গল্প #জুলিয়েট
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
১৪.
দখিনের জানালা খুলে রাখা হয়েছে।সেখান থেকে সাঁ সাঁ করে ঠান্ডা বাতাস ভেতরে প্রবেশ করছে।ঘরের অবস্থা এখন শান্ত।শোহরাব তার একটা হাত পাঞ্জাবির পকেটে গুজে সামনে দেখে বলল,’মিস! আপনি কি রেডি হবেন না?’
রূপসা বারান্দার পাশে দাঁড়ানো ছিল।মুখে কোনো বিকার নাই।অনুভূতি শূন্য চাহনি।শোহরাবের ডাকে একটুখানি সম্বিত ফিরে পেল।চোখ তুলে সোজাসুজি তার দিকে তাকালো।বলল,’আমার কোনো কাপড় নাই।আমি তো আর সাধ করে বিয়ে করি নি।বিয়ের আগে জানতাম না এমন টেনে হিঁচড়ে বিয়ে হবে।তাই কাপড় আনিনি সাথে।’
শোহরাব দুই ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো।আস্তে করে বলল,’সানজানা কে দিয়ে কাল তোমার কাছে কাপড় পাঠিয়েছিলাম।তুমি নাও নি কেন?’
‘তোর দেওয়া কাপড় পরার কোনো শখ আমার নাই।’
শোহরাব উত্তর দিলো না।ড্রেসিং টেবিলের সামনে থাকা হাত ঘড়িটা হাতে তুলে ব্যস্ত গলায় বলল,’তুমি তাহলে রেডি?’
চুলগুলো বড্ড এলোমেলো হয়েছিল রূপসার।চিরুনি ছাড়াই একহাতে টেনে টেনে যা একটু গুছিয়ে নিল।তারপর বলল,’হ্যাঁ।চলুন।’
শোহরাব চোখ বাঁকা করে তার মুখের দিকে তাকায়।একবার তুমি,আবার একটু পরেই আপনি,ব্যাপারটা ঠিক জমছে না।দু’টোর মাঝামাঝি তুমি বললেই ব্যাপারটা মিটে যেত।কিন্তু ম্যাডাম কি এই আবদার শুনবে?
জোহরা ব্যস্ত পায়ে ঘরে এলেন।রূপসা তাকে দেখেই সোজা হয়ে দাঁড়ালো।এই পুরো বাড়িটা রূপসার কাছে অসহ্য।কিন্তু এসবের মাঝে জোহরা কে তার সহনীয় মনে হয়।এই ভদ্রমহিলা বেশ স্নিগ্ধ।তার মুখে সরলতা আছে।সেই সরলতায় রূপসা বার বার আটকায়।
জোহরা তাকে আগাগোড়া দেখে অবাক হয়ে বললেন,’সেকি রূপসা! এই জামা পরে বাবার বাড়ি যাবে?’
রূপসা হতবুদ্ধি হলো।চোখ বড় বড় করে বলল,’জ্বী?’
‘বিয়ের পর প্রথম বাবার বাড়ি যাচ্ছো।সুন্দর একটা শাড়ি পরে যাবে না?’
