গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – উনিশ (প্রথম অংশ)
_____
– আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু।
– জ্বি, আমি সুপ্রভা রহমান বলছিলাম।
– বলেন, মিস সুপ্রভা ।
প্রভা ইতস্তত বোধ করল। ভুল হয়ে গেছে। সুপ্রভা রহমান নয়, বলা প্রয়োজন ছিল প্রভা রহমান। তার নাম সুপ্রভা। অথচ এই নামে তার দাদা এবং তাওহীদের মুখ ব্যতীত অন্য কারোর থেকে শোনা হয় নি। তার মা, বাবা, আফরিন, নিশী কী ভেবে তাকে প্রভা বলে ডাকে তারাই জানে। তাদের মুখ থেকে প্রভা শুনে শুনে হঠাৎ সুপ্রভা শুনতে অস্বস্তি হলো।
ওপাশের ব্যক্তিটি নিজে থেকেই প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
– আপনি তাওহীদ আলমের কেস নিয়া যে আসছিলেন। সে না?
– জ্বি।
– হ্যাঁ, বলেন কী বলতেন?
– আপনি মামলা বিষয়ে কতোদূর ভাবলেন তাই জানার ছিল?
– আপনার আমারে কী কোনোভাবে সন্দেহ হইতাসে?
– জ্বি না, সন্দেহ না। আমি অনেক চিন্তিত। আপনি বলেন আপনি কতোদূর আগালেন।
– দেখেন! আপনারে আগেই কইসি যে আমি একজন সফল আইনের লোক। আমার ভাষা এদিক-ওদিক হইতে পারে কিন্তু আমার কেস না। সফল আইনজীবী হইয়াও আমি কারোর উপরে জুলুম করি না তা নিশ্চয় জানেন।
প্রভা অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে ফোন এক কান থেকে অন্য কানে নিল। কিছুটা অতিষ্ঠ হয়ে বলল,
– আপনি অতিরিক্ত কথা বলেন। আমি যা জানতে চাইছি তাই বলেন। এফআইআর এর কাগজ দেখে কী বুঝলেন?
– বাবা, মামলা অনেক গুরুতর। দুই দুইজন খুনের আসামি। জামিন তো চাঁদ পাওয়ার সমান।
আকাঙ্ক্ষিত কথার বিপরীত কথায় দু’চোখ চিপে বন্ধ করে নেয় প্রভা। সকল রাগ গিয়ে পড়ে রাশেদ নামক লোকটির ওপর। অস্থিরতা হাঁসফাঁস করে উঠে জানতে চাইল,
– জামিন কী হবেই না?
– বাবা শোনেন, আল্লার দুনিয়ায় অসম্ভব নামক শব্দ খাটে না। জামিন হবে। তবে এই হওয়াটাতে বিশাল সময়ের ব্যাপার স্যাপার আছে। আবার নাও হইতে পারে। আমি আপনারে মিথ্যা আশা দিব না। সবচেয়ে বড় বিষয়, মামলাটা বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। পুরো ব্যাপারটিকে এমন ভাবে গাঁথা হয়েছে যে আসামির দোষী প্রমাণ হওয়া সহজ। আবার একবার জামিন নাকচ হয়ে গেলে পরে বের করাটা আরোও কঠিন।
প্রভা চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। লোকটর কথাগুলো প্রভার কানে গোলক ধাঁধাঁর ন্যায় পেঁচিয়ে উঠল। কী বলবে, কী করবে, এমন কী প্রতিক্রিয়া কেমন দেবে তাও বুঝে ওঠা হলো না। যন্ত্রের মতো কেবল হুট করে প্রশ্ন করে বসল,
– আসামির শারীরিক অবস্থা যদি ভালো না হয়? যদি বলি সে অসুস্থ?
ওপাশ থেকে রাশেদ সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইলেন,
– কী অসুখ?
প্রভা মুখস্থের মতো বলল,
– হার্টের সমস্যা আছে ওনার।
রাশেদ সাহেব এবার বললেন,
– অসুস্থতার ভিত্তিতে জামিন পাওয়ার সুযোগ আছে। তবে কোট সেটা মানব বলে মনে হয় না।
– কেন?
– খুনের মামলা বইলাই। সাধারণ অপরাধ হলে সহজ হইতো, কিন্তু কোর্ট এখানে সন্দেহ করবে রিপোর্ট সাজানো কি-না।
প্রভা একটু সাহস জুগিয়ে মিথ্যে বলতে চাইল,
– কিন্তু তাওহীদ তো সত্যিই অসুস্থ।
– মেডিকেল গ্রাউন্ডে জামিন চাইতে হলে আমাদের সরকারি হাসপাতালের রিপোর্ট লাগব। বেসরকারি হাসপাতালের রিপোর্ট কোর্ট সহজে গ্রহণ করতে চাইব না।
প্রভা আশাবাদী কণ্ঠে বলল,
– যদি সরকারি হাসপাতাল থেকে রিপোর্ট নেওয়া যায়?
– তাহলে একটা সুযোগ থাকবে। কিন্তু খুনের মামলায় মেডিকেল জামিন পেতে হলে খুব শক্ত আইনি লড়াই করতে হবে।
– তাহলে কাজ শুরু করেন।
– তা তো করেছিই। তবে আমার কথা মনে আছে তো?
প্রভা বুঝতে পেরেও এক ফোঁটা ভরসার অভাবে নীরব রইল। রাশেদ সাহেব নিজেই বললেন,
– খুনের মামলার জামিন… এইটা কমপ্লেক্স ব্যাপার। ফাইল স্টাডি, কোর্ট ফি, সময়—সব মিলিয়ে…
– আপনি জামিনের ব্যবস্থা করেন। যেদিন তাওহীদ বেরোবে সেদিনই আমি পঞ্চাশ হাজার দিয়ে দিব। এরপর যত লাগে তার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
– আপনের কথা বিশ্বাস করলাম, বাবা। সারাজীবন টাকার পিছে ছুইটা এখন একটু হালাল ইনকাম করতে চাই। আশা রাখি কথার খেলাপ করবেন না।
প্রভা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন কেটে দেয়। সেদিন মাটির ব্যাংক থেকে চুয়ান্ন হাজার পাঁচশ এর মতো টাকা বেরিয়েছে। এক দু’ বছরের তো আর নয়; বারো/তেরো বছর ধরে জমাচ্ছে প্রভা। আল্লাহর রহমতে তার জীবনে শখের অপারগতা, প্রিয়জনের দূরত্ব থাকলেও আর্থিকভাবে অস্বচ্ছতা ছিল না। বাবা, মা, মামা, খালা, ফুপু, কাকা যে যখন পেরেছে হাত ভরে ভরে কেবল দিয়েছেনই। তাই জমিয়ে এই পর্যন্ত এসেছে।
প্রভা চিন্তিত মুখে খাটে বসে। চারিপাশের এমন সংকটে সব ভুলে কোথাও গিয়ে লুকিয়ে পড়তে বড্ড মনে চায়। যেখানে দুঃখ থাকবে না, শখ থাকবে না, অতীত থাকবে না। সবচেয়ে বড় বিষয়, অনুভূতি থাকবে না। অনুভূতি থাকলেই তো তাওহীদও এসে পড়বে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তাওহীদ নামক মানুষটি থেকেও পালাতে বড় ইচ্ছে হয়। প্রভা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভাবনা ঘুরে ফের টাকায় গিয়ে ঠেকল। পঞ্চাশ হাজার না-হয় দেবে সে। কিন্তু পরের গুলো! তার বাবা-মা তো তার প্রতি এতোও সদয় নয় যে চাইবার মাত্র তার আশানুরূপ টাকা হাতে তুলে দেবে! প্রভা উঠে পড়ে টাকাগুলো হাতে নেয়। গুণে দেখুক, যদি টাকা বেড়ে যায়! অনর্থক চিন্তা জানে সে, তবুও! হতেও তো পারে। তাই না? আবারো গুণতে চাওয়ার প্রয়াসে টাকা হাতে নিলেও আচমকা মনে ভাসে আফরিনের মুখটি। এতো এতো আপনজনের মাঝে আফরিনকে মনে পড়ার কারণ প্রভা পায় না। তবুও, বন্ধুটা হয়তো তার ভীষণ যত্নের, আকাঙ্ক্ষার, ভালোবাসার; একারণেই না চাইতেও স্নেহের প্রভাবে ভেসে উঠছে। প্রভার মনে পড়ে, সে এই টাকা বহু আদর মিশিয়ে নিজের শখের দায়ে জমালেও এখানে আফরিনের একটা নীরব ভাগ সে বহাল রেখেছে। সে মনে মনে ঠিক করেছিল এবারের জন্মদিনে মেয়েটাকে কাঠের বুকশেলফ উপহার দেবে। খুব ব্যয়বহুল আড়ম্বরপূর্ণ শেল্ফ হয়তো দেওয়া হবে না, তবুও দেবে। আফরিনের শেলফ এর বড় শখ হয়। নিজেদের আর্থিক অবস্থায় হয়তো পরিবারে জানাতে পারে না। তবুও প্রভাকে বেশ কয়েকবার কথায় কথায় জানিয়েছিল। প্রভা নিজের বন্ধুর জন্যে বিবেকের বিপরীতে গিয়ে সাত হাজার টাকা আলাদা জায়গায় রেখে দিল। চোখে ঝাপসা হয়ে ভাসল তাদের বন্ধুত্বের স্মৃতি। ভাসল সর্বদা তার পাশে থাকার মুহূর্ত। মেয়েটার জন্মদিন দূরে নেই। পাঁচ হাজারেই সম্ভবত শেলফ হয়ে যাবে। তবুও দু’হাজার এক্সট্রা রাখা। মন বলল, তার এই জমানো টাকাতে যদি আফরিনকে কিছু না দেওয়া হয়, তবে বড্ড অন্যায় হবে। টাকা সরিয়ে সাতচল্লিশ হাজার টাকায় প্রভা নির্নিমেষ চেয়ে রইল। আট হাজার বিকাশে আছে। সেখান থেকে তুলে নিলে পঞ্চাশ পূর্ণ হবে। কিন্তু…কিন্তু এতোকিছুর পরিবর্তেও তাওহীদের মুক্তি মিলবে তো? কই? কেউ তো ভরসা দিতে পারল না। তারা কী জানে না, এই মুহূর্তে প্রভার এক ফোঁটা ভরসার যে বড়ই অভাব?
