গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – দশ
_____
টবিলে মাথা ফেলে বিমূঢ় হয়ে পড়ে আছে প্রভা। বুক ভর্তি উত্তেজনায় নিজেকে স্থির করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। আজ সে কী করল, কেমন করে করল! তাওহীদকে বন্ধুত্বের প্রস্তাব দিল! এতো সহজে! হ্যাঁ, দিয়েছে। তার দ্বারা লুকোছাপায় কিছু হয় না। তাওহীদকে দেখল, জানল, কথা হলো; এরপর হঠাৎ করেই মনে হলো মানুষটা বন্ধু হিসেবে হয়তো খারাপ হবেনা। কোনো কিছুতে হয়তো তাকে বিচার করবেনা। কখনো তাকে হয়তো অন্যদের সঙ্গে তুলনা করবে না। কেবল তাকে বুঝবে, তার সঙ্গের সাথী হবে। ব্যাস, বন্ধুত্বের প্রস্তাব দিয়ে বসল। প্রভার বন্ধুত্বের তালিকায় কখনোই বড় সংখ্যায় কেউ ছিল না। এতোকাল যাবত ছিল একজন; আজ যোগ হলো আরেকজন। আচ্ছা, তাওহীদকে বন্ধু বানানো কী ভুল হলো? হলে হোক, জীবনে এতো ভুল করতে পারলে, এই ভুলটাও নাহয় থাকুক।
প্রভা দৃষ্টি উঠিয়ে ঘড়িতে চাইল। ১ টা ১০ মিনিট। ঘুমানো প্রয়োজন। কাল আবার একবার আফরিনের সঙ্গে দেখা করতে হবে; অনেকদিন যাবত মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয় না। বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়েছিল বিধায় ভার্সিটিতেও দেখা হয় না। কাল ম্যাসেজ করেছিল। জানাল, সুস্থ হয়েছে। প্রভা হাত বাড়িয়ে পার্সটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। সে প্রায়শই পার্স নিতে ভুলে যায়। কাল ভুললে চলবে না। কাল যাওয়ার সময় কিছু ফলমূল আর আফরিনের প্রিয় খাবার নিয়ে যেতে হবে। সুপ্রভা শ্বাস ফেলে আবারো মাথা নামিয়ে ফেলল। তার জীবনে বন্ধুত্বের সংখ্যা কখনোই দীর্ঘ হয়নি। ছোটকালে যদিওবা অন্তর্মুখী স্বভাবটা এতো গাঢ় ছিল না, তবুও কেন জানি তার কোনো বন্ধু থাকত না। সবার দুমুখো ব্যবহার কিংবা হিংসাত্মক মনোভাবে প্রভার আর বন্ধু বানানোর ইচ্ছে হতো না। মনে হতো, কী হবে বন্ধু না হলে। বন্ধুর অভাবে প্রভা নিশ্চয় মারা যাবে না। এরপরই একদিন আবির্ভাব ঘটল আফরিনের। মেয়েটা এতো পরিমাণে চঞ্চল! মুখ থেকে দশ কথা বেরোলে মাঝের সাত কথাই থাকে অবান্তর আলাপ। অবান্তর কথা বলুক, প্রভাকে তো বোঝে, প্রভাকে তো শোনে – এতেই চলবে। এমনিতে আফরিন মানুষ হিসেবে দারুণ। প্রভার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষের মাঝে সে অন্যতম একজন। প্রভা মলিন হাসল। ঠিক করেছে সামনের ইদে আফরিনকে একটা জামা উপহার দেবে। কেমন হবে? নিশ্চয় মেয়েটা খুশি হবে। আফরিনের পরিবার নিম্ন-মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে হয়ে প্রায়ই আফরিন বুক ভর্তি হতাশা, আক্ষেপ নিয়ে নিজের শখের কথা বলে। দু’ চোখ ভর্তি স্বপ্নের গল্প করে। প্রভা মুগ্ধ হয়ে শোনে। প্রভা আর আফরিনের শখের মধ্যে একটি মিল আছে। দু’জনেই বই পড়তে পছন্দ করে। একারণেই তো প্রভা আফরিনকে প্রায়শই বই উপহার দিয়ে থাকে। উপহার পেয়ে আফরিনের মুখে যে উজ্জ্বলতা, যে খুশির দেখা মেলে, প্রভার জন্য সে খুশি মূল্যে অপরিমেয়। আফরিনের মুখভর্তি হাসি, জ্বলজ্বলে দু’টো চোখ যে প্রভার হৃদয়ে কতো প্রশান্তির, কতো শীতলতার, কতো আনন্দের ছাপ ফেলে যায়, তা হয়তো সেভাবে কখনো বলে ওঠা হবেনা। কাল প্রভা দেখা করবে তার দু’জন প্রিয় মানুষের সঙ্গে। এক আফরিন, দুই তাওহীদ। প্রভা অপেক্ষায় রইল এক নরম, সুন্দর দিনের।