রূপসা কঠোর হতে গিয়েই হতে পারল না।ঐ যে।জোহরার প্রতি তার কিঞ্চিৎ দুর্বলতা আছে।সে কেবল মাথা নেড়ে বলল,’জ্বী না আন্টি।এটাই ঠিক আছে।’
‘না ঠিক নেই।আমার ছেলের বউকে আমি এমন করে ছাড়বো না।তুমি একটা সুন্দর শাড়ি পরো রূপসা।’
জোহরা একটু তেজ দেখিয়েই কথাটা বললেন।দেখা গেল তার মুখে সামান্য কঠোরতা ফুটে উঠেছে।তার দিকে চোখ পড়তেই রূপসার মনে হলো তিনি অধিকার বোধ থেকেই এক প্রকার হুকুমের সুরে কথাটা বলেছেন।
এই সংসারের বন্ধন রূপসাকে টানে না।সমাজ,সমাজের নিয়মনীতি কিছুই তাকে টানে না।শ্বাশুড়ির সাথে বেয়াদবি করলে লোকে খারাপ বলবে,এই চিন্তাও তাকে ভীত করে না।কিন্তু জোহরার প্রতি যেই সম্মান সে অনুভব করে,সেটা অন্তর্নিহিত।জোহরার মুখে একটা চিরায়ত বাঙালি মায়ের ছাপ আছে।জনাব রাজিবের একমাত্র কন্যা রূপসা সেই মায়াবি মুখেই আটকায়।
জোহরা বললেন,’শোহু! ঘরের বাইরে যা।আমি রূপসা কে শাড়ি পরাবো।’
শোহরাব গোল গোল চোখে মায়ের দিকে তাকায়।ইশারায় বোঝায়,সত্যিই কি সে শাড়ি পরবে?জোহরা কেবল আস্তে করে তাকে আশ্বস্ত করলেন।শোহরাব আর কথা বাড়ালো না।বড় বড় পদক্ষেপ ফেলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
জোহরা দরজা বন্ধ করে রূপসার মুখোমুখি দাঁড়ালেন।ডাকলেন,’রূপসা।তুমি টুকটুকে লাল শাড়ি পরবে?লাল শাড়িতে তোমাকে দেখার আমার খুব শখ।’
রূপসা বিতৃষ্ণা দেখিয়ে বলল,’আন্টি! শাড়িটা না পরলে হয় না?’
‘সে কেমন কথা রূপসা?তুমি এমন করে বাবার বাড়ি যাবে?’
রূপসা ক্লান্তির শ্বাস ছাড়লো।উত্তর দিতে গিয়েও সেটা নিজের ভেতর চেপে নিল।তারপর বিষন্ন কন্ঠে ধিমি আওয়াজে কেবল বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।’
লাল রঙের শাড়িটা গায়ে জড়ানো মাত্র রূপসার লাবণ্য তরতর করে বেড়ে গেল।হতে পারে জোহরার চোখের ভুল,তবে টুকটুকে লাল শাড়িতে সামনে দাঁড়ানো মেয়ে মানুষটিকে বড্ড লাস্যময়ী মনে হলো তার।কি সুন্দর চোখ,কি স্নিগ্ধ মুখ! শাড়ি পরানো মাত্র মনে হলো তার নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে।যদিও বা তাকে পুরোপুরি সুখী মনে হচ্ছিল না।কারণ তার মুখে বিষাদের ছাপ লেপ্টে ছিলো।জোহরা একটা হাত তার থুতনিতে রাখলেন।
মেয়েটা বোধহয় তার ইশারা বুঝলো।তিনি মুখ খোলার আগেই সে আনত স্বরে বিড়বিড় করল,’দয়া করে এই বিয়ে মেনে নিতে বলবেন না আমায়।এতে আপনার প্রতি আমার সম্মান কমবে।এই বিয়ে আমি মেনে নিতে পারবো না।’
___
শোহরাব ঘরে এসেছিল আরো আধঘন্টা পরে।মা যখন খুব সুন্দর করে রূপসাকে সাজানো শেষ করেছিল,তখন।ঘরে পা রেখেই তার কদম থমকালো।শোহরাব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গোল গোল চোখে সামনে তাকালো।
রূপসা নির্বিকার হয়ে মূর্তির ন্যায় কক্ষের এক কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলো।চোখে ভয়াবহ বিতৃষ্ণা।দৃষ্টিতে কেমন যেন অনিহা।শোহরাব ঘরে আসতেই তার মুখজুড়ে বিরক্তির রেখা ছেঁয়ে গেল।সেই বিরক্তিভাব শোহরাবের চোখ এড়ায়নি।তবুও সে ড্যাব ড্যাব চোখে মেয়েটাকে দেখে গেল।কি সুন্দর করে মা তাকে শাড়ি পরিয়েছে!
