকিৎসার পুরো খরচ শেজাদ বহন করছে। ওর শাশুড়ী শায়লা চৌধুরী ওর মায়ের দেখভাল করছে। ডাক্তার সন্দেহ করছে ক্যান্সার হয়েছে। না অহনা ওর মাকে বলতে পারেনি ওর তথাকথিত দাম্পত্যের কথা। কেননা ওর মা খুব কষ্ট পাবে। মায়ের সামনে সুখে থাকার অভিনয় করে চলছে প্রতিনিয়ত।

চলবে