অকিঞ্চন পর্ব-১৫

0
86

গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – পনেরো
_____

অবিন্যস্ত দুপুরে নিজের ওড়না ফেলে ঘর পরিষ্কারে মনোযোগী হয়েছে প্রভা। গোছগাছের দিক থেকে সে টিপটপ ধরনের নারী। বেঢপ কিছুই তার আশেপাশে স্থান পায় না। সেখানে নিশী যেন আপাদমস্তক পুরোটাই তার বিপরীত। সকালবেলা কোচিং থেকে এসে কোচিং এর বইগুলো টেবিলের পাটাতনে বিছিয়ে দিয়ে চলে গেছে স্কুলের রুটিন অনুযায়ী বই নিয়ে। ড্রেসিং টেবিলের ওপরে নিশীর জামা রাখা। ফ্লোরে পড়ে আছে ওড়না, পায়জামা। প্রভা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল। এখন আর বিরক্ত হতেও ইচ্ছে হয় না। বিরক্ত হওয়া মানেই নিজের শক্তির অপচয়। কী দরকার! প্রভা তার চারিপাশের পরিবেশ গুছিয়ে বিছানায় দিকে এগুলো। বাইরের প্রাকৃতিক আলো এসে বিছানা জুড়ে শান্ত, ধীর, স্থির ভাবে পড়ে আছে। খাটের পাশ থেকে শলার ঝাড়ু বের করে বিছানা গুছাতে ব্যস্ত হলো প্রভা। খানিকক্ষণ পরে টুংটাং আওয়াজ হলে ঘাড় ফিরিয়ে ফোনের দিকে চাইল। কিছু মুহূর্ত পরে এগিয়ে এসে ফোন তুলতেই চোখে পড়ল আফরিনের কৃত্রিম বার্তা। লিখেছে,
– প্রভা, কতোদিন হয় তোরে দেখিনা। তুই তো পক্সের ডরে আর আসলিই না। এখন তো আমি একদম সুস্থ। আসবি?

প্রভা পুরোটা পড়ার আগেই ভ্রু কুঁচকে প্রথম লাইনের উত্তর লিখে পাঠাল,
– থাপ্পড় দিব, আফরিন। পক্সের ভয়ে যাই নাই কে বলসে তোরে? আর ভয় কীসের, আমার ছোটবেলায় হয়ে গেসে। আর হবে না।

ওপাশ থেকে কিছু একটা লিখছে আফরিন। তবে তার পূর্বেই প্রভা আবারো বার্তা পাঠাল,
– তুই যে দুই দিন পর পর গ্রামে যাস সেইটা বল। পক্স হয়ে চলে গেছে সেই কবে। এরপর যে গ্রামে ঘুরে আসলি সেইটার কী? সব দোষ আমার?

আফরিন পাঠিয়েছে,
– আচ্ছা, ভাই থাম। বুজছি। এখন বল আজকে আসবি? আয়। দু’জনে মুভি দেখবনি। নেটফ্লিক্স কিনসি আমি। অনেক সাধনার পরে কিনতে সফল হইসি। আসবি?

