অকিঞ্চন পর্ব-০৫

0
129

গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – পাঁচ (অর্ধাংশ)
_____

খিড়কি গলিয়ে রোদের আলো আছড়ে পড়ছে খসখসে দেয়ালে । সেই নরম আলোর কিছু অংশ খাবার টেবিলে পড়ায় টেবিলে থাকা ভাজি, রুটির বোল আরোও হলদেটে, আরোও একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। টেবিলে বসে আছেন প্রভার বাবা, প্রভা এবং নিশী। সবাই আশ্চর্য এক বিছিন্নতার সাথে তাদের সকালের নাস্তা সারতে ব্যস্ত। ছোট একটি পরিবার। সামাজিক ভাবে উচ্চবিত্ত শ্রেণীরই ধরা যায়। সৃষ্টিকর্তা তাদের ঘর জুড়িয়ে বিলাসবহুল আসবাবপত্র দিয়েছেন, সামাজিক মর্যাদা দিয়েছেন, আর্থিক সফলতা দিয়েছেন অথচ কোথাও যেন বিশাল বড় একটা কিছুর অভাবে অভাবী করে রেখেছেন। চার পায়ের কাঠের ব্যস্ত টেবিলে শেষ দু’টি রুটি রেখে প্রভার মা মাহমুদা নিজেও বসে গেলেন। খেতে আরম্ভ করে মাঝ পর্যায়ে প্রভার বাবা মিনহাজকে প্রশ্ন করলেন,

– আজকে তো অফিস নাই। বাইরে কই জানি যাবা বলসিলা? এখনি যাবা নাকি আরেকটু পরে?

– এখনি যাব। অফিসের একটা কাজ নিয়ে উত্তরা যাইতে হবে। ওইখানে আবার রাজিবের কাছে যাব। অনেকদিন ধরে যাইতে বলতেসে।

মাহমুদা আগ্রহের সাথে সাথে কিছুটা হতাশা নিয়ে মিনহাজকে মনে করিয়ে দিলেন,
– যাওয়ার সময় মনে করে প্রভার দুইটা ছবি নিয়ে যাইয়ো। তোমার রাজিব বন্ধুই তো বলসিল না মেয়ের ছবি দিয়ে রাখার কথা? নিয়ে যেও।

মিনহাজ সাহেব দ্বিরুক্তি করলেন,
– আজকেই? আজকে যাব একটা কাজে। অন্যদিন নিব নি।

মাহমুদা এবার কঠিন গলায় বললেন,
– কীসের অন্যদিন? আজকেই নিয়ে যেও। যতো আগে দেওয়া যায়। এইবার যদি আল্লাহ একটু দেখে। নিয়ে যাইয়ো। টেবিলের ড্রয়ারেই আছে। থ্রি-পিস পরাটা নিও না, শাড়ি পরা যেই দুইটা আছে, নিয়ে যাইয়ো।

ইতোমধ্যে নিশীর তার খাওয়া শেষ করে স্কুলের জন্য তৈরি হওয়া শেষ। দু’ কাঁধে দু’টো বেনী ফেলে সরল গলায় বলল,
– মা, দুইশো টাকা দাও।

মাহমুদা খাওয়া বাদ দিয়ে কৈফিয়ত চাইলেন,
– কেন? কী করবি?
– আমার বন্ধু রিমির জন্মদিন। ওর জন্য স্কুলে যাওয়ার সময় কিছু কিনে নিয়ে যাব।

মাহমুদা নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে শুধালেন,
– ওই মেয়ে তোর জন্মদিনে কী দিসে?

নিশী সগর্বে উত্তর দিল,
– আমার এক্টিভ স্কুল পছন্দ
বলে একটা এক্টিভ স্কুল দিসিল।

– ওইগুলার দাম কত?

– ৫০ টাকা।

মাহমুদা হেসে ফেললেন। হাসিপূর্ণ কণ্ঠে বললেন,
– ৫০ টাকার জুসের বিপরীতে ২০০ টাকার উপহার দিবি?

পনেরো বছর বয়সী নিশীর মায়ের তাচ্ছিল্যেতা বুঝতে মোটেও অসুবিধা হলো না। মূহুর্তেই উজ্জ্বল শ্যামলা মুখটি শুকিয়ে ছোট হয়ে গেল। শীতল কণ্ঠে শুধু বলল,
– ওর বাবা সবজি বিক্রেতা। ওর কাছে পঞ্চাশ টাকাই তো অনেক টাকা।

– সবজি বিক্রি করে ওদের সংসার চলে?

– হ্যাঁ।

– বেতন দেয় কীভাবে?

– শুধু ১৫ টাকা দেয়। বাকি বেসরকারি ফি আবেদন দিয়ে মওকুফ করে নিসে।

– ও! ভুলেই তো গেসিলাম যে সরকারি স্কুল। আচ্ছা যাহ। গিফট টিফট দিতে হবে না। এই বয়সে আমাদের কোনো বন্ধু ছিল না। খালি পড়ায় মন দিসি। ভালো রেজাল্টে বন্ধুর অভাব হয়না। যাহ, স্কুলের জন্য দেরি হয়ে যাবেনি।

নিজের মায়ের তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথার বিপরীতে নিশী কিছু বলার সাহস পেল না। নীরবে জায়গা ত্যাগ করল।

