#বিচ্ছেদের অন্তরালে প্রেম এলো জীবনে
পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী
অহনা নিজের জীবন দিয়ে এটুকু বুঝেছে গরীব হলে জীবনে অনেক অন্যায়কে মেনে নিতে হয়। যেমন ওকে নিতে হচ্ছে। তাছাড়া না নিয়ে ওর তো অন্য কোনো রাস্তা খোলা নেই। চাকরি করে দেখেছে অফিসের শিয়াল শকুনগুলো সুযোগ পেলেই ওর শরীরটাকে খুবলে খেতে চায়। তবে ওর ছেলেখেলা নামক বিয়েটাতে এসবের কোনো ঝামেলা নাই। তার খাওয়া পড়ার কোনো চিন্তা নাই। নিশ্চিত নিরাপত্তা আছে। বাহ্যিকদিক থেকে অহনাকে দেখলে মনে হবে, ও ভীষণ ভাগ্যবতী। রাজপুত্রের মতো স্বামী পেয়েছে শ্বশুরবাড়ীটাও আর্থিক স্বাচ্ছন্দে ভরপুর। কোনো খানে যেন কোনো কমতি নাই। সুখ যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। কিন্তু ওর রাত কেটে যায় নির্ঘুমে। বুকের ভিতর অপমানের কষ্টগুলো তড়পাতে থাকে। ওর পাশে শুয়ে এখন শেজাদ যখন নিহারের সাথে কথা বলে তখন ওর বুকের ভিতরটা কষ্টে ফেটে যায়। এতে অবশ্য অহনা খুব অবাক হয়। কেননা শেজাদের সাথে আদৌ ওর কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। তারপরও নিজের অধিকারবোধ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অহনা একদিন প্রতিবাদ করে বলেছিলো,
—-আপনি যদি নিহারকে ভুলতেই না পারবেন তাহলে আমাকে বিয়ে করলেন কেন?
—-নিহার আমাকে বলেছে তোমাকে বিয়ে করতে। তাই করেছি।
—-তাহলে ওকে ডিভোর্স দিলেন কেন? সেটাও কি নিহারের হুকুমে করেছেন?
—-হুম,
—- আপনি কি জানেন, ডিভোর্সের পর প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ রাখা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। কারণ ডিভোর্সের পর সে আপনার কাছে একজন পরনারী।
অহনার কথায় শেজাদ যেন বিরক্ত হলো। গম্ভীর হয়ে বেশ কঠিন স্বরে অহনাকে বললো,
—-তোমার কাছ থেকে আমার ধর্মীয় শিক্ষার তালিম নেওয়ার প্রয়োজন নাই। তুমি নিজের চরকায় ভালো করে তেল দাও। আমার হালাল হারাম নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তোমার কোনো দায়িত্ব তো আমি অবহেলা করিনি।
অহনা মুখে আর কিছু বলেনি। আর বলবেই বা কি করে? আত্মসম্মান বলে তো কিছু আছে। সেটাকে তো বিকিয়ে দেওয়া যায় না। ও গরীব হতে পারে কিন্তু ওর আত্মসম্মানটুকু অনেক ধনী।
এভাবেই অহনার দাম্পত্য জীবন চলতে থাকে। ওর মায়ের ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছে। কেমো দেওয়া হচ্ছে। আর দুটো কেমো দিলেই ওর মায়ের কেমো দেওয়া শেষ হবে। মায়ের সার্বক্ষনিক তদারকির জন্য শেজাদ একজন নার্স রেখে দিয়েছে। ওর মায়ের প্রতি ওর শ্বশুর শাশুড়ী আর শেজাদের যত্ন দেখে ও সব অন্যায় আচরণ ও মাথা পেতে নিয়েছে। বিয়ের ছ’মাস পেরিয়ে যাবার শেজাদ বহালতবিয়তে নেহারের সাথে সম্পর্ক রেখে চলেছে। শাশুড়ী কয়েকবার এই ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলো। কিন্তু ও কিছু জানায়নি। কেননা ওর ধারণা ওর শ্বশুর শাশুড়ী শেজাদের এই বিষয়টা নিয়ে জ্ঞাত আছে।