প্রভা দ্বিধায় জড়াল। আজ বিকেলে তাওহীদ দেখা করতে বলেছে। অনেকদিন বাদে আজ দু’জনে আবারো বিকেলে একটু বেরোবে। কিন্তু আফরিনকে কীভাবে না করবে প্রভা! আশ্চর্য হলেও সত্য — প্রভা আফরিনকে বাহিরে কেবল বন্ধু দেখালেও ভেতরে ভেতরে স্নেহ করে একটি শিশুর মতো। ওর সাথে যত ঝগড়া হোক, কথা-কাটাকাটি হোক, প্রভা নিজে থেকে তা মিটিয়ে নেয়। প্রভা ভালোবাসাকে রঙের মতো উড়িয়ে দেওয়াতে বিশ্বাসী। যে তাকে একটু গুরুত্ব দেয়, প্রভা তাকে নিজের পুরো দুনিয়া তুলে দিতে চায়; যদিওবা প্রভার ধ্যান-ধারণা সেভাবে প্রকাশিত হয় না। আমরা মানুষ। মানুষ প্রমাণে বিশ্বাসী, মুখে বলা কথায় বিশ্বাসী। প্রভা এখানেই বারে বারে হেরে যায়। সে কখনো তার ভালোবাসার মানুষদের বলতে পারেনি তার বুকের গভীর, টনটনে অনুভূতির কথা। বলতে পারেনি বুকের ভেতর জমাট বেঁধে থাকা ভালোবাসার কথা। সে কখনো তার বাবা-মা’কে বলতে পারেনি, বাবা! মা! তোমাদের আর আমার মাঝে যে বিশাল দেয়াল আছে, প্রকাশ না করলেও আমার ভালোবাসা সেই দেয়ালের মতো সত্যি। আমাদের মধ্যকার দূরত্ব যেমন সত্য, তোমাদের জন্য আমার সম্মান, ভালোবাসা তেমন সত্য। সে কখনো তার বোন নিশীকে বলতে পারেনি যে, নিশী! তোর মন-মরা মুখ আমার কখনো সহ্য হয়না। যা লাগবে আমার কাছে চাইবি কিন্তু তবুও এমন শুকনো মুখে থাকবি না। সে কখনো আফরিনকে বলতে পারে নি যে, আফরিন! তুই সবসময় আমাকে গুরুত্বের দিক থেকে উপরে রাখিস, সবসময় আমাকে হাসিয়ে হাসিয়ে মন ভালো করিস। সবসময় আমার প্রতি তোর ভালোবাসা শুনাস। কিন্তু আমি শুনাতে পারি না। আমি তোকে আপন ভেবেও তোর প্রতি আমার স্নেহ, ভালোবাসা শুনাতে পারি না, বলতে পারি না। মানুষের বন্ধুরা তাদের নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলে যেভাবে স্পেশাল ফিল করায়। আমি সেসব চেয়েও পারি না আফরিন। কিন্তু এরমানে এই না যে আমি তোকে গুরুত্ব দেই না। আমার কাছে তুই আর নিশী দু’জনেই এক। তোদের প্রতি আমার ভালোবাসা, স্নেহের পরিমাণ কতোটা তীব্র তা কখনো তোদের জানানো হবেনা, বলা হবেনা। প্রভা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল তার বন্ধুর প্রতি তার দুর্বলতা ভয়ংকর রকমের। ভাবল তাওহীদকেই না করে দেবে। প্রভা তাওহীদের কনভারসেশনে ঢুকল। তাওহীদ লিখেছে, ‘আমার একমাত্র বন্ধু ‘সুপ্রভার’ কী একটু করুণা হবে তার মূল্যবান সময় ‘তাওহীদ’ নামক ভাদাইম্মারে দেওয়ার। যদি দিতো, তাইলে দুইজনে মিলা আজকে একটু হাঁইটা আসতাম। আমার বন্ধু মনে হয় কোনো কারণে রাগ করসে। তার রাগটাও ভাঙ্গাইতাম।’

তাওহীদের বার্তা পড়তে পড়তে কখন যে মুখে হাসি ফুটেছে তা প্রভা বুঝতে পারল না। এমন অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে প্রভার মন খারাপ হলো। ক্ষণেই প্রভা নিজের সিদ্ধান্ত বদলাল। আফরিনের কনভারসেশন ওপেন করতেই নতুন দু’টো বার্তা চোখে পড়ল। আফরিন লিখেছে,
– আসবি প্রভা?
আবার লিখেছে,
– কিরে! কই মরলি তুই?

প্রভা উদ্বিগ্ন মুখে লিখে পাঠাল,
– আফরিন, আজকে তাওহীদ একবার দেখা করতে বলেছে।

ম্যাসেজটা পাঠানোর পরে প্রভা আবারো আফরিনের আগের ম্যাসেজের সাথে নিজের ম্যাসেজটা পড়ল। প্রভা অসহ্যবোধ করল। তার ম্যাসেজটা এভাবে লেখা উচিত হয় নি। রূঢ় শোনাচ্ছে! বিনীতভাবে বোঝানো যেত। কিন্তু এটাই তো তারমধ্যে নেই।

আফরিন লিখেছে,
– কী লিখেছে? কখন লিখেছে? ওই ব্যাক্কল লোকটা তাহলে শেষ পর্যন্ত ম্যাসেজ করলো? আল্লাহ রে আল্লাহ! মানুষ পাইলি না প্রভা! শেষমেশ এমন একটারে ধরছিস! থাক আর না বলি… দেখা করার কথা ম্যাসেজে বলসে না কি কলে? এই এক মিনিট এক মিনিট…..তুই অপেক্ষা করতে না পেরে নিজে থেকেই ম্যাসেজ দিস নাই তো? ভাই! তোরে কতোক্ষণ বুঝাইলাম সেল্ফরেস্পেক্ট নিয়া। তাও তুই নিজে থেকেই বললি?

