যে শ্রাবণে প্রেম আসে
তোনিমা খান
অন্তিম পর্বঃপ্রথমাংশ
নতুন প্রারাম্ভ অস্বাভাবিক রকমের আশ্চর্যজনক, সুখময় হয় দূর্ভাগা ইরার জন্য। এই যে সৃষ্টিকর্তা এতোটুকু তাকে দিয়েছে, তাতে সে পেছনের সব ক্লেশ ভুলে গিয়েছে নিমিষেই। স্বল্প চাহিদার মানুষ হওয়ায় এই পৃথিবীতে ইরার জন্য বেঁচে থাকা বেশ সহজ। স্বল্প চাহিদার মেয়েটি যখন চাহিদার উর্ধ্বে কিছু পেয়ে যায় তখন সেই অনুভূতি হয় অবর্ণনীয়। প্রভাতের শুরুটা ছিল কারোর আদরমাখা স্পর্শের সাথে। মুখশ্রীতে লাগাতার ছুঁয়ে যাওয়া পুরুষালী ওষ্ঠের স্পর্শে ঘুম জড়ানো চোখে ইরা লাজুক হেসে মুখ লুকায় বালিশে। সেই লাজের মাত্রা ছাড়িয়েই দম নিলো শ্রেয়ান। প্রভাতের শুরুটা এমনি সুখকর ছিল।
সকল আটটা। হোয়াইট বোর্ডের সামনে শ্রেয়ানের বাহুডোরে থাকা মেয়েটির, মলিনতা গাঢ় হয় বোর্ডটিতে সদ্য লেখা প্রশ্নটি দেখে।
–“গায়ে হাত তুলতো কেনো?”
প্রশ্নের জবাবের অপেক্ষায় অপেক্ষারত মানবটি কাঁধ থেকে থুতনি তুললো। বিগত জীবনের সব কথা নির্দ্বিধায় জানালেও এখানে খানিক আঁটকে গেলো কেনো? মেয়েটির মুখপানে তাকালে বড্ডো উদাসীনতা নজরবন্দী হয়। তবুও তার প্রশ্নের জবাব চাই। ইরা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে লিখলো,
–“অনেক সময় কাজ থেকে ফিরলে তার চাহিদা আমার কান পর্যন্ত পৌঁছাতো না। স্বাভাবিকভাবেই কাজ থেকে ফিরলে সবার মেজাজ খারাপ থাকে। তার উপর যদি প্রয়োজনীয় কিছু না পায় তবে রাগ তো করবেই। এছাড়াও আমি অজান্তে তার প্রয়োজনীয় অনেক কিছু ফেলে দিতাম কিংবা হারিয়ে ফেলতাম তার জন্য ও মাঝেমধ্যে গায়ে হাত তুলতো। আর শেষের এক বছর হয়তো একটু বেশি অসহ্য হয়ে গিয়েছিলাম আমি, তাই বিনা কারণেই হুটহাট হাত তুলতো!”
শ্রেয়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো ইরার কথায়। কতো বড়ো পশু হলে দৈহিক প্রতিবন্ধকতা সম্পন্ন স্ত্রীর গায়ে হাত তুলে! ইরা বাঁধন থেকে ছোটাতে চায় নিজেকে। আর এই বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না তার। এখন খুব করে চায় এগুলো ভুলে নতুন করে পাওয়া সবকিছু আগলে রাখতে। তবে শক্ত সেই বাহুডোর থেকে ছাড়া পাওয়া মুশকিল। ইরা ছলছলে নয়নে তাকায় শ্রেয়ানের মুখপানে। শ্রেয়ান মৃদু হেসে মেয়েটির ললাটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। সহসা ইরার ভরে ওঠা চোখের কার্নিশ থেকে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মানুষটাকে। জীবনে এই একটা মানুষ ই তো পেয়েছে যে তাকে সাদরে যত্নে আগলে রাখে। বিছানায় তখন দুই ভাই বোন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলো শ্রেয়ান আর ইরা! তাদের দুটো সুখপাখি!
বেলা গড়াতেই বাচ্চাদের হৈচৈ বাড়লো। তারা ঘুম থেকে উঠেই যার যার পছন্দের মানুষটির বুকে আধিপত্য বিস্তারে মগ্ন। তবে গম্ভীর মেয়েটির ভালোবাসার মাঝেও যেনো ভরপুর গাম্ভীর্যতা। বাসার সকলে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে গম্ভীর মেয়েটির দিকে যে কি-না ঘুম থেকে উঠেছে থেকে বাবার কলার মুঠোবন্দী করে বসে আছে। কলারটা ছাড়াতে গেলেই তার কঠোর দৃষ্টির সম্মুখীন হতে হয় নয়তো রাগে চিৎকার করে উঠবে। শ্রেয়ান বাধ্যগত ছেলের মতো মেয়েকে নিয়ে বসে আছে আর মিটিমিটি হাসছে। সুমনা আর সুস্মিতা হেসে বলল,
–“ভাইয়া বাজেভাবে ফেঁসে গিয়েছে, মামনি।”
মেয়েকে খাওয়াতে থাকা শ্রেয়ান খানিক অসহায়ত্ব নিয়ে মা বোনের দিকে তাকায়। খাচ্ছে তবুও কলার ছাড়ছে না। সে হতাশার সুরে বলে,
–“আজ সুন্দরী, পাপার জান বলে পার পেয়ে গেলো!”
সুমনা আর সুস্মিতা ফিক করে হেসে উঠলো। ছেলের আদর খেতে খেতে ইরা অবুঝ নয়নে দেখে তাদের হাসি। বরাবরের মতো ইরার আঁচলের এক অংশ শ্রবণের হাতের মুঠোয়। সুমনা মাঝেমধ্যে অবাক হয় অবুঝ দুই বাচ্চা কিভাবে তাদের সুখ বন্টন করে নিলো।
সুস্মিতা দশটার দিকেই শশুর বাড়িতে চলে গিয়েছে।বারোটা নাগাদ ছেলে মেয়েদের গোসল করিয়ে, খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া এক ধুরন্ধর শ্রেয়ান। কাঁধে শুয়ে থাকা বাচ্চা মেয়েটির হাতের মুঠো থেকে নিজের কলারটা ছেড়ে যেতেই শ্রেয়ান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। পা টিপে টিপে মেয়েকে দোলনায় শুইয়ে দিয়ে সে প্রফুল্ল হেসে ঘর থেকে বের হয়। বসার ঘর পর্যন্ত যেতেই মায়ের দেখা পেলো শ্রেয়ান। সে দেয়ালে হেলান দিয়ে শুধায়,
–“মামনি আমার টুকি-টাকি’র মা কোথায় জানো?”
শ্রেয়ানের প্রশ্নে সুমনা বিরক্তি নিয়ে তাকালো। বলল,
–“কি অদ্ভুত সম্বোধন শ্রেয়ান?”
–“এটা আমার ব্যক্তিগত সম্বোধন মামনি, তুমি নাক ছিটাতে পারো না।”, শ্রেয়ান গম্ভীর গলায় বলল। সুমনা মুখ ঝামটা মেরে বলল,
–“আচ্ছা, কিন্তু তোর বউ যখন এই সম্বোধনে রেগে যাবে তখন বুঝিস!”
–“সে কখনো আমার উপর রাগে না মামনি। সে লক্ষ্মী একটা মেয়ে! তাকে যদি তুমি মার ও দাও, তবুও সে টু শব্দটি করবে না।”, শ্রেয়ানের দাম্ভিকতায় পরিপূর্ণ কণ্ঠে সুমনা’র গতিরোধ হলো। ফুলদানি হাতে সে স্নেহের চোখে তাকায় ছেলের পানে। এবার বুঝি ছেলেটার কপালে একটু সুখের দেখা মিললো? সে মিহি স্বরে শুধায়,
–“সে কি আসলেই অনেক লক্ষ্মী?”
বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রেয়ান প্রগাঢ় হেসে মাথা নাড়লো। বলল,
–“আসলেই লক্ষ্মী, মামনি। পৃথিবীর সকল ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে সে। তাকে কখনো ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করো না। মায়ের মতো ভালোবাসা দিও। আর মাঝেমধ্যে শাশুড়িদের মতো একটু খোঁচা দিতে পারো— “যে তোমার ছেলেকে কি দিয়ে সে বশ করলো?” এই বলে। কিন্তু এর বেশি কিছু করবে না কিন্তু! আমার টুকি-টাকির মা চুপচাপ বলে সবাই তাকে কষ্ট দিতে পারে না।”
–“ওরে বাঁদর ছেলে! তোকে জন্ম দিয়েছি আমি, বড়ো করেছি আর উনি এসেছে বউয়ের তরফদার করতে। কুটনী শাশুড়ি হবো আমি। কি করবি তুই কর!”, সুমনা তেতে উঠলো। শ্রেয়ান ফিক করে হেসে উঠে বলল,
–“কিছু করবো না মামনি। শুধু তোমাকে চটাস চটাস করে দু’টো চুমু খাবো। কারণ আমার বউ বকা খেয়ে তো আমার বুকেই মুখ লুকিয়ে কাঁদবে। তুমি বকা দিও, যতো ইচ্ছা ততো। আর আমি তার কান্না থামানোর জন্য তৈরি থাকবো।”
সুমনার কণ্ঠে নম্রতা আসে। বিগত বাজে অভিজ্ঞতা স্মরণ করে বলল,
–“অত্যাচারি শাশুড়ি হওয়ার হলে, তখনি হতাম যখন খারাপ বউ ছিলো। তখন যখন করিনি এখনো করবো না।”
মায়ের মলিন মুখটি দেখে শ্রেয়ান অসন্তোষের কণ্ঠে বলল,
–“আহা! রাগ করো না মামনি। আমি তো মজা করছিলাম।”
–“তো আমি কখন বললাম তুই রাগ দেখাচ্ছিস? বাজে কথা বন্ধ কর এখন। ইরামের চুল ঘাড় ছুঁয়ে গিয়েছে। ঘেমে যায় আর সারাদিন শুধু মাথা চুলকায়। ওর চুল কাটাতে হবে।”, সুমনা ব্যস্ত কণ্ঠে বলল।
–“সেটা তুমি আগে বলবে না? গোসল করানোর আগে কাটিয়ে আনতাম।”, শ্রেয়ান কপাল কুঁচকে বলল।
–“বুড়ি হয়েছি, এতো কিছু মনে থাকে আমার? তোদের খেয়াল রাখা উচিৎ না? ইরা কোথায়? রান্না হয়েছে কখন! ও এখনো রান্নাঘরে কি করে?”
