গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – আঠারো (প্রথম অংশ)
_____
জীবনের প্রবাহ ও মনের গণনার মাঝের সুবিস্তীর্ণ ফারাক বুঝতে তাওহীদের সময় লাগল গোটা তিনদিন। জাগতিক গতিবিধির প্রাণহীন নির্মমতা এবং হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষিত চিন্তার প্রতারণা পাহাড়ের মতো অটল হতে দাঁড়াতেই ভীষণ সহজে ভেঙে গেল সকল প্রকারের সব অপেক্ষা। বৃহস্পতি গড়িয়ে রবি এলো। তবুও তাওহীদের ছাড়পত্রের কোনো নামগন্ধ মিলল না। তাওহীদের মনের ঝাপসা এক ভাবনা ছিল হতে পারে দোষী হয়েও দৈব কোনো শক্তিতে তার মুক্তি মিলে যাবে। সে দোষী তা সে জানে; সেই তিন ঘৃণ্য জীবকে যে সে পাষণ্ডের মতো আঘাত করেছে তাও সে জানে। তবুও সে জানায় কোনো মনস্তাপ নেই। কোনো অনুশোচনা, হতাশা নেই। তাওহীদের ভাবাদর্শে তারা কোনো মানুষ কিংবা পশুর শ্রেণিতেই পড়ে না। এখন কোন শ্রেণিতে পড়ে তা বলা যাচ্ছে না। কেবল বুঝতে চায় জন্তু, জানোয়ার এর সঙ্গে তুলনা করা হলে বড্ড অন্যায় হয়ে যাবে। তারা আরোও ঘৃণ্য কোনো জাত। যে জাতের নিচে আর কিছু স্থান পায় না। যে জাতকে ঘৃণার পরিমাপে কেউ ভেদ করতে জানে না। তাওহীদ অসাড় শরীর নিয়ে প্রাণহীন, সংকীর্ণ হাজতের একবার এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ায়, আবার কিছু মূহুর্ত বাদেই আবার বিপরীত কোণার উদ্দেশ্যে পা চালায়। শরীরের সঙ্গে যেন মনটাও অসাড়তায় ডুবে গেছে। কেমন কেমন বিদঘুটে এক অনুভূতিতে আটকে গেছে সে! নিজ গ্রাম দাপিয়ে বেড়ানো, সারা পাড়ার বাজার করে দেওয়া তাওহীদ কি না আজ বন্দি এই দুর্দম, পতিত বদ্ধ কারাগারে। শরীরকে বাহ্যিকভাবে বাঁধা গেলেও হৃদয়, মস্তিষ্ক তো বাঁধা গেল না। তার হৃদয়-প্রাণ তো এখন ছুটোছুটি করছে গ্রামের পথে পথে। তার মস্তিষ্ক তো দাপিয়ে চলছে বাসার সামনের সব রাস্তাঘাট; সেই শাপলা স্বরণীর মাঠ। দেহের থেকে মনের ক্লান্তিতেই যেন শরীরটা ভার হয়ে আসছে। তাওহীদ অবুঝ বালকের ন্যায় নিচে বসে পড়ে। মনকে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করে, মুক্তি তার মিলবে। হয়তো খানিকটা দেড়ি হচ্ছে। হয়তো কিছুটা মানসিক আঘাত সইতে হচ্ছে। তবুও…মুক্তি তার হবে। তার হাসান ভাই আছে, সুপ্রভা আছে। তারা কী কিছুই করবে না? মুহূর্তেই তাওহীদের মন কালো মেঘে ছেয়ে গেল। তাওহীদের প্রবল বিশ্বাসে এক কোপ এসে বসে রক্তাক্ত হলো। হাসান ভাই, সুপ্রভা থাকলেও তারা করবেটা কী? সে যে খুন করেছে এটা তো সত্য, তাই না? এতোক্ষণ যাবত লালন করা সকল বিশ্বাস, আশ্বাস, প্রবোধ মূহুর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল। কথাটা মানতে না চাইলেও সত্য, যত সময় পেরুচ্ছে তাওহীদের হৃদয় শুকনো পাতার ন্যায় গুটিয়ে যাচ্ছে। শুকিয়ে যাচ্ছে। যেকোনো মূহুর্তেই তা মর্মর ধ্বনি তুলে গুড়িয়ে গেলেও অবাক হওয়ার নেই। তাওহীদের নিজ অস্তিত্বের সঙ্গে বোঝাপড়ার মাঝেই বাইরের জেলারের কণ্ঠ ভেসে এলো,
– সকালে খাবার দিয়ে গেসে, এখনো খাও নাই যে! খাইয়া নাও। এইখানে কোনো স্বজন নাই যে তোমারে বইলা বইলা খাওয়াবে। নিজের চিন্তা নিজেরেই করা লাগবে।
তাওহীদ ম্লান মুখে চাইল প্রবীণ ব্যক্তিটির দিকে। চোখেমুখে গাম্ভীর্যের সঙ্গে অভিজ্ঞতা তীক্ষ্ণ মিশ্রণ। বয়সের দিক থেকে সম্ভাব্য ষাটোর্ধ বা তার কাছাকাছি হতে পারে। পেকে যাওয়া চুল, দাঁড়িতে চেহারায় গুরুজন গুরুজন ভাব। তাওহীদের সঙ্গে লোকটির পরিচয় হয়েছে শুক্রবারে। শুক্রবারে সকাল হতে রাত পর্যন্ত ডিউটিতে ইনিই কর্মরত ছিলেন। আগ বাড়িয়েই গুটি কয়েক কথা বলেছিলেন তাওহীদের সঙ্গে। তাওহীদও উত্তর দিয়েছে। তাওহীদ উঠে গিয়ে লোকটির বিপরীতে দাঁড়াল। জানতে চাইল,
– খুনের মামলায় কী জামিন হয়, স্যার?
জেলার তার দিকে তাকায়। গম্ভীর চোখে কিছু ভেবে বলেন,
– কখনো হয়, কখনো হয় না। নির্ভর করে কে জেলে আসছে তার উপর।
তাওহীদ শিশুর মতো বলে,
– আমার কী জামিন হবে, স্যার?