প্রভা ম্যাসেজ পড়তে পড়তে অতিষ্ঠ হয়ে বসে পড়ল। একের পর এক ম্যাসেজে ভারি হচ্ছে তার স্ক্রিন। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কানে বাজছে আফরিনের ভারি ভারি গলার সন্দিহান কণ্ঠ। ওপাশ থেকে আর কিছু আসার আগেই প্রভা লিখল,
– আমি ম্যাসেজ পাঠাইনি, আফরিন। সেই দিয়েছে। বুঝেছে যে রেগে ছিলাম।

এতোক্ষণে আফরিন আরোও বেশ কিছু কথা বলে ফেলেছে। প্রভার শেষ ম্যাসেজের পরেই সে তৎক্ষনাৎ লিখে পাঠাল,
– সত্যি তো?

– সত্যি রে বাবা। তুই কী জানিস না আমি কেমন?

– হ্যাঁ, হ্যাঁ। জানি, জানি। তবুও প্রেমে পড়লে তেলাপোকাও হাতি হয়ে যায়।

আবার অবান্তর কথা শুরু! প্রভা ধৈর্যহীন হয়ে লিখল,
– এবার বল গেলে কী তুই রাগ করবি? তোর বাসায় অন্যদিন আসি?

– এখন আমি আর কে! রাগ করলেও কী না করলেও কী! প্রমের থেকে কী বন্ধুত্ব বড়?

আফরিনের নাটকীয়তায় প্রভা তক্ত্য হয়ে লিখল,
– আফরিনন!

এভাবে আফরিন লিখে পাঠানোয় আফরিন ভ্রু কুঁচকে ফেলে। লিখে পাঠানো নামটা তার কানে ধমকের স্বরে বেজে উঠেছে। প্রভা রেগে যাচ্ছে। আর বিরক্ত করা ঠিক হবে না। আফরিন লিখল,
– আরেহ…ঠিকাছে ঠিকাছে। যাহ। পরে আসিস বাসায়। কেমন?

– হুম। রাখলাম।
_____

তাওহীদ আরিফুলকে ডাকল,
– আরিফুল ভাই, একটু শুইনা যান।

তাওহীদের হাতের ইশারায় আরফুল এগিয়ে এলো। হাসিমুখে জানতে চাইল,
– ভালো আছো তাওহীদ?

তাওহীদ হাসিমুখে বলল,
– জ্বি, ভাই। চলতেসে দিনকাল।

আরিফুল উৎসুক হয়ে বলল,
– কিছু বলতা আমারে? ডাকলা যে!

তাওহীদ ইতস্তত বোধ করল। কথাটা কীভাবে গুছিয়ে বলা যায় বুঝতে পারছে না। সামনের দিকে ইঙ্গিত করে বলল,
– ওই ভাইগুলা কী আপনার পরিচিত?

আরিফুল তাওহীদের ইশারা অনুযায়ী তাকিয়ে দেখে তাওহীদকে বলল,
– কোনো সমস্যা তাওহীদ?

তাওহীদ অধৈর্য হয়ে শুধাল,
– বলেন না, ভাই। চিনেন?

আরিফুল খানিকটা ভাবুক কণ্ঠে বলল,
– হ্যাঁ, চিনি তো। চিনবনা কেন? এই গ্রুপটা রাজিব ভাইদের গ্রুপ। সবাই চেনে। আমিও ভাইদের সাথে থাকি। ভাই-ব্রাদারের সম্পর্ক। কী হইসে? কোনো সাহায্য লাগবে?

তাওহীদ সাবলীল গলায় বলতে শুরু করল,
– উনাগোরে বইলেন তো ভাই এইখানে যেন না দাঁড়ায়। গলির সামনে দাঁড়ায় থাকে। অল্প বয়েসী মেয়েরা যাওয়া-আসা করে। অসুবিধা হয়। এতোগুলা ছেলেগো সামনে দিয়া কী চলাফেরা করা যায়! যে কারোরই তো শরম করবে। তাই বলতেসিলাম।

আরিফুল কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুধাল,
– কেউ কী তোমারে এই নিয়ে কিছু বলসে?