–“আমি দেখছি।”
–“হ্যাঁ দেখ। গিয়ে বল তাড়াতাড়ি গোসল করতে। সারাদিন শুধু খুঁটিনাটি কাজ করতেই থাকে। চুপচাপ বসতে পারে না মেয়েটা।”
–“কাজের মানুষেরা চুপচাপ বসতে পারে না মামনি।”, শ্রেয়ান স্মিত হেসে বলল। পা বাড়ায় রান্নাঘরের দিকে। রান্নাঘরে যেতেই তার কপাল কুঁচকে গেলো। কিচেন কেবিনেটের উপর পা ঝুলিয়ে বসা মিলা আর ইরা বড়ো আমোদের সাথে চেরি খাচ্ছে। নারীটিকে শুধু শুধু সে নির্দয় বলে? আর একদিন আছে সে! আর নির্দয় নারী এখানে বসে চেরি খাচ্ছে ! শ্রেয়ানকে দেখতেই মিলা খেতে খেতে বলল,
–“ভাইজান সেই মজা! এরপর আবার যখন যাইবেন তখন আরো আইনেন।”
শ্রেয়ান কপাল কুঁচকে এগিয়ে যায়। ইরার হাত থেকে চেরির বক্সটা নিয়ে মিলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
–“এই নে, পুরোটা খা। কিন্তু ঘরে গিয়ে, যা।”
মিলা নাচতে নাচতে চলে গেলো। আধখাওয়া চেরি হাতে ইরা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে শ্রেয়ানের দিকে। শ্রেয়ান সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে চট করে কোলে তুলে নেয়। ইরা ছটফট করে উঠলো এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে। শ্রেয়ান চাপা আক্রোশে বলল,
–“মা মেয়ের সারাদিন কি একটাই কাজ, আমার মতো ভোলাভালা ছেলেটার দিকে কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করা? অনেক হয়েছে আর সহ্য করবো না আমি।”
বাহুডোরে গুটিয়ে থাকা দেহটি একপ্রকার যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছে ছাড়া পওয়ার জন্য। শাশুড়ি যদি দেখে নেয়? তবে তেমন কিছুই হলো না বরং তার ভাবনা থমকায় নিজেকে ওয়ারশরুমে দেখে। সে বড়ো বড়ো নেত্রে তাকায় মিটিমিটি হাসতে থাকা শ্রেয়ানের দিকে। তীব্র আক্রোশ নিয়ে কিছু বলার আগেই এক পশলা ঝর্নার পানি ছুঁয়ে গেলো নারী বদন। সিক্ত বদন, লাগাতার ধেয়ে আসা ঝিরিঝিরি পানির প্রকোপে আধো আধো নয়নে স্পষ্ট হয় সম্মুখের পুরুষালী মুখটির বদলে যাওয়া আদল দেখে। লাজে সংকুচিত দেহ পিছিয়ে যেতে নিলে একটাসময় দেয়ালে আঁটকে গেলো। অলস পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসা মানুষটার গতিবিধিও রোধ হলো। ললাটে ললাট, নাকে নাক হাতের আঙুলের ভাঁজে পুরুষালী পাঁচ আঙুল এঁটে যায়। দেহের এক একটা স্নায়ু তখন অস্থির হয়ে পড়ে অনুভূতির তীব্রতায়। রোধ হয় প্রবাহমান কিছু সময় ও! সময়গুলো বড্ডো এলোমেলো, অনুভূতি ও প্রবল ভাবে গ্রাস করে দু’জনকে। কিন্তু এতো এতো সুখের আড়ালে ইরা যে ভুলেই গেলো তার জীবনে সুখ ক্ষণস্থায়ী!
বিকাল চারটার দিকে শ্রেয়ান ইরামকে নিয়ে চুল কাটাতে যায়। ইরা ছেলেকে নিয়ে আর শাশুড়ি মিলার কাছে ছিল। তন্মধ্যেই তার ফোনটা জ্বলে উঠলো। সে কৌতুহলী হয়েই ফোনটা হাতে নিলে সে বজ্রাহত চাহনিতে তাকায় ভেসে ওঠা মেসেজটির দিকে। ঠিক এই ভয়টার জন্যই বিগত দেড় মাস যাবৎ সে গুমড়ে গুমড়ে মরেছিল। তবে কি তার সুখের অন্ত এসে গেলো?
–“আমাকে না জানিয়ে সিম পরিবর্তন করেছো কোন সাহসে? আমি এক মাস যাবৎ যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি কিন্তু…আমার মেয়ে কেমন আছে ইরা? ওকে আমি একমাস যাবৎ দেখতে পারছি না। আর না তুমি টাকা চেয়েছো? সিম পরিবর্তন করার কারণ কি? তুমি কি কোন পরিকল্পনা করছো নাকি? নাকি নতুন নাগর জুটিয়েছো? এখন আমার মেয়েকে আমার থেকে দূরে করতে চাইছো? খবরদার ইরা আমার মেয়েকে নিয়ে কোন প্রকার ছেলেখেলা করার চেষ্টা করে থাকো, তবে আমি তোমার বেঁচে থাকা মুশকিল করে দেবো! শুনেছি তুমি ঢাকাতে। আমি ঢাকায় এসেছি দেখা করবো।”
বিয়ের সিদ্ধান্তটা ইরার জন্য একরোখা একটা সিদ্ধান্ত ছিল। ঐ বাচ্চাটির দুধের আহাজারির কাছে তার মাতৃত্ব দূর্বল হয়ে পড়ে। তাই কোনদিক চিন্তা না করেই সে এতো বড়ো সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ইরামের বাবা? ইরামের বাবা যদি এখন ইরামকে তার থেকে নিয়ে যায়? কম্পিত হাতটি অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে শুরু করলো। কাঁপনের তীব্রতা এতোটাই যে হাত থেকে ফোনটাও পড়ে যায়। সুমনা ইরা চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ইরার বিবর্ণ মুখটির দিকে। সুমনা ইরার কাঁধে হাত রেখে শুধায়,
–“কি হলো ইরা? এমন করছিস কেনো?”
শাশুড়ির ছোঁয়া পেতেই ইরা টলটল দৃষ্টি তুলে তাকায়। সহসা তার চোখ মুখ ঠিকরে ভয়ের কান্না বেরিয়ে আসে। ঝাঁপিয়ে পড়ে শাশুড়ির বুকে। অস্ফুট স্বরে জানায় অন্তঃস্থলে দানা বাঁধা ভয়ের কথা।
বিগত আধা ঘন্টা যাবৎ শ্রেয়ান সেলুনে বসে আছে। কিন্তু কোনভাবেই সেলুনের স্টাফরা ইরামকে ছুঁতে পারছে না। ছুলেই সে গগনবিদারী চিৎকার করে ওঠে। অতঃপর শ্রেয়ান নিরূপায়, ছুটে যায় পার্লারে। সেখানে অন্তত মেয়েদের যদি চুল ছুঁতে দেয় তার মেয়ে। সেখানে গিয়ে একটা উপায় হলো! ইরাম চুল ছুঁতে দিলেও তার কোল থেকে নামতে নারাজ। ফলস্বরূপ মেয়েকে কোলে নিয়ে শ্রেয়ানের বসতে হয়েছে আর পার্লারের মেয়েটা ইরামের চুল কেটেছে।
চুল কেটে শ্রেয়ান আর ইরাম শপিং সেন্টারে ঘুরছিল কিছু কেনাকাটার জন্য। পথিমধ্যে অজ্ঞাত কতো বাচ্চাপ্রিয় মানুষ তার পথরোধ করে—কোলে থাকা অপার্থিব সৌন্দর্যের অধিকারী বাচ্চাটিকে একটু ছুঁয়ে দিতে। তেমনি হঠাৎ এক অজ্ঞাত পুরুষ শ্রেয়ানের পথ আঁটকে দাঁড়ায়। শ্রেয়ান গতিরোধ করে কোর্ট প্যান্ট পড়া পরিপাটি, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা আধুনিকতার রেশ স্পষ্ট। লোকটি কেমন অদ্ভুত ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। শ্রেয়ান সৌজন্য হেসে শুধায়,
–“আমি কি আপনাকে চিনি? আপনি পথ আটকালেন কেনো?”
লোকটি জবাব দেয় না। স্থির দৃষ্টিতে ইরামের দিকে তাকিয়ে আছে সে। শ্রেয়ানের কপাল কুঁচকে যায় মেয়ের দিকে ওভাবে তাকাতে দেখে। বিষয়টা খুব একটা পছন্দ হলো না তার। সে মেয়ের মাথা কাঁধে চেপে পুনরায় শুধায়,
–“এক্সকিউজমি!”
লোকটি চোখ রাখে শ্রেয়ানের দিকে। কেমন অধিকারবোধের সাথে কাট কাট কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে,
–“আপনার কোলে থাকা বাচ্চাটি আপনার কে হয়?”
শ্রেয়ানের কপাল কুঁচকে গেলেও, স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
–“আমার মেয়ে! আমার কোলে তো আমার মেয়েই..”
কিন্তু হঠাৎ করেই তার মুখশ্রী থেকে স্বাভাবিকতা মিলিয়ে যায়। যখন ব্যগ্র কণ্ঠে সম্মুখের লোকটি দাঁতে দাঁত চেপে বলল
–“আমার মেয়ে! আপনার কোলে থাকা মেয়েটি আমার মেয়ে, ইরাম শেখ। খবরদার আমার মেয়েকে নিজের মেয়ে বলে পরিচয় দেবেন না।”
শ্রেয়ানের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে হাস্যকর জোক মনে হলেও শ্রেয়ান হাসতে পারলো না। কারণ তার স্মৃতি থেকে বেরিয়েই গিয়েছে সে যাকে কথায় কথায় আমার মেয়ে বলে দাবি করে সে আদোতে তার অংশ নয়। বিবর্ণ মুখশ্রী নিয়ে শ্রেয়ান নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো। তার হাত কাঁপছে কেনো? কেনো হঠাৎ করেই তার পিতৃত্ব নামক খুঁটি নড়বড়ে দূর্বল হয়ে পড়লো? শুকনো ঢোক গিলে ঘন ঘন পলক ঝাপটায় শ্রেয়ান। কিয়ৎকাল বাদ শুধায়,
–“আপনি ইরফান শেখ?”
ইরফান থমথমে গম্ভীর গলায় বলল,
–“জি, কিন্তু আপনি কে?”
শ্রেয়ান মিহি কণ্ঠে বলল,
–“আমি শ্রেয়ান চৌধুরী। ইরার হাজব্যান্ড!”
ইরফানের ভ্রু উঁচিয়ে যায়। বাঁকা সরু চোখে শ্রেয়ানের আপাদমস্তক দেখে সে। চেহারা, বাচনভঙ্গিতে বিত্তবান, আভিজাত্য ছাপ দেখে খানিক আশ্চর্য হয়। পরপরই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। তার মানে এর জন্যই ইরার এতো পরিবর্তিত আচরণ! তার ভাব বেড়েছে? তাকে তার মেয়ের থেকে দূরে করতে চাইছে?
