সুগন্ধি ফুল পর্ব-২৫

0
576

#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_২৫
#জান্নাত_সুলতানা

[পর্ব টা একটু রোমান্টিক। পড়তে না চাইলে স্কিপ করতে পারেন।]

-“ব্যাথা এখনো?”

ফিজা আবরাজ এর সামনের দিকের কোমড় এর লম্বা কাটা দাগ টার ওপর আলতো করে হাত ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করলো। আবরাজ হাসে। ভালো লাগে যখন মেয়ে টা তার একটু কেয়ার করে তার কথা ভাবে। সুখী মনে হয় নিজে কে। আবরাজ মুখে মৃদু হাসি রেখে জবাবে বললো,

-“পাগল মেয়ে। চার বছর হয়েছে এটার।”

-“আপনি কোমায় ছিলেন ছয় মাস!”

আবরাজ ফিজার কথায় অবাক হয়। সে মাথার আঘাত এর কারণে কোমায় ছিলো বছরখানেক সময়। এটা অবশ্য দেশে কেউ জানতো না। এমনিতেই সে দেশে খুব বেশি একটা যোগাযোগ করতো না। তারমধ্যে তখন সাব্বির ব্যাপার টা সামলেছে। আর ইলা বেগম ছেলের সাথে কথা বলতে খুব বেশি জোড়াজুড়ি করলে ভিডিও কল দিয়ে বলতো আবরাজ ঘুমচ্ছে। তিনি অবশ্য মেনে নিতো। ছেলের ব্যস্ততার কথা জানতেন তিনি। ছেলের হৃদয় বড্ডো পাষাণ এটাও বুঝে গিয়েছিল ছেলে বিদেশ যাওয়ার পরপরই। তাই ব্যাপার টা সামলাতে খুব বেশি হিমশিম খেতে হয় নি সাব্বির কে।

আবরাজ তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে উঠলো,

-“হু। বাড়িতে সাব্বির কথা বলতো।”

-“মাথার আঘাত টা আবার কোনো সমস্যা হবে না তো?”

-“সমস্যা যেন না হয় সেইজন্যই এক বছর এটার চিকিৎসা করিয়েছি। নয়তো এতোদিন দূরে থাকতাম না-কি! বিয়ে বাবা-র কথা রাখতে করেছিলাম। যদিও তখন অভিমানে ভেবেছিলাম কিছু বছর দেশে ব্যাক করবো না। আর ভাগ্যের কি পরিহাস দেখো চার বছর সত্যি সত্যি আসতে দিলো না।”

-“সেদিন আপনার ওপর অ্যাটাক কে করেছিলো?”

ফিজা সন্দিহান কণ্ঠে জানতে চায়। আবরাজ বউয়ের কথার বিপরীতে বললো,

-“সে সব ছাড়ো। যে করেছে সে আমার তোমার পরিচিত শুধু এটুকু জানো।”

-“আমরা আর ওখানে না যাই? সংসার করি এখানে? আমাদের একটা পরিবার হবে। আপনার আমার একটা সংসার হবে।”

-“হবে।”

মোলায়েম স্বরে বলে আবরাজ। ফিজা ভেজা শরীরে জড়িয়ে ধরে আবরাজ কে। এদিকে আবরাজ বউয়ের এমন ভাবলেশহীন কর্মে থম মেরে বসে রইলো।

-“পাগল করে দিচ্ছো সুগন্ধি ফুল।”

ফিজা আবরাজ বুকে নাক মুখ গুঁজে রেখে বললো,

-“খুব বাজে আপনি।”

-“শরীর ব্যাথা?”

মাথায় আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করলো আবরাজ। ফিজা কথা বলে। আবরাজ তপ্ত শ্বাস ফেলে ফিজা কে বললো,

-“ড্রেস চেঞ্জ করতে হবে। ঘুম প্রয়োজন তোমার।”

ফিজা দূরে গিয়ে দাঁড়াল। আবরাজ ওঠে বাহিরে চলে গেলো। নিজে কাপড় পড়ে ফিজা কে ওয়াশ রুমে কাপড় দিলো। ফিজা পুরো টা সময় যেন ঘোরে রইলো। ইশ সব সময় জীবন টা এমন সহজ সরল ভাবে চললে কতোই না ভালো হতো।

