অকিঞ্চন পর্ব-১১+১২

0
109

গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – এগারো
_____

জীবনে মানে বোধহয় এক অদ্ভূত-সুন্দর মরীচিকার নাম যার কোনো অর্থই হয়না। জীবনের প্রকৃত অর্থ আসলে কী তা হয়তো কখনো জানা হবেনা, বোঝা হবেনা। মাঝেমধ্যে জীবনের সাথে সাথে সম্পর্ক গুলোর অর্থও বোঝা হয়ে ওঠে না। যে ভাই-বোনের ঝগড়ায় এককালে বাড়ি উল্লাসে পূর্ণ থাকে, জীবনের একটা সময়ে গিয়ে সেই ভাই-বোনই হয়ে যায় একে অপরের বিশেষ অতিথি। যে ভাই-বোনকে মনের সবটা ক্রোধ ঢেলে বিবেচনাহীনভাবে মারা যেত, তর্ক করা যেত, একটা সময়ে গিয়ে সেই ভাই-বোনের সাথেই বেশ বুঝে-শুনে সৌজন্যে কথা বলতে হয়। কেমন আশ্চর্য এই দুনিয়া! কেমন আশ্চর্য সব নিয়ম-কানুন!
তাহমিদা বসে বসে ড্রইংরুমের সকল কিছু পর্যবেক্ষণ করছেন। সে এই বাড়িতে এসেছেন আজ সকালে। গ্রামে তার বড় ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে। উদ্দেশ্যে এখান থেকে তার বড় আপার সঙ্গে একসাথে যাবে। একা একা চলাফেরা তিনি করতে পারেন না। হেতুস্বরূপ সকাল সকাল চলে এসেছেন। কাল সবাই মিলে রওনা হবেন একসঙ্গে।
মাহমুদা চার কাপ চা এনে টি-টেবিলে রাখলেন। চা রেখেই ঘাড় ফিরিয়ে নিশী-প্রভাকে উদ্দেশ্য করে ডেকে বললেন,
– চা হয়ে গেছে। আয় তাড়াতাড়ি।

মূহুর্তের মধ্যেই নিশী দুলে দুলে এসে বসল সোফায়। নিজের কাপ দেখে বেশ হতাশ হয়ে বলল,
– মা, তুমি আমাকে চা দিতে এতো কিপটামি করো কেন? একটু বেশি দিলে কী হয়?

নিশীর কথায় তাহমিদা হেসে ফেলল। মাহমুদা বললেন,
– চা বেশি খাওয়া ভালো না। ছোট মানুষ। কম খাও।

বিরসমুখে নিশী চাপে চুমুক বসাল। প্রভা হাত খোপা করতে করতে এসে পাশে বসল নিশীর। চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
– আগে এক কাপ শেষ কর। প্রয়োজন পড়লে আমারটাও খাইস।

প্রস্তাবটা বোধহয় পছন্দ হলো না নিশীর। মুখ ভেংচি কেটে চা পান করতে লাগল। প্রভা তাহমিদাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– খালামণি, বিস্কিট দিব?

তাহমিদা সহাস্যমুখে বলল,
– না রে আম্মু, লাগবে না। আমি চা এমনিই খাই।

মাহমুদা বলল,
– কালকে সকাল সকাল বেরোবো। পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর হবে। বিকেলের আগেই যেন পৌঁছে যাই। আজকে তোরা রাত জাগিস না। আগে আগে ঘুমিয়ে পড়িস।

প্রভা তুষ্টচিত্তে চা পানে ব্যস্ত হলো। সে সাধারণত আত্মীয়-স্বজন, মানুষজন তেমন পছন্দ করে না। তবে তার প্রিয় মানুষদের তালিকায় তার খালামণিও আছে। ভীষণ সহজ একজন মহিলা। কী মিষ্টি তার ব্যবহার, কী মিষ্টি বাকভঙ্গি! প্রভার ধারণা, এতো মিষ্টি একজন মানুষের পাশে কেউ খারাপ মনে থাকতেই পারবে না। একারণেই বোধহয় প্রভার নিজের মনও ভালো। এছাড়া অজানা কারণে ভীষণ খুশি হচ্ছে মন। যে মামাতো বোনের বিয়ে হচ্ছে, তার সঙ্গে প্রভা তেমন আন্তরিক নয়। তবুও, শুনে ভালো লাগছে। মনের মাঝে শিশুসুলভ আনন্দ উতলে উঠছে; ঠিক যেমন ছোটবেলায় অল্প কিছুতেই জেগে উঠতো।

মাহমুদা চায়ের কাপ রেখে নিজের বোনের কাছে জানতে চাইলেন,
– ছেলে কী করে তা তো জানা হলো না।

তাহমিদা বললেন,
– উম..ছেলে মনে হয় ব্যবসা করে শুনসিলাম। আমিও ওইভাবে শুনি নাই। গিয়ে নিয়ে সব শুনতে হবে।

– প্রেমের বিয়ে নাকি?

