অকিঞ্চন পর্ব-০৩

0
210

গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – তিন
__________

অপরাহ্নের শুরু। আকাশে দুলছে খুচরো খুচরো ধূসর মেঘ। চারদিক জুড়ে বইছে আন্তরিকতার এক স্নিগ্ধ গন্ধ। সাথে কেমন আরাম আরাম আবহ। না আছে রবির উগ্র রশ্মি, না আছে শৈত্যপ্রবাহ। আছে কেবল দেহ-মন জুড়িয়ে দেওয়া সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত যত্নের নরম হাওয়া। যে হাওয়ার মাঝে মেলে বৃষ্টি বৃষ্টি স্নিগ্ধ গন্ধ। বৃষ্টি নেই অথচ বৃষ্টির গন্ধ অনুভব করাটা বেশ উপভৌগ্য বলে মনে হচ্ছে তাওহীদের কাছে। তাওহীদ একবার চোখ তুলে চারপাশে চাইল। বসন্তের গাছে যেমন থোকা থোকা রঙিন ফুল হাসে, ঠিক তেমনি সবুজ মাঠ জুড়ে হাসছে থোকা থোকা মানুষ। তাওহীদের ঠোঁটে হাসির সরু রেখার দেখা মিলল। তার অনেক অনেক প্রিয়কাজের একটি কাজ বোধহয় মানুষের খুশি দেখা। চারদিক জুড়ে আছে অচেনা, অদেখা সব মানুষের মেলা। অথচ সেই অচেনা মানুষদের হাসিমুখ দেখে তাওহীদের মন প্রীত হলো। চারপাশের বাতাসে সুখ সুখ গন্ধ অনুভব হলো। আজকের আবহাওয়াটাকে ‘সুখ-আবহাওয়া’ নাম দেওয়া যেতে পারে। হ্যাঁ, সুখ-আবহাওয়াই। এই সুখ সুখ আবহাওয়ায় যেসব মানুষেরা ঘর থেকে বের হয়, তাওহীদের ধারণা তারাও সবাই সুখী; সুখী বলেই পরিবার, বন্ধুবান্ধব নিয়ে বের হয়, ঘোরাফেরা করে, স্মৃতির টুপলিতে সোনালি দুঃখ বন্দি করে। পরিশেষে তারা এমন সুখী দিনটিকে নিজেদের সুখ, খুশি, আহ্লাদ, আমোদ মিশিয়ে ভীষণ আয়োজন করে উদযাপন করে। তাওহীদ একবার ভাবল, আচ্ছা! সে কী সুখী মানুষ? তার এতোক্ষণের আলোচনা অনুযায়ী, আজ সব সুখী মানুষ বের হয়েছে। তবে কী সেও….

– জনাব তাওহীদ আলম! শুনতে পারছেন?

আচানক এমন অপরিচিত ভঙ্গির ডাকে তাওহীদ ঘাড় উঁচিয়ে তাকাল। এতোক্ষণ যাবত ঘাড় নামিয়ে রাখা মাথাটা উঁচু হলে, আকাশের ঠান্ডা আলোয় তাওহীদের মসীবর্ণ চেহারাটা কিছুটা উজ্জ্বল দেখাল। আবহাওয়ার নরম ভাবটা বোধহয় চেহারাতেও খানিকটা লেগে গেছে। তাওহীদ প্রভাকে দেখে তেমন অস্থির বোধ করল না। যেন তারা যুগ-যুগ ধরে একে অপরকে চেনে এমন আন্তরিক কণ্ঠে বলল,

– অবশেষে আসছেন, সুপ্রভা? নেন, বসেন।

প্রভা অল্পতে অধিক বিরক্ত হওয়া মানুষ। তাওহীদের এমন আপ্যায়ন ভাব দেখে প্রভার কপাল নিজ শক্তিতে কুঁচকে গেল। বিরক্তিতে জিহ্বের ডগা তেতো হলো। তাওহীদের এমন আন্তরিক স্বরের কথা প্রভার গা খামছে ধরল। উত্তপ্ত হয়ে বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বলল,

– আপনার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে আমি আপনার সাথে প্রেম করতে এসছি। আপনি বললেন, অবশেষে এসছেন সুপ্রভা? কথাটা কেমন শোনাল জানেন? প্রেমিকরা অভিমান করে প্রেমিকাদের কাছে যেভাবে অভিযোগ করে তেমন শুনাল। আচ্ছা জনাব তাওহীদ আলম, আমাদের সম্পর্কটা কী প্রেমের সম্পর্ক? আমি কী এখানে আপনার সাথে প্রেম করতে আসছি?