তাওহীদ সরল হাসে। বলে,
– না ওইভাবে কেউ বলে নাই। আমি বুঝি তো। তার উপর…

আরিফুল সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
– তার উপর?

– ওই যে আমাদের সামনের বিল্ডিং এর মিনহাজ চাচা আছে না? তার মেয়েরা তো চলাফেরা করে। অসুবিধা হয়। চাচা আমারে বলসে মেয়ে দুইটার সুবিধা-অসুবিধা একটু দেখতে।

আরিফুল বেশ কিছু সময় চুপ থেকে, তার অসুন্তুষ্ট চেহারায় হাসি ফুটিয়ে বলল,
– আচ্ছা, আমি দেখতেসি ব্যাপারটা।

তাওহীদ চমৎকার হেসে বলল,
– ধন্যবাদ, ভাই। উনাদের বেশি কিছু বইলেন না। শুধু বলবেন এইখানে যেন না দাঁড়ায়। কতো জায়গাই তো আছে। এইখানে দাঁড়াইলে মেয়েদের অসুবিধা হয় না?

আরিফুল মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
– আচ্ছা, আমি গেলাম। থাকো তুমি।

আরিফুল চলে যাচ্ছে। সেদিকে নির্মল মুখে চেয়ে আছে তাওহীদ। আজ সকালেই হঠাৎ করে প্রভার বাবা অর্থাৎ মিনহাজ তাওহীদকে পেছন থেকে ডেকে ওঠে। প্রাথমিক হালচাল জানার শেষেই নিজের সমস্যার কথা খুলে বলে। জানায় যে গলির মাথার ছেলেগুলো প্রভা- নিশীকে উত্যক্ত করে। নিশীর অসুবিধা হয়। এই অসুবিধার কারণে সে তিন দিন কোচিং এ যায় নি। সব বলে মিনহাজ সাহেব বলে,
– আমি এমনিতে ওদের এক চোট শাসিয়ে দিসি। তবুও, তুমি তো বাইরেই থাকো। লক্ষ্য রাইখো কোনো অসুবিধা হয় না কি। চেনো না আমার মেয়েদের?

তাওহীদ সংকোচ ভরে হাসে। বলে,
– জ্বি, চাচা। চিনি আমি।

এরপরেই মিনহাজ হেসে চলে গেলেন। তাওহীদ তৎক্ষণাৎ ভেবে ফেলে এই বিষয়ে আরিফুল ভাইয়ের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। আরিফুল ভাই তাদের সামনের টিনশেডে থাকে। কীভাবে কীভাবে যেন দুইজনের পরিচয় হয়ে গেল। এরপর গলির মাথায়ও তাওহীদ লক্ষ্য করেছে অনেকদিন। সেই সম্ভবত কোনো সাহায্য করতে পারবে।
_____

– আপনারে কমলা রঙটায় বেশ মানাইতেসে।

তাওহীদের ভরাট কণ্ঠের কথায় প্রভা পূর্ণচোখে চাইল। মাত্র বলা কথাটিকে নিছক’ই কথা বলার একটা বাহানা মনে হলো। প্রভা রুক্ষ কণ্ঠে বলল,
– অযথা প্রশংসা আমি পছন্দ করি না, মিস্টার তাওহীদ আলম।

বেশ অনেকদিন পর প্রভার এমন সম্বোধনে তাওহীদ দারুণভাবে হেসে ফেলল। বলল,
– অযথা বলি নাই, সুপ্রভা। সত্যিই বললাম। আপনি সবসময়ের জন্যেই সুন্দর, সব রকমভাবেই সুন্দর। তবুও বললাম কারণ গাঢ় কমলা রঙটা বেশ ক্যাটক্যাটে একটা রঙ। যারে তারে মানায় না। কিন্তু আপনারে মানাইতেসে। মনে হইতেসে আমার পাশে সূর্য নেমে আসছে এই আমারে ঝলসাই দেওয়ার জন্যে।

প্রভা ভ্রুক্ষেপ করল। তাওহীদের চেহারায় বাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে শুধাল,
– কেন? আমি ঝলসে দিলে আপনার কোনো অসুবিধা আছে? আপনি চান না ঝলসে যেতে?