– না, প্রেমের হবে না। কি জানি….হইতেও পারে। এমনিতে ছেলে ভালো হইলেই হইসে।

– তা তো হইতে হবেই। এমনিতে কালকে তো ছোট অনুষ্ঠান। তাও কে কে আসব জানিস কিছু?

– আসব অনেকেই। স্মৃতির খালাতো, মামাতো বোনেরা তো আসবোই। কতোদিন ঝগড়া হয়ে তো ওর মামারা, বোনেরা আসে নাই। ওরা আসব আর আমরাই।

মাহমুদা কিছুক্ষণ থেমে জানতে চাইলেন,
– স্মৃতির খালাতো বোন তো মেডিকেল পড়ে না?

তাহমিদা বলল,
– হ্যাঁ, বড় টা এম.বি.বি.এস কমপ্লিট করসে। আর শুনসিলাম ছোট টাও এই বছর মেডিকেলে চান্স পাইছে।

মাহমুদা সুপ্ত আফসোসের সঙ্গে বললেন,
– হুম। মেয়েগুলারে সেইভাবে মানুষ করসে।

মাহমুদার এমন কথায় তাহমিদা কিছু বললেন না। তিনি কিছুটা আন্দাজ করতে পারছেন যে এখন কথা কোথায় গিয়ে ঠেকবে। মাহমুদা নিশী-প্রভার দিকে চেয়ে বলল ,
– স্মৃতির খালাতো বোন। এম.বি.বি.এস কমপ্লিট করসে। আরেকটা ডাক্তারিতে ভর্তি হইল। কাল আসবে। বড় টারে দেখিস চাল-চলনে, কথা বার্তায় কতো সুন্দর! খালি তাকাই থাকতে ইচ্ছে করে। ছোটবেলা থেকে মায়ে সেইভাবেই মানুষ করসে। তাইতো দুইজনই ডাক্তারিতে পড়তেসে। দেখিস কালকে আসলে কীভাবে চলাফেরা করে।

প্রভার আচম্বিত মনে হলো তার হৃদপিণ্ডের ওপর যে তৃপ্ততা, সন্তুষ্টির আস্তরণ ছিল, তার ওপর তার মা ভীষণ যত্নে কালো কোনো আবরণ ফেলে দিল। তার মা তাকে বকা দিলেন না, কোনো ক্রোধ, রাগও ঝাড়লেন না সেভাবে, তবুও প্রভা এমন ঠাণ্ডা গলার গরম গরম তুলনা মানতে পারল না। প্রভা নীরব মুখে কাপের ভেতরেই চেয়ে রইল। চা শেষ, কাপের তলায় দু’টো চা পাতি দেখা যাচ্ছে; সম্ভবত ঢালার সময়ে অসাবধানতায় পড়েছে। প্রভা মনোযোগ দিয়ে দু’টো চা-পাতির দিকেই চেয়ে রইল। সে বুঝতে পারল না তার উজ্জ্বল মুখটা ইতোমধ্যে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। সে এটাও বুঝতে পারল না, তার অন্ধকার মুখ আর কেউ লক্ষ্য না করলেও তারা খালামণি ঠিকই লক্ষ্য করেছেন। প্রভা আর নিজের মুখ উপরে তুলল না, তাই আর দেখাও হলো না তার সামনের মানুষটার মলিন মুখ।
_____