প্রভার এমন জ্বলা কণ্ঠের বিদ্রুপে তাওহীদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এরপর সরল কণ্ঠে বলল,

– তা তো আমি জানি না, সুপ্রভা।

প্রভা নিজের রাগ নিবৃত্ত করতে অন্যদিকে চেয়ে রইল। ক্ষণে ক্ষণে রাগের পারদে শরীর পূর্ণ হয়ে যাওয়া তার অন্যতম বাজে স্বভাব। প্রভা কোমড় থেকে হাত নামিয়ে তাওহীদের দিকে ঘুরল। তাওহীদের শ্রীহীন মুখে চেয়ে ঠান্ডা, স্থির তবে অতিমাত্রায় তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,

– নিজেকে খুব চালাক ভাববেন না। এবং মোস্ট ইম্পোর্টেন্ট নায়ক কিংবা স্মার্ট সাজার চেষ্টা করবেন না। আপনি ভীষণ ভালো করেই জানেন আপনি-আমি এখানে কেন এসছি। আমি আপনাকে আসতে বলেছি, তাই আপনি এসছেন। এবং আমি কী কারণে আসতে বলসি আমার ধারণা তাও আপনি জানেন। অথচ এইমাত্র ভীষণ ন্যাকা কণ্ঠে বলে দিলেন আপনি কিছু জানেন না।

তাওহীদের উজ্জ্বল মুখ কিছুটা নিভে গেল। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। হাসতে চেষ্টা করে বলল,
– আপনি অযথা রাগ করতেসেন। দাঁড়িয়ে থেকে কতোক্ষণইবা কথা বলা যাবে বলেন। একারণেই বসতে বলসিলাম।

– সেটা আমি বুঝব।

প্রভা নিজের ঠাঁট বজায় রেখে নিজের অবচেতনেই মাঠ পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। কী সুন্দর সবুজ, সুবিশাল প্রান্তর! মাটির বুকে যেন মাদুর পেতে বসেছে। দেখলেই ইচ্ছে হয় চট করে প্রেমে পড়ে যেতে। অবশ্য প্রভা বহুদিন আগেই এই মাঠের প্রেমে পড়েছে। এই মাঠটিকে প্রভা অদৃশ্যভাবে ভীষণ পছন্দ করে, ভালোবাসে। অদৃশ্যভাবে করে কারণ তার এই পছন্দের কথা কেউ জানে না। প্রভা কাউকে বলেনি। জন্ম থেকেই প্রভারা এখানে স্থায়ী বাসিন্দা। আগে স্কুল থেকে ফেরার সময় প্রায়ই প্রভার ইচ্ছে হতো মাঠে সবার সাথে মিশে খেলাধুলা করতে। কাবাডি , জুতা-চোর, মাংস-চোর, কানামাছিসহ নানাবিধ বিচিত্র খেলা খেলতে। নিজের শৈশব টাকে একটুখানি আদর-আহ্লাদে গড়ে তুলতে। কিন্তু সে খেলতে পারেনি। তাকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। এতে প্রভার মন যে মুমূর্ষু পাতার মতো ঝড়ে পড়েছে, সে খেয়াল কেউ রাখেনি। কারো তেমন কিছু যায় আসেনি; প্রকৃতি তার নিয়মেই অটল ছিল। এই মাঠের প্রতি প্রভার ভালোবাসা এতই প্রবল, এতোই গাঢ় ছিল যে প্রায় রাত, দিনই সে নিজের চক্ষুজলে বালিশ ভেজাত, কেবলমাত্র মাঠে কিছুসময় খেলবে বলে। তবে তার চাওয়াটা বোধহয় কিছুটা বেশি ছিল, তাই আর পাওয়া হয়ে ওঠেনি। এরপর সময় গেল। ধীরে ধীরে প্রভা বড় হলো, সাথে দৃশ্যমান থেকে অদৃশ্য হলো প্রভার ভালোবাসা। এখন সে চব্বিশ বছরের যুবতী। ভার্সিটির তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করে। একা একা প্রায় সবখানেই চলাফেরা করে। অথচ এই মাঠে আর আসা হয়না। চলাফেরার পথে যদিওবা চোখ পড়ে, ভীষণ কঠিন এক অভিমানে চোখ সরিয়ে নেয়। এখন অভিমানটা কার ওপর হয় সে নিয়ে আর ভাববার সময় হয়ে ওঠেনি। এরপর অনেকদিন পর তাওহীদের ঘটনায় বিরক্ত হয়ে প্রভা যখন দ্বিতীয়বারের মতো মুদির দোকানে গেল, ভাগ্য সহায় হয়ে তখনো তাওহীদ বাদে দোকানে অন্যকেউ ছিল না। প্রভা নিজের বিরক্তি সব চেপে গিয়ে কেবলমাত্র বলে,
– আপনার সাথে আমার কিছু প্রয়োজনীয় কথা ছিল। আগামীকাল বিকেল ৪ টায় শাপলা স্বরণীর মাঠটায় থাকবেন। সেখানেই কথা হবে। আমি অপেক্ষা করব।