ফিলোসোফি ‘প্রেম’ জিনিসটাকে অদ্ভুত ভাবে ব্যাখ্যা করে।প্রেম ধরা ছোঁয়ার বাইরে একটা বিশেষ অনুভূতি।মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায় প্রেম একটা রোগ।এই চোখের উপসর্গ হলো চিনচিন বুকে ব্যাথা,নিশ্বাসের গতি বাড়া,কখনো আবার নিশ্বাস থেমে যাওয়া।শোহরাব প্রেমে পড়েনি।অথচ নিজের বিয়ে করা বউকে দেখে অদ্ভুতভাবে উপসর্গ গুলো তার ভেতর দেখা দিলো।সেই রোগের অস্তিত্ব টের পেয়ে শোহরাব নিজেও চমকালো।দ্রুত মাথা নেড়ে সবটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বলল,’চলুন মিস।গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে ইয়ার্ডে।লেইট হচ্ছি আমরা।’
____
সুবাস মিত্র লেনের সবচেয়ে পেছনের গলিতে শোহরাবদের গাড়িটা এসে থামলো বেলা বারোটা নাগাদ।
ভর দুপুর।মাথার উপর উত্তপ্ত সূর্যকিরণ।গাড়ি থেকে নামতেই চোখ কুঁচকায় শোহরাব।তারপর গলার কাছে ঝুলানো সানগ্লাসটা চোখে পরে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে।এখন ভালো লাগছে।
সে পেছন ফিরলো।রোদ চশমার আড়ালে থাকা চোখ দু’টো দিয়ে গাড়ি থেকে হন্তদন্ত হয়ে নামা তরুণীর মুখটা দেখলো।রূপসা শাড়ির কুচি সামলে খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে গাড়ি থেকে নামলো।নামার পরেই আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না।আনাড়ি হাতে আটটা কুচি খাঁমচে ধরে সামনের দিকে পা বাড়ালো।এটাকে অবশ্য পা বাড়ালো না বলে ছুটে গেল বললে বেশি সমীচীন হবে।কারণ সে সত্যিই দিগবিদিক ভুলে নিজের ছোট্ট বাড়িটার দিকে ছুটে গিয়েছিলো।পেছন ফিরে শোহরাব কে দেখার কিংবা তাকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানানোর প্রয়োজন বোধ করলো না।শোহরাব কে?রূপসার হৃদয়ে কোনো কালেই তার স্থান ছিলো না।
বাড়ির সামনে গিয়েই রূপসার পদযুগল থমকে গেল।বাড়ির সবুজ রঙের সরু গেইটে জং ধরা লোহার তালা ঝুলছিলো।রূপসা কপালে ভাঁজ ফেলে সেই তালার দিকে তাকালো।তারপর হাত বাড়িয়ে সেটা স্পর্শ করলো।এই সময়ে বাড়িতে তালা কেন?
পাশ দিয়ে দু’জন লোক হেঁটে গেল।যেতে যেতে রূপসাকে এক নজর দেখলো,কিন্তু কিছু বলল না।রূপসা সেদিকে তাকাতেই তার মনে হলো তাদের দৃষ্টি অন্যরকম।তাচ্ছিল্য আর ঘৃণা মেশানো দৃষ্টি যেমন হয়,অনেক টা এমন।
রূপসা কয়েক সেকেন্ড ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।মস্তিষ্ক ভোঁতা হয়ে গেছে।অবশেষে একটু রয়ে সয়ে সে পাশের দোকানের লোকটাকে জিজ্ঞেস করল,’রফিক চাচা! গেইটে তালা কেন?তারা সবাই কোথায়?’
রফিকের দৃষ্টিও সেই আগের লোকদের মতোই।তিরষ্কার,ভৎসনা আর বিতৃষ্ণা মাখানো।রূপসার নিজেকে নোংরা মনে হলো।কেন যে সময়ে সময়ে বুকের ব্যাথাটাও প্রকট হলো।
রফিক ভূঁইয়া গলা খাকারি দিয়ে বললেন,’পালায় যাওয়ার সময় মনে থাকেনি এই কথা?এখন আসছে সবার খোঁজ নিতে!’
রূপসার কন্ঠরোধ হয়ে এলো।মনে হলো গলার কাছটায় ধাঁরালো কিছু বিঁধেছে।ঢোক গেলা যাচ্ছিল না।পালিয়ে গেল মানে?সে পালায়নি।সে কেন পালাবে?সে তো কাউকে ভালোবাসে না।তবে মিছেমিছি পালাবে কেন?