রাত্রির প্রথম ধাপে জানালার মাথায় দাঁড়িয়ে আছে প্রভা। দৃষ্টি কোনদিকে তা বলা যাচ্ছে না। ঘরবাড়ি এক ভূতুরে স্তব্ধতায় ছেয়ে আছে। বাসায় কেবল সে আর তার বাবা। বাকি সবাই গ্রামে চলে গেছেন স্মৃতির বিয়ে উপলক্ষে। প্রভা চোখ ফিরিয়ে খাটের নিচে ব্যাগের দিকে তাকাল। নানাবাড়ি যাবে শুনেই বুকভর্তি আমোদ-খুশি নিয়ে ব্যাগ কাল দুপুরেই গুছিয়েছিল। এমনিতে প্রায় সময় মন ছোট করে রাখলেও, স্মৃতির বিয়ে উপলক্ষে কেন যেন ভীষণ যেতে ইচ্ছে করছিল। খুব করে মন বলছিল যেতে। একটু ঘুরেফিরে বেরাতে। তবে শেষ মূহুর্তে আর যাওয়া হলো না। না হোক, কী হবে না গেলে! কিছুই হবে না। উলটো না গিয়ে সে ভালো কাজ করেছে বলেই প্রভার ধারণা। সে যাবে, স্মৃতির খালাতো বোনেরা আসবে, তার মা তাকে বারংবার তুলনা করে ছোট করবে – কী দরকার! প্রভা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাওহীদের ঘরের দিকে চেয়ে ভাবতে শুরু করল, প্রভা জানে সে স্বয়ংসম্পূর্ণা নয়। প্রভা জানে সে বিশেষ কেউ নয়। প্রভা জানে সে নামকরা, ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে না। প্রভা অবশ্যই স্বীকার করে সে চমৎকার কোনো মানুষ নয়। প্রভা জানে সে ভীষণ তুচ্ছ একজন মানুষ। প্রভা সব জানে। তবুও, প্রভা নিজের সাথে অন্যকারো তুলনা মেনে নিতে পারে না। সে খারাপ হোক, নীচ হোক, তুচ্ছ হোক — যাই হোক; সে তো ‘সে’। তবে কেন তার সাথে অন্যদের তুলনা করা হবে?
প্রভা একটি ডায়েরি খুলে বসেছে। উদ্দেশ্য ছিল নতুন কোনো গল্প, উপন্যাসের বই ধরবে। তবে চোখের সামনে ডায়েরিটা দেখে হঠাৎ ইচ্ছে হলো একটু দেখতে। ডায়েরিটা দিয়েছিল আফরিন। প্রভার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরের জন্মদিনে। প্রভা তখন সম্ভবত ক্লাস নাইনে পড়ে। এরপর কীভাবে যেন সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় বন্ধুত্বের আট বছর পেরিয়ে গেল। মাঝে কলেজ অবশ্য ভিন্ন ছিল। তবে ভার্সিটি একই; সাবজেক্ট ভিন্ন। প্রভা ডায়েরি খুলল। ডায়েরির সকল পৃষ্ঠা ফাঁকা। ফাঁকা থাকাই বোধহয় স্বাভাবিক। তার ডায়েরি লেখার শখ নেই; লিখতে ভালো লাগেনা, ইচ্ছেও হয়না। তিনশো পেজের ডায়েরিতে কেবল দু’পাতাই বোধহয় লেখা হয়েছে। প্রভা প্রথম পৃষ্ঠায় দেখতে পেল কিশোরীবেলার অভিমানী, আবেগী সব কথা লেখা। আবেগী কথা বলতে তেমন বিশেষ কিছু নেই। কেবল লিস্টা আকারে একটি পৃষ্ঠা ভরা –

প্রভার যা যা নেই –
১) নিজ স্বপ্নের স্বাধীনতা নেই।
২) এসএসসিতে এ প্লাস নেই।
৩) এইচএসসিতে এ প্লাস নেই।
৪) বাবা-মায়ের আমার প্রতি বিশ্বাস নেই।
৫) স্নেহ নেই।
৬) কারোর কাছে একটু আহ্লাদ করার অধিকার নেই।
৭) মায়ের স্বপ্ন পূরণের ক্ষমতা নেই।
৮) নিজের শখ নেই।
৯) স্বাধীনতা নেই।
১০) গর্ব হওয়ার কারণ নেই।