শ্রেয়ান ভদ্রতার সাথে বলল,
–“আমরা বসে কথা বলতে পারি।”
রেস্তোরাঁয় একে অপরের মুখোমুখি বসা ইরফান এবং শ্রেয়ান। তবে প্রবল অসহায়ত্ব শ্রেয়ানের মুখ জুড়ে। কেননা ইরাম তার কোলে নেই। গম্ভীর মেয়েটি এখন আর তার কলার আঁকড়ে ধরে নেই, সে তার নিজের বাবার কোলে শান্ত হয়ে বসে আছে। অথচ কতো আশ্চর্যের বিষয় ইরামের চোখেমুখে কোন গাম্ভীর্যতা নেই। যেখানে ইরাম সে ব্যতীত অন্য কারোর কোলে যেতে চায় না, ছুঁতে পর্যন্ত দেয় না সেখানে সে কতো অবলীলায় বসে আছে ইরফানের কোলে। তবে কি সব বিরক্তি, গাম্ভীর্যতা শুধুই তার জন্য? সূক্ষ্ম ব্যথায় চৌচির হয়ে আসলো শ্রেয়ানের বুক জুড়ে। নিজেকে কেমন তুচ্ছ এক মানুষ বলে মনে হলো ইরামের জীবনে।
মেয়েকে আদরে আদরে ভড়িয়ে তুললো ইরফান। দীর্ঘ দুই মাস পরে স্বচক্ষে দেখলো মেয়েকে। আদুরে গলায় বলে,
–“আমার বাচ্চা! পাপাকে মিস করেছে? তোমার খুব কষ্ট হয়েছে তাই না এতোদিন অচেনা মানুষদের সাথে থাকতে? পাপা, আর কোন কষ্ট পেতে দেবো না তোমায়। পাপা দ্রুত তোমায় আমার কাছে নিয়ে যাবো।”
ছোট্ট ইরাম পাপা বলতে একটা মানুষকেই বোঝে সেটা হলো ঐ বিরক্তিকর মানুষটিকে। হঠাৎ করেই সে বলে উঠলো,
–“পাহ…পা।”
শ্রেয়ান চোখ তুলে তাকায় মেয়ের দিকে। মেয়ের গম্ভীর দৃষ্টি তার দিকেই। তবে আজ আর আলোড়ন সৃষ্টি হলো না শ্রেয়ানের মাঝে। মেয়ে তাকে নয় তার বাবাকে পাপা বলেছে। ইরফানের মুখশ্রী চকচক করে উঠলো আনন্দে মেয়ের কণ্ঠ শুনে। মেয়ে তার কথা বলতে পারে এমনকি তাকেও ডাকতে পারে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে সে অজশ্র চুমুতে ভরিয়ে তুললো মেয়ের মুখ। তবে তাকে অবাক করে দিয়ে সহসা ইরাম চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে টেবিল চাপড়ে শ্রেয়ানের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো। ইরফান চমকে উঠলো ক্রন্দনরত মেয়ের গলায় পাপা ডাকটি অন্য কারোর জন্য উপলব্ধি করতে পেরে। ইরাম ইরফানের কোল থেকে টেবিল টপকে শ্রেয়ানের দিকে দেহ বাড়িয়ে দিচ্ছে বারবার। কাঁদছে আর বলছে, পাহ..পা! চেয়ারে গা এলিয়ে বসা উদাসীন দেহটিতে যেনো শক্তি ফিরে আসলো। ছলছল নয়নে মেয়ের কান্নারত মুখটির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। চমকানো ইরফানের থেকে মেয়েকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে বলল,
–“কেউ আদর করলে কিংবা ছুঁয়ে দিলে ও বিরক্ত হয়। দুঃখিত!”
শ্রেয়ানের কোলে যেতেই ইরাম কান্না থামিয়ে রাগান্বিত চোখে তাকায় তার দিকে। যেই দৃষ্টির মানে, তাকে অন্যের কোলে দিয়েছে কেনো? শ্রেয়ান নিরবে মেয়ের শাসন দেখলো। বাবাকে নিরুত্তর দেখে ইরাম থমথমে মুখে কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। ইরফান কিছুটা সময় থমথমে মুখে বসে রইল। কিয়ৎকাল বাদ নিরবতা ভেঙে শ্রেয়ান কিছু বলতে নিলে ইরফান তাকে আঁটকে দিলো। কাটকাট কণ্ঠে বলল,
–“আমার মনে হয় না আমাদের মধ্যে কথা বলার মতো কোন টপিক আছে। যদি থেকে থাকে সেটা আমার মেয়ে ইরাম শেখ। আর আমার প্রাক্তন আমায় না জানিয়ে আমার মেয়ে নিয়ে এতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাই আমি আমার মেয়েকে আমার কাছে নিয়ে যাওয়ার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করবো। আশাকরি তাকে জানিয়ে দিবেন আপনি।”
শ্রেয়ান বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় ইরফানের কথার প্রেক্ষিতে। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
–“চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মানে?”
ইরফান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। পকেটে হাত গুঁজে বলে,
–“হ্যাঁ, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। আমি ইরামকে নিজের কাছে নিয়ে যাবো। ও আর ইরার কাছে থাকবে না। কারোর দ্বিতীয় সংসারে, আমার মেয়ে রাখার প্রশ্ন’ই আসে না। যেখানে তার বাবা জীবিত রয়েছে।”
শ্রেয়ানের মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়লো সদ্য সুখের দেখা মিলা সংসারটিকে শূন্য হতে দেখে। গমগমে স্বরে বলে,
–“কারোর দ্বিতীয় সংসারে আপনি আপনার মেয়ে রাখবেন না— অথচ নিজের দ্বিতীয় সংসারে রাখবেন। মেয়েকে দ্বিতীয় সংসারে থাকতে দেবেন না, তবে মেয়ের মাকে ডিভোর্স কেনো দিয়েছিলেন? আপনার মেয়ের জন্য আপনার এতো ভালোবাসা তখন কোথায় ছিল— যখন রাতের অন্ধকারে তার বোবা বধির মায়ের সাথে তাকে বাসে তুলে দিয়েছিলেন? আজ যখন তারা একটু ভালো থাকতে শিখেছে তখন আপনার মনে হয়েছে আপনার মেয়ের কথা? আদোতে আপনি বাবা নাকি সন্তানের সুখ না দেখতে পারা এক অমানুষ?”
রাগে হুঁশ হারা শ্রেয়ান ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল। ইরফান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“আমার স্ত্রী, আমার মেয়ে—আমি কি করবো তাদের সাথে সেটা আমার ব্যপার। কার সাথে আমি থাকবো, কার সাথে নয় এটার কৈফিয়ত আমি আপনাকে দেবো না মিঃ শ্রেয়ান চৌধুরী। আপনি শুধু এতোটুকু মাথায় রাখুন আমি ইরামকে শিঘ্রই আমার কাছে নিয়ে যাবো।”
–“আমি নিতে দেবো না। সাড়ে আটমাসের একটা দুধের শিশু ও। মায়ের দুধ খায় ও এখনো। আপনি ওকে নিয়ে যাওয়ার কথা কি করে বলতে পারেন?”, শ্রেয়ান চোয়াল শক্ত করে বলল। ইরফান ও পাল্টা তেজ নিয়ে বলল,
–“যাদের মা থাকে না তারা কি বাঁচে না? দুনিয়াতে ফর্মুলা দুধ খেয়ে কতো বাচ্চা বেঁচে আছে! আর ও আমার কাছে যতোটা যত্নে থাকবে আর কারোর কাছে থাকবে না। আর আমি আপনাকে কৈফিয়ত ই বা দিচ্ছি কেনো? আপনি কে? আমি ওর বায়োলজিক্যাল ফাদার! দিনশেষে ওর উপর সবচেয়ে বেশি আমার অধিকার।”
–“বায়োলজিক্যাল ফাদার? এখন মনে পড়েছে আপনার এই কথা? আপনি আদোতে একজন বাবা হওয়ার থেকেও একজন স্বার্থান্বেষী হিংসুক। শুধু ভরণপোষন করলেই কি বাবা হওয়া যায়? একটা সন্তানের বিকাশে যে সুস্থ সুন্দর পরিবেশ আর শক্ত ঢালের দরকার, তা কি আপনি ওকে দিয়েছেন? নিজের সুখের জন্য ওর বোবা বধির মাকে ডিভোর্স দিয়েছেন। আপনার নতুন স্ত্রী অন্য ঘরের বাচ্চা লালন পালন করতে চায় না দেখে তাকে মায়ের কাছে ফেলে রেখেছেন। তবে আজ কেনো সন্তানের হক চাইছেন? থাকতে দিন না মা মেয়েকে তাদের মতো ভালো!”
–“ওর মা কে নিয়ে আমার আদৌ কোন মাথা ব্যাথা নেই আর না হবে। কিন্তু আমি আমার মেয়েকে কোনমতেও আর ইরার কাছে রাখবো না।”
শ্রেয়ান শিড়ঁদাড়া সোজা করে দাঁড়ায়। কন্ঠ আর চেহারা থেকে নম্রতা উবে যায়। সে শক্ত কণ্ঠে বলল,
–“আমি এতক্ষণ আপনাকে ভালোভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু আপনি বোঝেননি। আপনি যদি ওর বায়োলজিক্যাল ফাদার হন তবে ইরাও ওর বায়োলজিক্যাল মাদার। ইরা কেনো সৎ মায়ের ঘরে তার মেয়েকে রাখবে। আর আপনার সন্তানের প্রতি এই ভালোবাসাটা যদি শুরু থেকে থাকতো তবে আমি বিনা দ্বন্দ্বে মেনে নিতাম। কিন্তু ইরামের জন্য সৎ আশ্রয়স্থল আপনি নন। আমরা নাহয় আইনী প্রক্রিয়ায় পথ চলি। এটা আমাদের দুই পক্ষের জন্য উত্তম হবে।”
–“অন্যের বাচ্চা নিয়ে আপনার এতো আগ্রহ কেনো?”
–“আমার বাচ্চা, অন্যের বাচ্চা বিবেচনা করার মতো নিচু মন মানসিকতা আমার এখনো তৈরি হয়নি, ইরফান সাহেব। আমার কাছে বাচ্চা মানেই সৃষ্টিকর্তার দেয়া শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। আর যেদিন থেকে এই নেয়ামত আমার ঘরে, আমার বুকে এসেছে—সেদিন থেকে তাকে আমি সযত্নে আগলে রেখেছি। নিজেকে তার ভবিষ্যৎ হিসেবে দেখেছি, যেদিন থেকে আমি তার মায়ের হাত ধরেছি। তার বাবা হিসেবে মনস্থির করিনি বরং তার বাবা আমি! এটাই মেনে এসেছি। জানিনা অযাচিত এই অধিকার দিনশেষে আমার সঙ্গ দেবে কি না! তবে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো তবুও কোন স্বার্থান্বেষী মানুষের হাতে তাকে দেবো না।”
–“আপনি যাকে স্বার্থান্বেষী বলছেন সে ওর বাবা।”
–“বাবারা তো সন্তানের জন্য সব করতে পারে। একটা বোবা বধির মেয়ের সাথেও সংসার করে যেতে পারে। নিজের জৈবিক সুখের জন্য স্ত্রী সন্তানকে ছেড়ে দেয় না। তবে আপনি কেমন বাবা? এটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে!”
–“আপনি তবে সহজে বিষয়টা সমাধান করতে চাইছেন না?”
–“সহজ সমাধান বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন? আমি ওকে দিয়ে দেবো আপনার কাছে?”
–“হ্যাঁ!”