মধ্যবয়সী জেলার পূর্ণ চোখে তাওহীদের দিকে ক্ষণকাল চেয়ে বললেন,
– হবে। ভাগ্যে থাকলে হবে। যাও খাও।
তাওহীদ ঘাড় ফিরিয়ে খাবারের দিকে এগিয়ে যায়। খাবারের চেহারা দেখে তৃপ্তি আসে না, তবুও শরীরের ক্ষুধায় খেতে হয়। শরীরের অবিরাম ক্লান্তি, হৃদয়ের টনটনে কঠিন ব্যথা ভুলে হাপুস নয়নে খেতে আরম্ভ করে তাওহীদ। আর সে দৃশ্য দেখে বুক ছাপিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন জেলার।
_____
কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচতে পারে না — এটা খুব বড় একটি ভুল কথা। আসলে কেউ কখনো কারোর জন্যে মারা যায় না। দুঃখ কিছুটা হয়; তবুও বেঁচে থাকেই। এই ভুবনে কতো না স্ত্রী তার স্বামীকে বলেছে, কতো প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বলেছে, কতো সন্তান তার পিতা-মাতাকে আবেগঘন হয়ে বলেছে, ‘ তোমাদের ছাড়া বাঁচবো না’। আদতে কী বেঁচে নেই? বেঁচে মানুষ থাকেই, সৃষ্টিকর্তা বাঁচিয়ে রাখেনই। মাঝে থেকে কেবল মিছে শঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে তটস্থ থাকি যে, হয়তো সে চলে গেলে আমিও চলে যাব। এই মিথ্যে ভয় ছাড়া এই কথার আর কোনো অর্থ প্রকৃতপক্ষে নেই। দুঃখ হয়, সময়ের সঙ্গে সয়েও যায়। এই যে তাওহীদকে যে জেলে নিয়ে গেছে, এতে তো প্রভা যথেষ্ট আহত হয়েছে। মনে মনে ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। তাতে কী হয়েছে, কার কী এসেছে-গেছে? এমনকি প্রভারও তো কিছু যায় আসে নি। হয়তো কিছুটা অগোছালো কাটছে তার দিন, তার জীবন, তবুও কাটছে তো। থেমে তো নেই। এই যে পলকেই উড়ে গেছে তিন তিনটে দিন। সে তো দিব্যি এই তিনদিন ঝকঝকে, স্বচ্ছ রুমে কাটিয়ে দিয়েছে; তাওহীদ তো কাটায় নি। তাওহীদ তো পারে নি। সে কাটিয়েছে ম্লান, অস্বস্তিকর, অসামাজিক এক পরিবেশে। যেখানে ক্রমশ ঘনিয়ে আসে ভয়, আতঙ্ক। যেখানে নিশ্চিন্তমনে নেওয়া যায় না সামান্য শ্বাসটুকু। ফ্লোরে বসা অবস্থাতেই প্রভা মাথা ঠেকিয়ে ধরল বিছানায়। তার জীবনকালে এমন করুণ, পাষবিক অসহায়ত্বের মুখোমুখি সে আর কখনো হয় নি। আর কখনো এতোটা গ্লানি তাকে গ্রাস করে নি। প্রতিটা মূহুর্তে, প্রতিটা লহমায় সে নিজের প্রতি, এই দুনিয়ার প্রতি তীব্র অভিযোগে মূর্ছা যাচ্ছে। ছোট থেকেই নিজের মধ্যে থাকা প্রভা কখনো বাহিরের জগতে সেভাবে যোগাযোগ রাখার সুযোগ পায় নি। কখনো মানুষের সঙ্গে মেশার, বাহিরের জগতটাকে জানার, নানাবিধ নানান বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করার সুযোগ তার হয় নি। ছোট থেকে পরিবারের সীমাবদ্ধতায় নিজের খোলসে নিজেই গুটিয়ে গেছে। থেকে থেকে হয়েছে চরম অন্তর্মুখী এক মেয়ে। না আছে কারো সঙ্গে মেশার গুণ, আর না আছে প্রাণখুলে কথা বলবার গুণ। সেই মুখচোরা প্রভা এখন কেমন করে তাওহীদকে ছাড়ায়? কেমন করে আইনজীবীদের খুঁজে বের করে? চেনা-জানার সংকীর্ণ মালায় যারা আবদ্ধ ছিল, তাদের কাছে ইতোমধ্যে সাহায্য চাওয়া শেষ। ফেসবুকের পাবলিক গ্রুপে গ্রুপে, আইনি গ্রুপেও পোস্ট করার কাজ ইতোমধ্যে সারা হয়েছে। তবুও আশানুরূপ কোনো সমাধান পাওয়া গেল না। কমেন্টবক্সে যা গুটি দু’য়েক নাম্বার পাওয়া গেল, তাদের মধ্যে কারোর কারোর ফোন তোলারই অবকাশ মিলল না আবার কারোর চাহিদা হলো আকাশচুম্বী। শুরুতেই তাদের চাই লক্ষের উপরে অর্থ। হয়তো তারা অধিক জ্ঞানসম্পন্ন, হয়তো অধিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, তাই বলে কী কারোর সাহায্যেও নিজেদের দাম কমানো যায় না? এই দুনিয়াতে অর্থেই মূল্য বুঝি এমনই! ওদিকে থানাতেও নিজের জড়তা ভুলে আইনজীবীদের খোঁজ করেছে, তারাও সেভাবে সাহায্য করতে পারে নি। পারবে কেমন করে? একটু তো চেনা-জানার প্রয়োজন হয়। যে প্রভা ইহকালে আইন সমন্ধি কোনো বিষয়ে সম্পৃক্ত ছিল না, সেই প্রভা এ সময়ে কেমন করে আইনি বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে তা ভাবতে গেলে ক্লান্তিতে মস্তিষ্ক গুলিয়ে ওঠে। তাওহীদের সঙ্গে দেখা হওয়ারও পথ নেই। থানায় থাকাকালীন সপ্তাহে একদিন করে দেখা করারই নাকি নিয়ম। অনুরোধ করলে সম্ভবত আরোও একদিন দেখা করা যাবে। আজ বিকেলেই একবার যাওয়া যেতে পারে। মনে করে টাকা সঙ্গে নিতে হবে। হতে পারে টাকা দিলে দেখা করা নিয়ে আর কোনো বাঁধা-বিপত্তি থাকবে না। হ্যাঁ, হতেই পারে। প্রভা নিজেকে এই বলেই আশ্বস্ত করে দমিয়ে নিল। খানিকক্ষণ মাথা হেলিয়ে দিয়ে পড়ে থাকতে চাইল নীরবে, নিরালায়। এরইমধ্যে মস্তিষ্ক বেশ কিছুক্ষণ হাতড়ে হাতড়ে স্বস্তি খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা চালাল, হয়তোবা মিলল না। ব্যর্থ হয়ে সে কাজও ছেড়ে দিয়ে স্থিরতা বেছে পড়ে রইল।
আহত মস্তিষ্ক তন্দ্রাভাবের সামান্য ছোঁয়া পেতেই , বাহির ঘরের চিৎকার-চেঁচামেচিতে তা ছেড়েও উঠে পড়তে হয় প্রভার। ঘোর কাটানোর আগেই তার ঘরে গটগট করে প্রবেশ করেন তার বাবা মিনহাজ। মিনহাজ সাহেবের গম্ভীর মুখের বিপরীতে প্রভা কিছু বলবে কি না তা ভাবতে খানিকক্ষণ ভাবতে বসতে হয় তাকে। তবে তার পূর্বেই গর্জে উঠেন মিনহাজ,
– তাওহীদকে চিনিস তুই?
প্রভা আসন্ন বিপদের সুবাস পেয়েও নির্বিকার কণ্ঠে বলল,
– চিনব না কেন?
মিনহাজ সাহেব অধৈর্য হয়ে বললেন,
– আমি কোনো সাধারণ চেনার কথা যে বলতেসি না তা কিন্তু তুই ভালোমতোই বুঝতেসিস। ব্যক্তিগত ভাবে ওর সাথে তোর পরিচিতি আছে কি নেই?