_____
দিঘীর অনাবিল জলে কারো ছায়া পড়তেই তাওহীদ ঘাড় উঁচিয়ে চাইল। সুপ্রভা দাঁড়ানো। আচ্ছা, সুপ্রভা নামের অর্থ তো সুন্দর আলো কিংবা সুন্দর সকাল। তবে কী নিজের নামের সার্থকতার প্রকাশ ঘটাতেই সুপ্রভা আজ সাদা রঙ পড়ে এসেছে? তাওহীদ বিভ্রান্তি ভর্তি দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইল। নাহ, সাদা রঙ স্বচ্ছ; তবে সুপ্রভার মতো নয়। সুপ্রভার কাছে হয়তো দুনিয়ার সকল স্বচ্ছতাই ফিকে পড়ে যাবে। তাওহীদ ঘাড় নামিয়ে নিল। সুপ্রভা সাবলীল ভঙ্গিতে তাওহীদের থেকে যথেষ্ট দূরত্বে গিয়ে ঢালু অংশে বসল। তাওহীদ চোখ তুলে তাকাল। আজ প্রভার চেহারাত অন্যদিনের মতো কঠোরতা প্রকাশিত হচ্ছে না। কেমন যেন শান্ত, মিষ্টি একটা ছায়া পড়েছে মুখটায়। দু’জনের মাঝে থাকা দুঃসহ এই মৌনতার অন্ত ঘটাল তাওহীদ। ফ্যাকাশে পাঞ্জাবির পকেট হাত দিয়ে কিছু একটা নিয়ে এগিয়ে ধরল সুপ্রভার দিকে। সুপ্রভা দেখতে পেল তাওহীদের হাতে একটি ছোট্ট পেয়ারা। তাওহীদ নিজ গরজেই হাসিমুখে বলল,
– নিন, সুপ্রভা। আজ আপনার জন্য উপহার হিসেবে এই পেয়ারাটাই আছে। আমাকে বন্ধু হবার যোগ্য মনে করার জন্য আপনার উপহার।
সুপ্রভা হাত বাড়িয়ে পেয়ারা নিল। বলল,
– দেখে তো কেনা পেয়ারা মনে হচ্ছে না।
– এটা আমার গাছের পেয়ারা।
– গাছের?
– হ্যাঁ, গাছের। আমাদের বাড়ির গাছের পেয়ারা ভীষণ মিষ্টি আর অনেক রসে ভরা। তাই বাড়িতেই আরেকটা বড় টবে ওই গাছের চারা নিয়া বুনসিলাম। তো ঢাকায় আসার সময়ে ওই টবটা নিয়ে আসছিলাম সাথে করে। ইসমাত, হাসান ভাই সবার প্রিয় আমাদের গাছের পেয়ারা। ওদের জন্যেই আলাদা করে আনা। তো আজকে ইসমাত আইসা বলে যে ওই ছোট পেয়ারা গাছে নাকি দুইটা পেয়ারা ধরসে। একটা ইসমাত আর হাসান ভাই খাবে আরেকটা আমারে দিসে। সেইটাই আমি আপনার জন্যে নিয়ে আসছি।
প্রভা স্থবির হয়ে তাওহীদের দিকে চেয়ে রইল। কোথায় যেন শুনেছিল — Its all about the effort. কথাটা বোধহয় সত্য। সামান্য একটা পেয়ারা! তাওহীদ চাইলেই পারতো খেয়ে ফেলতে। চাইলেই পারতো যা কিছু করতে। অথচ… অথচ এই পেয়ারাটাও সে প্রভাকে দিল। প্রভা ভেবে পেল না, সবকিছুর মাঝে তাওহীদ কেমন করে এতো তার কথা ভাবতে পারে। কেমন করে তাকে এতো বিশেষ করে তুলতে পারে। প্রভা পেয়ারার দিকে তাকিয়ে ভাবল, সামান্য একটা বস্তুতেও যে এতো ‘বিশেষ কেউ’ বলে অনুভব করানো যায় তা তাওহীদের সঙ্গে পরিচয় না হলে বোধহয় অজানাই রয়ে যেত। ইফোর্ট! আসলেই হয়তো সবকিছু ইফোর্টের উপরই নির্ভর করে।
– কোথায় হারাই যান, সুপ্রভা?
সুপ্রভা চোখ তুলে বলল,
– ইসমাত কে? আগে তো নাম শুনিনি।
তাওহীদ বলল,
– ইসমাত হাসান ভাইয়ের বোন। ক্লাস টেনে পড়ে। বন্ধে নানার বাসায় গেসিল। গতকাল আসছে। আর আজকে তো ও পেয়ারা না আইনা দিলে জানাই হইতো না যে, আমার গাছে পেয়ারা ধরসে।
তাওহীদ আবারো বলল,
– মেয়েটা এমনিতে ভালো আছে। সারাক্ষণ ভাই, ভাই কইরা বাড়ি মাতায় রাখে। গুণী মেয়ে। হাতের কাজ পারে। সেলাই কাজ করে। আপনার জামা বানানোর হইলে ওর কাছে আসতে পারেন।
সুপ্রভা অধীর কণ্ঠে ডাকল,
– তাওহীদ!