প্রভার এমন প্রশ্নে তাওহীদ প্রভার চোখে গভীরভাবে চেয়ে রইল। এরপর চোখ ফিরিয়ে আকাশপানে মুখ উঁচিয়ে উদাস গলায় বলল,
– নাহ, ঝলসে যাওয়া মানেই নিজেরে হারায় ফেলা। আমি হারাইতে চাই না। আমি বাঁচতে চাই। অনেকদিন বাঁচতে চাই। এই পৃথিবীর জন্যে অতি তুচ্ছ মানুষ হয়েও বাঁচতে চাই।

তাওহীদের উত্তরে প্রভা সন্তুষ্ট হলো না। সবসময় এমন দার্শনিক, উদাস উদাস, অপার্থিব কথা তার ভালো লাগে না। প্রভা বুঝতে পারছে তার ভেতরকার চাপা রাগ ধীরে ধীরে বাড়ছে। প্রভা চোখ নামিয়ে নিজের হাতে থাকা ফুচকা খাওয়ায় মনোযোগী হলো। তাওহীদ প্রভার সম্মুখে হাত বাড়িয়ে দিল। প্রভার ফুচকায় গাল ভর্তি করে চোখে প্রশ্ন নিয়ে চাইল। তাওহীদ নরম গলায় বলল,
– আপনার জন্যে একটা উপহার নিয়ে আসছিলাম গ্রাম থেকে। আর দেওয়া হয় নাই।

প্রভা হাত বাড়িয়ে দিল। তাওহীদ প্রভার হাত বিন্দুমাত্র স্পর্শ না করে একটি সুন্দর নকশা করা মোমবাতি তুলে দিল। প্রভা মোমবাতির দিকে সপ্রশ্নে তাকিয়ে থেকে বলল,
– মোমবাতি!

তাওহীদ আদর কণ্ঠে শুধাল,
– পছন্দ হয় নি?

প্রভা উত্তর দিল না। স্থির চেয়ে রইল মোমবাতির দিকে। তাওহীদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
– এখনো কী রাগ কমলোনা আমার সুপ্রভার?

প্রভা মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল। ‘আমার সুপ্রভা’! তাওহীদের সুপ্রভা! কী আশ্চর্য আপন আপন সম্বোধন। আপন আপন হয়েও কোথাও যেন অন্তহীন দূরত্বের গন্ধ। প্রভা মৃদু ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
– রাগ করেছি কে বলল? রাগ করব কেন?

প্রভা অবনত হয়ে আছে। তাওহীদ’ও ঘাড় বেঁকিয়ে নিচু হলো। শিশুর মতো আদর করে বলল,
– রাগ করেননি? সত্যি রাগ করেন নি?

প্রভা তাওহীদের চোখে চোখ রেখে হেসে ফেলল। কপট শাসিত কণ্ঠে বলল,
– আপনি ধীরে ধীরে ভীষণ ফালতু হয়ে যাচ্ছেন, তাওহীদ। আগেই ভালো ছিলেন।

তাওহীদ তার হাসি প্রশস্ত করতে গিয়েও করল না। একটি বিষয় দৃষ্টিগোচর হতেই মুখে গম্ভীরতা ভীড় করল। সোজা হয়ে বসে নির্বিঘ্নে সকল কিছু নিরিক্ষণ করতে লাগল। খানিকক্ষণ পরেই প্রভার খাওয়া শেষ হলো। তা দেখেই তৎক্ষনাৎ তাওহীদ বলল,
– সুপ্রভা, চলেন উঠি।

প্রভা ভ্রুতে ভাঁজ ফেলল। সে আরোও একটু টক খাবে। নরম কণ্ঠে বলল,
– আরেকটু বসি, তাওহীদ।

তাওহীদের মুখের কাঠিন্য কিছুটা হ্রাস পেল। প্রভার চোখে নরম হয়ে চাইল। একটু আগে প্রভার করা রিনরিনে কণ্ঠের আবদারের বিপরীতে নেতিবাচক উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। সৃষ্টিকর্তা দেন নি। নিজের পরাজয় মেনে তাওহীদ বলল,
– আচ্ছা, বসলাম নাহয় কিছুক্ষণ। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ না। আপনারে আরেক কাপ টক আইনা দেই। টক খাওয়া শেষ হইলেই উইঠা যাব। ঠিকাছে?