প্রভা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
– আছে। তাওহীদ আমার খুব ভালো বন্ধু বাবা।
আচম্বিত মিনহাজ সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন। মাহমুদা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– দেখসো তোমার মেয়ের আচার ব্যবহার? বাপের সামনে দাঁড়াই তোমার মেয়ে বলতেসে ওই খুনী, চোরের বাচ্চা না কি তোমার মেয়ের বন্ধু হয়? এই মেয়ে পালসো? এই মেয়েরে মানুষ করসো?
তাওহীদকে নিয়ে মিনহাজ সাহেবের এমন বক্তব্যে প্রভার মনে হলো তার বাবা যেন প্রভার ব্যক্তিত্বকেই অপমান করলেন। তাওহীদকে না বলে প্রভাকেই লজ্জিত করলেন। প্রভা অশ্রুচোখে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
– তুমি তাওহীদকে নিয়ে এমন কথা বলতে পারো না বাবা। আর তাওহীদ যে খুনী সেটাও কিন্তু প্রমাণিত হয় নি।
মাহমুদা দরজায় দাঁড়ানো। মিনহাজ সাহেব তাকে দেখে হতভম্ব হয়ে বলল,
– দেখসো তোমার মেয়ের কথা? শুনসো তোমার মেয়ের গলার তেজ! এতোকাল যাবত মেয়েরে লেখাপড়া শিখাইসো না কি বেশ্যাগিরি করাইসো? এখন তো মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে বলা বন্ধু কথাও কথার কথা। ওই? তাওহীদ তোর বন্ধু না প্রেমিক? এই করো তুমি বাসা-বাড়িতে থাইকা? এই তোমার চরিত্র? কোথাকার না কোথাকার মূর্খ, অশিক্ষিত, ছোটলোক…..
আর বলতে পারলেন না মিনহাজ সাহেব। স্টিলের ফুলদানির ঝনঝন শব্দে মুখরিত পরিবেশ স্থির হওয়ার পূর্বেই প্রভার হুংকার শোনা গেল,
– আর একটা বাজে কথা বলবে না তোমরা তাওহীদকে নিয়ে। আর একটা কথাও না। সে ছোটলোক হোক, মূর্খ হোক যা ইচ্ছে হোক, সে অন্তত মানুষ। তোমাদের মতো শিক্ষিত নামের অমানুষ নয়। তোমরা কেবল নামেই শিক্ষিত। না আছে শিক্ষা না আছে কিছু। তোমাদের মতো শিক্ষা নেওয়ার চেয়ে অশিক্ষিত থাকাকেই আমি প্রাধান্য দেব। এমনই শিক্ষা তোমাদের যে নিজ সন্তানের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো গুরুত্ব তোমরা দাওনা। এমনই শিক্ষিত যে মানুষকে মানুষ ভাবতে তোমাদের ইচ্ছে হয় না। এমনই শিক্ষিত যে নিজের মেয়েকে বেশ্যার সঙ্গে তুলনা করো। তোমাদের বাবা, মা বলতে আমার বমি পায়। বমিইইই….!
তীব্র বেগে আছড়ে পড়ছে শ্বাস-প্রশ্বাস। সারা জনম ভর শান্ত প্রভা হঠাৎ আসা ঝড়ের ন্যায় গর্জে উঠতেই গলার ভেতরের অংশ জ্বলে যাচ্ছে। নিজের সবটুকু জেদ, রাগ থেকে চিৎকার করার দরুন মনে হচ্ছে এক্ষুনি গলা বেয়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে। মূহুর্তেই শক্ত একটা চড়ে দু’পা পিছিয়ে যেতে হয় তাকে। মাথা তুলে তাকাতে ইচ্ছে হয় না। যা হয় হোক, সে অন্তত বলেছে তো কিছু; এতেই শান্তি। হয়তো মনের সবটুকু অভিমান, অভিযোগ প্রকাশিত হয় নি তবুও তাওহীদের বিরুদ্ধে বলার জবাব তো দিয়েছে, এতেই চলবে। আর কিছু চাই না। সে আমৃত্যু অপমানিত হতে রাজী। কিন্তু তার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ তার তাওহীদকে অপমান করবে, এমন অধিকার প্রভা কাউকে দেবে না। কাউকে নয়। ক্ষণকাল পেরুতেই প্রভা বুঝল তার বাবা-মা বেরিয়ে গেছে। বাহির থেকে তীব্র শব্দের সব কথা ভেসে আসছে,
– এই জন্যই তোমার মেয়ে এই কদিন এতো বাহিরে বাহিরে ঘুরছে। এতো হয়রান হয়েছে। তোমার মেয়েকে সামলাও মাহমুদা। নয়তো ওকে খুন করব আমি। আজ ও কী বলল এইসব? নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে ও এইভাবে কথা কীভাবে বলে!
প্রভা আলগোছে বসে গেল মেঝেতে। জেদের তাড়নায় দাতে দাত চিপে রইল। দু’চোখ ভেসে গেল ক্ষিপ্রতার বহিঃপ্রকাশে। কল্পনা করল বহু বছর আগে দাদীর কথা। ছেলেবেলাতে দুষ্টুমি করায় মাহমুদা তাকে বড্ড মেরেছিলেন। সেই মার খেয়ে মায়ের মারে ভীত প্রভা যখন বাবার কাছে গিয়ে আশ্রয় আশা করল, সেই মূহুর্তে তার বাবাও তার মাথায় তিন-চারটে শক্ত মার দিলেন। ছেলেবেলায় এমন ঘটনার তীব্র অভিমানে, অসহায়ত্বে প্রভা কথা বলতেও ভুলে গেল। কেবল নীরবে অশ্রু গড়িয়ে গেল তার চোখ বেয়ে। সেই মূহুর্তে প্রভার দাদি এসে আগলে নিলেন প্রভাকে। দু’চোখ ভাসিয়ে আঁচল দিয়ে প্রভার চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বিলাপ করলেন,
– ‘ তুই এই জানোয়ারের ঘরে না আইসা মনিরের ঘরে আইতে পারলি না। মনুষ্যির জাতই না আমার এই পুলা। কেমনে কইরা নিজের মাইয়ারে মারে! এক ভাই নিজের তিন মাইয়ারে আসমানে তুইলা রাখে। আরেক ভাই একটামাত্র মাইয়ারে পশুর মতো মারে। ওই মিনহাজ, দয়া মায়া কী সব বেঁইচা আইছোস! ‘
বলেই বড্ড কেঁদেছিলেন তার দাদি। নিশী তখনো হয় নি। সে তার দাদা-দাদির বড্ড আদরের ছিল। দাদা-দাদি নেই। আদরও নেই। নিজের উপর নিজেরই উপহাস-বিদ্রুপ করতে বড় ইচ্ছে হয়। এ কী জীবন তার! জীবন বুঝি একে বলে? অথচ সে তো জেনে এসেছে গাছের ওপর খড়কুটোর ছোট্ট এক বাসা বেঁধে খাবারের জন্যে, সঙ্গির জন্যে বেরিয়ে পড়ার নাম জীবন। সে তো জেনে এসেছে ‘সকাল-সন্ধ্যে’ ফুলের মতো দু’বেলা নিয়ম করে জাগ্রত হবার নামই জীবন। সে তো জেনে এসেছে সবকিছু ছাপিয়ে কেবল ভালোবাসার মাঝে লুকিয়ে পড়ার নামই জীবন। সে তো জেনে এসেছে অতল মায়ায় ডুবে যাওয়ারই নামই জীবন। সে কী তবে ভুল জেনেছে? হ্যাঁ, ভুল জেনেছে। কিন্তু এখন এতো এতো ভুল শুধরানোর সময় কই?