এতোসব অবান্তর লেখায় প্রভা মলিন হাসল। ডায়েরিটা সর্বশেষ লেখা হয়েছিল এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের পর। এরপর আর লেখা হয়নি। তার মনে আছে, তাকে যখন খুব করে বকা হতো, তখন সে তীব্র অভিমান নিয়ে এই ‘না পাওয়ার’ তালিকা করতে ব্যস্ত হতো। প্রভা লেখাগুলোয় তাকিয়ে ভেবে পেলনা, এতো বড়বেলাতেও সে এমনতর অপরিণত কথা কেমন করে লিখেছিল! ভাবল একবার ছিঁড়ে ফেলে। নাহ! থাকুক। কিছু অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন জিনিসও জীবনে থাকা বোধহয় ভালো। প্রভা ডায়েরি বন্ধের আগে নিচের লাইনটাতে আবারো চোখ বুলাল। যেখানে লেখা – নেই! প্রভার কিছুই নেই।
হ্যাঁ, কিছুই নেই। তবে হতে বোধহয় পারতো। সে ছোট থেকেই খেলাধুলা পছন্দ করে। স্কুল থেকে বিভিন্ন খেয়াল ন্যাশনাল পর্যায়েও চলে গিয়েছিল। কিন্তু পারিবারিক বাঁধায় আর সফল হওয়া হয়নি। প্রভা ভেবে পায়না, কেন পুরো পৃথিবী জুড়ে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা! কেন সকলের মাঝে বেস্ট হওয়ার এই অসুস্থ মানসিকতা! কেন কেউ বোঝেনা, কেউ মানেনা যে সকলে তার নিজস্ব জায়গায় বেস্ট। দুনিয়ার প্রতি ভারী ক্লান্তিতে প্রভার মাথা নুয়ে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ পড়ে থেকে মনে হলো এভাবে মন খারাপ উদযাপন করার মানে হয়না। মন খারাপে কেবল মন ভারীই হবে হালকা হওয়ার পরিবর্তে। প্রভা ফোন তুলে নিজের অবচেতনেই বা নিজ ইচ্ছাতেই কল করল তাওহীদকে। বেশ কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পরে তাওহীদ ফোন তুলল –

– সুপ্রভা! কেমন আছেন?

– ভালো আছি আমি। আপনি?

– আলহামদুলিল্লাহ! আমি সবসময় ভালো থাকি। ঘুমান নাই? কী করতেসিলেন আপনি?

– কিছু না। ঘুমাব। আপনি কী করছিলেন?

– এমনিই…দোকানের হিসাব করতেসিলাম। চাচারে হিসাব দিব তাই।

– ও!

তাওহীদের মনে হলো সুপ্রভার কণ্ঠটা বেশি নীরব শোনাচ্ছে। তাওহীদ কিছু বলবে তার আগেই প্রভা বলল,
– আপনি আমাকে কেন পছন্দ করেন, তাওহীদ?

এমন প্রশ্নে তাওহীদ বিমূঢ় হয়ে পড়ল। কী বলবে, কী বলা উচিত হবে? তাওহীদ বলল,
– এটা কেমন প্রশ্ন, সুপ্রভা?

সুপ্রভা অস্থির হয়ে বলল,
– বলুন না, তাওহীদ। কেন আমাকেই পছন্দ করেন? আপনি বলেছিলেন আমাকে দেখলে আপনার ভালো লাগে, আপনি খুশি হোন। কেন খুশি হন? নিশ্চয় কোনো কারণ থাকবে?

তাওহীদ বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে বলল,
– ভালোলাগার কোনো কারণ থাকে না, সুপ্রভা। আমারো নেই।

প্রভা কিছু বলল না। সে এমন প্রশ্ন করতে চায় নি। এমন প্রশ্ন করাটা বোধহয় ঠিক হলো না। তাওহীদ শুধাল,
– আপনার মনটা কী খারাপ, সুপ্রভা? বেশি খারাপ?

প্রভা তাওহীদের এমন প্রশ্নে নিজের ব্যক্তিত্বের বিপরীতে গিয়ে আদরে গলে পড়ল। যে কথা কখনো কাউকে বলা হয়নি, সে কথা আজ সে তাওহীদকে বলল,
– হ্যাঁ, আমার মন অনেক খারাপ।

উত্তরে তাওহীদ সুন্দর হাসে। কণ্ঠে স্নেহ ঢেলে বলে,
– মন ভালো করে দেই?

– কেমন করে?

– গান গেয়ে।

– গান?

