অকিঞ্চন পর্ব-০২

0
283

গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – দুই
_____________

সমস্ত গঞ্জ যখন নিষুপ্ত, তখন নিশাচরের ন্যায় উজাগর রাত কাটাতে ব্যস্ত প্রভা। হেতুসাপেক্ষ, নিদ্রা-রাজ্যের ঘুমেরা তাকে ধরা দেয়না। তার চোখে বসেনা। একবার মনে হয়, জোর করে ঘুমিয়ে পড়ে; কিন্তু ঘুমোয়না। মনে হয়, এতে করে ঘুমেদের ওপর জোরজবরদস্তি করা হবে। ঘুমেরা দুঃখ পাবে। অভিমান করবে। ঘুমেদের সাথে অযথা ঝগড়া করতে ভীষণ কষ্ট হয় প্রভার। ঝগড়া’ইবা করবে কেন? একটু একটু করে সে নিজেই ঘুমদের সাথে নিজের বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে। যখন ঘুমেরা তার চোখে স্বেচ্ছায় এসে জুড়ে বসত, তখন সেই তো ঘুমদের উড়িয়ে দিয়েছে। তবে আজ কেন সে ঘুমদের দোষ দেবে? প্রভা অহেতুক ভাবনা পাশে ফেলে নিজের সম্পূর্ণ মনোযোগ বইয়ে দিতে চাইল। তার সামনে রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাস। প্রভা ভেবে ফেলল, যেহেতু তার ঘুম আসছেই না, তাহলে আজ সারারাত যাবত এই উপন্যাসটি পড়া যেতে পারে। প্রভা তার ভাবনা অনুযায়ী নিজের তন্ময়তার সাথে বইটি পড়া শুরু করল। বইয়ের তিন-চার পাতা পড়তেই প্রভার মনে হলো তার মাঝে কিছুক্ষণ আগে থাকা সেই তন্ময় ভাবটা লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা। সে বুঝতে পারল, সে যতটা আগ্রহ নিয়ে বইটি শুরু করেছিল, ততটা আগ্রহ অনুভব হচ্ছেনা। বিরক্তিরা যেন চারপাশে লেপ্টে আছে! সাথে যোগ দিয়েছে উদাসীন ভাব। বই পড়তে তার ভালো লাগছে না – এমন ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না। দেখা যখন গিয়েছে, এর অর্থ দাঁড়ায়, হয় সে কোনো বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন অথবা তার চারপাশের পরিবেশটা পড়ার পরিবেশ নয়। দ্বিতীয় কারণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে কী সে কোনো ব্যাপারে চিন্তিত? না, চিন্তিত হওয়ার কোনো ব্যাপার ঘটেনি। তবে হ্যাঁ, সে একটি ব্যাপারে ভীষণ রকমের অসন্তুষ্ট। তাওহীদের ব্যাপারে। ছেলেটা রীতিমতো মাথাব্যথায় পরিণত হয়েছে। চালের বস্তা নিয়ে আসা, প্রবেশপত্র ফেরত দেওয়ার বেশ অনেকদিন পর কালই ছেলেটার সাথে ফের কথা হয়েছে প্রভার। এছাড়া তার নাম যে তাওহীদ, তাও প্রভা জেনেছে গতকালের ঘটনায়। তাওহীদের কথা মনে আসতে হঠাৎই রাগে প্রভার শরীর কামড়ে উঠল।
প্রভা ভীষণ রকমের একজন অন্তর্মুখী, একগুঁয়ে, বদরাগী, নাক উঁচু ধরনের মেয়ে। তার দিকে কারোর সাধারণ দৃষ্টিও তার সহ্য সীমায় স্থান পায় না; ভীষণ রকমের অস্বস্তিতে গা গুলিয়ে ওঠে। সেখানে একটি ছেলে তার দিকে প্রতিদিন তাকিয়ে থাকে যা তার কাছে নিতান্তই একটি দুঃসহকর ব্যাপার। এর চেয়েও দুঃসহকর ব্যাপার হলো ছেলেটি প্রভার সাথে একটি পরোক্ষ জেদের খেলা খেলেছে। প্রভার মনে হলো তার সাথে জেদ দেখিয়ে ছেলেটি যেন তার মুখে চপটাঘাত করেছে। এইতো, এই গতকালই প্রভা নিজের ভেতরকার উশখুশ ভাবকে দূরে সরিয়ে মুদির দোকানের দিকে যায়। গিয়ে কিছুক্ষণ ধম ধরে দাঁড়িয়ে থেকে মেঘমন্দ্র কণ্ঠে বলে,
– আপনার নাম কী?