কিছুদিন আগে শেজাদ নেহারের সাথে সময় কাটিয়ে রাত বারোটায় বাড়ী ফিরেছিলো। সেদিন অহনার শরীরটা ভালো ছিলো না। শরীরের তাপমাত্রাটা একটু বেড়ে গিয়েছিলো। শাশুড়ী শায়লা চৌধুরী অবশ্য অহনার প্রতি শেজাদের অবহেলাটা লক্ষ্য করছিলেন। সেদিন একরকম জোর করেই অহনাকে দ্রুত রাতের খাবার খাইয়ে নাপা ট্যাবলেট খাইয়ে রুমে পাঠিয়ে দিয়ে বললেন,ও যেন দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে। নিজের রুমে এসে বিছানায় শরীরটাকে অহনা এলিয়ে দিলো। কিন্তু দুচোখে ঘুম আসছিলো না। আসলে শরীরের অসুখ তো ওষুধ দিয়ে সারানো যায়। কিন্তু মনের অসুখ তো ওষুধ দিয়ে সারানো যায় না। মনের অসুখ মন দিয়ে সুস্থ করতে হয়। চোখটা একটু লেগে এসেছিলো। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেঁচির শব্দে অহনার তন্দ্রা ছুটে যায়।ও কান খাড়া করে ড্রইং রুমের কথপোকথন শোনার চেষ্টা করছিলো। শায়লা চৌধুরী শেজাদকে বলছেন,
—-তুমি কি শুরু করেছো? নেহারের চ্যাপ্টার তো ক্লোজ হয়ে গিয়েছে। সেই সম্পর্ককে আবার নতুন করে পুনরুজ্জীবিত করছো কেন?
—-দুটো মানুষ একসাথে থাকলে ভুল বুঝাবুঝি হতে পারে। সেটা আবার মিটেও চায়। নেহারের সাথে আমার সব ভুল বুঝাবুঝি মিটে গিয়েছে।
শায়লা চৌধুরী রেগে গিয়ে বলছেন,
—-এসব তুমি কি বলছো? তুমি তাহলে বিয়ে করলে কেন?
—-নেহার বলেছে বলে ওকে বিয়ে করেছি। তাছাড়া ঐ মেয়েটাকে তো আমি ছেড়ে দিচ্ছি না। ওর সব দায়িত্ব তো আমি সঠিকভাবে পালন করছি।
শায়লা চৌধুরী তখন উনার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-খুব তো বড় ঘর থেকে ফ্রেস মেয়ে আনতে চেয়েছিলে। ও এতোদিন ধরে অহনার সাথে যা করেছে অন্য কোনো মেয়ে হলে কবেই ওকে ফেলে রেখে চলে যেতো। আর আমাদের সবার কোমরে দড়ি পরাতো।
শেজাদের কথাগুলো শুনে অহনার বুকের ভিতরটা ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়েছিলো। নিজেকে সেদিন বড্ড অপাংতেয় মনে হয়েছিলো। ও নেহারকে দেখেনি। অথচ ঐ মেয়েটা দয়ায় শেজাদ ওকে বিয়ে করেছে। এ কথা ভাবতেই নিজেকে অনেক ছোটো মনে হলো। একবার মনে হয়েছিলো এ বাড়ী থেকে ও চলে যাবে। কিন্তু কোথায় চলে যাবে। মাতো অসুস্থ। তার চিকিৎসার সমস্ত খরচ তো শেজাদ বহন করছে। অগত্যা ও এটা বুঝে নিয়েছে ওকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে। নিরবে নিভৃতে সব কষ্ট যন্ত্রণা হজম করে নিতে হবে।