– হ্যাঁ।

তাওহীদ জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। চাঁদের ওই টিমটিমে আলোয় প্রভাকে উদ্দেশ্য করে গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করল,

আমি থাকব মাটির ভাঁড়ে
আমার চোক্ষে বৃষ্টি পড়ে
আমি থাকব মাটির ভাঁড়ে
আমার চোক্ষে বৃষ্টি পড়ে
তোর হইবে মেঘের উপরে বাসা

প্রভা স্তব্ধ হয়ে তাওহীদের গান শুনতে লাগে। তাওহীদের এমন দরদ মাখা কণ্ঠে প্রভার সকল দুঃখ তার চোখ ছাপিয়ে আসে। প্রভা জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল তাওহীদের পানে। প্রভার হঠাৎ মনে হলো, তারা খুব কাছে। তবে কাছে থেকেও তারা বহু দূর দূরান্তের কেউ। প্রভার মনে হলো, তাওহীদ তার গানের মাঝে তার মন ভালো নয়, তাদের দূরত্বের কথাই মনে করিয়ে দিল। প্রভা এ দূরত্ব চাইল না। এ দূরত্ব ভরা গান চাইল না। তাই সে চক্ষুকোলে জল রেখে ডেকে উঠল,
– তাওহীদ!

– বলুন, সুপ্রভা!

– আমার মেঘের ওপর কোনো ঘর চাইনা, তাওহীদ।

চলবে-
_____

গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – বারো
_____

বইয়ের মাঝে ঠায় মাথা ফেলে নীরবে পড়ে আছে প্রভা। টেবিলে বসে পড়ার চেষ্টা করতে করতেই পিঠ ব্যথা হয়ে যাওয়ায় শুয়ে পড়েছে। পড়ার চেষ্টা করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বইয়ের লেখা দেখলেই তার ভীষণ অস্থির লাগে, ঘুম ঘুম পায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ইচ্ছে হয় না পড়তে। তবে ইচ্ছে হয়, সে পড়বে। পরীক্ষায় উজাড় করে লিখবে। কিন্তু…তা আর হয়ে ওঠে না। পড়াও হয় না, লেখাও হয় না। সে দেখে বা শুনে লিখতে পারে না। জিগ্যেস করতেও সংকোচে গলা ধরে আসে। আত্মসম্মানে আঘাত হানে। প্রভা ভাবল মিছেমিছি পড়ার চেষ্টা না করে এই ভরদুপুরেই সে ঘুমিয়ে পড়বে। এভাবে পড়া হয় না। প্রভা চোখ বন্ধ করার আগেই দেখতে পেল নিশীর অপ্রসন্ন মুখ এগিয়ে আসার দৃশ্য। নিশী গম্ভীরমুখে এসে সামনে বসতেই প্রভা চোখ তুলে পূর্ণ চোখে চাইল। বেশ অবলীলায় জানতে চাইল,
– কোনো সমস্যা?

নিশী কিছুট সময় নিয়ে মাথা উপর-নিচ দুলাল। প্রভা ভ্রুক্ষেপ করে বলল,
– কী সমস্যা?

নিশী অসংলগ্ন প্রশ্ন করে বসল,
– এখান থেকে বাসা চেঞ্জ করা যায়না, আপা? আমরা কী কখনোই অন্য বাসায় যাব না? এখানেই থাকব?

প্রভা ভ্রু কুঁচকে বলল,
– বাজে বকিস না, নিশী। এইটা আমাদের নিজের বাসা। অন্য বাসায় যাব কেন?

নিশীর মুখ মূহুর্তেই শুকিয়ে গেল। প্রভা নীরব গলায় আবারো জানতে চাইল,
– কী হয়েছে বলবি?

নিশী মিনমিন কণ্ঠে বলল,
– ছেলেগুলো বিরক্ত করে, আপা।

– কোন ছেলে?

– গলির মাথায় যে দাঁড়িয়ে থাকে, তারা।

নিশী কথায় প্রভাকে তেমন অবাক হতে দেখা গেল না। যেন সে জানতো একদিন না একদিন এমনটা হবেই। প্রভা বলল,
– কী করেছে?

– কেমন কেমন যেন কথা বলে। আমাকে মিন করে গান করে। আগেও কিছুদিন গান গাইতো। কিন্তু এখন বেশি খারাপ আচরণ করা শুরু করসে। দুপুর টাইমে প্রায়সময়ই ওইখানে কেউ থাকে না। আমার তো আসতে যেতে ভয় করে অনেক।

প্রভা স্থির বিচলিত কণ্ঠে বলল,
– গায়ে হাত দিয়েছে?