_____
– আসসালামু আলাইকুম।
প্রভা নীরস কণ্ঠে বলল,
– ওয়া আলাইকুমুস সালাম, হাসান ভাই।
‘ হাসান ভাই’ ডাকটিতে প্রভা শ্রদ্ধা, ভালোবাসার কোনো কমতি রাখতে চাইল না। কিছুটা লজ্জার হলেও সত্য, প্রভা যখনই তাওহীদের মুখে হাসান ভাইয়ের গুণগান শুনেছে, প্রতিবারেই মনে লুকোনো ইচ্ছের উদয় হয়েছে যে, সেও একদিন তাওহীদের মতো করেই হাসান ভাইকে ‘হাসান ভাই’ বলে ডাকবে। আশ্চর্যের হলেও সত্য যে, প্রভা বহুদূরে গিয়ে কল্পনা এঁকেছে যে, তাওহীদের সঙ্গে যখন তার বিয়ে হবে, সে হাসান ভাইকে মন ভরে ভাই বলে ডাকবে। ভাই, ভাই, ভাই। তাওহীদ-সুপ্রভার হাসান ভাই। তবে সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে আজকাল আর মন টানে না। তাই প্রভা এতো এতো অপ্রাপ্তির মাঝেও হাসান ভাইকে ভাই ডেকে কিছুটা প্রাপ্তি অর্জন করে নিতে চাইল।
– আপনারে এইখানে আসতে বইলা অসুবিধায় ফেলি নাই তো, প্রভা আপু?
হাসানের কণ্ঠে জড়তার রেশারেশি। প্রভা মৃদু কণ্ঠে হাসানের বিধ্বস্ত চেহারায় তাকিয়ে বলল,
– একদমই না। তাওহীদ জড়িত কিছুতে আমি কখনো অসুবিধা বোধ করি না হাসান ভাই। আপনি বলুন।
হাসান উশখুশ করতে শুরু করে। বারংবার জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজেয়। হাসানের এমন অস্থিরতায় প্রভা নির্বিকার চেয়ে থাকে। তখনি হাসান বলে ফেলে,
– আমি.. আমি কোনো ব্যবস্থা করতে পারতেসি না আপু। তাওহীদরে ছাড়ানোর কোনো ব্যবস্থা করতে পারতাসি না। কার কাছে যাব, কারে কি বলব কিছু বুঝতাসি না। আমার ভাইটা…
প্রভা মৃত চোখে দেখতে থাকে হাসানের অস্থিরতা। এতোক্ষণ যাবত ঠোঁট ভেঙে ভেঙে বলতে পারলেও এখন তার আরক্ত নয়ন বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বাহুতে সে জল মোছার ব্যর্থ চেষ্টায় ব্যস্ত হাসান। প্রভা চোখ ফিরিয়ে বুকের সকল দীর্ঘশ্বাস বের করতে চায়। কিন্তু হায়…শ্বাস ছাড়ার পরই আবারো জমা হয় এক বুক দীর্ঘশ্বাস।
– আজকে চারদিন গেল গা। কিছু করতে পারতাসি না। তার উপর ট্যাকা নাই। জমানো আছে দশ হাজার। আমার আব্বা-আম্মায় ট্যাকা দিবে না কইয়া দিসে। গ্রামেও খবর দিতে না করসে তাওহীদ। চাচা, চাচি কষ্ট পাইব। কি করুমু না করুমু কূল-কিনারা পাইতাসি না আপু। আপনি যদি…
প্রভা শক্ত ঢোক গিলে বলল,
– আমার কাছে টাকা আছে, হাসান ভাই। আপনি চিন্তা করবেন না। আপনি শুধু দেখেন যদি কোনো উকিল জোগাড় করতে পারেন! আমিও দেখতিসি।
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা চলল। নীরবতা ভেঙে হাসানই বলল,
– আসলে ট্যাকার জন্যেই আপনের সাহায্য চাইতেসিলাম। কারণ ট্যাকা ছাড়া ওরে ছাড়ানো সম্ভব না।
প্রভা হাসানের দিকে তাকাল। লজ্জায় হাসানের মাথা নিচু হয়ে আছে। প্রভা কৃত্রিম হেসে বলল ,
– লজ্জার কিছু নেই, হাসান ভাই। টাকার ব্যাপার আমার ওপরে ছেড়ে দেন। আর দশ হাজারে হাত দেবার প্রয়োজন নেই। আমি লাগলে জানাব। আজকে কী থানায় যাবেন?
হাসান মুখ তুলে উন্মুখ চোখে বলল,
– দেখা করতে দিবে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রভা বলল,
– টাকা দিলে দিতে পারে। আমি যাব এখন।
হাসান হতাশ কণ্ঠে বলল,
– তাইলে আপু আপনি যান। আমারে একজন উকিলের সন্ধান দিবে বলসে। আমি তাইলে ওইদিকে যাই। কালকে নাকি তাওহীদরে ম্যাজিস্ট্রেট এর কাছে নিবে। ওর মামলার সত্য মিথ্যা যাচাই করে ওরে হাজত থিকা কারাগারে দিয়া দিবে। এর মধ্যেই রিমান্ড যদি দিয়া দেয়, আমার ভাইরে যদি মারে! শুনসি ওইখানে অনেক যন্ত্রণা দেয়। আমারে তাড়াতাড়ি কিছু করতে হইব। আমি গেলাম। আপনি সাবধানে যাইয়েন।
প্রভা জড়বস্তুর ন্যায় মাথা নাড়ায়। সাধারণত চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই ম্যাজিস্ট্রেট বিচার তদন্ত করে সত্য-মিথ্যার। সেখানে তিনদিন পরে কেন করছে তা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে হলো না প্রভার। কিছুক্ষণ আগে বলা হাসান ভাইয়ের কথা সত্য হলে, রিমান্ড আটকানোর কোনো পথ প্রভা খোলা দেখছে না। আল্লাহর রহমতে জামিন যদি হয়ও সেখানে অনেক ঝামেলা পেরুতে হবে। ততোদিনে রিমান্ড কার্যকর হলেও আশ্চর্যের কিছু হবে না। হাসান ভাই কতো স্বপ্ন নিয়েই না কথাগুলো বলে গেল! অথচ সবকিছু কী এতোই সহজ! প্রভার হৃদয় নিভতে গিয়েও বাতাস পেয়ে ধপ করে জ্বলে ওঠার মতো জ্বলে উঠল। না হোক সহজ, তবুও চেষ্টা তো চালিয়ে যেতে হবে। চেষ্টা না করেই এতো সহজে পিছু হটলে কেমন করে চলবে?