_____
পরের সপ্তাহের কথা। প্রভা দেখা করতে না আসার দু’সপ্তাহ হয়। তবুও প্রভা আসে না নিজের স্বার্থে। যেদিন সে তাওহীদকে দেখে যায়, সেদিন কোনোরূপেই তার অস্থিরতা কাটে না। থেকে থেকে জমাট বাঁধে নিঃশ্বাস। মানুষের প্রতি তীব্র ঘৃণা বুক ঠিকরে বেরিয়ে আসে। অস্থির মনকে স্থিরতা দিতে আকাশপানে চাইলে, দু’চোখ ছেপে সৃষ্টিকর্তার জন্যে বেরোয় কেবল অভিযোগ আর অভিযোগ। সে অভিযোগ কোনোক্রমে আর বিরাম নিতে চায় না। এরপরে অনেকদিন যাবত না কাঁদা প্রভা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। সে জানে তার কান্না শোনার মতো কেউ নেই। তবুও কাঁদে। নিজের জন্যে কাঁদে। বুকে লুকোনো ব্যথা নিয়ে কাঁদে। ব্যথা তো আছে কিন্তু সারানোর পথ কই? এতো ব্যথা নিয়ে তো আর বাঁচা যায় না। তাই প্রভার আসাও হয় না। নিজের হৃদয়কে আশ্বস্ত করেছে প্রভা, সে কঠিন হৃদয়ের মেয়ে। তাওহীদকে না দেখে থাকা এমন কী ব্যাপার তার জন্যে?
হাসান এসেছে কিছুক্ষণ হলো। আজ বেশ কিছুদিন হয় হাসান নিজের সম্পর্কে দারুণ একটা ব্যাপার অনুধাবন করেছে। তার ধারণা ছিল, সে একজন কঠিন হৃদয়ের পুরুষ। অথচ যতবারই সে দেখা করতে আসে, ততবারই নরম আবেগে ভরে যায় তার চোখ। তাওহীদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরপরই ছেলেটা জানতে চাইল হাসানের মা-বাবার কথা, ব্যবসার কথা, শরীর-স্বাস্থ্যের কথা। অথচ এতে তীব্র লজ্জা আর বাবা-মায়ের করা কর্মের অনুতাপের দুঃখে মন ভার হলো হাসানের। যে ছেলেটা হাজতে থেকে তার বাবা-মার খবর নেয়, তার বাবা-মা কী পারতো না স্বাভাবিক জীবনে থেকে তাওহীদের একবার খোঁজ নিতে? কেন নেয় না? তাওহীদ তাদের কাছে এতো গুরুত্বহীন কেন? টাকা নেই বলে? ও গরীব বলে? টাকা-পয়সার উর্ধ্বে যে সম্পর্ক হয় – তা কবে বুঝবে তার বাবা-মা? হয়তো কোনোদিনো না। এই পৃথিবীতে অর্থকে সকল কিছুর উর্ধ্বে দেখা লোকের সংখ্যা অপ্রতুল। তারা তাদের গোটা জীবন এই এক ভুল বিশ্বাস আঁকড়ে বেঁচে থাকে। এতে না দেখা যায় তাদের মধ্যে অনুতাপ আর না কোনো আক্ষেপ। হয়তো তারাই ঠিক, হয়তো নয়; কে জানে! দু’জনের কথোপকথনের এক পর্যায়ে হাসান খানিকক্ষণ নীরব থেকে ডেকে উঠল ,
– তাওহীদ?
তাওহীদ মুখভর্তি হাসি হেসে বলল,
– হ্যাঁ, ভাই বলেন!
হাসান করুণ কণ্ঠে বলল,
– চাচি ফোন দেয় রে, তাওহীদ।
হাসান ভাইয়ের মুখে হঠাৎ মায়ের কথা হয়তো আশা করেনি তাওহীদ। তাওহীদ না মানলেও সত্য এই যে, সে সর্বদা চেষ্টা করে দুঃখ থেকে লুকোতে। বাস্তবতা থেকে পালাতে; তবুও কেমন করে যেন দুঃখগুলো তার সামনে এসেই হোঁচট খায়। উজ্জ্বল মুখের তাওহীদ আচম্বিত মায়ের কথা শুনে নিভে গেল। এতোক্ষণ যাবত যে প্রাণস্পর্শী হাসি ছিল, তা সরে গেল। হাসতে চাইল, তবুও সে হাসি কেমন যেন কৃত্রিম দেখাল। তাওহীদ বলল,
– ফোন দিলে কথা বলবেন ভাই। আর কী?
হাসান আশাহত কণ্ঠে বলল,
– তোরে চায়।
– বলবেন কাজে।
– লাভ হয় না রে।
তাওহীদ উদ্যমী কণ্ঠে বলল,
– লাভ হয়না মানে কী? বলবেন কাজে আছি। বলবেন ব্যবসা খুব ভালো যায়। আমার ফোন ধরার সময় নাই। হাবিজাবি বইলা বুঝাইয়া রাখবেন।
বলেই ফের হাসল তাওহীদ।
হাসান ঢোক গিলল। তাওহীদের ম্লান মুখের দিকে চেয়ে অসীম স্নেহের প্রভাবে বলার সাহস হলো না যে তাওহীদের মা কেবল ফোনই দেন না। ফোন করে বুক ভেঙে কাঁদেন। শ্বাস আটকানো গলায় কেবল তাওহীদকে খোঁজেন। মাতৃহৃদয়। বুঝবেই তো। নিশ্চিত বুঝেছে যে তার ছেলে ভালো নেই।
তাওহীদ শঙ্কিত গলায় নিভু আওয়াজে শুধাল,
– মা কী বেশি চিন্তা করে?