ওর এক দূরসম্পর্কের এক জায়ের কাছে শুনেছিলো, নেহারকে ওর শ্বশুরশাশুড়ী খুব একটা পছন্দ করতো না। এমনকি শেজাদের আগের বিয়েটা ওরা মেনে নেয়নি।তবে আর একটা কথা বলেছে সেটা অবশ্য অহনার বিশ্বাস করতে মন চায়নি। ওর শ্বশুর শাশুড়ী নাকি নেহারের উপর অনেক টর্চার করতো। আজ ছ’মাসের উপরে হলো ওর শ্বশুর শাশুড়ী ওর সাথে কখনও খারাপ ব্যবহার করেনি। শ্বশুর সারাদিন স্টাডি রুমেই পড়ে থাকেন। শাশুড়ী মা সংসারের দেখাশোনা করেন। বলতেই হবে মানুষ হিসাবে উনারা খুবই ভদ্র।
ইদানিং ও খেয়াল করেছে শেজাদ এখন আর আগের মতো রাত করে বাড়ি ফিরে না। অহনার সাথে সময় কাটায়। একসাথে বারান্দায় বসে ওরা চা খায়। আজ অহনার মনটা ভীষণ খুশী। শেজাদ ওকে ফোন করে বলেছে,ও যেন রেডী হয়ে থাকে। ওকে নিয়ে বের হবে। অহনা আজ বাসন্তী কালারের শাড়ী পড়েছে। চোখে কাজল টেনেছে। ঠোঁটে হালকা রংয়ের লিপিস্টিক দিয়েছে। মুখে পাউডারের প্রলেপ লাগিয়েছে। আয়নায় বারবার অহনা নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। শেজাদ ঠিক পাঁচটার সময় আজ বাসায় ফিরে আসে। অহনাকে নিয়ে ধানমন্ডীর শেফ’স টেবিলে হাজির হয়। এরপর অহনাকে বলে,
—-কি খাবে বলো?
—-আপনি যা খাবেন আমিও তাই খাবো।
—-তারপরও তোমার নিজের কোনো পছন্দ নেই?
অহনা মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। শেজাদ নিজের জন্য সিফুড দিয়ে টমইয়াম সুপ অর্ডার করে। অহনার জন্য চিকেন সহ সুপ অর্ডার করে। সাথে চিকেন ফ্রাই ও অর্ডার করে। খাওয়া শেষ করে শেজাদ অহনার দিকে তাকিয়ে বলে,
—-এতোদিন তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি। তুমি এসব মনে রেখো না। এখন থেকে সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মে চলবে।
অহনা মনে মনে ভীষণ খুশী হয়। হয়তো ওর অপেক্ষার ফল আজ বড় মিষ্টি হবে। সেদিন শেজাদ ওকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়। অহনা ভাবে হয়তো নেহার উপর থেকে শেজাদের মন ফিরে এসেছে। শেজাদ ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। অহনা বলে,
—-এভাবে জড়িয়ে ধরলে আমার ঘুম আসবে না।
শেজাদ ওকে নিজের বুকের সাথে আরো নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে বলে,
—-এভাবে সারাজীবন তোমায় জড়িয়ে রাখবো।
এরপর শেজাদ অহনার সারা মুখে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দেয়। অহনাও মনে মনে বলে,
“আমিও আপনাকে খুব খুব বেশী ভালোবাসি। প্লিজ আপনি আমাকে কখনও একা করে দিবেন না। তাহলে যে আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো।”
অহনার মনে হতে লাগলো,এই রাত যেন কখনও শেষ না হয়। আজকের এই রাতের মুহুর্ত ওর কাছে জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মুহুর্ত। বিয়ের পর থেকে অহনা এরকম একটা রাতের অপেক্ষায় ছিলো। অহনার নিরবতা দেখে শেজাদ বলে,
—-তুমি কিছু বলছো নাযে?
—-আমাকে সারাজীবন আপনি আগলে রাখবেন তো?
—-যেদিন থেকে আমাদের বিয়ে হয়েছে সেদিন থেকেই আমি তোমার দায়িত্ব নিয়েছি। আমৃত্যু আমি এই দায়িত্ব পালন করে যাবো।
চলবে