আচম্বিত এমন প্রশ্নে তাওহীদ চমকে ওঠে। প্রভার দাঁড়িয়ে থাকাকে হয়তো ভ্রম বলে বোধ করে। দৃষ্টি ঘোলাটে দেখায়। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে চারদিকে তাকিতুকি করে একটু হাসার চেষ্টা করে। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে,
– মোহাম্মদ ইশতিয়াক আলম তাওহীদ।

প্রভা ভীষণ ছোটখাটো কথায়-কাজে বিরক্ত হওয়া মানুষ। তাই এখনো সে এতোবড় নাম শুনে বেজায় বিরক্ত হলো। শুধুমাত্র একটা নামও তো বলা যেত। প্রভা ধারাল কণ্ঠ আসল জায়গায় তাক করে বলল,

– আমাকে বিরক্ত করার কারণ জানতে পারি? আপনি যে এভাবে সময়ে-অসময়ে চোখ দিয়ে আমাকে গিলে ফেলার চেষ্টা করেন এটা খুবই অস্বস্তিদায়ক। খুবই যন্ত্রণার। এর কারণ জানতে পারি? কিংবা এর থেকে পরিত্রাণ পেতে আমি কী করতে পারি তার সমাধান কী আপনি আমাকে দিতে পারেন?

শুকনো আকাশে বিজলির মতো প্রভার এমন হঠাৎ আক্রমণাত্মক প্রশ্নে তাওহীদ কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে মাথা নামিয়ে নেয়। সরাসরি এমন প্রশ্ন সে আশা করেনি। কী উত্তর দিবে বা দেওয়া প্রয়োজন তাও তার জানা নেই।
প্রভা লৌহ কণ্ঠে বলে,

– অস্বীকার করার উপায় কিন্তু নেই। আপনি যে শুধু দোকান থেকে তাকিয়ে থাকেন তাও নয়। নিজের বাসা থেকেও তাকিয়ে থাকেন। একজন পুরুষ হয়ে অন্য এক নারীর শোবার ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকাকে কী বলবেন আপনি? এখানে কতোটুকু ভদ্রতা শোভা পায় বলুন? বিগত পাঁচ/ছয় মাস ধরে লক্ষ্য করেছি। ভেবেছি নিজে থেকেই ঠিক হবেন। বলব, বলব করেও বলিনি। এখন আমার ভদ্রতাকে কী আমার দুর্বলতা মনে করছেন? এখন কী আপনার জন্য নিজের শোবার ঘরেও নিজেকে নিরাপদ করে রাখতে পারব না? সারাক্ষণ পর্দা টেনে রাখতে হবে?

তাওহীদ মনে মনে নিজেকে অপরাধী স্বীকার করে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো কথা বলেনা। তার দ্বারা সত্যই ভীষণ বাজে কাজ ঘটে গেছে। তার সামান্য ভদ্রতা টুকু মাথায় রাখা উচিত ছিল। তাওহীদ আড়ভাবে চারদিকে হালকা চোখ বুলিয়ে নেয়। ভরদুপুর হওয়ায় লোকসমাগম তেমন নেই। নয়তো ভীষণ লজ্জার একটা ব্যাপার ঘটে যেত। তাওহীদ আরোও একবার ম্লান দৃষ্টিতে প্রভার মুখ দেখে মুখ নামিয়ে নিল। সে কী বেশি খারাপ কাজ করে ফেলেছে? এখানে মেয়েটার রাগ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সে তো কখনো প্রভার ঘরের জানালা পেরিয়ে প্রভাকে দেখার চেষ্টা করেনি। প্রভা যখন বারান্দায় এসে ভীষণ আদর দিয়ে গাছে পানি দিয়েছে কিংবা বই নিয়ে কোনো এক ফ্যাকাসে বিকেলকে আয়োজন করে পার করার চেষ্টা করেছে, কেবলমাত্র তখন তাওহীদ প্রভাকে দেখে নিজের চোখ জুড়িয়েছে। প্রভাকে কী বলবে সে কথা? না থাক, কী দরকার! প্রভার অভিযোগ তো অযৌক্তিক নয়। তাওহীদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাওহীদ লক্ষ্য করে প্রভা তখনো তার দিকে শ্যেনদৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে। তবে তাওহীদের নত মস্তক প্রভার কাছে তাওহীদের পরাজয়ের গান গাইলে প্রভা শেষবারের মত শাসাতে চায়। বলে,
– আমি আজ আপনাকে ভদ্রভাবে বললাম। আশা করি নিজেকে সংযত করবেন। নয়তো, একথা আমি আমার বাবার কানে তুলতে বাধ্য হব; যা হয়তো আপনার জন্য শুভকর হবেনা।