হাসান মিথ্যে হেসে না করে বসল। বলল,
– আরে নাহ। খালি তোর কথা জানতে চায়। চিন্তা করিস না। কথা কওয়াই দিমুনি। এখন একটা ফোন দেই খাঁড়া।
তখনি হুংকার ছেড়ে বসল জেলার,
– ফোনে কোনো কথা হবে না।
তাওহীদ তাকাল তার দিকে। ইনি বেশ ভয়ানক একজন মানুষ। চেহারায় দৈত্য দৈত্য ভাব। মুখের ভাবভঙ্গিতে তাওহীদ আগ বাড়িয়ে কখনো কথা বলে না। এখন, এই মুহূর্তে এমন আচরণের পরে আর অনুরোধের অর্থ হয় না। তাওহীদ নীরব কণ্ঠে হাসি মিশিয়ে বলল,
– ফোন দিয়েন না, হাসান ভাই। পরেই দিয়েন একেবারে। আম্মারে বইলেন আমি ভালো আছি। বইলেন নতুন চাকরি পাইসি। তাইলে বিশ্বাস যাইতে পারে।
হাসান শিশুভঙ্গিতে মাথা কাত করে বুঝাল, তাওহীদ যা বলেছে সে তাই বলবে। হাসান তাওহীদের মাথায় হাত রেখে বলল,
– আইজকা তাইলে জাইগা ভাই? সামনের সপ্তাহে না তোরে আদালতে নিব? একদম ভয় পাইস না। কেউ না আসলেও আমি আসুমু। ভাই তাইলে যাই?
তাওহীদ চেয়ে রইল হাসান ভাইয়ের দিকে। আদালতে কেউ না আসলেও সে আসবে – এই বাক্য নূন্যতম দশবার বলা তার হয়ে গেছে। আবারো বলল। তাওহীদ হাসানকে আশ্বস্ত করে হাসল। তাওহীদ মায়ার অতলে হারিয়ে যাওয়ার মতো হাসি হাসলেও তাতে প্রকাশিত হলো লুকোনো ব্যথা। সে অদেখা ব্যথায় কতোক্ষণ অনিমেষ চোখ বুলিয়ে চলে গেল হাসান। চলে গেল তাওহীদকে প্রতিবারের মতো অসহায়ত্বে ডুবিয়ে। তাওহীদকে দেখতে এসে যখন তারা ফিরে যায়, তাওহীদের বড় অসহায় মনে হয় নিজেকে। তীব্র অসহায়ত্বে কেঁদে ওঠে প্রাণ। হয়তো প্রাণে চায় তাদের সঙ্গে চলে যেতে। কিন্তু উপায় কই?
চলবে-
_____
#অকিঞ্চন
#শারমিন_ইরান
গল্প- অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – উনিশ (২য় অংশ)
_____
নিদারুণ আনুষ্ঠানিক এক পরিবেশ! সকল কিছু কেমন নীরব, নিঃস্তব্ধ। সবার মুখেই স্পষ্ট গাম্ভীর্য ভাব। কোথাও কোনো শোরগোল নেই, বিশৃঙ্খলা নেই। কেবল যান্ত্রিক এক নির্জনতা। এমন পরিবেশ যে সিনেমা ব্যতীত বাস্তবেও হয়, তা এখানে না দাঁড়ালে বোধহয় জানা হতো না তাওহীদের। না, হতো। হয়তো তাওহীদের হতো না। কিন্তু আইন সংক্রান্ত বিষয়ে যারা জড়িত, তাদের ঠিকই জানা হতো। সে তো আর এইসবের ধারকাছে কখনো ছিল না। জানবে কেমন করে? এমনতর মুহূর্ত যে জীবনে আসবে তা অলীক ভাবনাতেও কখনো আসে নি। তার ভুবন, তার ভাবনা বরাবরই একটা ক্ষুদ্র গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ। সেখানে এমন জটিল জীবনের জায়গা কই?
তাওহীদ মৃত দৃষ্টিতে একবার বিচারক এবং অদূরে বসে থাকা হাসানের দিকে তাকাল। আসামির জন্যে বরাদ্ধ স্থানে দাঁড়িয়ে হাসান ভাইয়ের চোখে চোখ রাখতে বড় লজ্জা হয়। তবুও রাখে; স্বজন বলতে তো ওই একজনই।
এতোক্ষণ বাদি-বিবাদি পক্ষের তুমুল বিতর্ক চলেছে। বিবাদি পক্ষ অর্থাৎ তাওহীদের পক্ষের উকিল বেশ ভালোই বলেছেন। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন তাওহীদকে সেফ জোনে রাখার। বোঝানোর চেষ্টা করেছে আসল ঘটনা’টি। ঘটনার স্রোত অনুকূলে পৌঁছেছে পর্যায়ে গেলেই বাদি পক্ষের উকিল জিগ্যেস করলেন,
– ইউর ওনার, আমি এই মুহূর্তে কিছু বলতে চাই।
বিচারকের ইতিবাচক হুকুমে তিনি বলতে শুরু করলেন,
– উনি প্রমাণ করতে চাইছেন যে সেখানে খুবই গর্হিত একটি কাজ হচ্ছিল। যাদের খুন করা হয়েছে সেই দু’জন সহ আরোও এক ভিক্টিম না-কি কাউকে ধর্ষণের চেষ্টা করছিল। সেই মুহুর্তে সেখানে আসামি তাওহীদ পৌঁছান এবং তাদের আটকান। আমার প্রশ্ন হলো, তবে যেই নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে সেই নারী কোথায়? তাকে এখানে আনা হোক। সাক্ষ্য দিক।
রাশেদ সাহেব বললেন,
– ইউর ওনার, মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা বিষয় আছে। যিনি ভিক্টিম তাকে হয়তো এই মুহূর্তে কেউ চেনে না। কিন্তু সে যদি আদালতে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দেন তবে আমাদের সমাজ তার ওপর কেমন ব্যবহার করবে তা নিশ্চয়ই আর বলতে বাকি রাখে না।
বাদি পক্ষ থেমে গেল না,
– আপনার কথা অনুযায়ী কিন্তু সেই নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে, করা হয় নি। তবে?
রাশেদ সাহেবকে দিশেহারা দেখাল। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন,
– ইটস হার পার্সোনাল ম্যাটার। তার আসতে বাঁধা না থাকলে আমি নিশ্চয় আনতাম, ইউর ওনার।
– ইউর ওনার, সে সাক্ষ্য প্রমাণ আনতে না পারলেও আমি এনেছি। তাকে ডাকার জন্য অনুমতি চাইছি।
আদালতের পরিবেশের মতো তাওহীদের ভেতরকার পরিবেশকেও আন্দোলিত, বাকহারা করে দিতে সাক্ষ্য দেওয়ার স্থানে এসে দাঁড়াল আরিফুল ভাই। এতো এতো মানুষের মাঝে আরিফুল ভাইকে খেয়াল করা হয়নি। তাওহীদের খেয়াল, অ-খেয়ালের মাঝেই তাওহীদ শুনল আরিফুল ভাই গড়গড় করে বলছেন ,
– আমার বাবার হার্টের রোগী। হঠাৎ করে বুক ব্যথা ওঠায় আমি বাইরে বেরোই। আমার এলাকার যে সোমেল আছে তা রাত নয়টা, দশটাতেই বন্ধ হয়ে যায়। আর সোমেল বন্ধ হলে এলাকাটা অতিরিক্ত নীরব হয়ে পড়ে। তখন আনুমানিক বাজে এগারোটা কি সাড়ে এগারোটা। আমি সেই রাস্তা দিয়া যাওয়ার সময়ে গোঙানির আওয়াজ পাই। সন্দেহ হলে সেদিকে যাইতেই দেখি তাওহীদ নামক মানুষটি দুইজনকে দাও দিয়ে কুপাচ্ছে। ভয়ে আমি দৌড়ে চলে আসি। এরপর আমি আর কিছু জানি না। তবে আমি নিজের চোখে দেখেছি এই ঘটনা।
– আপনার সঙ্গে আর কেউ ছিল?