‘আমি পালাইনি।’
মৃদুস্বরের অস্ফুট আওয়াজ রফিক সাহেবের কানে যায়নি।কাজেই তার বিদ্রুপের দৃষ্টি তখনও রূপসার উপরই পড়েছিল।নার্গিস এসেছিলেন কাপড় কাচার সাবান কিনতে।রূপসার দিকে চোখ পড়তেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন।কন্ঠে বিস্ময় উপচে দিয়ে বললেন,’রূপসা! তুমি এসেছো!! জানো কাল বাড়িতে কি হয়েছে?’
শোহরাব এসে দাঁড়িয়েছিল তার পেছনে।নার্গিসের কথার প্রেক্ষিতে সে নিজেও কৌতূহলী হলো।কেমন যেন বিস্ময় কাজ করলো ভেতরে।সে খুব আগ্রহ নিয়ে নার্গিসের জবাবের অপেক্ষা করলো।অথচ নার্গিসের জবাব পেতেই তার মুখটা রীতিমতো ফ্যাকাশে হয়ে উঠল।
নার্গিস বললেন,’কাল তোর শ্বশুড় বাড়িতে এলো।তারপর কি যেন বলে গেল।রাতের ভেতরই তোর বাবা হার্ট অ্যাটাক করলেন।কিছুদিন আগেই তো ওপেন হার্ট সার্জারি করল।এখন আবার হার্ট অ্যাটাক।রূপম দেখলাম কাঁদতে কাঁদতে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলল।’
শোহরাবের পুরো পৃথিবী চক্কর খেয়ে গেল।সত্যিকার অর্থেই মাথা ঘুরালো।মনে হলো সে যা শুনলো পুরোটাই মিথ্যা,অবাস্তব।এমন কি কখনো হয় নাকি?’
‘রূপসা! এই রূপসা! কি হয়েছে?’
শোহরাবের ধ্যান ভাঙলো।সম্বিৎ ফিরতেই দেখলো রূপসা মাটিতে বসা।নার্গিস তার কাঁধে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছে।রূপসা কি সে কথা শুনতে পারছে?
শোহরাব নিজেও দু’পায়ের উপর ভর দিয়ে মাটিতে বসলো।কাঁপা হাতে রূপসার কাঁধ স্পর্শ করে জানতে চাইলো,’মিস!তুমি কি শুনছো?রূপসা?’
রূপসা হয়তো শুনেছে,হয়তো শুনেনি।চোখ দু’টো দেখে মনের অবস্থার কিছুই আঁচ করা গেল না।শোহরাব শুধু দেখলো,মেয়েটা অল্প অল্প করে মাটির দিকে হেলে পড়ছে।পুরোপুরি পড়ার আগেই শোহরাব হতচকিত হয়ে একহাতে খপ করে তাকে ধরে নিল।
রূপসা কিছু বললো না।এই প্রথম শোহরাবের স্পর্শে সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।সে জ্ঞান হারায়নি।তবে সে স্বাভাবিকও ছিলো না।এই জটিল অবস্থা কে কি বলে,শোহরাব জানে না।
__________________________________________
রূপসা আর শোহরাবের সম্পর্ক আগে থেকেই জটিল ছিলো।সেখানে সরল সাধারণ কিছুই ছিলো না।অথচ সেদিন শোহরাবের মনে হলো পৃথিবী ইচ্ছে করে তাদের সম্পর্কটা জটিলতায় ভরিয়ে দিচ্ছে।না মানে জিনিস গুলো এর চেয়ে সহজভাবে হলেও তো পারতো।এমন কিছু কেন ঘটলো?শোহরাব এসব চায়নি।এমন জানলে কোনোদিন রূপসাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিতো না সে।
রূপসাদের বাড়ির সামনে থেকে তারা দু’জন গাড়িতে করে হাসপাতালে এসেছে।রূপসা কেমন এলোমেলো হয়ে বসেছিল।শোহরাবের সাথে যেতে চাইছিলো না।শোহরাবই এক প্রকার জোর করে তাকে গাড়িতে তুলেছে।রূপসা শুধু পুরোটা সময়ে একটা কথা বলেছিল।চোখের পানি এক টানে মুছে হেঁচকি তোলা স্বরে বলল,’তোর জন্য সবকিছু গেছে।আমি আর পারছি না।আর না।’
তারা হাসপাতাল এলো।আর তারপর শোহরাবকে আরেকদফা হতবাক করে দিয়ে ডাক্তার জানালেন রাজিব সাহেব আর বেঁচে নেই।তিনি আজ ভোরেই পরলোকগমন করেছেন।এরপর?এরপের স্মৃতি আরো বেশি জঘন্য।
|
|
~~~~
|
|
শাহাবুদ্দীন আহমেদ একটা ঢোক গিলে গলা ভেজালেন।রূপসা তখন নির্বিকার হয়ে বসা।তার চোখে মুখে কোনো বিশেষ অনুভূতির ছাপ নেই।একটু আগে ভেজা ছিলো,এখন কটকটে শুকনো।
শাহাবুদ্দীন বলল,’তার মানে আপনার বাবার সাথে আপনারও আর দেখা হয় নি?’