–“তবে ওর মায়ের কি দোষ? ওর মা কিভাবে তার সন্তান ছাড়া থাকবে? এই বাচ্চাটা এখনো মাতৃদুগ্ধপান করে। আর আপনি কতো অবলীলায় বলে দিলেন ওকে কেড়ে নিবেন ওর মায়ের থেকে। আমি মোটেই সহজ সমাধানে আগ্রহী নই মিঃ ইরফান শেখ। তার থেকে চলুন জটিল সমাধানে যাই। আমি নাহয় ওর মাতৃদুগ্ধ ওর জন্য বরাদ্দ করতে লড়বো, আর আপনি আপনার স্বার্থান্বেষী মনের জেদ!”, শ্রেয়ানের শক্ত কণ্ঠ।
ইরফান নিরুত্তর চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইল।
সেই সাক্ষাৎকারের সমাপ্তি সেখানেই ঘটলো। সন্ধ্যা নাগাদ শ্রেয়ান অন্তঃস্থলে বিদীর্ণ অসুখ নিয়ে বাড়ি ফিরলো। শাহেদ চৌধুরীর মুখশ্রী চিন্তিত। ছেলেকে দেখতেই সে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,
–“ইরা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। বারবার কি যেনো বলছে কিছু বুঝতে পারছি না।”
শ্রেয়ানের স্থবিরতা ভঙ্গ হলো। সে মেয়েকে বাবার কোলে দিয়ে দ্রুত ঘরে যেতে চাইলে ছোট্ট হাত দু’টো ক্ষিপ্র বেগে তার কলার চেপে ধরলো। কড়া গম্ভীর দৃষ্টি শ্রেয়ানের মুখপানে। দাঁত খিটিমিটি দিচ্ছে রাগে। শ্রেয়ান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েকে আবার কোলে তুলে নিতেই মেয়েটা শান্ত হয়। শ্রেয়ান তার চোখে চোখ রেখে খানিক রাগ ঝেড়ে বিড়বিড় করে বলে,
–“সব গাম্ভীর্যতা রাগ শুধু আমার জন্য। আর ভালোবাসা, নম্রতা সব অন্যের জন্য, তাই না?”
কলার চেপে ধরা ইরাম কপট চোখ মুখ কুঁচকে তাকায় বাবার রাগ দেখে। শাহেদ চৌধুরী ডানে বামে মাথা নাড়লো বাবা মেয়ের পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষ দেখে। কেউ কারোর থেকে কম নয়।
মর্মযন্ত্রনা, উদগ্রীবতা নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকতেই, বিছানায় বসা উন্মাদপ্রায় নারীটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে শ্রেয়ানের। ক্রন্দনরত ইরা মেয়েকে দেখতেই দৌড়ে আসে বিছানা থেকে নেমে। শ্রেয়ানের কোল থেকে তাকে নিয়ে নেয়। বুকে চেপে ধরে অজশ্র চুমুতে ভরিয়ে তুললো। কাঁদতে কাঁদতে অস্ফুট স্বরে শ্রেয়ানকে কতোকিছু বলছে। শ্রেয়ান যেনো বুঝে নেয় স্ত্রীর ভয়। সুমনা বিছানা ছেড়ে নামে। চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
–“হ্যাঁ রে শ্রেয়ান। দেখনা সেই বিকাল থেকে কেঁদে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। কি হয়েছে ঠিক করে বুঝিয়ে বলছেও না।”
শ্রেয়ান মায়ের দিকে তাকিয়ে মিহি স্বরে বলল,
–“কিছু হয়নি, চিন্তা করোনা। আমি দেখছি।”
–“আচ্ছা তুই সামলা ওকে। দাদুভাইদের আমি নিয়ে যাই।”
–“দরকার নেই মামনি, ওরা থাকুক।”, সুমনা মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে কক্ষ থেকে বের হয়। মা যেতেই শ্রেয়ান আগলে নেয় স্ত্রীকে। নম্র স্বরে শুধায়,
–“কি হয়েছে ইরা, কাঁদছেন কেনো?”
ইরা দ্রুতপায়ে মোবাইলটির কাছে যায়। মোবাইলটা এনে শ্রেয়ানের হাতে দিয়ে অস্ফুট স্বরে কিছু বলে। শ্রেয়ান মেসেজটা পড়লো, অতঃপর ফোনটা রেখে দেয়। ইরা অনাহুত দৃষ্টিতে তাকায়। শ্রেয়ান মৃদু হেসে ইরার দুইগাল আঁকড়ে ধরে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে শব্দ আর ইশারা ইঙ্গিতে বলল,
–“দিনশেষে ইরাম আমাদের মাঝে, আপনার বুকে এভাবেই থাকবে। এটা আমার ওয়াদা। এতো ভয়ের কিছু নেই, ইরা।”
ইরা শান্ত হতে পারে না ছুটে যায় হোয়াইট বোর্ডের কাছে। মার্কার দিয়ে বোর্ডে শব্দ করে দেখিয়ে শ্রেয়ানকে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ইশারা করে বলে, এখানে লিখতে। শ্রেয়ান এগিয়ে গিয়ে বোর্ডে একই কথা লিখলো। ইরা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে লিখলো,
–“ওয়াদা?”
শ্রেয়ান মৃদু হেসে লিখলো,–“ওয়াদা।”
ইরা আবার লিখলো,
–“আমার এইটুকু সম্বল ছাড়া, নিজের বলতে আর কিছু নেই। এইটুকু কেড়ে নিলে আমার মরন ছাড়া উপায় নেই।”
শ্রেয়ান নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে ইরার দিকে। এই মাত্র কদিনের সংস্পর্শে সে ইরামকে ছাড়া এক মুহুর্ত ও কল্পনা করতে পারে না সেখানে ইরা? নিজের অংশ ছাড়া কিভাবে থাকবে? সদ্য ই না সুখের মুখ দেখলো তারা? তবে ফের কেনো? কম কি দুঃখ ছিল মেয়েটার জীবনে?
বসার ঘরে জরুরী বৈঠকে পরিবারের সদস্য সহ সুস্মিতা আর সুস্মিতার হাজব্যান্ড ও রয়েছে। শাহেদ চৌধুরী নিরবতা ভেঙে বললেন,
–“কি করতে চাও? আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে? সে ইরামের বায়োলজিক্যাল ফাদার। দায়িত্ব পালনেও কখনো কার্পন্য করেনি। তার দিকটা কতোটা ভারী ভেবেছ?”
শ্রেয়ান মাথা তুলে তাকায়। বলে,
–“বায়োলজিক্যাল ফাদার, দায়িত্ব এগুলো হলেই কি বাবা হওয়া যায়? দূরে বসে অন্য স্ত্রী নিয়ে সুখে সংসার করবে, আর বোবা মায়ের কাছে সন্তান রেখে লালন পালন করে শ্রেষ্ঠ বাবা হয়ে যাবে? ইরা যে ইরামের জন্মদাত্রী, ওনার কোন অধিকার নেই মেয়ের ওপর? আমি লড়বো ইরার হয়ে।”
–“ভাইয়া ঠিক বলছে পাপা। ইরাম আমাদের কছে ভালো আছে। আর ঐরকম বাবার কাছে ইরাম যে খুব ভালো থাকবে তার গ্যারান্টি কি?”, সুস্মিতা উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল। শাহেদ চৌধুরী গম্ভীর গলায় বলল,
–“ঠিক আছে, তবে তাই হোক।”
*****
ইরফান হাসপাতাল থেকে রিপোর্ট নিয়ে হোটেলে ফিরতেই, ছাব্বিশ সাতাশ বছরের একজন নারী বেরিয়ে আসলো দ্রুত কদমে। নিহার ইরফানের বিমর্ষ মুখটি উপেক্ষা করে ক্রুব্ধ কণ্ঠে শুধায়,
–“আমি কি শুনছি ইরফান? তুমি নাকি ইরামকে আইনীভাবে নিজের কাছে নিয়ে আসছো?”
ইরফান সোফায় বসতে বসতে গম্ভীর গলায় জবাব দেয়,
–“হ্যাঁ।”
–“কিন্তু কেনো?”, নিহার চোয়াল শক্ত করে শুধায়।
ইরফান জ্বলন্ত চোখে তাকায়। বলে,
–“কেনো মানে? ইরাম আমার মেয়ে ও আমার কাছে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।”
–“কিন্তু বিয়ের আগে তোমার সাথে আমার কথা হয়েছে। ইরামকে আমি দেখাশোনা করতে পারবো না।”
–“তুমি এখনো এই কথা বলছো? ডাক্তার কি বলেছে শোননি? তোমার প্রেগন্যান্সিতে কমপ্লিকেশন রয়েছে। বাই এনি চান্স তুমি যদি গর্ভধারণ না করতে পারো, তবে আমি কি সারাজীবন সন্তানহীন থাকবো? নো ওয়ে। আমার পরীর মতো মেয়ে থাকতে আমি সন্তানহীন থাকবো কেনো? ইরাম আমাদের সাথে থাকবে তুমি ওর দেখাশোনা করতে বাধ্য।”, ইরফানের কঠোর কণ্ঠে নিহার ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,
–“ডাক্তার বলেছে কমপ্লিকেশন রয়েছে, কোনদিন বাচ্চা হবেই না এটা তো বলেনি ইরফান? আমি অন্যের বাচ্চা লালন পালন করবো কেনো? আমার জব রয়েছে। তোমার যদি মেয়ের প্রতি এতোই ভালোবাসা তবে তুমি তার মাকে ডিভোর্স দিলে কেনো? আমি একটা অবিবাহিত মেয়ে হয়ে , ডিভোর্সি বাচ্চা ওয়ালা লোককে বিয়ে করেছি কি এই কারণে? আমি এটা কখনো মানবো না ইরফান।”
–“তুমি মানতে বাধ্য। যদি সংসার করতে চাও তবে ইরামকে সাথে নিয়ে করতে হবে। তুমি সবকিছু জেনেই আমায় বিয়ে করেছো।”
–“কিন্তু তুমি তখন আমায় কথা দিয়েছিলে ইরাম আমাদের সাথে থাকবে না।” , নিহার চিৎকার করে উঠলো। ইরফান রেগে একটা চড় বসিয়ে দেয় নিহারের গালে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–“নিজে একটা অসম্পূর্ণ মেয়ে হয়েও সন্তান নিয়ে তোমার এতো অবহেলা কেনো? আমি যেটা করছি তাতে চুপচাপ সায় দেবে নিহার। আমি যেমন যেমন বলবো কোর্টে তেমন বয়ান দেবে।”
বলেই ইরফান গটগট করে ঘরে চলে যায়। গালে হাত দিয়ে নিহার অশ্রুসিক্ত নয়নে চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে থাকে তার গমনের পথে।
সেদিনের পর থেকে শুরু হয় দ্বন্দ্ব, একটা ঘৃণ্য দ্বন্দ্ব! সন্তান নিয়ে কাড়াকাড়ি নামক ঘৃণ্য দ্বন্দ্ব।
চলবে…
যে শ্রাবণে প্রেম আসে
তোনিমা খান
অন্তিম পর্বঃদ্বিতীয়াংশ
[অন্তিম পর্বঃ প্রথমাংশ ও দ্বিতীয়ংশ দুটি পর্ব দেয়া হয়েছে।]
সন্তান নিয়ে কাড়াকাড়ির সেই দ্বন্দ্বের স্থায়ীত্ব হয় দীর্ঘ ছয় মাস। দীর্ঘ এই ছয় মাসে বাচ্চা সমেত ইরা আর শ্রেয়ানকে কতোবার কোর্টে হাজিরা দিতে হয়েছে। কখনো আশার আলো দেখেছে তো কখনো আশাহত।
রাত এগারোটা। চৌধুরী বাড়ি জুড়ে আলো ঝলমল করছে। তবে সেই আলোতেও ঘরটা কেমন অনুজ্জ্বল, উদাসীনতা, মূর্ছনা গুমোট ভাব স্পষ্ট। সমীরনে ভরপুর ক্লেশ। আগামীকাল কোর্ট সর্বশেষ শুনানি দেবে। যেই শুনানিতে তথাকথিত বায়োলজিক্যাল ফাদার এর জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা আশিভাগ। কেননা ইরফান ইরার সাথে যাই করুক না কেনো! কিন্তু সন্তানের প্রতি দায়িত্বে কখনো হেলা করেনি। দুনিয়ার কাছে দায়িত্ব জিতে যায় বাবার ভালোবাসা থেকে। তাদের কছে দায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বাবার ভালোবাসা না পাওয়ার যে শূন্যতা—সেটা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই তো ইরফান দিন শেষে জিতে যাচ্ছে। আর হেরে যাচ্ছে শ্রেয়ান! দিনশেষে একটা জায়গায় সে আঁটকে যায়—সৎ বাবা। কোর্টকাছারিতে ভালোবাসা খুব একটা জায়গা পায় না বোধহয়। এমনি ভ্রান্ত ধারণা শ্রেয়ানের মনে আজ জেঁকে বসেছে।
বরাবরের মতো বাবার শার্টের কলার গম্ভীর মেয়েটির মুঠোবন্দী। কাঁধে তার গরম নিঃশ্বাস আঁছড়ে পড়ছে। ঘুমিয়েছে পাঁচ মিনিট হবে। এখনো হাত ঢিলে হয়নি।
আগামীকাল সকাল দশটায় কোর্টে উপস্থিত থাকতে হবে সকলকে। এক সপ্তাহের ছুটিতে শ্রেয়ান আজ বাড়িতে রয়েছে। খাবার ঘরে সুমনা আর সুস্মিতা মলিন মুখে খাবার বাড়ছে। সুমনা শ্রেয়ানকে ডেকে বলল,
–“শ্রেয়ান খেতে আয়।”
লালচে দৃষ্টি লুকিয়ে শ্রেয়ান মিহি স্বরে জবাব দেয়,
–“খিদে নেই মামনি। তোমরা খাও।”
–“ইরা খাবে না? ওকে ডাক! সকাল থেকে পানি ছাড়া আর কিছু খায়নি।”, সুমনা আবার বলল। শ্রেয়ানের জবাব আসে না। কেনা ততক্ষণে ইরাম ঘুম জড়ানো চোখ তুলে দাদির দিকে তাকায়। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে ওঠে,
–“দাদ্দা!”