– জ্বি, না।
তাওহীদ নির্বাক চোখে চেয়ে রইল। পলক ঝাপটে কেবল একটি কথাই ভাবল, আরিফুল ভাই তো সেখানে ছিল না। দেখেওনি। দেখলে নিশ্চয় এগিয়ে আসতো। ওই তিনজন পালিয়ে যাবার পরেও তো সে এলো না। না-কি এসেছিল? হয়তো সত্যিই এসেছিল। কেবল পেছন থেকে তার ক্ষিপ্র প্রহার দেখেছে। দেখে ভয়ে পালিয়ে গেছে। হতেই তো পারে। আরিফুল ভাই তার এলাকার ভাই। তাকে ভালো চেনে। একবার রাতে ঘরে তার মা-বোন একা ছিল। তার মায়ের হঠাৎ ব্যথায় বোন যখন দিশেহারা তখন তাওহীদকেই ফোন করেছিল আরিফুল। সে দূরে থাকায় সাহায্য চেয়েছিল তাওহীদের। আগ-পিছ না ভেবে রাত দেড়টার সময়ই বেরোতে হয়েছিল তাওহীদকে। যে ভাই তাকে এতো বিশ্বাস করে, স্নেহ করে, সে ভাই অযথা মিথ্যা কেন বলবে তার ব্যাপারে? তবুও কোথাও যেন কিছু ঠিক নেই। কিন্তু কী ঠিক নেই তা বুঝে ওঠা যাচ্ছে না। তাওহীদের বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে এলো মস্ত এক লম্বা শ্বাস।
_____
সোশ্যাল মিডিয়ায় মাঝে একটি লাইন বেশ ভাইরাল হয়েছিল। লাইনটি বোধহয় কিছুটা এমন – পরিবার এমন এক জায়গা যেখানে থাকা যায় না। সম্ভবত লাইনটি ছিল ভারতীয় কোনো চলচ্চিত্রের। যখন লাইনটি বেশ ভাইরাল হলো, তখনি কাউন্টার পোস্ট হিসেবে অনেকে লিখল – পরিবার এমন এক জায়গা যা ছাড়া থাকা যায় না। সেই লাইনটিও বলা যায় ট্রেন্ডে চলে এলো। পৃথিবী বাদ রেখে কেবল বাংলাদেশের কথা চিন্তা করলেই প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি মানুষ। দুটো বিপরীত লাইন সমান ভাইরাল হওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। এতোগুলো মানুষের কারো না কারো সাথে তো মিলেই যায়।
আজ প্রভা কোর্টে যেতে পারে নি। গতকাল থেকে তার বাসায় বিশাল এক ঝড় বয়ে গেছে। তার বাবা কবে না কবে তাকে থানা থেকে বেরুতে দেখেছে, সেই নিয়ে বড়সড় এক হাঙ্গামা বাঁধিয়ে দিয়েছেন। তাকে, মাকে অশ্রাব্য সব গালিতে ভরিয়ে তুলেছেন। ভাগ্য সহায় নিশী খালামনির বাড়িতে। মেয়েটা যেমন চঞ্চল তেমনি নাজুক। এমন সব পরিবেশ তার জন্যে নয়। চোটপাটের এক পর্যায়ে তার বাবা জানিয়েছেন এখন থেকে যখন-তখন সে বাইরে বেরুতে পারবে না।
বাবার পরে মাও তার ওপরে বেশ ক্ষিপ্র হলেন। এক দফা ফাঁকা শাসন করে বেরিয়ে গেলেন। পুরোটা সময় প্রভা চুপ করে রইল। তাদের মুখে মুখে তর্ক করতে ইচ্ছে হয় না। প্রভার বুঝ হবার পর থেকে তারা একাই চেঁচামেচি করেন। রাতের দিকে অবশ্য মা আবার এলেন। ঘরে এসে শান্ত ভঙ্গিতে বুঝালেন। সেই বুঝ প্রভার কানে ঢুকেছে কি-না বা সে গ্রাহ্য করেছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। কারণ কোনো কথাই তার মনে নেই। এরপর সকাল সকাল যখন সে বেরুতে গেল, দেখা গেল যে তার বাবা তার ঘর বাহির থেকে লক করে দিয়েছেন। আদেশ জারি করেছেন যেন কেবল সময় করে খাবার দেওয়া হয় তাকে। তাই হয়েছে আজ সমস্ত দিন। প্রভা মাঝেমধ্যে তার বাবা-মায়ের সাইকোলজি বুঝতে চেষ্টা করে। পেরে ওঠা হয় না। এই যে তার ওপর অর্থহীন নির্যাতন – এসবের কোনো মানে হয়? তার বাবা-মা কী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত?
প্রভা হাফ ছেড়ে বালিশ থেকে মাথা উঠাল। ঘরের বাতি নেভানো। চারিদিকে চোখ সয়ে যাওয়া আঁধার। বাইরের ঈষৎ হলদে আলোয় আঁধার তার রূপ পুরোপুরি দেখাতে পারে নি। জানালায় দাঁড়িয়ে বেখেয়ালেই চোখ গেল তাওহীদের বারান্দায়। তাওহীদের বারান্দা – হয়তো বলা চলে না। তবুও, দেড়/দুই মাস আগেও তাওহীদ এখানে দাঁড়াত। দাঁড়িয়ে তাকে দেখত। সে অসহ্য বিরক্ত হতো। ইচ্ছে হতো মুহূর্তেই তার চোখ দু’টো উপরে দিতে। তখন ঝোঁকের বশে কী অনায়াসেই না ভেবে ফেলা যেত অথচ এখন ভাবলেও হৃদযন্ত্র যেন নড়ে ওঠে। ওই টলটলে সুন্দর চোখ দু’টি সে কেমন করে উপরে দিতে চেয়েছে? একটুও কী মায়া হয়নি তার প্রাণে? আহা! কী সুন্দর দিন না কেটে গেছে। তার আর তাওহীদের মাঠে বসে বাদাম খাওয়া, অর্থহীন কথা বলা, প্রভার রাগ, তাওহীদের নীরবতা- অমূল্য সব স্মৃতি। ভেবেই মনের কোথাও একটা আঁচড় কেটে গেল যে, কতো সুদিন ভেসে গেছে অথচ সুদিনে থেকেই সে ‘সুদিন’ এর আশায় বুক বেঁধেছে। জীবনের এই পর্যায়ে এসে প্রভার মনে হলো, ‘সুদিন’ একটি অতিকথা ছাড়া আর কিছুই নয়। মরীচিকার নাম মাত্র। প্রকৃতঅর্থে, সুদিন বলে কিছুই হয় না। আমরা যে দিন পিছনে ফেলে আসি, তাই মূলত সুদিন।
বারান্দা ছেড়ে চোখ গিয়ে ঠেকল অদূর আঁধারে। সেথায় একগুচ্ছ গাছপালা বিহীন কিছুই চোখে পড়ছে না। জনশূন্য বলেই বুঝি এতো আঁধার। আঁধার প্রভার বড্ড প্রিয়। তার নিজ জীবন আঁধারে তলানো বলেই না-কি অন্য কারণে কে জানে! আচ্ছা, জেলে কী আজও লোডশেডিং হয়েছে? আজও কী অতল অন্ধকারে অস্থির হয়ে উঠছে তাওহীদের হৃদয়? কী হতো মানুষটার যদি ওমন দুর্বলতা না থাকতো? কী হতো সে মানসিকগত আরেকটু সবল হলে?মানসিক স্বাস্থ্য শারীরিক স্বাস্থ্যের চেয়ে অধিক সংবেদনশীল। মানসিকভাবে যে তাওহীদ কতোটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে তা আর কেউ না বুঝলেও প্রভা বেশ বুঝতে পারে। ভীষণ জেদ হলো প্রভার। তাওহীদ এমন কেন হলো? অন্যরকম কেন হলো না? এই যে তার মামলা আগা-গোড়া সম্পূর্ণই মিথ্যে – এ কী আদতেও সে বুঝে উঠেছে? প্রভা কোর্টে উপস্থিত না থাকলেও হাসানের থেকে ফোনকলে সব কিছু শোনা শেষ। আর সেই আরিফুল! সে অবশ্যই অবশ্যই একটি মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়েছে। নিশ্চয় মোটা অঙ্কের অর্থের ধাক্কা খেয়েছে! প্রভার খুব ইচ্ছে হলো সেই তিনজনের সামনে গিয়ে হাতজোড় করে বলে, আপনারা প্লিজ এইসব বন্ধ করুন। যার পিছনে লেগেছেন সে নিতান্তই সহজ সুন্দর একজন মানুষ। সে আপনাদের খেলা বুঝবে না। এই এতোটুকু জটিলতা তার মধ্যে নেই। সে হয়তো সময়ে দৃঢ় হতে পারে কিন্তু জটিল হতে জানে না। ওনার মতো তুচ্ছ একজন মানুষের পেছনে আপনারা এতো টাকা খরচ করবেন না। একটু রেহাই দিন। একটু বাঁচুক সে।
প্রভার চোখে জ্বলুনি হলো। এতোকিছুর পরেও সে সেদিনের রাত ভুলতে পারে না। নিজের গায়ের বিকৃত স্পর্শ ভুলতে পারে না। এইতো এখানে… এখানে..এখানে সবজায়গাতে হাতড়ে বেরিয়েছিল নোংরা হাত। কল্পনাতে এনে সাড়াও হলো না, ঘৃণায়, অপমানে ঝাড়া দিয়ে উঠল নিজের শরীর। এ যন্ত্রণা কী কভু তার পিছু ছাড়বে? বোধ হয় না। সারা জীবন তাকে ভীষণ যত্নে বয়ে বেড়াতে হবে কিছু কদর্য স্পর্শ।
_____
– হ্যালো, মা? কেমন আছোও তুমি?