———

ফিজা সারাদিন রুমে শুয়ে বসে দিন কাটালো। আবরাজ অফিস গিয়েছে ফিরতে রাত হবে বলেছে। সবাই রুমে এসে ফিজার সাথে আড্ডা দিয়েছে। মিষ্টি ইলা বেগম। মোহিতা বেগম মেহরিন। তারা এখনো রয়েছে। আবরাজ নিজ থেকে তাদের থাকতে বলেছে। বাড়িতে সে একটা গেটটুগেদার করবে। এতে কারোর সমস্যা থাকার কথা নয়। যেহেতু হঠাৎ আবরাজ বিয়ে করেছে সেক্ষেত্রে সবাই তো জানে না বিয়ে হয়েছে। আবরাজ এর সিদ্ধান্তে সবাই সহম।
বিকেলের দিকে ইয়া বড়ো একটা পার্সেল নিয়ে একজন গার্ড হাজির হলো। রুমে বসে তখন ফিজা। গার্ড পার্সেল ফিজা কে দিয়ে চলে গেলো। তখন ফিজার মোবাইলে আবরাজ এর কল এলো। ফিজা ফোন রিসিভ করে কানে তুলতে ওপাশ থেকে রাশভারী কণ্ঠ স্বর ভেসে আসে,

-“সুগন্ধি ফুল!”

-“হু। পার্সেল?”

-“রাতে বেরবো।”

আবরাজ পরপরই জিজ্ঞেস করলো,

-“শরীর এখনো খারাপ লাগছে?”

ফিজা লজ্জা আড়ষ্ট হয়ে গেলো। মিনমিন করে বললো,

-“ঠিক আছি।”

-“রেডি থেকো। রাতে ফিরছি।”

আবরাজ কল কাটতে ফিজা তপ্ত শ্বাস ফেললো। কি সাঙ্ঘাতিক পুরুষ। এসব কেউ ফোনে জিজ্ঞেস করে! ফিজা ফোন রেখে পার্সেল খুলে থম মেরে বসে রইলো। এক এক করে সব গুলো শাড়ী নামিয়ে বিছানায় রেখে ফ্যাল ফ্যাল করে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। ফিজা এক এক করে সব ক’টা শাড়ী গুনে দেখলো। মোট চব্বিশ টা শাড়ী এখানে। বিছানা অনেক টা যায়গা জুড়ে সব গুলো শাড়ী। ফিজা বিস্ময় কিছু সময় চুপ করে থেকে আবার ফোন হাতে নিলো। কল লাগালো আবরাজ কে। আবরাজ কল রিসিভ করলো না। ফিজা বিরক্ত হলো। ফোন বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে হাঁটু মুড়ে বসে রইলো ফ্লোরে। জার্মানি থাকতে বারোটা দিয়েছিলো। আর এখন চব্বিশ টা। ডাবল।

——–

রাত সাড়ে আটটায় আবরাজ বাসায় ফিরলো। সবাই তখন লিভিং রুমে বসা। কালকের অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে সবার আলোচনা। বাড়িঘর সন্ধ্যা থেকে সাজানো-গোছানো শুরু হয়ে গিয়েছে। আবরাজ দৃষ্টি বুলিয়ে চার দিকে দেখে। সবাই আছে বউ নেই তার। হাতে ঝুলানো কোট একজন সার্ভেন্ট নিতে এলে আবরাজ দিলো না। মনে আছে তার এটার কথা। বউয়ের পছন্দ নয়। সে সেটা কোলে নিয়ে বসলো সোফায়। কথা হলো সবার সাথে টুকটাক। আব্রাহাম আছে এখানে। আবরাজ কি মনে করে জিজ্ঞেস করলো,

-“বিয়ে করবি না?”

এক ঘর মানুষ। যদিও খুব বেশি নয়। মেহরিন মিষ্টি মোহিতা বেগম ইলা বেগম মিলন খান সাব্বির। আর দুই তিন জন ডেকোরেশনের লোক। আবরাজ এর মুখে হঠাৎ এমন প্রশ্নে সবাই কিছু টা কৌতূহল নিয়ে আব্রাহাম এর দিকে তাকালো। ইলা বেগম অবশ্য বড়ো ছেলের কথায় সন্তুষ্ট হলেন। ছেলে বড়ো হয়েছে। বিয়ে দেওয়া নিয়ে তিনি তো কিছু বললেও কেউ কানে তুলবে না। এখন নিশ্চয়ই বড়ো ভাই কে এড়িয়ে যেতে পারবে না। আব্রাহাম গলা পরিষ্কার করলো। আঁড়চোখে একবার রান্না ঘরের দিকে তাকিয়ে কফির মগ হাতে তুলে নিলো। বললো,