প্রভা অদূরে ক্ষীণ হয়ে যাওয়া হাসানের দিকে তাকায়। হাসান ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতার ভারে নুয়ে পড়ে প্রভার দুনিয়া। আল্লাহর এই দুনিয়ায় কতো ধরনের মানুষেরই না বাস! ভেবেই আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না।
প্রভা ক্ষণকাল নীরব থেকে হাঁটা দেয়। হাঁটা দেয় জানা তবুও অজানা আকাঙ্ক্ষার পথে, হাঁটা দেয় নিভু নিভু স্বপ্নের পথে, হাঁটা দেয় নিজের এক অংশের জন্যে যুদ্ধের পথে…
চলবে-
_____
গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – আঠারো (পরবর্তী অংশ)
_____
বদ্ধ কারাগারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ‘কেমন আছেন?’ প্রশ্নটা প্রভার কণ্ঠ পেরিয়ে বেরুতে পারল না। কণ্ঠনালিতেই আটকা পড়ে ক্ষত-বিক্ষত হলো কাঁটাতারের নির্মম আঘাতে। আজ সাক্ষাৎঘরে নয়, সোজাসুজি হাজতের সামনেই নিয়ে আসা হয়েছে প্রভাকে। মাঝের বিশাল বিশাল শক্ত লোহার বেষ্টনীর বিপরীতে তাওহীদের সরল মুখখানা বড় বেমানান দেখাল প্রভার চোখে। কঠিন একটা ঢোক গিলে নীরবে চেয়ে রইল একভাবে। প্রভার এমন দৃষ্টির পরে এতোক্ষণ প্রভা যে প্রশ্নটা করতে পারছিলো না, তা তাওহীদই করে বসল। হাসিমুখে জানতে চাইল,
– কেমন আছেন, সুপ্রভা?
প্রভার চোখ পিটপিট করে। তাওহীদের চেহারার ম্লানিমায় আহত হয় প্রভার হৃদয়। তবুও নিজেকে এই বুঝিয়ে আশ্বস্ত করতে চায় যে, হোক তাওহীদের চেহারা ম্লান, তার হৃদয় তো আর নয়। বাহ্যিকরূপে মলিনতা খুব সহজেই ছাপিয়ে যেতে পারে, অন্তরে তা পারে না। প্রভা তাওহীদের মতো প্রাণ থেকে হাসতে জানে না, তবুও চেষ্টা চালিয়ে বলল,
– আপনার কী মনে হয়? কেমন আছি?
তাওহীদ আবারো হাসে। পরিস্থিতির ভাবে মনে হয় যেন খুব স্বাভাবিক পরিবেশে রয়েছে তারা। তাওহীদ বলে,
– আপনি কেমন আছেন এটা কী আমার জানার কথা?
– জানার কথা নয়?
– নাহ। আপনি আমি আলাদা মানু্ষ। আমাদের সবকিছুই আলাদা।
প্রভা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– ভালো আছি আমি, তাওহীদ। ঘুরছি, ফিরছি। স্বাদের খাবার খাচ্ছি। নরম গদিতে ঘুম দিচ্ছি। খারাপ থাকব কোন কারণে? আমি ভালো আছি। আপনার দিনকাল কেমন যাচ্ছে?
প্রশ্নটা বোধহয় খুব পাষণ্ড শোনাল। শোনাক। শোনালেও প্রভার কিছু করার নেই। তাওহীদ তার সঙ্গে হেয়ালি করলে প্রভাও করবে।
তাওহীদ ঠোঁট ভেজাল। উৎফুল্ল কণ্ঠে আমোদ নিয়ে বলল,
– আমি তো ফিটফাট। খাই, ঘুমাই, বইসা বইসা নানান কথা ভাবি। এক্কেবারে ভালো আছি। খালি কারেন্টের উপদ্রবে একটু ঝামেলায় পড়ি। রাত্রবেলাতে ঝামেলাডা বেশি করে। কারেন্টের জন্যে ঘুম আসতে পারি না।
একাধারে তাকিয়ে থাকা প্রভার জন্য বলতে বলতে ক্রমশ নিভে যাওয়া তাওহীদের চেহারা বুঝতে মোটেও কোনো দৈব শক্তির প্রয়োজন পড়ল না। ক্রমশ উৎফুল্লতার হ্রাসে, তাওহীদের বেরিয়ে আসা সরলতায় প্রভার হৃদয় থমকে দাঁড়াল। তাওহীদ কী জানে, সে যে না চাইতেও নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে দিচ্ছে? প্রভা ধুক ধুক হৃদয়ে অবুঝের মতো নরম কণ্ঠে শুধাল,
– অন্ধকারে খুব ভয় হয়, তাই না তাওহীদ?
আশকারা পেয়ে কেবল নারীর হৃদয় আহ্লাদে গলে পড়ে – এ বাক্যকে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণ করে তাওহীদের চোখে ভেসে উঠল টলটলে অশ্রুধারা। সঙ্গে ঠোঁটের সেই সরল হাসি নিয়ে মাথা নেড়ে বোঝাল, না, তার ভয় হয় না। তাওহীদের এমন অবুঝ পনায় প্রভার চোখ ছাপিয়ে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা বিশাল দুঃখ। সেই দুঃখের চিহ্ন কপোলে রেখেই প্রভা আদরে, মমতায় লোহার শিক গলিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। তাওহীদের গালে সামান্য ছোঁয়ায় স্পর্শ করে বলল,
– পরেরবার দেখা করতে এলে মোমবাতি, লাইটার নিয়ে আসব। মোমবাতি জ্বেলে রাখবেন। কিচ্ছু হবে না। আঁধার খুব সামান্য একটা বিষয় তাওহীদ। এত ভয় পেলে চলে নাকি? পরেরবার সব নিয়ে আসব আমি। ততোদিন একটু কষ্ট করে থাকুন, কেমন?
প্রভার এমন মমতাময়ী কণ্ঠের কথা শুনতে তাওহীদের ভালো লাগছে। তাই সে কথার ঘোরেই হাসিমুখে মাথা নেড়ে জানাল, তার খুব মনে থাকবে।
প্রভা তাওহীদের চিন্তায় রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,
– আপনি কোনো কিছুতেই ভয় পাবেন না, তাওহীদ। প্লিজ। এটা আমার অনুরোধ। কিছুক্ষণ পরেই আপনাকে ম্যাজিস্ট্রেট এর কাছে নেওয়া হবে। সেখানেও ভয় পাবেন না। আমি, হাসান ভাই, আপনার মা আমরা সবাই আছি তাওহীদ। আমরা ঠিক ছাড়িয়ে নিব আপনাকে।
– জেলে থাকার ভয় আমার নাই, সুপ্রভা।
হঠাৎ করেই ক্ষণকাল পূর্বের তাওহীদ যেন বড্ড বুঝদার হয়ে গেল। ভরাট কণ্ঠের এমন কথার বিপরীতে প্রভা বলল,
– মানে?
– দোষ করলে তো শাস্তি পুলিশ দিবোই তাইনা? এমনে এমনে তো ছাইড়া দিব না।
– আপনি কী বলতে চান?
– খুন করসি না আমি?
– আপনি তাদের মেরেছিলেন তাওহীদ। হ্যাঁ, হয়তো নৃশংস ভাবে। কিন্তু তারা মারা যে গেসে এইটার প্রমাণ কী?