– আব্বা? তাওহীদ আব্বা?
তাওহীদ শক্ত একটা ঢোক গিলে, বুক তীব্র হাহাকার-যন্ত্রণা নিয়ে বলল,
– হঁ, মা। আমি তাওহীদ।
ওপাশ থেকে তাওহীদের মা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। ফুঁপিয়ে ওঠে বললেন,
– বাবা, তোমারে কতোদিন ধইরা আমি খুঁজতাসি। ফোন দেও না ক্যা? মায়ের কথা মনে পড়ে না? মায়ের জন্য পরাণ পুড়ে না তোমার?
তাওহীদ চোখটা প্রসারিত করে অশ্রুগুলো শুষে নিতে চাইল চোখের মাঝে। হলো না। যতোটুকু শুষলো, তার চেয়ে দ্বিগুণ তীব্র অশ্রু ভেসে উঠল। বলল,
– মনে পড়ব না ক্যা? পড়ে তো, মা। কিন্তু এইখানে অনেক কাজের চাপ। এর জন্যে সময় কইরা ফোন দিতে পারি না। হাসান ভাই কয় নাই তোমারে?
তাওহীদের মা থামলেন না। উতলা হয়ে কাঁদলেন। সে কান্না এপাশ থেকে স্পষ্ট শুনতে পেল তাওহীদ। মায়ের এমন কান্নায় তার নিজের বুকের পাড়েও ভাঙন ধরল। তীব্র আওয়াজ তুলে ভেঙে পড়ল হৃদয়ের একেকটি অংশ। তার মা এভাবে কাঁদছেন কেন? তার মা তো ভীষণ নীরব একজন মানুষ। শ’ কথাতেও একটি উত্তর তার মুখ দিয়ে বেরোয় না। সেবার যে তাওহীদ গ্রামে গেল, তখনও তো মানুষটা সেভাবে কথা বললেন না। কেমন যান্ত্রিক ছিল তার আচারণ! তবে আজ কেন এমন করে কাঁদছে?
ওপাশ থেকে মা বললেন,
– হাসান ভালো না, বাজান। তোমারে চাইলে দেয় না। আমি কতো খুঁজি তোমারে! কতোদিন ফুন দিলাম! একবারো দেয় নাই তোমারে।
তাওহীদ সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
– কতোদিন ফোন দিসো আম্মা?
বলেই হাসানের দিকে চাইল তাওহীদ। হাসান ঢোক গিলল। তাওহীদ জেলে আসার পরদিন থেকেই ফোন দিচ্ছে তাওহীদের মা। তবে সেদিন এ কথা বলার সাহস হাসানের হয় নি। কম তো হলো না, দু’মাস ধরে ছেলের খোঁজে মরিয়া, আর না পেরে আজ কথা বলিয়েই ক্ষান্ত হলো হাসান।
তাওহীদের মা বলল,
– মেলা দিন দিসি। একদিনোও তোমারে দেয় নাই। তুমি কবে আইবা, বাবা আমার?
তাওহীদ কম্পিত কণ্ঠে বলল,
– এখন তো আসতে পারুমুই না। পরে আসুমু, মা।
নাছোড়বান্দার মতো ছেলেমানুষী জেদে মা বললেন,
– না, আব্বা। তাড়াতাড়ি আসো। কাম বেশি হইলে হাসান রে একটু কইয়া আসো। একটাদিনের লিগা আসো বাবা। একবার দেখুমু খালি তুমারে। চোখ ভইরা দেখুমু। দেখা হইলেও যাইয়োগা তুমি। আইসো আব্বা?
চক্ষু জল ছেড়ে দিল তাওহীদ। বলল,
– আসুমু, আম্মা।
– কবে আইবা?
– আসুমু। তাড়াতাড়িই আসুমু।
– কী খাইবা বাবা? কী রাঁন্ধুমু তোমার জন্য?
– ভাত খামু আম্মা। আমাগো ক্ষেত থিকা শাক তুইলো। আর তেলাপিয়া মাছ ভাঁজি কইরো। আইসা আমি পেট ভইরা ভাত খামু।
– তোমার শরীলডা ভালো, আব্বা?
তাওহীদ উত্তর না দিয়ে কথা ঘুরিয়ে বলল,
– আইজকা রাখি, মা? কামের চাপ অনেক। দোকানে মানুষ আসতাসে।
মা আবারো জানতে চাইলেন,
– তোমার শরীলডা ভালো?
– হ, আম্মা। ভালো। রাখি?
– আইচ্ছা। শুনো আব্বা… ম্যাছের কাঠি, মোমবাতি সাথে রাইখো। কোনোহানে আন্ধার দেখলেই জ্বালাই রাখবা। ভয় পাইয়ো না, বাবা। সাহস রাখবা বুক…
– রাখলাম আম্মা।
বলেই কান থেকে নামিয়ে ফোন কেটে ফেলল তাওহীদ। দু’চোখের বড় বড় অশ্রুফোঁটায় বেশ লজ্জা হলো। সামনে দু’দুজন মানুষ রেখে এভাবে কাঁদা ঠিক হলো না। কাঁদতে হয় নীরবে, আড়ালে। তাওহীদ কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাজতের কোণায় চলে গেল। কোণ ঘেষে বসে দু’হাঁটুতে মুখ আড়াল করে নিল। কেবল মুখ আড়াল করতেই মনে হলো তার অযুতদিকে কেউ নেই, কেউ তাকে দেখবে না। তার কান্না শুনবে না। হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেলল তাওহীদ। এতোক্ষণের জমাটবদ্ধ শ্বাস বেরিয়ে এলো কান্না হয়ে। সময় ভুলে, পরিবেশ ভুলে, দুনিয়া ভুলে কাঁদল তাওহীদ। বুক উজাড় করে কাঁদল। সে কান্নাধ্বনি আছড়ে আছড়ে পড়ল চার দেয়ালে। তার জীবন তো এমন হবার কথা ছিল না, তার জীবন তো এতো জটিল হবার কথা ছিল না। তবুও কেন হলো? কেন? সৃষ্টিকর্তা কী জানেন না তাওহীদ কেমন? তবুও কেন তিনি এমন করলেন?
তাওহীদের বুক ভাঙা ধ্বনির বিপরীতে হাসানও আর কিছু বলতে চাইল না। বাহুতে চোখ মুছে বেরিয়ে যেতে গিয়েও গুরুজন চেহারার জেলারের দিকে তাকিয়ে বলল,
– ধন্যবাদ আপেনেরে।
চলে তো গেল হাসান। কিন্তু তার দেখা হলো না জেলারের চক্ষুকোণের ক্ষুদ্র জলটুকু। ভীষণ যত্নে লুকোনো জলটুকু বুড়ো আঙুলে মুছে ফেললেন জেলার।
_____
নিজের হাতের ছেঁড়া নোটের দিকে একভাবে চেয়ে আছে তাওহীদ। হাতের এক অংশ লেখা ‘সুপ্রভার দেও’ আরেক অংশে লেখা ‘য়া প্রথম উপহার’। নোট টা সে বরাবরের মতো নিজের পকেটে নিয়েই ঘুরেছে। তাই যেদিন তাকে আটক করা হলো সেদিনও তাকে সঙ্গ দিতে এই নোটটা সাথে এলো। এতোদিন বেশ যত্ন করে রাখলেও আজ দু’দিন যাবত আর রাখা গেল না। গোসলের সময় বেখেয়ালিতে ভিজে গেল নোটটা। ধরার সঙ্গে সঙ্গেই ভাগ হয়ে চলে এলো হাতে। তাওহীদ বেশ মনোযোগী হয়ে দুটো অংশ একসাথ করে তার পাশে রেখে দিল। বাইরে থাকলে জোড়া লাগানো যেত। এখানে উপায় নেই। সেদিকে একাগ্রচিত্তে বেশ খানিকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইল তাওহীদ। ভাঁটা পড়ল বাইরের শোরগোলে। তাওহীদ মাথা উঁচিয়ে চাইতেই দেখল এক দল পুলিশ ছুট লাগাচ্ছে। মিছিলের মতো যাওয়া-আসা করছে। তাওহীদ উঠে দাঁড়িয়ে হাজতের সামনে গেল। অচেনা একজন জেলার। তাকে আগে দেখে নি তাওহীদ। তবুও জিগ্যেস করল,
– বাইরে এতো চেঁচামেচি কীসের?