এতো এতো জায়গা থাকতে প্রভা এই মাঠটার নামই কেন নিয়েছিল, তা সে জানে না। হঠাৎ মনে হলো, অভিমান নামক তুচ্ছ ব্যাপারকে পাশে রেখে এই মাঠে আসাই যায়, ব্যাসস! চলে এলো। প্রভা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাঠে তো আরোও বহুবার আসা যাবে, কিন্তু শৈশব, কৈশোর এর যে শখ, খুশি সেগুলো কী ফিরে আসবে?
প্রভা তাওহীদের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। তাওহীদ এতোক্ষণ যাবত বসে ছিল এই মাঠের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানে। এই মাঠের একপাশে আছে স্বচ্ছ জলের একটা মাঝারি আকৃতির দিঘি। দিঘির দিকের মাঠটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে টলটলে জলের সাথে। সেখানেই বসে অপেক্ষার প্রহর গুণছিল তাওহীদ। প্রভারও ইচ্ছে হলো এই ঢালু অংশে তাওহীদের মতো পা গুটিয়ে বসতে। ইচ্ছে হলো, স্বচ্ছ জলে নিজের মন খারাপকে ভেলায় তুলে ভাসিয়ে দিতে। কিন্তু চাইলেও প্রভা তার কিছুই করল না। এখানে বসে যাওয়ার অর্থ তাওহীদের কথা মেনে নেওয়া। হেরে যাওয়া। জীবনের বড় বড় অংশে হেরে গিয়ে ছোট ছোট ব্যাপারে আর হারতে ইচ্ছে হয়না প্রভার; অহংকার ঠিকরে বেরিয়ে পড়ে। সেকারণেই প্রভা বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল সামনের ফাঁকা বেঞ্চের দিকে।

– তো বলুন মিস্টার আলম, আপনার দিনকাল যাচ্ছে কেমন?

প্রভার তীক্ষ্ণ কণ্ঠে তাওহীদ ঘাড় ফিরিয়ে প্রভার চোখে তাকাল। নির্লিপ্ত মুখে হাসি টেনে বলল,

– আমার দিনকাল বেশিরভাগ সময়ই ভালো যায়।

– বাহ! তাহলে তো ভালোই।

প্রভা চুপ করে গেল। তাকে চুপ করিয়ে দিল দখিনা বাতাস। সুন্দর, মিষ্টি বাতাসে প্রভা নিজের আলাপ বাদ দিয়ে বাতাসের মিষ্টি গন্ধ নিতে চাইল। ঠিক তখনই তাওহীদ কিঞ্চিৎ কৌতূহলী হয়ে শুধাল,

– আপনি আমাকে কিছু বলবেন বলসিলেন।

প্রভা বাতাসের গন্ধ নেওয়া ছেড়ে তাওহীদের দিকে তাকাল। তাওহীদের চেহারা দেখে কিছুক্ষণ আগের হারিয়ে ফেলা জেদ আবারো মাথায় চেপে বসল। ক্ষিপ্ত হয়ে রহস্য করে বলল,

– এই জেদ কবে বন্ধ করবেন জনাব তাওহীদ আলম?