তাওহীদকে এবার একটু বিভ্রান্ত দেখাল। গোলমেলে গলায় বলল ,
– আমি যে ওদের খুব মারসি এইটা তো সত্যি। এমন তো হইতেই পারে যে ওরা হাসপাতালে যাওয়ার পর মারা গেসে।
প্রভা দিশেহারা হয়ে বলল,
– জানি না আমি। জানি না। জানি না। এইসব আমি জানতে চাইছি না তাওহীদ। আমি জানি যে আপনাকে আমি ছাড়িয়ে নিব।
তাওহীদ দুনিয়ার প্রতি তীব্র অভিমান থেকে বলল,
– আমি বের হইলেই কী আর না হইলেই কী?
প্রভা করুণ, অস্থির কণ্ঠে বলল,
– অনেক কিছু।
– কী অনেক কিছু?
– আপনার কাছে আমার অনেক জিনিস পাওয়ার আছে, তাওহীদ।
তাওহীদ প্রভার কথার স্রোতের ধারা বুঝল। ধারার বিপরীতে চলে গিয়ে আচমকা বলে বসল,
– চোখ ডাইবা গেসে কেনো? ঘুমান না, সুপ্রভা?
– না।
– কেন?
প্রভা উদাস হয়ে বলল,
– ঘুমানোর জন্যে ঘর পাই না, তাওহীদ।
– আপনার ঘর আছে না?
– ঘর মানে কী আপনি জানেন?
– ঘর মানে আরাম, স্বস্তি, স্বাচ্ছন্দ্য।
– আমার ঘরে স্বস্তি নেই তাওহীদ। সেটা একটা ইট-পাথরের ইমারত ছাড়া আর কিছুই না আমার জন্যে। স্বস্তি পাই না, তাই ঘুমও আসিনা।
প্রভার কথা শুনে কিছু বলতে পারে না তাওহীদ। প্রভার চোখে চেয়ে কী যেন বুঝতে চেষ্টা করে। প্রভা নিজেই বলল,
– আমাকে একটা ঘর দেবেন আপনি?
প্রভার এমন প্রশ্নে বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে তাওহীদের। তবুও অস্বস্তি গিলে নরম, সাবলীল কণ্ঠে বলে,
– দেব।
– কবে দেবেন?
– জেল থেকে বেরিয়েই দিব।
– আমি তবে অপেক্ষা করব আপনার বেরোনোর?
প্রভার এমন দুঃখী কণ্ঠের বিপরীতে তাওহীদ মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। থাকুক না কিছু মিথ্যা প্রতিশ্রুতি।
তাওহীদের সায়ে প্রভা মাথা নামিয়ে হেসে ফেলে। বলে,
– দেখেছেন কী বেয়াদব, কী গাধা আমি! এখানে এসে কীসব কথা বলে চলেছি!
তাওহীদ মাথা নামিয়ে রাখে। কোনো জবাব সে দেয় না। প্রভা নিজেই বলে,
– আজ আসি, তাওহীদ। কেমন?
তাওহীদ মাথা উঁচিয়ে আরোও কিছুক্ষণ থাকার আবদার করতে চায়। করা হয়না। আবদার চোখে মাথা নাড়িয়ে বিদায় জানাতে হয়। প্রভা সে বিদায় নিয়ে কৃত্রিম হেসে চলে গিয়েও ফিরে চায়। বলে,
– নিজের খেয়াল রাখবেন, তাওহীদ। আপনার জন্যে না হলেও আমার জন্যে।
শেষের বাক্যটি বেরোয় বড় অস্পষ্টভাবে। তাওহীদ যে সে বাক্য শোনে নি তা আর ঘটা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। একলা তাওহীদকে ফেলে এগিয়ে যায় তাওহীদের সুপ্রভা।
_____
ভেসে গেছে আরোও কিছুদিন। সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য কে জানে, তাওহীদকে রিমান্ডে নেওয়া হয় নি। রিমান্ড ব্যতীতই পুলিশ মামলা বিষয়ক সকল চার্জশিট জমা করে দিয়েছে। এছাড়াও ম্যাজিস্ট্রেট যখন তাওহীদকে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে সাধারণ কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন, তাওহীদও তার অটল উত্তর দিয়েছে। তাকে যখন দুই নিহত ব্যক্তির ছবি দেখিয়ে জিগ্যেস করা হয়েছে,
– আপনি এদের চেনেন?
তখন ক্ষণমুহূর্তের জন্য থমকে গেছে তাওহীদ। সে এতোদিন যাবত জানতো তার খুনের মামলা একজনের বিরুদ্ধে। আর আজ এখন জানছে সে দু’ দু’জন মানুষকে খুন করেছে! ছবিগুলো দেখে চিনতে অসুবিধে হয় না তাওহীদের। বলে,
– জ্বি, চিনি।
– আপনি এদের খুন করেছেন?
তাওহীদ স্বচ্ছ সরল উত্তরে বলে,
– তারা কোনো ভালো মানুষ না, স্যার। তারা আমার সামনেই একটা মেয়ের সম্মান হাত দিসে। খারাপ আচরণ করসে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মেয়েটিরে ধর্ষণ করা। তাই আমি মেয়েরে বাঁচানোর জন্য উনাদের মারি। তবে আমার সামনেই তারা প্রাণ বাঁচাই পালায় যায়। এরপর আর আমি কিছু জানি না।
ম্যাজিস্ট্রেট কিছুক্ষণ গম্ভীরমুখে বসে থেকে বলেন,
– ধরলাম আপনি সত্যি বলছেন। তবে সেই মেয়েকে যদি সাক্ষী হিসেবে আনা হয়, তাতে নিশ্চয় আপনার কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়?
তাওহীদ বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
– সে মেয়েটা সাক্ষী হিসেবে আসতে পারবে না, স্যার।
– কেন পারবে না?
– আমি চাই না আসুক।
– আপনার চাওয়া না চাওয়াতে আদালত কাজ করবে?
তাওহীদ উত্তর দেয় নি। ম্যাজিস্ট্রেটও তাওহীদের হেয়ালি, মামলার তথ্য সকল কিছু পর্যবেক্ষণ করে, মামলার বৈধতা যাচাইকরণ করে পাঠিয়ে দিয়েছে তাকে জেল হাজতে। তাওহীদের প্রমোশন হয়ে হাজত থেকে জেল হাজত হয়েছে তার ঘর। তাকে এও জানানো হয়েছে, সামনের মাসের এক তারিখেই তার বিচারকার্যক্রমের প্রথম দফা বসবে। তাওহীদ হাফ ছেড়ে জেলের দরজায় তাকাল। দৃষ্টিতে আটকাল সেই গুরুজন গুরুজন ভাবের কনস্টেবলকে। তার আসামী হিসেবে প্রমোশন হলেও থানা পরিবর্তন হয় নি। একই থানার উপর বিভাগে পৌঁছেছে, এই যা! গুরুজন ভাবের লোকের দেখা পাওয়া অদ্ভূত কোনো ব্যাপার নয়; ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তো একই কনস্টেবলরা ডিউটি পালন করছে। তাওহীদ নিজে থেকেই জেলারটিকে ডেকে উঠল,
– আমি যেইখানে যাই আপনিও দেখি সেইখানেই থাকেন, স্যার!
লোকটি ফিরে চাইলেন। চোখে নরম ভাব। তাওহীদের উত্তর না দিয়ে বললেন,
– তোমার লোকজন কোনো উকিল এখনো ঠিক করতে পারে নাই?