লোকটি নিজেও আগ্রহী কণ্ঠে বলল,
– বুঝতে পারছি না। জানলে আপনাকে জানাব।
তাওহীদ আর গেল না। দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। গারদ গলিয়ে বাহিরদৃশ্য দেখার বৃথা চেষ্টায় পড়ে রইল। তারও কিছুক্ষণ পর তাওহীদের দেখা দৈত্য দৈত্য চেহারার কনস্টেবল এলো। জেলার লোকটিই প্রথমে জানতে চাইলেন,
– জানেন কী হইসে?
দৈত্য লোকটির মুখে হাসির আবহ। বললেন,
– আজকে এক আসামির ফাঁসির ডেট ছিল। ফাঁসির সময়ে গলা ছিঁড়ে গেসে অর্ধেক। তাই ওইদিকে ওইখানে যাইতেসে সবাই।
জেলার লোকটি আশ্চর্যের সঙ্গে যে ভীত হলেন , তা তার চেহারার ভঙ্গিতেই বোঝা গেল। আতঙ্কিত কণ্ঠে বললেন,
– কী বলেন এইসব!
– হু।
অস্ফুটে আওয়াজ করে মুখে কিছু চিবুতে আরম্ভ করলেন তিনি। জেলার লোক ভীত কণ্ঠে বলল,
– গলা ছিঁড়বে কেন? এমন তো কখনো শুনি নি।
– এখন শুইনা নেন।
বলেই কিছুক্ষণ পর ভাবুক দৃষ্টিতে বলল,
– সম্ভবত দড়িতে মোম ডলা হয় নাই। মোম ডললেও কম ডলসে। ফাঁকিবাজি হইসে। ওই রশির ধকেই গলা ছিঁড়ে আসছে।
জেলার ভীত নয়নে চেয়ে রইলেন। আর তাওহীদ চেয়ে রইল জড়বস্তুর মতো। সম্পূর্ণ ঘটনাটি গ্রহণ করতে বেশ কষ্ট করতে হলো তাকে। সারা শরীর ঝিঁ ঝিঁ করে উঠল। বুকের ভেতর চাপা পড়ল বিশাল বড় কোনো পাথর। তাওহীদ ঢোক গিলে কোণার কাসার গ্লাস হাতে তুলে নিল। ঢকঢক করে ফাঁকা করল সম্পূর্ণ গ্লাস। ভেতরটা থমথমে হয়ে আছে। পানি খেয়েও বিশেষ লাভ হলো না। শুকিয়ে গেল মরুভূমির মতো। চোখ বুজে নিজেকে আশ্বস্ত করতে চাইলেও ব্যর্থ হয় তাওহীদ। ভাবনা ফেরাতে মনে পড়ে সুপ্রভার কথা। হাসান ভাই তখন তাকে একটা কাগজ দিয়ে গেছিল। সুপ্রভার দেওয়া। মেয়েটা আসে না কত্তোদিন হলো! তাওহীদের দৃষ্টি যে তাকে দেখার অভাবে শুকিয়ে গেছে, তা কী সে জানে না? তাওহীদ কাগজ বের করে হাতের মুঠোয় নিল। বেশ ছোটখাটো একটি কাগজ। খুলতেই চোখে পড়ল কেবল একটি লাইন,
‘ আমাদের হবে মেঘের ওপর মাটির বাসা।’
তাওহীদের চোখে আরোও আটকাল বেশ খানিকটা নিচে বসা সরল একটি প্রশ্ন, ‘ হবে না তাওহীদ?’
চলবে-
_____
গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – উনিশ (তৃতীয় অংশ)
_____
তাওহীদকে ফাঁসিতে চরানো মাত্র তার গলা ছিঁড়ে মাটিতে গড়িয়ে গেল। সেই দৃশ্যে হেঁসে উঠল উপস্থিত সকলে। ঘন আঁধার বেলাতে সকলের হাসিতে ঝড়ে পড়ল নিদারুণ হিংস্রতা। কী আশ্চর্যজনক দৃশ্য! আশ্চর্যজনক অনুভূতি! তাওহীদ বিস্মিত হলো তার মাথা এভাবে পড়ে যাওয়াতে। আচ্ছা, সে বিস্মিত হওয়ার সুযোগ পেল কেমন করে? সে কী তবে মারা গিয়েও অনুভূতি সম্পন্ন?
বেশ খানিকক্ষণ পর অন্ধকার গাঢ় হয়। মিলিয়ে যায় দৈত্যধারী মানুষেরা। দেখা মেলে মায়ের। মা কাতর চোখে চেয়ে আছেন তাওহীদের পানে। তাওহীদের ঘাড়ে মাথা না থাকলেও মাকে দেখতে একদমই ভুল হয় না তার। তার মা আটপৌরে, সস্তা, ম্লান একটা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে আছেন। দু’চোখে উপচে’ পড়া অসহায়ত্ব। বুকের ধনকে বুকে আগলে নেওয়ার কাতরতা। তাওহীদকে দেখা মাত্রই করুণ কণ্ঠে বলে উঠল,
– আব্বা, তোমার মাথা কাটসে কেমনে? তোমার ঘাড়ে মাথা নাই ক্যা? ক্যারা আলাদা করসে আমার মানিকের মাথা? ব্যথা করেনাই তুমার?
এরপরই মা তাওহীদের মা তুলে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন। তাওহীদের দেহের সামনে মাথা বুকে জড়িয়ে হুঁহুঁ করে কাঁদলেন। ছিঁড়ে যাওয়া মাথার মুখমণ্ডল মুছিয়ে দেলেন পরম মমতায়।
এরপর কেমন কেমন করে যেন হারিয়ে গেলেন তিনি। মায়াজাদুর ন্যায় মিশে গেলেন সেই ঘন গুচ্ছ আঁধারে। হঠাৎ সেই বিভীষিকাময় স্থানে দেখা মিলল সুপ্রভার। সুপ্রভা কঠিন মুখে তাওহীদের মাথা তুলে তাওহীদের কাঁধে বসিয়ে দিলেন। গম্ভীরমুখে বলল,
– দেখেছেন কী কাণ্ড! ফাঁসি দিবে দিক। এভাবে গলা ছিঁড়ে দেওয়ার মানে কী? আপনার কী কষ্ট হচ্ছে তাওহীদ?
গলা ছেঁড়া অর্ধ-দেহের তাওহীদ সকল কিছুই বুঝল, শুনল, অনুভব করল। কী আশ্চর্য! তাওহীদ বলল,
– আমার খুব ভয় করতেসে, সুপ্রভা। আপনি আমারে এইখান থেকে নিয়া চলেন।
সুপ্রভা হাসল। বলল,
– আপনি এমন ভীতু কেন?
তাওহীদ আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল,
– আমার গলা থেকে আর রক্ত পড়তেসে সুপ্রভা। আমারে ডাক্তারখানায় নিয়ে চলেন।
– কই? রক্ত পড়ছে না তো, তাওহীদ। আমি যে দেখতে পাচ্ছি না।
– কেন? গলা ছিঁড়ে গেল আর রক্ত পড়ব না কেন?
– অনেকক্ষণ যাবত রক্ত পড়ে পড়ে আপনার রক্ত শেষ।
– এই যে আমার গলা ছিঁড়ে গেল, এখন আমি বাঁচুমু কেমন করে?
প্রভা গালে হাত দিয়ে নরম কণ্ঠে জানতে চাইল,
– তাওহীদ! বাঁচতে খুব ইচ্ছে করে?