নিশী তার শুকনো মুখ তুলে দু’পাশে মাথা নাড়ে। বলল,
– দেয় নি। তবে আমাকে ইঙ্গিত করেই যে ওভাবে গান গেয়েছে আমি বুঝতে পারি। আজকে তো সরাসরি নিজেরা নিজেরা আমাকে শুনিয়ে বলতেসিল, ‘ ভালোই তো দেখতে’।

প্রভা হাপ ছাড়ল। কিছু বলবে তার পূর্বেই নিশী বলল,
– এই ঘটনাটা সকালের। সকাল তো যেমন তেমন বিকেলের দিকে গলির মাথা তো দূর চারপাশেও মানুষ থাকে না। আমার ছেলেগুলোর সামনে দিয়ে আসতে ভয় লাগে। একবার তো চালের বস্তা নিয়ে যে ভাইয়াটা আসছিল না? ওই ভাইয়া দোকান থেকে বেরোইসিল। আমি তার সাথে আসছিলাম এতোটুকু তার পিছু পিছু।

প্রভা হতাশ কণ্ঠে বলল,
– ছেলেগুলো রাজনীতি করে এই এলাকায়। দেখিস না কীসব পোস্টার টোস্টার এ নিজেদের নাম, ছবি লাগিয়ে ঘুরে। এখানে তো আমি কিছুই করতে পারব না। আমিও মেয়ে। এর থেকে তুই পুরো ঘটনা শান্তভাবে বাবাকে বুঝিয়ে বল। একদম শুরু থেকে বলবি। বাবা কিছু একটা করতে পারবে।

নিশী ভীষণ হতাশায়, ক্লান্তিতে মাথা নাড়ে। প্রভা বলল,
– যা ঘুমা। তুই তো দুপুরে ঘুম ছাড়া থাকতে পারিস না। ঘুমা। চিন্তা করিস না। বাবা কিছু ১ টা করবেই।

ভীষণ অবহেলায় নিশী উঠে দাঁড়াল। বিছানায় সামনে গিয়ে ধাপ করে বিছানায় পড়ে গেল। প্রভা স্থির দৃষ্টিতে নিশীকে দেখে নজর ফেরাল। মুখটা শুকিয়ে গেছে নিশীর। ভয়ে, আতঙ্কে চেহারাটা আঁধারে তলিয়ে আছে। নিজের সহজ জীবনে সামান্যতম জটিলতাটুকু সে গ্রাহ্য করতে পারছে না। সামনে তো আরোও নানান জটিলতার মুখোমুখি হবে। প্রভা ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘরের জানালায় তাকাল। ঘরের সামনের কাঁঠাল গাছটা মৃদু হাওয়ায় দুলছে। মাঝে পেরিয়েছে দেড়/দু’মাসের মতো। তাওহীদকে দেখে না আজ ৩ দিন। আজ রাত পেরুলে হবে ৪ দিন। গ্রামে গেছে তাওহীদ। বলে গেছে একসপ্তাহ থেকে আসবে পরিবারের সাথে। এক সপ্তাহ! প্রভা আবারো গুণে দেখল। আজ রাত পেরুলে হবে ৪ দিন। আরোও বাকি ৩ দিন। কীভাবে থাকবে প্রভা! প্রভা নিজের ওপর বিরক্ত হলেও কিছু করার নেই। এখন সে প্রায় দিনই তাওহীদের সাথে দেখা করে, কথা বলে। টুকটুক করে দু’জন কথা বলে কিংবা ঝগড়া করে। তাওহীদ অবশ্য ঝগড়া করে না। তবে সে যে শান্তভঙ্গিতে প্রভার রাগ শোনে। আর এই ব্যাপারটাই প্রভার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। দেখা হয়নি ৪ দিন, আর কথা হচ্ছে না দু’দিন। গতকাল থেকে তাওহীদের ফোন বন্ধ। অসহ্য যন্ত্রণায় প্রভা মাথা হেলিয়ে কাঁঠাল গাছে দৃষ্টি রাখল। গাছে একটি কুচকুচে কালো কাক বসেছে। গাছের মৃদু দোলনের সাথে সাথে কাকটাও দুলছে সাথে শিশুভঙ্গিতে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে।
_____