তাওহীদ অনুজ্জ্বল হেসে বলল,
– চেষ্টা করতেসে। আর এমনেতেও আমি তো খুন করসিই। এইখানে উকিল কী কিছু করতে পারব?
তাওহীদের এমন উত্তরে জেলারের চোখে এবার সূক্ষ্ম অবিশ্বাস দেখা গেল। বলল,
– তুমি সত্যিই খুন টা করসো?
তাওহীদ মাথা নামিয়ে নিল। প্রভার মুখ মনে করে অদ্ভূত ব্যথায় ছেয়ে গেল বুক। ম্লান কণ্ঠে বলল,
– কখনো কখনো অনেক কিছু না চাইলেও করা লাগে।
জেলার তাওহীদের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। চেয়ে থেকে বললেন,
– তোমার লোকজনরে বলবা জামিনের চেষ্টা করতে। উকিল না পাইলে আদালত থেকেই দিবে। জামিনের আবেদন যেন তেন কথা না। আগেভাগে নিম্ন আদালতে আবেদন করতে হবে। না হইলে হাইকোর্টে। সেখানেও না হইলে সুপ্রিম কোর্টে। আর টাকার ব্যবস্থা রাখবা, টাকা থাকলে এই দুনিয়ায় সবই সোজা।
তাওহীদ কিঞ্চিৎ আশ্চর্য হয়ে ছেলেমানুষী কণ্ঠে বলল,
– টাকা থাকলে খুন কইরাও বাঁচতে পারুমু বলতেসেন? তবে খুনের সাজা যে ফাঁসি এইটা তো সবাই জানে।
জেলার তাওহীদের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝতে চেষ্টা করলেন। পারলেন কি না কে জানে, বললেন
– তোমারে রিমান্ডে নিসে?
– না।
– খুনের আসামি রিমান্ড নেয় নাই?
– না।
– তাইলে তদন্তও হয় নাই?
তাওহীদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– ওইসব কিছু জানি না আমি। আমারে যা জিগ্যেস করসে সবকিছুর খালি উত্তর দিয়ে আসছি। আইন নিয়া ওইভাবে পড়া হয় নাই।
নীরবে পার হলো কিছু সময়। নীরবতা
কাটিয়ে তাওহীদ আবারো জানতে চাইল,
– এই জেলে কী আমি একাই থাকুমু?
– না। পরে যতোজন আসামি আসব, তারা এই জেলেই ঢুকব। তার আগ পর্যন্ত একাই থাকবা।
– স্যার, আপনার আমার এই জেলে কয়দিন পর পর ডিউটি পড়ব?
– ৩ দিন পর পর পরে মনে হয়। কীসের জন্য?
তাওহীদ এক মুহূর্তের জন্য তার জীবনের সকল দুর্যোগ ভুলে প্রাণ ভুলানো হাসি হাসল। হাসিমুখে বলল,
– আপনার সঙ্গে কথা বলতে আরাম লাগে। আপনার যখন যখন এইখানে ডিউটি পড়ব, আমি আপনার সঙ্গে তখন তখন কথা বলব। কথা বলেই কাটায় ফেলব সব সময়।
এক আসামির মুখ থেকে এমন কথায় কী অভিব্যক্তি হওয়া উচিত তা জেলার লোকটির জানা নেই। একটু বোধহয় রাগ করতে চাইলেন, হলো না। উলটো বুকে বইয়ে গেল বাঁধাহীন মায়ার স্রোত। কী বলবেন, কী উত্তর দেবেন মনে এলো না। তবে এমন অস্বস্তিকর এক মুহূর্ত থেকে বিধাতা তাকে চট করে রক্ষা করলেন। তাদের জেলের সামনে দিয়েই একজন মধ্যবয়সী লোককে অমূল্য রত্নের মতো রক্ষা করে নিয়ে যাওয়া হলো। পুলিশেরা নিয়ে গেলেন। এক দল পুলিশ চলে যেতেই তাওহীদ, জেলার এর মন সেদিকে ঘুরে গেল। তাওহীদ বলল ,
– স্যার, ঐদিকে আরোও জেল আছে?
জেলার বলল,
– ওইদিকে সব কারাগার। নতুন একজন আজকে কারাগারে ঢুকল। এখন কয়মাস, কয়বছর নাকি যাবজ্জীবন কে জানে!
গরাদ গলিয়ে উন্মুখ চোখে তাওহীদ দেখতে চায় সেই আসামিকে। চোখ জুড়ে তার ছেলেমানুষী উৎসাহ দেখা গেলেও ভাসমান মেঘের মতো ক্ষণকাল বাদেই সেই চোখে ফুটে ওঠে অতল হতাশা। নিভে যায় মায়ায় তলানো মুখ। মন আসামির স্থানে নিজেকে দেখে হতাশ হয়, না আসামির জন্যে দুঃখবোধে হতাশ হয় কে জানে! ছেলেমানুষী টলটলে স্বচ্ছ চোখে নির্নিমেষ কেবল চেয়ে রয়। তারা সকলে সে দৃশ্য থেকে মুছে গেছে অনেকক্ষণ, তবুও তাওহীদ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।
_____
মেঝেতে অগোছালো বসে আছে প্রভা। তার সামনেই বিছানায় বসে উদগ্রীব চোখে চেয়ে আছে আফরিন। উদ্দেশ্য প্রভার লক্ষ্য বোঝা। সম্ভব বলে মনে হয় না। এখানে এসেও বড় ফাঁসা ফেঁসে গেছে আফরিন। বন্ধুর চিন্তায় পাগল হয়ে যখন তার বাড়িতে এলো, তখনো প্রভা বাড়ি ফেরে নি। ফিরল আরোও আধ ঘন্টা বাদে। ফিরেই তাকে নিয়ে ঘরে দোর আটকে কিছুক্ষণ স্থবিরতা নিয়ে পড়ে রইল বিছানায়। কোনো কথা নেই, কাজ নেই। চারিপাশে তখন অস্থির নীরবতা। সেই নীরবতার রেশ ভেঙে আফরিন কিছু বললেও শোনে নি প্রভা। নিশ্চুপে চেয়ে থেকেছে ওপরে। আফরিন বিস্মিত চোখে দেখেছে, প্রভার নীরব কান্না। প্রভার নীরব কান্নাতে আফরিনের মনে হয়েছে চোখের পানিগুলোও প্রভাকে ধিক্কার জানাচ্ছে। তীব্র অভিযোগে ভরিয়ে তুলছে তাদের প্রতি এমন অবহেলাতে। কাঁদতে হয় যত্ন নিয়ে, অশ্রু মুছে দিতে বড় আদরে। অথচ অশ্রুফোঁটার প্রতি প্রভার এমন নির্মমতা বোধহয় সহ্য হয় নি তাদের। সবশেষে যখন আফরিন নিজের বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা বলেছে, প্রভা তখন নির্বিকার দৃঢ় কণ্ঠে আদেশ শুনিয়ে দিয়েছে,
– আজ তুই কোথাও যাবি না, আফরিন। কোথথাও না। আজ আমার সঙ্গে থাকবি। তোকে নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। আমি একা সম্ভব না। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগে আফরিন। কোনোকিছুতেই এই ক্লান্তি কাটে না। তুই একটু বোস। আমি একটু স্বস্তি পাই। মনকে একটু আশ্বস্ত করি যে আমার কাছে কেউ না থাকলেও তুই আছিস।
এমন আবদার আফরিন ফেরায় নি। বলতে হয়, কোনো মানবিক মানুষের পক্ষেই হয়তো ফেরানো সম্ভব হতো না। এরপর থেকেই সে বসে আছে এই বদ্ধ ঘরটাতে। এরমাঝে প্রভার মাকে একবারো দেখা যায় নি। সে নিয়ে আশ্চর্য হতে গিয়েও হয় না আফরিন। অনেক বছর তো হলো তাদের জানে; আর কতো হতবাক হবে সে? আর হয় না। বরং শীতল কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ হয় তার হৃদয়। তার পরিবার আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল, তাদের পারিবারিক দ্বন্দ্বের ঘটনা, কাহিনী অপ্রতুল। তবুও তার বাবা-মা অন্তত তাদের ভালোবাসে, অন্তত মূল্য দেয়। তার কোনো বন্ধু গেলে সামান্য হলেও হেসে কথা বলে। এই তো কতো! আর কী চাই! ঠিক সেই সময়ে আফরিন ভুলে যায় তার জীবনের সকল অস্বচ্ছতা, সকল আর্থিক দুঃখবোধ।
আফরিনের ভাবনার মাঝেই প্রভা তার ছেলেবেলার ব্যাংক ভেঙে দিয়েছে। এখন সে একে একে নোট আলাদা করণে ব্যস্ত। চোখ তুলে নীরব কণ্ঠে বলল,
– আয়, আলাদা কর। একা কতোক্ষণ করব?
