#বিচ্ছেদের অন্তরালে প্রেম এলো জীবনে
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী
জীবনে প্রথম কাউকে একদম নিজের করে পাওয়ার আনন্দে অহনা বিভোর। নিজেকে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ভাবতে শুরু করেছে। ঘরে কাজের লোকের অভাব নেই তারপরও উদ্যেগী হয়ে শেজাদের জন্য ইউটিউব দেখে নিত্য নুতন রান্না করছে। শেজাদের একটুখানি প্রশংসাবাক্য শুনে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যাচ্ছে। বর্ষার নতুন পানিতে যেমন প্রকৃতি সজীব হয়ে উঠে অহনাও তেমনি শেজাদের ভালোবাসায় উৎফুল্ল হয়ে উঠছে। নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে শোবার ঘরখানা সুন্দর করে সাজিয়ে তুলছে। আড়ং থেকে জানালার পর্দা কিনছে সাথে ম্যাচ করে বেডকভার কিনে আনছে। দামী ফ্লাওয়ার ভাস কিনে ঘরের কোনায় সাজিয়ে রাখছে। শাশুড়ী শায়লা চৌধুরীও ভীষণ খুশী। ছেলে আর বৌমার ঘরে বসন্তের সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। হয়তো খুব শীঘ্রই নাতিনাতনির মুখ দেখবেন বলে অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলেন।
অহনা বরাবর ভালোবাসার কাঙ্গাল। সে কারণে শেজাদের আদর ভালোবাসা পেয়ে নিজেও উজার করে শেজাদকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। প্রথম বিয়েতে স্বামীর দ্বিচারিতা ওর জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছিলো। ভেবেছিলো এই অগোছালো জীবনটা ও হয়তো আর কোনোদিন সাজাতে পারবে না। মুরুব্বিরা বলেন,অপেক্ষার ফল নাকি বড়ই মিষ্টি হয়। আজ ওর মনে হতে লাগলো আসলেই অপেক্ষার ফল খুবই মিষ্টি। শেজাদের ভালোবাসা ওর জীবনটাকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। সুখ স্বপ্নে বিভোর হয়ে জীবনের সময়গুলো পার হয়ে গেল। বিবাহিত জীবনের আটমাস সময় অতিবাহিত হতে চললো। শেজাদ আজ অফিস থেকে ফিরে অহনাকে বললো,
—-তাড়াতাড়ি রেডী হয়ে নাও। তোমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো।
অহনা বুঝে পেলো না শেজাদ হঠাৎ কেন ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইছে। ওর তো শরীর খারাপ করেনি। সে কারণে শেজাদকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-আমার তো কোনো অসুখ হয়নি,তাহলে ডাক্তারের কাছে কেন যাবো?
—-পরীক্ষা করাতে যাবো।
অহনা একটু অবাক হয়ে বললো,
—-কিসের পরীক্ষা করাবেন?
—তোমার এ মাসেও পিরিয়ড হয়ে গেল। কনসিভ করলে নাতো?
—-আপনি কিভাবে বুঝলেন আমার পিরিয়ড হয়েছে?
—-গত দু’দিন ধরে তুমি তো নামাজ পড়ছো না।
অহনা সত্যি ভীষণ অবাক হলো। এই মানুষটা তার পিরিয়ডের দিন তারিখ মনে রেখেছে। শেজাদ ওকে নিরব থাকতে দেখে বললো,
—-গাইনী ডাক্তারের কাছে যাবো। তোমার কোনো সমস্যা আছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাই।
একথা শুনে অহনা খুব বিরক্তবোধ করলো। নিজের বিরক্তিভাব চেপে রেখে শেজাদকে বললো,
—-আপনি পরীক্ষা করিয়েছেন?
—-হুম,গতমাসে করিয়েছি।
—-আমার টেস্ট করাতে হবে না।
—-কেন?
—-আমি পিল খেয়েছিলাম।
—-তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা না করে পিল খেলে কেন?