সুমনা ছলছল নয়নে তাকায় নাতনির দিকে। সাড়ে চৌদ্দ মাসের মেয়েটা এখন কতোকিছু বলে! সবাইকে ডাকতে পারে। মা, পাপা, দাদ্দা, ফুপিকে ডাকে ফুফি! আর মিলাকে ডাকে মিনা। পুরো ঘর তার আধো আধো কথায় মেতে ওঠে।
শাহেদ চৌধুরী খেতে বসেছিলেন কিন্তু খেতে পারলো না একমুঠো ভাত। উঠে যায় চেয়ার ছেড়ে। হাত ধুয়ে নাতনির কাছে এগিয়ে যায়। হাত বাড়িয়ে বলে,
–“দাদ্দা আসবে দাদুমনি?”
ইরাম চোখ পিটপিট করে একবার দাদা আর বাবার দিকে তাকায়। বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
–“পাপ্পা!
কিয়ৎকাল থেমে দাদাকে দেখিয়ে বলে,
–“দাদ্দা!”
শ্রেয়ান লালচে টলমলে চোখে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকায়। বলে,
–“হ্যা মা, দাদ্দা। যাবে দাদার কাছে?”
ইরাম নাকমুখ কুঁচকে মাথা নেড়ে বলল,
–“নো!…পাপ্পা!”
শ্রেয়ানের চোখ থেকে টপ করে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে বাবার কাছ থেকে যাবে না। কর্মক্ষেত্র থেকে যতোটুকু অব্যাহতি পায় ততটুকু সময় পুরোটা এই গম্ভীর মেয়েটাকে দিতে হয়। নয়তো রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ে ঘর ভাঙচুর করে। অথচ পৃথিবীর নিয়ম কি নির্দয় এই মেয়েটি তার কাছে আর একটা রাত আছে। ভাবতেই শ্রেয়ান শব্দ করে কেঁদে উঠলো। বসার ঘরের সকলে হকচকায় শ্রেয়ানের কান্নার শব্দে। মেয়ের ঘাড়ে মুখ গুঁজে হাঁউমাঁউ করে কাঁদছে শ্রেয়ান। সুমনা ছুটে এসে ছেলেকে আগলে নেয় বুকে। শ্রেয়ান ক্রন্দনরত গলায় আর্তনাদ করে উঠে বলে,
–“আমি ওকে দেবো না মামনি। কাউকে দেবো না। ও আমার মেয়ে। আমি ওর সৎ বাবা নই। ওকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকবো মামনি? কার জন্য সুন্দর সুন্দর ফ্রক কিনবো? কার জন্য ব্যাগ ভরে বেরি আনবো? তুমি কিছু করো না মামনি? পাপাকে বলোনা কিছু করতে! কেনো তারা আমার মেয়েকে নিয়ে যাবে আমার থেকে? আমি…আমি বরং ওকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাই। তাহলে কেউ ওকে আমার থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।”
শাহেদ চৌধুরী আর সুস্মিতার চোখ ভরে উঠলো শ্রেয়ানের আহাজারিতে। সোফার এক কিনারায় চুপসে বসে থাকা মিলাও কেঁদে উঠলো নাক টেনে। ইরাম অবাক নয়নে বাবাকে দেখছে। বাবা কাঁদছে বুঝতে পেরেই তার চোখ বড়বড় হয়ে যায়। চোখ টলকল করে উঠলো। দ্রুত বাবার গালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। আর অস্ফুট স্বরে বলতে লাগলো,
–“ভায়োওও…ভায়োওও…আদো আদো!”
সুমনা ছলছল নয়নেও হেসে ফেললো ইরামের কথায়। সে সুর টেনে টেনে বলছে ভালো ভালো…আদর..আদর। এমন করে তারা সকলে তাকে আদর করে তাই সেও এটা শিখে নিয়েছে। শ্রেয়ান কান্নারা আরো বৃদ্ধি পায় মেয়ের আদরে। মেয়ের চোখেমুখে আদর করে দিয়ে বলে,
–“পাপাকে ছেড়ে যেও না মা। পাপা তোমার আদর না খেলে খুব কষ্ট পাবো।”
বাবা চুমু দিয়েছে তাই ইরামের ও চুমু দিতে হবে। সে বাবাকে হাত দেখিয়ে ডাকে আর আধো আধো কণ্ঠে বলে,
–“পাপ্পা! তিসি তিসি…নোজ”
শ্রেয়ান অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে শুধায়,
–“পাপ্পাকে নোজে কিসি দেবে? দাও।”
শ্রেয়ান নাক এগিয়ে দেয়। ইরাম একগাল হেসে নাকে চুমু দেয়। আবার আধো আধো কণ্ঠে বলে,
–“চিক!”
শ্রেয়ান হেসে ফেললো। মেয়ে তার সব পারে। নোজ, এয়ার, লিপ আইজ এগুলো সব শিখিয়েছে সে। বলল,
–“গালেও দেবে? দাও!”
গাল এগিয়ে দিতেই ইরাম গালেও শব্দ করে চুমু খায়। আর হাত তালি দিয়ে বলে,
–“তিসি, পাপ্পা তিসি।”
–“হ্যা, আমার মা! পাপ্পাকে কিসি দিয়েছে।”
বাবা হেসেছে দেখতেই ইরাম আবার কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। একহাত বাবার শার্ট ভেদ করে বুকের লোমগুলো টানছে। এটা ইরামের একটা অভ্যাস! বদ অভ্যাস না কি! বলা যায় না। তবে শ্রেয়ানের খুব পছন্দের একটা বিষয় এটা। মেয়ে তার কাছে আসলেই বুকের উপর বসে বুকের লোম টানবে। সকলে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে বাবা মেয়ের আহ্লাদ দেখে।
ইরামকে নিয়ে শ্রেয়ান ধীরপায়ে নিজের ঘরে ঢুকলো। কিন্তু কাঙ্খিত মানুষটির দেখা পেলোনা। বারান্দায় উঁকি দিলে, অন্ধকারে বেতের চেয়ারে বসা একটি উদাসীন অবয়ব ভেসে উঠলো। আঁচলের নিচে থাকা ছেলের চুক চুক করে দুধ খাওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। শ্রেয়ান পা বাড়ায় না। কোন সাহসে বাড়াবে? একদিন যে কতো জোরগলায় ওয়াদা করেছিল তার বুক খালি হতে দেবে না। সে পারলো না ওয়াদা রাখতে। শ্রেয়ান মুখ লুকিয়ে ঘরে ঢুকে গেলো। অলস দেহ বিছানায় এলিয়ে দেয়। বুকের উপর মেয়েকে শুইয়ে তার চুলে অলস গতিতে হাত বুলাতে লাগলো। মেয়ের চুল এখন অনেক বড়ো হয়েছে। মাথার দুই পাশে দু’টো তালগাছ করা যায়। ভেবেই ম্লান হাসলো শ্রেয়ান! নিস্তব্ধতা ভেঙে হঠাৎ করেই তার ফোনটা বেজে উঠলো। শ্রেয়ান অনাগ্রহে ফোনটা কানে তুললো। বলে,
–“আসসালামুআলাইকুম! কে বলছেন?”
–“ওয়ালাইকুমুসসালাম! আমি নিহার বলছি।”
নিহার! এই নামটিকে এই ছয় মাসে শ্রেয়ান চিনে গিয়েছে। অনাগ্রহে, দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–“জি, বলুন।”
–“ইরামকে লালন পালন করার মতো সময় আর ইচ্ছা আমার নেই। আমি জব করি, আমার পর্যাপ্ত সময় নেই একটা বাচ্চার দেখাশোনা করা। আমার মনে হয় ইরাম আপনার কাছে অনেক যত্নে আর সুখেই আছে। একটা বাচ্চার অযত্ন হোক এটা আমি চাই না। আপনি যদি ইরামকে চিরদিনের জন্য নিজের কাছে রাখতে চান তবে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।”
মৃতপ্রায় আত্মা যেনো হঠাৎই প্রাণ ফিরে পেলো। শ্রেয়ান চকিতে উঠে বসতে নিলেই ঘুমন্ত মেয়ে, চোখ মুখ কুঁচকে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে ওঠে,
–“পাপ্পাহ!”
শ্রেয়ান হড়বড়িয়ে বলে,
–“স্যরি মা! স্যরি। তুমি ঘুমাও।”
ইরাম আবার ঘুমিয়ে পড়ে। সেই অন্ধকার রাতটা যেনো শ্রেয়ানের কাছে প্রজ্বলিত দ্বীপশিখার ন্যায় জ্বলজ্বল করে উঠলো নতুন আশার আলোয়।
পরদিন সুপ্রভাতটি হয় রৌদ্রজ্জ্বল। চারিদিকে কেমন খুশির আভাস। কোর্টে উপস্থিত দুই পক্ষের এক পক্ষের মাঝে পূর্বাভাস ছাড়াই আঁছড়ে পড়লো দুঃসংবাদের লহরী। আইনজীবী যখন কোর্টে নিহারের প্রেগনেন্সি কমপ্লিকেশনের রিপোর্ট আর নিহারের কিছু বক্তব্য সাবমিট করলো তখন ইরফানের মুখশ্রী বিবর্ণ হয়ে পড়ে। এতোদিন নিহারকে ডিভোর্সের ভয় দেখিয়ে কোর্টে বয়ান দিতে বাধ্য করেছিল সে!