বলেই প্রভা চলে আসে। প্রভা ধরেই নেয় তার এমন কঠিন কথার বিপরীতে ছেলেটি শুধরে যাবে। নিজেকে সংযত করবে। প্রভাকে অস্বস্তি থেকে মুক্তি দেবে। অথচ প্রভাকে অবাক করে দিয়ে আজ সকাল বেলা ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিলে ভাংতির জন্য তিনি একে ওকে জিগ্যেস করছিল। ঠিক সেই মূহুর্তে তাওহীদ গিয়ে রিকশাওয়ালাকে নিজ গরজে ভাংতি দেয়। এই ঘটনায় আত্মাভিমানী প্রভার মনে হয়, ছেলেটা যেন গতকালের কথারই চরম অবাধ্যতা দেখাল। প্রভাকে ছোট করল। প্রভা বলেছিল ছেলেটিকে প্রভার থেকে দূরত্ব রেখে চলতে। অথচ সে প্রভাকে সাহায্যের নামে দয়া দেখিয়ে দিল। প্রভা মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো যে, কালই সে ছেলেটার সাথে আবার কথা বলবে। তবে ভদ্রভাবে নয়। ভীষণ অভদ্রভাবে। ভদ্রকণ্ঠের কথা যদি কানে না পৌঁছোয়, তবে অভদ্রকণ্ঠই সই।
প্রভা নিজের বিরক্তি দমাতে না পেরে চেয়ার ছেড়ে শব্দ করে উঠে দাঁড়াল। নিজেকে শান্ত করা প্রয়োজন। নিজেকে শান্ত করা বলতে মানুষ গান শোনা, প্রিয় খাবার খাওয়া, আঁকিবুঁকি করা কিংবা নিজের প্রিয় কাজ করা বোঝে। প্রভা তেমন শৌখিন নয়। তার ভালোলাগা, রাগ, বিরক্তি কিছুই শৌখিন নয়। এতো আয়োজন করে তাদের আনতে হয়না, আবার দূর’ও করতে হয়না। প্রভা যেমন সাধারণ, তাকে ঘিরে রাখা অনুভূতিরাও তেমন সাধারণ। হঠাৎ আসে, হঠাৎই কেমন মিলিয়ে যায়। প্রভা নিঃশব্দে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। একপল রাতের নিস্তব্ধ শহরের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে টলটলে চোখ তুলে চাইল গগণপানে। চোখের দৃষ্টিতে নরম ভাব। সে যে এখানে নিজের বিরক্তি ঝাড়তে এসেছিল তা সে বেমালুম ভুলে বসল। এই আলো-আঁধারির খেলা দেখে মনে হলো কেউ যেন রাতের ওপরে বিষণ্ণতার আস্তরণ মেখে দিয়েছে। রাতের বিষণ্ণতা বোধয় প্রভাকেও ছুঁয়ে দিল। হঠাৎ করেই তার মন বিষণ্ণ গলায় গেয়ে উঠল, এই সুন্দর দুনিয়ায় সে একজন অতি তুচ্ছ এবং অতি অপ্রয়োজনীয় প্রাণী। সে না থাকলে এই দুনিয়ার তেমন কোনো ক্ষতি বোধকরি হতো না। তবুও কেন সে জন্ম নিল? প্রশ্নটা জ্বলে উঠতেই প্রভা নিভে গেল। স্থবির হয়ে ক্ষণকালের জন্য ভাবনায় মশগুল হলো। তবে এর কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া গেল না। প্রভা বিশাল আকাশের দিকে মুখে তুলে স্থির হয়ে চেয়ে রয়। মুহূর্তের পর মূহুর্ত যায়। তার মাঝে কোনো হেলদোল মেলে না। মাঝে মন কেবল ভারী কণ্ঠে বলে ওঠে, জন্মই আজন্মের দায়।
_____
চলবে।