মাহমুদা আপনমনে বিরবির করতে লাগলেন,
– এই বয়সে পইড়া কুল পাইনাই আর আসছে বন্ধু নিয়া। তাও আবার যার বাপ কিনা সবজি বিক্রি করে। খোদা তা’য়ালা যে আমার পেটেই কেমনে এইগুলারে দিসে! একজনের পড়ার খবর নাই অন্যজনের বিয়ার খবর নাই। মানুষের এক দিক তো থাকে! আমার পেটেরডির কোনো দিকই নাই। চেহারাটা খালি সাদা’ই দিসে আল্লাহ। চেহারা সাদা দিয়া কী হইব যদি অলক্ষী হইয়া দুনিয়ায় আসে। বাইরে গেলে সবার এক কথা, ভাবি বড়টার বিয়া কবে দিবেন, অমুক কবে… তমুক কবে। গর্ব আর করতে পারলাম না। অন্যদিকে নিচের বাসায় এক বছরের ছোট মেয়ের বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হইয়া আবার বিয়াও হইয়া যাইতাসে। সবই কপাল।

মাহমুদা নিজের মনের কথা আওড়াতে আওড়াতে টেবিল পরিষ্কার করতে শুরু করলেন। তার ভাবভঙ্গিতে মনে হলো, প্রভা নামের কেউ যে তার সামনেই বসা তা যেন সে দেখতেই পাচ্ছেন না। প্রভা শুরু থেকেই নীরবদর্শক হয়ে কেবল শুধু দেখে গেল। নিজের মায়ের কোনো কথাই তার কান এড়িয়ে যায়নি। উপরন্তু, তার মা যে তাকে শোনাতেই এতোসব বিলাপ করলেন তাও প্রভার জানা। তবে এতোসব কিছুতেও প্রভা তার মাকে ভীষণ ভালোবাসে, সম্মান করে। কেবল…কেবল মাঝেমধ্যে আকাশসমান হতাশায় ভেঙে পড়ে মনে হয়, তার মায়ের মানসিকতা একটু ভালো হলেও বোধহয় হতো। তার মা অন্যদের একটু সম্মান জানাতে জানলেও বোধহয় হতো। আবার মাঝেমধ্যে নিজেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে এই ভেবে যে, মানসিকতায় সমস্যা হয়তো প্রভার নিজেরই। তার মায়ের না। তার মা তো এককালীন শিক্ষক ছিলেন। একজন শিক্ষকের মানসিকতা নিশ্চয় খারাপ হবে না। প্রভা শান্তভাবে পানি পান করে উঠে পড়ল। এইসব নতুন কিছু নয়। এইসবে আর তার কষ্ট হয় না। সে এখন সবকিছুই মানিয়ে নিতে পারে। নিজের মাঝে থেকে থেকে শিখে গেছে।

প্রভা ঘরে ঢুকে দেখল নিশী ব্যাগ গুছিয়ে মাত্রই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরুবে। প্রভা তৎক্ষনাৎ ডেকে উঠল,
– নিশী, শোন!

নিশী ঘুরে সরল, শুকনো মুখে উত্তর নিল,
– বলো, আপা।

প্রভা তার ব্যাগ থেকে আড়াইশো টাকা নিশীর দিকে বাড়িয়ে কঠিন গলায় বলল,
– নে। আমার কাছে আর নেই। আগে জানলে রেখে দিতাম পাঁচশো টাকা।

কিছুক্ষণ আগের ঘটনার প্রভাবে নিশী মাথা নিচু করে বলল,
– লাগবে না, আপা।

– অবশ্যই লাগবে। নে চুপচাপ। দুইশো টাকা দিয়ে কী কিনতে চাইছিলি তা কিনে দিস। আর পঞ্চাশ টাকা দিয়ে এক্টিভ স্কুল কিনে খাস।

নিশী হাত বাড়িয়ে টাকা নেয়। প্রভা আবারো বলে,
– তোর বন্ধু তোকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী উপহার দিয়েছিল। এখানে উপহার দেওয়াটা দামী নয়, তোর বন্ধু যে দিয়েছে, দেওয়ার ইচ্ছাটা পোষণ করেছে এইটাই দামী। তাই তুই’ও নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী দে। বন্ধুত্বে বাবার টাকা আসা উচিত না। কখনো এ নিয়ে ওকে কিছু বলবিও না। আর মাকে এই টাকা নিয়ে কিছু বলিস না।

নিশী চঞ্চলা-পাখি। আপার মুখে এমন কথা শুনে উজ্জ্বল মুখে জড়িয়ে ধরে দৌড়ে চলে গেল। প্রভা নিশ্চল চোখে দেখল নিজের অষ্টম শ্রেণিতে পড়া বোনের মুখের উচ্ছ্বাস। এরপর পাশেই একবার আয়নায় তাকিয়ে নিজের দিকে তাকাল। কেমন নির্জীব মুখ তার! কোনো হাসি নেই কিছু নেই। সবসময়ই নিজেকে আড়াল করে রাখা। অথচ সেও একদিন নিশীর মতো উড়তে চাইতো। একদিন তারও অল্প কথাতেই, অল্প খুশিতেই দিনভর মুখ উজ্জ্বল হয়ে থাকতো। প্রভা নিজের নিষ্প্রাণ মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবল, একদিন নিশীও কী এমন প্রাণহীন হয়ে যাবে! একদম তার মতো? একদিন নিশীও কী সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শিখে যাবে? একদিন নিশীর’ও কী এই দুনিয়া জুড়ে তার মতো অভিযোগেরা ভেসে বেড়াবে? তার মতো অভিযোগ! নাহ, তার কোনো অভিযোগ নেই। তার অভিযোগ থাকা উচিত না।

চলবে ~
______
#শারমিন_ইরান
#অকিঞ্চন