রূপসা ঠোঁট উল্টে জবাব দিলো,’দেখা কেন হবে না?আমি দেখেছি তো।দেখেছি,কথা বলেছি,বাবার বুকে মাথা রেখেছি।বাবা অভিমান করেছে তো।তাই জবাব দেই নি।দেখা কেন হবে না?’
শাহাবুদ্দীন সাহেব মাথা নাড়লেন।গাঢ় স্বরে বললেন,’জ্বী রূপসা।বুঝতে পারছি।’
রূপসা কাঁপা হাতে পানির গ্লাসটা হাতে তুলল।শাহাবুদ্দীন লক্ষ্য করলেন তার দৃষ্টির অস্থিরতা।কথা বলার সময় সে চোখের দিকে পুরোপুরি তাকাতে পারে না বেশিক্ষণ।তার কপালের চিকন ঘাম,কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া,চোখের পাতা পর পর ফেলা,সবকিছুই শাহাবুদ্দীন কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো,রূপসা পোস্ট ট্রমাটিক ডিজঅর্ডারে ভুগছে।তিনি আর কোনো প্রশ্ন করলেন না।কারণ তার ধারণা,রূপসার গল্প সে নিজেই শেষ করবে।
রূপসা চোখ তুলল না।নখ দিয়ে ডেস্ক খোঁচাতে খোঁচাতে নিভু স্বরে বলল,’আমরা হসপিটাল গিয়েই শুনলাম বাবা আর নেই।এই কথা কি বিশ্বাস যোগ্য বলেন?সেদিনই তো বাবার অপারেশন হলো।তারপর ধীরে ধীরে হাঁটাচলা করছিলো।এখন নাকি বাবা আর নাই।আমি তো এই কথা বিশ্বাস করি নি।পাগলের মতো ছুটে ছুটে আইসিইউ এর সামনে গিয়েছি।রূপম ছিলো সেদিকে।ছেলেটা লম্বা সময় কান্না ধরে রেখেছিল।আমাকে দেখতেই কেমন ঠোঁট ভেঙে দিলো।মনি ছিলো একদম বিধ্বস্ত।আমার আসাতে সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাই নি।কাছে যাওয়াতে তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল,’এতো বড় বাড়ির বউ তুমি! আমাদের মতো মধ্যবিত্ত বাড়ির লোকদের কাছে আসলে কেন?
আমি সেদিন ভীষণ চমকেছিলাম।মনি এসব কি বলছে?আমি আমার বাবার কাছে আসবো না?