—-আপনি তো আমাকে বলেননি যে এই মুহুর্তে আপনি সন্তান চান। সে কারণেই খেয়েছিলাম। এখন যখন মনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তখন আর খাবো না।
এর পরের মাসেই অহনার পিরিয়ড হলো না। পিরিয়ডের সময় একসপ্তাহ পার হয়ে যাবার পর ফার্মেসী থেকে একটা প্রেগনেন্সি কিড কিনে আনলো। কিন্তু সেদিন আর টেস্ট করা গেল না। নিয়ম অনুযায়ী সকালের ইউরিনে কিডটা ডোবাতে হবে। সে রাতে টেনশনে অহনার দুচোখে ঘুম আসছিলো না। খুব ভোরে অহনা কিডটা নিয়ে বাথরুমে গিয়ে ইউরিনে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখলো। সাথে সাথে স্ট্রীপে পাশাপাশি দুটে লাল রংয়ের রেখা জ্বলজ্বল করতে লাগলো। অহনার ভিতরটা ভালোলাগায় ভরে গেল। ও মা হতে চলেছে এটা ভাবতেই ও যেন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো। ঘরে এসে দেখে শেজাদ তখনও ঘুমোচ্ছে। উত্তেজনায় ও শেজাদকে ডেকে সুসংবাদ দিলো। শেজাদ ওকে কিছু না বলে বিছানা থেকে উঠে গায়ে একটা টিশার্ট জড়িয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। অহনা বুঝে পেলো না শেজাদ এই সাত সকালে কোথায় যাচ্ছে? বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর শেজাদ একটা রজনীগান্ধা স্ট্রিক সাথে পাঁচ কেজির মতো মিষ্টি কিনে বাড়ী ফিরে আসলো। শেজাদ যে এতো খুশী হবে এটা অহনার ধারণার বাইরে ছিলো। খুশীতে গদগদ হয়ে অহনা বললো,
—–আপনি খুব সন্তান বাৎসল মানুষ।
—-আমার তো এখন পর্যন্ত কোনো সন্তান হয়নি, তুমি কিভাবে বুঝলে আমি সন্তান বাৎসল।
—-না,মানে আমি কনসিভ করছি বলে আপনার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ দেখে তাই মনে হলো।
—-বিষয়টা আসলে তা নয়। বেবি হলে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বন্ধন সূদৃঢ় হয়।
কথাটা অহনার খুব একটা পছন্দ হলো না। কেননা স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বন্ধন সূদৃঢ় হওয়ার জন্য বাচ্চার কেন দরকার হবে? স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক মজবুত না হলে সন্তান নেওয়াই উচিত না। ও জানে না ওর ভবিতব্যে কি লেখা রয়েছে? ওর শ্বশুর শাশুড়ীও ভীষণ খুশী। ওরা এই দিনটার জন্য আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করেছে। অবশেষে আল্লাহপাকের রহমতে সুসংবাদ ঘরে আসলো।
তবে কনসিভ করার সাথে সাথে ওর প্রচন্ড বমি হতে লাগলো। কোনো কিছুই খেতে পারছিলো না। সে কারনে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে স্যালাইন দিতে হলো। একদিকে শাশুড়ী শায়লা চৌধুরী ওর প্রতি যথেস্ট খেয়াল রাখছে তেমনি অন্যদিকে শেজাদও অহনাকে প্রচুর সময় দিচ্ছে। অহনা ভাবছে শেজাদ এখন পুরোপুরি ওর হয়ে গিয়েছে। ঘরে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ ওকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। ইদানিং শেজাদকে নিহারের সাথে ফোনো কথা বলতে দেখে না। তবে অফিসে থাকাকালীন বলে কিনা সেটা তো ওর পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
দিনগুলো ভালোই চলছিলো। ছ’মাস সময় পার হয়ে গেল। আজ সন্ধায় অহনাকে নিয়ে বিকাল পাঁচটার সময় শেজাদের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। অহনা রেডী হয়ে বসে আছে। শেজাদের বাড়ী আসার কোনো নামগন্ধ নেই। পাঁচটা পেরিয়ে ঘড়ির কাঁটা ছ’টার কাঁটা ছুঁতে চললো। অহনা এর মাঝে শেজাদকে কয়েকবার ফোন করেছে। কিন্তু মোবাইল সুইসস্টপ বলছে। অহনা বুঝে পেলো না শেজাদ কোথায় যেতে পারে। এই ছ’মাস তো ওকে নিহারের সাথে যোগাযোগ করতে দেখেনি। ওদিকে ওর শ্বশুর শাশুড়ীও চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। কেননা রাত বারোটা পার হয়ে গিয়েছে। কি করবে উনারাও বুঝে পাচ্ছেন না। সবাই পুরোটা রাত খুব টেনশনে কাটালো। সবার প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে শেজাদ ভোর ছ’টায় বাড়ি ফিরে আসলো। কারো সাথে কোনো কথা না বলে রুমে এসে সোজা বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো। অহনা এসে জিজ্ঞাসা করলো,
—-সারাটা রাত আপনি কোথায় ছিলেন?বাড়ির মানুষগুলো যে আপনার জন্য চিন্তা করে সেদিকে আপনার খেয়াল আছে?