তাওহীদের কাটা মাথা নড়ে ওঠে। প্রভা বলে,
– ঠিকাছে। আপনার মাথা আমি সেলাই করে দিচ্ছি। দেখবেন আপনি আবার বেঁচে উঠবেন।
প্রভা সুঁই-সুতো গাঁথে। প্রকাণ্ড এক সুঁই এগিয়ে ধরে তাওহীদের কণ্ঠদেশে। গলায় সেলাই করবে নিজ হাতে। বাঁচিয়ে তুলবে তাওহীদকে।
সুঁই এই যন্ত্রণা তাওহীদের অনুভব হয় না, তবুও হৃদপিণ্ডের ভয়াবহ কাঁপনে ভেঙে যায় তার ঘুম। চোখে মেলে চারিপাশের ঘুটঘুটে আঁধারে আরেক দফা শিউরে ওঠে তাওহীদ। কম্পিত হাতজোড় নিজ গলাতে স্পর্শ করতে নিজেই শঙ্কিত বোধ করে। অবোধের মতো কণ্ঠদেশে আঙুল দ্বারা আশ্বস্ত হতে হাত চালায়। সত্য সত্য সেলাই নেই তো? মুখ মুছতে গিয়ে ভেজা মুখের স্পর্শে তাওহীদের চেতনা ফেরে। হুড়মুড় করে উঠে বসে। দু’তিনবার গোসল সেড়ে ওঠা ঘামে ভেজা মুখটা হাত দিয়েই মোছার চেষ্টা করে। হাজতের বাইরের হলদে নরম আলোয় নির্নিমেষ চেয়ে রয়। বুকের ভেতর জলশুন্য থমথমে পরিবেশ। অস্থিরতার ছড়াছড়ি। বুক যন্ত্রের শব্দ সুস্পষ্ট কানে অনুরণিত হচ্ছে। যেন বুক ভেঙে বেরিয়ে পড়বে। তাওহীদ ঢোক গেলে। চারিপাশে তার প্রতি কেমন এক নীরব উপেক্ষার গন্ধ। ঘন আঁধারের চোখের ভাষায় প্রহসন। তাওহীদ মাথা ঝুঁকিয়ে নেয়। এমন দৃশ্য তার দেখতে ইচ্ছে হয় না। সে যেমনই হোক, যাই করুক। তার প্রতি সৃষ্টি সকলের এই অবমাননা সে সাদরে নিতে পারছে না। এতোদিন হয়তো নিয়েছে, তবে আজ হচ্ছে না। বুকের কোথাও তীব্র জ্বলুনি হচ্ছে। সেই জ্বলুনি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে তার পুরো সত্তায়। তাওহীদ নিঃস্ব চোখে চারিপাশে চাইল। তার স্বস্তির কী কোনো উপায় নেই? কোনো মাধ্যম নেই? কেউ কেন তাকে বুঝছে না, বুঝতে চেষ্টা করছে না। হৃদয়ের তীব্র দহনে দেয়ালে মাথা হেলিয়ে বসে রইল তাওহীদ।
_____
– তাওহীদের ব্যপারে সব মিথ্যা কাগজ বানানো শেষ, মিস প্রভা। আমি গত এক সপ্তাহ লাগাইয়া এইসব কাজ করলাম। এখন পালা আবেদনের।
প্রভা বিরস মুখে বলল,
– ধন্যবাদ। সত্য, মিথ্যা যেকোনো উপায়ে আমি তাওহীদের জামিন চাই। সত্যের কোনো পথ খোলা না পেলে মিথ্যাই আমার জন্য সমাধান। আপনি এতো কষ্ট করে কাজ করেছেন এজন্য আমি অবশ্যই আপনাকে এক্সট্রা পে করব।
– কষ্ট বেশি করা লাগে নাই। ডাক্তার বন্ধু আছে, কাজ হইয়া গেছে। কাগজে লেখা আসামির হার্টে ছিদ্র, রক্তনালি অচল। রিপোর্ট দিসি ২০১৭ সালের। অর্থাৎ ১৭ তে ধরা পড়সে রোগ। আর লাস্ট চিকিৎসা ২২ এ।
প্রভা চিন্তিত মুখে টেবিলে ভর দিয়ে বলল,
– আপনি শিওর এতে কাজ হবে?
– হইবে না মানে! হার্টে ছিদ্র আপনি কম কিছু মনে করেন? এই অসুখে মানুষ মারা পর্যন্ত যায়।
প্রভা অনুভূতিশুন্য চোখে চেয়ে রইল টেবিলের পাটাতনে।
রাশেদ সাহেব বললেন,
– পরের মাসে কিন্তু দ্বিতীয় শুনানি।
প্রভা যন্ত্রের মতো বলল,
– মনে আছে। আপনার এখন প্রথম কাজ এই চিকিৎসার কাগজপাতি দিয়ে সাময়িক জামিন নেওয়া। এরপরে দ্বিতীয় কাজ তারা দু’জন যে মারা যায় নি তার তথ্যপ্রমাণ নেওয়া।
রাশেদ সাহেব চিন্তিত হয়ে বলল,
– দ্বিতীয় কামে ভেজাল আছে। দুইজনে যে মরসে তার সকল কাগজপাতি মানে ডেথ সার্টিফিকেট জমা করা শেষ।
– মিথ্যা। এই কাগজগুলা যেমন মিথ্যা, ওইগুলাও মিথ্যা। সার্টিফিকেট কেবল দেখানোর জন্যে। আর যে দু’জন মারা গেসে বলে বলা হচ্ছে তারা কোনো সাধারণ মানুষ না। রাজনীতির সাথে যুক্ত। ওই এলাকাতেই তারা থাকে। এলাকার মানুষ মরবে আর এলাকাতে কথা উঠবে না? এতো সহজ সবকিছু?
রাশেদ সাহেব এক দৃষ্টিতে তার সামনের রমণীকে দেখলেন। বলল,
– বুঝা সহজ হইলেও প্রমাণ করা কঠিন।
প্রভা চোখ বুজে মুহূর্তেই এক দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। বলল,
– দেখুন, আপনি কেবল জামিনের দিকে নজর দিন। বাকিটা আমিই সামলে নিব। আর দ্বিতীয় দফার শুনানিতে যাকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে সে হাজির হয়ে যাবে।
রাশেদ সাহেব ভ্রু কুঁচকে বলল,
– আপনি না বলসিলেন সে সাক্ষী দিতে পারব না? এখন আবার অন্য কথা বলেন কীসের জন্য? প্রথমেই যদি তারে আনতেন তাও তো প্রথম দিনে ব্যাপারটা আমার হাতে থাকতো।
প্রভা নড়বড়ে কণ্ঠে বলল,
– এতোকিছু মাথায় ছিল না। দুঃখিত তার জন্য। তবে দ্বিতীয় দিন তাকে নিয়ে আমি অবশ্যই হাজির হবো। আপনি প্লিজ বাকি দিকটা দেখেন।
রাশেদ সাহেবের চেহারার পরিবর্তন হলো না। থমথমে, ভাবুক, অস্থির চেহারায় তিনি কিছু ভাবতে বসলেন।
_____
আফরিনের বিছানায় পড়ে আছে প্রভা। আফরিন পাশে বসেই হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাথায়। সব শুনে কিছুটা ভীত হলো আফরিন। বলল,
– তোর কী মনে হয় প্রভা, মিথ্যা কাগজে জামিন হয়ে যাবে?
ঠায় শুয়ে থেকে প্রভা জবাব দিল,
– মিথ্যা অভিযোগে হাজতে যেতে পারলে, মিথ্যা কাগজে জামিনও হবে।
আফরিন গোল গোল চোখে বলল,
– পুরো ব্যাপারটা কিন্তু বেশ ভয়ংকর হবে রে প্রভা।
প্রভা মলিন হাসে। আফরিন সংবেদনশীল মানুষ। তার থেকে এমন প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। উলটো তারই তো ভয়ংকরের থেকেও বেশি কিছু মনে হয়েছিল প্রথমে। তবে দু’মাস বাদে এসে এসব জেল-হাজত তার জন্য পান্তা-ভাতের মতো সাধারণ হয়ে এসেছে। মনে হয় যেন, দৈনিক হাজতে যাওয়া আসা খুবই নিত্তনৈমিত্তিক কোনো ঘটনা।
আফরিন কৌতূহলী হয়ে শুধাল,
– এই যে উকিলটা এতোসব করল, এখানে কতো নেবে সে? নিশ্চয় আগের চেয়েও বেশি নেবে?