জবাবে প্রভা সুন্দর করে হেসে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। হাতের গ্লাসটা বাড়িয়ে দেয় তাওহীদের দিকে। তাওহীদ উঠে গেল টক আনতে। খানিক বাদেই ফিরে এলো।
প্রভা টক পান করা অবস্থাতে তাওহীদকে লক্ষ্য করে চলেছে। তাওহীদের মুখের অস্থিরতায়, আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধাল,
– কোনো সমস্যা?

তাওহীদ প্রভার দিকে চেয়ে কিছু বলবে তার পূর্বেই পেছন থেকে সমস্বরের কিছু কথা ভেসে এলো। তাওহীদ সেদিকে চেয়ে নিজের চোখ ফিরিয়ে নিল। তার চোয়াল ক্রমেই দৃঢ়তায় শক্ত হলো। প্রভা আশ্চর্য হয়ে কিছু বলতেও ভুলে গেল। কথায় কথায় খেয়ালই করা হয় নি কখন গোধূলি পেরিয়ে সন্ধ্যে নেমেছে। পেছন থেকে আবারো কিছু বলা হলো। প্রভা চমকে উঠল। এমন পরিস্থিতিতে সে আগে কখনো পড়ে নি। সে ঘরকুনো মেয়ে। প্রয়োজনের বাহিরে কখনো চৌকাঠই পেরোনো হয় নি। তাই এমন অস্বস্তিকর পরিবেশের সাথে সে পরিচিত নয়। কেউ একজন বলল,

– আমাদের পাশে মনে হয় আসবে না। চল আমরাই আপুর পাশে গিয়ে বসি। আপুরে টক খাইতে সাহায্য করি।

আচম্বিত কথায় প্রভার হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল। রাগে, অস্বস্তিতে, লজ্জায় শরীর ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। মাঠের দিকের নির্জন জায়গা। সন্ধ্যে হওয়ায় তেমন মানুষ নেই। প্রভা করুণ চোখে তাওহীদের দিকে চাইল। সে কেন কিছু বলছে না। প্রভা চোখ তুলে চাওয়ার আগেই বেশ শান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল তাওহীদ। বাম হাতে ফুচকার প্লেট নিয়ে ডান হাতে প্রভার কবজি বেশ শক্ত করে ধরে উঠে দাঁড়াল। প্রভা ক্ষণেই দ্বিতীয়বারের মতো বিস্ময়ে থমকে গেল। এই প্রথম হয়তো তাওহীদ নিজ থেকে তার হাত ধরেছে। তাওহীদ বেশ বড় বড় করে পা ফেলে এগিয়ে চলল প্রভাকে নিয়ে। পেছন থেকে ভেসে এলো আরোও বেশ কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ কণ্ঠের বিদ্রুপ।
বাড়ির গলির কিছুটা দূরে পৌঁছতেই প্রভা ভীষণ অবিনীত ভঙ্গিতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। তাওহীদ পেছন ঘুরতেই প্রভার জ্বলজ্বলে চোখের মনিতে আটকে গেল তার দৃষ্টি। প্রভা তখন নিজ স্থানে লজ্জায়, রাগে তিরতির করে কাঁপছে। কিছুদিন পূর্বের ঘটনার চাপা রাগে আজকের ঘটনা যেন একটু বাতাস দিয়ে গেল। মুহূর্তেই ধপপ করে জ্বলে উঠল সেই চাপা রাগ। তার অবচেতন হয়তো মানতে পারে নি তাওহীদের এভাবে চলে আসা। হয়তো তার মনের অজ্ঞাত আকাঙ্ক্ষা ছিল তাওহীদ এভাবে নির্বিবাদে চলে আসবে না। কিছু হলেও বলবে। তীক্ষ্ণ, জ্বলে ওঠা কণ্ঠে প্রভা বলল,
– এভাবে চলে আসতে একটুও বিবেকে বাঁধল না, তাওহীদ? তারা আমাদের বাজে ভাবে ইঙ্গিত করল। সেখানে আপনার কিছু অন্তত বলা ছিল। আর আপনি চলে এলেন? একটু কিছুও কি বলতে পারতেন না? একটা ধমক, একটা কথা কী বলতে পারতেন না? এই আপনার মেরুদণ্ড?