আফরিন যায় না। উলটো হতবুদ্ধি দৃষ্টিতে বলে,
– তুই তোর ছোটবেলার ব্যাংক ভেঙে ফেললি!
– ফেললাম।
– কী জন্যে?
– তাওহীদের জন্যে।
আফরিনের আশ্চর্য হওয়ার পারদ বেড়ে আকাশ ছুঁলো। তাওহীদের কারণে প্রভা ব্যাংক ভেঙে ফেলবে, এমন ভাবনা তার মস্তিষ্কের ধারের কাছেও ছিল না। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
– কদিনের অজানা একটা ছেলের জন্য তুই….
প্রভার মৃত চোখের দৃষ্টিতে কথা থামিয়ে দেয় আফরিন। দৃষ্টি মৃত হলেও সে দৃষ্টিতে কেমন নীরব শাসন। আফরিন থেমে গেল।
প্রভা আফরিনের দিকে কিছুসময় চেয়ে রইল একাধারে। দুনিয়ার সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়তে ইচ্ছে হলো, দিনের হিসেবে কী প্রিয়জন হওয়া যায়? তার সাথে তো তার বাবা-মায়ের সম্পর্ক তেইশ/সাড়ে তেইশ বছরের। কোথায়! তারা তো প্রভার প্রিয় হলো না। তাওহীদের সঙ্গে চেনা-জানার আট, নয়মাস পেরিয়েছে কেবল। অথচ মা-বাবা এর চেয়ে তো তাওহীদ বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রভার জন্য। কথাটা বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি শোনাল। শোনালেও কিছু করার নেই। প্রভা সম্মানের পাগল। সম্মান সকল সম্পর্কের ধ্রুব সত্য – এই নীতিতেই বিশ্বাসী সে। এই যে তার বাবা, মা; তাদের ব্যবহারে প্রভার প্রতি কী তীব্র অসম্মান! সেই অসম্মান প্রভা সইতে পারে না। আবার না সইয়েই সে কাটিয়ে দিল তেইশটা বছর। অন্যদিকে তাওহীদ তার সামান্য কথাতেও প্রভাকে সম্মানিত করেছে, বিশেষ করে তুলেছে। তবে সে প্রভার আপন হবে না কেন? প্রভার ভার মনকে যখন সকলে পাথর হিসেবে দেখেছে, তাওহীদ সেখানে দেখেছে প্রভার একাকীত্ব। তবে সে আপন না হয়ে আর কে আপন হবে? প্রভা জড়বস্তুর ন্যায় চেয়ে রইল নিজের হাতে। আফরিনকে সে সকল ঘটনার মূলভাব জানিয়েছে তবে সে কেন্দ্রিক ঘটনা টা বাদে। একবার মন বলেছিল, বলে দেয়। না বললে তো আফরিন বুঝবে না। তাওহীদকে চিনবে না। তবুও বলা হয় নি। কানের সামনে কেউ এসে বলেছে,
– আপনার জীবনে আমি নামক বন্ধুর যদি কোনো মূল্য থাকে, তবে আজকের ঘটনা কক্ষনো কাউরে জানাবেন না, সুপ্রভা। কাউরেই না।
সেই কথা স্মরণ করে আফরিনকে বলার সাহস আর হয় নি। হয়তো কখনো হবে না। প্রভা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– ক’ দিনের অজানা একটা ছেলেই আমার জন্য কতো যে বিশেষ তা তুই জানিস, আফরিন। তুই অন্তত এভাবে বলিস না।
আফরিন নিভু কণ্ঠে বলল,
– না, সেভাবে বলিনি। তবুও যদি একবার ভেবে দেখতি।
প্রভা টাকা গোছাতে গোছাতে বলল,
– তাওহীদ আমার সকল কাজ, সকল ভাবনার উর্ধ্বে, আফরিন। হতে পারে উনি আমার জীবনেরও উর্ধ্বে।
প্রভার মুখে এমন দৃঢ় কথায় নীরব হয়ে যায় আফরিন। বলার মতো কিছু পায় না। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে প্রভার কর্মকাণ্ড। আফরিন শুনেছিল এই ব্যাংক প্রভা যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে, তখনকার কেনা। প্রভা ভীষণ শখ করে কিনেছিল। দেখতে সাধারণের তুলনায় বেশ বিশাল। ব্যাংকটি যে প্রভার জন্য কতো মূল্যবান, কতো শখের, কতো যত্নের তা আফরিন জানে। প্রায়শই প্রভা বলে বসত, এই ব্যাংকের টাকা দিয়ে একদিন সে তার সকল স্বপ্ন পূরণ করবে। এইটা করবে, ওটা করবে। কতোই না স্বপ্ন তার। অথচ আজ এইভাবে…..এসব কী ভাবছে আফরিন! প্রভা তো ঠিকই করছে। নিজের স্বপ্ন পূরণ করছে। তাওহীদ যে প্রভার কতো বড় একটা স্বপ্ন তা ইতোমধ্যে আফরিনের বোঝা শেষ। এখন তো প্রভার একমাত্র এবং সর্বপ্রধান স্বপ্নই তাওহীদ। তবে, সৃষ্টিকর্তা কী এই স্বপ্ন পূরণ করবে মেয়েটার? নাকি বরাবরের মতো এবারেও অপূর্ণ থেকে যাবে তার স্বপ্ন! এবারেও হেরে যাবে মেয়েটা! কে জানে…কখন কার কী হয়, কী হবে তা সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত আর কে জানে…!
চলবে-
_____
#অকিঞ্চন
#শারমিন_ইরান