– পরে কতো নেবে জানি না। শুরুতে নেবে পঞ্চাশ হাজার।
আফরিন জানে এমনই পরিমাণ হবে। তবুও শুনতে যেন বেশিই শুনাল। বিস্মিত হয়ে বলল,
– পঞ্চাশ! এতো টাকা দিবি তুই প্রভা?
আফরিনের থেকে এমন প্রশ্নে আহত হলো প্রভা। উঠে বসে সপ্রশ্ন চোখে তাকাল আফরিনের দিকে,
– কেন দিতে পারি না, আফরিন?
আফরিন প্রভার এমন প্রশ্নে চোখ নামিয়ে নেয়। নিজের স্থান থেকে কিছু বলতে উদ্যত হয়। বোঝাতে চায় প্রভাকে,
– প্রভা ভেবে দেখ…
আফরিনের কথা শোনে না প্রভা। তার আগে নিজেই বলতে আরম্ভ করে,
– জীবনের অনেক দাম প্রভা। এই মুহুর্তে আমার জন্যে তাওহীদের জীবনের থেকে দামী কিছু নেই। তুই ভেবে দেখ, তাওহীদকে যদি আমি হারিয়ে ফেলি। ওর যদি কিছু হয়ে যায়….তবে তবে হাজার টাকা দিয়েও আমি তাকে ফিরে পাব না। পৃথিবীর সব অর্থ একত্রিত করলেও কেউ আমায় তাওহীদ দিতে পারবে না। না এখন পারবে না হাজার বছর পরে পারবে। কক্ষনো পারবে না। তুই বুঝছিস আফরিন উনি কতো দামী? ওনার জীবন কতো দামী?
আফরিন প্রভার প্রশ্নের জবাব দেয় না। ভাবুক চোখে চেয়ে থাকে দূরে কোথাও। প্রভা আবারো বলে,
– আগেও তুই এমন বলেছিস। আজও বলছিস। আর কখনো বলিস না, বন্ধু। কেমন? এসব শুনতে আমার ইচ্ছে হয় না। মন খারাপ হয়। সবাই তো এমন বলে। তুই বলিস না।
আফরিন প্রভার দিকে তাকাল। চোখে, মুখে সে কী অসহায়ত্ব! আফরিন ভেবে পেল না, কিছুদিনের পরিচিত একটা মানুষের জন্যে, এতো অসহায়ত্ব কেমন করে আসে! তবুও কিছু বলল না আফরিন। পাছে তার বন্ধুকে যদি আবার আঘাত করে বসে। কেবল বিস্মিত চোখে দেখে গেল তার একগুঁয়ে, একরোখা, গম্ভীর বন্ধুটিকে।
আফরিনের বিস্ময়কে আরোও একটু বাড়িয়ে দিতে প্রভা ঢলে পড়ল বিছানায়। আফরিন কেবল শুনতে পেল ক্লান্তিতে ডুবো শ্রান্ত কণ্ঠ ছাপিয়ে বেরুনো দু’টো বাক্য,
– আমি তাকে ভালোবাসি, আফরিন। আমি তাকে আমার উর্ধ্বে গিয়ে ভালোবাসি। জগত-সংসার এর সবকিছুর বিনিময়ে আমি তাকে চাই।
আফরিনের চোখে এবার বিস্ময়ের বদলে ধরা দিল দরদ। সেই দরদে ছলছল করে উঠল তার চক্ষু দু’টি। আবারো শুনতে পেল প্রভার নিস্তেজ স্বর,
– তাওহীদ! আমি আপনাকে ভালোবাসি তাওহীদ।
_____
ডাল-রুটি বেশ আয়েশ করে খাচ্ছে তাওহীদ। স্বাদ অতো ভালো নয়। তবে পেটের ক্ষুধাতে এখন আর ভালো-খারাপ বোধ আসে না। খাবার হলেই চলে। তবে এখন আবার আরেক অসুবিধে। খেতে বসলে খাবারগুলো গলায় আটকে থাকে। পানি দিয়েও সে খাবার গেলা যায় না। গেলার পরেও বেশ ব্যথা হয় গলায়। খাবারের দোষ নেই নিঃসন্দেহে। কিন্তু দোষটা যে কোথায় তা তাওহীদের বুঝে ওঠা হয় না। হতে পারে খাবারে, হতে পারে তাওহীদে। কে জানে! তাওহীদের বড়ো মন খারাপ হলো। আজ কেন যেন খাবারে এতোটুকু স্বাদ মিলছে না। মনে হচ্ছে, কেউ যেন সকল স্বাদ যন্ত্র দিয়ে শুষে নিয়েছে। খাবার ছেড়ে তাওহীদ পানি খেল। তাতেও তেমন কাজ হলো না। তীব্র তিক্ত স্বাদে গুলিয়ে উঠলো শরীর। জ্বর আসবে সম্ভবত। খাবার কোনায় রেখে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। এই এতোবড় দুনিয়াতে এই মুহূর্তে তার জন্য কেবল এই একটা দেওয়ালই আছে। যাকে সম্বল করে বসা যায়। মন খারাপে দেওয়াল ঘেষে শুয়ে থাকা যায়।
তাওহীদ পড়ে রইল নীরবে। বুকের ভেতর খা খা করে উঠল অশেষ পিপাসায়। খুব করে মনে চাইল, নিজের গ্রামে ফিরে যেতে। খুব করে মনে চাইল, সবুজ কোনো জঙ্গলে হারিয়ে যেতে। খুব করে মনে চাইল, একটু অন্তর ভরিয়ে সজীব শ্বাস নিতে। ভেতরের ক্ষতটা সারিয়ে তুলতে। তবে, এসব কী সম্ভব? শ্বাস তো এখানেও নেওয়া হয়। কিন্তু এই শ্বাসে বুক ভরে ওঠে বিষাক্ত বাতাসে। তাজা হয়ে যায় ভেতরকার দগদগে ঘা। আজকাল এখানে মনটা আর বসে না। কোনোমতেই নিজেকে শান্ত করা যায় না। হাজারো প্রবোধ, হাজারো আশ্বাস ফিঁকে পড়ে যায় তার দুর্বল হৃদয়ে। এই দুনিয়া, দুনিয়ার প্রতিটি মানুষের প্রতি উগরে পড়ে তার সকল অভিযোগ। একেকটা আঁধার রাতে তীব্র অসহায়ত্বে ফুঁপিয়ে ওঠে তাওহীদ। উদ্ভ্রান্তের মতো লোহার শিক ধরে টানাটানি করে। যদি খুলে! যদি বেরিয়ে পড়া যায়! অশান্ত প্রাণ খুঁজে বেড়ায় এক ফোঁটা স্থিরতার জল। দেয় না; কেউ তাকে দেয় না।
তাওহীদ পাশ তাকাল। অজ্ঞাত একটি লোক ঘুমিয়ে আছে পরম শান্তিতে। লোকটি তার সঙ্গী হিসেবে এসেছে সপ্তাহ দু’য়েক হয়। এসে থেকেই সে এমন করে ঘুমোয়। তার ঘুম দেখে তাওহীদের মন বলে, না জানি কতো নির্ঘুম রাত কাটিয়ে এখন শান্তি পেয়েছে লোকটা। তাওহীদ চায়, লোকটির মতো করে ঘুমোতে। পারে না। সে আসলে কিছুই পারে না। সকল কিছুতে বেশ সুন্দর করে হেরে বসে থাকে। তাওহীদ নিচে শুয়ে পড়ল। শরীরের অসহ্য তাপ টের পাওয়া যাচ্ছে। মাথার যন্ত্রণা, চোখের জ্বলুনি ছাপিয়ে হৃদয়ের যন্ত্রণায় অধিক জর্জরিত হলো তার শরীর। দু’চোখের তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা পেরিয়ে বেরিয়ে এলো দু’ফোঁটা উত্তপ্ত অশ্রুজল। সে কী তবে চেতনা হারিয়ে ফেলছে?
~চলবে
_____
#অকিঞ্চন
#শারমিন_ইরান