তাওহীদ কিছুক্ষণ পিটিপিটিয়ে তাকিয়ে থেকে বলল,

– বুঝতে পারলাম না।

– কিন্তু আমি যে বুঝেছি আপনি আমার সাথে জেদ দেখাচ্ছেন। আমি আপনাকে সেদিন বললাম নিজেকে সংযত করতে। আমার দিকে, আমার বারান্দায়, আমার ঘরে অভদ্রের মত তাকিয়ে না থাকতে। অথচ আপনি তাই করে চলেছেন। আমি আপনাকে যেদিন বললাম দূরত্ব রেখে চলতে, তার পরের দিনই আপনি চলে এলেন আমার রিকশাওয়ালাকে ভাংতি দিতে। কেন? আমি চেয়েছিলাম? ভাংতি দিয়ে কী প্রমাণ করতে চাইলেন আপনি? আপনার জেদ আমার থেকেও বেশি? আপনি আমার কথা মানবেন না – এটাই তো?

তাওহীদ সরল কণ্ঠে বলল,
– আমি এতোকিছু ভেবে আসি নাই। আপনার শুকনো মুখ দেখে মনে হইসিল টাকাটা দিলে আপনার উপকার হবে। তাই দিসিলাম।

প্রভা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বলল,
– দোকানে বসেন কাজ করতে নাকি মেয়েদের সমস্যা দেখতে?

প্রভার মুখে এমন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা শুনে তাওহীদ কিছুটা থমকাল। মনে মনে আহত হলো। চোখ তুলে প্রভাকে দেখে হাসার চেষ্টা করে বলল,

– আপনি কিন্তু অনেক তুচ্ছ বিষয় নিয়ে রাগ করতেসেন, সুপ্রভা।

প্রভা ভ্রু কুঁচকে চাইল,
– আমার দিকে একটা পুরুষ নির্লজ্জের মত তাকিয়ে থাকে এটা আপনার কাছে তুচ্ছ মনে হয়? আমার সাথে অভদ্রতামি করা তুচ্ছ মনে হয় আপনার?

এ পর্যায়ে তাওহীদ কোনো কথা বলতে পারল না। ম্লান চোখে চেয়ে রইল। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,

– কেউ যদি কোনো মানুষকে দেখে খুশি হয়, তাহলে কী তার দিকে তাকানোটা অপরাধ? আপনাকে দেখলে আমি একটু খুশি হই। একারণেই তাকাই। আমার তাকানোতে অন্য কোনো অর্থ নাই, সুপ্রভা। আপনি ব্যাপারটাকে বড় করতেসেন শুধু শুধু।

তাওহীদের উত্তরে ভীষণ রকমের বিরক্ত হলো প্রভা। উত্তপ্ত কণ্ঠে বলল,

– দুনিয়াজোড়া মানুষকে খুশি করতে বসে নাই আমি। একে তো দোষ করেন, আবার সেটা উঁচু গলায় বলেনও? আর কী সুপ্রভা, সুপ্রভা শুরু করসেন! আমাকে এইভাবে নাম ধরে ডাকার অধিকার কই পান আপনি?

তাওহীদ তার সরল মুখটা কিঞ্চিৎ গম্ভীর করে বলল,
– আচ্ছা। এখন থেকে আমি তবে আপনাকে ভদ্রমহিলা বলে ডাকব। চলবে, ভদ্রমহিলা?

এহেন গুরুগম্ভীর এক আলোচনার মাঝে অকস্মাৎ এমন ধরনের সস্তা রসিকতা শুনে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইল প্রভা। ক্ষণকালের জন্য কথা বলতে ভুলে গেল। এরপর যখনই আশ্চর্য ভাবটা একটু কাটল, ভেতর থেকে রাগেরা ফোঁস ফোঁস করে ফণা তুলে বের হতে চাইল। সামনে দাঁড়ানো এই ফালতু শ্রেণীর পুরুষটিকে ভীষণ রকমের চতুর বলে বোধ হলো। এরপর একদফা হতাশা কাজ করল নিজের প্রতি। মনে হলো, কিছুক্ষণ আগের বলা এই ফালতু লোকের কথাটা ততোটাও ভুল ছিল না। সে আসলেই ভীষণ তুচ্ছ একটা ব্যাপারে এই ফালতু লোকের সাথে কথা বলতে এসেছে। প্রকৃতঅর্থে, তার এখানে আসার কারণটা মোটেও তুচ্ছ নয়। জনাব তাওহীদ আলমকে বলা কথাগুলোও তুচ্ছ, অর্থহীন ছিল না। সে একটা সমাধানে আসার প্রচেষ্টা চালিয়েছে মাত্র। প্রভা নিজেকে প্রবোধ দিল যে সে ঠিকই করার চেষ্টা করেছে। তবে এতো এতো ঠিকের মাঝে যে বেঠিক সে হলো জনাব আলম নিজে। একটা মানুষ তার সাথে গুরুতর আলোচনায় বসেছে, আর সে কিনা সেখানে রসিকতা জুড়ে দিয়েছে! প্রভা তার পাশে দূরত্বে থাকা মানুষটার প্রতি এতো হতাশ হলো যে, বলার মত কিছু পেল না। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