-“করবো। মন মতো মেয়ে পাই।”

-“কেমন মেয়ে আমাকে বলো আব্বু। আমি খুঁজবো।”

ইলা বেগম বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলো। আব্রাহাম মায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেঁসে জবাব দিলো,

-“তোমাকে কষ্ট করতে হবে না আম্মু। আমি খুঁজে বলবো তোমায়।”

এই কথার ওপর তো আর কোনো কথা খাটে না। তাই এ ব্যাপারে আর কেউ কিছু বললো না। আবরাজ আব্রাহাম কে লক্ষ্য করলো। রান্না ঘরে তাকিয়েছে এটা সে খুব ভালো করে লক্ষ্য করছে। কিন্তু কেনো তাকালো। এই প্রশ্নের উত্তর এর জন্য আবরাজ কে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। ফিজা হাতে নাশতার একটা প্লেট নিয়ে তখন বেরিয়ে এলো। আবরাজ এমনিতেই ফুরফুরে মেজাজে ছিলো। তবে বউ কে কাজ করতে দেখে মেজাজ খারাপ হলো। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। হনহনিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেলো। ইলা বেগম পেছন থেকে ডাকলেও আবরাজ না তাকিয়ে বলে দিলো তার টায়ার্ড লাগছে। ইলা বেগম এটা শুনে আর কিছু বললো না। ফিজা বুঝে পেলো না এতো সময় বসে থেকে এখন কেনো চলে গেলো!
ফিজা নাশতা রেখে ইলা বেগম এর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ভদ্রমহিলা কি বুঝলেন কে জানে। ফিজা কে গম্ভীর স্বরে বললেন,

-“রুমে যাও। দেখো গিয়ে ওর কিছু লাগবে না-কি?”

ফিজা সবার দিকে একবার করে তাকালো। কারোর ওর দিকে নজর নেই। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে ফিজা। এরপর শাশুড়ীর পেছন থেকে গুটিগুটি পায়ে চলে গেলো। আব্রাহাম সেদিকে বারকয়েক আঁড়চোখে তাকিয়ে দেখলো। তবে নিজের এই কাজে সে নিজেই বারবার বিরক্ত হচ্ছে সাথে নিজের ওপর রাগ হচ্ছে।

ফিজা রুমে এসে আবরাজ এর দেখা পেলো না। রুমে নেই আবরাজ। ওয়াশ রুম থেকে পানির শব্দ হচ্ছে। ফিজা কাঁচের দেওয়ালের ওপাশে বলিষ্ঠ একটা ছায়া দেখলো। ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে। ফিজা জানে আবরাজ রেগে আছে। কারণ কি? ওই যে রান্না ঘরে গেলো। আবরাজ মোটেও চায় না বউ তার রান্না ঘরে যায়। সে জার্মান থাকা অবস্থায় এবিষয়ে কথা বলেছে অনেকে বার ফিজার সাথে। কড়াকড়ি নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে রান্না ঘরে যেন না যায়। যেটা ফিজা বারবার লঙ্ঘন করছে। ফিজা টাওয়াল একটা হাতে নিয়ে বাইরে থেকে হাত নাড়িয়ে আবরাজ এর মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করলো। তবে কোনো লাভ নেই। আবরাজ দেওয়ালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। রাতের বেলায় এতো সময় পানিতে ভিজলে ঠান্ডা লাগবে। ফিজা শেষমেশ বাধ্য হয়ে দরজা দিয়ে নক করলো। দরজা খোলা। ফিজা দ্বিধায় পরলো। যাবে কি-না! এরমধ্যে ভেতর থেকে গম্ভীর স্বর ভেসে আসে,

-“কাম।”

-“আপনি নিয়ে নিন না এটা।”

ফিজা মোলায়েম স্বরে বললো। কিন্তু পরক্ষণেই চমকে উঠলো।

-“কানে শুনতে পাচ্ছো না? আসতে বলেছি আমি।”

ভারিক্কি স্বর। ধমক খেয়ে ফিজা দরজা অল্প একটু ফাঁক করে ভেতরে এলো। আবরাজ সাথে সাথে বউ কে ঝট করে নিজের সাথে চেপে ধরলো। ফিজা হতভম্ব। নিজে কে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললো,

-“আবরাজ আর ইউ ম্যাড?”

-“কথা শোনো না কেনো তুমি? না-কি নিজে কে খুব বড়ো মনে করো? তুমি শুনতে পাও না আমার কথা?”