নরম হাওয়ায় ভেসে ভেসে বাড়ি ফিরছে তাওহীদ। না..না…বাড়ি নয়, ঢাকা। তাওহীদ ঢাকা ফিরছে। বাড়িতে কাটিয়ে এলো ৩ দিন। এখন সে ট্রেনে বসে। রংপুর থেকে ঢাকা পৌঁছতে ৬/৭ ঘন্টা লাগবে। সাড়ে চার ঘণ্টার মতো পেরিয়েছে। কখন পৌঁছবে কে জানে!
গত মাসের বেতন পেয়েই তাওহীদ ভাবে একবার পরিবারকে গিয়ে দেখে আসবে। বেতন পাওয়া মাত্রই সবার জন্য টুকটাক কেনাকাটা করে চলে যায় রংপুর। গিয়ে অবশ্য তাওহীদের কোনো কল্পনাই বাস্তবিক রূপ নেয়নি। সে ভেবেছিল, সে যাওয়া মাত্র তাদের টিনের বাড়িতে একটা হট্টগোল পড়ে যাবে। এতোদিন বাদে তাওহীদ যাওয়ার খুশিতে তার বাবা হাসিমুখে এগিয়ে আসবে, তার মা সুখ যন্ত্রণায় কেঁদে উঠবে, তার ভাই এসে তার খবরাখবর নেবে, ছোট বোনটাকে খুশিতে ফোন করে জানানো হবে যে তাওহীদ এসেছে, ভাবি অতোটা খুশি না হলেও বেজার অন্তত হবে না। সবাইকে একসঙ্গে দেখা হবে, সবার হাসিমুখ দেখা হবে, নিজের জন্য ভালোবাসা দেখা হবে। আপন মানুষদের থেকে নিজের জন্য ব্যাকুলতা দেখাটাও বোধহয় আত্মিক প্রশান্তির। তাওহীদ মৃদুমন্দ বাতাসে নিজের ব্যাগ খুলে একটি সুন্দর মোমবাতি বের করল। মোমবাতি টা দিয়েছে তার মা। সঙ্গে দিয়েছেন দিয়াশলাই বাক্সও। এইতো সে যে গেল, তেমন করে সবার মাঝে আমোদ-উচ্ছ্বাস প্রকাশিত না হলেও, চোখের তারায় বিস্ময় ঠিকই প্রকাশিত হলো। সবার সাথে অল্পস্বল্প কথা হলো, খাওয়া হলো। দু’দিন কেমন করে গেল তাওহীদ টের পেল না। তিন দিনের দিন সে সকলের জন্য নেওয়া উপহার সবাইকে বুঝিয়ে দিল। মাকে একটি সুতির কাপড়, বাবা-ভাইকে একটি লুঙ্গি, ভাবি আর ছোট বোনের জন্যে একটি ওড়না নিয়েছিল। উপহার পেয়ে সবার মুখে সামান্য হাসি দেখলেও মায়ের মুখে হাসি দেখা গেল না। সে নীরবে তাকিয়ে রইল কেবল। সবাই যখন একে একে চলে গেল তখন তার মা এগিয়ে এসে বললেন,
– কাপড় কি না শুধু শুধু ট্যাকা নষ্ট করলা কেন, বাপ? কাপড় এখন পড়ি না। বয়স হইসে। মেক্সি পরতেই আরাম। এক মেক্সিতে অনেকদিন যায়।
মায়ের এমন কথায় তাওহীদ কিছু বলার মতো পায় নি। শুধু চোখে ভেসেছে একটি দৃশ্য। সে তখন পনেরো বা ষোলো বছর বয়সী কিশোর। তার মা শখে, আহ্লাদে গদগদ হয়ে বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্যে একটি শাড়ি চেয়েছিলেন কেবল। তাওহীদের বাবা সেই শাড়ি দিতে নারাজ হন। এক কথায় দু’কথায় উঠে পড়ে নিজের শক্তি দেখাতে ব্যস্ত হন। সামান্য অবাধ্যতায় মার খেয়ে নিশ্চুপে ঘরে চলে যান তাওহীদের মা। এরপর আর কোনোদিন সেভাবে শাড়ি চান নি তিনি। সেই কুৎসিত, করুণ দৃশ্যটিকে কল্পনা করেই তাওহীদ তার মায়ের জন্য শাড়ি নিয়েছে। তবে তার মায়ের চোখে কোনো উচ্ছ্বাসের দেখা মেলে নি। অবশ্য মৃত চোখে উচ্ছ্বাস প্রকাশিতও হয় না। এরপরেই তাওহীদ কী ভেবে যেন চলে এলো। বাড়িতে এক সপ্তাহের মতো থাকার বন্দোবস্ত করে গেলেও ফিরে এলো আগেই। আসার সময় তার মা তাকে একটি নকশা করা মোমবাতি আর দেয়াশলাই এগিয়ে দিলেন। শুকনো কণ্ঠে বললেন,
– নিয়া যাও এইটা। বাবা, আন্ধারে ডরাইয়ো না। আন্ধারে কিচ্ছু হইবো না। আন্ধার তোমারে কিচ্ছু করতে পারবো না। সবসময় মোমবাতি সাথে রাইখো। আন্ধার হইলে, লাইট গেলেগা জ্বালাইবা। ভয়ে থাইকো না বাবা আমার।
বলেই কপালের মধ্যিখানে চুমু খেলেন। তাওহীদ হাত বাড়িয়ে নিজের কপাল স্পর্শ করল। মনে হলো যেন এখনো ঠোঁটের ছোঁয়া লেগে আছেন। নিজ মায়ের মাতৃসুলভ আদরের কথা ভেবে মূহুর্তেই তাওহীদের বুক ফাঁকা হয়ে গেল। ট্রেন চলছে। যতো এগুচ্ছে, ততই মা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। বাহিরে তাকাতেই চোখের জ্বলুনি বৃদ্ধি পেল। আচ্ছা, সে কী তার ‘মা’ কে একটু খুশি উপহার দিতে পারবে না? সম্ভব না? খুব কী অসম্ভব? এই যে তার মা তাকে মোমবাতি দিলেন। কেন দিলেন? তার কথা ভেবেই তো। সে ভয় পায় অন্ধকার। ছোটবেলায় খেলাধুলোর সময় একবার এক গর্তে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারায়। এরপর থেকেই অন্ধকার কেমন যেন সহ্য হয় না তার। গা কেঁপে কেঁপে ঘেমে ওঠে শরীর। তাওহীদ মোমবাতি ব্যাগে ভরে বাহিরের দৃশ্যতে মগ্ন হলো। নাহ, জ্বলুনি কমছে না। ক্রমশ বেড়েই চলছে।
_____