নিজের বক্তব্যে নিহার জানায়, সে ঐ বাচ্চার লালন পালনের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নেয়নি তাকে জোর করা হয়েছে। আর সে নিতে চায় না বাচ্চাটির দায়িত্ব। এটাও জানায় ইরফান শুরুতে ইরামকে নিজের কাছে নিতে চায়নি; কিন্তু যখন জেনেছে তার গর্ভধারণে সমস্যা রয়েছে তখনি ইরামকে নিজের কাছে আনার সিদ্ধান্ত নেয়।
সেই বয়ানে পুরো কেসের গতিবিধি পাল্টে গেলো। একটা মিরাকেলের মতো, কোর্টের নির্দেশে ইরাম চিরদিনের মতো শ্রেয়ানের হয়ে গেলো। মাসে একবার ইরফান দেখা করতে পারবে ইরামের সাথে, চাইলে কিছু সময় ও কাটাতে পারবে। পিতৃত্বের স্থান থেকে মেয়ের জন্য ভালোবেসে কিছু দিতে চাইলে সেটাও পারবে।
কোর্টে থেকে বের হয়েই ইরফান রাগে ফেটে পড়লো। কষিয়ে এক চড় বসিয়ে দিলো নিহারের গালে। নিহার অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় বলে,
–“তুমি কি আমায় রোজ রোজ ডিভোর্সের হুমকি দাও—আমিই তোমায় ডিভোর্স দেবো। আমার গায়ে হাত তোলার স্পর্ধা কি করে হয় তোমার?”
ইরফানের রাগ দমে যায় নিহারের হুমকিতে। তাকে কোন প্রকার কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিহার গটগট করে চলে যায়। ইরফান ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তার পিছু নিলো। দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখে ইরা শ্রেয়ান বুকভরা নিঃশ্বাস নিলো। পুরো চৌধুরী বাড়িতে সুখ আঁছড়ে পড়লো। মেয়েকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে পেয়ে শ্রেয়ান আবেগে কেঁদে ফেললো। আর নেই কোন সন্তান হারানোর ভয়। সুখ দীর্ঘস্থায়ী হলো ইরার জীবনের প্রাপ্তির খাতাটিতে। ছেলেকে কোলে নিয়ে ইরা চোখ মুদে নেয় শ্রেয়ানের কান্নারত মুখটি। অন্যের সন্তানের জন্য মানুষটার এই কান্না! সুবিশাল এই পৃথিবীতে এমন একজন পুরুষের সান্নিধ্য সে পাবে, এটা অকল্পনীয় ছিল। সেদিনের পর থেকে আর কোনকিছুর জন্য পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি ইরা, শ্রেয়ান, শ্রবণ আর ইরামের।
পরিশিষ্টঃ
কখনো ব্যাঙ, কখনো ভুত, কখনো লক্ষ্মী টেরা তো কখনো গরু, ছাগল! এতোকিছুর অভিনয় করেও যখন পাশের গম্ভীর মুখটিতে হাসি ফোটাতে ব্যর্থ হলো শ্রবণ—তখন সে ফোঁস করে বিরক্তি মিশ্রিত নিঃশ্বাস ফেললো। বেঞ্চে গা এলিয়ে দিয়ে শ্রবণ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
–“ইরেটেটিং! হাসতে কি টাকা লাগে মেরি বেহেন? নাকি হাসলে দশ তালা বিল্ডিংটা ধ্বসে পড়বে? নাকি আপনার কিডনি খসে পড়বে?”
চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের অধিকারী রোগা পাতলা একটি মেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকায় নিজের পাশে থাকা ক্লাস ফিলোর বেশে নিজের ছোট ভাইয়ের দিকে। যে কি-না হাত মুখ নেড়ে নেড়ে লাগাতার পকর পকর করে যাচ্ছে। সে গম্ভীর গলায় শাসিয়ে বলল,
–“শ্রবণ!”
–“আরে আমি জানি তো আমার নাম শ্রবণ চৌধুরী। বারবার মনে করিয়ে দেয়ার কি প্রয়োজন?”, শ্রবণ কাঁধ ঝাঁকিয়ে রিল্যাক্স মুডে বলল।
ইরাম রাগান্বিত চোখে তাকায়। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
–“ইউ আর আ জোকার! ইট’স সাউন্ড’স সো গুড দ্যান অ্যান অ্যাথলেট।”
শ্রবণের চোয়াল জুড়ে বড়োসড়ো এক হা। বিস্ময়ে তার হেলান দেয়া রোগা দেহ সোজা হয়ে গেলো। নিজের দিকে আঙুল তাক করে বিস্ময় নিয়ে শুধায়,
–“কি বললে তুমি? আমি জোকার? আমি একজন ক্রীড়াবিদ এটা শুনতে খারাপ লাগে? তুমি এটা বলতে পারলে?”
শ্রবণ একটু আধটু খেলাধুলা করে, প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। আর তাতেই সে নিজেকে এথলেট বলে দাবি করে। ইরাম গম্ভীর গলায় বলল,
–“আমি সত্য বলতে কখনো পিছুপা হই না।”
–“ওরে আমার সাহসী, মহিয়সি নারী! টিকটিকি দেখলে লাফিয়ে আমার কাঁধ জড়িয়ে থাকে কে? ভীতুর ডিম! আবার নিজেকে সাহসী বলতে চাইছো। হাসি পাচ্ছে আপনার কথা শুনে, হি হি হি!”,নানা আঙ্গিভঙ্গি করে বলেই শ্রবণ দাঁত কেলিয়ে হাসলো। ইরাম দাঁতে দাঁত চেপে তাকায়। বলে,
–“ইউ আর আ ইরেটেটিং গাই!”
–“নিজের প্রসংসা নিজের করছো কেনো, বেহেন? আমি জানি তুমি একটা ইরেটেটিং গাই।”, শ্রবণ সয়তানি হাসি দিয়ে বলল। ইরাম রাগে চাপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,
–“শ্রবণণণণ!”
–“আরে আমি জানি আমার নাম শ্রবণ।”, শ্রবণ বিরক্তি নিয়ে বলল।
–“শ্রেয়সী এন্ড শ্রবণ হোয়াট হ্যাপেন টু ইউ?”, মিসের জলদগম্ভীর আওয়াজ শুনতেই শ্রেয়াসী ওরফে ইরাম আর শ্রবণ সোজা হয়ে বসে যায়। ভীত চোখে তাকায় কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মিসের দিকে। মিস রাগান্বিত স্বরে বলল,
–“তোমরা দু’জন প্রতিটা ক্লাসে ঝগড়া করো। আমি আর নিতে পারছি না। বোথ অব ইউ, জাস্ট গেট আউট!”
শ্রবণ চোখ বড়বড় করে তাকায় মিসের দিকে। তীব্র আক্রোশ নিয়ে বলে,
–“ম্যাম আই ডিড নাথিং। শি ইজ দ্যা মেইন কালপ্রিট!”
ইরাম ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে তাকায় ভাইয়ের দিকে। তেতে উঠে বলে,
–“ম্যাম নো! হি ইজ আ লায়ার। হি ইজ দ্যা মেইন কালপ্রিট!”
–“জাস্ট শাট আপ! তোমরা বের হও। আর একটা কথা যদি বলতে হয় তবে আমি তোমাদের হেড টিচারের কাছে নিয়ে যাবো।”
পরমুহূর্তে ইরাম এবং শ্রবণের জায়গা হয় ক্লাসের বাইরে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ইরাম রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় পাশে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভাইয়ের দিকে। শ্রবণ ঘাড় কাত করে বোনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসলো। মুখ বিকৃত করে বলল,
–“আপা, আপনার এই রাগান্বিত মুখ দেখতে দেখতে আমার জীবন ছেঁড়া জুতো হয়ে গিয়েছে। এখন একটু হাসুন। অঙ্গ খসে পড়ে যাবে না, আই সোয়্যার!”
ইরাম নিরুত্তর দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইল। সাত বছর সাত মাস এর ইরাম এবং সাত বছর তিন মাস এর শ্রবণ বর্তমানে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সেকেন্ড স্টান্ডার্ডে পড়ে। কাগজপত্রে শ্রেয়সী চৌধুরী নামের মেয়েটির ডাক নাম ইরাম। তবে স্কুলে সবাই তাকে শ্রেয়সী নামেই চেনে। কিন্তু সবার সাথে ইরামের সুসম্পর্ক বজায় থাকলেও ভাইয়ের সাথে তার আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক। শ্রবণের কাজ ইরামকে বিরক্ত করা আর ইরামের কাজ শ্রবণের কাজে বিরক্ত হওয়া।
–“আ’ম লিটল বিট হাংরি!”, শ্রবণের বলহীন কণ্ঠে ইরাম চট করে চোখ খুললো। কোনপ্রকার প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সে ক্লাসের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বিনীত অনুরোধ করে ম্যামকে বলে,
তার স্কুল ব্যাগটা থেকে টিফিন বক্স নেয়ার অনুমতি দিতে। ম্যাম অনুমতি দিলে সে টিফিন বক্সটা নিয়ে আসে। পুনরায় আগের জায়গায় বসে মিটিমিটি হাসতে থাকা ভাইয়ের হাতে টিফিন বক্সটা ধরিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
–“ইট।”
শ্রবণের গতরে হাড্ডি মাংস খুব একটা চোখে না পড়লেও ছেলেটা প্রচুর পেটুক। কিন্তু স্বাস্থ্য দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। তার একটু পর পর খিদে পায়। আর এই খিদের সম্পূর্ণ খেয়াল ইরাম রাখে। শ্রবণ টিফিন বক্স হাতে নিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,
–“মাত্র চার মাসের বয়সের ব্যবধানে’র কারণে তুমি যদি আমার থেকে আপা ডাক শুনতে পারো; তবে আমি তোমার থেকে বড় আপার মতো আচরণ আশা করতে পারি না? অবশ্যই পারি। খাইয়ে দাও বলছি, নয়তো পাপাকে বলে দবো, পাপার লাডলি কি কি করে বেড়ায় আমার সাথে।”
–“অসহ্য!”
বলেই ইরাম রাগে গজগজ করতে করতে টিফিন বক্সটা হাতে নেয়। চামচ সহ টিফিনে দেয়া চাওমিন ভাইয়ের মুখে তুলে দিতেই সে গপগপ করে খেয়ে ফেলল। একে একে পুরো বাটি শেষ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললো শ্রবণ। খেয়েদেয়ে জিজ্ঞাসা করে,
–“তুমি খাবে কি?”