-“আমি মোটেও নিজে কে বড়ো মনে করি না। কেনো রেগে আছেন?”

-“চুপ বেয়াদব মেয়ে। রাগের কারণ জানার পরে-ও কারণ জানতে চাইলে আরো বেশি রাগ হয়।”

আবরাজ ফিজার পেটে আঙুল চেপে ধরে। ফিজা ব্যাথা পায়। তবুও টুঁশব্দ করে না৷ বরং আবরাজ রাগ দেখে এই মূহুর্তে ওর হাসি পাচ্ছে। ঠোঁট টিপে হাসি আঁটকে রাখলো। পানির ধারা ঝরনা থেকে পরে দু’জন কে ভিজিয়ে জুবুথুবু করে দিয়েছে। দু’জনের কেউ পানির জন্য চোখ মেলে একে-অপরের দিকে তাকাতে পারছে না। ফিজা তবুও পিটপিট করে তাকিয়ে আবরাজ এর দিকে। বললো,

-“আচ্ছা সরি। যাব না রান্না ঘরে। ছাড়ুন আমায়।”

বলতে বলতে আবরাজ এর উন্মুক্ত লোমহীন বক্ষে অধর ছুঁয়ে দিলো। আবরাজ ফিজা কে ছাড়লো না। ফিজা নিজে কে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ভ্রু কুঁচকে তাকায় আবরাজ এর দিকে। আবরাজ ফিজার ঘাড়ের ভেজা চুল গুলো বাঁ হাতে সরিয়ে নিলো। ঝুঁকে এসে সেখানে পরপর অনেকবার অধর বুলিয়ে দিতে লাগলো। ফিজা কোনো রকম নিজের হাত টা ছাড়িয়ে ট্যাপ বন্ধ করে দিলো। পানি পরা বন্ধ হলো। তবুও আবরাজ খান এর রোমাঞ্চ বন্ধ হলো না। ফিসফিস মাদকাসক্ত স্বরে শুধালো,

-“নো। এখন তো আরো আগে না।”

আবরাজ শোনার পাত্র নয়। ফিজা বাঁধা দিলে-ও শুনবে না। ভেজা কাপড়ে বউ কে কোলে নিয়ে আবরাজ রুমে চলে এলো। নিজের গায়ের অর্ধ পরিহিত ভেজা শার্ট খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। সেটার স্থান হলো মেঝেতে। ফিজার সর্বাঙ্গে বিচরণ ঘটে বলিষ্ঠ সুঠাম দেহের মানুষ টার। অনুভূতির অন্তরালে সারবস্তু আবিষ্কার করলো পুরুষ টা তাকে ছুঁয়ে দিলে সে নিজে কে সামলে উঠতে পারে না। এতো বছর এতোদিন যা হয় নি। কিংবা বারবার ছোঁয়ার চেষ্টায় বাঁধ সাধত সে। আজ এখন এসে আর বাঁধা দিতে পারে না। বরং স্বামী নামক এই পুরুষের ছোঁয়ায় সে ভালোবাসা খুঁজে পায়। সুখের খুঁজ পেয়ে সে দুঃখ ভুলতে বসে৷ হয়তো দুঃখ দেওয়ার মানুষ টা তাকে সুখী করে ভালোবাসে বলে। এবার কি সময় এলো তবে আবরাজ খান কে অবহেলার অনলে পুড়িয়ে তার করা ভুলের সাথেই তাকে সাক্ষাৎ করানোর!
ফিজার বুক ভারী হয়। চোখের কোল ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ে নোনাজল। কানের পিঠে তা বিলীন হয়ে যায়। শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে সামনের মানুষ টাকে। কাঁদতে কাঁদতে আওড়াল,

-“ইউ আর ভেরী ব্যাড বয় আবরাজ খান।”

আবরাজ থতমত খেলো। নিজের কাজের ব্যাঘাত তার মোটেও খারাপ লাগে নি। বরং বউয়ের কান্নায় তার অন্তর ছারখার হয়। বউয়ের ছোটখাটো দেহখানা নিজের শক্ত-পোক্ত দেহে চেপে ধরে শক্ত করে। কাতর কণ্ঠে বলে,

-“সরি সুগন্ধি ফুল। আমি তোমায় শুধু কষ্টই দিয়ে গেলাম। তবে এতে আমি একটুও অনুতপ্ত নই। তোমাকে কাঁদাতে আমার ভালো লাগে। সরি বাট ইট’স ট্রু।”

#চলবে…..

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]