তাওহীদের চোখ, মুখের দৃঢ়তা ধীরে ধীরে মুছে গেল। প্রভা থামল না। রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,
– আমি মানতেই পারছি না। আপনি কিছু অন্তত বলতেন তাওহীদ। এভাবে কীভাবে….

তাওহীদ স্থির কণ্ঠে বলল,
– বাসায় চলুন, সুপ্রভা।

তাওহীদ এখনো এমন নির্বিকার! প্রভা হতবাক হয়ে পড়ল। এরপর বরফ শীতল কণ্ঠে বলল,
– আপনারে চিন্তা করতে হবে না, চলে যেতে পারব আমি।

প্রভা শান্ত তবে অস্থির ভঙ্গিতে এগিয়ে চলল। তাওহীদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে ঠিক জানে এই যে তাকে তৃষ্ণা মিটিয়ে ঝেড়ে গেল, বাসায় গিয়ে ঠিক বুক ভর্তি মন ভার নিয়ে বসে থাকবে। সেই ভাড় মন নিয়ে কাটাবে গোটা এক রাত, গোটা কয়েক দিন। তাওহীদ এগিয়ে চলল প্রভার পিছু পিছু। প্রভা বিল্ডিং এর গেটে ঢুকতেও তাওহীদ পিছু ডাকল,
– সুপ্রভা!

তাওহীদের ডাক উপেক্ষা করার শক্তি প্রভার কখনো ছিল না। আজ’ও হলোনা। প্রভা বিতৃষ্ণা ভর্তি মুখে ফিরে চাইল। তাওহীদ এগিয়ে এসে হুট করে প্রভার চুলে হাত রেখে আদর কণ্ঠে বলতে লাগল,
– না বুইঝা শুইনাই হুটহাট কইরা রাইগা যান। একটু শুনবেন তো। জীবনটা কোনো রূপকথা না, সুপ্রভা। আর রূপকথা হইলেও আমি তো আপনার নায়ক না যে সব বিপদ থিকা আপনারে তুরি মাইরা বাঁচাই ফালাব। এইটা বাস্তব জীবন। বাস্তবের সমস্যা গুলাও বাস্তবের মতোই জটিল। আপনি তো ফিরা চান নাই। ওরা কতোজন ছিল জানেন! ছয়/সাতজন। এতোগুলা ছেলের সাথে আমি একলা কী করতাম! করতাম। করতে পারতাম। কিন্তু আমার দুর্বলতা আপনি। আপনি সঙ্গে ছিলেন। আমি তিন/চার জনের সাথে মারামারি করলে অন্যদিক থেকে দুইজন আইসা যদি আপনার গায়ে হাত দিত, তবে কী আমার কিছু করার থাকতো আর না কিছু করতে পারতাম! আপনি অনেক দামী, সুপ্রভা। দামী কাউরে সঙ্গ ছাড়া করতে নাই। তাই সব নজর আপনার উপরই দিয়া নিয়া আসলাম।

সুপ্রভা চেহারায় থেকে অপ্রসন্নতা মুছে গেলেও কাঠিন্যতা কমল না। কে জানে এই কাঠিন্যতা কার প্রতি! তাওহীদের প্রতি না কি সুপ্রভার নিজের প্রতি। তাওহীদ নিজের হাতটা সুপ্রভার মাথায় আবারো বুলিয়ে দিয়ে বলল,
– যান, উপরে যান। আপনারে অনেক ক্লান্ত দেখাইতেসে। মন খারাপ করে না, সুপ্রভা।

প্রভা থমকে গেল। সে কিছুক্ষণ আগেই সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে ভীষণ খারাপভাবে তিরস্কার করেছে। তাকে যথাসম্ভব ছোট করেছে। অথচ মানুষটা এরপরেও এমন আদর কণ্ঠে কথা বলছে! প্রভা তার টলটলে, ঘোলাটে দৃষ্টি উঁচিয়ে ভাবল, কী দিয়ে তৈরি এই মানুষটা!

চলবে~
_____
#অকিঞ্চন
#শারমিন_ইরান