–“সেটা তোমার চিন্তার বিষয় নয়। তোমার পেট ভরেছে না? এখন একটু উল্লুকের মতো আচরণ করা বন্ধ করো।”
–“উল্লুকের বড়ো বোন—বড়ো উল্লুক!”, শ্রবণ মুখ বাঁকিয়ে বলল। ইরাম তেতে উঠবে তার আগেই শ্রবণ তার মুখের সামনে একটা কিটক্যাট তুলে ধরলো। সহসা ইরাম শান্ত হয়ে গেলো। থমথমে মুখে ভাইয়ের থেকে এক প্রকার ছিনিয়ে নিলো কিটক্যাটটা। শ্রবণ গা দুলিয়ে হাসলো। কিটক্যাট বোনের অতিশয় প্রিয় একটা চকলেট। অদূরে ইন করা সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রেয়ান গাল ভরে হাসলো ছেলে মেয়েদের দেখে। কপালের ঘাম মুছে কয়েকপা এগিয়ে যেতেই, আচমকা ইরামের দৃষ্টি পড়লো তার দিকে। সে হাসলো। ইরাম চকলেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আচমকাই পাপ্পা বলে চেঁচিয়ে উঠলো। এক ছুটে গিয়ে লাফিয়ে পড়লো বাবার বুকে। হাঁটু গেড়ে বসা শ্রেয়ান আঁছড়ে পড়া দেহটিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। আলিঙ্গনটা নিরবেই কেটে গেলো। কিয়ৎকাল বাদ নাক টানার শব্দ কনে আসতেই শ্রেয়ান মেয়ের চুলের গোছায় চুমু দিয়ে আদুরে গলায় বলে,
–“পাপা তো এসে গিয়েছি মা। কাঁদছো কেনো?”
ইরাম নাক টানতে টানতে বলল,
–“আই মিসড ইউ সো মাচ।”
–“পাপা অলসো মিসড ইউ। এখন আর মিস করতে হবে না, পাপা অনেক দিনের জন্য তোমার সাথে থাকবো। পুরো একমাস!”
ইরাম চট করে কাঁধ থেকে মাথা তুলে তাকায় বাবার দিকে। চেহারায় খুশির ঝিলিক স্পষ্ট। প্রফুল্ল চিত্তে শুধায়,
–“সত্যি?”
শ্রেয়ান মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
–“তিন সত্যি মা।”
–“আই লাভ ইউ পাপ্পা!”, ইরাম বাবার গালে শব্দ করে চুমু খেয়ে হাসিমুখে বলল। শ্রেয়ান মেয়েকে নামিয়ে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে তার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল,
–“আই লাভ ইউ ঠু।”
ততক্ষণে হেলতে দুলতে আসা শ্রবণ গতিরোধ করে বাবার সামনে। বাবার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর পর্যবেক্ষকের মতো করে বলল,
–“পাপা! আমি বলি কি, চলো আমরা আপাকে নিয়ে ইন্ডিয়া যাই। স্টার জলসার অডিশন দেওয়াই। দেখবে এবারেই চান্স পেয়ে যাবে। তারপর আমরা সেলিব্রিটি হয়ে যাবো তার সাথে সাথে।”
কথাটা শেষ হতে না হতেই শ্রবণের কান মলে দিলো শ্রেয়ান। বলে,
–“পাজি ছেলে, পাপার সামনেও আপনার দুষ্টুমি কমে না? আপাকে জ্বালাতে খুব মজা?”
শ্রবণ এক গাল হেসে বলল,
–“ওহ্, পাপা! ইট’স হার্টিং।”
শ্রেয়ান ছেড়ে দেয়। হাত বাড়িয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নেয়। মাথায় চুমু দিয়ে বলে,
–“কেমন আছেন চ্যাম্প? পাপা এতোদিন পর এসেছি— অথচ আপনার মাঝে একটুও আগ্রহ নেই পাপার বুকে আসার।”
–“কারণ আমি তো তোমার বুকেই থাকি। আর যারা বুকে থাকে না তারাই তো কবুতরের মতো প্যা প্যা করে উড়তে উড়তে আসে। এই যেমন তোমার ন্যাকা মেয়ে!”
ইরাম দাঁতে দাঁত চেপে তাকায় ভাইয়ের দিকে। বাবার কাছে বিচার দিয়ে বলে,
–“দেখেছো? কি বলছে ও?”
শ্রেয়ান ডানে বামে মাথা নেড়ে ছেলে মেয়েদের নিয়ে বেরিয়ে আসে। টিচারের অনুমতি নিয়ে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাবে। গাড়িতে বসে শ্রেয়ান মেয়ের হাতে একটা হট ডগ তুলে দেয়। সে জানে মেয়ের টিফিন প্রতিদিন তার ছেলেই খায়। নিজেরটাও খায়, বোনের টাও খায়, আবার কিনেও খায়। কিন্তু শ্রেয়ানের বুঝে আসে না এতো খাবার যায় কোথায়? ছেলের দেহে তো হাড়ে মাংস খুব কম! সে ছেলের দিকে একটা ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিঙ্কস এগিয়ে দিলো। কিন্তু শ্রবণ অনাগ্রহ প্রকাশ করে বলল,
–“এসব ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকে আমার কিছু হবে না। আমার শক্তিশালী ইলেক্ট্রোলাইট তো বাড়িতে।”
শ্রেয়ান হাসে। ছেলের এই শক্তিশালী ইলেক্ট্রোলাইট আর কেউ নয় বরং তার মা। বাড়িতে ঢুকতেই শ্রবণ টাই খুলতে খুলতে ছুটে গেলো রান্নাঘরে। কাঙ্খিত মানুষটিকে পেতেই বিলম্বহীন পেছন থেকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজলো। তবে ছোট হাত দুটিতে বৃহৎ স্ফিত উদর আঁকড়ে ধরতে কষ্ট হলো। নারীটির ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। চোখে মুখে আভিজাত্য, যত্নের ছাপ সুস্পষ্ট। মাতৃত্বের চমৎকার চোখ ধাঁধানো সেই সৌন্দর্য নিয়ে ইরা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ছেলের দিকে। তোয়ালেতে হাত মুছে ছেলেকে পেছন থেকে সামনে টেনে নেয়। দু’হাতে জড়িয়ে ধরতেই শ্রবণের মাথা ঠেকলো মায়ের স্ফিত উদরে। সেখানে টোকা দিয়ে বলল,
–“নক! নক! তুমি কি শুনতে পাচ্ছো নাকি ঘুমাচ্ছো? ভাই স্কুল থেকে এসে গিয়েছি, ওঠো। আজ তোমার বড়ো বোন কি করেছে জানো? একটাবার একটু হাসেনি, আমি কতোকিছু করলাম তবুও হাসেনি। আগামী সপ্তাহে তুমি যখন এখান থেকে বেরিয়ে আসবে তখন ইচ্ছা মতো বকে দিও। ঠিক আছে? ভাই তোমার অপেক্ষায় আছি। তোমার সাথে খেলবো।”
যেই মানুষটার কাছে আগে পুরো পৃথিবী নিস্তব্ধ মনে হতো। সেই মানুষটা আজ সব শুনতে পায়। চিকিৎসা প্রযুক্তির উন্নয়নে ইরা এখন সব শুনতে পায়। বিদেশে নিয়ে গিয়ে তার উন্নত চিকিৎসা করানো হয়। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট নামক অস্ত্র পাচারের মাধ্যমে ইরার কানে একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র বসানো হয়। যার দ্বারা সে শুনতে পারে। কিন্তু এখনো পুরোপুরি স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে না তার স্পিচ থেরাপি চলছে। একটু আধটু অনেক কথাই বলে সে ইদানীং।
নয় মাসের গর্ভবতী ইরা শুনলো ছেলের সব কথা। শুনে গা দুলিয়ে হাসলো। দীর্ঘ এক রজনী পার করার পর ইরা এবং শ্রেয়ানের মনে হলো, এখন তাদের একটা অংশ আসলে খুব একটা খারাপ হয় না। তাই এই ছোট্ট আরেক সদস্যের আগমন ঘটছে চৌধুরী বাড়িতে। এর মধ্যে সুস্মিতা ও এক ছেলে সন্তানের মা হয়েছে। সে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু দিল। বহুকষ্টে উচ্চারণ করে বলল,
–“পানি।”
মায়ের আধাআধুরা কথার মানে শ্রবণ বোঝে। সে বলল,
–“পানি খেয়েছি মাম্মা। তোমার মেয়েকে আজ একটুও হাসাতে পারিনি। এমন কেনো? বিরক্তিকর।”
শ্রবণ বিরক্ত হয়ে বলল। শ্রেয়ান লম্বা লম্বা পা ফেলে রান্নাঘরে ঢুকতেই দেহ শ্রান্ত হয়ে গেলো তার। ঢিলেঢালা গোলাপী ফ্রক আর ঢিলেঢালা সেলোয়ারে আবৃত মেদ যুক্ত দেহটি দেখে সে মুগ্ধ হয়। এক হাতে পেট আঁকড়ে ধরে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকা মুখটি দেখে অস্ফুট স্বরে শ্রেয়ান মাশাআল্লাহ বলে উঠলো। পরপর ই ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল,
–“শ্রবণ, ড্রেস চেইঞ্জ করে হাত মুখ ধুয়ে তারপর মাম্মার কাছে আসো।”
–“ওকে।” , শ্রবণ চলে যায়। শ্রেয়ান এগিয়ে যায় স্ত্রীর কাছে। রান্নাঘর তখন শূন্য। দু’হাতের আজলায় মেদ যুক্ত মুখটি নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলে,
–“কারোর নজর না লাগুক আমার বিবিজানের উপর।”
মানুষটার এই ডাকটির উপর ইরা মন হারায়। একদা যার কথা শোনার জন্য সে তরপাতো এখন তার কথা শুনে সে তরপায়। শ্রেয়ান স্ফিত উদর আঁকড়ে ধরে ডেকে ওঠে অনাগত সন্তানকে,
–“এই যে পাপার পিচ্চি জান! আপনি আর কতো সময় নিবেন? অনেক বড়ো হয়েছেন এখন বেরিয়ে আসুন। বাকিটা পাপা যত্ন করে বড়ো করে নেবো। আমার যে আর তর সময় না আপনাকে দেখতে।”
ইরা হেসে উঠলো। শ্রেয়ানের চুলে হাত গলিয়ে দিতে লাগলো। লোকটাকে দীর্ঘ পঁচিশ দিন পর দেখেছে সে। আগামী সপ্তাহে তার ডেলিভারির ডেট। এর জন্য একমাসের ছুটি নিয়ে এবার এসেছে শ্রেয়ান।
–“সব ভালোবাসা বেবিকে দিয়ে দিচ্ছো?”