– আপনার মত ফাজিল, উগ্র, বেয়াদব একটা মানুষের পিছনে আমি আমার জীবনের পঁয়ত্রিশ’টা মিনিট নষ্ট করলাম – এটা ভাবতেই মনে হচ্ছে ওই দিঘির জলে ডুবে মরি। আর হ্যাঁ, আপনি চাইলে আমাকে ভদ্রমহিলা ডাকতেই পারেন। আমার তরফ থেকে কোনো অসুবিধা নেই। ভদ্রমহিলা ডাক ফার বেটার আদর মেশানো সুপ্রভা ডাকের থেকে। আসছি।

তাওহীদ অবিলম্বে উঠে দাঁড়াল। সুপ্রভার সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ আগের করা অপরাধে কিঞ্চিৎ অনুতপ্ত হয়ে বলল,

– রাগ করলেন সুপ্রভা? আমি দুঃখিত। আমি বুঝতে পারিনাই আপনি কষ্ট পাবেন। একটু হাসাতে চাইসিলাম শুধু।

সুপ্রভা তাওহীদের দুঃসাহসে বিস্মিত হয়ে বলল,

– নিজেকে এতো প্রায়োরিটি কেন দিচ্ছেন বুঝতে তো পারছি না। আপনি কে? আপনার কথায় আমি কষ্ট কেন পাব? আর আমাকে হাসাতে চাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করার অধিকারটাও আমি আপনাকে দেইনি। আপনার সাথে আমার পরিচয় কয়দিনের? দিন তো দূর, ঘন্টারও তো না। এসেছিলাম ভালোমত কথা বলতে অথচ সে সুযোগও পেলাম না। আপনার মত আদবহীন মানুষের সাথে কোনো ভদ্র কথা হতে পারেনা। ভালো থাকবেন। আর যদি নিজের মাঝে মিনিমাম ভদ্রতা থাকে তবে আশা করব এরপর থেকে আমাকে এমন মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন।

প্রভা চলে যেতে নিলে তাওহীদ দ্বিতীয়বারের মত পথ আগলে দাঁড়াল। ব্যগ্র কণ্ঠে বলল,

– আচ্ছা যাচ্ছেনই যখন এটা নিয়ে যান।

প্রভা চোখ নামিয়ে তাওহীদের হাতে তাকাল। তাওহীদ সহাস্য মুখে বলল,

– আপনাকে বললাম না, সুপ্রভা? আপনাকে দেখলে আমার ভালো লাগে। আমি খুশি হই। ভাবলাম, যে মানুষটা আমাকে খুশি করে তার সাথে প্রথম দেখা এমন নিরামিষ, আয়োজনহীন কেমন করে হতে পারে! একারণেই আপনাকে দেবার জন্য এক প্যাকেট বাদাম কিনে রাখসি।

প্রভা আশ্চর্য হয়ে শুধাল,
– আর আপনার ধারণা আমি এই বাদাম নিব?

– নেবেন না?

তাওহীদের এমন প্রশ্নে প্রভা পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ আশ্চর্য হয়ে বলল,
– আমার নেওয়া উচিত?