পরে বুঝেছিলাম,মনি আমার উপর অভিমান করেছিলো।মনি তো আর জানতো না যে আমি কোন পরিস্থিতির ভেতরে বিয়েটা করেছিলাম।’
রূপসা থামলো।দম ফেলল।খুব বেশি ঠান্ডা গলায় বলল,’শোহরাবের বাবা এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে।যেদিন বসার ঘরে আমি তার মুখের উপর জবাব দিয়েছিলাম,সেদিন রাতেই তিনি আমাদের বাড়িতে গেলেন।বাবাকে কথা শোনানোর জন্য।তিনি এমনই জঘন্য ভাবে তাকে আঘাত করলেন,যে আমার বাবা সেটা সহ্য না করতে পেরে হার্ট অ্যাটাক করলেন।’
|
|
~~~~~~~
|
|
রূপসা হাসপাতালের একটা চেয়ারে বসেছিল।রূপম বসেছিল মেঝেতে,তার দিদিয়ার পায়ের কাছে।তার চোখে পানি।জেসমিন নির্বিকার।তিনি অন্য পাশের বেঞ্চে বসে আনমনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিলেন।একটু পরেই লাশ তাদের হাতে হস্তান্তর করা হবে।আজ আসরের পর তার জানাযা।
রূপসার চোখ দু’টো ঈষৎ ফোলা।কিছুক্ষণ আগে কেঁদেছিলো।এখন আর কাঁদছে না।শোহরাব অপরাধীর ন্যায় হেঁটে তার সামনে গেল।রূপসা তখনো তাকে দেখেনি।অথবা দেখলেও ইচ্ছে করে তাকায়নি।
শোহরাব হাঁটু মুড়ে বসলো।অত্যন্ত চাপা স্বরে ডাকলো,’রূপসা! শুনছো?’
রূপসা শুনে নি।রূপম বোনের হাত ছেড়ে একটু দূরে সরে এলো।শোহরাব আরেকদফা ডাকলো,’রূপসা! শুনছো?’
এইবার রূপসা তাকালো।তার চাহনি দেখেই শোহরাবের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা তরল নেমে এলো।সে অপেক্ষা করলো রূপসার প্রতিক্রিয়ার,তার কিছু বলার।
রূপসার প্রতিক্রিয়া টা ছিলো ভিন্ন।শোহরাবের দিকে তাকাতেই তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে উঠল।দিনের পর দিন রাগের স্তর জমতে জমতে ভেতরটা বোধহয় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।আচমকাই ভরা হাসপাতালে সশব্দে একটা চড় পড়ল শোহরাবের গালে।
চড়টা রূপসাই মেরেছে।একবার না।দুইবার।তারপর দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’অমানুষের বাচ্চা! তোর বাপ গিয়েছিল আমাদের বাড়িতে।তারপর আমার বাবাকে খুব সম্মান করেছে।অমানুষ কোথাকার!’
শোহরাব গালে একটা হাত ছোঁয়ালো।কন্ঠনালিতে কিছু একটা আটকে ছিলো।সেটা সে উগলে দিলো না।ভেতরেই চেপে গেল।রূপসা দুই হাতে মাথার চুল টেনে ধরে বলল,’আমি কি ক্ষতি করেছি আপনাদের?আপনারা বাবা ছেলে মিলে কিসের প্রতিশোধ নিলেন আমার থেকে?আপনার বাবা এই কাজ কেন করলো?তার কি ক্ষতি করেছি আমি?এই জোরজবরদস্তির বিয়েতে আমার দোষ কোথায়?’
শোহরাব আগের মতোই বসে থাকলো।রূপসা তার সামনে দুই হাত জোড় করে বলল,’আমার একটা সাহায্য করবেন?জানি,আপনি এসবের ধার ধারেন না।তবুও অনুরোধ করছি,প্লিজ এখান থেকে যান।আমার অসহ্য লাগছে আপনাকে।একটু করুণা করুন।আমি হাত জোড় করছি।যান,প্লিজ।’
শোহরাব উঠে দাঁড়ালো।ফিচেল হেসে বলল,’আচ্ছা।যাচ্ছি।’
‘ধন্যবাদ।’
মুখে সেই হাসি ধুরে রেখেই শোহরাব ঘুরে দাঁড়ালো।কয়েক কদম সামনে যেতেই রূপসা বলল,’আর কখনো আসবেন না।’
শোহরাব থামলো।শেষবারের মতো একবার পেছনে ফিরে তারপর হনহনিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেল।আপাতত বাবার সাথে কিছু কথা বলা জরুরি।এরপর রূপসার কথা ভাবা যাবে।
চলবে-