মেয়ের কণ্ঠে শ্রেয়ান হেসে ফেললো। হাঁটু গেড়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে দেয় মেয়ের দিকে। বলে,
–“পাপাদের ভালোবাসা’র কখনো ভাগ হয় না মা। সবার জন্য সমান ভালোবাসা থাকে। এসো বেবি তার আপাকে মিস করছে। পাপাকে মাত্র বললো।”
–“মিথ্যে কথা! বেবি তার ভাইয়াকে বেশি মিস করছে। পাপা বলো বলো! বেবি আমায় বেশি মিস করছে?”, টিশার্ট জড়াতে জড়াতে ছুটে আসতে থাকা শ্রবণ চেঁচিয়ে বলতে বলতে আসলো। ইরাম রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় ভাইয়ের দিকে। বলে,
–“নো, বেবি আমায় বেশি মিস করেছে।”
–“তোমার মতো গম্ভীর মেয়েকে বেবি কেনো মিস করবে? বেবি আমায় মিস করবে।”
–“পাপ্পা?”, ইরাম চেঁচিয়ে উঠলো। শ্রেয়ান আর ইরা হেসে উঠলো তাদের মিষ্টি কলহ দেখে। দু’জনে হাত বাড়িয়ে ছেলে মেয়েকে নিজেদের সাথে জড়িয়ে ধরে। শ্রেয়ান, ইরাম আর শ্রবণকে অবাক করে দিয়ে ইরা অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“বে..বি ছবাইকে মি..স করচে।”
শ্রেয়ান চমকে উঠলো ইরার কণ্ঠে দীর্ঘ এক লাইন শুনে। ইরাম আর শ্রবণের চোখেমুখেও বিস্ময়। ইরা কখনোই এতো দীর্ঘ লাইন উচ্চারণ করেনি আগে। ইরা লাজুক হাসলো সকলের দৃষ্টি দেখে। দরজায় দাঁড়ানো সুমনা আর শাহেদ তাদের দেখে প্রশান্তি ভরা হাসি হাসলো পরিপূর্ণ সুখি পরিবারটি দেখে। বলল,
–“সব ভালোবাসা রান্নাঘরে বসেই হবে নাকি বের হবেন। ইরা বের হও এই অবস্থায় আর রান্নাঘরে থাকার দরকার নেই। মেয়েটা বড্ডো জেদি। কোন কথা শোনেনা।”
শ্রেয়ান স্ত্রীর হাত ধরতে গিয়েও ধরলো না কেননা ছেলে মেয়ে মায়ের হাত দু’টো আঁকড়ে ধরে ইতিমধ্যেই হাঁটা দিয়েছে। তার অবর্তমানে এই দু’জন ই মায়ের খেয়াল রাখে। সাত বছরের এই বাচ্চা দুটি রাতে না ঘুমিয়ে মায়ের ফুলে টসটসে হয়ে থাকা পা টিপে দেয়। তাই সবক্ষেত্রে তাদেরকেই আগে রাখে। তবে ঘন্টা দুই পার হতেই চৌধুরী বাড়িতে হুলুস্থুল কাণ্ড বেঁধে গেলো যখন দেখলো সময়ের আগেই ইরার ডায়ালেশন শুরু হয়। তবে ইরার মাঝে কোন ভয় দেখাগেলো না। সে একদম শান্ত। উদ্বিগ্ন শ্রেয়ান স্ত্রীর এমন শান্তভাবে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তারা হাসপাতালে পৌঁছায়। তবে কিছুটা সময় গড়াতেই ইরার লেবার পেইন বাড়তে লাগলো। মায়ের অস্ফুট চিৎকারে ইরাম আর শ্রবণ কেমন মিইয়ে গেলো। শ্রবণের চঞ্চল চিত্ত একদম মিইয়ে যায়। ইরাম দেখে তার দুষ্টু চঞ্চল ভাইয়ের মিইয়ে যাওয়া। চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে আদর করে মিষ্টি হেসে বলল,
–“চিন্তার কিছু নেই। আল্লাহ মাম্মাকে শিঘ্রই সুস্থ করে দেবে।”
শ্রবণ বিবর্ণ মুখ নিয়ে বোনের হাসি দেখলো যেই হাসির জন্য সে সারাদিন কতোকিছুই না করে। এবং দীর্ঘ ছয় ঘন্টা পর বাবা মায়ের কোল আলো করে একটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে। তোয়ালে হাতে বসা শ্রেয়ানকে ডাক দিলে শ্রেয়ান ছুটে যায়। একজন নার্স বাচ্চাটিকে তার কোলে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–“মেয়ে হয়েছে অভিনন্দন!”
শ্রেয়ান উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধায়,
–“আমার স্ত্রী?”
–“সেও সুস্থ আছে। একটু দূর্বল আছে। ছয়টার দিকে তাকে নরমাল কেবিনে দেয়া হবে।”
–“আচ্ছা, ধন্যবাদ।”
বলেই শ্রেয়ান হাস্যোজ্জ্বল দৃষ্টিতে তাকায় লালচে আবরণে আবৃত ছোট্ট ছোট্ট হাত পায়ের ঠিকযেনো হাতেগড়া এক পাপেট। সে ছলছল নয়নে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো। শাহেদ চৌধুরী, সুমনা আর সুস্মিতা ঝাঁপিয়ে পড়লো বাচ্চাটির উপর। শাহেদ চৌধুরী ছেলেকে বলল,
–“দাদুভাইয়ের কানে আজান দাও।”
শ্রেয়ান মৃদু হেসে মেয়ের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে, মেয়ের কানে আজান দিলো। অতঃপর ছেলে মেয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে। যারা চুপটি করে অদূরে দাঁড়িয়ে আছে। সে এগিয়ে যায়। তোয়ালেতে মোড়ানো মেয়েকে গিয়ে হাঁটু গেড়ে তাদের সামনে বসে এবং মেয়েকে এগিয়ে দেয় তাদের দিকে। ইরাম আর শ্রবণ পিটপিট করে সরু নয়নে অবলোকন করে বোনকে। শ্রেয়ান ছলছল নয়নে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
–“বনুকে নাও। ও হলো একমাত্র তোমাদের দায়িত্ব! ওর ভালো মন্দ সব তোমরা দেখবে। পাপাকে কথা দাও দেখবে? কখনো কোন ক্ষতি হতে দেবে না। সবসময় আগলে রাখবে।”
শ্রবণ আর ইরাম স্মিত হেসে বলল,
–“সবসময় আগলে রাখবো। কখনো কোন ক্ষতি হতে দেবো না।”
–“এই তো আমার সাহসী বাচ্চারা! নাও, এখন বনুকে আদর করে ওয়েলকাম জানাও।”
তারা সানন্দে বোনকে কোলে তুলে আদর করলো। দীর্ঘ চিকিৎসা পদ্ধতির কারণে লাগাতার হাসপাতালে আসা ইরফান আর নিহারের গতিরোধ হলো সেই দৃশ্য দেখে। ইরফানের ভেতর থেকে এক চাপা যন্ত্রনাদ্বায়ক নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। বুকের ভেতর কেমন সূক্ষ্ম ব্যথা হয়। সৃষ্টিকর্তা আজো তার ঘরে কোন নেয়ামত পাঠায়নি। অথচ জৈবিক সুখের কারণে একদিন যাদের নিজের থেকে দূরে করে দিয়েছিল তারা আজ কতোটা সুখি। বোনকে দেখতে দেখতেই ইরামের চোখ পড়ে ইরফানের দিকে। শ্রেয়ানের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো তারা। শ্রেয়ান সদ্য জন্মানো মেয়ে আর ইরামকে নিয়ে এগিয়ে গেলো। ইরামকে বলল,
–“পাপাকে সালাম দাও মা।”
ইরামের ছোট্ট এই পৃথিবীতে অদ্ভুত এক বিষয় হলো তার দু’জন বাবা। এর এক্সপ্লেনেশন কখনো বাবা মা দেয় না। আর না সে চেয়েছে। হয়তো সময় হলে একদিন নিজেই বুঝে যাবে। ইরফানের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হয় ইরামের। বাবার ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ইরাম। কোনদিন থেকে খামতি নেই। বাবার কথায় ইরাম পুতুলের মতো করে বলল,
–“আসসালামুয়ালাইকুম পাপা!”
ইরফান হাঁটু গেড়ে বসলো। মৃদু হেসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেয়। জিজ্ঞাসা করে,
–“আমার মা কেমন আছে?”
ইরাম কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
–“ভালো আছি। বনু এসেছে এখন আরো বেশি ভালো আছি।”
ইরফান ম্লান হাসলো। শ্রেয়ান মেয়েকে ইরফানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
–“আমার মেয়ে, শ্রেয়া চৌধুরী।”
ইরফান মৃদু হেসে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নেয়। দোয়া করে দিয়ে বলে,
–“আপনার উপর আল্লাহ তায়ালার রহমত আরো বৃদ্ধি পাক। আমার রহমত থেকেও নেই আর আপনার ঘরে ভরপুর রহমত।”
নিহার চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ইরফানের কথার কোন প্রভাব তার মধ্যে পড়ছে না। নিহারকে নির্বিকার দেখে ইরফান দীর্ঘশ্বাস ফেললো এটা তার কর্মের ফল! তারা চলে যায় সেখান থেকে। শ্রেয়ান মেয়েকে নিজের সাথে আগলে এগিয়ে চলে। এই জীবনটাতে ছোট্ট ছোট্ট এই সঙ্গগুলোই তার অর্জন।
দীর্ঘসময় বাদ যখন ইরা চোখ খুললো তখন শ্রেয়ানের হাস্যোজ্জ্বল মুখ ভেসে উঠলো। শ্রেয়ান মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে লম্বা সময় নিয়ে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। ললাটে ললাট ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
–“ধন্যবাদ বিবিজান। সবকিছুর জন্য। সৃষ্টিকর্তার কাছে ধন্যবাদ আপনাকে আমার করে দেয়ার জন্য। আপনি এমন একজন মানুষ যাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল, আপনার কাছে আমার পুরো জীবনের সব ভালোবাসা, ভালোলাগা, যত্ন, ইচ্ছা-অনিচ্ছা জিম্মি করে রাখা যাবে। আর আপনি সম্মান আর যত্নের সাথে আমার ভালোবাসা গুলো আগলে রাখবেন। দেখুন আমার বিশ্বাস জিতে গিয়েছে। আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষটা আমি।”
ইরা দূর্বল দেহে শুনলো সেই অনুভূতির পঙ্ক্তিমালা গুলো। ততক্ষণে দরজা খুলে শ্রবণ বোনকে কোলে নিয়ে এক প্রকার ছুটতে ছুটতে আসলো। তার পিছু পিছু শাহেদ চৌধুরী, সুমনা , সুস্মিতা, মোজাম্মেল আর ইরাম ও আসলো। শ্রবণ শ্রেয়াকে দেখিয়ে তীব্র আক্রোশ নিয়ে বলল,
–“পাপা! মাম্মা! দেখো দেখো আমার দিকে কিভাবে তাকাচ্ছে? জন্মানোর সাথে সাথে আমার দিকে কড়া চোখে তাকাচ্ছে। ঠিক তোমার বড়ো মেয়ের মতো। এ তো আরেকটা গম্ভীর পুতুল। এতো এতো রাগ সামলাতে গিয়ে দেখি আমি চিকন হয়ে যাবো। এই মেয়ে এতো গুলো মাস তোমার সাথে মিষ্টি মিষ্টি গল্প করেছি এই কারণে? জন্মানোর সাথে সাথে বোনের মতো আমার দিকে কড়া চোখে তাকাচ্ছো? কেনো হাসতে পারলে না? হাসলে কি তোমাদের দু বনের অঙ্গ খসে পড়বে? ইয়া আল্লাহ! দু দু’টো গম্ভীর বোন দিয়ে আমি কি করবো? কে খেলবে আমার সাথে?”
শ্রবণ আহাজারি করতে লাগলো। উপস্থিত সকলে হো হো করে হেসে উঠলো। শ্রেয়ান আর ইরা মুগ্ধ চোখে নিজেদের অংশদের দেখে। সমাপ্তি বলতে কি বুঝি আমরা? ভালোবাসা, সংসার, মাতৃত্ব পিতৃত্বের কোন সমাপ্তি হয় নাকি? হয় নাতো! এগুলো তো এভাবেই সব দুঃখ, ঝড় ঝাপটা, পরীক্ষা উত্তীর্ণ করে সুখের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়। আজ ইরা আর শ্রেয়ান ও জীবনের সকল ঝড়ঝাপটা, ক্লেশ , পরীক্ষা উত্তীর্ণ করে সুখের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। যেখানে নেই কোন অপ্রাপ্তি! শুধু সুখ আর সুখ!
———————-সমাপ্ত—————–