– সবকিছুর মাঝে উচিত-অনুচিত খুঁজতে নাই।

– আমাকে যেতে দেন তো। আর কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে নিশ্চিত আমাকে হাসপাতালে নিতে হবে। আপনার এমন দুঃসাহস দেখে মূহুর্তে মূহুর্তে আকাশ থেকে টপকাচ্ছি আমি।

– আপনি যান, মানা তো করি নাই। বাদামগুলি নিয়া যান।

প্রভা নিজের দম্ভে অটল থেকে বলল,
– আপনি কে যে আমি আপনার থেকে কিছু নিব? আমি আপনার দেওয়া কিছুই নিব না। পথ ছাড়েন।

তাওহীদকে দমানো গেল না। আদুরে কণ্ঠে বলল,
– আমি যে আপনার কেউ না সেইটা আমি জানি, সুপ্রভা। তবুও বাদাম নেয়ার জন্যে যদি সত্যিই কোনো সম্পর্কের দরকার হয়, তাহলে ধইরা নিন না যে আমি আপনার জীবনের খুব অপ্রয়োজনীয় কোনো মানুষ। আপনার জীবনে তো অনেক প্রয়োজনীয় মানুষ আছে। এতো এতো প্রয়োজনীয় মানুষের ভিড়ে একজন অপ্রয়োজনীয় মানুষরে জায়গা দেওয়া যায়না?

তাওহীদের এমন কথায় প্রভা তাওহীদের ফ্যাকাসে, কৃষ্ণবর্ণ মুখে চেয়ে রইল। তাওহীদ আবারো মিনতি করে বলল,
– সুপ্রভা, নিয়া যান। দেখেন, আপনারে দিব দেইখা আমি বসে বসে সবগুলি বাদামের খোসা ছাড়াইসি। দেখেন।

তাওহীদ ব্যস্ত হয়ে প্রভাকে দেখাতে চাইল নিজের যত্ন, শখ। প্রভা অতি সাধারণ একটি খবরের কাগজ দিয়ে বানানো ঠোঙার ভেতরে তাকিয়ে দেখতে পেল তাওহীদের কথার সত্যতা। প্রভার কী হলো কে জানে, সে নিজের সমস্ত একাগ্রতার সাথে চেয়ে রইল খোলসহীন, লাল আস্তরণবিহীন কিঞ্চিৎ হলদে বাদামের দিকে।
তাওহীদ হয়তো কিছু বলছে, তবে সে কথা প্রভার কানে প্রবেশ করছে না। তাওহীদ প্রভাকে ডেকে উঠল,
– সুপ্রভা, নেন না।

তাওহীদের এমন ডাকের এই পর্যায়ে প্রভা ভীষণ দৃঢ়ভাবে তাওহীদের বাড়ানো ঠোঙাটা চেপে ধরল। ঠোঙা নিয়ে বিনা বাক্যব্যয়ে চলে যেতে চাইলে তাওহীদ এবারেও বিঘ্ন সৃষ্টি করল। ডেকে উঠল,
– সুপ্রভা?

প্রভা তাওহীদের ডাকের সাড়া দিতে অসাড়ভাবে নিজের দৃষ্টি ঘুরিয়ে চাইল। লোকটার মুখ হাস্যোজ্জ্বল বর্ণ ধারণ করে আছে। সহসা হাসির আভা কেটে গিয়ে কিছুটা গম্ভীর দেখাল। তাওহীদ এক পা এগিয়ে এসে ভীষণ আদর দিয়ে বলল,

– হুটহাট রাইগা যাবেন না। অল্প কথায় রাগ করেন। পরে নিজেই কষ্ট পান। রাগার আগে কমসে কম তিন চারবার ভাববেন যে রাগ করাটা যুক্তিযত কিনা, যদি দেখেন আপনের রাগ যুক্তিযত। তাইলে অবশ্যই রাগ করবেন। এইভাবে ভাইবা চিন্তা রাগ করলে পরে নিজের রাগের জন্য কষ্ট পাবেন না। আল্লার দোহাই এখন আবার রাইগা যাইয়েন না। আপনার জীবনের অপ্রয়োজনীয় মানুষ হিসেবে একটা পরামর্শ দিলাম শুধু। আর বাদাম গুলা তাড়াতাড়ি খাইয়া ফেইলেন। নয়তো পুতায় যাবেগা।

প্রভা পূর্ণচোখে তাকিয়ে রইল তাওহীদ নামক আশ্চর্যজনক অতি সাধারণ মানবের দিকে। তাওহীদও একইভাবে তাকিয়ে রইল প্রভার দিকে। সাথে দেখতে পেল প্রভা নামক রমণীর চোখ থেকে ঝরে পরা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মত ঝিরিঝিরি বিস্ময়!

চলবে-
_______
#অকিঞ্চন
#শারমিন_ইরান