তাওহীদ থমকে গিয়ে থেমে গেল। প্রভা এমন করে কখনো তাকে ডাকেনি। প্রভা আচ্ছন্ন কণ্ঠে বলল,
– আপনি খুব সরল। এতো সরলতা ভালো নয়, তাওহীদ।
প্রভার কথায় তাওহীদ হেসে ফেলল,
– সরলতার কী হইল?
প্রভা উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করল,
– শুনলাম, আপনি নাকি আমাদের বাসার কাজ বিনামূল্যে করে দেন?
তাওহীদ সাবলীল কণ্ঠে বলল,
– বিনামূল্যে মানে কী! টাকার কথা আসবো কেন? আমারে তো কেউ সাহায্য করতে বললেই কইরা দেই। এখন সাহায্য কইরাও যদি টাকা নেই কেমন লাগব? গ্রামে তো কতো মানুষের বাজার কইরা দিসি। এখন কেউ যদি বিপদে পইড়া সাহায্য চায়, করতে তো হইবোই। হইবো না?
প্রভা খানিকটা ব্যাকুল হয়ে বলল,
– এটা গ্রাম না, ঢাকা।
– তাতে কী! ঢাকায় কী সাহায্য করা বারণ নাকি?
– বারণ না। কিন্তু এই যে আপনি আমাদের বাসায় ওইদিন মুরগি এনে দিলেন। বিনিময়ে কী হলো জানেন? আমার মা হাসল।
প্রভার পুরো কথা শেষ না হতেই তাওহীদ মুখ ভর্তি খুশি নিয়ে বলল,
– চাচিআম্মা খুশি হইসে?
কথার মাঝে কথা বলায় রেগে উঠল প্রভা। ক্রোধান্বিত, অস্থির কণ্ঠে বলল,
– পুরা কথা শুনেন আগে! আপনি চিন্তা করতেসেন চাচিআম্মা খুশি হইসে কি না। আর ওইদিকে আমার মা খুশি হইসে এইভেবে যে সে বিনামূল্যে চাকর পাইসে। যখন তখন আপনারে দিয়ে ফরমায়েশ খাটাইতে পারবে, টাকা লাগবে না এইভেবে। আপনি বুঝতেসেন কিছু?
তাওহীদ কিছুটা নীরব থেকে বলল,
– সবাই নিজের কষ্টের টাকার চিন্তা করবে এইটাই তো স্বাভাবিক। তাই না?
সুপ্রভা চোখ গরম করে বলল,
– একদম কথা কাটাবেন না। একদম না। আপনি আর এইসব করবেন না শেষ কথা। আমার বাবা ফোন দিলে মুখের ওপর না বলে দিবেন।
তাওহীদকে কিছুটা বিচলিত দেখাল। বলল,
– চাচারে না করব?
– চাচা?
তাওহীদ সুন্দর হেসে বলল,
– আমার মুখ দিয়া আংকেল-আন্টি বেরোয় না, সুপ্রভা। চাচা, চাচিআম্মা এইগুলা ডাকতেই বেশি আরাম লাগে।
সুপ্রভা কিছু বলল না। নিজেকে কিছুটা শান্ত করে শুধু বলল,
– কথাটা যেন মাথায় থাকে, মিস্টার তাওহীদ আলম। আর জীবনেও যেন এইসব কাজে না দেখি। যারা আপনাকে সম্মান দিবে, তাদের কাজ আপনি ভালোবেসে করতেই পারেন। কিন্তু যারা আপনাকে অসম্মান করবে তাদের দিকে ফিরেও তাকাবেন না, তাওহীদ।
তাওহীদ বুঝল সুপ্রভা রেগে যাচ্ছে। বহুদিন পর ‘তাওহীদ আলম’ ডাকে যে ক্রোধেরা উতলে পড়ছে তা আর বলার বাকি রাখে না। তাওহীদ আদর কণ্ঠে বলল,
– আদেশ করলেন?
প্রভাও বেশ নরম কণ্ঠে বলল,
– অনুরোধ করলাম, বন্ধু হিসেবে। এতোটুকু অধিকার নিশ্চয় আছে।
তাওহীদ কপট অসহায়ত্ব নিয়ে বলল,
– আপনার অনুরোধকে আদেশস্বরূপ নিলাম। বন্ধুত্বের প্রথমদিনেই যে ধমক দিলেন! আল্লাহ জানে পরের দিনগুলোতে জান না কবজ করে নেন!
তাওহীদের এমন রসিকতায় প্রভার মুখে মোটেও হাসি ফুটল না। উপরন্তু, সব মিলিয়ে বেশ বিরক্তির সাথে মুখ কুঁচকে চেয়ে রইল দিঘীর পানে। মনে প্রশ্ন এলো, সে যদি তাওহীদকে এই দিঘীতে চুবিয়ে ওঠায় – তবে কী চুবানি খেয়ে ছেলেটার সরলতা একটু কমবে?
চলবে –
_____
#অকিঞ্চন
#শারমিন_ইরান