অহনার কথার উত্তর দেওয়ার শেজাদ কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করলো না। এতে ওর রাগ হলো। অহনা একটু ঝাঁঝ মেরে বললো,
—-আমাকে নিয়ে আপনার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিলো।
অবশেষে শেজাদ উত্তর দিলো।
—-আজ যাবো। তুমি বিকাল পাঁচটায় রেডী হয়ে থেকো।
—-আপনি সারা রাত কোথায় ছিলেন সে উত্তর কিন্তু আমি এখনও পাইনি।
—-উত্তরটা শুনতে তোমার ভালো লাগবে না তাই দিতে চাইছি না।
—-তারপরও আপনি বলুন,
—-নিহারের কাছে ছিলাম।
অহনার ধৈর্যের পারদ চরমে উঠলো। সে কারণে মেজাজ দেখিয়ে বললো,
—-আপনি যদি নিহারকে ভুলতে না পারেন তাহলে এতোদিন আমার সাথে অভিনয় করার দরকার ছিলো না। আর এভাবে আমাকে ঠকানোর কোনো অধিকার আপনার নেই।
শেজাদও গম্ভীর হয়ে বললো,
—-আমি তোমার সাথে অভিনয় করিনি। আর তোমাকে ঠকায়নি।
অহনা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—-আপনি একজন ভন্ড প্রতারক। আর ঐ মহিলাও নির্লজ্জ। একজন ডিভোর্সী মহিলা কি করে তার প্রাক্তন স্বামীর সাথে যোগাযোগ রাখে আমি বুঝে পাই না। এটা ধর্মীয় এবং সামাজিক ভাবে একটা অবৈধ সম্পর্ক।
—কোনটা বৈধ সম্পর্ক আর কোনটা অবৈধ সম্পর্ক সেটা আমার তোমার কাছে শিখতে হবে না। তবে কান খুলে শুনে রাখো নিহার স্বেচ্ছায় এ বাড়ি ছেড়ে গিয়েছে বলে তুমি আজ চৌধুরী বাড়ির বউ হতে পেরেছো। সুতরাং নিহারকে নির্লজ্জ্ব বলার আগে নিজের ওজনটা মেপে নিও।
শেজাদের কথাগুলো শুনে অহনার শরীরের হাড়গুলো যেন ব্যথায় মোঁচড়াতে লাগলো। ওর দম আটকে আসতে চাইলো। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ও আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে এক কাপড়ে চৌধুরী বাড়ী থেকে বের হয়ে আসলো। একটা উবার ডেকে নিজের মায়ের বাড়ীর পথে রওয়ানা দিলো। শেজাদ সম্পর্কে কি ভাবলো আর আজ ওকে কি অবস্থার মুখোমুখি হতে হলো। মানুষের স্বভাব যে গিরগিটির মতো হতে পারে সেটা শেজাদকে না দেখলে ওর জানা হতো না।
চলবে