নারী এক অদ্ভূত প্রাণী। তাদের মন খারাপের কারণ যেমন পাওয়া যায় না, তেমনি মন ভালো হওয়ার হিসেবটাও মেলানো যায় না। সুপ্রভা প্রসন্ন মনে বারান্দার গাছগুলোয় পানি দিচ্ছে। অজ্ঞাত কারণেই মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। ইচ্ছে করছে নিজে সাজতে, ইচ্ছে করছে আশেপাশের পরিবেশকে সাজাতে। তুষ্ট মন নিয়ে বারান্দার কাজগুলোই আগে শুরু করল। গাছের একটু কাজ করে টব গুলোর আগাছা ছেটে দিল। বারান্দার গ্রিলগুলো পরিষ্কার করল। কাজ শেষে ঘরে যেতে ভেবে ফেলল সে তার নতুন কিনে আনা গজ কাপড় গুলো বানাবে ইসমাতের কাছ থেকে। তাওহীদ বলেছিল ইসমাত ভালো জামা বানায়। প্রভা বানিয়ে দেখতে চায়। এখন ইসমাতের কাছে আসলেই বানিয়ে দেখতে চায় নাকি তাওহীদদের ঘরে যেতে চায় তা প্রভা জানে না। শুধু জানে, যাবে। প্রভা কাজ শেষে হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে বসল। খবর পেয়েছে তাওহীদ আজ সন্ধ্যাতেই ফিরেছে। প্রভা ভেবে ফেলল কালই তাওহীদদের বাসায় যাবে। চমকে দেবে। তাওহীদ কী চমকাবে? হ্যাঁ… নিশ্চয় ধ্যান-জ্ঞান ভুলে ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলবে — সুপ্রভা! আপনি এখানে!
প্রভা স্মিত হাসল। ভাবতেই উত্তেজনা কাজ করছে। টেবিলে দু’হাত ফেলে, হাতের ওপর থুতনি রেখে বসল। হাত বাঁড়িয়ে সাদা কাগজে অযথা আঁকিবুকিতে মনোযোগ দিল। হঠাৎ’ই তাওহীদের গলা ছাড়া দরদ কণ্ঠের গানটা কানে ভেসে উঠল –

আমি থাকব মাটির ভাঁড়ে
আমার চোখে বৃষ্টি পড়ে
তোর হইবে মেঘের উপরে বাসা

প্রভার কানে গানটা ভেসে উঠতেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। খাতায় লিখে ফেলল একটি লাইন। লেখা হতেই চোখের সামনে ধরে দেখতে পেল,

‘ আমাদের হবে মেঘের ওপর মাটির বাসা’

চলবে-
_____
#অকিঞ্চন
#শারমিন_ইরান